রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভুয়া ডিগ্রিধারীদের বহিষ্কারই যথেষ্ট নয়

সংবাদটি ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। তাতে বলা হয়েছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যকে তার পিএইচডি ডিগ্রি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার এই বহিষ্কার এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর শিক্ষকতা করে আসছি, আমাদের একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কেননা আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেরই পিএইচডি এবং বিদেশি ডিগ্রি রয়েছে। আমাদের সবার পিএইচডি নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে! আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে চিনি, যিনি এখন সম্ভবত চাকরি করেন না অথবা ছুটিতে আছেন। তিনি অনলাইনে একটি ‘পিএইচডি’ ডিগ্রি নিয়েছিলেন অর্থনীতিতে তথা ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে। যদিও এই বিষয়ে তার অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি ছিল না। তিনি ওই ডিগ্রিটা নিয়েছিলেন, যাতে করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনে কাস নিতে সুবিধা হয়। তবে সচেতনভাবে তিনি ওই ডিগ্রিটি ব্যবহার করতেন না নামের আগে। কিন্তু যাকে নর্থ সাউথ থেকে বহিষ্কার করা হলো, যতদূর জানি তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এমনকি তিনি এর আগে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট-ওয়েস্টে সহ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখানে অনেক প্রশ্ন এসে যায় সঙ্গত কারণেই। এক. নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিয়োগের আগে তার ডিগ্রিটি সঠিক কি না, তা কেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে যাচাই-বাছাই করে নিল না? দুই. তিনি আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দায়িত্বে ছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কেন তার ডিগ্রি যাচাই করল না? তিন. তিনি তো দীর্ঘদিন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন। তাহলে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কেন তার ব্যাপারে আগে সতর্ক হলো না। ২০০৪ সালে ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ইংরেজি নিউ এইজ পত্রিকায় তখন এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। যিনি সংবাদটি প্রকাশ করেছিলেন, তিনি আমাকে মেইলে কনফার্ম করেছেন এবং ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তাহলে এই ব্যক্তি সম্পর্কে আগেই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। তবুও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আমি ধন্যবাদ দেব যে, তারা শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কার করল। কিন্তু বহিষ্কারই যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি একটি বড় অপরাধের যা শাস্তি তা তার প্রাপ্য। নিজেকে এবং নিজের ডিগ্রি ‘জাস্টিফাই’ করার জন্য অপর একটি দৈনিকে ছাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার তথাকথিত ডিপিএ ডিগ্রিটি পিএইচডি মানের। এই তথ্যটি ভুল এবং প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার শামিল। ডিপিএ নামের একটি ডিগ্রি আছে বটে, কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই পিএইচডি সমমান তো নয়ই, বরং একাডেমিক মানেরও নয়। মূলত ডিপিএ ডিগ্রি দেওয়া হয় অনলাইনে। ১৯৭৭ সালে অনলাইন ছিল না। কিন্তু ওই সময় কিভল্যান্ড (ওহাইও) বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপিএ ডিগ্রি ছিল, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে জানাতে পারেনি। উপরন্তু ডিপিএ ডিগ্রি তাদেরই দেওয়া হয়, যারা ব্যবসা প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। একটু খোঁজখবর নিলেই দেখা যাবে, ডিপিএ ডিগ্রিটি কী এবং তা কীভাবে দেওয়া হয়। ইন্টারনেটের এই যুগে কিভল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করাও কঠিন কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডিগ্রি ভেরিফাই’ নামে একটা শাখা আছে। সেখান থেকেও তথ্য নেওয়া যায়। এ ধরনের একটি ভুয়া পিএইচডির খবর আমাদের চোখ খুলে দিল। ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন আরেকটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমাদের জানিয়েছে, দেশে প্রায় ৫ হাজার ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী রয়েছে। যারা ইতোমধ্যে ওই ডিগ্রি ব্যবহার করে অনেক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। ওই প্রতিবেদক আমাকে জানিয়েছেন, খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। শর্ষের ভেতরেই যদি ভূত থাকে, তাহলে আমরা ভূত তাড়াব কীভাবে? সমাজের সর্বত্র এখন ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ছড়াছড়ি (যে কারণে আমি নিজে এখন আর নামের আগে ‘ড.’ শব্দটি ব্যবহার করি না। এটা আমার প্রতিবাদও বলতে পারেন!)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত, নিম্ন আদালত, বেসরকারি ব্যাংকের এমডি, উকিল, জজ, সচিব সবাই এখন নির্বিবাদে এই ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। কেউ জানেন। কেউ আবার জানেন না। সংবাদপত্রের কর্মীরা প্রায়ই না জেনেশুনে, পরীক্ষা না করে নামের আগে ‘ড.’ শব্দটি জুড়ে দেন। এতে করে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে যায়। এক এনজিও নেত্রীকে আমি বারবার বলেছি এই পদবি ব্যবহার না করার জন্য। তিনি তা করছেন এবং অবৈধভাবে অধ্যাপক শব্দটিও ব্যবহার করছেন। কে দেখবে এসব?
কেউ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে না গেলে তার ডিগ্রি যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। তবে কমিশন প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের তালিকা এখন চাইতে পারে। আমরা যখন মঞ্জুরি কমিশনে ছিলাম তখন আমার উদ্যোগেই ও আমার এক সহকর্মীর সহযোগিতায় শিক্ষকদের একটা ‘ডাটা ব্যাংক’ তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই কাজটি করা আর হয়নি। কারা এর জন্য দায়ী? অবৈধ কর্মকর্তারা সব জায়গাতেই আছে। কীভাবে সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করতে হয়, তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানে। তাই ‘ম্যানেজ’ হয়ে গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটা ব্যাংকের উদ্যোগটি এখন ইউজিসির ডিপ ফ্রিজে। যারা সেখানে সদস্য হিসেবে যান, তারা বিষয়টি বোঝেন কি না, তাতে আমার সন্দেহ রয়েছে। এখন একজন সহ-উপাচার্যের ভুয়া পিএইচডির বিষয়টি যখন ধরা পড়ল, তখন ইউজিসির উচিত অবিলম্বে ‘ডাটা ব্যাংক’-এর কার্যক্রম শুরু করা।
পিএইচডি হচ্ছে একটা গবেষণা। একজন গবেষককে একটি তত্ত্বের আলোকে একটা নতুন গবেষণা উপস্থাপন করতে হয়। এটা একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা। নতুন একটি তথ্য তিনি গবেষণা করে উপস্থাপন করবেন। কিন্তু আমাদের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা তা কী করছেন? কোথায় তাদের গবেষণা? আরও একটা কথা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ব্যাপকভাবে পিএইচডি দেওয়া শুরু হয়েছে। কী তার কোয়ালিটি? কে তাদের তত্ত্বাবধায়ক? কীভাবে তারা গবেষণা করছেন? এসব দেখার কেউ নেই। মজার কা-, যার নিজেরই পিএইচডি নেই, অধ্যাপকও ননÑ তারাও এখন পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা পিএইচডি নিচ্ছেন কোনো রকম গবেষণা না করেই। পুলিশের শীর্ষ ব্যক্তিসহ ডজন ডজন কর্মকর্তা এখন পিএইচডি ডিগ্রিধারী অথবা নেওয়ার পথে। অথচ একটিবারের জন্যও তারা লাইব্রেরিতে যাননি। ফিল্ড ওয়ার্ক করেননি। কে তাদের থিসিস লিখল? ছুটি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু কেউ ছুটি নিচ্ছেন না। আমরা পিএইচডি ডিগ্রিটাকে এখন হাস্যাস্পদ ব্যাপারে পরিণত করেছি। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়েই পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদের ওই ফিল্ডে নিজস্ব কোনো শিক্ষক নেই। ধার করা শিক্ষক দিয়ে তারা পিএইচডি কোর্স পরিচালনা করছে। এটি কি ঠিক? এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? যদি সত্যিকার অর্থেই ডিগ্রি দিতে হয়, তাহলে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ধার করা শিক্ষক দিয়ে পিএইচডি কোর্স পরিচালনা করা যাবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে ইউজিসিকে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার আহ্বান জানাচ্ছি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ছড়াছড়ি রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার চেয়েও মারাত্মক। সমাজকে তা অধঃপতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কথা ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংসদের শিক্ষা-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি তৎপর হয়েছে। সংসদীয় কমিটির পরবর্তী সভায় আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি রয়েছে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম তাদের ‘একটি’ ভূমিকা দেখার জন্য। এখন যেটা করার দরকার, তা হচ্ছেÑ ১. ইউজিসি অবিলম্বে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষকদের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করবে। এক মাসের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষকদের ডিগ্রির তালিকা দেবে এবং ইউজিসি তা যাচাই-বাছাই করবে এবং ভুয়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবে। ২. অনলাইন পিএইচডি যে একাডেমিক কোনো ডিগ্রি নয়, তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ করবে ও সতর্ক করবে। ৩. ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ব্যবহার নিষিদ্ধ ও ব্যবহারকারীদের কঠোর শাস্তির বিধানসংবলিত আইন সংসদে পাস করতে হবে। অথবা প্রচলিত আইনে সংশোধনী আনতে হবে। ৪. প্রয়োজনে ইউজিসি এ সংক্রান্ত একটি ‘সেল’ গঠন করবে। ৫. প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি করে ‘সেল’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যারা তাদের শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রির মান পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করবেন। ৬. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রক্রিয়ায় বিশেষ কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করতে হবে। কোনো প্রার্থী পদে থেকে পিএইচডি করতে পারবেন না। আইন অনুসরণ করে ছুটি নিয়ে প্রার্থীকে গবেষণা পরিচালনা করতে হবে। ভাড়া করা শিক্ষক দিয়ে পিএইচডি কোর্স চালু করা যাবে না। কোনো বিভাগে ন্যূনতম ৪ থেকে ৫ জন অধ্যাপক না থাকলে, সেই বিভাগ পিএইচডি কোর্স চালু করতে পারবে না। ইউজিসি এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। একটা অদ্ভুত সমাজে আমরা বসবাস করছি। ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে আমরা শিক্ষকতার চাকরি নিচ্ছি। বছরের পর বছর চাকরি করছি। কিন্তু ভুয়া ডিগ্রির খবর জানাজানি হয়ে গেলেও কোনো শাস্তি হচ্ছে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক কানেকশনে পার পেয়ে যাচ্ছেন। একটা অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দেয়। একটি ভুয়া পিএইচডি আরেকটি ভুয়া পিএইচডির জন্ম দিচ্ছে। টাকার বিনিময়ে এখন পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা নিয়ে এই যে বেসাতি, তা পৃথিবীর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা ইউজিসির দায়িত্ব অনেক বেশি। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবেই পালন করবেন। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র Daily Amader Somoy 16.11.14

0 comments:

Post a Comment