রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মিসরের অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও অনিশ্চিত রাজনীতি

মিসরে মুরসির পতন ও নয়া সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পরও দেশটি নিয়ে বড় আশঙ্কার কারণ হচ্ছে তাদের অর্থনীতি। দেশটির অর্থনীতি এখন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ট্যুরিজম ছিল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উত্স। সেই ট্যুরিজম এখন বন্ধ। অতিসম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, পর্যটকরা এখন আর কায়রো আসছেন না। পর্যটকদের জন্য যে শত শত হোটেল তৈরি হয়েছিল, সেগুলো এখন খালি পড়ে থাকে। হোটেল ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। হোটেল রুমের ৮০ শতাংশ থাকছে অবিক্রীত। পর্যটন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট ব্যবসা। সেগুলো এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ট্যুরিস্ট গাইডরা এখন বেকার। তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। ট্যুরিজম সেক্টর এখন আর মিসরের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। অথচ একসময় এ ট্যুরিজম সেক্টর ছিল মিসরের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মিসরে ২০১১ সালের ‘বিপ্লবের’ আগে ২০০৮-এ যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে তা ২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। ২০১২ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ শতাংশের ওপরে। এর অর্থ হচ্ছে, মুরসির নির্বাচনে জয়লাভ অর্থনীতিতে কোনো সুবাতাস বয়ে আনতে পারেনি। বিদেশী দাতাগোষ্ঠী, স্থানীয় ব্যবসায়িক সম্প্রদায় তার ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছিলেন না। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হয়নি। যে কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। বেকারত্ব বেড়েছে। বর্তমানে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ। অর্থনীতিকে ঠিকমতো রাখতে বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। সরকারের সর্বোচ্চ ঋণ এখন ৮৫ শতাংশ অথচ ২০১২ সালে ছিল ৮০ শতাংশের নিচে। ২০১১ সালে ছিল ৭৫ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায় সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে। একসময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল (হোসনি মোবারক জমানায়, ২০০৯ সালে) ৩০ বিলিয়ন, ‘বিপ্লবের’ পর পরই তা কমে এসে দাঁড়ায় ২০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৩ সালের প্রথমার্ধে এর পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন, এখন যা ৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ডলারের সঙ্গে মিসরের মুদ্রা পাউন্ডের বিনিময় হারের মারাত্মক পতন ঘটেছে। ২০০৯ সালে ১ ডলারে যেখানে পাওয়া যেত ৫ দশমিক ৬ পাউন্ড, এখন পাওয়া যায় ৭ পাউন্ড।
তাই সঙ্গত কারণেই একটা প্রশ্ন উঠেছে যে, মিসরের ভবিষ্যত্ কোন পথে? অর্থনৈতিক এই অব্যবস্থা মিসরকে কোথায় নিয়ে যাবে? একসময় মিসর উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ‘বিপ্লব’ মিসরের অর্থনৈতিক শক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। দেশটি যদি অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে মিসর আর আরব বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে পারবে না। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে প্রথম থেকেই। প্রয়োজন ছিল একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা, সেখানে ইসলামপন্থীরা হাজেম এল বেবলাওয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেয়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইসলামপন্থীদের সরকারে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এখন ইসলামপন্থী তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি যোগ না দেয়ায় সরকার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তাই প্রশ্নটা থাকবে যে, কোন পথে এখন মিসর? মিসর আলজেরিয়ার মতো পরিস্থিতি বরণ করে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ১৯৯১ সালে আলজেরিয়ায় কী ঘটেছিল। এর আগে সাধারণ নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হলেও তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হয়নি। ফলে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে যে গৃহযুদ্ধ হয়, তাতে প্রায় এক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনীই আলজেরিয়ার রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি, যার সঙ্গে মিসরের রাজনীতির একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর সেখানে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ) আলজেরিয়ার দেশ পরিচালনা করে আসছে। আর এনএলএফের দেশ পরিচালনার পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে সেনাবাহিনীকে বলা হয়, ‘Le Paivoir’। ফরাসি ভাষায় এর অর্থ ‘শক্তি’। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি’ মূলত আলজেরিয়ার মূল ‘রাজনৈতিক শক্তি’। প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা (১৯৯৯ সাল থেকে) গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারাই চালিত হন। ইসলামপন্থীদের মূল ধারায় না নিয়ে আসায়, এরা এখনো সেখানে একটি শক্তি। সেখানে এরই মধ্যে জন্ম হয়েছে আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশকিছু জঙ্গি সংগঠনের, যারা আত্মঘাতী বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত। এসব জঙ্গি সংগঠনের তত্পরতা শুধু আলজেরিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তাদের তত্পরতা লিবিয়া ও সিরিয়ায়ও লক্ষ করা গেছে।
‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। আর তা হচ্ছে, স্বৈরাচারী সরকারগুলোর উত্খাতের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা। এক্ষেত্রে তিউনিসিয়া একটি মডেল হতে পারত। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো এন্নাহদাও তিউনিসিয়ার অন্যতম ইসলামিক শক্তি। এন্নাহদা নেতা দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। ২০১১ সালে বেন আলির পতনের পর ওই বছরের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে এন্নাহদা সংসদের নিম্নকক্ষে অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৩৭ শতাংশ ভোট তারা পেয়েছিল। ইচ্ছে করলে এন্নাহদা এককভাবে সরকার গঠন করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। সেখানে তিন শক্তির একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছে। এন্নাহদার নেতা হামাদি জেবালি প্রধানমন্ত্রী হলেও সর্বজন গ্রহণযোগ্য মনসেফ মাজুকিকে তারা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মাজুকি বামমনা ‘কংগ্রেস অব দ্য রিপাবলিক’ পার্টির নেতা। অন্যদিকে সোস্যাল ডেমোক্রেটিক ধারার দল (ডেমোক্রেটিক ফোরাম ফর লেবার অ্যান্ড লিবারটিজ বা এত্ত্বাকাতল) সরকারে যোগ দিয়েছিল। এত্ত্বাকাতল নেতা আবদের রাহমান লাদঘাম ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। লাদঘামের সঙ্গে আরো দুজন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, যাদের একজন এন্নাহদা ও অন্যজন নিরপেক্ষ। মন্ত্রিসভায় দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এ কারণে দেখা যায়, তিউনিসিয়ায় বিপ্লব-পরবর্তী তেমন কোনো অসন্তোষ সংঘটিত হয়নি। সেখানে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মিসর এ মডেল অনুসরণ করতে পারত। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের হিসেবে ভুল ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে দলটির। ১৯২৫ সালে যে সংগঠনটির জন্ম, তাদের বিশাল জনপ্রিয়তা রয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু ব্রাদারহুডের নেতারা যেটা বুঝতে পারেননি তা হচ্ছে— মিসরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি রয়েছে, যাদের প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে, অর্থনীতিতে অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। তাহরির স্কোয়ারের ১৭ দিনের অবস্থান হোসনি মোবারকের পতন ঘটালেও, সেদিন ধর্মনিরপেক্ষ তথা উদারমনা ও নারীবাদীরা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে আন্দোলন করেছিল। মোবারকের পতনের পর সেখানে নতুন যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল, তাতে খুব দ্রুত এগোতে চাচ্ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। তিনি শরিয়াভিত্তিক একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। তার দ্রুত ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও নারীবাদীরা। হোসনি মোবারকবিরোধী আন্দোলনের মূল স্পিরিট ছিল ‘Bread, freedom, social justice’। অর্থাত্ রুটি, স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল, তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা লাঘব হবে, দূর হবে বৈষম্য, সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত এবং তরুণরা পাবে চাকরি। কিন্তু তা হয়নি। মুরসি এদিকে দৃষ্টি দেননি। তিনি বেশিমাত্রায় ইসলামীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ায় সামাজিক খাত উপেক্ষিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে যে ঋণ পাওয়ার কথা, তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র এক বছরের মাথায় মানুষের অসন্তোষ বাড়ছিল। মুরসি যদি তিউনিসিয়ার মডেল অনুসরণ করতেন, আমার ধারণা, এত তাড়াতাড়ি তার পতন ঘটত না। তবে সেনা-সমর্থিত আদলি মনসুরও ভুল করবেন, যদি তিনি ইসলামপন্থীদের মূল ধারায় না আনেন। সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকায় তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন বটে, কিন্তু অসন্তোষ দমন করতে পারবেন না। অসন্তোষ থাকবে এবং তা জঙ্গিবাদের জন্ম দেবে। এরই মধ্যে মিসরে আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনের সীমিত তত্পরতা লক্ষ করা গেছে। এরা আরো শক্তিশালী হবে।
তাই মিসরকে পুনরায় তার আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে হলে একটা সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। গত ৩ জুলাই মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির পরও তার সমর্থকরা কায়রোয় আন্দোলন করে যাচ্ছে। নয়া সরকার একটি সংবিধান প্রণয়ন করার লক্ষ্যে কমিশন গঠন করেছে। আগামী বছরের শুরুর দিকে সেখানে সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেনা-সমর্থিত সরকার যদি এককভাবে নির্বাচন করে, তাতে তারা প্রাথমিকভাবে হয়তো সফল হবে; কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী একটা অস্থিতিশীলতা থেকে যাবে। এটা এখন স্পষ্ট যে, বর্তমান সরকারে এল বারাদির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি প্রমাণ করে, তিনিই হতে যাচ্ছেন ২০১৪ সালের সেনা-সমর্থিত সরকারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। কিন্তু সংবিধান সংশোধন কিংবা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কোনোটাই মিসরের সমস্যার কোনো সমাধান দেবে না। মিসরের অর্থনীতিতে যদি পরিবর্তন ও তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে দেশটিতে দীর্ঘস্থায়ী অরাজকতা বিরাজ করবে। আর তাতে লাভবান হবে ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
Bokin barta 5th August 2013

0 comments:

Post a Comment