সংকট নিরসনের সম্ভাবনা কি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে? এই মন্তব্যটি করেছে ব্রিটেনের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট গত ১০ আগস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে। ইকোনমিস্ট এর আগেও বাংলাদেশকে নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনটিতেও আগের মতো যেমন মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের খুশি না হওয়ারই কথা। সরকার তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে এবং আগামী নির্বাচনে সরকারি দল ও জোট হেরে যেতে পারে, এমন মন্তব্যও আছে প্রতিবেদনটিতে। চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়া হবে-এমন আভাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে যে জটিলতা ছিল তা দূর হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন-এটাই এখন অবধি সরকারের অবস্থান। অন্যদিকে বিএনপি তথা ১৮ দলের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অথবা নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার। এরই মাঝে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। উচ্চ আদালতে জামায়াতকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। আপিল বিভাগে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে জামায়াত দল হিসেবে তার অস্তিত্ব হারাল। তবে জামায়াত নতুন করে ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবে, নির্বাচন না করলেও দলীয় কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে এমন কথাই বলেছেন ইসির কমিশনাররা। নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার হলেন অধিকারের সম্পাদক ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর রহমান। নি¤œ আদালত তাকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেও উচ্চ আদালত তা স্থগিত করেন। জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। সরকারের অভিযোগে তিনি তথ্য অধিকার আইন লঙ্ঘন করেছেন। রাজনীতিতে উত্তেজনার মাত্রা বাড়ানোর জন্য এসব ঘটনা যথেষ্ট। তবে দশম জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি যেমন সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে, তা আমার বিবেচনায় আলোচনার অন্যতম বিষয়। কেননা দিন যতই যাচ্ছে ততই নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। আর কমিশনের সংস্কারের প্রস্তাব আলোচনার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটির রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচন বিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা ১ ভাগ ভোটারের পূর্ব স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থীপদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয়প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিওর ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উস্কেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখোমুখি-এই অভিযোগকে আরো শক্ত করবে। আরপিওর ৯১ই (২) ধারায় আছে আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনের নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তীতে পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন এই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে যে কোনো প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয় তাহলে সরাসরি দলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায় ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল। দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকাণ্ড যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে এটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির ময়দানে’ আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চাইতেও নির্বাচন কমিশনের অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয় এবং তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এর জবাব হচ্ছে এক কথায় ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনোমতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নির্বাচন কমিশন কাগজ-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনো বহাল। বলা হয় ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালে কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধি ভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাই-আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্তাদের রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। এরা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে সব সময়ই ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘সাউন্ড সেটআপ’ এর কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অব.) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদ মর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা বারবার বলেছি নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রথমত, প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসপির মাধ্যমে এবং সরকারি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগ ইত্যাদি সব কিছু করবে কমিশন। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে। কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারে বারে একই ঘটনা ঘটতে থাকবে। সরকার তার সমর্থকদের এই কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসন সব জায়গাতেই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেন-এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি ঘটেছে যে অতীতের সব রেকর্ড তারা ভঙ্গ করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি, পুলিশ বিভাগে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি, শিক্ষক-বিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে প্রশাসনের ওপর আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মূল ধারায় আমরা কীভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসব সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। একটা দেশের প্রশাসন যদি ঠিক না থাকে, তাহলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে এই মুহূর্তে ইসির করণীয় কিছুই নেই। আদালতের নির্দেশনার বাইরে ইসি যেতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জামায়াত যদি নিষিদ্ধ হয় তাতে কি সমাধান হবে? এই নিউইয়র্ক শহরে থেকে ভয়েস অব আমেরিকার এক অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে বেশ কয়েক স্রোতা তাতে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের সবার প্রশ্ন ছিল একটাই-জামায়াত নিষিদ্ধ হলে তারা কী করবে? কিংবা জামায়াত কি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে? ইতিহাস বলে পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তারা ভিন্ন নামে ফিরে এসেছে। কেননা তাদের সমর্থকদের তো নিষিদ্ধ করা যায়নি। থাইল্যান্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল থাই রাক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু তার সমর্থকরা লাল শার্ট আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ও নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তারা আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। থাকসিনের বোন এখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিউনেসিয়ায় এন্মাহদা পার্টি নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু ‘আরব বসন্ত’ দলটিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তারা ক্ষমতা পরিচালনা করছে জনসমর্থন নিয়ে। মিসরে ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল। ড. মুরসি সে দলের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তুরস্কে জাস্টিস এড ডেভেলমেন্ট পার্টি (একেপি) পরপর তিনবার সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ২০০১ সালে তারা প্রথম ক্ষমতা পেয়েছিল। অথচ তাদের মূল দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। একেপির ব্যানারে সংগঠিত হয়ে তারা ক্ষমতা পেয়েছে। এরদোগান সে দেশের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। আলজেরিয়াতে ইসলামপন্থি সালভোসন ফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতা পায়নি। দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তারা এখন ‘ফ্রি এওয়াকেনিং পার্টি’ নামে নিবন্ধন নেয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি আফগানিস্তানে সলিডারিটি পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু দলটি বর্তমানে যথেষ্ট জনপ্রিয়। ইতিহাসই বলে দেয় দল নিষিদ্ধ করে কোনো সমাধান বয়ে আনা যায় না। সম্ভবত এটা বিবেচনা করেই সৈয়দ আশরাফ বলেছেন তাদের কোনো ইচ্ছা নেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার।
তবে অধিকারের সম্পাদককে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। অধিকারের রিপোর্টে হেফাজতে ইসলামের জামায়াতে মৃত্যুর খবর নিয়ে যদি অতিরঞ্জিত কোনো খবর থেকে থাকে সরকার আইনি প্রক্রিয়ায় তার সমাধান করতে পারত। কিন্তু গ্রেফতার ও রিমান্ড চাওয়া কেন? সরকারকে সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে। অনেকেই পত্র-পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা করেন। টক শোতে মন্তব্য করেন যা সরকারের কঠোর সমালোচনার শামিল। কিন্তু তাই বলে কি সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে? অধিকারের রিপোর্টে ৬১ জনের মৃত্যুর খবর বলা হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে ধরে নিচ্ছি এ তথ্য ভুল। কিন্তু আল-জাজিরা কিংবা সর্বশেষ ইকোনমিস্টের রিপোর্টেও অনেক মৃত্যুর খবর বলা হয়েছে। সরকার এর প্রতিবাদও করেছে। গ্রেফতার কোনো সমাধান নয়। এখন সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে আদৌ কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। গ্রেফতার করার সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়। সরকার এতে সমর্থন পাবে না। সুশীল সমাজের সমর্থন এখন গেল সরকারের বিরুদ্ধে। রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হচ্ছে। ১৩ ও ১৪ আগস্ট জামায়াতের আহ্বানে হরতাল হয়েছে। এতে ঈদ-পরবর্তী ঢাকায় ফেরা মানুষগুলো পড়েছিলেন নানা বিড়ম্বনায়। আগামীতে আরো হরতাল আসছে। তাই ইকোনমিস্ট যে মন্তব্যটি করেছে, তা হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংকট নিরসনের একটি সম্ভাবনার দ্রুত ‘মৃত্যু’ ঘটছে। আমরা চাই সংকটের একটা সমাধান হোক। নির্বাচনকালীন একটি সরকারের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হোক। আর নির্বাচন আচরণবিধি কিংবা গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে তা করা হোক সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে।
প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করেছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু? তারা মোট ৪১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটির রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ইসি যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো, নির্বাচন বিধি ভঙ্গ করলে শাস্তি কমানো, স্বতন্ত্র সদস্যদের জন্য শতকরা ১ ভাগ ভোটারের পূর্ব স্বাক্ষর গ্রহণ প্রযোজ্য না করা, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থীপদ বাতিলের ব্যাপারে দলীয়প্রধানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, নির্বাচন কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রহিত করা ইত্যাদি। ইসি আরপিওর ৯১ ধারা বাতিলের যে প্রস্তাব করেছে, তা শুধু বিতর্ককে উস্কেই দেবে না, কমিশন যে সরকারের মুখোমুখি-এই অভিযোগকে আরো শক্ত করবে। আরপিওর ৯১ই (২) ধারায় আছে আচরণবিধি ভঙ্গের অপরাধে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে এবং সেখানে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে ওই আসনের নির্বাচন বন্ধ থাকবে। পরবর্তীতে পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ধারায়। বর্তমান কমিশন এই ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে। তারা প্রস্তাব করেছে যে কোনো প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল হলে, ওই আসনে অন্য একজন প্রার্থী থাকলে তাকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হবে। এর অর্থ কী? যে কোনো প্রক্রিয়ায় যদি বিএনপি তথা ১৮ দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয় তাহলে সরাসরি দলীয় সদস্যকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা সহজ হবে। এখন ইসির সংশোধনী প্রস্তাবটি বিতর্কিত হওয়ায় ইসি পুরো ৯১ ধারাই বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই যায় ইসি কার স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রস্তাব এনেছিল। দল নিবন্ধন কিংবা স্বতন্ত্র সদস্যদের ব্যাপারে আরপিওতে যে বাধ্যবাধকতা ছিল তাও বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং ইসির কর্মকাণ্ড যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে এটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র কয়েক মাস। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষ পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান নিয়েছে। ঠিক এমন একটি সময় নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংস্কারের উদ্যোগ ‘রাজনীতির ময়দানে’ আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার শামিল। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই মুহূর্তে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর চাইতেও নির্বাচন কমিশনের অনেক কাজ বাকি। কমিশন সেসব ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করত।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটা কথা বলা হয় এবং তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। আমাদের মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কি আদৌ স্বাধীন? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা কি সম্ভব? এর জবাব হচ্ছে এক কথায় ‘না’। যে কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিতর্কিত হয়ে যায়, সেই কমিশন দিয়ে কোনোমতেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করা যায় না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন যদি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের ক্ষমতাবলে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নির্বাচন কমিশন কাগজ-কলমে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব এখনো বহাল। বলা হয় ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে। কথাটার পেছনে সত্যতা আছে। কিন্তু এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালে কমিশন সব ক্ষমতা ভোগ করে। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কোনো ক্ষমতা থাকে না। অন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকেন বটে, কিন্তু তার কোনো ক্ষমতা থাকে না। ওই তিন মাস মূল ক্ষমতা থাকে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারা কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ বিধি ভঙ্গের অভিযোগে মন্ত্রীদের, সাবেক মন্ত্রীদের গ্রেফতারের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে পারেন। এখন ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের নির্বাচন কমিশনের পার্থক্য একটাই-আমাদের কমিশন, কমিশনের সদস্যরা অনেকটা ‘সরকারি চাকরি’ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর দলীয় আনুগত্যের কারণে তারা কমিশনে আসেন পাঁচ বছরের জন্য এবং যাদের দ্বারা তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের স্বার্থ রক্ষা করেন। ইদানীং একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবসরের পর কমিশনে নিয়োগ পান। এসব সামরিক কর্তাদের রাজনীতি, রাজনীতির গতিধারা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। এরা সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে সব সময়ই ‘কমান্ড’ মানতেন। মানতে বাধ্য থাকতেন। এখন কমিশনে এসেও তারা সেই ‘কমান্ড’ই মেনে চলছেন। তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়া অসম্ভব। তাদের ‘সাউন্ড সেটআপ’ এর কারণে তারা কমান্ডের বাইরে যেতে পারেন না। অতিরিক্ত সচিব (অব.) পদমর্যাদায় কিংবা জেলা জজ পদ মর্যাদায় যারা থাকেন, তারাও সরকারি প্রভাবের বাইরে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কমিশনকে দিয়ে তাই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমরা বারবার বলেছি নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব। তবে সেখানে ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ আছে। প্রথমত, প্রতিটি জেলায় যে নির্বাচন কমিশনের অফিস ও কর্মকর্তারা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। এখানে পিএসপির মাধ্যমে এবং সরকারি ইসির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তাদের নিয়োগকর্তা হবে কমিশন। তাদের বদলি, বেতন-ভাতা, নিয়োগ ইত্যাদি সব কিছু করবে কমিশন। সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো প্রভাব তাদের ওপর থাকবে না। তারা কোনো সরকারি কর্মকর্তার (যেমন জেলা প্রশাসক) নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তারা শুধু নির্বাচন কমিশনের আদেশ গ্রহণ করবেন ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন। এখন যদিও পিএসসি তাদের রিক্রুট করেছে। কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাব তাদের ওপর রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিকভাবে নির্বাচন কমিশন সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারবে না। বাজেটে প্রথম থেকেই তাদের বরাদ্দ থাকবে। বাজেট বরাদ্দ থাকলে তারা টাকার জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হবে না। না হলে এই আর্থিক নির্ভরতাকে সরকার নিজের কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ হলেও কারা কারা এর প্রধান হবেন বা সদস্য হবেন, তার কোনো নীতিমালা নেই। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। না হলে বারে বারে একই ঘটনা ঘটতে থাকবে। সরকার তার সমর্থকদের এই কমিশনে নিয়োগ দেবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে ‘রাজনীতিকরণ’ হয়েছে। শিক্ষকতা, পেশাজীবী, প্রশাসন সব জায়গাতেই রাজনীতি। নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শকে মাথায় রেখে। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ‘আদেশ’ অনুসরণ করবেন, তাদের ‘খুশি’ করার জন্য ‘পদক্ষেপ’ নেবেন-এটাই স্বাভাবিক। মহাজোট সরকারের আমলে প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টি এত বেশি ঘটেছে যে অতীতের সব রেকর্ড তারা ভঙ্গ করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি, পুলিশ বিভাগে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি, শিক্ষক-বিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের ঘটনা এত বেশি ঘটেছে যে প্রশাসনের ওপর আস্থা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মূল ধারায় আমরা কীভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসব সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। একটা দেশের প্রশাসন যদি ঠিক না থাকে, তাহলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে এই মুহূর্তে ইসির করণীয় কিছুই নেই। আদালতের নির্দেশনার বাইরে ইসি যেতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জামায়াত যদি নিষিদ্ধ হয় তাতে কি সমাধান হবে? এই নিউইয়র্ক শহরে থেকে ভয়েস অব আমেরিকার এক অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে বেশ কয়েক স্রোতা তাতে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের সবার প্রশ্ন ছিল একটাই-জামায়াত নিষিদ্ধ হলে তারা কী করবে? কিংবা জামায়াত কি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে? ইতিহাস বলে পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তারা ভিন্ন নামে ফিরে এসেছে। কেননা তাদের সমর্থকদের তো নিষিদ্ধ করা যায়নি। থাইল্যান্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল থাই রাক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু তার সমর্থকরা লাল শার্ট আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ও নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তারা আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। থাকসিনের বোন এখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিউনেসিয়ায় এন্মাহদা পার্টি নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু ‘আরব বসন্ত’ দলটিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তারা ক্ষমতা পরিচালনা করছে জনসমর্থন নিয়ে। মিসরে ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল। ড. মুরসি সে দলের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তুরস্কে জাস্টিস এড ডেভেলমেন্ট পার্টি (একেপি) পরপর তিনবার সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ২০০১ সালে তারা প্রথম ক্ষমতা পেয়েছিল। অথচ তাদের মূল দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। একেপির ব্যানারে সংগঠিত হয়ে তারা ক্ষমতা পেয়েছে। এরদোগান সে দেশের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। আলজেরিয়াতে ইসলামপন্থি সালভোসন ফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতা পায়নি। দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তারা এখন ‘ফ্রি এওয়াকেনিং পার্টি’ নামে নিবন্ধন নেয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি আফগানিস্তানে সলিডারিটি পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু দলটি বর্তমানে যথেষ্ট জনপ্রিয়। ইতিহাসই বলে দেয় দল নিষিদ্ধ করে কোনো সমাধান বয়ে আনা যায় না। সম্ভবত এটা বিবেচনা করেই সৈয়দ আশরাফ বলেছেন তাদের কোনো ইচ্ছা নেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার।
তবে অধিকারের সম্পাদককে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। অধিকারের রিপোর্টে হেফাজতে ইসলামের জামায়াতে মৃত্যুর খবর নিয়ে যদি অতিরঞ্জিত কোনো খবর থেকে থাকে সরকার আইনি প্রক্রিয়ায় তার সমাধান করতে পারত। কিন্তু গ্রেফতার ও রিমান্ড চাওয়া কেন? সরকারকে সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে। অনেকেই পত্র-পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা করেন। টক শোতে মন্তব্য করেন যা সরকারের কঠোর সমালোচনার শামিল। কিন্তু তাই বলে কি সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে? অধিকারের রিপোর্টে ৬১ জনের মৃত্যুর খবর বলা হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে ধরে নিচ্ছি এ তথ্য ভুল। কিন্তু আল-জাজিরা কিংবা সর্বশেষ ইকোনমিস্টের রিপোর্টেও অনেক মৃত্যুর খবর বলা হয়েছে। সরকার এর প্রতিবাদও করেছে। গ্রেফতার কোনো সমাধান নয়। এখন সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে আদৌ কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। গ্রেফতার করার সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়। সরকার এতে সমর্থন পাবে না। সুশীল সমাজের সমর্থন এখন গেল সরকারের বিরুদ্ধে। রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হচ্ছে। ১৩ ও ১৪ আগস্ট জামায়াতের আহ্বানে হরতাল হয়েছে। এতে ঈদ-পরবর্তী ঢাকায় ফেরা মানুষগুলো পড়েছিলেন নানা বিড়ম্বনায়। আগামীতে আরো হরতাল আসছে। তাই ইকোনমিস্ট যে মন্তব্যটি করেছে, তা হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংকট নিরসনের একটি সম্ভাবনার দ্রুত ‘মৃত্যু’ ঘটছে। আমরা চাই সংকটের একটা সমাধান হোক। নির্বাচনকালীন একটি সরকারের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হোক। আর নির্বাচন আচরণবিধি কিংবা গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে তা করা হোক সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ১৭ আগস্ট ২০১৩।
ওয়াশিংটন ডিসি ১৪ আগস্ট ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ওয়াশিংটন ডিসি ১৪ আগস্ট ২০১৩
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
0 comments:
Post a Comment