রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে মিসর?

মিসরে গণহত্যার পর যে কথাটা এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে কোন পথে যাচ্ছে এখন মিসর। কিংবা সেখানে আদৌ কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? যে দেশটিতে দীর্ঘ ৬১ বছর সেনাবাহিনী পরোক্ষভাবে শাসন করেছে, সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম হলেও ৩ জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থান গণতন্ত্র বিকাশের সব সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখানে সেনাবাহিনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তা আদৌ মনে হয় না। প্রায় সাড়ে ৮০০ মানুষ হত্যা করে সেনাবাহিনী বিশ্ববাসীকে একটা মেসেজই দিল- আর তা হচ্ছে ইসলামপন্থী ইসলামিক ব্রাদারহুডের কাছে তারা আর ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা গণহত্যার নিন্দা করলেও মিসরে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য বন্ধ করেননি। সম্ভবত মার্কিন প্রশাসনের কাছে ড. মুরসির চেয়ে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবিরও একটা যোগসাজশ আছে। মুরসির অতিমাত্রায় ইসলামপ্রিয়তা তেলআবিব ও ওয়াশিংটনে ভুল সংবাদ পৌঁছে দিয়েছিল। ভয়টা ছিল সেখানেই, শরিয়াভিত্তিক সংবিধান প্রণীত হওয়ায় মিসর একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যা তেলআবিব একটি বড় হুমকি বলে মনে করে। অন্যদিকে ওয়াশিংটনের ভয়টা ছিল, সেখানে ইসলামপন্থীদের উত্থান এই অঞ্চলজুড়ে ইসলামিক শক্তিকে আরো শক্তিশালী করবে এবং ভবিষ্যতে ইরানের ইসলামিক শক্তির সঙ্গে তাদের সহাবস্থান এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই মুরসিকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন ও তেলআবিবে এক ধরনের 'স্বস্তি' ফিরে এসেছে। তবে ভয়টা হচ্ছে এখানেই, একটি ইসলামিক সংস্কৃতিনির্ভর দেশে যে পশ্চিমা গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না, এটাই প্রমাণিত হলো। ইসলামপন্থীরা বারবার বলে আসছিলেন, ইসলাম আর গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। এখন ইসলামপন্থীরা এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতা এসাম এল হাদ্দাদ তো স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন The message will resonate throughout the Muslim world loud and clear : democracy is not for Muslim. শঙ্কাটা তাই রয়েই গেল। মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র যদি ব্যর্থ হয়, তার অর্থ কী? ১৯৯১ সালে আলজিরিয়ায় ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৫ সালে তুরস্কে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের কাছে ক্ষমতা দেয়নি। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে হামাস নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতা পায়নি। কোনদিকে তাহলে যাবে এখন মিসর?
মিসর কি আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হতে যাচ্ছে? এই সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে মিসরে ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠন 'আল গামা আল ইসলামিয়া' কর্তৃক প্রচারিত একটি বিবৃতির পর। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে যে মিসরকে আরেকটি আফগানিস্তান বানানোর লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করে একটি ইসলামপন্থী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। জঙ্গিবাদী আল গামা আল ইসলামিয়ার বিবৃতিটি যখন প্রচারিত হয়, ঠিক তখনই আল-কায়েদার নেতা জওয়াহিরির একটি বিবৃতিও ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে। জওয়াহিরি মুরসির উৎখাতের পেছনে সেনাবাহিনী, ইহুদিবাদ, খ্রিস্টান তথা যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। স্পষ্টতই মিসর নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের শঙ্কা অনেক। কী হতে যাচ্ছে মিসরে- এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে ৩ জুলাই সেনাবাহিনী মুরসিকে উৎখাত করার পর এখন পর্যন্ত সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এরই মধ্যে কায়রো সফর করেছেন মার্কিন দূত উইলিয়াম বার্নস ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিশনার এসটন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, লেডি এসটন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে বাস্তবতা ও নয়া প্রেসিডেন্টকে মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু মুরসি তাতে রাজি হননি। মুরসির সমর্থকরা কায়রোর একটি মসজিদ দখল করে সেখানে অবস্থান করছিলেন। প্রতি শুক্রবার তারা বড় বিক্ষোভের আয়োজন করে। এদিকে নয়া সরকারের পক্ষে জনসমর্থনও বাড়ছে। তারাও সেনাবাহিনীর সমর্থনে বিক্ষোভ করছে। সুতরাং মিসর নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। নয়া সরকার আগামী ২০১৪ সালে একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তার আগে সংবিধান সংশোধন করাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একটি সাংবিধানিক পরিষদও গঠন করা হয়েছে, যারা সংবিধান সংশোধন করবে। একটি সমঝোতার উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতার উদ্যোক্তা। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান ও গণহত্যা মিসরের সমাজে যে বিভক্তি ডেকে এনেছে, তা অপসারিত হবে কিভাবে? একদিকে ইসলামপন্থী, অন্যদিকে সেক্যুলারপন্থী, যাদের সঙ্গে মিলেছে লিবারেলরা ও ডেমোক্রেটরা- এই পরস্পরবিরোধী দুই শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান আদৌ হবে কি?
