সংবাদ শিরোনা
গেল সপ্তাহে টিআইবির একটি প্রতিবেদন
নিয়ে সারা দেশ জুড়ে বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল নবম
পার্লামেন্টের সংসদ সদস্যদের শতকরা ৯৭ ভাগ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।
নেতিবাচক কর্মকাণ্ড হিসেবে টিআইবি বোঝাতে চেয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
প্রভাব বিস্তার, ক্রয় সংক্রান্ত কাজে হস্তক্ষেপ, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন
ইত্যাদি। মোট ১৪৯ জন এমপির উপর গবেষণা চালানো হয়, যাদের মাঝে ২৭ জন
মন্ত্রীও আছেন। বাংলাদেশ তো বটেই, বাংলাদেশের বাইরেও টিআইবির একটি
গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেই টিআইবির রিপোর্টে যখন মন্ত্রী তথা সরকারি দলের
এমপিদের নেতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরে, তখন বুঝতে হবে দেশে সুশাসনের বড় অভাব।
দেশটি ঠিকমত চলছে না। টিআইবির রিপোর্টে অতিরঞ্জিত করে কিছু বলা হয়নি। যা
সত্য, গবেষণায় সেই সত্যটিই বেড়িয়ে এসেছে। সংবাদপত্রগুলোই এর সাক্ষী।
প্রতিদিন সংবাদপত্রে সরকারি দলের যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর ছাপা হচ্ছে,
তার পেছনে রয়েছে সরকারি দলের এমপিরা। টিআইবি তাদের রিপোর্টে ১৩৬ জন এমপির
কর্মকাণ্ড উল্লেখ করেছে। আমার ধারণা আওয়ামী লীগের মোট ২৩১ জন এমপির
ব্যাপারে যদি গবেষণা চালানো হত, একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যেত। সরকারি দলের
ভাগ্য ভালো, টিআইবি তাদের নির্বাচিত সব সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে অনুসন্ধান
চালায়নি।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি কিংবা
ডেসটিনির ঘটনা, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘লুটপাট’ হয়েছে, সেখানে
টিআইবির প্রতিবেদনে তার যে প্রতিফলন ঘটবে, সেটাই স্বাভাবিক। শেয়ারবাজার
থেকে শুরু করে ডেসটিনি প্রতিটির সাথে ক্ষমতাসীন দলের ঊর্ধ্বতন নেতা তথা
ঊর্ধ্বতন সমর্থকরা জড়িত। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে অভিযোগ উঠেছে একজন উপদেষ্টার
বিরুদ্ধে। দুদক তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। ডেসটিনির অর্থ আত্মসাতের ঘটনায়
জড়িত ছিলেন একজন ঊর্ধ্বতন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, যিনি আওয়ামী লীগের
রাজনীতির সাথে জড়িত। সোনালী ব্যাংকের পাশাপাশি আরো কয়েকটি ব্যাংকও অর্থ
কেলেঙ্কারিতে জড়িত। এটা তো স্পষ্ট উপর মহলের সাথে যোগসাজশ না থাকলে এটা
সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বিষয়টি আগেই ধরা পড়ে এবং বাংলাদেশ
ব্যাংকের উপদেশ কেন ‘উপেক্ষিত’ হলো, তা জানা প্রয়োজন। দুদক বিষয়টি তদন্ত
করছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সাবেক কর্মকর্তাদেরও
তারা তলব করেছিল। কিন্তু আদৌ কী কোনো ‘ফল’ তাতে পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত
ব্যক্তি এখনও দিব্যি ‘ঘুরে’ বেড়াচ্ছেন। তারা কেন গ্রেফতার হননি, তার কোনো
ব্যাখ্যা নেই। ব্যাংক চিঠি লিখে জানিয়েছিল পনের দিনের মধ্যে ঋণের অর্ধেক এক
হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা ফেরত দেয়ার। ওই টাকা হলমার্ক দেয়নি। নানা ছলাকলার
আশ্রয় নিচ্ছে। রাষ্ট্র কী এত দুর্বল যে, হলমার্ক থেকে টাকা উদ্ধার করতে
পারবে না? অভিযুক্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তিদের বাইরে রেখে ‘তদন্ত’ কাজ করলে,
তাতে কী ‘তদন্ত’ কাজে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে না? কোনো সভ্য দেশে
এটা সম্ভব নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা, এ টাকা জনগণের। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে
এ টাকা তারা আত্মসাৎ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যদিও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন,
কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমছে। একটি
চক্র বাংলাদেশ ব্যাংক তথা গভর্নরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটি অসাধু
চক্র সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে ‘ম্যানেজ’ করে হাতিয়ে নিয়েছিল
কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর আগে শেয়ারবাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ‘লুট’
হয়েছে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ রিপোর্টে এ ব্যাপারে দোষী ব্যক্তিদের
চিহ্নিত করলেও ‘অদৃশ্য শক্তি’র বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক
ক্রিমিনালরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের নির্লিপ্ততা জনমনে সরকার সম্পর্কে
মিশ্র ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। হলমার্কের ঘটনার যদি ‘বিচার’ না হয়, যদি
আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধার না হয়, তাহলে মানুষ পুরো ব্যাংক ব্যবস্থার উপর
আস্থা হারিয়ে ফেলবে। সংবাদপত্রে এমন খবরও ছাপা হয়েছে যে, হলমার্ক
কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সদ্য ওএসডিতে যাওয়া ডিএমডি মো. মইনুল হক ছিলেন
ট্রুথ কমিশনে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ (আমার দেশ, ১৩ সেপ্টেম্বর)।
আত্মস্বীকৃত এই দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করে হলমার্কের সাথে অবৈধ
সম্পর্ক রেখে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই-এর
সভাপতি তাই দাবি জানিয়েছিলেন অভিযুক্তদের গ্রেফতারের। সেটা করা হয়নি। এতেই
প্রমাণ হয়, হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট রয়েছে। এ ধারণা
আরো বদ্ধমূল হয় যখন জানা যায়, গেল বছর বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি লিখিতভাবে
অর্থমন্ত্রীকে জানালেও অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা
নেননি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায়দায়িত্ব মুহিত সাহেব এড়াতে পারেন না। পদ্মা
সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট
হয়েছে। এখন এর সাথে যোগ হলো হলমার্কের ঘটনা।আরো একটি সমস্যা সরকারের ভাবমূর্তি ুণœ করেছেÑ আর তা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিশেষ করে সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারা না হওয়া। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড বিভক্ত সাংবাদিক সমাজকে একত্রিত করেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছেন বারবার। সাংবাদিক সমাজে যারা সরকারের ‘বন্ধু’ বলে পরিচিত ছিলেন এই হত্যাকাণ্ডে তারাও আজ সরকারের পাশে নেই। সাংবাদিক সমাজ একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত খুনীদের খুঁজে বের করার। কিন্তু নয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ব্যর্থ। সর্বশেষ পরাগ অপহরণ ঘটনায় জড়িয়ে গেছে যুবলীগের এক কর্মকর্তা। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বটে। কিন্তু উদ্ধার হয়নি ৫০ লাখ টাকা। আজ পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে পুলিশ তথা র্যাবের কার্যক্রম থাকা সত্ত্বেও ‘মুক্তিপণ’ এর মতো ঘটনা ঘটেছে। যা আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। অভিভাবকদের মধ্যে তাদের সন্তানদের জন্য একটা দুশ্চিন্তা থাকবেই। পুলিশ বিরোধী দলকে হেনস্তা আর লাঠিপেটা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু ছিনতাইকারী, অপহরণকারীকে গ্রেফতার করতে পারছে না এবং এই প্রবণতা রোধ করতেও পারছে না। শিশু পরাগ অপহরণের ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা কত অসহায়। আরো দুঃখজনক খবর হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তা বন্ধেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
আগামী কয়েকটি মাস সরকারের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। একদিকে বিরোধী দলের সাথে রাজনৈতিক ‘দ্বন্দ্ব’ আরো তীব্র হচ্ছে, অন্যদিকে একাধিক ঘটনায় সরকারের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হচ্ছে। প্রথম ঘটনায় সরকার রেলের ভাড়া অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। সাধারণ মানুষ রেলে চলাফেরা করে। ভাড়া কম থাকায় রেল যাত্রা তারা পছন্দ করে। ভাড়া বৃদ্ধি মানেই হচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর আঘাত আসা। আমরা ভারতের উদাহরণ দেখাতে পারি। সাধারণত খুব কম ক্ষেত্রেই রেলের ভাড়া সেখানে বাড়ানো হয়। ভাড়া বাড়িয়ে কোনো দলই জনপ্রিয়তা হারাতে চায় না। তৃণমূলের রেলমন্ত্রী ভাড়া বৃদ্ধি করেছিলেন দলের সিদ্ধান্ত না নিয়ে। ফলে মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। নয়া রেলমন্ত্রী বিষয়টি বোঝেন কী না জানি না। কিন্তু রেলের ভাড়া বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা। মানুষ খুশি হবে না এই সিদ্ধান্তে। আমলাদের দ্বারা প্রণীত সিদ্ধান্ত যদি জনপ্রতিনিধিরা কোনো কিছু না বুঝেই গ্রহণ করেন, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দ্বিতীয় ঘটনা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। যেখানে বিদ্যুতের চুরি রোধ করার কোনো উদ্যোগ নেই, সেখানে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সরকার কী লাভবান হবে? এতে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিদ্যুৎ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা থাকলেও, তিনি মূলত আমলা, জনগণের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার প্রধানকে তিনি সঠিক উপদেশটি দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না।
পদ্মা সেতু, হলমার্ক, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, রেলের ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি একটি ঘটনাও সরকারের পক্ষে যায়নি। এমনিতেই কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটা নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পর বিরোধী এক অবস্থান গ্রহণ করেছে। সংবিধান, নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয়টি মুখ্য, সেখানে সরকারের এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। এমনি এক পরিস্থিতিতে আসলো টিআইবির রিপোর্টটি। সরকারের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে এর পেছনে সত্যতা আছে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, তারা টিআইবির সদর দফতরে নালিশ জানাবেন। এতে করে কী ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ সংসদ সদস্যদের তাদের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা যাবে? আমার তা মনে হয় না। বরং তারা উৎসাহিত হতে পারেন। বরং সরকার যদি বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করে এবং টিআইবি যেসব সুপারাশি করেছে তা যদি অনুসরণ করে,আমার ধারণা এতে করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি ঘটবে। মনে রাখতে হবে টিআইবি’র এই রিপোর্ট এখন আন্তর্জাতিকভাবে ‘রেফার’ করা হবে। এটা সরকার নয়, রাষ্ট্রের জন্যও অমঙ্গল। আমরা এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে চাই। আর তার পথ একটাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে আসা। এটা সবার জন্যই মঙ্গল।
0 comments:
Post a Comment