কথাটা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, সংবিধানের বাইরে তিনি যাবেন না। আর সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় বেগম জিয়াও অনেকটা হুমকির সুরে বলেছেন, আন্দোলনের মুখে সরকারি দল তার অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলবে...। এ ধরনের বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্যের সঙ্গে আমরা মোটামুটি পরিচিত। গত বেশ কিছুদিন ধরেই দল দুটোর নেতারা এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করে রাখছেন। এতে করে বাড়ছে উত্তেজনা।
গত ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, তখন তিনি ছিলেন স্পষ্ট। তার ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ দেখে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, তিনি বিরোধী দলের ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ব্যাপারে এতটুকুও ছাড় দিতে নারাজ। অর্থাৎ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবেই তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে এখন নানা প্রশ্ন। সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান শুভর গ্রেফতারের রেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সরকার। ওই ঘটনা সরকারের সুনাম বয়ে আনেনি। দীর্ঘদিন পর হেফাজতের জমায়েতে সত্যিকার অর্থে কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল, সে প্রশ্নটা উঠে এসেছে আবার। জামায়াতের ইসিতে নিবন্ধন বাতিল ঘোষিত হয়েছে উচ্চ আদালতে। আপিল করেছে জামায়াত। দল হিসেবে জামায়াত থাকবে কি থাকবে না, এটা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। আদালতের এই রায় সরকার তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, এমন অভিযোগও উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ থাকলেও, নির্বাচন কমিশন তথাকথিত সংস্কারের নামে নিজেরাই অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেখানে নির্বাচন কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য একটা উদ্যোগ নিতে পারত, সেখানে তা না করে একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই সমর্থন করেনি। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে মানুষের মাঝে শঙ্কা বাড়ছে। ২৫ অক্টোবর সংসদ আদৌ ভেঙে যাবেÑ এমন সম্ভাবনাও কেউ আর দেখছেন না।
নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচনবিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা এক ভাগ ভোটারের পূর্ব স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থীপদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয় প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিওর ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উস্কেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখাপেক্ষিÑ এই অভিযোগকে আরও শক্ত করবে।
আরপিও’র ৯১ই(২) ধারায় আছে, আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনে নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তীকালে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন এই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে, কোনো প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়, তাহলে সরকারি দলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায়, ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল? দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকা- যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির আগুনে’ ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চেয়েও নির্বাচন কমিশনের আরও অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয়, তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা! আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এর জবাব হচ্ছে, এক কথায় ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনো মতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কী?
নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনও বহাল। বলা হয়, ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে; কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধিভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাইÑ আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থরক্ষা করেন।
ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি তা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্তার রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। এরা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘মাইন্ড সেটআপ’-এর কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অবসর) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদমর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আমরা মনে করি, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসসির মাধ্যমে এবং সরকারি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগে ইত্যাদি সব কিছু করবে কমিশন। সরকারের কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য হন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে; কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষি হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারে বারে একই ঘটনা ঘটতে থাকবে। সরকার তার সমর্থকদের এ কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থরক্ষা করবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসনÑ সব জায়গাতেই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি হয়েছে যে, প্রশাসনের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না। এরই মধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন নিষিদ্ধ করে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা যদি সরকার অনুসরণ করে, তা আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। কেননা, ইতিহাস বলে, দল নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। অন্য নামে দলগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিউনেসিয়া, তুরস্ক কিংবা থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, কোনো কোনো দল সেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও, পরে তা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। জামায়াতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
সরকারের সামনে তাই একের পর এক ‘ফ্রন্ট’ উন্মুক্ত হচ্ছে। সরকার কোনো একটিরও সুষ্ঠু সমাধান বের করতে পারছে না। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ‘নির্বাচন পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকবে’ বলে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এই আস্থাহীনতা বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু দুটি বড় দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা যেভাবে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন, তাতে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। তাই প্রয়োজন সংযম প্রদর্শন ও সেই সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ২৬ আগস্ট, ২০১৩।
ডালাস, ২২ আগস্ট, ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান
গত ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, তখন তিনি ছিলেন স্পষ্ট। তার ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ দেখে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, তিনি বিরোধী দলের ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ ব্যাপারে এতটুকুও ছাড় দিতে নারাজ। অর্থাৎ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবেই তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে এখন নানা প্রশ্ন। সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান শুভর গ্রেফতারের রেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সরকার। ওই ঘটনা সরকারের সুনাম বয়ে আনেনি। দীর্ঘদিন পর হেফাজতের জমায়েতে সত্যিকার অর্থে কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল, সে প্রশ্নটা উঠে এসেছে আবার। জামায়াতের ইসিতে নিবন্ধন বাতিল ঘোষিত হয়েছে উচ্চ আদালতে। আপিল করেছে জামায়াত। দল হিসেবে জামায়াত থাকবে কি থাকবে না, এটা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। আদালতের এই রায় সরকার তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, এমন অভিযোগও উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ থাকলেও, নির্বাচন কমিশন তথাকথিত সংস্কারের নামে নিজেরাই অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেখানে নির্বাচন কমিশন তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য একটা উদ্যোগ নিতে পারত, সেখানে তা না করে একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই সমর্থন করেনি। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে মানুষের মাঝে শঙ্কা বাড়ছে। ২৫ অক্টোবর সংসদ আদৌ ভেঙে যাবেÑ এমন সম্ভাবনাও কেউ আর দেখছেন না।
নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচনবিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা এক ভাগ ভোটারের পূর্ব স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থীপদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয় প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিওর ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উস্কেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখাপেক্ষিÑ এই অভিযোগকে আরও শক্ত করবে।
আরপিও’র ৯১ই(২) ধারায় আছে, আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনে নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তীকালে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন এই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে, কোনো প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়, তাহলে সরকারি দলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায়, ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল? দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকা- যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির আগুনে’ ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চেয়েও নির্বাচন কমিশনের আরও অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয়, তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা! আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এর জবাব হচ্ছে, এক কথায় ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনো মতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কী?
নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনও বহাল। বলা হয়, ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে; কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধিভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাইÑ আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থরক্ষা করেন।
ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি তা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্তার রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। এরা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘মাইন্ড সেটআপ’-এর কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অবসর) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদমর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
আমরা মনে করি, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসসির মাধ্যমে এবং সরকারি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগে ইত্যাদি সব কিছু করবে কমিশন। সরকারের কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য হন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে; কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষি হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারে বারে একই ঘটনা ঘটতে থাকবে। সরকার তার সমর্থকদের এ কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থরক্ষা করবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসনÑ সব জায়গাতেই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি হয়েছে যে, প্রশাসনের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না। এরই মধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন নিষিদ্ধ করে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা যদি সরকার অনুসরণ করে, তা আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। কেননা, ইতিহাস বলে, দল নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। অন্য নামে দলগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিউনেসিয়া, তুরস্ক কিংবা থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, কোনো কোনো দল সেখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও, পরে তা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। জামায়াতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
সরকারের সামনে তাই একের পর এক ‘ফ্রন্ট’ উন্মুক্ত হচ্ছে। সরকার কোনো একটিরও সুষ্ঠু সমাধান বের করতে পারছে না। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যও নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ‘নির্বাচন পর্যন্ত সরকার ক্ষমতায় থাকবে’ বলে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এই আস্থাহীনতা বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু দুটি বড় দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা যেভাবে পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন, তাতে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। তাই প্রয়োজন সংযম প্রদর্শন ও সেই সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ২৬ আগস্ট, ২০১৩।
ডালাস, ২২ আগস্ট, ২০১৩
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
tsrahmanbd@yahoo.com
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment