রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নয়া মোড়

গেল বছর (২০১৩) আইএসের নাম প্রথম শোনা যায়। তখন এর নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট (আইএসআইএল)। ইতিহাসে সিরিয়া, জর্দান, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরাক, সাইপ্রাস ও দক্ষিণ তুরস্ক নিয়ে যে বিশাল এলাকা, তা 'লেভান্ট' নামে পরিচিত। জঙ্গিরা এই নামটি তখন ধারণ করে। তবে ১৯৯৯ সালে 'জামাত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ' নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে 'আল-কায়েদা ইন ইরাক' নাম ধারণ করে। এই সংগঠনের মূলত সুন্নিনির্ভর ও ইরাকের সুন্নিপ্রধান এলাকায় প্রভাব বেশি। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন সুরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। তবে ২৯ জুন (২০১৪) বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আল-কায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী, এটি নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আল-কায়েদা আইএসের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কেন সম্পর্ক ছিন্ন করেছে- এটি নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কেউ বলার চেষ্টা করছেন আইএসের নৃশংসতা এর বড় কারণ। কেউ বলছেন জিহাদি নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে- এ জন্যই বিরোধের জন্ম হয়েছে। এদের রাজনীতি মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল-কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। আর বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যা আল-কায়েদার নেতা লাদেন বা জাওয়াহিরি নিজেকে ঘোষণা করেননি। তবে এটা বলতেই হবে, আইএসের নৃশংসতা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। একাধিক মার্কিন সংবাদকর্মীর গলা কেটে হত্যা করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে একটি ভয়ের আবহ তৈরি করেছে আইএস। অতি সম্প্রতি কোবানিতে যুদ্ধরত এক কুর্দি তরুণী যোদ্ধার গলা কেটে জনৈক আইএস যোদ্ধার উল্লসিত ছবিও ইন্টারনেটে প্রকাশ পেয়েছে। আল-কায়েদা তার শত্রুদের হত্যা করত বটে; কিন্তু এভাবে গলা কেটে হত্যা করত না। তবে আইএসের উত্থান অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন, কোন শক্তি আইএসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে? যত দূর জানা যায়, আইএসের যোদ্ধারা প্রতি মাসে বেতন পায়। অর্থের পরিমাণটা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই অর্থ কোত্থেকে এসেছে? শুধু দখলকৃত অঞ্চলের (তিকরিত, মসুল) তেল বিক্রি করে এই অর্থ জোগান দেওয়া কি সম্ভব? অস্ত্রই বা আসছে কোত্থেকে? কারা অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আইএসের যোদ্ধারা এরই মধ্যে দক্ষ একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। তাদের কারা প্রশিক্ষণ দিল? তৃতীয় প্রশ্ন, কে এই আবু বকর বুগদাদি? কারা তাঁকে সামনে নিয়ে এলো? বিশ্বব্যাপী আল-কায়েদা স্বীকৃত। এখন বিকল্প আরেকটি ফোর্স তৈরি করে কোনো 'শক্তি' কি চাচ্ছে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে? যদি মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তা তো মার্কিন অর্থনীতির চাঙ্গাভাব বজায় রাখতে সাহায্য করবে। কারণ মার্কিন অর্থনীতি তো 'যুদ্ধ অর্থনীতি'। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। অস্ত্র বিক্রি বাড়ে। ব্যবসা বৃদ্ধি পায় যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে। ইরাক এর বড় প্রমাণ। এ ধরনের হাজারটি প্রশ্ন এখন উঠেছে এবং রাজনৈতিক পণ্ডিতরা এসব প্রশ্নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন।

তবে নিঃসন্দেহে কোবানির যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপটকে পাল্টে দিতে পারে। কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন তথা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশ্নটি এখন সামনে এলো। চারটি দেশেই কুর্দিদের বসবাস। কুর্দিদের এলাকায় রয়েছে জ্বালানি সম্পদ, তেল। ইরান কুর্দিদের তেল পরিশোধন করে। অন্যদিকে ইরান থেকে গ্যাস কেনে কুর্দিরা। ইরাকি কুর্দিরা এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। তাদের নিজস্ব পতাকা, পার্লামেন্ট ও সেনাবাহিনী আছে। ১৯২৩ সাল থেকেই কুর্দিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে আসছে। ইরাকি কুর্দিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। ইসরায়েলের সঙ্গেও কুর্দি নেতাদের সম্পর্ক ভালো। বর্তমান সংকট এ অঞ্চলে একটি কুর্দি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দিল। এই রাষ্ট্র অনেকটা তাইওয়ান মডেলে গড়ে উঠতে পারে। কোবানির যুদ্ধ ও আইএসের উত্থান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করল। একসময় মনে হয়েছিল আসাদের দিন শেষ। এখন দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা, যাদের মধ্যে আরব রাষ্ট্রগুলোও আছে, তারা চাচ্ছে আসাদ থাকুক। মার্কিনি ছত্রচ্ছায়ায় আসাদবিরোধী যে ফ্রন্টের জন্ম হয়েছিল এবং যারা আসাদকে উৎখাতের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, এখন তারা আর আসাদবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না। তাদের টার্গেট এখন ইসলামিক স্টেট। ফলে সুবিধা পাচ্ছেন আসাদ। ইসরায়েলও এখন পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে আসাদকে। একসময় গোলান মালভূমি নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়ার যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল। স্ট্র্যাটেজিক্যালি এর গুরুত্ব অনেক। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ইসরায়েলের মনোভাব নমনীয়।

ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছিল, আইএসের উত্থানে ইরানকে নিয়ে এখন আর তেমন উদ্বেগ নেই মার্কিন প্রশাসনের। একসময় ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে, যেখানে ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করছে- এমন অভিযোগ ছিল, মার্কিন তথা ইসরায়েলি বিমান হামলার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, এখন সেই প্রশ্ন 'অতীত'। যুক্তরাষ্ট্রের এখন প্রয়োজন ইরানকে। আইএসের উত্থান এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকা ও অবস্থানকে শক্তিশালী করল। ইরাক এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে। কুর্দিরা স্বাধীন হয়ে গেলে আর সুন্নি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় একটি 'জিহাদি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠিত হলে শিয়ারা একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে ইরাকের অস্তিত্ব বহন করবে। আর ইরাক ভেঙে গেলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় 'পরাজয়'।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও সীমানা বদলে যাচ্ছে। কোনো কোনো মহল থেকে আভাস দেওয়া হচ্ছে যে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি রাষ্ট্র ভেঙে (সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সৌদি আরব ও ইয়েমেন) ভবিষ্যতে ১৪টি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সিরিয়া-ইরাক যুদ্ধ এর বড় প্রমাণ। এই যুদ্ধ স্থায়ী হবে এবং অলিখিতভাবে এসব রাষ্ট্রের জন্ম হবে। আর এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আইএসের জন্ম হয়েছিল। রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে সৌদি আরব, কাতার আর যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আইএসের জন্ম। আইএসের জন্মের পেছনে যে 'শক্তিই' দায়ী থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে।
Daily Kalerkontho
23.11.14

1 comments:

  1. কি বলতে চায় তা রাইটার মনে হয় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনাই। লোল।

    ReplyDelete