রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনীতিতে চুলতত্ত্ব এবং বান কি মুনের টেলিফোন

হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘চুল’ নিয়ে আলোচনার পরিধি বেড়েছে। আর এর সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। প্রধানমন্ত্রী ১৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, ‘সরকার আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে এক চুলও নড়বে না।’ এর প্রতিক্রিয়ায় বেগম জিয়া বললেন ‘আন্দোলনের বাতাসে চুল তো থাকবেই না, অস্তিত্বও যাবে।’ মন্ত্রীরা চুল নিয়ে কথা বলবেন না, তা কি হয়! হঠাৎ মন্ত্রী হওয়া হাসান মাহমুদও চুল নিয়ে মন্তব্য করে বসলেন। আসলে প্রধানমন্ত্রী যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে আগামীতে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী। সংবিধানে যেভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সরকার সেভাবেই নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আরো অনেক কথা বলেছেন, যা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ইতোমধ্যে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ফেসবুকে দেখলাম অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে নির্বাচনের ব্যাপারে যে সমঝোতার সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তাতে এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলো। এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন দু’নেত্রীকে টেলিফোন করেন এবং চলমান রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দেন। বান কি মুনের টেলিফোন নতুন আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকবে, তখন বিতর্ক যে বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংসদে দেয়া তার আগের বক্তব্য থেকে সরে এলেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন ২৫ অক্টোবরের পর সংসদ ভেঙে যাবে। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো তারিখ নির্ধারণ করে দেন, তখন এই তারিখটি গুরুত্ব দিতে হয়। মানুষ দিয়েছেও। আমরাও দিয়েছি। তার এই বক্তব্যের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে এলো নির্বাচনের প্রশ্নটি। বিভিন্ন মহল থেকে বলাবলি হতে লাগল যে, ডিসেম্বরে অথবা জানুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। কেননা সংবিধানে বলা আছে সংসদ ভেঙে দিলে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তাই ধারণাটা স্বাভাবিকই ছিল যে, নির্বাচন হবে ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে। এখন প্রধানমন্ত্রী বললেন নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকবে। এর ব্যাখ্যা কি? যদি জানুয়ারিতে নির্বাচন হয়, তাহলে কি সংসদ জানুয়ারি পর্যন্তই চালু থাকবে? ২৫ জানুয়ারি (২০১৪) পর্যন্ত বর্তমান সংসদের সময়কাল। জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার থাকতেই পারে। এক্ষেত্রে জানুয়ারি পর্যন্ত যদি সংসদ চলে, তাহলে নির্বাচন হতে হবে এপ্রিলের ২৫ তারিখের মধ্যে। কিন্তু তা কি রাজনৈতিক দলগুলো চাইবে? প্রধানমন্ত্রী ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা ছিল যৌক্তিক। নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ কার্যকর থাকলে নানা জটিলতা তৈরি হবে। ওই সময় পর্যন্ত যারা সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকবেন, তারা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন। বিশেষ করে যারা সরকারি দলের সংসদ সদস্য হিসেবে থাকবেন, তারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাবেন। তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে নির্বাচিত এমপিকে অস্বীকার করা কোনো মতেই সম্ভব হয়ে উঠবে না। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে তখন স্থানীয় এমপির চাপ অস্বীকার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমি এর আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামোয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন নানা কারণে সরকারের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় প্রশাসনে নিয়োগ দেয় সরকার। তাদের ওপর নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্তৃত্ব বা প্রভাব নেই। তারা স্থানীয় প্রশাসনকে কোনো নির্দেশও দিতে পারে না। স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রের জনপ্রশাসন। ইতোমধ্যে এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাবেন। ফলে ওই সময় তার নেতৃত্বাধীন যে সরকার থাকবে, সেই সরকারের অধীনে যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থাকবে, তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসন। এক্ষেত্রে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে না। ইতোমধ্যে প্রশাসনে ব্যাপকভাবে রাজনীতি ঢুকে গেছে। সরকারের সামরিক জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রমোশন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যারা সরকারের ঠিক ‘বন্ধু নন’, এমন কর্মকর্তাদের ওএসডি অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে। তাই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাঠামোকে এভাবে রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা আশা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং একাধিক মন্ত্রী প্রায়ই একটা কথা বলেন-পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, এভাবেই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। তারা প্রায়ই ভারতের দৃষ্টান্ত দেন। এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী তিন মাসের জন্য থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। আর ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিংবা কমিশনাররা নিরপেক্ষতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের কমিশনাররা পারেননি অতীতে; বরং দেখা গেছে তারা অনেকটা সরকারি কর্মচারীদের মতো আচরণ করে গেছেন। অতীতে এমনও দেখা গেছে ভারতের নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন কোনো কোনো মন্ত্রীকে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কি অতীতে কখনো এমন ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছে? বরং দেখা গেছে তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরেও এক চুল যেতে পারেনি। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন আরপিওতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে রাজনৈতিক মহলে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে যদি ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তুলনা করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। ভারতের নির্বাচন কমিশন যেসব দৃষ্টান্তযোগ্য কাজ ইতোমধ্যে করেছে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কি এমন কোনো কাজ করা সম্ভব হয়েছে? সংসদে বিল আনতে হবে। কমিশনের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে হবে। নিজস্ব ক্যাডার তৈরি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা যদি সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী করা হয়, যদি জেলা পর্যায়ের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জেলা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে না পারেন, তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বর্তমান কাঠামোয়, তা সম্ভব নয়। তাই ভারতীয় তথা অন্যান্য দেশের দৃষ্টান্ত দেয়া অর্থহীন। বর্তমান সরকারের হাতে সুযোগ ছিল। যখন সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হলো এবং সংসদে পাস করা হলো, তখন সরকার নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে পারত। সরকার তা করেনি। এটা সত্য, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা যদি পুরোপুরি অনুসরণ করা হতো, তাহলে কোনো বিতর্ক উঠত না। কিন্তু সরকার তো তা করেনি। আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় আয়োজন করারও সুপারিশ ছিল উচ্চ আদালতের। সরকার সেদিকে যায়নি। সরকার সংবিধানে সংশোধনী আনার জন্য যে কমিশন গঠন করেছিল, তারা নীতিগতভাবে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন-এমন একটি সংবাদ পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সরকারপ্রধানের ইচ্ছার কারণে তা নাকি বাদ দিতে হয়েছিল। এমনকি সংবিধানে সংশোধনী আনার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। প্রধান বিরোধী দলের কোনো মতামত গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া হয়নি। ফলে সংবিধানে যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন তা একতরফাভাবে হয়েছে। ঐকমত্যভাবে সংবিধানে সংশোধনী আনা হলে আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। এখন ক্ষমতাসীন সরকারকে এবং প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান রেখে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নির্বাচনের মতো একটি বিষয়ে যদি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই এবং তাতে সংকট বাড়বেই।
আমাদের দুর্ভাগ্য একটাই-নির্বাচন এলেই দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তৎপর হয়ে ওঠেন। অতীতেও এমনটি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিএনপির জমানায় তথাকথিত ‘টুয়েস ডে ক্লাবের’ তৎপরতার খবর আমাদের অনেকেরই জানা আছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করত। এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের তৎপরতা আবার শুরু হয়েছে। নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এদেশের জনগণ। এক্ষেত্রে বাইরের হস্তক্ষেপ বা পরামর্শ কাম্য হতে পারে না। কিন্তু হচ্ছে। আর আমরা, আমাদের রাজনীতিবিদরাই তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে যদি ঐকমত্য হতে পারতাম, তাহলে দাতারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারতেন না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সরকার সেই আশঙ্কা দূর করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা এখানেই যে, বিরোধী দলগুলোকে তারা আশ্বস্ত করতে পারেনি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। তবে এখন অনেক কারণের জন্য দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রথমত, সরকারের দমননীতি। সরকার যেভাবে বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে, তাতে বিরোধী দলের পক্ষে এটা ভাবা স্বাভাবিক যে, সরকার বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তাদের কর্মকাণ্ডে সীমিত করতে চায়। উপরন্তু বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা এটাই প্রমাণ করে গণতন্ত্রে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার যে সম্পর্ক থাকা দরকার, তা নেই। সরকারের ব্যর্থতা এখানেই যে, তারা সেই আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। বিরোধী দলকে আস্থায় না নিয়ে যে দমননীতি গ্রহণ করেছে তা দশম সংসদ নির্বাচনে সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশ যখন এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, তার প্রায় ১৭ বছর পর বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পাকিস্তান ও নেপাল এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। এমনকি গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত গ্রিসেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইউরোপের অপর একটি দেশ বুলগেরিয়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সংশোধন করে এই ব্যবস্থাকে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত, কিন্তু সরকার তা করেনি। ফলে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। সংবিধান এমন কোনো দলিল নয় যে, এটা পরিবর্তন করা যাবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য থাকা দরকার। উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। তৃতীয়ত, একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা ‘তৃতীয় শক্তির’ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন। তিনি আকার-ইঙ্গিতে সেনাবাহিনীর কথা বলতে চেয়েছেন। তার এই ধারণা ভুল। সেনাবাহিনী এখন যথেষ্ট ‘প্রফেশনাল।’ তারা সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ। তাদের দ্বারা কোনো অসাংবিধানিক কাজ হবে বলে মনে হয় না। চতুর্থত, সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। নষ্ট হওয়া ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সরকারের। পঞ্চমত, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে সরকার প্রমাণ করতে চাইছে যে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, কিন্তু এটাও ভুল ধারণা। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। সিটি কর্পোরেশনে মিডিয়ার উপস্থিতি ছিল সরব। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে তিনশ’ আসনে মিডিয়ার উপস্থিতি সম্ভব নয়। ষষ্ঠ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যানারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থেকে যাওয়া জনমনে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। এই প্রবণতা একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে! ভবিষ্যতে বিরোধী দল যদি ক্ষমতায় আসে, তারাও সংবিধানের কাটছাঁট করে নিজেরা ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবে। এটা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দিয়ে এক চুলও সরে না যাওয়ার যে বক্তব্য দিলেন তা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো ভালো খবর নয়। এতে দুটি বড় দলের মাঝে অবিশ্বাস আরো বাড়বে। সংকটের গভীরতা আরো বাড়বে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একদলীয় শাসন কায়েম করার যে অভিযোগ, সেই অভিযোগ আরো শক্তিশালী হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৮ দলীয় জোট যদি বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলে কিংবা যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বয়কট করে তা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য হবে ছুরিকাঘাতের শামিল। যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করেন, তারা এটা মনে করতেই পারেন যে, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা। তাতে সরকারের লাভ একাধিক। এককভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া। সেই সঙ্গে বিএনপির বিভক্তিকে ত্বরান্বিত করা। বিএনপি নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলে একটা অংশ বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট (বিএনএফ) নামে একটি নয়া দলের অনুমোদন প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত। বিএনপির বিকল্প হিসেবে বিএনএফ যদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মপ্রকাশ করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা চলমান সংকটে কোনো সমাধান বয়ে আনবে না; বরং দেশে একটি বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে, যা আমাদের জন্য আদৌ কোনো ভালো খবর নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে যে ভূমিকা ইতোমধ্যে রাখলেন তা শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু আমাদের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য আমাদেরই ভাবতে হবে, অন্যদের ভাবনা মুখ্য নয়। আমাদের সমস্যা-সংকটের নিরসন করতে
হবে আমাদেরই।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ২৭ আগস্ট ২০১৩।
ডালাস, ২০ আগস্ট ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বিশ্লেষক





0 comments:

Post a Comment