নির্বাচন কমিশন একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এর ব্যাপক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব এনে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি নোট পাঠিয়েছে। যদিও আইন মন্ত্রণালয় এখন অবধি সেসব প্রস্তাব গ্রহণ করেনি, কিন্তু ইসির এ প্রস্তাব ইতিমধ্যেই রাজনীতির ময়দানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছাড়াও মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ইসির এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন। যে অভিযোগটি উঠেছে তা হচ্ছে, ইসি সরকারের পক্ষে কাজ করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসব অভিযোগের কোনো জবাব দেননি। তবে বলছেন, কমিশন ইতিমধ্যে এসবের জবাব দিয়েছে। প্রয়োজনে কমিশন আরও ব্যাখ্যা দেবে। দেশ যখন একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি, জাতি যখন এখনও স্পষ্ট নয় কোন পদ্ধতির সরকারের আওতায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন নির্বাচন কমিশন এ ধরনের কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত না নিলেই পারত। নির্বাচন কমিশন কি আদৌ চিন্তা করেনি যে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি করবে? ইসির দায়িত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। কিন্তু এ ধরনের একটি অযৌক্তিক সংশোধনী শুধু নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণকেই অনিশ্চিত করবে না, বরং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বস্তুত কমিশন ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জটিলতা আরও বাড়বে।
নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে থাকে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এ সংশোধনী আনা প্রয়োজন, তারা সেটা করতে পারে। এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা মূল ‘অ্যাক্টর’, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে তাদের যদি সম্মতি না থাকে, তাহলে ওই সব সংশোধনী আনার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বর্তমান ইসি যেসব সংশোধনী আনল, তাতে মূল ‘অ্যাক্টর’দের সম্মতি না থাকায় সেসব সংশোধনী অর্থহীন হয়ে পড়ল। কমিশন দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারল না। বরং রাজনৈতিক সংকটে নতুন একটি মাত্রা যোগ করল। কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হল।
প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, যার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচনবিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা ১ ভাগ ভোটারের পূর্ব-স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থী পদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয় প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনারের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিও’র ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উসকেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখাপেক্ষী- এ অভিযোগকে আরও জোরালো করবে।
আরপিওর ৯১ই(২) ধারায় আছে, আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনের নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সময়ে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন ওই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে, কোনো প্রার্থীর প্রার্থী পদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে, তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়, তাহলে সরকারদলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায়, ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল? দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকাণ্ড যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য।
নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির আগুনে’ ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এ মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চেয়ে নির্বাচন কমিশনের আরও অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত। সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয়- তা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে, ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনোমতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কী? নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনও বহাল। বলা হয়, ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধিভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্র্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাই- আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি, তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্মকর্তার রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। তারা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন সব সময়ই ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘মাইন্ড সেটআপে’র কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অবসর) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদমর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আমরা বারবার বলেছি, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রথমত, প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসসির মাধ্যমে এবং সরাসরি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগ ইত্যাদি সবকিছু করবে কমিশন। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে, কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন আর্থিকভাবে সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারবার একই ঘটনা ঘটতে থাকবে- সরকার তার সমর্থকদের এই কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসন সব জায়গায়ই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি ঘটেছে যে, অতীতের সব রেকর্ড তারা ভঙ্গ করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি, পুলিশ বিভাগে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে, প্রশাসনের ওপর আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মূলধারায় আমরা কিভাবে ফিরে আসব, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। একটা দেশের প্রশাসন যদি ঠিক না থাকে, তাহলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আজ নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করল, কমিশন সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি কমিশন হিসেবে কাজ করতে পারছে না। কমিশন একটি ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে’র মতোই আচরণ করছে। তাদের এই ‘আচরণ’ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু কমিশনের বড় কাজ হচ্ছে বড় দলগুলোর আস্থা অর্জন করা। শুধু সরকারি দলের আস্থা অর্জন করলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, বড় দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে কমিশন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তুতি মূল্যহীন। আরপিওতে সংশোধনী যদি আনতে হয়, তাহলে তা বড় দলগুলোর সম্মতি নিয়েই আনতে হবে। এককভাবে সংশোধনীর উদ্যোগ বিতর্কের মাত্রা বাড়াবেই মাত্র। সিইসি বলেছেন, তিনি একটি ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু ব্যাখ্যার চেয়েও বড় প্রয়োজন বড় দলগুলোর মতামতকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া। আরপিওর ব্যাপারে বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি যে মতামত দিয়েছে, নির্বাচন কমিশন তা গ্রহণযোগ্যতায় নিতে পারে এবং সেই মতো কাজ করতে পারে। তাহলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটবে। না হলে যে কোনো উদ্যোগ হয়তো সরকারি দলকে খুশি করবে, কিন্তু বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে পারবে না।
এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশন কতটুকু পূরণ করে, সেটাই দেখার বিষয়।
দৈনিক যুগান্তর, ১৭ আগস্ট ২০১৩।
নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে থাকে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এ সংশোধনী আনা প্রয়োজন, তারা সেটা করতে পারে। এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা মূল ‘অ্যাক্টর’, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে তাদের যদি সম্মতি না থাকে, তাহলে ওই সব সংশোধনী আনার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বর্তমান ইসি যেসব সংশোধনী আনল, তাতে মূল ‘অ্যাক্টর’দের সম্মতি না থাকায় সেসব সংশোধনী অর্থহীন হয়ে পড়ল। কমিশন দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারল না। বরং রাজনৈতিক সংকটে নতুন একটি মাত্রা যোগ করল। কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হল।
প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, যার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচনবিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা ১ ভাগ ভোটারের পূর্ব-স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থী পদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয় প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনারের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিও’র ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উসকেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখাপেক্ষী- এ অভিযোগকে আরও জোরালো করবে।
আরপিওর ৯১ই(২) ধারায় আছে, আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনের নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সময়ে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন ওই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে, কোনো প্রার্থীর প্রার্থী পদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে, তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়, তাহলে সরকারদলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায়, ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল? দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকাণ্ড যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য।
নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির আগুনে’ ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এ মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চেয়ে নির্বাচন কমিশনের আরও অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত। সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয়- তা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে, ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনোমতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কী? নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনও বহাল। বলা হয়, ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধিভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্র্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাই- আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি, তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্মকর্তার রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। তারা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন সব সময়ই ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘মাইন্ড সেটআপে’র কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অবসর) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদমর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আমরা বারবার বলেছি, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রথমত, প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসসির মাধ্যমে এবং সরাসরি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগ ইত্যাদি সবকিছু করবে কমিশন। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে, কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন আর্থিকভাবে সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারবার একই ঘটনা ঘটতে থাকবে- সরকার তার সমর্থকদের এই কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসন সব জায়গায়ই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি ঘটেছে যে, অতীতের সব রেকর্ড তারা ভঙ্গ করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি, পুলিশ বিভাগে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে, প্রশাসনের ওপর আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মূলধারায় আমরা কিভাবে ফিরে আসব, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। একটা দেশের প্রশাসন যদি ঠিক না থাকে, তাহলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আজ নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করল, কমিশন সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি কমিশন হিসেবে কাজ করতে পারছে না। কমিশন একটি ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে’র মতোই আচরণ করছে। তাদের এই ‘আচরণ’ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু কমিশনের বড় কাজ হচ্ছে বড় দলগুলোর আস্থা অর্জন করা। শুধু সরকারি দলের আস্থা অর্জন করলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, বড় দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে কমিশন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তুতি মূল্যহীন। আরপিওতে সংশোধনী যদি আনতে হয়, তাহলে তা বড় দলগুলোর সম্মতি নিয়েই আনতে হবে। এককভাবে সংশোধনীর উদ্যোগ বিতর্কের মাত্রা বাড়াবেই মাত্র। সিইসি বলেছেন, তিনি একটি ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু ব্যাখ্যার চেয়েও বড় প্রয়োজন বড় দলগুলোর মতামতকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া। আরপিওর ব্যাপারে বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি যে মতামত দিয়েছে, নির্বাচন কমিশন তা গ্রহণযোগ্যতায় নিতে পারে এবং সেই মতো কাজ করতে পারে। তাহলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটবে। না হলে যে কোনো উদ্যোগ হয়তো সরকারি দলকে খুশি করবে, কিন্তু বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে পারবে না।
এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশন কতটুকু পূরণ করে, সেটাই দেখার বিষয়।
দৈনিক যুগান্তর, ১৭ আগস্ট ২০১৩।
ওয়াশিংটন ডিসি, আগস্ট ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment