মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি যখন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সঙ্গে একটি সমঝোতায় যেতে ব্যর্থ হয়েছেন, ঠিক তখনই পার্শ্ববর্তী তিউনেশিয়ার রাজধানী তিউনিশে সেøাগান উঠেছে ‘ফবমধমবষ’। অর্থাৎ ‘বের হয়ে যাও’। ফরাসি ভাষার ইংরেজি অনুবাদ করলে এমনটিই দাঁড়ায়। দু’বছর আগে তিউনিশের রাজপথ এভাবেই প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল বেন আলির বিরুদ্ধে। সাধারণ একজন ফল বিক্রেতা পওয়াফুজিজি আত্মহত্যা করে ‘বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন। এই বিপ্লব শুধু বেন আলি পতনকেই ত্বরান্বিত করেনি, বরং তিউনেশিয়ায় একটি ঐকমত্যের রাজনীতির সূচনা করেছিল। কিন্তু দু’বছরের মাথায় সেই ঐকমত্য এখন ফিকে হয়ে আসছে। গত পাঁচ মাসে দু’জন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ খুন হয়েছেন। সর্বশেষ খুন হলেন মোহাম্মদ ব্রাহিমি। একই সঙ্গে জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন ৯ সৈন্য। ব্রাহিমির মৃত্যু মানুষকে আবারও রাস্তায় নিয়ে এসেছে। তারা এখন সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদের দাবি, সরকার এক বছরের মাথায় একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে বলে ঘোষণা করলেও, তা তারা করেনি বা পারেনি। নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, তারিখ নির্ধারিত হয়নি। শুধু একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ও সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ দিয়ে চলছে দেশ। সরকারের এই ব্যর্থতাই সাধারণ মানুষকে আবারও রাস্তায় নামিয়ে এসেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী আলি লারায়েধ শেষ পর্যন্ত সংবিধান চূড়ান্তকরণ ও নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর সেখানে নির্বাচন। আর ২৩ আগস্টের মধ্যে সংবিধান চূড়ান্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতিতে সেখানকার উত্তপ্ত রাজনীতি কতটুকু শান্ত হবে বলা মুশকিল। তাই নিউনেশিয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল, শেষ পর্যন্ত তিউনেশিয়ার সেনাবাহিনী কি মিসরের সেনাবাহিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে? স্পষ্টতই মিসরের ঘটনাবলি পুরো আরব বিশ্বের দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছে। ‘আরব বসন্ত’ সেখানে গণতন্ত্র বিকাশের যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সেই সম্ভাবনা এখন ফিকে হয়ে আসছে। মিসরে গণতন্ত্র বিকাশের সম্ভাবনা এখন রহিত হয়ে গেল। তিউনেশিয়াও সেদিকেই যাচ্ছে। ইয়েমেনের অবস্থাও তেমনি। তাহলে ‘আরব বসন্ত’ কি ব্যর্থ হলো? গোটা আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বিকাশে মিসর ও তিউনেশিয়ার রাজনীতির উত্থান-পতন অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশেষ করে মিসর হচ্ছে কেন্দ্রবিন্দু। মিসরে গণতন্ত্র বিকশিত না হলে, গোটা আরব বিশ্বেই গণতন্ত্র হুমকির মুখে থাকবে।
মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রায় পাঁচ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে তা হচ্ছে, মিসর কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? সামরিক শাসকরা যে মিসরের সমাজে একটি বড় ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি’, তার ইতিহাস তো শুধু মুরসিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হলো না। বলা যেতে পারে, মিসরের সেনাবাহিনী ৬১ বছরে যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে করে এ সমাজ সামরিক বাহিনীনির্ভর একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তাÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সে দেশের অলিখিতভাবে ‘ছায়া রাষ্ট্রপতি’, আর লিখিতভাবে দেশরক্ষামন্ত্রী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি পরিষদ ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ হিসেবে কাজ করে। এটা আগেও ছিল, এখনও আছে। এমনকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এবং জনগণের ভোটে মুরসি সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও তিনি সেনাবাহিনীর এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। ‘প্রেসিডেন্ট’ মুরসি নিজে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দেশরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন জেনারেল সিসি মুরসির শাসনকালে। যে নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেখানে মুরসির কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন জেনারেল সিসি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ইলাহিÑ মাত্র দু’বছর সময় নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এই দু’বছর তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যাদের ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মুরসি। এই যুক্তিতে তার ‘বিচার’ হয়েছে এবং ১৫ দিনের ‘জেল’ হয়েছে। স্পষ্টতই বলা যায়, জেনারেল আবদেল ফাত্তাই এল সিসি হতে যাচ্ছেন মিসরের পরবর্তী ‘নেতা’। ইতিহাস বলে, মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরে সেনাবাহিনী সেই ক্ষমতাই পালন করতে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
জেনারেল সিসির পূর্বসূরিরা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন ‘লিবারেশন র্যালি’। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠিত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন’। উভয় ক্ষেত্রেই লিবারেশন, র্যালি ও ন্যাশনাল ইউনিয়ন একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদাত গঠন করেছিলেন আরব সোস্যালিস্ট ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে এটাকে ভেঙে গঠন করেছেন ‘নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন’। আর হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গেছেন। সুতরাং জেনারেল সিসি যে ক্ষমতা একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা আমার মনে হয় না।
তাহলে কোন পথে যাচ্ছে মিসর? মিসর থেকে যেসব খবরাখবর আসছে, তা কোনো আশার কথা বলছে না। মুরসির পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি জনমত রয়েছে। মুরসির সমর্থক মুসলিম ব্রাদারহুড লাখ লাখ লোকের জমায়েত করলে সেনাবাহিনী তাতে গুলি চালায়। এতে মারা যায় প্রায় ১৫২ জন। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট আবারও রক্তাক্ত হয়েছে কায়রোর রাজপথ। সেনাবাহিনীর চতুর্মুখী অভিযানে মুরসিপন্থীদের উৎখাত হতে হয়েছে দুটো ক্যাম্প থেকে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে মুসলিম ব্রাদারহুডের দাবি অনুযায়ী নিহত হয়েছে কমপক্ষে দু’হাজার এবং আহত অগণিত। তবে সরকারি ভাষ্য বলছে, নিহতের সংখ্যা দু’শতাধিক। এতে করে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছেÑ ‘সেনাবাহিনী’ কোনো মতেই আর মুরসিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনছে না। যদিও মুরসির সমর্থকদের দাবি এটাই। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়। সেনাবাহিনী কী এককভাবে কোনো একটি দল গঠন কিংবা পুনর্গঠিত করে নিজেরা ক্ষমতা পরিচালনা করবে! যেমনটি করেছিলেন আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারক?
ক্লাসিক্যাল সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী যা করে, তাই করেছে মিসরের সেনাবাহিনী। হাজেম এল বেবলাওইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার এই নিযুক্তি কিংবা মন্ত্রিসভায় যোগদানে মুসলিম ব্রাদারহুডের আপত্তি মিসরের এই সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করবে। মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। এমনকি তারা এই অভ্যুত্থানকে একটি সামরিক অভ্যুত্থান বলতেও রাজি ছিল না। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন কোনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে না। তাই তারা ওটাকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত না করে পরোক্ষভাবে সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। এটা তাদের রাজনীতির একটা বৈপরীত্য। আসলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন রীতিনীতি সমালোচিত হচ্ছে। মিসরের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেউ সমর্থন করেনি। আসলে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মিসরে এমন একটি সরকার দরকার, যে সরকার ইসরাইলের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবে। মুরসি তাদের জন্য একটা সমস্যা ছিল। তাই তাকে চলে যেতে হলো। আপতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের জন্য ৪টি এফ-১৬ বিমান সরবরাহ স্থগিত করেছে। এটা লোক দেখানো। এতে করে মিসরের ব্যাপারে তাদের স্ট্রাটেজির কোনো পরিবর্তন আসবে না। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দেয়। এর কোনো হেরফের হবে না।
মুরসির ব্যর্থতা আছে। কিন্তু যা সত্য তা হচ্ছে, আরবের সমাজ, সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। মিসরের জনগণ সামরিকতন্ত্রেই অভ্যস্ত। ইসলামী শক্তিগুলো, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল নূর পার্টির জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা ও দেশ শাসন এক নয়। যেখানে প্রয়োজন ছিল ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যের, তাতে মুরসি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার ব্যর্থতাই সামরিক বাহিনীকে এখানে নিয়ে এলো। ভুলে গেলে চলবে না, মিসরের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনী জড়িত। খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন, বিশুদ্ধ পানি, উৎপাদন ও সরবরাহ, রিয়েল স্টেটÑ এ ধরনের অনেক ব্যবসার সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই জড়িত। সুতরাং এই ‘শক্তি’কে অস্বীকার করা যাবে না। এটা ঠিক, মুসলিম ব্রাদারহুডের সমাজে একটা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবই মুরসিকে নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল। তবে তিনি ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর স্পিরিট অনুসরণ করেননি। এটা সত্য, ইসলামিক শক্তিগুলো এখনও সেনা সমর্থনকারী শক্তিকে সমর্থন করেনি। এখনও তারা তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তাতে করে সরকারের পতন ঘটবে না।
তিউনেশিয়া নিয়ে এই ভয়টা রয়েই গেল। সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হচ্ছে। মিসরেও তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। এই ইসলামী জঙ্গিরা এখন গোটা আরব বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য রীতিমতো হুমকি। আজ তাই তিউনেশিয়ায় যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে, তা যদি স্তিমিত না হয়, তাহলে তিউনেশিয়া অবধারিতভাবে বহন করবে মিসরের পরিণতি। আর এতে করে অনিবার্যভাবে স্তিমিত হবে গণতন্ত্রের বিকাশ।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রায় পাঁচ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে তা হচ্ছে, মিসর কি আদৌ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত? সামরিক শাসকরা যে মিসরের সমাজে একটি বড় ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি’, তার ইতিহাস তো শুধু মুরসিকে উৎখাত করার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হলো না। বলা যেতে পারে, মিসরের সেনাবাহিনী ৬১ বছরে যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে করে এ সমাজ সামরিক বাহিনীনির্ভর একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তাÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান সে দেশের অলিখিতভাবে ‘ছায়া রাষ্ট্রপতি’, আর লিখিতভাবে দেশরক্ষামন্ত্রী। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন একটি পরিষদ ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ হিসেবে কাজ করে। এটা আগেও ছিল, এখনও আছে। এমনকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এবং জনগণের ভোটে মুরসি সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও তিনি সেনাবাহিনীর এই প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। ‘প্রেসিডেন্ট’ মুরসি নিজে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ এল সিসিকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দেশরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন জেনারেল সিসি মুরসির শাসনকালে। যে নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেখানে মুরসির কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছিলেন জেনারেল সিসি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ইলাহিÑ মাত্র দু’বছর সময় নিয়েছিল সেনাবাহিনী। এই দু’বছর তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুতির ব্যাপারে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যাদের ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে, তাদের সমর্থন দিয়েছিলেন মুরসি। এই যুক্তিতে তার ‘বিচার’ হয়েছে এবং ১৫ দিনের ‘জেল’ হয়েছে। স্পষ্টতই বলা যায়, জেনারেল আবদেল ফাত্তাই এল সিসি হতে যাচ্ছেন মিসরের পরবর্তী ‘নেতা’। ইতিহাস বলে, মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরে সেনাবাহিনী সেই ক্ষমতাই পালন করতে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
জেনারেল সিসির পূর্বসূরিরা দল গঠন করে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। ১৯৫৩-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন ‘লিবারেশন র্যালি’। ১৯৫৭-৭০ সময়সীমায় গঠিত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন’। উভয় ক্ষেত্রেই লিবারেশন, র্যালি ও ন্যাশনাল ইউনিয়ন একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদাত গঠন করেছিলেন আরব সোস্যালিস্ট ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে এটাকে ভেঙে গঠন করেছেন ‘নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন’। আর হোসনি মোবারকও একই পথ অনুসরণ করে গেছেন। সুতরাং জেনারেল সিসি যে ক্ষমতা একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবেন, এটা আমার মনে হয় না।
তাহলে কোন পথে যাচ্ছে মিসর? মিসর থেকে যেসব খবরাখবর আসছে, তা কোনো আশার কথা বলছে না। মুরসির পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি জনমত রয়েছে। মুরসির সমর্থক মুসলিম ব্রাদারহুড লাখ লাখ লোকের জমায়েত করলে সেনাবাহিনী তাতে গুলি চালায়। এতে মারা যায় প্রায় ১৫২ জন। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট আবারও রক্তাক্ত হয়েছে কায়রোর রাজপথ। সেনাবাহিনীর চতুর্মুখী অভিযানে মুরসিপন্থীদের উৎখাত হতে হয়েছে দুটো ক্যাম্প থেকে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে মুসলিম ব্রাদারহুডের দাবি অনুযায়ী নিহত হয়েছে কমপক্ষে দু’হাজার এবং আহত অগণিত। তবে সরকারি ভাষ্য বলছে, নিহতের সংখ্যা দু’শতাধিক। এতে করে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছেÑ ‘সেনাবাহিনী’ কোনো মতেই আর মুরসিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনছে না। যদিও মুরসির সমর্থকদের দাবি এটাই। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়। সেনাবাহিনী কী এককভাবে কোনো একটি দল গঠন কিংবা পুনর্গঠিত করে নিজেরা ক্ষমতা পরিচালনা করবে! যেমনটি করেছিলেন আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারক?
