রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ওবামার ভারত সফর ও প্রসঙ্গ কথা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন এবং জানুয়ারিতে রিপাবলিকান ডে অনুষ্ঠানে নয়াদিল্লিতে উপস্থিত থাকবেন। হোয়াইট হাউস বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বলা ভালো, সেপ্টেম্বরে (২০১৪) মোদি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর তিনি বারাক ওবামার আমন্ত্রণে ওয়াশিংটন যান এবং ওবামার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মিলিত হন। তখন মোদি তাকে নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানান। ওবামা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ওবামা এর আগেও নয়াদিল্লি সফর করেছেন। ২০১৫ সালের প্রথমদিকে তিনি আবারও যাবেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পরিস্থিতি যা তাতে রিপাবলিকানদের পাল্লা ভারি। মধ্যবর্তী নির্বাচনে (নভেম্বর ২০১৪) রিপাবলিকানদের ভরাডুবি ঘটেছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে ওবামা যখন ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান, তখন অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়। এক. যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নিম্নের অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ল্যাটিন আমেরিকাও তেমন গুরুত্ব পায়নি। দুই. এর আগে ওবামা চীন সফরে গিয়েছিলেন। কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের ব্যাপারে চীন-যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তি হয়েছে সত্য; কিন্তু অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। তিন. ভারত ও চীন বিশ্বের উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। এ দুই শক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করবে। চীন ও ভারত উভয়েই এশিয়ার উঠতি শক্তি। মোদি নিজে একদিকে চীন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। সেপ্টেম্বরে তার যুক্তরাষ্ট্র সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ তিন সরকারের (চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যকার সম্পর্ক বেশ কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের মাঝে আলোচিত হতে থাকবে। একদিকে চীন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র উভয় শক্তির পাশে ভারসাম্য রক্ষা করে ভারতের স্বার্থ মোদি কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, ভারত ও চীন উভয়ই 'ব্রিকস' এর সদস্য। 'ব্রিকস' সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে একটি ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার, যা ২০১৬ সাল থেকে কাজ শুরু করার কথা। উপরন্তু চীন নতুন করে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় (২০১৪) একই সময়ে তিনি মালদ্বীপ ও শ্র্রীলঙ্কাও সফর করেছেন। এ দুটি দেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানেও আসার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি পাকিস্তানে যাননি বটে। কিন্তু চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চীন সফর করে এসেছেন। এ অবস্থায় এটা বোঝা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ বাড়ছে। ওয়াশিংটন এটা যে বোঝে না, তা নয়। এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে হলে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের 'দূরত্ব' কমাতে হবে। ওবামা প্রশাসনের কাছে মোদির গুরুত্ব তাই অনেক বেশি। এরই মধ্যে আফগানিস্তানে একজন নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় আরও বেশ কিছু দিনের জন্য মার্কিনি সৈন্য রাখতে চান। এ ধরনের একটি চুক্তি করতে বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তখন একটি নয়া নিরাপত্তা চুক্তি ও ভারতীয় ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা হয়। এটা অনেকেই জানেন, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছে ভারত আফগানিস্তানে একটি বড় ভূমিকা পালন করুন। আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে কিংবা শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, আফগানিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে। এখন মোদি মার্কিনি স্বার্থ রক্ষা করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আরও বড় কোনো কর্মসূচি নেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। ফলে ওয়াশিংটনে মোদি-ওবামা শীর্ষ বৈঠক যে অনেকের কাছেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রতিরক্ষা খাতে ১০ বছর মেয়াদি যে সহযোগিতা চুক্তি তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। দুই দেশের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত। সমুদ্র নিরাপত্তার ব্যাপারে দুই দেশের মনোভাব এক ও অভিন্ন। এ ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, সে ব্যাপারেও চুক্তি হয়েছে। আজমীর, আহমেদাবাদ শহর আর বিশাখাপত্তম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। সেইসঙ্গে ভারতের ছোট ছোট ৫০০ শহরে 'সোলার এনার্জি' চালু করবে যুক্তরাষ্ট্র। বেসরকারি খাতে এখানে বিনিয়োগ বাড়বে। সন্ত্রাস দমনেও দুই দেশের মনোভাব এক। লস্কর-ই-তৈয়্যেবা, জয়স-ই-মোহাম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়নের ব্যাপারটি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। এ জঙ্গি সংগঠনে অর্থায়ন বন্ধে দুই দেশই কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে। বেসরকারি খাতে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যাপারে দুই দেশ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে কোনো কোনো ইস্যুতে ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি ওবামা প্রশাসন। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠী। ইসলামিক স্টেটের আগ্রাসন রোধে ১৫ দেশীয় যে আন্তর্জাতিক একটি অ্যালায়েন্স গঠিত হয়েছে ওবামা প্রশাসন চেয়েছিল ভারত সেই অ্যালায়েন্সে যোগ দিক। কিন্তু ভারত তাতে রাজি হয়নি। যদিও খোদ ভারতের নিরাপত্তাও আজ হুমকির মুখে। আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে এ শাখার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে যে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে সুনি্ন জঙ্গি গোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট'র উত্থান ও আরব দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন গঠিত হলেও ভারত এতে যোগ না দেয়ায় নিশ্চয়ই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ভারত আরব রাষ্ট্র নয়। তবে ভারতে মুসলমান ধর্মাবলম্বী এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। মুসলমানদের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক ভালো, তা বলা যাবে না। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদি নিজে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই দাঙ্গায় প্রায় ১ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। সম্ভবত মার্কিনি চাপ উপেক্ষা করে যে কোনো আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দিয়ে মোদি সম্ভবত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন। আর তা হচ্ছে, আইএস'র (ইসলামিক স্টেট) বিষয়টি আরব বিশ্বের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কোনো অংশ হতে পারে না। উপরন্তু এতে করে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন বার্তা পেঁৗছে যেতে পারে। ভারত এক্ষেত্রে একটি 'নিরপেক্ষ' অবস্থানই গ্রহণ করেছে। ভারতের এ ভূমিকাকে অনেকেই সমর্থন করবেন। ভারত যে মার্কিনি স্বার্থে সব সময় কাজ করে না, এটা আবারও প্রমাণিত হলো। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। শুধু জঙ্গি দমনে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি একটি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তির ব্যাপারে মোদি কোনো 'কমিটমেন্ট' করেননি। মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন- এমন অভিমত ভারতের নীতিনির্ধারকদের। অন্যদিকে টিপিপি চুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে এখনও উপনীত হয়নি। টিপিপিতে ভারতের অংশগ্রহণ বা না থাকা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কেননা এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এতে ভারতের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে তা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইবে। এ জন্যই ওবামার ভারত সফর। ওবামা মিয়ানমারও সফর করেছেন। এখন মোদি সরকারে যদি অতি মাত্রায় মার্কিনি-ভীতি কাজ করে তবেই চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। এতে করে নতুন স্নায়ুযুদ্ধেই এরা জয়ী হতে পারে। মার্কিন নীতি এমনই আগ্রাসী হয়ে উঠছে। ইউক্রেন কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব রয়েছে। রাশিয়াকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলার অংশ হিসেবেই ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ন্যাটোর ৫নং ধারাবলে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ইউক্রেনে রাশিয়ার সম্ভাব্য সামরিক হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা বলে গণ্য করা হয়। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে 'অবিশ্বাসের' জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্নে নতুন কিছু খুঁজতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং চীন-যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে অনেকের। মোদির ওয়াশিংটন সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গভীর করেছিল। আর এখন ওবামা আসছেন ভারতে। এ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগর এলাকায় তার নজরদারি বাড়িয়েছে। প্যাসিফিক এলাকা থেকে ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ সরিয়ে এনে যুক্তরাষ্ট্র তা ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করবে। ২০১৭ সালের মধ্যে এ মোতায়েন সম্পন্ন হবে। ফলে আগামী দিনগুলোতে ভারত মহাসাগর যে 'উত্তপ্ত' হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আওতায় বাংলাদেশও পড়ে। বাংলাদেশ ওই সম্পর্কের বাইরে থাকতে পারে না। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে তার পলিসি প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ ওই সম্পর্কের বাইরে থাকতে পারে না। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যে ভালো, তা বলা যাবে না। নানা ইস্যুতে সম্পর্ক আগের মতো নেই। বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের মাঝে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি কমিয়ে আনা প্রয়োজন। শীর্ষ পর্যায়ে কোনো মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ ভ্রমণ করেননি। ওবামা বাংলাদেশ সফর করবেন-এমন প্রত্যাশা ছিল অনেকের। দুই দুইবার পাশের দেশ মিয়ানমারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসছেন। ভারতেও আসছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এ তালিকায় বাদ পড়ল। এমনকি ভাইস প্রেসিডেন্ট কিংবা সেক্রেটারি অব স্টেটের বাংলাদেশ সফরও তাদের কার্যতালিকায় নেই। যুক্তরাষ্ট্র নীতিতে এ ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। দুই দেশের মাঝে বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য নেই, তা সত্য। তবে জিএসপি সুবিধা না পাওয়ায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর খুশি নন। অন্যদিকে মার্কিন অনুরোধ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে আইএসবিরোধী কোনো জোটে যোগ দেয়নি। সব মিলিয়ে আমাদের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। আগামীতে ভারত সফরের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া যায়। নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়টির দিকে নজর দিতে পারেন। মোদ্দাকথা, ওবামার আগামী ভারত সফর থেকে বাংলাদেশও ফায়দা ওঠাতে পারে। তবে ভারতের 'কৌশল'ও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে এক ধরনের ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করছে। এটাই আমাদের জন্য একটি 'শিক্ষা'। Daily Alokito Bangladesh 01.12.14

বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় জঙ্গিবাদের স্বরূপ

সম্প্রতি জঙ্গিবাদ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়। এগুলো দেশের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। ভারতের বর্ধমানের খগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বলা হয়, বাংলাদেশের ইসলামপন্থী জঙ্গিরা এর সঙ্গে জড়িত। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদিনকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হল। তারপর ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশে এলেন। তারা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। মতবিনিময়কালে বাংলাদেশ ভারতীয় পক্ষকে ১০ জঙ্গি ও ৪৯ জন সন্ত্রাসীর একটি তালিকা দিয়েছে, যারা পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে অবৈধভাবে বসবাস করছে। তৃতীয় খবরটি এলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সূচক ২০১৪ প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশ করেছে ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস নামে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সূচক ২০১৪-এ ১৬২টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ নম্বরে।
এ তিনটি ঘটনাকে যদি একসঙ্গে মেলান যায়, তাহলে কতগুলো প্রশ্ন ওঠে। এক. বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আছে, এর অস্তিত্ব আছে এবং জঙ্গিরা বাংলাদেশের বাইরে ভারতেও তৎপর। এ ঘটনা বাংলাদেশের ইমেজের জন্য খারাপ। এতে করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নজরদারিতে চলে যাবে এবং আগামীতে বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক চাপ আরও বাড়বে। দুই. তিনটি জঙ্গি সংগঠনের কথা মোটামুটিভাবে আমরা জানি এবং এদের তৎপরতা সীমিত আকারে হলেও আছে। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম এবং আনসারুল্লাহ বাংলাটিম। এদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা গেছে, এটা বলা যাবে না। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এদের তৎপরতার খবর মাঝে-মধ্যে সংবাদপত্রে ছাপা হয় এখনও। এখানে বাংলাদেশের পুলিশ তথা গোয়েন্দাদের ভূমিকার প্রশ্নটি চলে আসে। তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, এই প্রশ্নটিও আছে। সরকার পুলিশ প্রশাসনের জন্য অনেক কিছু করেছে। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে সিনিয়র পদ অনেক বাড়ানো হয়েছে। এতে করে কি তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো গেছে? জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল দরকার। এখানে বেশ ঘাটতি আছে। এ বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
একসময় র‌্যাব যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইকে গ্রেফতারের কৃতিত্ব র‌্যাবের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাবের কর্মকাণ্ড (সন্ত্রাস দমনে) তেমন চোখে পড়ে না। র‌্যাবকে অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপরন্তু র‌্যাবের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আসরেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে র‌্যাবকে দিয়ে জঙ্গি দমনের বিষয়টি এখন আর তেমনভাবে আলোচিত হয় না।
দুই. বাংলাদেশের জঙ্গিরা এখন পশ্চিমবঙ্গে তৎপর! এ খবরটি ভারতীয় গোয়েন্দাদের। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের বর্ধমানে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশ যদি ভারতীয় গোয়েন্দাদের বক্তব্যকে স্বীকার করে নেয়, তাহলে বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় চাপ আরও বাড়বে। একসময় ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশে এসে কাজ শুরু করবে! এতে করে বাংলাদেশের জঙ্গি দমনের ব্যর্থতা (?) প্রশ্নের মুখে থাকবে। বাংলাদেশের উচিত বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত করা। তবে ভারতে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা আছে, বসবাস করে, এটা মোটামুটিভাবে স্পষ্ট। নিশ্চয়ই এসব সন্ত্রাসীর সঙ্গে ভরতীয় সন্ত্রাসীদের একটা যোগসূত্র আছে। এই যোগসূত্রটি ভেঙে দিতে হবে। বাংলাদেশের জঙ্গিরা ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। সীমান্ত অতিক্রম করা কঠিন কিছু নয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা সৎ নন। তাদের ম্যানেজ করা কঠিন কিছু নয়। উপরন্তু চোরাকারবারিরাও রয়েছে। এদের ম্যানেজ করে বাংলাদেশের জঙ্গিরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে পারে। এটা স্বাভাবিক। এখন বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের উচিত হবে তৎপরতা বাড়ানো।
তিন. জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ ও ভারতের খোলামন নিয়ে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এই সহযোগিতায় যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে না। এক পর্যায়ে ভারত বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াবে এবং সুবিধা আদায় করে নিতে চাইবে। যা কি-না যে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য ভালো খবর নয়।
চার. বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা দমনের স্বার্থে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম প্রশ্নে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন। না হলে জঙ্গিরা এর সুযোগ নেবে। এ মুহূর্তে যে সংসদ কার্যক্রম রয়েছে, তার ভূমিকা নিয়ে জনমনে ও বুদ্ধিজীবী সার্কেলে নানা প্রশ্ন আছে। সংসদ কার্যকর নয়- এটা জাতীয় পার্টিও স্বীকার করে। বিএনপি বড় দল। সংসদে না থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে এ দলটির ভূমিকা বড় ও ব্যাপক। সন্ত্রাস দমনে বিএনপিরও একটি ভূমিকা আছে। এ ভূমিকাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়ে সরকারের উচিত বিএনপির সঙ্গে একটা সহাবস্থান গড়ে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, সন্ত্রাসবাদ দমনে ও জঙ্গি উৎখাতে বিএনপি আন্তরিক। এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি জঙ্গি দমনে এক হয়, তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই দুটি দলের মাঝে বিভক্তি ও বিদ্বেষ এত বেশি যে, এর সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা। তারা সংগঠিত হচ্ছে। সুতরাং বড় দল দুটির মাঝে সমঝোতা দরকার।
পাঁচ. জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থান জঙ্গিবাদে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। এদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের যোগাযোগ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। তবে আল কায়দার উপমহাদেশীয় শাখা ইতিমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার নিয়ে এ শাখা গঠিত। এদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কোনো খবর আমাদের জানা নেই। তবে আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এরা সংগঠিত হচ্ছে। ভারতে ইসলামী জঙ্গিরা রয়েছে। এদের তৎপরতার খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এদের সঙ্গে আল কায়দা কিংবা আইএসের সম্পর্ক কী, তা এখন খতিয়ে দেখার বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ কাজটি করা অত্যন্ত জরুরি। তবে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন আল কায়দা ও আইএসের মধ্যে নীতিগতভাবে ও জঙ্গি তৎপরতার দিক দিয়ে পার্থক্য রয়েছে। আইএস যেখানে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছে এবং ইতিমধ্যে ইরাক-সিরিয়ার একটি বিশাল এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে (সুন্নিস্তান), সেখানে আল কায়দা এখনও গেরিলা কায়দায় তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। আইএসের মতো তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনীও নেই। এ দুই সশস্ত্র গ্র“পের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। উপরন্তু আল কায়দার সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্পর্ক বা তাদের শাখা থাকলেও আইএসের শাখা নেই। এমনকি পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়ার মতো দেশে যেখানে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে, সেখানে আইএসের কোনো শাখা নেই। সুতরাং বাংলাদেশ বা ভারতে আইএস এ মুহূর্তে কোনো শাখা নাও খুলতে পারে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের উত্থানে উৎসাহিত হবে, এটা স্বাভাকি। সব জঙ্গির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাই জরুরি।
আল কায়দা তার জঙ্গি তৎপরতা পরিচালিত করে সীমিত জায়গায় সংগঠিত হয়ে, যাকে বিশ্লেষকরা স্পাইডার ওয়েভ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাকড়সা যেভাবে ছোট জায়গায় জাল বোনে এবং ওই জাল ভেঙে গেলে আবার অন্যত্র গিয়ে জাল বোনে, আল কায়দার স্ট্র্যাটেজি অনেকটা তেমনি। তারা এক জায়গায় একত্রিত হয়। সেখানকার স্থাপনার ওপর আক্রমণ করে এবং তা ধ্বংস করে দেয়। পরে আবার অন্যত্র গিয়ে আক্রমণ করে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের মধ্যে তেমন স্ট্র্যাটেজি চোখে পড়ে না। এদের বড় কোনো কর্মকাণ্ড সম্প্রতি আমাদের চোখে পড়েনি। এরা যে খুব শক্তিশালী তাও আমার কখনও মনে হয়নি। মাঝে মাঝে দু-একজন ধরা পড়ে। তবে এদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই। আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে এরা সংগঠিত হতে পারছে না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ একটা বৈশ্বিক সমস্যা। মুসলিমপ্রধান অঞ্চলেই এদের তৎপরতা। এ জঙ্গি তৎপরতা এখন সুদূর আফ্রিকার যেখানে মুসলমান জাতি রয়েছে, সেখানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। নাইজেরিয়া, সাদ, সুদানের মতো দেশেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, জঙ্গি তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে এখন আফ্রিকায় সম্প্রসারিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডেও জঙ্গিরা তৎপর। ইন্দোনেশিয়ায়
এদের অবস্থান অত্যন্ত শক্তশালী। ফলে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশকে এরা টার্গেট করবে, এটাই স্বাভাবিক। সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনটা তাই এ কারণেই।
জঙ্গিবাদ মানবতার শত্রু। আল কায়দা কিংবা আইএস যেভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই সেটা সমর্থন করবে না। জঙ্গিবাদী ইসলাম আসলেই কোনো ইসলাম নয়। গলা কেটে, বোমা বানিয়ে মানুষ হত্যা করার নাম ইসলাম হতে পারে না। ইসলাম মানবতার ধর্ম। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে, বোমা বানায়, এদের কোনো গণভিত্তি নেই। মানুষ এদের সমর্থনও করবে না। তবে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তকারীরা রয়েছে। বাংলাদেশেও আছে। তাই এ মাটিতে জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। ইসলামের নামে এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় আমরা তাই শংকিত। বর্ধমানের জঙ্গি তৎপরতার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভর না করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা প্রয়োজন। এটা ভারতীয় জঙ্গিদের কাজও হতে পারে। মমতা ব্যানার্জি সরকারের ভূমিকা কী এটাও আমাদের জানা দরকার। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কাজ করছে কি-না, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ আমরা জানি, মোদি সরকারের এখন প্রধান টার্গেট হচ্ছে মমতা ব্যানার্জিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎখাত করা। তাই বলে আমরা যেন কোনো ধরনের আত্মতুষ্টিতে না ভুগি। আমাদের দেশে জঙ্গিরা আছে। এরা হয়তো তেমনভাবে সংগঠিত নয়। তবে আছে এবং সুযোগ পেলেই এরা তৎপর হয়ে ওঠে। ত্রিশালের জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা এর বড় প্রমাণ। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি ও বিদ্বেষ বাড়ছে। সংসদ কার্যকর নয়। রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা।
সরকার জঙ্গি দমনের কথা বলছে বটে; কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে যে প্রচারণা দরকার, সেটি হচ্ছে না। গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বাড়ানো দরকার। সেটিও হচ্ছে না। গোয়েন্দাদের অন্যত্র ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। তবে একটি আশার কথা অবশ্যই আছে- এ জঙ্গি তৎপরতা বড় কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই বলে আমরা চুপচাপ বসে থাকলে এদের তৎপরতা বাড়বে বৈ কমবে না। বাংলাদেশে সীমিত আকারে হলেও জঙ্গি তৎপরতা আছে। এ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ যে মানবতার শত্রু এ প্রচারণার ওপরই এখন গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Jugantor 29.11.14

ইসলামিক স্টেটের উত্থানকে কেন গুরুত্ব দিতে হবে

ইসলামিক জঙ্গিবাদী সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটের কর্মকা- এখন আর শুধু ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই জঙ্গিবাদী সংগঠনের তৎপরতা সম্প্রসারিত হয়েছে লিবিয়া, মিসর ও তিউনিসিয়াতেও। এমনকি উত্তর আফ্রিকাতেও এদের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। তবে এসব দেশে জঙ্গিরা আইএসের ব্যানারে তাদের কর্মকা- পরিচালনা না করলেও, স্থানীয়ভাবে সংগঠিত ইসলামিক জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে লিবিয়া। লিবিয়ার শহর দারনা এখন ইসলামিক স্টেটের নিয়ন্ত্রণে। ভূমধ্যসাগর ঘেঁষে এই শহরটি বেনগাজি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ইসলামিক জঙ্গিরা শহরটি দখল করে পরে তারা শহরটি ইরাক-সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক স্টেটের ‘বারকা প্রদেশ’ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরব বসন্তর ব্যর্থতাই আরব বিশ্বে ইসলামিক জঙ্গিদের ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত করেছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফি-পরবর্তী সময়সীমায় দেশটিতে কোনো রাজনৈতিক কাঠামোর জন্ম হয়নি। সেখানে নামেমাত্র একটি সরকার রয়েছে। কিন্তু ওই সরকারের কোনো কর্মকা- নেই। বরং ইসলামিক জঙ্গিরা এখন দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। এককভাবে কোনো একটি বিশেষ জঙ্গিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে লিবিয়া নেই। রাজধানী এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছে ‘ফজর লিবিয়া’ নামে একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। অন্যদিকে, দারনা প্রথমে দখল করে নেয় ‘ইসলামিক ইয়ুথ সুরা কাউন্সিল’। জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল শারিয়া থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে এই ইসলামিক ইয়ুথ কাউন্সিল গঠন করে। এদের সঙ্গে ‘আল বাতার ব্রিগেড’ যোগ দেয়। এবং নিজেদের ইসলামিক স্টেটের সম্প্রসারিত অংশ বলে ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে দারনা ইসলামিক খেলাফত রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। কেননা ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যভাগ নিয়ে যে বিশাল এক খেলাফত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, এরই প্রদেশ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করেছে দারনা শহরের জঙ্গিরা। এটা নিঃসন্দেহে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সেই সঙ্গে উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য দেশের জঙ্গিদের উৎসাহিত করবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। যদিও আমাদের কাছে এমন কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নেই, এ দেশের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আইএস বা আল কায়েদার কোনো যোগাযোগ রয়েছে। এ সংগঠন বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করে। তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে যেসব জঙ্গি সংগঠন কাজ করছে, তারা এখন প্রকাশ্যেই আইএসকে সমর্থন করছে এবং আইএসের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যেমন বলা যেতে পারে নাইজেরিয়ায় হারাম, ফিলিপাইনের আবু মায়াখ গ্রুপ, পাকিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী। একটা কথা আমাদের জানা দরকার, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থান নতুন একটি পথ দিয়েছে। তবে আল কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা ইতোমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার নিয়ে এই শাখা গঠিত। এটি আমাদের জানা নেই। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারা সংগঠিত হচ্ছে। ভারতে ইসলামি জঙ্গিরা রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাদের সঙ্গে আল কায়েদার ও আইএসের সম্পর্ক কী, তা এখন খতিয়ে দেখার বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এই কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন আল কায়েদা ও আইএসের মধ্যে নীতিগতভাবে ও জঙ্গি তৎপরতার দিক দিয়ে কিছু পার্থক্য রয়েছে। আইএস যেখানে সশস্ত্র যুদ্ধ করছে এবং ইতোমধ্যে ইরাক-সিরিয়ার একটি বিশাল এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সেখানে আল কায়েদা এখনো তাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উপরন্তু আল কায়েদার সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্ক বা তাদের শাখা থাকলেও আইএসের শাখা অন্যত্র নেই। এমনকি পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়ার মতো দেশে, যেখানে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে, সেখানে আইএসের কোনো শাখা নেই। সুতরাং বাংলাদেশ বা ভারতে আইএস এই মুহূর্তে কোনো শাখা না-ও খুলতে পারে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থানে উৎসাহিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সব জঙ্গির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাই জরুরি। আল কায়েদা তার জঙ্গি তৎপরতা পরিচালনা করে সীমিত জায়গায় সংগঠিত হয়ে, আক্রমণ করে, যাকে বিশ্লেষকরা ‘স্পাইডার ওয়েভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাকড়সা যেভাবে ছোট জায়গায় জাল বোনে এবং ওই জাল ভেঙে গেলে আবার অনত্র গিয়ে জাল বোনে। আল কায়েদার স্ট্র্যাটেজি অনেকটা তেমনই। তারা এক জায়গায় একত্র হয়। ওখানকার স্থাপনার ওপর আক্রমণ করে। এবং তা ধ্বংস করে দেয়। পরে আবার অন্যত্র গিয়ে আক্রমণ করে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের তেমন একটা স্ট্র্যাটেজি চোখে পড়ে না। এদের বড় কোনো কর্মকা- সম্প্রতি আমাদের চোখে পড়েনি। ওরা যে খুব শক্তিশালী, তা-ও আমার কখনোই মনে হয়নি। মাঝেমধ্যে দু-একজন ধরা পড়ে। তবে এদের কোনো কর্মকা- নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে এরা সংগঠিত হতে পারছে না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ একটা বৈশ্বিক সমস্যা। মুসলিমপ্রধান অঞ্চলেই এদের তৎপরতা। এই জঙ্গি তৎপরতা এখন সদূর আফ্রিকায়, যেখানে মুসলমান খ্যাতি রয়েছে, সেখানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। নাইজেরিয়ার বোকো হারামের উত্থান এর বড় প্রমাণ। পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা এদের নিয়ন্ত্রণে। চাদ, সুদানের মতো দেশেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, জঙ্গি তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে এখন আফ্রিকায় সম্প্রসারিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডেও জঙ্গিরা তৎপর। ইন্দোনেশিয়ায় এদের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশকে এরা টার্গেট করবে, এটাই স্বাভাবিক। সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনটা তাই এ কারণেই।জঙ্গিবাদ মানবতার শত্রু। আল কায়েদা কিংবা আইএস যেভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ ওই জঙ্গিবাদকে কখনোই সমর্থন করবে না। জঙ্গিবাদী ইসলাম আসলেই কোনো ইসলাম নয়। গলা কেটে, বোমা মেরে মানুষকে হত্যা করার নাম ইসলাম হতে পারে না। ইসলাম মানবতার ধর্ম। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে, বোমা বানায়, এদের কোনো গণভিত্তি নেই। মানুষ এদের সমর্থনও করবে না। তবে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তকারীরা রয়েছে। বাংলাদেশেও আছে। তাই এই মাটিতে জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। ইসলামের নামে এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনায় আমরা তাই শঙ্কিত। বর্ধমানের জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশের জঙ্গিদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য একটা চিন্তার কারণ। প্রথমত, এই ঘটনা প্রমাণ করল বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে ভারতীয় জঙ্গিদের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, ভারতীয় জঙ্গিদের সহযোগিতাতেই বাংলাদেশি জঙ্গিরা এ কাজটি করেছে। ভয়টা হচ্ছে বাংলাদশি জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি তথা আইএসের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত, আইএস বিশ্বব্যাপী একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। খেলাফতের ধারণা অনেক পুরনো। এখন খোদ আইএসের শীর্ষ কমান্ডাররাও বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী ও উৎসাহী হতে পারে! বাংলাদেশ একটি মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চল। মানুষ যেহেতু ধর্মভীরু, এ ক্ষেত্রে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব।বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের তৎপরতা ও দক্ষতা আরও বাড়ানো দরকার। গোয়েন্দাদের যদি অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে জঙ্গি দমনে তাদের তৎপরতা হ্রাস পাবে।বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিস্মিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বিএনপি আবারও বড় ধরনের আন্দোলনের কথা বলছে। ফলে দেশে যদি অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে, তাহলে জঙ্গিরা এই সুযোগটি তাদের কাজে লাগাবে। তাই ইসলামিক স্টেটের উত্থান ও লিবিয়ার শহর দারনায় একটি প্রদেশ গঠনের ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের যে সূচক প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ নম্বরে। অর্থাৎ বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। শায়খ আবদুর রহমানের মতো জঙ্গি নেতা ও তাদের দলের তৎপরতা আমরা জানি। সুতরাং আমরা যদি এখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আমরা ভুল করব। সন্ত্রাসবাদকে কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। একে পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করার মধ্য দিয়েই দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখা সম্ভব। জঙ্গি তৎপরতা বাড়লে এর আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা বাড়বে। এতে ব্যাহত হবে গণতন্ত্রচর্চা।নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র Daily Amader Somoy 25.11.14

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নয়া মোড়

গেল বছর (২০১৩) আইএসের নাম প্রথম শোনা যায়। তখন এর নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট (আইএসআইএল)। ইতিহাসে সিরিয়া, জর্দান, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরাক, সাইপ্রাস ও দক্ষিণ তুরস্ক নিয়ে যে বিশাল এলাকা, তা 'লেভান্ট' নামে পরিচিত। জঙ্গিরা এই নামটি তখন ধারণ করে। তবে ১৯৯৯ সালে 'জামাত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ' নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে 'আল-কায়েদা ইন ইরাক' নাম ধারণ করে। এই সংগঠনের মূলত সুন্নিনির্ভর ও ইরাকের সুন্নিপ্রধান এলাকায় প্রভাব বেশি। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন সুরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। তবে ২৯ জুন (২০১৪) বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আল-কায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী, এটি নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আল-কায়েদা আইএসের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কেন সম্পর্ক ছিন্ন করেছে- এটি নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কেউ বলার চেষ্টা করছেন আইএসের নৃশংসতা এর বড় কারণ। কেউ বলছেন জিহাদি নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে- এ জন্যই বিরোধের জন্ম হয়েছে। এদের রাজনীতি মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল-কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। আর বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যা আল-কায়েদার নেতা লাদেন বা জাওয়াহিরি নিজেকে ঘোষণা করেননি। তবে এটা বলতেই হবে, আইএসের নৃশংসতা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। একাধিক মার্কিন সংবাদকর্মীর গলা কেটে হত্যা করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে একটি ভয়ের আবহ তৈরি করেছে আইএস। অতি সম্প্রতি কোবানিতে যুদ্ধরত এক কুর্দি তরুণী যোদ্ধার গলা কেটে জনৈক আইএস যোদ্ধার উল্লসিত ছবিও ইন্টারনেটে প্রকাশ পেয়েছে। আল-কায়েদা তার শত্রুদের হত্যা করত বটে; কিন্তু এভাবে গলা কেটে হত্যা করত না। তবে আইএসের উত্থান অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন, কোন শক্তি আইএসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে? যত দূর জানা যায়, আইএসের যোদ্ধারা প্রতি মাসে বেতন পায়। অর্থের পরিমাণটা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই অর্থ কোত্থেকে এসেছে? শুধু দখলকৃত অঞ্চলের (তিকরিত, মসুল) তেল বিক্রি করে এই অর্থ জোগান দেওয়া কি সম্ভব? অস্ত্রই বা আসছে কোত্থেকে? কারা অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আইএসের যোদ্ধারা এরই মধ্যে দক্ষ একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। তাদের কারা প্রশিক্ষণ দিল? তৃতীয় প্রশ্ন, কে এই আবু বকর বুগদাদি? কারা তাঁকে সামনে নিয়ে এলো? বিশ্বব্যাপী আল-কায়েদা স্বীকৃত। এখন বিকল্প আরেকটি ফোর্স তৈরি করে কোনো 'শক্তি' কি চাচ্ছে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে? যদি মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তা তো মার্কিন অর্থনীতির চাঙ্গাভাব বজায় রাখতে সাহায্য করবে। কারণ মার্কিন অর্থনীতি তো 'যুদ্ধ অর্থনীতি'। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। অস্ত্র বিক্রি বাড়ে। ব্যবসা বৃদ্ধি পায় যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে। ইরাক এর বড় প্রমাণ। এ ধরনের হাজারটি প্রশ্ন এখন উঠেছে এবং রাজনৈতিক পণ্ডিতরা এসব প্রশ্নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন।

তবে নিঃসন্দেহে কোবানির যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপটকে পাল্টে দিতে পারে। কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন তথা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশ্নটি এখন সামনে এলো। চারটি দেশেই কুর্দিদের বসবাস। কুর্দিদের এলাকায় রয়েছে জ্বালানি সম্পদ, তেল। ইরান কুর্দিদের তেল পরিশোধন করে। অন্যদিকে ইরান থেকে গ্যাস কেনে কুর্দিরা। ইরাকি কুর্দিরা এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। তাদের নিজস্ব পতাকা, পার্লামেন্ট ও সেনাবাহিনী আছে। ১৯২৩ সাল থেকেই কুর্দিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে আসছে। ইরাকি কুর্দিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। ইসরায়েলের সঙ্গেও কুর্দি নেতাদের সম্পর্ক ভালো। বর্তমান সংকট এ অঞ্চলে একটি কুর্দি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দিল। এই রাষ্ট্র অনেকটা তাইওয়ান মডেলে গড়ে উঠতে পারে। কোবানির যুদ্ধ ও আইএসের উত্থান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করল। একসময় মনে হয়েছিল আসাদের দিন শেষ। এখন দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা, যাদের মধ্যে আরব রাষ্ট্রগুলোও আছে, তারা চাচ্ছে আসাদ থাকুক। মার্কিনি ছত্রচ্ছায়ায় আসাদবিরোধী যে ফ্রন্টের জন্ম হয়েছিল এবং যারা আসাদকে উৎখাতের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, এখন তারা আর আসাদবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না। তাদের টার্গেট এখন ইসলামিক স্টেট। ফলে সুবিধা পাচ্ছেন আসাদ। ইসরায়েলও এখন পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে আসাদকে। একসময় গোলান মালভূমি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল। স্ট্র্যাটেজিক্যালি এর গুরুত্ব অনেক। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ইসরায়েলের মনোভাব নমনীয়।

ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছিল, আইএসের উত্থানে ইরানকে নিয়ে এখন আর তেমন উদ্বেগ নেই মার্কিন প্রশাসনের। একসময় ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে, যেখানে ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে- এমন অভিযোগ ছিল, মার্কিন তথা ইসরায়েলি বিমান হামলার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, এখন সেই প্রশ্ন 'অতীত'। যুক্তরাষ্ট্রের এখন প্রয়োজন ইরানকে। আইএসের উত্থান এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা ও অবস্থানকে শক্তিশালী করল। ইরাক এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে। কুর্দিরা স্বাধীন হয়ে গেলে আর সুন্নি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় একটি 'জিহাদি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠিত হলে শিয়ারা একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে ইরাকের অস্তিত্ব বহন করবে। আর ইরাক ভেঙে গেলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় 'পরাজয়'।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও সীমানা বদলে যাচ্ছে। কোনো কোনো মহল থেকে আভাস দেওয়া হচ্ছে যে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি রাষ্ট্র ভেঙে (সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সৌদি আরব ও ইয়েমেন) ভবিষ্যতে ১৪টি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সিরিয়া-ইরাক যুদ্ধ এর বড় প্রমাণ। এই যুদ্ধ স্থায়ী হবে এবং অলিখিতভাবে এসব রাষ্ট্রের জন্ম হবে। আর এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আইএসের জন্ম হয়েছিল। রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে সৌদি আরব, কাতার আর যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আইএসের জন্ম। আইএসের জন্মের পেছনে যে 'শক্তিই' দায়ী থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে।
Daily Kalerkontho
23.11.14

আমেরিকার মানুষ পরির্তন চেয়েছে

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে গেল ৪ নভেম্বর। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। দুপুরে টেক্সাসের ডালাসের হাইল্যান্ড ভিলেজ উপশহরের একটি ভোট কেন্দ্র। হেরিটেজ এলিমেন্টারি স্কুলে এই ভোট কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়েছে। এই স্কুলটি আমাদের দেশের প্রাইমারি স্কুলের মতো। পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত বাচ্চারা এখানে পড়ে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠলেই চলে যায় মিডেল স্কুলে। স্কুলের আশপাশে কোনো প্রচারণা নেই। প্রার্থীদের কোনো এজেন্টও নেই। কেউ একজন এলেন না ভোটের জন্য। আমাকে যিনি নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশি-আমেরিকান ভোটার। আমি ভোটার নই, দর্শক। দুপুরে আমার মতো দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে দেখলাম না উৎসাহী হয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আমেরিকান নাগরিকদের আগ্রহ কম। এটা নিয়ে দীর্ঘদিনই বিতর্ক হচ্ছে। আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে আমরা প্রশংসা করি। হাজারটা উদাহরণ দিই। কিন্তু ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতির হার কম। যদিও এখানে পোস্টাল ব্যালটেরও সুযোগ আছে। মানুষ কাজ করে। ভোটের জন্য এখানে কোনো ছুটি থাকে না। যারা কাজ করেন, তারা কাজ ফাঁকি দিয়ে অথবা ছুটি নিয়ে ভোট দিতে যান না। কাজ শেষে ভোট দিতে যান। এ জন্য কোনো কোনো ভোট কেন্দ্র সন্ধ্যা ৭টা অথবা ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মানুষ তার কাজ শেষে ভোট দিয়ে বাড়ি যায় অথবা যারা এই বিড়ম্বনা এড়াতে চান, তারা আগেই ভোট দিয়ে দেন পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে। শুধু হেরিটেজ এলিমেন্টারি স্কুলেই যে ভোটারদের উপস্থিতি কম, তা নয়। বরং প্রতিটি ভোট কেন্দ্রেরই মোটামুটি একই চিত্র দেখা যায়। হেরিটেজ এলিমেন্টারি স্কুলের প্রবেশ মুখে দুটি পোস্টার দেখলাম মাত্র। দু’জন প্রার্থীর। ছোট একটি কাগজে দিকনির্দেশনা দেয়া কোথায় ভোট হচ্ছে। কোনো জটলা নেই। কোনো হৈহল্লা নেই। ভোটের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যাও কম। সাধারণত বাসায় বাসায় ভোটার নম্বরের কাগজপত্র পাঠানো হয়। না পেলেও সমস্যা নেই। নিজের আইডি দেখে ভোট দেয়া যায়। দু’ভাবে ভোট দেয়া যায়। ইলেক্ট্রনিক ভোট অথবা সাধারণ ভোট। ইলেক্ট্রনিক ভোট ও বোতাম টিপে ভোট দিতে হয়। আরো একটা কথা। শুধু কংগ্রেস সদস্য বা সিনেটর নির্বাচনের জন্যই ভোট হয়নি এবার। জনগণ ভোট দিয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন শীর্ষ প্রশাসনিক পদে কাদের বসানো হবে, তাদের জন্যও। কি অদ্ভুত জিনিস, যিনি হাইল্যান্ড ভিলেজ শহরের পুলিশ প্রধান হবেন কিংবা পরিবেশ বিভাগের প্রধান হবেন, তাকে ভোট দিল জনগণ। অর্থাৎ ওইসব পদ আমলাপ্রধান নয়, আমাদের দেশের মতো। এখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত করে। ফলে এক ধরনের দায়বদ্ধতা থাকে। এরা অর্থাৎ শহরপ্রধানরা মাসে একবার সভা করেন। সমস্যার কথা শোনেন। নাগরিকরা সরাসরি প্রশ্ন করেন। এটাই আমেরিকার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এটা কি বাংলাদেশে সম্ভব? খোদ জনগণের প্রতিনিধি, অর্থাৎ এমপিদেরই তো পায় না মানুষ। ভোটের সময়ই দেখা পেল। এরপর তো আর পাওয়া যায় না। যিনি শহরের সব স্কুলের প্রধান। তিনিও মিটিং করেন অভিভাবকদের নিয়ে। বাচ্চাদের স্কুলগুলোও দেখেছি এটা বাংলাদেশে চিন্তা করাও যায় না। এর মধ্য দিয়েই এক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। বলা ভালো এবারে নির্বাচন হয়ে গেল ৪৩৫ আসনবিশিষ্ট প্রতিনিধি পরিষদের সব আসনে। আর সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ আসনে। সিনেট সদস্যরা ৬ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। আর প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা ২ বছরের জন্য।কিন্তু নির্বাচন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। তার দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হেরে গেছে নির্বাচনে। ফলে প্রশাসন পরিচালনা করা তার জন্য একটি সমস্যা হবে। তিনি চাইলেও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারবেন না রিপাবলিকানদের বিরোধিতার মুখে। ডিসেম্বরে বাজেট পাস করতে হবে। যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য তিনি কংগ্রেসের কাছে অতিরিক্ত টাকা চেয়েছেন। কংগ্রেস এই অর্থ ছাড় নাও করতে পারে। ইতোমধ্য অবৈধ অভিবাসী ও ইরানের সঙ্গে একটি সমঝোতার প্রশ্নে তিনি রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যদের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। ফলে জটিলতা থাকলই। গত প্রায় দু’মাস যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে দেখেছি অনেক সাধারণ আমেরিকান ওবামার কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে বাংলাদেশি-আমেরিকানরা বরাবরই ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে অনেক বাঙালিকে দেখেছি, তারা ভোট দিতে যাননি। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনেকেরই কোনো আগ্রহ দেখিনি। অনেক আমেরিকানও ভোট দেননি। আমি যে এলাকাতে থাকি, এটা মোটামুটি শিক্ষিত এলাকা। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা আইটি বিশেষজ্ঞ। আলাপ করে দেখেছি অনেকেই ভোট দিতে যাননি।মার্কিন কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি ছিল এবার অন্যতম একটা আলোচিত বিষয়। এই কালো টাকাকে এরা বলছে ‘ডার্ক মানি।’ ৪ নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে এই কালো টাকা ব্যয় করা হয়েছে প্রধানত রিপাবলিকান প্রার্থীরা কীভাবে বিজয়ী হবেন সে জন্য। নির্বাচনী প্রচারণায়, বিশেষ করে দলীয়ভাবে অপর পক্ষকে (এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের) হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যই এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিকস তাদের গবেষণায় এই কালো টাকার একটি হিসাব দিয়েছে। তারা জানিয়েছে মধ্যবর্তী এই নির্বাচনে মোট ব্যয় হয়েছে ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। শুধু নেতিবাচক প্রচারণার কাজে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। চিন্তা করা যায়! তাও আবার পুরো নির্বাচনের জন্য নয়। মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ সিনেট আসন ও পুরো প্রতিনিধি পরিষদের আসনের জন্য। ২০০৮ সালে কালো টাকা খরচের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন আর ২০১০ সালে ছিল ৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন। ২০১২ সালেও প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। কিভাবে খরচ হয় এ টাকা? মূলত টিভি বিজ্ঞাপন বাবদ, বিল বোর্ড নির্মাণ বাবদ অর্থাৎ প্রচারণার কাজেই এ টাকা ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে এক দল অপর দলের বিভিন্ন সমালোচনা করে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয়। এটা বৈধ। প্রার্থীর ব্যক্তিগত চরিত্র কিংবা কর্মকাণ্ড স্থান পায় কম। সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিক্স তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে কীভাবে নেতিবাচক প্রচারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালের সিনেট নির্বাচনে ইতিবাচক প্রচারণা ছিল ৪৩ দশমিক ১ ভাগ আর নেতিবাচক প্রচারণা ছিল ৪৩ দশমিক ৭ ভাগ। ২০১৪ সালে তা বেড়েছে যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৫ ভাগ ও ৫৫ ভাগ। অর্থাৎ নেতিবাচক প্রচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। তেমনি প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে ২৭ দশমিক ৬ ভাগ (২০১০) থেকে বেড়েছে ৪১ দশমিক ৪ ভাগ (২০১৪)। ইতিবাচক প্রচারণা ছিল ৫২ (২০১০) ও ৪৭ দশমিক ৬ ভাগ (২০১৪)। গভর্নর পদে নির্বাচনে এই নেতিবাচক প্রচারণা বেড়েছে ৩৩ ভাগ (২০১০) থেকে ৪৭ দশমিক ৮ ভাগ (২০১৪)। সুতরাং বোঝাই যায় এই নেতিবাচক প্রচারণা এবার যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে। এখানে বলা ভালো, বিভিন্ন বেসরকরি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এই নেতিবাচক প্রচারণায় টাকা দিয়ে থাকে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের চেম্বার অব কমার্স ৩১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, ক্রসরোড সিপিএস ২৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন, লীগ অব কনজারভেটিভ ভোটারস ৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন, ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশন ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার ইত্যাদি। দেখা গেছে, এসব সংগঠনের মূল টার্গেট হচ্ছে ডেমোক্র্যাটরা এবং তাদের প্রচারণার অর্থ হচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থীদের কংগ্রেসের উভয় কক্ষে বিজয়ী করানো। ফলাফলে দেখা গেছে এই কালো টাকার প্রভাবে রিপাবলিকান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। ৪ নভেম্বরের (২০১৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই মধ্যবর্তী নির্বাচন অনেক গুরুত্ব বহন করে। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর মার্কিন রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের ফলাফল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (২০১২) দু’বছর পর কংগ্রেসের উভয় কক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিনেটের তিন ভাগের এক ভাগ আসনের আর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের পুরো আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিনেট সদস্যরা ৬ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি রাজ্যের গভর্নর, কিছু রাজ্যের কংগ্রেসের, কোনো কোনো শহরের মেয়রের নির্বাচনও একই সময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৪ নভেম্বর মোট ৪৭১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ছিল হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের ৪৩৫টি আসন ও সিনেটের ৩৬টি আসন। একই সঙ্গে প্রায় ৪৮টি গভর্নর পদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্র্যাটিক দলের নিয়ন্ত্রণে ছিল সিনেট। ১০০ সিনেট সিটের ৫৩টি আসন ছিল ডেমোক্র্যাটদের। এখন তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৫-এ। রিপাবলিকানদের হাতে এখন ৫২টি আসন। দু’জন রয়েছেন নিরপেক্ষ। অন্যদিকে ৪৩৫ আসনের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রিপাবলিকানদের দখলে ছিল ২৩৩টি আসন (এখন ২৪৩) আর ডেমোক্র্যাটদের ছিল ১৯৯ আসন (এখন ১৭৯)। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই আসন বিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অতীতে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে নানা জটিলতায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। গেল বছর ‘শাট ডাউন’-এর মতো ঘটনাও ঘটেছিল। বর্তমানে দুটি ইস্যুতে (এবোলা ও আইএসের উত্থান) ওবামা বিপদে আছেন। এখন কংগ্রেসে তার সমর্থন না থাকলে আগামীতে তার সরকার পরিচালনায় সমস্যা হবে। বুশের সময় সিনেট ছিল ডেমোক্র্যাট পার্টির দখলে। বুশ নিজে ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির সদস্য। মজার ব্যাপার, ওই সময় অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদও ছিল ডেমোক্র্যাটদের দখলে। পরিস্থিতি বদলে গেল প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময়। ক্লিনটনের সময় ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট নিয়ন্ত্রণ করেছে রিপাবলিকানরা অথচ প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ছিলেন ডেমোক্র্যাট। আবার প্রেসিডেন্ট বুশের (জুনিয়র) সময়সীমায়ও প্রথম দিকে ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট নিয়ন্ত্রণ করেছে রিপাবলিকানরা। প্রেসিডেন্ট ওবামার দু’টার্মে (২০০৮ সালে তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন) দু’রকম দৃশ্য দেখা যায়। ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদে তার দল ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর প্রথম থেকে (২০০৮ থেকে) এখন অব্দি সিনেট ডেমোক্র্যাটদের দখলে। কিন্তু ২০১২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদ চলে যায় রিপাবলিকানদের দখলে। ফলে চলতি ২০১৪-এর মধ্যবর্তী নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্লিনটনের সময়কার পরিস্থিতির মতো (যখন কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করেছে বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি)। একটি পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের দখলে থাকছে প্রেসিডেন্সি। কিন্তু কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করবে বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি। ফলে আগামী ২ বছর ওবামাকে নানা ঝামেলা পোহাতে হবে।
নির্বাচনে ওবামার দল হেরে গেল বটে, কিন্তু তাতে প্রেসিডেন্ট ওবামার পদত্যাগের কোনো সুযোগ নেই অথবা তাকে পদত্যাগ করানোও যাবে না। তবে প্রশাসন পরিচালনায় তিনি সমস্যায় পড়বেন এবং তাকে রিপাবলিকানদের সমর্থন নিয়েই প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে। রিপাবলিকানরা তাদের পছন্দমতো বিল কংগ্রেসে পাস করতে পারবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাতে ‘ভেটো’ দিতে পারবেন। অন্যদিকে ওবামার অনেক ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে না, কেননা তাতে রিপাবলিকানদের সমর্থন থাকবে না। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা এখন নানা অঙ্ক কষতে শুরু করেছেন। রিপাবলিকানরা এখন ইরাক-সিরিয়ায় আমেরিকান মেরিন সেনা পাঠাবে, যা ওবামা পাঠাননি। রিপালিকানরা মধ্যপ্রাচ্যের ৫টি দেশকে, বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়াকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে। ইরানের সঙ্গে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা নেই। যুদ্ধে এখন প্রতিদিন খরচ হচ্ছে ৩ লাখ ডলার। এ জন্য জনগণকে ট্যাক্স দিতে হবে অতিরিক্ত। রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে এই বিল অনুমোদন করবে। সামাজিক খাত এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাস্থ্য খাত সংকুচিত হবে। কর্পোরেট হাউসগুলোর সুবিধা আরো বাড়বে। কারণ তারাই রিপাবলিকানদের ক্ষমতায় এনেছে। রিপাবলিকানরা তাদের স্বার্থ দেখবে। ধনীরা আরো ধনী হবে। গরিবরা আরো গরিব হবে। নতুন চাকরির বাজার সৃষ্টি হবে না। যে ৮০ লাখ বেকার হয়েছিল অতীতে, এই সংখ্যা আরো বাড়বে। নয়া গ্রাজুয়েটরা চাকরি পাবে না। ছাত্ররা সরকারের কাছ থেকে যে আর্থিক সহযোগিতা পায় (গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার জন্য এবং যা পরে তাদের চাকরি পেয়ে পরিশোধ করতে হয়) তাতে স্থবিরতা আসবে। নতুন করে কোনো ঋণ দেয়া হবে না। এই ঋণের পরিমাণ এখন ১ ট্রিলিয়ন ডলার। একটি রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস ‘অফ শোর ড্রিলিং’-এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য এই ‘অফ শোর ড্রিলিং’ পরিবেশবাদীদের হতাশ করবে। বিশ্বব্যাপী কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমন হ্রাসের যে দাবি (যুক্তরাষ্ট্র বড় কার্বন নিংসরকারী দেশ), তা থেকে পিছিয়ে আসবে যুক্তরাষ্ট্র। বৈদেশিক সাহায্য ও সুযোগ-সুবিধা হ্রাস পাবে। ইমিগ্রেটদের জন্য কোনো ভালো খবর থাকবে না আগামী দিনগুলোতে। একটি নির্বাচন হয়েছে। আমার সুযোগ হয়েছে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে সত্য, কিন্তু সাধারণ মানুষের হতাশা আরো বেড়েছে। তবে একটা কথা সত্য, মানুষ এখানে পরিবর্তন চেয়েছে। সেই পরিবর্তনটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ধনীদের রাষ্ট্র এবং ধনীরাই যে প্রশাসন পরিচালনা করে, এটা আবারো প্রমাণিত হলো।
হাইল্যান্ড ভিলেজ, ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daily Manob Kontho 23.11.14

পরাশক্তির সম্পর্ক ও নয়া বিশ্ব

সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির বিপুল বিজয়ের পর এখানকার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মাঝে একটা প্রশ্ন উঠেছে, পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো এখন বেশ সতর্ক। রিপাবলিকান পার্টি এখন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে। ফলে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির আড়ালে কংগ্রেস একটি বড় ভূমিকা পালন করবে এবং প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করবে একটি কনজারভেটিভ নীতি গ্রহণ করতে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি আক্রমণ এবং চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর নীতি গ্রহণ করার ব্যাপারে কংগ্রেস বেশকিছু নীতি গ্রহণ করতে পারে। এমনকি আইএস দমনে ইরানের সহযোগিতা চেয়ে ওবামা খামেনিকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে আপত্তি তুলেছেন রিপাবলিকানরা। ফলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতার সম্ভাবনাও এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। ন্যাটো রাশিয়াকে ঘিরে ফেলতে চায় ও ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মোতায়েন করতে চায়- এ অভিযোগ রাশিয়ার দীর্ঘদিনের। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির পর থেকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সেপ্টেম্বরে (২০১৪) পূর্ব ইউক্রেনে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনের যে চুক্তি হয়েছে, ওই চুক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য ওবামা পুতিনকে অনুরোধ করেছেন। বেইজিংয়ে ওবামা-পুতিন সৌজন্য সাক্ষাৎ হয় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করেছে। তারা বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। এ নিয়ে সেখানে যুদ্ধ চলছে এবং তাতে প্রায় চার হাজার নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে দাবি করেছে জাতিসংঘ। এখন রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেয়, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। কংগ্রেস নির্বাচনে তার সমর্থকদের পরাজয়ের পর প্রথম সফর হিসেবে ওবামা চীনে যান। সেখানে তিনি এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (অ্যাপেক) সম্মেলনে যোগ দেন। এরপর যান মিয়ানমারে ইস্ট এশিয়া সামিটে যোগ দিতে। মিয়ানমারে এটা তার দ্বিতীয় সফর। দ্বিতীয়বার নির্বাচনের পরপরই (২০১২) তিনি মিয়ানমার সফর করেছিলেন। এরপর যান অস্ট্রেলিয়ায় জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক আগামীতে কোনদিকে গড়ায়, এ ব্যাপারে বিশ্লেষকদের আগ্রহ এখন অনেক বেশি। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে 'ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলার' এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনকে দুর্বল করাই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ নিচ্ছে 'ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট' বা টিপিপিএফটি করার। প্রস্তাবিত এ চুক্তিতে চীনকে রাখা হয়নি। অথচ এশিয়ার তথা প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি চীন। ২০০৯ সালে প্রথম টিপিপিএফটির কথা জানা যায়। এখন এ চুক্তির আওতায় আছে ১১টি দেশ- অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, চিলি, মালয়েশিয়া, মেঙ্েিকা, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। ২০১২ সালে এ অঞ্চলের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সেবা খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৪২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব জিডিপির ৪০ ভাগ এ অঞ্চলের। আর বিশ্ব বাণিজ্যের ২৬ ভাগ পরিচালিত হয় এ অঞ্চলে। কিন্তু চীনকে বাদ দিয়ে এ চুক্তি নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। আগামী বছর এ চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার কথা। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। রিপাবলিকানরা চাইবে অতি দ্রুত এ চুক্তিটি স্বাক্ষর হোক। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, চীন এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের দুটি বড় অর্থনীতির একটি জোট গঠিত হলো। দক্ষিণ কোরিয়া অনেক আগেই মধ্যম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার মোট রফতানির ২৬ দশমিক ০৫ ভাগ রফতানি হয়েছে চীনে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৯ ভাগ। বলা হচ্ছে, ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানি (এ অঞ্চলে) বাড়বে ৩০০ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানির ৩৯ দশমিক ৫ ভাগ। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২১৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। এখন প্রশ্ন থাকবে, টিপিপিএফটি চালু হলে চীন-দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কের ওপর তা কতটুকু প্রভাব ফেলবে? একইসঙ্গে চীন, রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলকে নিয়ে ব্রিকস ব্যাংক গড়ে উঠেছে, যা কিনা বিশ্বব্যাংকের কর্তৃত্ব ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছে। চীন এরই মধ্যে 'এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গঠন করেছে। বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ এ ব্যাংকের ব্যাপারে এরই মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীনের এ ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে খুব ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের এ ভূমিকাকে অস্বীকার করতে পারবে না। কেননা যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস ও তেল আহরণ ক্ষেত্র, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও কৃষিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক খারাপ হলে এ বিনিয়োগে তা প্রভাব ফেলবে। সামরিক ক্ষেত্রেও পারস্পরিক অবিশ্বাস আছে। চীন রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে 'সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন' নামক একটি সংস্থা গড়ে তুলেছে। মধ্য এশিয়ায় তথা জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করছে এ সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, পূর্ব চীন সাগরে চীন একটি 'ওয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন' গড়ে তুলেছে। অর্থাৎ বিতর্কিত ও তেল সম্পদসমৃদ্ধ এ অঞ্চলে চীন অন্য কারও কর্তৃত্ব স্বীকার করে না। এটা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করার শামিল। এ অঞ্চলে চীনের ভূমিকাকে অনেক পর্যবেক্ষক 'চীনা মনরো ডকট্রিন' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত 'মনরো ডকট্রিনের' সময় যা ছিল ইউরোপীয় শক্তি (অর্থাৎ মার্কিন এলাকায় কোনো ইউরোপীয় শক্তির জড়িত থাকাকে চ্যালেঞ্জ করা)। এক্ষেত্রে চীনা এলাকায় কোনো বিদেশি শক্তির (জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র) জড়িত থাকার বিষয়ে চীনের অপছন্দ। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় মহাসাগর অঞ্চলে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক স্প্রি্রটের ছয়টি যুদ্ধজাহাজ ভারতীয় মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে 'ঘিরে ফেলার' যে নীতি প্রণয়ন করেছে, তার অংশ হিসেবেই ভারতীয় মহাসাগরে এ যুদ্ধজাহাজগুলো মোতায়েন করা হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র তা স্বীকার করে না। বলা ভালো, ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীনের জ্বালানি সম্পদের প্রায় ৬০ ভাগ চীন এ পথে আমদানি করে। চীন কোনো অবস্থাতেই চাইবে না এ জ্বালানি সম্পদ সরবরাহে কোনো বাধা আসুক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরকে একত্রিত করে চীন তার 'মুক্তার মালা' নীতি প্রণয়ন করেছে। অর্থাৎ এ অঞ্চলে চীন তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নৌজাহাজের উপস্থিতি এক ধরনের স্নায়ুচাপ সৃষ্টি করবে চীনের ওপর। চীন এটা ভালো চোখে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। ফলে আগামীতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা নতুন করে এক 'স্নায়ুযুদ্ধের' জন্ম দিতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ সময়কার পরিস্থিতিকে মেলান যাবে না। ওই সময় বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই পরাশক্তির প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতার কারণে ওই সময়ে বড় ধরনের যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। যুদ্ধ হয়নি বটে। কিন্তু দীর্ঘসময় বিশ্বকে একটি উত্তেজনার মধ্যে রেখেছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল সত্য; কিন্তু তা ছিল সাময়িক। ২০ বছর পর নতুন আঙ্গিকে 'স্নায়ুযুদ্ধ' শুরু হয়েছে। তবে পার্থক্যটা হলো স্নায়ুযুদ্ধে একসময়কালে পক্ষ ছিল দুটি- যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখন পক্ষ বেশ ক'টি। চীন, ভারত এমনকি ইরানও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর। এখন দেখতে হবে, এ শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। এখানে প্রয়োজন একটি 'রিয়েল পলিটিকসের'। অর্থাৎ বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করা। বিশ্ব নেতারা যদি এ বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ না করেন, তাহলে বিশ্বে উত্তেজনা থাকবেই। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, এ বাস্তববাদী নীতির বড় অভাব। যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' সূচনা করে মুসলিম বিশ্বকে পদানত রাখার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে। দেশটি আফগানিস্তানে যুদ্ধের সূচনা করে, তা এখন সম্প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইরাক-সিরিয়ায় সীমিত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের সীমানাও পরিবর্তিত হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের ওপরও 'চাপ' বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হচ্ছে রাজনীতিতে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কনজারভেটিভ রিপাবলিকানদের দখলে চলে যাওয়ায় বিশ্ব-রাজনীতিতে উত্তেজনার সম্ভাবনা আরও বাড়ল। Daily Alokito Bamgladesh 23.11.14

এই যুদ্ধের শেষ কোথায়

গত ১২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট বা আইএসের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার ৯৬ দিন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এতে আইএসের জঙ্গি নেটওয়ার্ক যেমনি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি, ঠিক তেমনি আইএসের অগ্রযাত্রা রোধ করাও সম্ভব হয়নি। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র একটা কথা এখন আলোচিত হচ্ছে যে এই 'যুদ্ধ' কতদিন স্থায়ী হবে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল। তা স্থায়ী হয়েছিল ১৩ বছর। ২০১৪ সালে এসে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও কিছু সৈন্য সেখানে রয়েই যাবে। এবং নতুন একটি নিরাপত্তা চুক্তিও করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ইরাকে যে আগ্রাসন চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, তা স্থায়ী হয়েছিল ৮ বছর। এখন নতুন করে সেখানে ৩১০০ সৈন্য পাঠানো হয়েছে, যারা কোনে 'যুদ্ধে' অংশ নেবে না। তবে ইরাকি সেনাদের প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের 'দি আটলান্টিক' ম্যাগাজিন ১২ নভেম্বর তাদের এক প্রতিবেদনে আমাদের জানাচ্ছে যে প্রতি ঘণ্টায় ইরাক-সিরিয়ায় বোমা বর্ষণে খরচ হচ্ছে ৩ লাখ ডলার। যদি সীমিত পাল্লার বিমান আক্রমণ চলে, তাহলে মাসিক খরচ গিয়ে দাঁড়াবে ২০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। আর যদি দীর্ঘস্থায়ী বিমান হামলা চলে, তাহলে এই খরচ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৩৫০ মিলিয়ন থেকে ৫৭০ মিলিয়ন ডলারে। আর অন্যান্য খরচ মাসে ১ বিলিয়ন থেকে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বলা ভালো আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন, যুদ্ধের পেছনে খরচ হয়েছিল ৬ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং নতুন করে সিরিয়ায় ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রে যে যুদ্ধের সূচনা করেছে তার খরচ কত ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে উন্নীত হবে। এটা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও, এটা বলা যায় এ অঙ্কের পরিমাণ কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। কেননা এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। মার্কিন জেনারেলরাই এমন কথা বলছেন। পরিস্থিতি এখন যেদিকেই গড়াক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি আফগানিস্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে সিরিয়ায়। এই মুহূর্তে এটা স্পষ্ট নয়_ যুক্তরাষ্ট্র শুধু বিমান হামলা চালিয়েই তাদের কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখবে, বাকি একই সঙ্গে স্থল বাহিনীও পাঠাবে, যা তারা পাঠিয়েছিল আফগানিস্তানে। একটা মিত্রবাহিনী ইতোমধ্যে গঠন করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত ২২টি রাষ্ট্র এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিমান হামলায় যোগও দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মেরিন সেনা পাঠায়নি। স্থানীয় উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো চাচ্ছে শুধু বিমান হামলা নয়, বরং মেরিন সেনাও সেখানে পাঠানো হোক। এখানে বলা ভালো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশও যোগ দিক। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে তার সম্মতি জানায়নি। যদিও এ অঞ্চলে জঙ্গি রাজনীতি বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে। আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি গেল মাসে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আল-কায়েদার শাখা প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করেছেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে যেখানে এই অঞ্চলে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে বাংলাদেশ আইএসের বিরুদ্ধে কোনো অ্যালায়েন্সে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালো। এখানে বাংলাদেশের এই নীতি অনেকটা ভারতীয় নীতিরও অনুসরণ মাত্র। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফর করে গেছেন। ওবামা-মোদি আলোচনায় ওবামাও মোদিকে এই অ্যালায়েন্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মোদির সমর্থন ওবামা পাননি। এখন বাংলাদেশও আপত্তি করল। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। তাতেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আইএসের জঙ্গি উত্থানকে ঠেকাতে মার্কিন অবস্থানকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। ইসলামিক জঙ্গিবাদ যে শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে বিঘি্নত করছে, তা নয়। বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে_ মার্কিন এই মূল্যায়নের সঙ্গে ওবামা প্রশাসন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে সম্পর্কিত করতে চায়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে অনেক মুসলিম রাষ্ট্রই ওবামার ডাকে সাড়া দেয়নি। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই 'চতুর্থ যুদ্ধ' কীভাবে শেষ হবে কিংবা আইএসকে পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করা সম্ভব হবে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাক কুয়েত দখল করে নিলে কুয়েত মুক্ত করার লক্ষ্যেই জাতিসংঘের উদ্যোগে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে একটি বহুজাতিক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। 'অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম' নামে পরিচালিত ওই অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল এবং কুয়েত শত্রুমুক্ত হয়েছিল। তা ছিল উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের 'প্রথম যুদ্ধ'। 'দ্বিতীয় যুদ্ধ' শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। লক্ষ্য ছিল একটাই ইরাক আক্রমণ করে ইরাককে সাদ্দামমুক্ত করা। অভিযোগ ছিল ইরাকের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র রয়েছে, যা ওই অঞ্চল ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এই অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়াই ইরাক আক্রমণ করল। সাদ্দাম হোসেন উৎখাতই নয়, বরং সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করা হলো। অথচ ইরাকের কাছে কোনো অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। 'দ্বিতীয় যুদ্ধ' দীর্ঘস্থায়ী হয় দীর্ঘ ৮ বছর। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইরাক থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এই যুদ্ধ ঘোষণার কোনো অনুমতি ছিল না কংগ্রেসের। ওই যুদ্ধে শুধু কোয়ালিশন বাহিনীর সৈনিকের মৃত্যু সংখ্যা ছিল সরকারিভাবে ৪৮০৯ জন, আর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সংখ্যা ছিল ৪৪৮১ জন। আর আহত হয়েছিল ৩২২২৬ জন। এ ক্ষেত্রে ইরাকি বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে একা যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে ৬ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায়? অথচ মার্কিন সমাজে বেকারত্ব রয়েছে। বৈষম্য রয়েছে। উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। এই বিপুল ব্যয় এসব সামাজিক খাতে ব্যয় করা যেত। লিবিয়ায়ও কর্নেল গাদ্দাফিকে উৎখাত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছিল ১৯ মার্চ, ২০১১। ওই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল সাত মাস। ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ওই যুদ্ধে ন্যাটো একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আর তাতে অংশ নিয়েছিল ১৯টি রাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ওবামা, যিনি শান্তির জন্য ২০০৮ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। কর্নেল গাদ্দাফির মৃত্যু ও ন্যাটোর বিমান হামলা বন্ধ, কিংবা সেখানে একটি তথাকথিত সরকার গঠন করার পরও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। লিবিয়া এখন অস্ত্রবাজদের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অস্ত্রবাজরা এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। 'মানবতার নামে সামরিক হস্তক্ষেপ'-এর যুক্তি তুলে ধরে সেখানে সামরিক হামলা চালিয়ে দেশটি ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু শান্তি আসেনি। এখন ওবামা আরো একটি ভুল করতে যাচ্ছেন। তিনি লিবিয়ার মতোই সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিদের ওপর বোমা হামলার নির্দেশ দিয়ে উপসাগরীয় অঞ্চলে 'চতুর্থ যুদ্ধ' শুরু করেছেন। ইরাক যুদ্ধের সময় বুশ ছিলেন ক্ষমতায়। বুশের মতো তিনিও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের আর্টিকল ১, সেকশন ৮-এ বলা আছে যুদ্ধ ঘোষণা কিংবা শুরু করার অধিকার কংগ্রেসের, প্রেসিডেন্টের কোনো অধিকার নেই। প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। কিন্তু ওবামা লিবিয়ার ব্যাপারেও সংবিধান লঙ্ঘন করেছিলেন। আর এখন সিরিয়ার ব্যাপারেও করলেন। তবে সিরিয়া ইরাক বা লিবিয়ার মতো নয়। ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের পরাজিত করা অত সহজ হবে না। সিআইএর হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে ইসলামিক স্টেট বাহিনীর। মূলত ইরাকের সুনি্নদের নিয়েই এই বাহিনী গঠিত হয়েছে। বলা হচ্ছে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আরো প্রায় ১৫ হাজার সেনা এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এরা ইতোমধ্যে একটি দক্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সাদ্দামের সেনাবাহিনীর অনেক জেনারেল এই বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে বলা যায় আইএস যেসব এলাকা 'স্বাধীন' করেছে সেখানে নিজস্ব প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। একটি সরকারও আছে। আছে মন্ত্রিপরিষদ। ধর্মীয় পুলিশ বাহিনীও রয়েছে সৌদি আরবের মতো। তাদের কাজ হচ্ছে আজানের সময় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা ও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জনসাধারণ পরিচালিত হচ্ছে কিনা, তা দেখা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। যতদূর জানা যায়, আবু বকর বুগদাদির দুজন ডেপুটি রয়েছেন_ একজন ইরাকের জন্য। অন্যজন সিরিয়ার জন্য। বেশকিছু তেল ক্ষেত্র (ইরাকের) এখন এদের দখলে। এই তেল বিক্রির অর্থ এখন তাদের আয়ের অন্যতম উৎস। প্রতিদিন তাদের নিয়মিত এলাকা থেকে ২৫ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলিত হয়। কালোবাজারে এর মূল্য দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। প্রতিদিন এই অর্থ জমা হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের ফান্ডে। আফগানিস্তানের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের এই 'চতুর্থ যুদ্ধ' দীর্ঘায়িত হবে। এই যুদ্ধ অনেক সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। আগামীতে প্রতিটি রাষ্ট্রেই এ যুদ্ধের প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। একটি বিশাল এলাকা ইসলামিক জঙ্গিদের দখলে থাকায় ইরাক ও সিরিয়ার বর্তমান সীমানা আর থাকছে না। সিরিয়ার মধ্যভাগ আর ইরাকের মধ্যভাগ নিয়ে গঠিত হতে পারে সুনি্ন প্রভাবাধীন 'সুনি্নস্থান' নামে নতুন একটি রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রটি একটি 'জিহাদি' রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে। আইএস জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এই রাষ্ট্রটি। এরা কট্টর ইসলামিক ভাবধারায় পরিচালিত হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব কী চোখে এই সম্ভাব্য রাষ্ট্রটিকে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে একটি পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। রিপাবলিকানরা মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ফলে একটি কট্টর নীতি তারা গ্রহণ করবেন এবং ওবামাকে বাধ্য করবেন তাদের অনুসৃত নীতি গ্রহণ করতে। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গি উৎখাত যে তাদের প্রক্টর প্রায়োরিটি, এ বিষয়টি তারা নিশ্চিত করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'-এর যে নীতি, তার সম্প্রসারণ ঘটবে ইরাক ও সিরিয়ায়। ইরানের সঙ্গে 'সমঝোতার' যে উদ্যোগ ওবামা নিয়েছিলেন, রিপাবলিকানরা তা পছন্দ করছে না। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে ইরানকেও তারা অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ফলে এই অঞ্চলে যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে। এতে সমগ্র আরব রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে অলিখিতভাবে অনেক সামরিক ক্যাম্প স্থাপন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন তা আরো বাড়বে। আফগানিস্তান 'যুদ্ধ' শেষ হয়েছে। এখন নতুন করে আরেক যুদ্ধ শুরু করল যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধ সহসা শেষ হবে না। কেননা যুদ্ধ মানেই অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব। তাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বার্থেই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। Daily Jai Jai Din 19.11.14

