রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

উত্তরাধিকারের রাজনীতি বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

সাম্প্রতিক সময়ে লন্ডনে তারেক রহমানের দেয়া একটি বক্তব্য ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঢাকায় দেয়া অন্য একটি বক্তব্য বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করেছে। উত্তরাধিকারের রাজনীতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। তারেক রহমান সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান। একই সঙ্গে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। অন্যদিকে জয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তিনি আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ সদস্যও বটে। কিন্তু দলের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতা তিনি নন। এরা দুজন আলোচনায় আছেন অনেক দিন থেকে। বেগম জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা অবসরে যাবেন— এ রকম কোনো ইঙ্গিত তারা এখনো দেননি। একবার নির্বাচনে হেরে গিয়ে শেখ হাসিনা অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তার ওই ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই দুই নেত্রী বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। শেখ হাসিনার অসুস্থতার কথা জানা না গেলেও বেগম জিয়া অসুস্থ। সঙ্গত কারণেই তাই প্রশ্ন জাগে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কার ওপর বর্তাবে? বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ধারিত— তারেক রহমান আইন ও সাংগঠনিকভাবেই বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা। তবে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যাপারটি এখনো অস্পষ্ট। তিনি রাজনীতিতে আসবেন কিনা কিংবা প্রধানমন্ত্রী তা চান কিনা, সে ব্যাপারটিতে এখনো অস্পষ্টতা রয়েছে। জয় রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচন পরিচালনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। গেল নির্বাচনেও তিনি নির্বাচন পরিচালনা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এবারো ঠিক নির্বাচনের আগে তিনি বিদেশী স্ত্রীসহ দেশে এসেছেন। ধারণা করছি, তিনি নির্বাচন পর্যন্ত দেশে থাকবেন। স্পষ্টতই বাংলাদেশের রাজনীতি দুটো পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত— একদিকে রয়েছে শেখ মুজিবের পরিবার। অন্যদিকে জিয়া পরিবার। রাজনীতিতে পারিবারিক ধারা শুধু এই দুই পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের ছেলে কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলেও বাবার পারিবারিক রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে রাজনীতিতে এসেছেন। তবে এটা বলতেই হবে, তাদের বাবারা যে দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের শীর্ষ পদটিতে আসীন হয়েছিলেন, তাদের সন্তানদের সেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। একজন জিল্লুর রহমান কিংবা একজন আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট এক দিনে তৈরি হয়নি। তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। ‘সোনার চামচ’ মুখে দিয়ে তারা মন্ত্রী হননি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাদেরকে ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে সাহায্য করেছিল।
শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই পারিবারিক রাজনীতির ধারা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা প্রায়ই ভারতে নেহরু পরিবারের দৃষ্টান্ত দেই। কিন্তু ভারতে প্রতিটি রাজ্যে এই পারিবারিক রাজনীতির শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কোথাও কোথাও (উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু) ব্যক্তির নামেই দলের পরিচয়। পারিবারিক রাজনীতির এই ধারা যে শুধু কংগ্রেসের মাঝেই আছে, তা নয়। বরং বিজেপি থেকে শুরু করে প্রতিটি আঞ্চলিক দলের মাঝেই আছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মাঝে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে না থাকলেও আছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, আফ্রিকার অনেক দেশে এই প্রবণতা ব্যাপক। কোথাও কোথাও স্বামী, সন্তান, ভাই সবাই মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছেন। আফ্রিকার অনেক দেশে আমি দেখেছি যে, রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত। তাদের সন্তানদের অনেকেই ব্রিটেন অথবা ফ্রান্স থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
আমাদের উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বীজ যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য। নেহরু পরিবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী পরিবার। নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু একসময় (১৯২১) কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শ্রীলংকায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতা-পরবর্তী শ্রীলংকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বন্দেরনায়েকে পরিবার। প্রথমে বাবা, পরে মা, তারপর নিজে কুমারা রানাতুঙ্গা শ্রীলংকার রাজনীতি পরিচালনা করে গেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ও তার পরিবার এখন শ্রীলংকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। শ্রীলংকার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র একটি ঐতিহ্য। এটা নিয়ে কেউ সেখানে হইচই করে না। নেপালে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, সেখানেও রয়েছে পরিবারতন্ত্র। কৈরালা পরিবার শুধু নেপালের সরকার পরিচালনাই সম্পৃক্ত ছিল না, বরং নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বও রয়েছে কৈরালা পরিবারের হাতে। এমনকি মাওবাদী নেতা প্রচন্দও এ ধারা থেকে নিজেকে বাইরে রাখতে পারেননি। তার মেয়ে এখন দলের তথা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও গাইয়ুমের (সাবেক প্রেসিডেন্ট) মেয়ে পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছেন। সিঙ্গাপুরেও পরিবারতন্ত্র আছে। পাকিস্তানের কথা নাইবা বললাম। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলেরা রাজনীতিতে আসছেন না, আসছেন তার মেয়ে কুলসুম। ফিলিপাইনের দিকে তাকান। কোরাজান অ্যাকুইনোর (সাবেক প্রেসিডেন্ট) ছেলে এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিবারতন্ত্র ভালো-না খারাপ। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান ইউয়ের ছেলে যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেখানে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ তিনি যোগ্য। সিঙ্গাপুরকে বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তিনি অতীতে রেখেছেন। এ প্রশ্ন ওঠেনি কোরাজান অ্যাকুইনোর ছেলের বেলায়— একজন সিনেটর হিসেবে তিনি অবদান রেখেছিলেন। প্রশ্নটা সেখানেই। প্রাচীন ভারতে একটি শ্লোক আছে— ঠধংঁফঁধ কঁঃঁসনরশধস। সংস্কৃতি থেকে ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘ধষষ ঃযব ঁহরাবত্ংব রং ধ ভধসরষু’। অর্থাৎ বিশ্বকে একটি পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সেই বিবেচনায় নিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে তারা শাসন করে। ভারতে রাজনীতিতে এই পারিবারিক ধারা অত্যন্ত শক্তিশালী। নেহরু পরিবারের বাইরে বেশকিছু পরিবারের জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতিতে প্রভাব খাটাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়— চরণ সিং, দেবগৌড়া, শারদ পাওয়ার, আবদুল্লাহ, মুলায়ম সিং যাদব, করুণানিধি, রেড্ডি, সিঙ্গিয়া পরিবার। এসব পরিবারের পেশা হচ্ছে রাজনীতি। পারিবারিক এ রাজনীতির ধারা বাংলাদেশে আছে ও থাকবে। এ মুহূর্তে আলোচিত হচ্ছে তারেক ও জয়। জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি এখন সক্রিয় হবেন এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়াবেন। তিনি যদি পূর্বকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করেন, আমি তাতে অবাক হবো না। বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা একজন ব্যক্তি, যিনি তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি আধুনিকমনস্ক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আমি তো মনে করি, তিনি রাজনীতির সনাতন ধারাকে বদলে দিতে পারেন। তার বিদেশী স্ত্রী, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতির কোনো কারণ হতে পারে না। একুশ শতকে এক তরুণ নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগকে সজীব ওয়াজেদ জয় একুশ শতক উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন। একই কথা প্রযোজ্য তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। অতি সম্প্রতি লন্ডনে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে আমি নেতৃত্বের একটি ‘গন্ধ’ পাচ্ছি। তিনিই বিএনপির নেতা। বেগম জিয়া-পরবর্তী দলকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন তারেক রহমান। তিনি যে ‘ভুল’ করেননি, তা নয়। অতীত থেকে তিনি শিখেছেন। তিনি যথেষ্ট ‘ম্যাচিউরড’। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে তিনি বাংলাদেশকে একুশ শতকে কোথায় নিয়ে যেতে চান। একটা দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। তাকে কেন্দ্র করেই বিএনপি তৈরি হচ্ছে। তার অবর্তমানে দলে দ্বিতীয় কোনো নেতাই নেই— যিনি বেগম জিয়ার অবর্তমানে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। জিয়ার অবর্তমানে বিচারপতি সাত্তার পারেননি। দলের স্বার্থেই সাধারণ একজন গৃহবধূ থেকে খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসতে হয়েছে। বিএনপিতে এখন তৈরি হচ্ছে পরবর্তী নেতৃত্ব। তারেক রহমানের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তার শরীরে শহীদ জিয়ার রক্ত; দ্বিতীয়ত. তিনি তারুণ্যের অধিকারী। তিনি অভিজ্ঞও। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন দরকার। বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটকে অস্বীকার করে আসছি বারবার। গণতন্ত্রে পরস্পরের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের কথা শেখায়। এটি বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এখানে নির্বাচন হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই শুধু নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশে বিরোধী পক্ষকে ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিরোধী দলকে দমন যেন স্বাভাবিক একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এজন্যই দরকার তরুণ নেতৃত্ব। তারেক ও জয়ই পারেন বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির যে ‘চক্র’ তা থেকে দলকে বের করে আনতে। পারেন যুগোপযোগী এক নয়া নেতৃত্ব তৈরি করতে। জয় যুবলীগের এক সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। স্পষ্টতই সজীব ওয়াজেদ জয় সক্রিয় রাজনীতিতে আসছেন। আমি তাকে স্বাগত জানাই। 
বনিক বার্তা ০৩.০৮.২০১৩ অষ্টপ্রহর
নিউইয়র্ক, ২৯ জুলাই ২০১৩

0 comments:

Post a Comment