মিসরের সেনা অভ্যুত্থান ও গণহত্যার পর বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। যে প্রশ্নটা এখন উঠেছে, তা হচ্ছে মিসর কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? সামরিক শাসকরা যে মিসরের সমাজে একটি বড় 'রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি', তার ইতিহাস তো শুধু মুরসিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হলো না। বলা যেতে পারে, মিসরের সেনাবাহিনী গত ৬১ বছরে যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে এই সমাজ সামরিক বাহিনীনির্ভর একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সে দেশে অলিখিতভাবে 'ছায়া রাষ্ট্রপতি', আর লিখিতভাবে দেশরক্ষামন্ত্রী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি পরিষদ 'কিচেন ক্যাবিনেট' হিসেবে কাজ করে। এটা আগেও ছিল। এখনো আছে। এমনকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ও জনগণের ভোটে মুরসি সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও, তিনি সেনাবাহিনীর এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। 'প্রেসিডেন্ট' মুরসি নিজে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দেশরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন জেনারেল সিসি মুরসির শাসনামলে। যে নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেখানে মুরসির কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন জেনারেল সিসি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের জুলাই- মাত্র দুই বছর সময় নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এই দুই বছরে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যাদের ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মুরসি। এই যুক্তিতে তার 'বিচার' হয়েছে এবং ১৫ দিনের 'জেল' হয়েছিল। স্পষ্টতই বলা যায়, জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি হতে যাচ্ছেন মিসরের পরবর্তী 'নেতা'। ইতিহাস বলে মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়াত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরে সেনাবাহিনী সেই ক্ষমতাই পালন করতে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও, মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
মিসরে গণহত্যার পর এটা এখন স্পষ্ট যে জেনারেল সিসি ক্ষমতা ছাড়ছেন না। ওবামা 'মৃদু' সমালোচনা করলেও, সামরিক সাহায্য মিসরে বন্ধ করেননি। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ জাতিসংঘও মিসরের ব্যাপারে কোনো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। ফলে পরোক্ষভাবে তা জেনারেল সিসির হাতকেই শক্তিশালী করছে। জেনারেল সিসির পূর্বসূরিরা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র‌্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। উভয় ক্ষেত্রেই 'লিবারেশন র‌্যালি' ও 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন' একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদাত গঠন করেছিলেন 'আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন'। আর হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গেছেন। আর এখন জেনারেল সিসি যে একই পথ অনুসরণ করবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এতে মিসরে ক্ষমতাসীন জেনারেলরা হয়তো ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু মিসরে একটি বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্ম দেবে। মিসরের অর্থনীতি এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম এই ক্ষমতার পালাবদলে কোনো আশার আলো দেখছে না। মিসরে ২০০৮ সালে যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে তা ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার। মিসর নিয়ে তাই ভয় রয়েই গেল। আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাড়ছে। আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির হুমকি স্মরণ করিয়ে দিল আল-কায়েদা ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে। কলম্বিয়া (নিউ ইয়র্ক) বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ডিন অধ্যাপক স্টিভ কোলও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা করায়ত্ত করা মিসরে সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিতে পারে এবং তা আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের একটি মন্তব্যকে হালকাভাবে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। জঙ্গীবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে আরব বিশ্বে। লন্ডনের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট প্রশ্ন রেখেছে, 'আরব বসন্ত' কী শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে চলেছে? ১৩-১৯ জুলাইয়ের (২০১৩) সংখ্যায় বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে 'আরব বসন্ত'-এর ব্যর্থতার! মিসরের সামরিক অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়ে ব্যর্থতা মিসরের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিল। আগামীতে মিসর একটি গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবে কি না, সেটিই দেখার বিষয় এখন।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৭ আগস্ট ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment