গত ৪ নভেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের
মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তাতে আগামী দিনে মার্কিন রাজনীতি
নিয়ে একটি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সিনেট নিয়ন্ত্রণ করত
ডেমোক্র্যাটরা। আর রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রতিনিধি পরিষদ। ফলে অনেক
নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রেসিডেন্ট ওবামা সিনেটের সমর্থন পেয়েছেন। প্রতি দুই বছর
পর পর প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি আসনেই নির্বাচন হয়। আর ১০০ সদস্যের সিনেট আসনের
এক-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচন হয়। ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও প্রতিনিধি
পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ওবামা দ্বিতীয়বারের
মতো বিজয়ী হলেও প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণভার চলে গিয়েছিল রিপাবলিকান পার্টির
হাতে। ২০১২ সালের পর ২০১৪ সালে আবার নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি
আরো ১৩টি প্রতিনিধি পরিষদের আসন বেশি পেয়েছে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে,
প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টির আসন এখন ২৪৩, আর ডেমোক্রেটিক পার্টির ১৭৯।
অন্যদিকে সিনেটে রিপাবলিকানরা অতিরিক্ত সাতটি আসনে বিজয়ী হওয়ায় রিপাবলিকান পার্টির
আসন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২, আর ডেমোক্রেটিক পার্টির আসন কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৫টিতে।
দুটি আসনে রয়েছেন নিরপেক্ষরা। আর একটি আসনে 'রানঅফ' হওয়ায় ডিসেম্বরে অথবা
জানুয়ারিতে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
কংগ্রেসের নির্বাচনের পাশাপাশি
বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নর পদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে দেখা যায় ৩১টি রাজ্যে
গভর্নর পদে বিজয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীরা। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক
পার্টির গভর্নর পদে বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র ১৭। ফলে এক কথায় যা বলা যায় তা
হচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থীর জয়ই সর্বত্র। এই নির্বাচনে অনেক বিষয় এবার লক্ষণীয়।
এক. শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৭৫ শতাংশ ভোট দিয়েছে। তাদের মধ্যে রিপাবলিকানদের
পক্ষে ভোট দিয়েছে ৬০ শতাংশ, আর ডেমোক্র্যাটদের ৩৮ শতাংশ। কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে ৮৯
শতাংশ ভোট দিয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের ৭০ শতাংশ ভোট দিয়েছে ডেমোক্র্যাটদের, মাত্র
১০ শতাংশ ভোট দিয়েছে রিপাবলিকানদের। ল্যাটিনো ভোটারদের মাত্র (৮ শতাংশ) ৬২ শতাংশ
ভোট পেয়েছে ডেমোক্র্যাটরা, আর ৩৬ শতাংশ রিপাবলিকানরা।
দুই. মার্কিন কংগ্রেসের মধ্যবর্তী
নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। এই কালো টাকাকে তারা বলছে
'ডার্ক মানি'। ৪ নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে এই কালো টাকা ব্যয় করা হয়েছে
প্রধানত রিপাবলিকান প্রার্থীরা কিভাবে বিজয়ী হবেন সে জন্য। নির্বাচনী প্রচারণায়,
বিশেষ করে দলীয়ভাবে অপর পক্ষকে (এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের) হেয় প্রতিপন্ন করার
জন্যই এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর
রেসপনসিভ পলিটিকস তাদের গবেষণায় এই কালো টাকার একটি হিসাব দিয়েছে। তারা জানিয়েছে,
মধ্যবর্তী এই নির্বাচনে মোট ব্যয় হয়েছে ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। শুধু নেতিবাচক
প্রচারণার কাজে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি
টাকায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। চিন্তা করা যায়! তা-ও আবার পুরো নির্বাচনের জন্য
নয়। মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ সিনেট আসন ও সমগ্র প্রতিনিধি পরিষদের আসনের জন্য। ২০০৮
সালে কালো টাকা খরচের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন, আর ২০১০ সালে ছিল ৩ দশমিক ৮৫
বিলিয়ন। ২০১২ সালেও প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। কিভাবে খরচ হয় এ টাকা? মূলত
টিভি বিজ্ঞাপন বাবদ, বিলবোর্ড নির্মাণ বাবদ অর্থাৎ প্রচারণার কাজেই এ টাকা ব্যবহৃত
হয়। এ ক্ষেত্রে এক দল অন্য দলের বিভিন্ন সমালোচনা করে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয়। এটা
বৈধ। প্রার্থীর ব্যক্তিগত চরিত্র কিংবা কর্মকাণ্ড স্থান পায় কম। সেন্টার ফর
রেসপনসিভ পলিটিকস তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে কিভাবে নেতিবাচক প্রচারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১০ সালের সিনেট নির্বাচনে ইতিবাচক প্রচারণা ছিল ৪৩.১ শতাংশ, আর নেতিবাচক
প্রচারণা ছিল ৪৩.৭ শতাংশ। ২০১৪ সালে নেতিবাচক প্রচার বেড়েছে, যথাক্রমে ২৭.৫ শতাংশ
ও ৫৫ শতাংশ। তেমনি প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে ২৭.৬ শতাংশ (২০১০) থেকে বেড়েছে
৪১.৪ শতাংশ (২০১৪)। ইতিবাচক প্রচারণা ছিল ৫২ (২০১০) ও ৪৭.৬ শতাংশ (২০১৪)। গভর্নর
পদে নির্বাচনে এই নেতিবাচক প্রচারণা বেড়েছে ৩৩ শতাংশ (২০১০) থেকে ৪৭.৮ শতাংশ
(২০১৪)। সুতরাং বোঝাই যায় এই নেতিবাচক প্রচারণা এবার যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী
নির্বাচনে কিভাবে প্রভাব ফেলেছে। এখানে বলা ভালো, বিভিন্ন বেসরকারি
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই নেতিবাচক প্রচারণায় টাকা দিয়ে থাকে।
যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের চেম্বার্স অব
কমার্স ৩১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, ক্রসরোড জিপিএস ২৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন, লিগ অব
কনজারভেটিভ ভোটারস ৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন, ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশন ৬ দশমিক ৭
মিলিয়ন ডলার ইত্যাদি। দেখা গেছে, এসব সংগঠনের মূল টার্গেট হচ্ছে ডেমোক্র্যাটরা এবং
তাদের প্রচারণার অর্থ হচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থীদের কংগ্রেসের উভয় কক্ষে বিজয়ী
করানো। ফলে দেখা গেছে, এই কালো টাকার প্রভাবে রিপাবলিকান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।
৪ নভেম্বরের (২০১৪) যুক্তরাষ্ট্রের এই মধ্যবর্তী নির্বাচন আরেক গুরুত্ব বহন করে।
এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর মার্কিন রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিশেষ করে
২০১৬ সালে এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের ফলাফল
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায়
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (২০১২) দুই বছর পর কংগ্রেসের উভয় কক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হলো। ফলে সিনেটের তিন ভাগের এক ভাগ আসনের আর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের পুরো আসনে
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সিনেট সদস্যরা ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে বেশ
কয়েকটি রাজ্যের গভর্নর, কিছু রাজ্যের কংগ্রেসের, কোনো কোনো শহরের মেয়রের নির্বাচনও
একই সময় অনুষ্ঠিত হলো। ৪ নভেম্বর মোট ৪৭১টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এর মধ্যে
ছিল হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের ৪৩৫টি আসন এবং সিনেটের ৩৬টি আসন। একই সঙ্গে ৪৮টি
গভর্নর পদেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্রেটিক
পার্টির নিয়ন্ত্রণে ছিল সিনেট। ১০০ সিনেট আসনের ৫৩টি ছিল ডেমোক্র্যাটদের। এখন তা
কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৫-এ। রিপাবলিকানদের হাতে এখন ৫২টি আসন। দুজন রয়েছেন নিরপেক্ষ।
অন্যদিকে ৪৩৫ আসনের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রিপাবলিকানদের দখলে ছিল ২৩৩টি আসন
(এখন ২৪৩) আর ডেমোক্র্যাটদের ছিল ১৯৯ আসন (এখন ১৭৯)। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই
আসনবিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অতীতে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে নানা জটিলতায়
জড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। গেল বছর 'শাট ডাউন'-এর মতো ঘটনাও ঘটেছিল।
বর্তমানে দুটি ইস্যুতে (এবোলা ও আইএসের উত্থান) ওবামা বিপদে আছেন। এখন কংগ্রেসে
তাঁর সমর্থন না থাকলে ভবিষ্যতে তাঁর সরকার পরিচালনায় সমস্যা হবে। বুশের সময় সিনেট
ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টির দখলে। বুশ নিজে ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির সদস্য এবং মজার
ব্যাপার হলো, ওই সময় অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদও ছিল
ডেমোক্র্যাটদের দখলে। পরিস্থিতি বদলে গেল প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময়। ক্লিনটনের
সময়, ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট নিয়ন্ত্রণ করেছে
রিপাবলিকানরা। অথচ প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ছিলেন ডেমোক্র্যাট। আবার প্রেসিডেন্ট বুশের
(জুনিয়র) সময়সীমায়ও প্রথম দিকে, ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিনিধি
পরিষদ ও সিনেট নিয়ন্ত্রণ করেছে রিপাবলিকানরা। প্রেসিডেন্ট ওবামার দুই টার্মে (২০০৮
সালে তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন) দুই রকম দৃশ্য দেখা যায়। ২০১২ সাল
পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদ তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টির নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর প্রথম
থেকে (২০০৮ থেকে) এখন পর্যন্ত সিনেট ডেমোক্র্যাটদের দখলে। কিন্তু ২০১২ সালের
মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদ চলে যায় রিপাবলিকানদের দখলে। ফলে চলতি ২০১৪
সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্লিনটনের সময়কার পরিস্থিতির মতো (যখন
কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করেছে বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি) একটি পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের দখলে থাকছে প্রেসিডেন্সি। কিন্তু
কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করবে বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি। ফলে আগামী দুই বছর ওবামাকে নানা
ঝামেলা পোহাতে হবে।
আমাদের দেশের মতো নির্বাচনে ওবামার দল
এখন হেরে গেল বটে। কিন্তু তাতে প্রেসিডেন্ট ওবামার পদত্যাগের কোনো সুযোগ নেই। অথবা
তাঁকে পদত্যাগ করানোও যাবে না। তবে প্রশাসন পরিচালনায় তিনি সমস্যায় পড়বেন এবং
তাঁকে রিপাবলিকানদের সমর্থন নিয়েই প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে। রিপাবলিকানরা তাদের
পছন্দমতো বিল কংগ্রেসে পাস করতে পারবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাতে 'ভেটো' দিতে
পারবেন। অন্যদিকে ওবামার অনেক ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে না। কেননা তাতে রিপাবলিকানদের
সমর্থন থাকবে না। ফলে সৃষ্টি হবে নানা জটিলতার।
নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে
ওবামা আশা প্রকাশ করেছেন যে তিনি প্রশাসন পরিচালনায় কংগ্রেসের সমর্থন পাবেন। তিনি
জঙ্গি তথা আইএসের উত্থান ঠেকাতে, এবোলা বিস্তার রোধে এবং অবৈধ অভিবাসীদের একটি
আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে কংগ্রেসের সহযোগিতা চেয়েছেন। তাঁর স্বাস্থ্যসেবাও
(ওবামা কেয়ার) এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। মানুষ হতাশাগ্রস্ত ছিল। ভোটেই তার প্রতিফলন
ঘটল। কিন্তু কংগ্রেস আর প্রেসিডেন্ট যদি একসঙ্গে কাজ করতে না পারে, তাহলে এক জটিল
পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে যুক্তরাষ্ট্র। কংগ্রেস এখন প্রেসিডেন্টকে কতটুকু ছাড় দেয়
কিংবা প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের কথা কতটুকু শুনবে- সেটিই এখন দেখার বিষয়। মধ্যবর্তী
নির্বাচনের ফলাফল একটা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করল মাত্র।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
0 comments:
Post a Comment