রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইসলামিক স্টেটের উত্থানকে কেন গুরুত্ব দিতে হবে

ইসলামিক জঙ্গিবাদী সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটের কর্মকা- এখন আর শুধু ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই জঙ্গিবাদী সংগঠনের তৎপরতা সম্প্রসারিত হয়েছে লিবিয়া, মিসর ও তিউনিসিয়াতেও। এমনকি উত্তর আফ্রিকাতেও এদের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। তবে এসব দেশে জঙ্গিরা আইএসের ব্যানারে তাদের কর্মকা- পরিচালনা না করলেও, স্থানীয়ভাবে সংগঠিত ইসলামিক জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে লিবিয়া। লিবিয়ার শহর দারনা এখন ইসলামিক স্টেটের নিয়ন্ত্রণে। ভূমধ্যসাগর ঘেঁষে এই শহরটি বেনগাজি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ইসলামিক জঙ্গিরা শহরটি দখল করে পরে তারা শহরটি ইরাক-সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক স্টেটের ‘বারকা প্রদেশ’ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরব বসন্তর ব্যর্থতাই আরব বিশ্বে ইসলামিক জঙ্গিদের ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত করেছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফি-পরবর্তী সময়সীমায় দেশটিতে কোনো রাজনৈতিক কাঠামোর জন্ম হয়নি। সেখানে নামেমাত্র একটি সরকার রয়েছে। কিন্তু ওই সরকারের কোনো কর্মকা- নেই। বরং ইসলামিক জঙ্গিরা এখন দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। এককভাবে কোনো একটি বিশেষ জঙ্গিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে লিবিয়া নেই। রাজধানী এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছে ‘ফজর লিবিয়া’ নামে একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। অন্যদিকে, দারনা প্রথমে দখল করে নেয় ‘ইসলামিক ইয়ুথ সুরা কাউন্সিল’। জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল শারিয়া থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে এই ইসলামিক ইয়ুথ কাউন্সিল গঠন করে। এদের সঙ্গে ‘আল বাতার ব্রিগেড’ যোগ দেয়। এবং নিজেদের ইসলামিক স্টেটের সম্প্রসারিত অংশ বলে ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে দারনা ইসলামিক খেলাফত রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। কেননা ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যভাগ নিয়ে যে বিশাল এক খেলাফত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, এরই প্রদেশ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করেছে দারনা শহরের জঙ্গিরা। এটা নিঃসন্দেহে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সেই সঙ্গে উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য দেশের জঙ্গিদের উৎসাহিত করবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। যদিও আমাদের কাছে এমন কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নেই, এ দেশের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আইএস বা আল কায়েদার কোনো যোগাযোগ রয়েছে। এ সংগঠন বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করে। তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে যেসব জঙ্গি সংগঠন কাজ করছে, তারা এখন প্রকাশ্যেই আইএসকে সমর্থন করছে এবং আইএসের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যেমন বলা যেতে পারে নাইজেরিয়ায় হারাম, ফিলিপাইনের আবু মায়াখ গ্রুপ, পাকিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী। একটা কথা আমাদের জানা দরকার, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থান নতুন একটি পথ দিয়েছে। তবে আল কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখা ইতোমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার নিয়ে এই শাখা গঠিত। এটি আমাদের জানা নেই। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারা সংগঠিত হচ্ছে। ভারতে ইসলামি জঙ্গিরা রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাদের সঙ্গে আল কায়েদার ও আইএসের সম্পর্ক কী, তা এখন খতিয়ে দেখার বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এই কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন আল কায়েদা ও আইএসের মধ্যে নীতিগতভাবে ও জঙ্গি তৎপরতার দিক দিয়ে কিছু পার্থক্য রয়েছে। আইএস যেখানে সশস্ত্র যুদ্ধ করছে এবং ইতোমধ্যে ইরাক-সিরিয়ার একটি বিশাল এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সেখানে আল কায়েদা এখনো তাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উপরন্তু আল কায়েদার সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্ক বা তাদের শাখা থাকলেও আইএসের শাখা অন্যত্র নেই। এমনকি পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়ার মতো দেশে, যেখানে জঙ্গি তৎপরতা রয়েছে, সেখানে আইএসের কোনো শাখা নেই। সুতরাং বাংলাদেশ বা ভারতে আইএস এই মুহূর্তে কোনো শাখা না-ও খুলতে পারে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থানে উৎসাহিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সব জঙ্গির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাই জরুরি। আল কায়েদা তার জঙ্গি তৎপরতা পরিচালনা করে সীমিত জায়গায় সংগঠিত হয়ে, আক্রমণ করে, যাকে বিশ্লেষকরা ‘স্পাইডার ওয়েভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাকড়সা যেভাবে ছোট জায়গায় জাল বোনে এবং ওই জাল ভেঙে গেলে আবার অনত্র গিয়ে জাল বোনে। আল কায়েদার স্ট্র্যাটেজি অনেকটা তেমনই। তারা এক জায়গায় একত্র হয়। ওখানকার স্থাপনার ওপর আক্রমণ করে। এবং তা ধ্বংস করে দেয়। পরে আবার অন্যত্র গিয়ে আক্রমণ করে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের তেমন একটা স্ট্র্যাটেজি চোখে পড়ে না। এদের বড় কোনো কর্মকা- সম্প্রতি আমাদের চোখে পড়েনি। ওরা যে খুব শক্তিশালী, তা-ও আমার কখনোই মনে হয়নি। মাঝেমধ্যে দু-একজন ধরা পড়ে। তবে এদের কোনো কর্মকা- নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে এরা সংগঠিত হতে পারছে না। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ একটা বৈশ্বিক সমস্যা। মুসলিমপ্রধান অঞ্চলেই এদের তৎপরতা। এই জঙ্গি তৎপরতা এখন সদূর আফ্রিকায়, যেখানে মুসলমান খ্যাতি রয়েছে, সেখানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। নাইজেরিয়ার বোকো হারামের উত্থান এর বড় প্রমাণ। পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা এদের নিয়ন্ত্রণে। চাদ, সুদানের মতো দেশেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে, জঙ্গি তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে এখন আফ্রিকায় সম্প্রসারিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডেও জঙ্গিরা তৎপর। ইন্দোনেশিয়ায় এদের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশকে এরা টার্গেট করবে, এটাই স্বাভাবিক। সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনটা তাই এ কারণেই।জঙ্গিবাদ মানবতার শত্রু। আল কায়েদা কিংবা আইএস যেভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ ওই জঙ্গিবাদকে কখনোই সমর্থন করবে না। জঙ্গিবাদী ইসলাম আসলেই কোনো ইসলাম নয়। গলা কেটে, বোমা মেরে মানুষকে হত্যা করার নাম ইসলাম হতে পারে না। ইসলাম মানবতার ধর্ম। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে, বোমা বানায়, এদের কোনো গণভিত্তি নেই। মানুষ এদের সমর্থনও করবে না। তবে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তকারীরা রয়েছে। বাংলাদেশেও আছে। তাই এই মাটিতে জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। ইসলামের নামে এরা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনায় আমরা তাই শঙ্কিত। বর্ধমানের জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশের জঙ্গিদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য একটা চিন্তার কারণ। প্রথমত, এই ঘটনা প্রমাণ করল বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে ভারতীয় জঙ্গিদের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, ভারতীয় জঙ্গিদের সহযোগিতাতেই বাংলাদেশি জঙ্গিরা এ কাজটি করেছে। ভয়টা হচ্ছে বাংলাদশি জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি তথা আইএসের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত, আইএস বিশ্বব্যাপী একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। খেলাফতের ধারণা অনেক পুরনো। এখন খোদ আইএসের শীর্ষ কমান্ডাররাও বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী ও উৎসাহী হতে পারে! বাংলাদেশ একটি মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চল। মানুষ যেহেতু ধর্মভীরু, এ ক্ষেত্রে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব।বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের তৎপরতা ও দক্ষতা আরও বাড়ানো দরকার। গোয়েন্দাদের যদি অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে জঙ্গি দমনে তাদের তৎপরতা হ্রাস পাবে।বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিস্মিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বিএনপি আবারও বড় ধরনের আন্দোলনের কথা বলছে। ফলে দেশে যদি অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে, তাহলে জঙ্গিরা এই সুযোগটি তাদের কাজে লাগাবে। তাই ইসলামিক স্টেটের উত্থান ও লিবিয়ার শহর দারনায় একটি প্রদেশ গঠনের ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের যে সূচক প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ নম্বরে। অর্থাৎ বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। শায়খ আবদুর রহমানের মতো জঙ্গি নেতা ও তাদের দলের তৎপরতা আমরা জানি। সুতরাং আমরা যদি এখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আমরা ভুল করব। সন্ত্রাসবাদকে কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। একে পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করার মধ্য দিয়েই দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখা সম্ভব। জঙ্গি তৎপরতা বাড়লে এর আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা বাড়বে। এতে ব্যাহত হবে গণতন্ত্রচর্চা।নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র Daily Amader Somoy 25.11.14

0 comments:

Post a Comment