রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনীতিতে জয় ও রাজনীতির উত্তরাধিকার

শেষ পর্যন্ত কি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সক্রিয় রাজনীতিতে এলেন? এ মুহূর্তে তিনি সস্ত্রীক দেশে। দাদাবাড়ি পীরগঞ্জে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন মা ও বিদেশিনী স্ত্রী। তাঁর একটি বক্তব্য- 'মুই ফিরি আসিম', অনেক প্রশ্নের জবাব হয়তো আমাদের দেবে আগামী দিনে। এর আগে ঢাকায় যুবলীগের এক ইফতার পার্টিতে তিনি বলেছিলেন, তাঁর কাছে খবর আছে, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। তাঁর ওই বক্তব্যে রাজনীতি মহলে তোলপাড় কম হয়নি। খোদ এই নিউ ইয়র্ক শহরেও একদিকে বাঙালিরা যেমনি তাঁর রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ যে তিনি কী করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে। এটা রাজনৈতিক বক্তব্য। আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের মতো তিনিও বক্তব্য রেখেছেন। রংপুরে একটি জনসভায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বক্তব্যও দিয়েছেন। এর অর্থ কি দাঁড়াল এই যে প্রধানমন্ত্রীই তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ঠিক করে দিলেন! জয়কে তিনি তৈরি করছেন!
সজীব ওয়াজেদ জয়ের রক্তে রয়েছে রাজনীতি। তিনি রাজনীতিতে আসবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ দেশের আরেক পরিবার, জিয়া পরিবারের সন্তান তারেক রহমানের রাজনীতিতে অভিষেক হয়েছে অনেক আগেই। তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। 'এক-এগারো'র ঘটনায় তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। এখন লন্ডনে 'চিকিৎসাধীন'। তিনি যে বিএনপির হাল ধরবেন, তা নির্ধারিত। গেল জুলাই মাসে লন্ডনে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি এই দুই পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই দুই পরিবার প্রভাব বিস্তার করে বটে; কিন্তু আরো বেশ কয়টি পরিবার রয়েছে, রাজনীতির উত্তরাধিকারের ধারা তারা বহন করে চলছে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সন্তান ও বর্তমান রাষ্ট্রপতির সন্তানের রাজনৈতিক অভিষেক হয়েছে। যদিও সন্তানদের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নেই। বাবাদের মতো দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা সমাজে স্ব স্ব অবস্থান গড়ে তুলতে পারেননি এখনো। একজন জিল্লুর রহমান কিংবা আবদুল হামিদ একদিনে তৈরি হয়নি। তাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। 'সোনার চামচ' মুখে দিয়ে তাঁরা মন্ত্রী হননি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাঁদের ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে সাহায্য করেছিল।
শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা প্রায়ই ভারতে নেহরু পরিবারের দৃষ্টান্ত দিই; কিন্তু ভারতে প্রতিটি রাজ্যে এই পারিবারিক রাজনীতির শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কোথাও কোথাও (উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু) ব্যক্তির নামেই দলের পরিচয়। পারিবারিক রাজনীতির এই ধারা যে শুধু কংগ্রেসের মধ্যেই আছে, তা নয়। বরং বিজেপি থেকে শুরু করে প্রতিটি আঞ্চলিক দলের মধ্যেই আছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে এ প্রবণতা ব্যাপকভাবে না থাকলেও আছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, আফ্রিকার অনেক দেশে এ প্রবণতা ব্যাপক। কোথাও কোথাও স্বামী, সন্তান, ভাই- সবাই মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছেন। আফ্রিকার অনেক দেশে আমি দেখেছি যে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের সন্তানদের অনেকেই ব্রিটেন অথবা ফ্রান্স থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
আমাদের উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বীজ যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য। নেহরু পরিবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী পরিবার। নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু একসময় (১৯২১) কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বন্দরনায়েকে পরিবার। প্রথমে বাবা, পরে মা, তারপর চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা নিজে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি পরিচালনা করে গেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ও তাঁর পরিবার এখন শ্রীলঙ্কার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র একটি ঐতিহ্য। এটা নিয়ে কেউ সেখানে হৈচৈ করে না। নেপালে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, সেখানেও রয়েছে পরিবারতন্ত্র। কৈরালা পরিবার শুধু নেপালের সরকার পরিচালনায়ই সম্পৃক্ত ছিল না, বরং নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বও রয়েছে কৈরালা পরিবারের হাতে, এমনকি মাওবাদী নেতা প্রচণ্ড এ ধারা থেকে নিজেকে বাইরে রাখতে পারেননি। তাঁর মেয়ে এখন দলের তথা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও গাইয়ুমের (সাবেক রাষ্ট্রপতি) মেয়ে পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। সিঙ্গাপুরেও পরিবারতন্ত্র আছে। পাকিস্তানের কথা না হয় নাই বললাম। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলেরা রাজনীতিতে আসছেন না। আসছেন তাঁর মেয়ে কুলসুম। ফিলিপাইনের দিকে তাকান। কোরাজন অ্যাকুইনোর (সাবেক প্রেসিডেন্ট) ছেলে এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবারতন্ত্র ভালো, না খারাপ? সিঙ্গাপুরে লি কোয়াক কুয়ান ইউর ছেলে যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ, তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তিনি অতীতে রেখেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি কোরাজন অ্যাকুইনোর ছেলের বেলায়- একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রশ্নটা সেখানেই। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে- Vasudua Kutumbikam। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় all the Universe is a family। অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তাঁরা শাসন করেন। ভারতে রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহরু পরিবারের বাইরে বেশ কিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যাঁরা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, চরণ সিং, দেবগৌড়া, শারদ পাওয়ার, আবদুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি, সিন্দিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। বাংলাদেশ এ থেকে পৃথক নয়। পারিবারিক এ রাজনীতির ধারা বাংলাদেশে আছে ও থাকবে। এ মুহূর্তে আলোচিত হচ্ছেন তারেক ও জয়। জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি এখন সক্রিয় হবেন এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়াবেন। তিনি যদি পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেন, আমি তাতে অবাক হব না। বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা একজন ব্যক্তি, যিনি তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি আধুনিকমনস্ক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আমি তো মনে করি, তিনি রাজনীতির সনাতন ধারাকে বদলে দিতে পারেন। তাঁর বিদেশি স্ত্রী, তাঁর জন্য আদৌ কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে ভারতে রাজীব গান্ধীর দৃষ্টান্ত আমাদের জানা আছে। প্রয়াত রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীকে একজন 'পুরোপুরি ভারতীয়' হিসেবে বিজেপি গ্রহণ করে নেয়নি, যে কারণে সোনিয়া গান্ধী কোনো দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি এবং ভবিষ্যতেও পারবেন না। তবে নির্বাচনের সময় যদি রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণবিধিতে পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে জয় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন।
জয়ের রাজনীতিতে আসাকে আমি স্বাগত জানাই। এর মধ্য দিয়ে দুটো ধারার সূচনা হতে পারে। এক. সিনিয়র নেতারা বিদায় নিতে পারেন; দুই. দলে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে। বর্তমানে দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে তরুণ সমাজের জন্য কোনো আদর্শ আমরা রেখে যেতে পারছি না। বিরোধী পক্ষকে আস্থায় না নেওয়া এবং রাজনীতি থেকে তাদের উৎখাত করা, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে রাজনীতিকে উত্তেজিত করে তোলা, সহিংস পথে রাজনীতিকে পরিচালনা করা, ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে রাজনীতির চেয়ে বড় করে দেখা, হত্যা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা- এই যে রাজনীতির চিত্র, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। আওয়ামী লীগের সিনিয়র পর্যায়ে যাঁরা রয়েছেন, দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, তাঁরা জাতির জন্য কোনো 'রোল মডেল' নন। অনেকেই আছেন বহিরাগত। যে দলটিকে একসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তাজউদ্দীন আহমেদ- আজ এত বছর পর দল কি 'আরেকজন শেখ মুজিব' কিংবা 'আরেকজন তাজউদ্দীন' তৈরি করতে পেরেছে? না, পারেনি। আজ তাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতি এক নয়া নেতৃত্ব পাক, যারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে একটি 'সফট পাওয়ার' হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করবে।
(নিউইয়র্ক থেকে)
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment