রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ত্রুটি!

কথাটা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বয়ং। ২২ জুলাই ডালাসে পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হত্যাকা-ে আয়োজিত এক স্মরণ সভায় তিনি বলেছেন, 'The deepest fault lines of our democracy' (ভোয়া, ১৩ জুলাই)। যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বিদ্বেষ যেভাবে বাড়ছে, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বিদ্বেষ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা উল্লেখ করেই ওবামা বলেছেন, এটাই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বড় ত্রুটি। একজন প্রেসিডেন্ট যখন প্রকাশ্যে এ ধরনের কথা বলেন, যখন বলেন এত বছর পরও এ জাতিগত দ্বন্দ্বের কোনো অবসান হয়নি, তখন বুঝতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তার নিজের সংস্কৃতিতে যে বড় ত্রুটি, তা সারাতে পারেনি। অতি সম্প্রতি কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিদ্বেষী জনমতও বাড়ছে। আর বলতে দ্বিধা নেই, মুসলিম বিদ্বেষকে উসকে দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, তিনি মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবেন! তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দীর্ঘদিন পর কট্টরপন্থী আমেরিকানরা এমন একজন ‘ব্যক্তি’কে পেয়েছেন, যিনি প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সূচনা করতে পারেন! ১৮ জুলাই ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি কনভেনশনে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন পেয়েছেন। চলতি জুলাইয়ে পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছিল ডালাসে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ মিকা জেভিয়ার জনসন তাদের হত্যা করে। এর আগে মিনেসোটা ও লুসিয়ানায় দুইজন কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে হত্যা করেছিল শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। ধারণা করা হয়, প্রতিশোধ নিতেই জনগণ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারদের হত্যা করেছিল। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দ্বন্দ্ব বেড়েছে। এমনকি একাধিক জরিপে বলা হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় চলতি ওবামা প্রশাসনের আমলে এ জাতিগত দ্বন্দ্ব বেশি বেড়েছে। এ জাতিগত দ্বন্দ্ব যখন অনেকের জন্য চিন্তার কারণ, ঠিক তেমনি এর পাশাপাশি মুসলিম বিদ্বেষও বেড়েছে। পাঠক, স্মরণ করতে পারেন ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর সমকামী ক্লাবে সন্ত্রাসী হামলার কথা। ওই হামলায় মারা যান ৪৯ জন সাধারণ মানুষ। একজন আফগান-আমেরিকান ওমর মতিন এ সমকামী ক্লাবে হামলা চালিয়ে সবাইকে হত্যা করেছিলেন। ওমর মতিন একজন মুসলমান এবং হামলার আগে আইএসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে গিয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর আইএসবিরোধী একটা জনমত এখানে আরও শক্তিশালী হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ওমর মতিন সমকামীও ছিলেন। সমকামীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটে এক ধরনের ‘অ্যাপ’ ব্যবহার করে। ওমর মতিন তাই করতেন। টিভিতে দুইজনের বক্তব্য আমি দেখেছি, যারা বলেছেন ওমর মতিন তাদের সঙ্গে ‘সমকামী সম্পর্ক’ স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। সালাফিস্টরা সাধারণত মুখম-লে দাড়ি রাখেন। এটা এক ধরনের বাধ্যবাধকতা। কিন্তু ওমর মতিন ছিলেন ‘ক্লিন শেভড’। সালাফিস্টরা সাধারণত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্তের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর (লেবানন) সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না ধর্মীয় আনুগত্যের কারণে। কিন্তু ওমর মতিনের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, তিনি কোনো একসময় হিজবুল্লাহ সংগঠনের ব্যাপারে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সালাফিস্টরা সাধারণত তাদের স্ত্রীদের ধর্মীয় বিধান মতে পর্দাপ্রথা তথা হিজাব পরতে ‘বাধ্য’ করেন। কিন্তু মতিনের প্রথম স্ত্রী সিতোরা ইউসুফী এবং দ্বিতীয় স্ত্রী নূর সালমানÑ কেউই হিজাবি ছিলেন না। তিনি তাদের পর্দা করতেও বাধ্য করেননি। ধর্ম সম্পর্কে ওমর মতিনের জ্ঞান ছিল সীমিত। শিয়া-সুন্নির পার্থক্য তিনি জানতেন না। নিয়মিত মসজিদে যেতেন কিংবা নামাজ আদায় করতেন, এমন তথ্যও পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে কট্টরপন্থী ইসলামিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রক্ষা করতেন, এমন তথ্যও এফবিআই’র পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। তবে এফবিআই দুই-দুইবার তার ব্যাপারে তদন্ত করেছে, এমন তথ্য আমরা পেয়েছি এবং দুই-দুইবারই এফবিআই তাকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাহলে এ হত্যাকা-ের পেছনে কী মোটিভ কাজ করেছিল? তিনি কী হতাশাগ্রস্ত কিংবা বিকারগ্রস্ত ছিলেন? উগ্র মানসিকতার অধিকারী তিনি ছিলেন? প্রথম স্ত্রীকে তিনি পেটাতেন, এটা স্ত্রী নিজে স্বীকার করেছেন। যে কারণে তার মাত্র ৪ মাসের বৈবাহিক জীবন ছিল সিতোরা ইউসুফীর সঙ্গে। তাহলে শুধু রাগ, ক্ষোভ আর হতাশা থেকেই কী তিনি এ হত্যাকা- সংঘটিত করেছিলেন? এটাও অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। শুধু সমকামী বিদ্বেষ থেকে (তার বাবার ভাষ্য মতে) ওমর মতিন এ হত্যাকা- চালিয়েছিল? এটাও অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কেননা তিনি অনিয়মিত ‘পালস’ নামের এ সমকামী ক্লাবে যেতেন। নাকি কোনো তৃতীয় পক্ষ তাকে ব্যবহার করেছে? উদ্দেশ্য ক্লিয়ারÑ যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবকে আরও উসকে দেয়া? সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিজয়ী করতেই কী এই হত্যাকা-? ৯/১১-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে আফগানিস্তান, পরে ইরাক দখল করে নিয়েছিল। ২০০১ সালের পর তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এ যুদ্ধ চলছে। ফলাফল? আফগানিস্তানে এখনও যুদ্ধ চলছে। গত সপ্তাহেই ন্যাটো সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে ন্যাটোর সেনাবাহিনী আরও কিছু দিনের জন্য থাকবে। ইরাক থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে সত্য; কিন্তু ইরাক ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে লিবিয়া ও সিরিয়াও। আফ্রিকায় বোকো হারাম, আল-শাবাবের মতো সংগঠনের জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, তা শেষ হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিদ্বেষ কিছুটা কমেছে। এখন অরল্যান্ডোর এ হত্যাকা-ে মুসলিম বিদ্বেষ আবারও বাড়ল। অরল্যান্ডোর এ হত্যাকা-ে আইএস নতুন একটি মাত্রা পেল। আইএসের কর্মকা- সিরিয়া-ইরাক ছাড়িয়ে ইউরোপের পর এখন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রসারিত হলো। আইএস মার্কিন সমাজে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পেরেছে, এটা নিয়ে একদিকে বিতর্ক বাড়বে, অন্যদিকে নীতিনির্ধারকদের চিন্তার খোরাক জোগাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিম সমাজে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে আইএস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কী? আমি দুইটি সার্ভে রিপোর্টের কথা উল্লেখ করতে চাই। দুইটি সার্ভে রিপোর্টই পিউই (Pew )গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ওয়াশিংটন) থেকে পরিচালিত হয়েছে। পিউই ২০১৫ সালে বেশ কিছু মুসলিমপ্রধান দেশে আইএসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। যেমন লেবাননে শতকরা ১০০ ভাগ মানুষ আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল নন। জর্ডানে এ সংখ্যা ৯৪ ভাগ, ইন্দোনেশিয়ায় ৭৯ ভাগ, ফিলিস্তিনে ৮৪ ভাগ, তুরস্কে ৭৩ ভাগ, নাইজেরিয়ায় ৬৬ ভাগ, বুরকিনা ফাসোতে ৬৪ ভাগ, মালয়েশিয়ায় ৬৪ ভাগ, সেনেগালে ৬০ ভাগ এবং পাকিস্তানে ২৮ ভাগ। অর্থাৎ মুসলিমপ্রধান দেশে মানুষ আইএসের প্রতি সহানভূতিশীল নন। আবার এসব দেশে আইএসের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে মাত্র ৮ ভাগ মানুষ (তুরস্ক), ৪ ভাগ (ইন্দোনেশিয়া), নাইজেরিয়ায় রয়েছে ১৪ ভাগ, মালয়েশিয়ায় ১১ ভাগ, সেনেগালে ১১ ভাগ, পাকিস্তানে ৯ ভাগ। অর্থাৎ আইএস মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা পরিসংখ্যান দিই। পিউই ২০১৬ সালে এ গবেষণাটি করে। যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ আইএসকে অন্যতম হুমকি হিসেবে মনে করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মনে করে ৭৬ ভাগ মানুষ। সাইবার আক্রমণকে ৭২ ভাগ মানুষ হুমকি মনে করে (ইইউ ৫৪ ভাগ); আর পরিবেশ বিপর্যয়কে হুমকি মনে করে ৫৩ ভাগ (ইইউ ৬৬ ভাগ)। পিউই’র এ গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আইএসের হুমকিকে তারা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। ফলে অরল্যান্ডোর হত্যাকা-, আইএসের সংশ্লিষ্টতা যে মার্কিন সমাজে উদ্বেগ সৃষ্টি করবে, এটা বলাই বাহুল্য। এর প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেছে। মসজিদগুলোতে পুলিশি পাহারা বাড়ানো হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আবারও কালো-সাদার দ্বন্দ্ব অর্থাৎ কৃষাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নতুন এক রূপ পেয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, (২০১৬) যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর মাঝে শতকরা ১ ভাগ হচ্ছে মুসলমান। ২০১০ সালে এ পরিসংখ্যান ছিল ০.৯ ভাগ। অন্যদিকে শতকরা ৭০ দশমিক ৬ ভাগ হচ্ছে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী, ইহুদি ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা প্রায় ২ ভাগ। মাত্র ১ ভাগ জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে তাদের এত উৎকণ্ঠা(!) স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। অন্যদিকে প্রায় ৩২ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর এ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার মাঝে ৭২ দশমিক ৪ ভাগ শ্বেতাঙ্গ, ১২ দশমিক ৬ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ৪৪১ জন সদস্যের মাঝে ৪৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ, আর সিনেটের ১০০ জন সদস্যের মাঝে মাত্র ২ জন কৃষ্ণাঙ্গ। সুতরাং বোঝাই যায়, কৃষ্ণাঙ্গরা কীভাবে মার্কিন সমাজে অবহেলিত। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃষ্ণাঙ্গরা আক্রান্ত হচ্ছেন। মার্কিন সমাজে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যকার এ বৈষম্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রতিটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী অনেক পিছিয়ে আছে। শিক্ষায়ও তাদের অগ্রগতি নেই। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা ও শ্বেতাঙ্গ বিদ্বেষ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। আর এরই প্রতিফলন ঘটেছে ডালাস হত্যাকা-ের ঘটনায়। এরপর ঘটল বেটন রুজে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও দেখা গেছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কিছু সম্পদশালী লোকের কাছে। এসব সম্পদশালী লোকই রাজনীতি তথা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এরা শত শত করপোরেট হাউস গঠন করে আজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ১ ভাগ মানুষ। এখানেই গড়ে উঠেছিল ‘অকুপাই ম্যুভমেন্ট’। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের সেই জুকোটি পার্কের কাহিনী সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। ম্যানহাটনের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পাশেই সেই জুকোটি পার্ক। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম সেখানে। ছোট একটি পার্ক। মানুষ বসে বিশ্রাম করে। আগের মতো সেই জুকোটি পার্ক আন্দোলনের (সেপ্টেম্বর ২০১১) কথা কেউ মনে রাখে না এখন আর। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এ বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ কখনও গ্রহণ করা হয়নি। সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ ছিল। আর সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল মিনেসোটা ও লুজিয়ানায় কিশোর হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে। পুলিশের ভূমিকা এখন সর্বত্র সমালোচিত হচ্ছে। পুলিশ অফিসাররা, যারা সবাই শ্বেতাঙ্গ, তারা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যে বর্বরোচিত আচরণ করেছে, তা সঙ্গত ছিল না। তাদের ভেতরে এক ধরনের জাতিবিদ্বেষ কাজ করেছিল। একজন কৃষ্ণাঙ্গ গবেষক মিস একেনি সøটার-জনসন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন সম্প্রতি (Still Second Class Citizens , Other Words, 13 July 2016 )। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এই যে অত্যাচার, নিপীড়ন তা মূলত ১৮৫৭ সালে দেয়া তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রজার তানেহর দেয়া একটি ঐতিহাসিক রায়েরই প্রতিফলন। একটি দাস পরিবারে জন্ম নেয়া জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ ড্রেড স্কট ‘স্বাধীন’ কিনা, এটা জানতেই সেদিন মামলা হয়েছিল। বিচারপতি রজার তার ওই আবেদন শুধু খারিজই করেননি, বরং একটি মেসেজও দিয়েছিলেন, যা আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, ‘আফ্রো-আমেরিকার অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গরা আদৌ এ দেশের নাগরিক নন, তাদের কোনো অধিকারই নেই এ ধরনের মামলা করার।’ প্রধান বিচারপতি রজার তার রায়ে তখন উল্লেখ করেছিলেন, ‘আফ্রো-আমেরিকানদের কোনো অধিকার নেই, যা শ্বেতাঙ্গরা মানতে বাধ্য।’ কী সাংঘাতিক কথা! কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে কী এ ধরনের কথা বলা সম্ভব? যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের কথা বলে। গেল ১৫ জুলাই তুরস্কে যে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান হয়ে গেল, সেখানেও মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জন কেরি বলেছেন, তুরস্ক আইনের শাসন, তথা গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রাখবে, এটাই যুক্তরাষ্ট্র চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কী আইনের শাসন সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত হয়েছে? জর্জ বুশ ইরাক আক্রমণ করে দেশটি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যে একটি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, ওই যুদ্ধ ন্যায্য ছিল না। এক মার্কিন অধ্যাপকের লেখায় পড়েছিলাম যে, বুশকে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত! কিন্তু সেটা করা কখনোই সম্ভব হবে না। আজ কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ দ্বন্দ্বের ফলে ডালাসে হত্যাকা-ের মতো ঘটনা ঘটেছে। তারপর ঘটল বেটন রুজের ঘটনা। একদিকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকরা, অন্যদিকে এর প্রতিশোধ নিচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরা। তাই ওবামা যখন মার্কিন সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ত্রুটির কথা বলেন, তিনি মিথ্যা বলেন না। কিন্তু এ ত্রুটি সারাবে কে? এই সমাজ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তি সৃষ্টি করেছে, যাকে এখন হাজার হাজার মার্কিন নাগরিক সমর্থন করেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মুসলমানদের এ দেশ থেকে বের করে দেবেন! এর বড় প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়নি। এ বৈপরীত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বে বড় ভূমিকা পালন করতে দেবে না। যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। এ দেশের নেতৃত্বের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। হ ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
 Daily Alokito Bangladesh
24.07.2016

0 comments:

Post a Comment