সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির বিপুল বিজয়ের পর এখানকার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মাঝে একটা প্রশ্ন উঠেছে, পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো এখন বেশ সতর্ক। রিপাবলিকান পার্টি এখন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে। ফলে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির আড়ালে কংগ্রেস একটি বড় ভূমিকা পালন করবে এবং প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করবে একটি কনজারভেটিভ নীতি গ্রহণ করতে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি আক্রমণ এবং চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর নীতি গ্রহণ করার ব্যাপারে কংগ্রেস বেশকিছু নীতি গ্রহণ করতে পারে। এমনকি আইএস দমনে ইরানের সহযোগিতা চেয়ে ওবামা খামেনিকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে আপত্তি তুলেছেন রিপাবলিকানরা। ফলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতার সম্ভাবনাও এখন প্রশ্নের মুখে থাকল।
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। ন্যাটো রাশিয়াকে ঘিরে ফেলতে চায় ও ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মোতায়েন করতে চায়- এ অভিযোগ রাশিয়ার দীর্ঘদিনের। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির পর থেকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সেপ্টেম্বরে (২০১৪) পূর্ব ইউক্রেনে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনের যে চুক্তি হয়েছে, ওই চুক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য ওবামা পুতিনকে অনুরোধ করেছেন। বেইজিংয়ে ওবামা-পুতিন সৌজন্য সাক্ষাৎ হয় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্ত অতিক্রম করেছে। তারা বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। এ নিয়ে সেখানে যুদ্ধ চলছে এবং তাতে প্রায় চার হাজার নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে দাবি করেছে জাতিসংঘ। এখন রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেয়, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। কংগ্রেস নির্বাচনে তার সমর্থকদের পরাজয়ের পর প্রথম সফর হিসেবে ওবামা চীনে যান। সেখানে তিনি এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (অ্যাপেক) সম্মেলনে যোগ দেন। এরপর যান মিয়ানমারে ইস্ট এশিয়া সামিটে যোগ দিতে। মিয়ানমারে এটা তার দ্বিতীয় সফর। দ্বিতীয়বার নির্বাচনের পরপরই (২০১২) তিনি মিয়ানমার সফর করেছিলেন। এরপর যান অস্ট্রেলিয়ায় জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক আগামীতে কোনদিকে গড়ায়, এ ব্যাপারে বিশ্লেষকদের আগ্রহ এখন অনেক বেশি। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে 'ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলার' এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনকে দুর্বল করাই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ নিচ্ছে 'ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট' বা টিপিপিএফটি করার। প্রস্তাবিত এ চুক্তিতে চীনকে রাখা হয়নি। অথচ এশিয়ার তথা প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি চীন। ২০০৯ সালে প্রথম টিপিপিএফটির কথা জানা যায়। এখন এ চুক্তির আওতায় আছে ১১টি দেশ- অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, চিলি, মালয়েশিয়া, মেঙ্েিকা, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। ২০১২ সালে এ অঞ্চলের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সেবা খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৪২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব জিডিপির ৪০ ভাগ এ অঞ্চলের। আর বিশ্ব বাণিজ্যের ২৬ ভাগ পরিচালিত হয় এ অঞ্চলে। কিন্তু চীনকে বাদ দিয়ে এ চুক্তি নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। আগামী বছর এ চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার কথা। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। রিপাবলিকানরা চাইবে অতি দ্রুত এ চুক্তিটি স্বাক্ষর হোক। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, চীন এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের দুটি বড় অর্থনীতির একটি জোট গঠিত হলো। দক্ষিণ কোরিয়া অনেক আগেই মধ্যম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ার মোট রফতানির ২৬ দশমিক ০৫ ভাগ রফতানি হয়েছে চীনে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৯ ভাগ। বলা হচ্ছে, ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রফতানি (এ অঞ্চলে) বাড়বে ৩০০ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রফতানির ৩৯ দশমিক ৫ ভাগ। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২১৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। এখন প্রশ্ন থাকবে, টিপিপিএফটি চালু হলে চীন-দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কের ওপর তা কতটুকু প্রভাব ফেলবে? একইসঙ্গে চীন, রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলকে নিয়ে ব্রিকস ব্যাংক গড়ে উঠেছে, যা কিনা বিশ্বব্যাংকের কর্তৃত্ব ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছে। চীন এরই মধ্যে 'এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গঠন করেছে। বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ এ ব্যাংকের ব্যাপারে এরই মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীনের এ ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে খুব ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের এ ভূমিকাকে অস্বীকার করতে পারবে না। কেননা যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস ও তেল আহরণ ক্ষেত্র, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও কৃষিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক খারাপ হলে এ বিনিয়োগে তা প্রভাব ফেলবে।
