সিরিয়ায় ‘সীমিত’ আক্রমণের বিষয়টি এখন বোধকরি একরকম নিশ্চিত। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের পর মার্কিন মিডিয়ায় এখন দিনক্ষণ গোনা শুরু হয়ে গেছে কখন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে ক্রুস মিসাইল নিক্ষেপ করে এ আক্রমণ চালানো হবে। এরই মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে চারটি মার্কিন ডেসট্রয়ার এবং সাইপ্রাসের এক্রোটিরি ব্রিটিশ বিমানঘাঁটিতে বেশ কিছু ব্রিটিশ বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিমান আক্রমণ পরিচালনার জন্য। বলা ভালো, সাইপ্রাসের এ বিমানঘাঁটি থেকে সিরিয়ার দূরত্ব মাত্র ১৫০ মাইল। সিরিয়ার বিরুদ্ধে সর্বশেষ যে অভিযোগটি উঠেছে তা হচ্ছে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার। অভিযোগ উঠেছে, সিরিয়ার সৈন্যরা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এ অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যুর ঘটনাটি সত্য এবং জাতিসংঘের তদন্তকারী দল এর সত্যতা খুঁজে পেলেও তদন্তকারী দল বলেনি এ ঘটনাটি সিরিয়ার সৈন্যরাই করেছে। যদিও সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ঘটনায় সিরিয়ার সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে স্পষ্টতই এ হত্যাকাণ্ড বহির্বিশ্বে সিরিয়ার ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। শুধু পশ্চিমা বিশ্বই নয়, বরং সৌদি আরব, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এবং তুরস্কও আজ সিরিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া এখন অনেকটা একা।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ২৯ মাস ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন এক নতুন দিকে টার্ন নিয়েছে। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির অবনতি হল এমন একটা সময়, যখন মিসরে সেনাবাহিনী নির্বাচিত ইসলামপন্থী একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এমনকি তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের পরিস্থিতিও টলটলায়মান। ‘আরব বসন্ত’ যে ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছিল, সেই প্রত্যাশা এখন ফিকে হয়ে আসছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এ অঞ্চলে বৃহৎ শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এর আগে তিন-তিনবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী কুয়েতকে ইরাকি বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে এ অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ‘মানবতা রক্ষায়’ হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এবারও তেমনটি হতে যাচ্ছে।
লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশনে’র তত্ত্বটি। আর এবার ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্ট’ তত্ত্ব। এর মূল কথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব। যেহেতু সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে(?), সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এ সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলী সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতিসংঘ সনদে উল্লেখ আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এমন কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে, সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রে (২০১১) এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটা সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্টে’র একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়। এর অর্থ হচ্ছে, সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে অধ্যাপক গ্লেননের একটি বই রয়েছে- ‘লিমিটস অব ল’, প্রিরোগেটিভ্স অব পাওয়ার’। এ গ্রন্থে গ্লেনন উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।
বিশ্বশক্তি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার স্বার্থ রয়েছে, সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ‘মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ’ কিংবা ‘মানবতা রক্ষায় দায়িত্বশীলতা’র যে যুক্তি সামরিক হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, আফ্রিকার বরুন্ডি-রুয়ান্ডায় গণহত্যা বন্ধে কিংবা কসোভোতে গণহত্যা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা-বরুন্ডিতে হুতু-তুতসি দ্বন্দ্ব ও গণহত্যায় কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। কসোভোতে ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের একপর্যায়ে, শেষের দিকে, ন্যাটোর বিমানবহর সার্বিয়ার সেনা ঘাঁটির ওপর বিমান হামলা চালালেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ সংকটে হস্তক্ষেপ করেনি। আজ সিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তা করতে যাচ্ছে। কারণ এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা ওয়াশিংটনে অবস্থিত একটি গবেষণা সংস্থা দ্য প্রোজেক্ট ফর দ্য নিউ অ্যামেরিকান সেঞ্চুরি কর্তৃক (১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ ‘গ্লোবাল ইউএস এম্পায়ার : রিবিল্ডিং অ্যামেরিকা’স ডিফেন্সেস- স্ট্রাটেজি, ফোর্সেস অ্যান্ড রিসোর্সেস ফর এ নিউ সেঞ্চুরি’ পড়ে দেখতে পারেন।
সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বিমান হামলা ‘সীমিত’ সময়ের জন্য পরিচালিত হবে বলে বলা হচ্ছে। এ বিমান হামলা পরিচালিত হবে সিরিয়ার সেনাঘাঁটিকে কেন্দ্র করে এবং তা সীমাবদ্ধ থাকবে কয়েক দিন মাত্র। এ হামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে সিরিয়ার সরকারকে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ‘শাস্তি’ দেয়া। এতে করে বাশার কতটুকু ‘শাস্তি’ পাবেন, তা এক ভিন্ন প্রশ্ন। এ হামলা নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে উৎসাহ জোগাবে। এমনকি এ বিমান হামলা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট বাশারের ক্ষমতাচ্যুতিও বিচিত্র কিছু নয়। তবে এ হামলা সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে নানা জটিলতা ও সংকট তৈরি করতে পারে। প্রথমত, এ যুদ্ধ শুধু যে সিরিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। বরং এ যুদ্ধে লেবানন ও তুরস্ক জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে করে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার শরণার্থীদের মাঝে। বর্তমানে শরণার্থীর যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এ রকম : তুরস্কে ৪ লাখ, লেবাননে ৭ লাখ, বেক্কা উপত্যকায় ২ লাখ ৪০ হাজার, বৈরুতে ১ লাখ ৬০ হাজার, ইরাকে ১ লাখ ৫০ হাজার, জর্দানে ৫ লাখ, মিসরে ১ লাখ ১০ হাজার। এ শরণার্থীরা একটা বড় সমস্যা তৈরি করবে আগামীতে। দ্বিতীয়ত, সিরিয়া জাতিগতভাবে ভাগ হয়ে যেতে পারে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মতো পরিস্থিতি বরণ করতে পারে সিরিয়া। তৃতীয়ত, সিরিয়ায় আক্রমণ আগামীতে ইরানে সম্ভাব্য হামলায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের উৎসাহ জোগাতে পারে। চতুর্থত, এ ধরনের একটি হামলায় ইসরাইল খুশি হবে সবচেয়ে বেশি। ইসরাইলের স্বার্থ এতে করে রক্ষিত হবে। বলা ভালো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে ইসরাইল আতংকিত। একই সঙ্গে সিরিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো নয় ইসরাইলের। পঞ্চমত, এ হামলার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। ষষ্ঠত, বাশারের অবর্তমানে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়বে বিদ্রোহীরা। আর তাতে করে সুবিধা নেবে আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল নুসরা ফ্রন্ট ও ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সংগঠন দুটি। এরা এরই মধ্যে সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই হামলা এ দুটি সংগঠনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়া ও সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাকে এ রকমটি আমরা লক্ষ্য করেছি।
সিরিয়ায় সম্ভাব্য মার্কিন আগ্রাসন সিরিয়া সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের একটি সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবেন। এ সিদ্ধান্তটি তিনি হয়তো পাবেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ‘যুদ্ধ’ বিশ্বে বিশেষ করে আরব বিশ্বে তার অবস্থানকে দুর্বল করবে। এক ধরনের ‘আমেরিকা বিদ্বেষে’র জš§ হবে এ অঞ্চলে। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। ‘আরব বসন্ত’ যে সম্ভাবনার জš§ দিয়েছিল, তার মৃত্যু ঘটবে। ‘যুদ্ধ’ সিরিয়া সমস্যার কোনো সমাধান নয়।
অস্টিন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd-yahoo.com - See more at: http://jugantor.com/window/2013/08/31/24745#sthash.k7C4rLkN.dpuf
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ২৯ মাস ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন এক নতুন দিকে টার্ন নিয়েছে। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির অবনতি হল এমন একটা সময়, যখন মিসরে সেনাবাহিনী নির্বাচিত ইসলামপন্থী একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এমনকি তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের পরিস্থিতিও টলটলায়মান। ‘আরব বসন্ত’ যে ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছিল, সেই প্রত্যাশা এখন ফিকে হয়ে আসছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এ অঞ্চলে বৃহৎ শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এর আগে তিন-তিনবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক বাহিনী কুয়েতকে ইরাকি বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করেছিল। ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে এ অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বাগদাদে মিসাইল হামলা চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১১ সালে লিবিয়ায়। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ‘মানবতা রক্ষায়’ হস্তক্ষেপ করেছিল এবং গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে কুয়েতকে ইরাকি দখলমুক্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০০৩ ও ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এবারও তেমনটি হতে যাচ্ছে।
লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়েছিল ‘হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশনে’র তত্ত্বটি। আর এবার ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্ট’ তত্ত্ব। এর মূল কথা হচ্ছে, মানবতা রক্ষায় বিশ্বশক্তির দায়িত্ব। যেহেতু সিরিয়ায় সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে(?), সেহেতু সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পশ্চিমা শক্তি দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই এ সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে! এখানে বলা ভালো, সিরিয়ার ঘটনাবলী সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতিসংঘ সনদে উল্লেখ আছে, একটি দেশ অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি এমন কোনো ঘটনার জন্ম হয় যে, সেখানে স্থিতিশীলতা ও গণহত্যা রোধে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে কাজটি করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। ইরাকের (২০০৩) ক্ষেত্রে কিংবা লিবিয়ার ক্ষেত্রে (২০১১) এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়নি নিরাপত্তা পরিষদ। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এটা সত্য, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্টে’র একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি এবং এটা কোনো আন্তর্জাতিক আইনও নয়। এর অর্থ হচ্ছে, সিরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে অধ্যাপক গ্লেননের একটি বই রয়েছে- ‘লিমিটস অব ল’, প্রিরোগেটিভ্স অব পাওয়ার’। এ গ্রন্থে গ্লেনন উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।
বিশ্বশক্তি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার স্বার্থ রয়েছে, সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। ‘মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ’ কিংবা ‘মানবতা রক্ষায় দায়িত্বশীলতা’র যে যুক্তি সামরিক হস্তক্ষেপের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, আফ্রিকার বরুন্ডি-রুয়ান্ডায় গণহত্যা বন্ধে কিংবা কসোভোতে গণহত্যা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা-বরুন্ডিতে হুতু-তুতসি দ্বন্দ্ব ও গণহত্যায় কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। কসোভোতে ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের একপর্যায়ে, শেষের দিকে, ন্যাটোর বিমানবহর সার্বিয়ার সেনা ঘাঁটির ওপর বিমান হামলা চালালেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ সংকটে হস্তক্ষেপ করেনি। আজ সিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তা করতে যাচ্ছে। কারণ এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা ওয়াশিংটনে অবস্থিত একটি গবেষণা সংস্থা দ্য প্রোজেক্ট ফর দ্য নিউ অ্যামেরিকান সেঞ্চুরি কর্তৃক (১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ ‘গ্লোবাল ইউএস এম্পায়ার : রিবিল্ডিং অ্যামেরিকা’স ডিফেন্সেস- স্ট্রাটেজি, ফোর্সেস অ্যান্ড রিসোর্সেস ফর এ নিউ সেঞ্চুরি’ পড়ে দেখতে পারেন।
সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য বিমান হামলা ‘সীমিত’ সময়ের জন্য পরিচালিত হবে বলে বলা হচ্ছে। এ বিমান হামলা পরিচালিত হবে সিরিয়ার সেনাঘাঁটিকে কেন্দ্র করে এবং তা সীমাবদ্ধ থাকবে কয়েক দিন মাত্র। এ হামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে সিরিয়ার সরকারকে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ‘শাস্তি’ দেয়া। এতে করে বাশার কতটুকু ‘শাস্তি’ পাবেন, তা এক ভিন্ন প্রশ্ন। এ হামলা নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীকে উৎসাহ জোগাবে। এমনকি এ বিমান হামলা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট বাশারের ক্ষমতাচ্যুতিও বিচিত্র কিছু নয়। তবে এ হামলা সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে নানা জটিলতা ও সংকট তৈরি করতে পারে। প্রথমত, এ যুদ্ধ শুধু যে সিরিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। বরং এ যুদ্ধে লেবানন ও তুরস্ক জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে করে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার শরণার্থীদের মাঝে। বর্তমানে শরণার্থীর যে সংখ্যা পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এ রকম : তুরস্কে ৪ লাখ, লেবাননে ৭ লাখ, বেক্কা উপত্যকায় ২ লাখ ৪০ হাজার, বৈরুতে ১ লাখ ৬০ হাজার, ইরাকে ১ লাখ ৫০ হাজার, জর্দানে ৫ লাখ, মিসরে ১ লাখ ১০ হাজার। এ শরণার্থীরা একটা বড় সমস্যা তৈরি করবে আগামীতে। দ্বিতীয়ত, সিরিয়া জাতিগতভাবে ভাগ হয়ে যেতে পারে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মতো পরিস্থিতি বরণ করতে পারে সিরিয়া। তৃতীয়ত, সিরিয়ায় আক্রমণ আগামীতে ইরানে সম্ভাব্য হামলায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের উৎসাহ জোগাতে পারে। চতুর্থত, এ ধরনের একটি হামলায় ইসরাইল খুশি হবে সবচেয়ে বেশি। ইসরাইলের স্বার্থ এতে করে রক্ষিত হবে। বলা ভালো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে ইসরাইল আতংকিত। একই সঙ্গে সিরিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো নয় ইসরাইলের। পঞ্চমত, এ হামলার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। ষষ্ঠত, বাশারের অবর্তমানে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়বে বিদ্রোহীরা। আর তাতে করে সুবিধা নেবে আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল নুসরা ফ্রন্ট ও ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সংগঠন দুটি। এরা এরই মধ্যে সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই হামলা এ দুটি সংগঠনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়া ও সাদ্দাম-পরবর্তী ইরাকে এ রকমটি আমরা লক্ষ্য করেছি।
সিরিয়ায় সম্ভাব্য মার্কিন আগ্রাসন সিরিয়া সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের একটি সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবেন। এ সিদ্ধান্তটি তিনি হয়তো পাবেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ‘যুদ্ধ’ বিশ্বে বিশেষ করে আরব বিশ্বে তার অবস্থানকে দুর্বল করবে। এক ধরনের ‘আমেরিকা বিদ্বেষে’র জš§ হবে এ অঞ্চলে। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। ‘আরব বসন্ত’ যে সম্ভাবনার জš§ দিয়েছিল, তার মৃত্যু ঘটবে। ‘যুদ্ধ’ সিরিয়া সমস্যার কোনো সমাধান নয়।
অস্টিন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd-yahoo.com - See more at: http://jugantor.com/window/2013/08/31/24745#sthash.k7C4rLkN.dpuf
0 comments:
Post a Comment