ভুয়া ডিগ্রিধারীদের বহিষ্কারই যথেষ্ট নয়

সংবাদটি ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। তাতে বলা হয়েছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যকে তার পিএইচডি ডিগ্রি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার এই বহিষ্কার এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর শিক্ষকতা করে আসছি, আমাদের একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কেননা আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেরই পিএইচডি এবং বিদেশি ডিগ্রি রয়েছে। আমাদের সবার পিএইচডি নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে! আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে চিনি, যিনি এখন সম্ভবত চাকরি করেন না অথবা ছুটিতে আছেন। তিনি অনলাইনে একটি ‘পিএইচডি’ ডিগ্রি নিয়েছিলেন অর্থনীতিতে তথা ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে। যদিও এই বিষয়ে তার অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি ছিল না। তিনি ওই ডিগ্রিটা নিয়েছিলেন, যাতে করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনে কাস নিতে সুবিধা হয়। তবে সচেতনভাবে তিনি ওই ডিগ্রিটি ব্যবহার করতেন না নামের আগে। কিন্তু যাকে নর্থ সাউথ থেকে বহিষ্কার করা হলো, যতদূর জানি তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এমনকি তিনি এর আগে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট-ওয়েস্টে সহ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখানে অনেক প্রশ্ন এসে যায় সঙ্গত কারণেই। এক. নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিয়োগের আগে তার ডিগ্রিটি সঠিক কি না, তা কেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে যাচাই-বাছাই করে নিল না? দুই. তিনি আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দায়িত্বে ছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কেন তার ডিগ্রি যাচাই করল না? তিন. তিনি তো দীর্ঘদিন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন। তাহলে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কেন তার ব্যাপারে আগে সতর্ক হলো না। ২০০৪ সালে ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ইংরেজি নিউ এইজ পত্রিকায় তখন এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। যিনি সংবাদটি প্রকাশ করেছিলেন, তিনি আমাকে মেইলে কনফার্ম করেছেন এবং ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তাহলে এই ব্যক্তি সম্পর্কে আগেই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। তবুও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আমি ধন্যবাদ দেব যে, তারা শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কার করল। কিন্তু বহিষ্কারই যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি একটি বড় অপরাধের যা শাস্তি তা তার প্রাপ্য। নিজেকে এবং নিজের ডিগ্রি ‘জাস্টিফাই’ করার জন্য অপর একটি দৈনিকে ছাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার তথাকথিত ডিপিএ ডিগ্রিটি পিএইচডি মানের। এই তথ্যটি ভুল এবং প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার শামিল। ডিপিএ নামের একটি ডিগ্রি আছে বটে, কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই পিএইচডি সমমান তো নয়ই, বরং একাডেমিক মানেরও নয়। মূলত ডিপিএ ডিগ্রি দেওয়া হয় অনলাইনে। ১৯৭৭ সালে অনলাইন ছিল না। কিন্তু ওই সময় কিভল্যান্ড (ওহাইও) বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপিএ ডিগ্রি ছিল, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে জানাতে পারেনি। উপরন্তু ডিপিএ ডিগ্রি তাদেরই দেওয়া হয়, যারা ব্যবসা প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। একটু খোঁজখবর নিলেই দেখা যাবে, ডিপিএ ডিগ্রিটি কী এবং তা কীভাবে দেওয়া হয়। ইন্টারনেটের এই যুগে কিভল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করাও কঠিন কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডিগ্রি ভেরিফাই’ নামে একটা শাখা আছে। সেখান থেকেও তথ্য নেওয়া যায়। এ ধরনের একটি ভুয়া পিএইচডির খবর আমাদের চোখ খুলে দিল। ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন আরেকটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমাদের জানিয়েছে, দেশে প্রায় ৫ হাজার ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী রয়েছে। যারা ইতোমধ্যে ওই ডিগ্রি ব্যবহার করে অনেক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। ওই প্রতিবেদক আমাকে জানিয়েছেন, খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। শর্ষের ভেতরেই যদি ভূত থাকে, তাহলে আমরা ভূত তাড়াব কীভাবে? সমাজের সর্বত্র এখন ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ছড়াছড়ি (যে কারণে আমি নিজে এখন আর নামের আগে ‘ড.’ শব্দটি ব্যবহার করি না। এটা আমার প্রতিবাদও বলতে পারেন!)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত, নিম্ন আদালত, বেসরকারি ব্যাংকের এমডি, উকিল, জজ, সচিব সবাই এখন নির্বিবাদে এই ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। কেউ জানেন। কেউ আবার জানেন না। সংবাদপত্রের কর্মীরা প্রায়ই না জেনেশুনে, পরীক্ষা না করে নামের আগে ‘ড.’ শব্দটি জুড়ে দেন। এতে করে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে যায়। এক এনজিও নেত্রীকে আমি বারবার বলেছি এই পদবি ব্যবহার না করার জন্য। তিনি তা করছেন এবং অবৈধভাবে অধ্যাপক শব্দটিও ব্যবহার করছেন। কে দেখবে এসব?
কেউ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে না গেলে তার ডিগ্রি যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। তবে কমিশন প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের তালিকা এখন চাইতে পারে। আমরা যখন মঞ্জুরি কমিশনে ছিলাম তখন আমার উদ্যোগেই ও আমার এক সহকর্মীর সহযোগিতায় শিক্ষকদের একটা ‘ডাটা ব্যাংক’ তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই কাজটি করা আর হয়নি। কারা এর জন্য দায়ী? অবৈধ কর্মকর্তারা সব জায়গাতেই আছে। কীভাবে সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করতে হয়, তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানে। তাই ‘ম্যানেজ’ হয়ে গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটা ব্যাংকের উদ্যোগটি এখন ইউজিসির ডিপ ফ্রিজে। যারা সেখানে সদস্য হিসেবে যান, তারা বিষয়টি বোঝেন কি না, তাতে আমার সন্দেহ রয়েছে। এখন একজন সহ-উপাচার্যের ভুয়া পিএইচডির বিষয়টি যখন ধরা পড়ল, তখন ইউজিসির উচিত অবিলম্বে ‘ডাটা ব্যাংক’-এর কার্যক্রম শুরু করা।
পিএইচডি হচ্ছে একটা গবেষণা। একজন গবেষককে একটি তত্ত্বের আলোকে একটা নতুন গবেষণা উপস্থাপন করতে হয়। এটা একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা। নতুন একটি তথ্য তিনি গবেষণা করে উপস্থাপন করবেন। কিন্তু আমাদের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা তা কী করছেন? কোথায় তাদের গবেষণা? আরও একটা কথা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ব্যাপকভাবে পিএইচডি দেওয়া শুরু হয়েছে। কী তার কোয়ালিটি? কে তাদের তত্ত্বাবধায়ক? কীভাবে তারা গবেষণা করছেন? এসব দেখার কেউ নেই। মজার কা-, যার নিজেরই পিএইচডি নেই, অধ্যাপকও ননÑ তারাও এখন পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা পিএইচডি নিচ্ছেন কোনো রকম গবেষণা না করেই। পুলিশের শীর্ষ ব্যক্তিসহ ডজন ডজন কর্মকর্তা এখন পিএইচডি ডিগ্রিধারী অথবা নেওয়ার পথে। অথচ একটিবারের জন্যও তারা লাইব্রেরিতে যাননি। ফিল্ড ওয়ার্ক করেননি। কে তাদের থিসিস লিখল? ছুটি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু কেউ ছুটি নিচ্ছেন না। আমরা পিএইচডি ডিগ্রিটাকে এখন হাস্যাস্পদ ব্যাপারে পরিণত করেছি। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়েই পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদের ওই ফিল্ডে নিজস্ব কোনো শিক্ষক নেই। ধার করা শিক্ষক দিয়ে তারা পিএইচডি কোর্স পরিচালনা করছে। এটি কি ঠিক? এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? যদি সত্যিকার অর্থেই ডিগ্রি দিতে হয়, তাহলে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ধার করা শিক্ষক দিয়ে পিএইচডি কোর্স পরিচালনা করা যাবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে ইউজিসিকে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার আহ্বান জানাচ্ছি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ছড়াছড়ি রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার চেয়েও মারাত্মক। সমাজকে তা অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কথা ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংসদের শিক্ষা-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি তৎপর হয়েছে। সংসদীয় কমিটির পরবর্তী সভায় আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি রয়েছে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম তাদের ‘একটি’ ভূমিকা দেখার জন্য। এখন যেটা করার দরকার, তা হচ্ছেÑ ১. ইউজিসি অবিলম্বে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষকদের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করবে। এক মাসের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষকদের ডিগ্রির তালিকা দেবে এবং ইউজিসি তা যাচাই-বাছাই করবে এবং ভুয়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবে। ২. অনলাইন পিএইচডি যে একাডেমিক কোনো ডিগ্রি নয়, তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ করবে ও সতর্ক করবে। ৩. ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ব্যবহার নিষিদ্ধ ও ব্যবহারকারীদের কঠোর শাস্তির বিধানসংবলিত আইন সংসদে পাস করতে হবে। অথবা প্রচলিত আইনে সংশোধনী আনতে হবে। ৪. প্রয়োজনে ইউজিসি এ সংক্রান্ত একটি ‘সেল’ গঠন করবে। ৫. প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি করে ‘সেল’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যারা তাদের শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রির মান পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করবেন। ৬. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রক্রিয়ায় বিশেষ কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করতে হবে। কোনো প্রার্থী পদে থেকে পিএইচডি করতে পারবেন না। আইন অনুসরণ করে ছুটি নিয়ে প্রার্থীকে গবেষণা পরিচালনা করতে হবে। ভাড়া করা শিক্ষক দিয়ে পিএইচডি কোর্স চালু করা যাবে না। কোনো বিভাগে ন্যূনতম ৪ থেকে ৫ জন অধ্যাপক না থাকলে, সেই বিভাগ পিএইচডি কোর্স চালু করতে পারবে না। ইউজিসি এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। একটা অদ্ভুত সমাজে আমরা বসবাস করছি। ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে আমরা শিক্ষকতার চাকরি নিচ্ছি। বছরের পর বছর চাকরি করছি। কিন্তু ভুয়া ডিগ্রির খবর জানাজানি হয়ে গেলেও কোনো শাস্তি হচ্ছে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক কানেকশনে পার পেয়ে যাচ্ছেন। একটা অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দেয়। একটি ভুয়া পিএইচডি আরেকটি ভুয়া পিএইচডির জন্ম দিচ্ছে। টাকার বিনিময়ে এখন পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা নিয়ে এই যে বেসাতি, তা পৃথিবীর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা ইউজিসির দায়িত্ব অনেক বেশি। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবেই পালন করবেন। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র Daily Amader Somoy 16.11.14

মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসছে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির বিপুল পরাজয়ের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, ডেমোক্রেটদের এ পরাজয় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো ইঙ্গিত বহন করে কিনা? অর্থাৎ সোজাসাপটা যে কথাটা মার্কিন টিভিতে বারবার আলোচিত হচ্ছে তা হল, ওবামা তার পররাষ্ট্রনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনবেন কিনা? মার্কিন রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা সর্বাধিক হলেও প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়েই তার পররাষ্ট্র তথা দেশরক্ষা নীতি পরিচালনা করতে হয়। একা প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বটে, কিন্তু কংগ্রেস তা আটকে দিতেও পারে। তাই প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের সমর্থন চাইতে হয়। সামনে অনেক ইস্যু- দেখতে হবে ওবামা এসব ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেন।মধ্যপ্রাচ্যের আইএস জঙ্গিদের উত্থান ও ইরাক-সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ে নতুন একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র সুন্নিস্তান-এর জন্মের সম্ভাবনা প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য এক নম্বর ইস্যু। প্রেসিডেন্ট সেখানে, বিশেষ করে ইরাকে আরও ১৫শ আমেরিকান সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইরাকে আরও আছে ১৪শ সৈন্য। এরা যুদ্ধে অংশ নেবে না বটে; কিন্তু বলা হচ্ছে ইরাকি সেনাবাহিনী ও কুর্দি বাহিনীকে এরা প্রশিক্ষণ দেবে। আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও কিছু সৈন্য সেখানে থেকে যাবে। এই সৈন্য মোতায়েনের জন্য প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের কাছে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ চেয়েছেন। প্রশ্ন এখানেই- কংগ্রেস এই অর্থ অনুমোদন করবে কি-না?দ্বিতীয়ত, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে একটি খবর বেরিয়েছে যে, ওবামা অত্যন্ত গোপনে গেল মাসে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামিনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠিতে ওবামা সম্ভাব্য একটি পারমাণবিক চুক্তির বিনিময়ে (ইরান-যুক্তরাষ্ট্র) ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক জঙ্গিদের ঠেকাতে ইরানের সহযোগিতা চেয়েছেন। এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, ইরান পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে, এই অভিযোগ ওবামা প্রশাসনের দীর্ঘদিনের। এমনকি একাধিকবার এমন কথাও বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো সময় ইরানের পারমাণবিক চুল্লিগুলোতে বোমা হামলা করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের সঙ্গে ছয়-জাতি আলোচনা চলে আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও চীন এই ছয় জাতি আলোচনায় শরিক হলেও কোনো ফলাফল তাতে পাওয়া যায়নি। এমনকি ওবামার ইরানি ধর্মীয় নেতাকে চিঠি দেয়া ও সাহায্য চাওয়ার অর্থ হচ্ছে পরিষ্কার- ইরান এই অঞ্চলে একটি ফ্যাক্টর। ইরানকে বাদ দিয়ে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়। ফলে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন আসছে। সুতরাং এই পরিবর্তন, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থানের বিষয়টিকে কনজারভেটিভরা কীভাবে দেখাবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস ইরানকে কতটুকু ছাড় দেবে, এ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।কট্টরপন্থী সিনেটর ম্যাকেইন এখন সিনেটের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান। এ বছরের শেষ নাগাদ National Defense Authorization Act পাস হবে কি-না, তাতে বড় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। আগামী বছরের প্রতিরক্ষা বাজেট পাস হওয়ার কথা। এটা ৫২১ বিলিয়নে (৪৯৬ বিলিয়ন থেকে) উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এটা পাস না হলে আটকে যাবে সমস্ত সামরিক কার্যক্রম। ওবামা Overseas Contingency Fund-এর জন্য (বিদেশে সৈন্য মোতায়েন বাবদ খরচ) ৭৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের ফান্ডের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু সিনেট অনুমোদন করেছে ৫৯ মিলিয়ন ডলার। দূরপাল্লার বিমান (এ-১০), যা আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমানবাহিনী। এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রতিরক্ষা বাজেট পাস হতে হবে। প্রতিরক্ষা বাজেটের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাজেট পাস না হলে আইএস জঙ্গি দমনে অব্যাহত সামরিক অভিযানে ভাটা পড়বে। রিপাবলিকানরা তা কি চাইবে? একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাও বাড়ছে। এটা নিয়েও প্রশ্ন থাকবে।মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। কংগ্রেস নির্বাচনে তার সমর্থকদের পরাজয়ের পর প্রথম সফর হিসেবে ওবামা চীনে যান। সেখানে তিনি এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (আপেক) যোগ দেন। এরপর যান মিয়ানমারে ইস্ট এশিয়া সামিটে যোগ দিতে। মিয়ানমারে এটা তার দ্বিতীয় সফর। দ্বিতীয়বার নির্বাচনের পরপরই (২০১২) তিনি মিয়ানমার সফর করেছিলেন। এবার যান অস্ট্রেলিয়ায় জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক আগামীতে কোনদিকে গড়ায়, এ ব্যাপারে বিশ্লেষকদের আগ্রহ এখন অনেক বেশি। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলার এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনকে দুর্বল করাই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ নিচ্ছে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা টিপিপিএফটি করার। প্রস্তাবিত এই চুক্তিতে চীনকে রাখা হয়নি। অথচ এশিয়ার তথা প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি চীন। ২০০৯ সালে প্রথম টিপিপিএফটির কথা জানা যায়। এখন এই চুক্তির আওতায় আছে ১১টি দেশ- অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। ২০১২ সালে এই অঞ্চলের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সেবাখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৪২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব জিডিপির ৪০ ভাগ এ অঞ্চলের। আর বিশ্ব বাণিজ্যের ২৬ ভাগ পরিচালিত হয় এ অঞ্চলে। তবে চীনকে বাদ দিয়ে এই চুক্তি নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। আগামী বছর এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। রিপাবলিকানরা চাইবে অতি দ্রুত এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হোক। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের দুটি বড় অর্থনীতির একটি জোট গঠিত হল। দক্ষিণ কোরিয়া অনেক আগেই মধ্যম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার মোট রফতানির ২৬ দশমিক ০৫ ভাগ রফতানি হয়েছে চীনে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ০৯ ভাগ। বলা হচ্ছে ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানি (এই অঞ্চলে) বাড়বে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে, যা মোট রফতানির ৩৯ দশমিক ৫ ভাগ। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২১৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। এখন প্রশ্ন থাকবে টিপিপিএফটি চালু হলে চীন-দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কের ওপর তা কতটুকু প্রভাব ফেলবে? একই সঙ্গে চীন, রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলকে নিয়ে ব্রিকস ব্যাংক গড়ে তুলেছে, যা কিনা বিশ্বব্যাংকের কর্তৃত্ব ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছে। চীন ইতিমধ্যে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গঠন করেছে। বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ এই ব্যাংকের ব্যাপারে ইতিমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীনের এই ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই ভূমিকাকে অস্বীকার করতে পারবে না। কেননা যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস ও তেল আহরণ ক্ষেত্রে, রিয়েল স্টেট ব্যবসা, কৃষিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হলে এই বিনিয়োগে তা প্রভাব ফেলবে। অনেকেরই জানার কথা যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চীনকে অস্বীকার করা সহজ নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র চায় চীন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, মুদ্রা বিনিময় ক্ষেত্রে আরও উদার হোক। যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরেই চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি করতে চাচ্ছে। কিন্তু আলোচনা খুব একটা এগিয়ে যায়নি। পরিবেশ, বিশেষ করে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকার তীব্র সমালোচক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের জন্য একটি চুক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে। কপ সম্মেলনে বারবার এ কথাগুলো বলা হয়। এক্ষেত্রে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর দিকে (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) আঙুল নির্দেশ করা হলে, যুক্তরাষ্ট্র বারবার চীনের কথা বলছে। কেননা ইতিমধ্যে চীন বায়ুমণ্ডলে অন্যতম কার্বন নির্গমনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। চীনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে গৌণ। তেমন কোনো উদ্যোগ চীন নেয়নি। ফলে এ প্রশ্নে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিমত আছে।সামরিক ক্ষেত্রেও পারস্পরিক অবিশ্বাস আছে। চীন রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছে। মধ্য এশিয়ায় তথা জ্বালানি সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করছে এই সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, পূর্ব চীন সাগরে চীন একটি এয়ার ডিফেন্স আইডেনটিফিকেশন জোন গড়ে তুলেছে। অর্থাৎ বিতর্কিত ও তেলসম্পদ সমৃদ্ধ এই অঞ্চলে চীন অন্য কারও কর্তৃত্ব স্বীকার করে না। এটা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করার শামিল। এ অঞ্চলে চীনের ভূমিকাকে অনেক পর্যবেক্ষক চীনা মনরো ডকট্রিন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মনরো ডকট্রিনের সময় যা ছিল ইউরোপীয় শক্তি (অর্থাৎ মার্কিন এলাকায় কোনো ইউরোপীয় শক্তির জড়িত থাকাকে চ্যালেঞ্জ করা), এক্ষেত্রে চীনা এলাকায় কোনো বিদেশী শক্তির (জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র) জড়িত থাকার বিষয়টি চীনাদের অপছন্দ। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এই সম্পর্ককে অনেকে থুসিডিডেজ ফাঁদ (Thucydides Trap) হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডিডেজের নামে এই মতবাদের নামকরণ। এই মতবাদের মূল বিষয়টি হচ্ছে একটি উঠতি শক্তির সঙ্গে একটি স্বীকৃত শক্তির দ্বন্দ্ব। চীন উঠতি শক্তি ও যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃত শক্তি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দুই শক্তির মধ্যকার সম্পর্ক প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতাকে লুসিডিডেজ ফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওবামার চীন সফরের সময় তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু আলোচনা খুব ফলপ্রসূ হয়েছে, এটা বলা যাবে না। এমনকি ওবামার হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রসঙ্গে মন্তব্যও চীনা নেতারা খুব ভালোভাবে নেবেন না। সুতরাং রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস যে চীনের ব্যাপারে আরও কড়া নীতি গ্রহণ করবে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং ওবামার জন্য আগামী দুবছর খুব একটা ভালো সময় কাটবে না।রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে। ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়ার আগ্রাসী নীতির প্রশ্নে অনেক কংগ্রেস নেতার আপত্তি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মানসিকতা নিয়ে রাশিয়াকে পরিচালনা করছেন। রিপাবলিকানরা এতে অখুশি এবং রাশিয়ার ওপর আরও কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপের পক্ষপাতী। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। এখন অবধি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়নি। এখন পর্যন্ত রাশিয়া এর প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু একবার যদি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে ন্যাটোর সনদের ৫নং ধারা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে পাশে এসে দাঁড়াবে ইউক্রেনের। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে সীমিত যুদ্ধের সম্ভাবনা অনিবার্য।মিডটার্ম নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ওবামার অনেক সিদ্ধান্ত বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সিদ্ধান্ত সিনেট সমর্থন করেছে। এখন সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদ কোনোটারই নিয়ন্ত্রণ তার সমর্থক অর্থাৎ ডেমোক্রেটদের হাতে নেই। ফলে আগামী দুবছর ওবামার জন্য হবে অত্যন্ত কঠিন এক সময়। এক্ষেত্রে ওবামা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার প্রশাসনিক ক্ষমতা কিংবা তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন বটে, কিন্তু তাতে করে কংগ্রেসের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী একটি দ্বন্দ্বে তিনি জড়িয়ে যাবেন। ফলে প্রশাসনের গতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জিত হবে না। আবার রিপাবলিকানদের কট্টর মনোভাব (মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সূচনা) বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের একটি নেতিবাচক ইমেজের জন্ম দেবে। তাই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় একটি কমপ্রোমাইজ দরকার। কংগ্রেসকে যেমনি প্রেসিডেন্টের ওপর আস্থা রাখতে হবে, ঠিক তেমনি প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেস নেতাদের আস্থায় নিতে হবে। দেখা যাক, আগামী দুবছর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসে। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daily JUGANTOR 14.11.14

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ

গত ২৯ অক্টোবর হংকংয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে গণতন্ত্রকামীদের বৈঠকের পর খুব সঙ্গত কারণেই একটি প্রশ্ন উঠেছে। তা হচ্ছে হংকংয়ের ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে? সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে পরিচালিত এই আন্দোলন কি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পরিণত হলো? বিক্ষোভকারীদের মধ্যে যারা ছিল মূলত তরুণ, তারা কি শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে, নাকি রণে ভঙ্গ দেবে এটাও একটি মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল এক মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল হংকংয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। তাদের দাবি ছিল হংকংয়ের যে পার্লামেন্ট, সেখানকার সদস্যরা জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। একই সঙ্গে হংকংয়ের প্রধান নির্বাহীও জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু ২১ অক্টোবর দু’পক্ষের মাঝে (বিক্ষোভকারী ও হংকং প্রশাসন) যে সংলাপ হয় এবং যা টিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয় তা এক রকম ব্যর্থতায়ই পরিণত হয়েছে। কেননা কোনো সুনির্দিষ্ট সমঝোতায় কোনো পক্ষ রাজি হয়নি। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল হংকংয়ের ভবিষ্যৎ আসলে কি?
অনেকেই জানেন ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বের আলোকে হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রয়াত চীনা নেতা দেং জিয়াও পিং ছিলেন এই তত্ত্বের প্রবক্তা। অর্থাৎ হংকং তার পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিয়েই চীনের সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল। হংকংয়ে সমাজতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়নি। হংকংয়ে একটি পার্লামেন্ট আছে। এর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৭০ জন (অন্তর্ভুক্তির পরে ১৯৯৮ সালে ছিল ৬০ জন)। এরা তিনভাবে নির্বাচিত হন। ‘বেসিক ল’ (যা অনেকটা সংবিধানের আলোকে) মতে ভৌগোলিক অঞ্চল অর্থাৎ জেলা থেকে সরাসরি নির্বাচিত হন ৩৫ জন। তথাকথিত পেশাভিত্তিক প্রতিনিধির রয়েছেন ৩৫ জন (বিভিন্ন পেশা)। প্রথম দিকে নির্বাচন কমিটির একটা প্রতিনিধিত্ব ছিল এখন তা আর নেই। অন্যদিকে প্রধান নির্বাহী একটি প্রাথমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে তার ক্ষমতা পরিচালনা করেন। এই প্রশাসনিক কাউন্সিলে রয়েছেন ২৯ জন সদস্য। ১৫ জন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা আর ১৪ জন সাধারণ প্রতিনিধি। চীনের পিপলস কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটি সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে। প্রধান নির্বাহী তার কাছে দায়বদ্ধ। গণতন্ত্রকামীরা এর পরিবর্তন চেয়েছিল, কিন্তু তা হয়নি।
এখন প্রশ্ন একটাই-হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কি কোনো মেসেজ দিয়ে গেল? কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াতে এই আন্দোলন নিয়ে মাতামাতি কম দেখছি না। শত শত চ্যানেলের ভিড়ে কোথাও না কোথাও হংকংয়ের এই আন্দোলন ও চীনের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। অনেকেই হংকংয়ের এই আন্দোলন, যা কিনা পরিচিতি পেয়েছে ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ হিসেবে, তার সঙ্গে আরব বসন্ত সময়কালীন কায়রোতে যে আন্দোলন হয়েছিল তার একটা মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ হয়েছে, তার সঙ্গে হংকং অক্যুপাই আন্দোলনের যেমনি মিল আছে, তেমনি আছে অমিলও। খোদ নিউইয়র্ক শহরে ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ বড় ধরনের আবেদন সৃষ্টি করতে পারলেও তাতে পরিবর্তন এসেছে অতি সামান্যই। মানুষ এখন আর ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’-এর কথা মনে করে না। তবে মিসরের রাজধানী কায়রোতে যে অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট হয়েছিল তাতে পরিবর্তন এসেছিল। হোসনি মোবারকের পতন, মুরসির উত্থান ও পতন এবং সর্বশেষ সিসির ক্ষমতা করায়ত্ত করার মধ্য দিয়ে ‘আরব বসন্ত’-এর নতুন ইতিহাস এখন রচিত হয়েছে। থাইল্যান্ডের অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের খবরও আমরা জানি। প্রতিবাদের এটা একটা ধরন। এই প্রতিবাদ কোথাও কোথাও সরকারের পতন ঘটিয়েছে এটা সত্য। তবে সাধারণ মানুষ এ ক্ষেত্রে উপকৃত হয়েছে খুব কম ক্ষেত্রেই। অনেক ক্ষেত্রেই একটি বিশেষ শ্রেণী এই আন্দোলন থেকে ফায়দা উঠিয়েছে। মিসরে সাধারণ মানুষ এই অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট থেকে যেমনি উপকৃত হয়নি, ঠিক তেমনি ইউক্রেন কিংবা থাইল্যান্ডের মানুষের জন্যও তা কোনো সুফল ডেকে আনেনি। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অতিসম্প্রতি এক ধরনের ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ আমরা লক্ষ্য করেছি, কিন্তু তাতে সরকারের পতন হয়নি। এমনি এক প্রেক্ষাপট আমরা প্রত্যক্ষ করেছি হংকংয়ে ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল।’ তবে ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’-এর সঙ্গে অন্যান্য ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের’ কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেননা ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ হংকংয়ে সরকার পরিবর্তনের কোনো আন্দোলন নয়; বরং বলা যেতে পারে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার। আরো বেশি গণতন্ত্র। ২০১৭ সালে হংকংয়ে প্রধান প্রশাসনিক পদের জন্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হলেও হংকং তার অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য এখনো বজায় রেখেছে। অর্থাৎ এখানে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। তবে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এখনো চীনের হাতে। অর্থাৎ চীন এখানে একজন প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে থাকে। এই প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ চীনের প্রতি দায়বদ্ধ। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা চাচ্ছে এখানে পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন সম্পন্ন হোক। অর্থাৎ ‘এক মাথা এক ভোট’ ভিত্তিতে দলগতভাবে এখানে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হংকংয়ের প্রশাসন পরিচালনা করবেন। এ ক্ষেত্রে চীন যে সংস্কারের কথা বলেছে (প্রধান প্রশাসনিক ব্যক্তির নির্বাচন) সেখানে দলগতভাবে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। চীনা কর্তৃপক্ষ একটি তালিকা তৈরি করে দেবে এবং জনগণ ওই তালিকা থেকে একজনকে বেছে নেবে। চীনা কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাব গণতন্ত্রকামীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা মধ্য হংকংয়ের মংকক এলাকা দখল করে নিয়ে অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের জন্ম দিয়েছিল।
হংকংয়ের অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের ইতিহাস খুঁজে দেখা গেছে এই আন্দোলন তরুণদের দ্বারা পরিচালিত হলেও এর তাত্ত্বিক হচ্ছেন অধ্যাপক বেনই তাই নামে এক ব্যক্তি। তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কম্পারেটিভ অ্যান্ড পাবলিক ল-এর তিনি অধ্যাপক। তিনি দু’বছর আগে তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের একটি আন্দোলনের কথা বলেন। অহিংস পদ্ধতিতে, অনেকটা গান্ধীবাদী নীতির আলোকে তিনি হংকংয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। তার এই গান্ধীবাদী নীতি অনুসরণ করে তরুণরা, যাদের অধিকাংশই ছাত্র এই ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’-এর জন্ম দিয়েছে। হংকংয়ের ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস এই আন্দোলনে নিজেদের জড়িত করেছে। আর মজার ব্যাপার এর নেতৃত্বে রয়েছে ১৭ বছরের এক যুবক, যার নাম জসুয়া ওং। জসুয়া ওং নিজে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। তবে এই আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তারই অংশ হিসেবে জন্ম হয়েছে হংকং ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলনের। চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন এই পরিকল্পনার একটি অংশমাত্র। যুক্তরাষ্ট্র এনডিআই বা ‘ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’ নামক সংস্থার মাধ্যমে হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীদের প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করেছে। অধ্যাপক বেনই তাইকে তারাই তৈরি করেছে এবং অধ্যাপক তাইকে সামনে রেখেই গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর কম্পারেটিভ অ্যান্ড পাবলিক ল’ নামের একটি থিংক ট্যাঙ্ক, একটি গবেষণা সংস্থা। এনডিআইয়ের অর্থায়নে হংকংয়ে মার্টিন লি’র নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ডেমোক্রেটিক পার্টি। মার্টিন লি নিজে ২০১৪ সালে ও অধ্যাপক তাই ওয়াশিংটন সফর করেছেন একাধিকবার। শুধু তা-ই নয়, হংকংয়ে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে যে রেফারেন্ডাম বা গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল তারও অর্থায়ন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। হংকংয়ের ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ (পাঁচ ভাগের এক ভাগ) ওই গণভোটে অংশ নিয়েছিল। মিসরেও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের গণভোটের আয়োজন করেছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইউএসএইডয়ের হংকংয়ে সাহায্যের পরিমাণও বেড়েছিল। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ডলার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে হংকংয়ে একটি তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। উদ্দেশ্য, মূল চীনে এই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে দেয়া ও চীনের চূড়ান্ত বিচারে চীনা সরকারের পতন ঘটানো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যুক্তরাষ্ট্র হংকংয়ে গণতন্ত্র চায় বটে (?), কিন্তু সেখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। হংকংয়ে ঘণ্টাপ্রতি যে বেতন দেয়া হয় (৩ দশমিক ৬০ ডলার), তা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের গড় বেতনের অর্ধেক। শুধু তা-ই নয়, হংকংয়ে এ জীবনযাত্রার খরচ এত বেশি যে, অনেককে খরচ মেটানোর জন্য দুটি চাকরি পর্যন্ত
করতে হয়। গণতন্ত্র সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে পারবে না। গণতন্ত্র বোধকরি হংকংয়ের সমস্যার কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং হংকংয়ের এই আন্দোলন কি আদৌ কোনো  প্রভাব ফেলবে চীনের ওপর?
গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সংস্কৃতি হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনা নেতৃত্ব এটা মানবে না। কেননা এতে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়তে পারে। তবে ২০১৭ সালে হংকংয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে আরো কিছুটা ছাড় দিতে পারে চীন। প্রার্থীদের যে তালিকা চীন অনুমোদন করবে, সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। হংকংয়ের বিকল্প হিসেবে সাংহাই, শেন ঝেন কিংবা গুয়াং ঝো এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন আর সাধারণ চীনাদের আকৃষ্ট করে না; বরং শেন ঝেন কিংবা গুয়াং ঝোর মতো এলাকায় ‘নতুন অর্থনৈতিক জোন’ গঠিত হয়েছে, যেখানে জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, চীনা নেতৃত্ব চীনের অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যেই চীন হবে বিশ্বের একমাত্র বড় অর্থনীতি। ফলে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে চীনা নেতৃত্ব সজাগ রয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অত্যন্ত প্রাগমেটিক। তিনি চীনা অর্থনীতিকে আরো উন্মুক্ত করে দেবেন। জাতীয় স্বার্থকে তিনি গুরুত্ব দেবেন। একটি ‘মার্কিনি ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে তিনি ও তার পলিটব্যুরোর সদস্যরা সচেতন। চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করতে চাচ্ছে, তাতে চীনকে রাখা হয়নি। এটা চীনবিরোধি একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। চীনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন, তাই চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে জন্ম হতে যাচ্ছে একটি ‘নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’, যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আঘাত করবে। জন্ম দেবে বিকল্প একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। এ লক্ষ্যেই ২০১৬ সালে ব্রিকস ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাই হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে পরোক্ষভাবে চীনা নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল, এটা চীনা নেতারা উপলব্ধি করেছেন। চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। চীন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চীনা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সেখানেই লুকায়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এখন চাচ্ছে চীনও একাধিক চীনা রাষ্ট্রে বিভক্ত হোক। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সেনাবাহিনী এখনো পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। চীনা সেনাবাহিনী এখনো পার্টির নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। ফলে চীনে হংকংয়ের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে অদূর ভবিষ্যতে চীনে একটি ‘সিঙ্গাপুর মডেল’-এর জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ দ্বারা পরিচালিত হয় না। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাতের বিকাশ ঘটিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ নামে নতুন এক অর্থনীতি চালু করেছে। এর ফলও তারা পেয়েছে। চীন এখন বিশ্বের বড় অর্থনীতি। সুতরাং হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হংকয়ের ব্যাপারে চীনা নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় হংকংয়ের প্রশাসনিক কাউন্সিলের যিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, সেই মিসেস ক্যারী লাম একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আলোচনার পর। তিনি বলেছেন, হংকংয়ের এই আন্দোলনের পেছনে ‘বৈদেশিক শক্তি’র সম্পর্কিততা রয়েছে। যদিও তিনি বলেননি এই ‘বৈদেশিক শক্তি’ কারা। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূমিকার ব্যাপারে চীনা সরকারি ভাষ্যে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও সেই সঙ্গে পশ্চিমা শক্তি যদি হংকংকে আরো অস্থিতিশীল করতে চায়, তাহলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অবনতি ঘটতে বাধ্য। নিশ্চয়ই মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা এটি উপলব্ধি করবেন। কেননা পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির বিকাশে চীনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকাকে অবজ্ঞা করতে পারে না। তখন হংকংয়ের ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, যে ‘আবেদন’ নিয়ে এই আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, সেই ‘আবেদন’ এখন আর নেই। গত পাঁচ মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে হতাশা এসে গেছে। তারা চান না এ ধরনের অরাজকতা দীর্ঘদিন বজায় থাকুক এবং তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হোক। হংকংয়ের ‘বেসিক ল’তে ধীরে ধীরে সব পর্যায়ের নির্বাচন জনগণের ভোটে অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা যদি এদিকে লক্ষ্য রাখেন, তাহলে ভালো করবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, নিউইয়র্কের ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের মতো ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলনও ব্যর্থ হলো। Daily Manob Kontho 11.11.14

যে যুদ্ধের শেষ নেই

শেষ পর্যন্ত আসল কথাটি বলে ফেলেছেন জেনারেল অস্টিন। জেনারেল অস্টিন মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান। এই সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায় এখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী শহর কোবানির ওপর ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের অব্যাহত চাপ ও সম্ভাব্য কোবানির পতনের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল অস্টিন প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গ এই জেনারেল, যিনি এর আগে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর প্রধান ছিলেন বলেছেন, আইএসের জঙ্গিদের পরাজিত করা সহজ হবে না এবং যে যুদ্ধ আইএসের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
একজন শীর্ষস্থানীয় মার্কিন জেনারেল যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন মধ্যপ্রাচ্যে যে ‘নয়াযুদ্ধের’ সূচনা হয়েছে, তা বড় ধরনের একটি প্রশ্নের মুখে সবাইকে ফেলে দেয় বৈকি। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ যাবৎ কোবানি অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো সময় ইসলামি জঙ্গিদের হাতে কোবানির পতন ঘটতে পারে। কুর্দিরা এখানে বসবাস করে। তারাই যুদ্ধ করছে আইএসের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র তথা ২০ মিত্র রাষ্ট্র এখন এই যুদ্ধে শরিক হয়েছে। অব্যাহত মার্কিনি যুদ্ধবিমানের বোমাবর্ষণের কারণে আইএসের অগ্রযাত্রা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বটে, কিন্তু কোম্পানির ঘটনাবলি এখন সারা বিশ্বের আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। যুদ্ধরত কুর্দিদের সাহায্যের জন্য মার্কিন বিমান থেকে কুর্দিদের কাছে অস্ত্র ফেলা হলেও মার্কিন ইলেকট্রনিক মিডিয়া আমাদের জানাচ্ছে, পাঠানো অস্ত্রশস্ত্রের একটা বড় অংশ চলে গেছে ইসলামিক জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে মার্কিন ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে বাগদাদের ৯ মাইলের মধ্যে ঢুকে গেছে আইএসের জঙ্গিরা। ইরাকের বেশ কয়েকটি শহরের পতন ঘটেছে এদের হাতে। ইরাকের বেশ কয়েকটি তেলক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণভার এখন আইএসের জঙ্গিদের হাতে।
কোবানি রক্ষা নিয়েও একটা বড় ‘রাজনীতি’ হচ্ছে এবং এই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আঞ্চলিক রাজনীতি, বিশেষ করে পুরো অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব ও প্রতিপত্তির ব্যাপারে অনেকেই আতঙ্কিত।
ইতোমধ্যে কোবানি শহর রক্ষার জন্য গঠিত হয়েছে কুর্দিস্তান ডিফেন্স ফোর্স। এর মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে সিরিয়ার কুর্দিস্তানের ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি। অনেকেই ধারণা করে থাকেন ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টির সঙ্গে তুরস্কের কুর্দি ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকের সম্পর্ক রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা অনেকে বলার চেষ্টা করেন, পিকেকের একটি সম্প্রসারিত অংশই হচ্ছে সিরিয়ায় ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি। এদের সঙ্গে আবার ইরাকি কুর্দিদের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। কুর্দিরা মূলত এ অঞ্চলের চারটি দেশেই বসবাস করে। তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান। প্রতিটি দেশেই কুর্দিদের নিজস্ব সংগঠন রয়েছে। ইরাকে কুর্দিরা আবার বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। কোবানির ঘটনাবলি কুর্দি রাজনীতিকে সামনে নিয়ে এসেছে। সিরিয়ায় কুর্দিরা যখন কোবানি শহরে অবরুদ্ধ হয়ে রইল, তখন তুরস্কের একটা ভূমিকা বড় হয়ে দেখা দিল। দীর্ঘদিন তুরস্ক এই সংকটে নিজেকে জড়িত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল। এখানে একটা জটিল ‘রাজনীতি’ কাজ করছে। ইরাকি কুর্দিদের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো। ইরাকি কুর্দিরা চায় না সিরিয়ার কুর্দিরা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করুক। উত্তর ইরাকের কুর্দি ‘পেশমারগা’ (প্যারামিলিটারি ফোর্স) বাহিনী কোবানির যুদ্ধে সিরীয় কুর্দিদের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেও সিরিয়ার কুর্দি নেতারা তাতে আপত্তি জানিয়েছেন। তাত্ত্বিকভাবে পেশমারগা কুর্দিস্তান ডিফেন্স ফোর্সের বিরোধী। ফলে এক জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছে। কোবানি যুদ্ধে তুরস্কের সমর্থন, তার সীমান্ত ইরাকি কুর্দিদের ব্যবহার করতে দেওয়ার বিষয়টি পিকেকে দেখছে ভিন্ন দৃষ্টিতে। তারা মনে করে, এতে করে সিরিয়ার কুর্দিরা আরও শক্তিশালী হবে এবং পিকেকের ভূমিকা হ্রাস পাবে। এই জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়ে কোবানিতে মার্কিন বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। তবে এর পরিণতি কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে জেনারেল অস্টিন যে মন্তব্য করেছেন, তা হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
গেল বছর (২০১৩) আইএসের নাম প্রথম শোনা যায়। তখন এর নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট (আইএসআইএল)। ইতিহাসে সিরিয়া, জর্ডান, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরাক, সাইপ্রাস ও দক্ষিণ তুরস্ক নিয়ে যে বিশাল এলাকা তা লেভান্ট নামে পরিচিত। জঙ্গিরা এই নামটি তখন ধারণ করে। তবে ১৯৯৯ সালে এটি ‘জামাত আল তাওহিদ ওয়াল জিহাদ’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে মূলত সংগঠিত হয়েছিল। পরে ‘আল কায়েদা ইন ইরাক’ নাম ধারণ করে। এই সংগঠনটি মূলত সুন্নিনির্ভর ও ইরাকের সুন্নিপ্রধান এলাকায় এদের প্রভাব বেশি। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন শূরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। তবে ২৯ জুন (২০১৪) বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আল কায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আল কায়েদা আইএসের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কোন সম্পর্ক ছিন্ন করেছেÑ এটা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কেউ বলার চেষ্টা করছেন, আইএসের নৃশংসতা এর বড় কারণ। কেউ বলছেন, জিহাদি নেতৃত্ব কার হাতে থাকবেÑ এ জন্যই বিরোধের জন্ম হয়েছে। এদের রাজনীতি মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। আর বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন ধ্বংসের ঘোষণা করেছেন, যা আল কায়েদার নেতা লাদেন বা জাওয়াহিরি নিজেকে ঘোষণা করেননি। তবে এটা বলতেই হবে, আইএসের নৃশংসতা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। একাধিক মার্কিন সংবাদকর্মীর গলা কেটে হত্যা করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে একটি ভয়ের আবহ তৈরি করেছে আইএস। অতি সম্প্রতি কোবানিতে যুদ্ধরত এক কুর্দি তরুণী যোদ্ধার গলা কেটে জনৈক আইএস যোদ্ধার উল্লসিত ছবিও ইন্টারনেটে প্রকাশ পেয়েছে। আল কায়েদা তার শত্রুদের হত্যা করত বটে। কিন্তু এভাবে গলা কেটে হত্যা করত না। তবে আইএসের উত্থান অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. কোন শক্তি আইএসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে? যতদূর জানা যায়, আইএসের যোদ্ধারা প্রতি মাসে বেতন পান। অর্থের পরিমাণটা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অর্থ কোত্থেকে এসেছে? শুধু দখলকৃত অঞ্চলের (তিকরিত, মসুল) তেল বিক্রি করে এই অর্থ জোগান দেওয়া কি সম্ভব? অস্ত্রই বা আসছে কোত্থেকে? কারা অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে? দুই. আইএসের যোদ্ধারা ইতোমধ্যে দক্ষ একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এদের কারা প্রশিক্ষণ দিল? তিন. কে এই আবু বকর বুগদাদি? কারা তাকে সামনে নিয়ে এল? বিশ্বব্যাপী আল কায়েদা ধিকৃত। তখন বিকল্প আকেরটি ফোর্স তৈরি করে কোনো শক্তি কী চাচ্ছে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে? যদি মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তা তো মার্কিন অর্থনীতির চাঙ্গাভাব বজায় রাখতে সাহায্য করবে। কারণ মার্কিন অর্থনীতি তো ‘যুদ্ধ অর্থনীতি’। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। অস্ত্র বিক্রি বাড়ে। ব্যবসা বৃদ্ধি পায় যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে। ইরাক এর বড় প্রমাণ। এ ধরনের হাজারটা প্রশ্ন এখন উঠেছে। রাজনৈতিক প-িতরা এখন প্রশ্নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন।
তবে নিঃসন্দেহে কোবানির যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট পাল্টে দিতে পারে। এক. কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন তথা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশ্নটি এখন সামনে এল। চারটি দেশেই কুর্দিদের বসবাস। কুর্দিদের এলাকায় রয়েছে জ্বালানিসম্পদ তেল। ইরান কুর্দিদের তেল পরিশোধন করে, অন্যদিকে ইরান থেকে গ্যাস কেনে কুর্দিরা। ইরাকি কুর্দিরা এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। তাদের নিজস্ব পতাকা, পার্লামেন্ট ও সেনাবাহিনী আছে। ১৯২৩ সাল থেকেই কুর্দিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য ‘যুদ্ধ’ করে আসছে। ইরাকি কুর্দিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো। ইসরায়েলের সঙ্গেও কুর্দি নেতাদের সম্পর্ক ভালো। বর্তমান সংকট এ অঞ্চলে একটি কুর্দিরাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিল। এই রাষ্ট্রটি অনেকটা তাইওয়ান মডেলে গড়ে উঠতে পারে। দুই. কোবানির যুদ্ধ ও আইএসের উত্থান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করল। এক সময় মনে হয়েছিল আসাদের দিন শেষ। এখন দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা, যাদের মাঝে আরব রাষ্ট্রগুলোও আছে, তারা চাচ্ছে আসাদ থাকুক। মার্কিনি ছত্রচ্ছায়ায় আসাদবিরোধী যে ফ্রন্টের জন্ম হয়েছিল এবং যারা আসাদকে উৎখাতের জন্য রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ শুরু করে দিয়েছেন, এখন তারা আর আসাদবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন না। তাদের টার্গেট এখন ইসলামিক স্টেট। ফলে সুবিধা পাচ্ছেন আসাদ। তিন. ইসরায়েলও এখন পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে আসাদকে। এক সময় গোলান মালভূমি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। স্ট্র্যাটেজিকালি এর গুরুত্ব অনেক। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ইসরায়েলের মনোভাব নমনীয়। চার. ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছিল, আইএসের উত্থানে ইরানকে নিয়ে এখন আর তেমন উদ্বেগ নেই মার্কিন প্রশাসনের। এক সময় ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেখানে ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে, এমন অভিযোগ ছিল, মার্কিন তথা ইসরায়েলি বিমান হামলার একটা আশক্সক্ষা তৈরি হয়েছিল। এখন সেই প্রশ্ন ‘অতীত’। যুক্তরাষ্ট্রের এখন প্রয়োজন ইরানকে। আইএসের উত্থান এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা ও অবস্থানকে শক্তিশালী করল। পাঁচ. ইরাক এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে। কুর্দিরা স্বাধীন হয়ে গেলে আর সুন্নি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় একটি ‘জিহাদি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠিত হলে, শিয়ারা একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে ইরাকের অস্তিত্ব বহন করবে। ছয়. ইরাক ভেঙে গেলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ‘পরাজয়’।
কোবানি নিয়ে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে গেলে এখনো সেখানে মার্কিন স্থলবাহিনী বা মেরিন সেনা পাঠানো হয়নি। এই যুদ্ধে শুধু মার্কিন বিমান ব্যবহৃত হচ্ছে। আর তাতে ব্যয় হচ্ছে প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু আইএসের অগ্রযাত্রা বা তাদের ধ্বংস করা যাচ্ছে না। এই ‘যুদ্ধ’ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য।
 অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Amader Somoy
11.11.14