সামরিক ক্ষেত্রেও পারস্পরিক অবিশ্বাস আছে। চীন রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে 'সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন' নামক একটি সংস্থা গড়ে তুলেছে। মধ্য এশিয়ায় তথা জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করছে এ সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, পূর্ব চীন সাগরে চীন একটি 'ওয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন' গড়ে তুলেছে। অর্থাৎ বিতর্কিত ও তেল সম্পদসমৃদ্ধ এ অঞ্চলে চীন অন্য কারও কর্তৃত্ব স্বীকার করে না। এটা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করার শামিল। এ অঞ্চলে চীনের ভূমিকাকে অনেক পর্যবেক্ষক 'চীনা মনরো ডকট্রিন' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত 'মনরো ডকট্রিনের' সময় যা ছিল ইউরোপীয় শক্তি (অর্থাৎ মার্কিন এলাকায় কোনো ইউরোপীয় শক্তির জড়িত থাকাকে চ্যালেঞ্জ করা)। এক্ষেত্রে চীনা এলাকায় কোনো বিদেশি শক্তির (জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র) জড়িত থাকার বিষয়ে চীনের অপছন্দ। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় মহাসাগর অঞ্চলে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক স্প্রি্রটের ছয়টি যুদ্ধজাহাজ ভারতীয় মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে 'ঘিরে ফেলার' যে নীতি প্রণয়ন করেছে, তার অংশ হিসেবেই ভারতীয় মহাসাগরে এ যুদ্ধজাহাজগুলো মোতায়েন করা হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র তা স্বীকার করে না। বলা ভালো, ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীনের জ্বালানি সম্পদের প্রায় ৬০ ভাগ চীন এ পথে আমদানি করে। চীন কোনো অবস্থাতেই চাইবে না এ জ্বালানি সম্পদ সরবরাহে কোনো বাধা আসুক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরকে একত্রিত করে চীন তার 'মুক্তার মালা' নীতি প্রণয়ন করেছে। অর্থাৎ এ অঞ্চলে চীন তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নৌজাহাজের উপস্থিতি এক ধরনের স্নায়ুচাপ সৃষ্টি করবে চীনের ওপর। চীন এটা ভালো চোখে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। ফলে আগামীতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
তাই পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা নতুন করে এক 'স্নায়ুযুদ্ধের' জন্ম দিতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ সময়কার পরিস্থিতিকে মেলান যাবে না। ওই সময় বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই পরাশক্তির প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতার কারণে ওই সময়ে বড় ধরনের যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। যুদ্ধ হয়নি বটে। কিন্তু দীর্ঘসময় বিশ্বকে একটি উত্তেজনার মধ্যে রেখেছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল সত্য; কিন্তু তা ছিল সাময়িক। ২০ বছর পর নতুন আঙ্গিকে 'স্নায়ুযুদ্ধ' শুরু হয়েছে। তবে পার্থক্যটা হলো স্নায়ুযুদ্ধে একসময়কালে পক্ষ ছিল দুটি- যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এখন পক্ষ বেশ ক'টি। চীন, ভারত এমনকি ইরানও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর। এখন দেখতে হবে, এ শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। এখানে প্রয়োজন একটি 'রিয়েল পলিটিকসের'। অর্থাৎ বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করা। বিশ্ব নেতারা যদি এ বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ না করেন, তাহলে বিশ্বে উত্তেজনা থাকবেই। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, এ বাস্তববাদী নীতির বড় অভাব। যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' সূচনা করে মুসলিম বিশ্বকে পদানত রাখার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে। দেশটি আফগানিস্তানে যুদ্ধের সূচনা করে, তা এখন সম্প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইরাক-সিরিয়ায় সীমিত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের সীমানাও পরিবর্তিত হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের ওপরও 'চাপ' বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হচ্ছে রাজনীতিতে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কনজারভেটিভ রিপাবলিকানদের দখলে চলে যাওয়ায় বিশ্ব-রাজনীতিতে উত্তেজনার সম্ভাবনা আরও বাড়ল।
Daily Alokito Bamgladesh
23.11.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment