রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ

গত ২৯ অক্টোবর হংকংয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে গণতন্ত্রকামীদের বৈঠকের পর খুব সঙ্গত কারণেই একটি প্রশ্ন উঠেছে। তা হচ্ছে হংকংয়ের ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে? সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে পরিচালিত এই আন্দোলন কি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পরিণত হলো? বিক্ষোভকারীদের মধ্যে যারা ছিল মূলত তরুণ, তারা কি শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে, নাকি রণে ভঙ্গ দেবে এটাও একটি মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল এক মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল হংকংয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। তাদের দাবি ছিল হংকংয়ের যে পার্লামেন্ট, সেখানকার সদস্যরা জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হবেন। একই সঙ্গে হংকংয়ের প্রধান নির্বাহীও জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু ২১ অক্টোবর দু’পক্ষের মাঝে (বিক্ষোভকারী ও হংকং প্রশাসন) যে সংলাপ হয় এবং যা টিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয় তা এক রকম ব্যর্থতায়ই পরিণত হয়েছে। কেননা কোনো সুনির্দিষ্ট সমঝোতায় কোনো পক্ষ রাজি হয়নি। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল হংকংয়ের ভবিষ্যৎ আসলে কি?
অনেকেই জানেন ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বের আলোকে হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রয়াত চীনা নেতা দেং জিয়াও পিং ছিলেন এই তত্ত্বের প্রবক্তা। অর্থাৎ হংকং তার পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিয়েই চীনের সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল। হংকংয়ে সমাজতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়নি। হংকংয়ে একটি পার্লামেন্ট আছে। এর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৭০ জন (অন্তর্ভুক্তির পরে ১৯৯৮ সালে ছিল ৬০ জন)। এরা তিনভাবে নির্বাচিত হন। ‘বেসিক ল’ (যা অনেকটা সংবিধানের আলোকে) মতে ভৌগোলিক অঞ্চল অর্থাৎ জেলা থেকে সরাসরি নির্বাচিত হন ৩৫ জন। তথাকথিত পেশাভিত্তিক প্রতিনিধির রয়েছেন ৩৫ জন (বিভিন্ন পেশা)। প্রথম দিকে নির্বাচন কমিটির একটা প্রতিনিধিত্ব ছিল এখন তা আর নেই। অন্যদিকে প্রধান নির্বাহী একটি প্রাথমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে তার ক্ষমতা পরিচালনা করেন। এই প্রশাসনিক কাউন্সিলে রয়েছেন ২৯ জন সদস্য। ১৫ জন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা আর ১৪ জন সাধারণ প্রতিনিধি। চীনের পিপলস কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটি সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে। প্রধান নির্বাহী তার কাছে দায়বদ্ধ। গণতন্ত্রকামীরা এর পরিবর্তন চেয়েছিল, কিন্তু তা হয়নি।
এখন প্রশ্ন একটাই-হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কি কোনো মেসেজ দিয়ে গেল? কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াতে এই আন্দোলন নিয়ে মাতামাতি কম দেখছি না। শত শত চ্যানেলের ভিড়ে কোথাও না কোথাও হংকংয়ের এই আন্দোলন ও চীনের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। অনেকেই হংকংয়ের এই আন্দোলন, যা কিনা পরিচিতি পেয়েছে ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ হিসেবে, তার সঙ্গে আরব বসন্ত সময়কালীন কায়রোতে যে আন্দোলন হয়েছিল তার একটা মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ হয়েছে, তার সঙ্গে হংকং অক্যুপাই আন্দোলনের যেমনি মিল আছে, তেমনি আছে অমিলও। খোদ নিউইয়র্ক শহরে ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ বড় ধরনের আবেদন সৃষ্টি করতে পারলেও তাতে পরিবর্তন এসেছে অতি সামান্যই। মানুষ এখন আর ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’-এর কথা মনে করে না। তবে মিসরের রাজধানী কায়রোতে যে অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট হয়েছিল তাতে পরিবর্তন এসেছিল। হোসনি মোবারকের পতন, মুরসির উত্থান ও পতন এবং সর্বশেষ সিসির ক্ষমতা করায়ত্ত করার মধ্য দিয়ে ‘আরব বসন্ত’-এর নতুন ইতিহাস এখন রচিত হয়েছে। থাইল্যান্ডের অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের খবরও আমরা জানি। প্রতিবাদের এটা একটা ধরন। এই প্রতিবাদ কোথাও কোথাও সরকারের পতন ঘটিয়েছে এটা সত্য। তবে সাধারণ মানুষ এ ক্ষেত্রে উপকৃত হয়েছে খুব কম ক্ষেত্রেই। অনেক ক্ষেত্রেই একটি বিশেষ শ্রেণী এই আন্দোলন থেকে ফায়দা উঠিয়েছে। মিসরে সাধারণ মানুষ এই অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট থেকে যেমনি উপকৃত হয়নি, ঠিক তেমনি ইউক্রেন কিংবা থাইল্যান্ডের মানুষের জন্যও তা কোনো সুফল ডেকে আনেনি। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অতিসম্প্রতি এক ধরনের ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ আমরা লক্ষ্য করেছি, কিন্তু তাতে সরকারের পতন হয়নি। এমনি এক প্রেক্ষাপট আমরা প্রত্যক্ষ করেছি হংকংয়ে ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল।’ তবে ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’-এর সঙ্গে অন্যান্য ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের’ কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেননা ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ হংকংয়ে সরকার পরিবর্তনের কোনো আন্দোলন নয়; বরং বলা যেতে পারে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার। আরো বেশি গণতন্ত্র। ২০১৭ সালে হংকংয়ে প্রধান প্রশাসনিক পদের জন্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হলেও হংকং তার অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য এখনো বজায় রেখেছে। অর্থাৎ এখানে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। তবে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এখনো চীনের হাতে। অর্থাৎ চীন এখানে একজন প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে থাকে। এই প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ চীনের প্রতি দায়বদ্ধ। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা চাচ্ছে এখানে পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন সম্পন্ন হোক। অর্থাৎ ‘এক মাথা এক ভোট’ ভিত্তিতে দলগতভাবে এখানে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হংকংয়ের প্রশাসন পরিচালনা করবেন। এ ক্ষেত্রে চীন যে সংস্কারের কথা বলেছে (প্রধান প্রশাসনিক ব্যক্তির নির্বাচন) সেখানে দলগতভাবে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। চীনা কর্তৃপক্ষ একটি তালিকা তৈরি করে দেবে এবং জনগণ ওই তালিকা থেকে একজনকে বেছে নেবে। চীনা কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাব গণতন্ত্রকামীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা মধ্য হংকংয়ের মংকক এলাকা দখল করে নিয়ে অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের জন্ম দিয়েছিল।
হংকংয়ের অক্যুপাই ম্যুভমেন্টের ইতিহাস খুঁজে দেখা গেছে এই আন্দোলন তরুণদের দ্বারা পরিচালিত হলেও এর তাত্ত্বিক হচ্ছেন অধ্যাপক বেনই তাই নামে এক ব্যক্তি। তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কম্পারেটিভ অ্যান্ড পাবলিক ল-এর তিনি অধ্যাপক। তিনি দু’বছর আগে তত্ত্বগতভাবে এ ধরনের একটি আন্দোলনের কথা বলেন। অহিংস পদ্ধতিতে, অনেকটা গান্ধীবাদী নীতির আলোকে তিনি হংকংয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। তার এই গান্ধীবাদী নীতি অনুসরণ করে তরুণরা, যাদের অধিকাংশই ছাত্র এই ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’-এর জন্ম দিয়েছে। হংকংয়ের ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস এই আন্দোলনে নিজেদের জড়িত করেছে। আর মজার ব্যাপার এর নেতৃত্বে রয়েছে ১৭ বছরের এক যুবক, যার নাম জসুয়া ওং। জসুয়া ওং নিজে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। তবে এই আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, তারই অংশ হিসেবে জন্ম হয়েছে হংকং ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলনের। চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন এই পরিকল্পনার একটি অংশমাত্র। যুক্তরাষ্ট্র এনডিআই বা ‘ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’ নামক সংস্থার মাধ্যমে হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীদের প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করেছে। অধ্যাপক বেনই তাইকে তারাই তৈরি করেছে এবং অধ্যাপক তাইকে সামনে রেখেই গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর কম্পারেটিভ অ্যান্ড পাবলিক ল’ নামের একটি থিংক ট্যাঙ্ক, একটি গবেষণা সংস্থা। এনডিআইয়ের অর্থায়নে হংকংয়ে মার্টিন লি’র নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ডেমোক্রেটিক পার্টি। মার্টিন লি নিজে ২০১৪ সালে ও অধ্যাপক তাই ওয়াশিংটন সফর করেছেন একাধিকবার। শুধু তা-ই নয়, হংকংয়ে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে যে রেফারেন্ডাম বা গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল তারও অর্থায়ন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। হংকংয়ের ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ (পাঁচ ভাগের এক ভাগ) ওই গণভোটে অংশ নিয়েছিল। মিসরেও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের গণভোটের আয়োজন করেছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইউএসএইডয়ের হংকংয়ে সাহায্যের পরিমাণও বেড়েছিল। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ডলার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে হংকংয়ে একটি তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। উদ্দেশ্য, মূল চীনে এই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে দেয়া ও চীনের চূড়ান্ত বিচারে চীনা সরকারের পতন ঘটানো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যুক্তরাষ্ট্র হংকংয়ে গণতন্ত্র চায় বটে (?), কিন্তু সেখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। হংকংয়ে ঘণ্টাপ্রতি যে বেতন দেয়া হয় (৩ দশমিক ৬০ ডলার), তা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের গড় বেতনের অর্ধেক। শুধু তা-ই নয়, হংকংয়ে এ জীবনযাত্রার খরচ এত বেশি যে, অনেককে খরচ মেটানোর জন্য দুটি চাকরি পর্যন্ত
করতে হয়। গণতন্ত্র সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে পারবে না। গণতন্ত্র বোধকরি হংকংয়ের সমস্যার কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং হংকংয়ের এই আন্দোলন কি আদৌ কোনো  প্রভাব ফেলবে চীনের ওপর?
গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সংস্কৃতি হংকংয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনা নেতৃত্ব এটা মানবে না। কেননা এতে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়তে পারে। তবে ২০১৭ সালে হংকংয়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে আরো কিছুটা ছাড় দিতে পারে চীন। প্রার্থীদের যে তালিকা চীন অনুমোদন করবে, সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। হংকংয়ের বিকল্প হিসেবে সাংহাই, শেন ঝেন কিংবা গুয়াং ঝো এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন আর সাধারণ চীনাদের আকৃষ্ট করে না; বরং শেন ঝেন কিংবা গুয়াং ঝোর মতো এলাকায় ‘নতুন অর্থনৈতিক জোন’ গঠিত হয়েছে, যেখানে জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের আয় বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, চীনা নেতৃত্ব চীনের অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যেই চীন হবে বিশ্বের একমাত্র বড় অর্থনীতি। ফলে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে চীনা নেতৃত্ব সজাগ রয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অত্যন্ত প্রাগমেটিক। তিনি চীনা অর্থনীতিকে আরো উন্মুক্ত করে দেবেন। জাতীয় স্বার্থকে তিনি গুরুত্ব দেবেন। একটি ‘মার্কিনি ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে তিনি ও তার পলিটব্যুরোর সদস্যরা সচেতন। চীনা অর্থনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করতে চাচ্ছে, তাতে চীনকে রাখা হয়নি। এটা চীনবিরোধি একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। চীনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন, তাই চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে জন্ম হতে যাচ্ছে একটি ‘নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’, যা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আঘাত করবে। জন্ম দেবে বিকল্প একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। এ লক্ষ্যেই ২০১৬ সালে ব্রিকস ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। তাই হংকংয়ের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে পরোক্ষভাবে চীনা নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল, এটা চীনা নেতারা উপলব্ধি করেছেন। চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বিনির্মাণ সম্ভব নয়। চীন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। চীনে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চীনা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সেখানেই লুকায়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এখন চাচ্ছে চীনও একাধিক চীনা রাষ্ট্রে বিভক্ত হোক। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সেনাবাহিনী এখনো পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। চীনা সেনাবাহিনী এখনো পার্টির নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল। ফলে চীনে হংকংয়ের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে অদূর ভবিষ্যতে চীনে একটি ‘সিঙ্গাপুর মডেল’-এর জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ দ্বারা পরিচালিত হয় না। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাতের বিকাশ ঘটিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ নামে নতুন এক অর্থনীতি চালু করেছে। এর ফলও তারা পেয়েছে। চীন এখন বিশ্বের বড় অর্থনীতি। সুতরাং হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হংকয়ের ব্যাপারে চীনা নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় হংকংয়ের প্রশাসনিক কাউন্সিলের যিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, সেই মিসেস ক্যারী লাম একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আলোচনার পর। তিনি বলেছেন, হংকংয়ের এই আন্দোলনের পেছনে ‘বৈদেশিক শক্তি’র সম্পর্কিততা রয়েছে। যদিও তিনি বলেননি এই ‘বৈদেশিক শক্তি’ কারা। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূমিকার ব্যাপারে চীনা সরকারি ভাষ্যে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও সেই সঙ্গে পশ্চিমা শক্তি যদি হংকংকে আরো অস্থিতিশীল করতে চায়, তাহলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অবনতি ঘটতে বাধ্য। নিশ্চয়ই মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা এটি উপলব্ধি করবেন। কেননা পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির বিকাশে চীনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকাকে অবজ্ঞা করতে পারে না। তখন হংকংয়ের ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, যে ‘আবেদন’ নিয়ে এই আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, সেই ‘আবেদন’ এখন আর নেই। গত পাঁচ মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে হতাশা এসে গেছে। তারা চান না এ ধরনের অরাজকতা দীর্ঘদিন বজায় থাকুক এবং তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হোক। হংকংয়ের ‘বেসিক ল’তে ধীরে ধীরে সব পর্যায়ের নির্বাচন জনগণের ভোটে অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা যদি এদিকে লক্ষ্য রাখেন, তাহলে ভালো করবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, নিউইয়র্কের ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের মতো ‘অক্যুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলনও ব্যর্থ হলো। Daily Manob Kontho 11.11.14

0 comments:

Post a Comment