ক্লাসিক্যাল সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী যা করে, তাই করেছে মিসরের সেনাবাহিনী। হাজেম এল বেবলাওইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার এই নিযুক্তি কিংবা মন্ত্রিসভায় যোগদানে মুসলিম ব্রাদারহুডের আপত্তি মিসরের এই সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করবে। মিসরের সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। এমনকি তারা এই অভ্যুত্থানকে একটি সামরিক অভ্যুত্থান বলতেও রাজি ছিল না। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন কোনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করে না। তাই তারা ওটাকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত না করে পরোক্ষভাবে সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। এটা তাদের রাজনীতির একটা বৈপরীত্য। আসলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন রীতিনীতি সমালোচিত হচ্ছে। মিসরের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেউ সমর্থন করেনি। আসলে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মিসরে এমন একটি সরকার দরকার, যে সরকার ইসরাইলের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবে। মুরসি তাদের জন্য একটা সমস্যা ছিল। তাই তাকে চলে যেতে হলো। আপতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের জন্য ৪টি এফ-১৬ বিমান সরবরাহ স্থগিত করেছে। এটা লোক দেখানো। এতে করে মিসরের ব্যাপারে তাদের স্ট্রাটেজির কোনো পরিবর্তন আসবে না। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দেয়। এর কোনো হেরফের হবে না।
মুরসির ব্যর্থতা আছে। কিন্তু যা সত্য তা হচ্ছে, আরবের সমাজ, সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। মিসরের জনগণ সামরিকতন্ত্রেই অভ্যস্ত। ইসলামী শক্তিগুলো, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল নূর পার্টির জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা ও দেশ শাসন এক নয়। যেখানে প্রয়োজন ছিল ব্যাপকভিত্তিক ঐকমত্যের, তাতে মুরসি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার ব্যর্থতাই সামরিক বাহিনীকে এখানে নিয়ে এলো। ভুলে গেলে চলবে না, মিসরের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনী জড়িত। খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন, বিশুদ্ধ পানি, উৎপাদন ও সরবরাহ, রিয়েল স্টেটÑ এ ধরনের অনেক ব্যবসার সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই জড়িত। সুতরাং এই ‘শক্তি’কে অস্বীকার করা যাবে না। এটা ঠিক, মুসলিম ব্রাদারহুডের সমাজে একটা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবই মুরসিকে নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল। তবে তিনি ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর স্পিরিট অনুসরণ করেননি। এটা সত্য, ইসলামিক শক্তিগুলো এখনও সেনা সমর্থনকারী শক্তিকে সমর্থন করেনি। এখনও তারা তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তাতে করে সরকারের পতন ঘটবে না।
তিউনেশিয়া নিয়ে এই ভয়টা রয়েই গেল। সেখানে ইসলামী জঙ্গিরা শক্তিশালী হচ্ছে। মিসরেও তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। এই ইসলামী জঙ্গিরা এখন গোটা আরব বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য রীতিমতো হুমকি। আজ তাই তিউনেশিয়ায় যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে, তা যদি স্তিমিত না হয়, তাহলে তিউনেশিয়া অবধারিতভাবে বহন করবে মিসরের পরিণতি। আর এতে করে অনিবার্যভাবে স্তিমিত হবে গণতন্ত্রের বিকাশ।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment