রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অভ্যুত্থানচেষ্টার পেছনে কার হাত?

ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের রাজনীতি নিয়ে এখন আলোচনার শেষ নেই। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ বিশ্বাস করেন তারা বলার চেষ্টা করছেন যে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্য ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নামে একটি ‘সাজানো নাটক’ মঞ্চস্থ করেছেন (দি ইনডিপেনডেন্ট, লন্ডন, ১৬ জুলাই)। ১৯৩৩ সালে হিটলার এমন এক ‘সাজানো নাটকের’ মাধ্যমে জার্মান পার্লামেন্ট আক্রমণ করে গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করে সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এরদোগান যখন এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে তুরস্কের ধর্মগুরু ও পণ্ডিত ফতেহউল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়া থেকে গুলেন এমনই একটি আভাস দিয়েছেন যে, এটি ছিল একটি সাজানো নাটক! এই ‘সাজানো নাটকের’ কাহিনী বেশ কটি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ছাপা হলেও তুরস্কের সাধারণ মানুষ এটা গ্রহণ করেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানে অন্তত ২৬৩ জন মানুষ মারা গেছেন এবং অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে। ১৯২৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্যে দিয়ে তুরস্ক নামক যে রাষ্ট্রটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেখানে দীর্ঘ ৯৩ বছরের ইতিহাসে তিনটি সামরিক অভ্যুত্থানের খবর জানা যায় (১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০), যা সফল হয়েছিল। এবং ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী বাধ্য করেছিল তৎকালীন সরকারকে তাদের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। এরপর থেকে আর তেমন কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের খবর পাওয়া যায় না। তবে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানই দেশটির শেষ সামরিক অভ্যুত্থান নয়। যারা তুরস্কের রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন মূলত তিনটি ‘শক্তি’ তুরস্কের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই তিনটি শক্তি হচ্ছে : সেনাবাহিনী, ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা। এর মাঝে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা সবচেয়ে দুর্বল। আর সেনাবাহিনী শক্তিশালী হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আস্থাশীল। কামাল পাশা, যিনি জাতীর পিতা বা ‘আতাতুর্ক’ হিসেবে ভূষিত হয়েছিলেন, তিনি এই সেনাবাহিনী গঠন করে গেছেন। কামাল পাশা তুরস্কে একটি ব্যাপক সংস্কার এনেছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শেই তিনি সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছিলেন। সেই আদর্শ থেকে সেনাবাহিনী আজও বিচ্যুত হয়নি। তবে সাম্প্রতিককালে সেনাবাহিনীর মধ্যে ফতেহউল্লাহ গুলেনের অনুসারীদের প্রভাব বাড়ছিল, যা ছিল এরদোগানের চিন্তার কারণ। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীতে এখন ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ৬ লাখ ৪০ হাজার সদস্য নিয়ে গঠিত তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এর মাঝে সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যাই বেশি। ব্রিগেডিয়ার থেকে শুরু করে পূর্ণ জেনারেল পর্যন্ত সিনিয়র অফিসারের সংখ্যা ৩৫০-এর ওপরে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ১০৩ জন সিনিয়র অফিসারকে ইতিমধ্যে বহিষ্কার অথবা গ্রেফতার করা হয়েছে। একসময় ধারণা করা হতো তুরস্কে ইসলামপন্থীদের যেভাবে উত্থান ঘটেছে, সেখানে কামাল আতাতুর্কের রাজনীতির অনুসারী সেনাবাহিনী তাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সে ধারণা পাল্টে গেছে। গুলেনপন্থী ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের বহিষ্কার ও গ্রেফতারের ঘটনা প্রমাণ করে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে গুলেনপন্থীদের প্রভাব বাড়ছিল। এতে করে গুলেনপন্থীদের প্রভাব প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়ে গেছে- এটা যেমন স্বীকৃতি পেল, ঠিক তেমনি এদের উৎখাত করে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে এখন ব্যাপক সংস্কার আনতে সক্ষম হবেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। এটা করতে গিয়ে তিনি তার জনপ্রিয়তাকে বিতর্কিত করতে পারেন। এখানে বলা ভালো, ফতেহউল্লাহ গুলেন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। তথাকথিত ইসলামী শিক্ষায় তিনি শিক্ষিত না হয়েও কিংবা তুরস্কে কোনো শীর্ষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান না হয়েও তিনি ইসলাম ও গণতন্ত্রের সমন্বয় করে ইসলামকে নতুন করে তুরস্কের মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি প্রচুর লিখেছেন এ বিষয়ে। ইংরেজিতে অনূদিত বইও আছে তার। আমার মনে আছে, ঢাকাস্থ তুরস্কের সাংস্কৃতিক বিভাগের প্রধানের মাধ্যমে ২০১২ সালে আমি গুলেনের একটি বই পেয়েছিলাম। বাংলাদেশে ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের মাঝে গুলেন খুব পরিচিত নাম নয়। তার ওপর লেখাজোখা খুব কমই হয়েছে। তার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের এক অধ্যাপকের একটি প্রবন্ধও আমি পড়েছিলাম আজ থেকে ৪-৫ বছর আগে। গুলেন নিজে স্যুটেড-বুটেড, বর্তমানে স্বেচ্ছা নির্বাসিত, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ায়। অনেকটা সুফি ভাবধারার অনুসারী তিনি। জিহাদি মতাদর্শকে তিনি সমর্থন করেন না। তাকে বলা হয় ‘ইসলামের গান্ধী’। তার মূল মন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। ‘জিহাদি শিক্ষার’ কথাও শোনা যায় কোনো কোনো প্রবন্ধে। এর অবশ্য বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। তুরস্কে একটি বিশাল সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন। যে সাম্রাজ্যের আওতায় রয়েছে ব্যাংক, বীমা, মিডিয়া ও শত শত স্কুল। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে একশ’র বেশি স্কুল রয়েছে গুলেন অনুসারীদের। তিনি যে প্রতিষ্ঠান তুরস্কে গড়ে তুলেছিলেন, তার নাম Hizmet, ইংরেজি করলে দাঁড়ায় Service অথবা সেবা। এই সংগঠনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বলা হয় Cemaat বা সম্প্রদায় অথবা কমিউনিটি। তার সংগঠন ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে তুরস্কে। বাংলাদেশে উত্তরার ৫নং সেক্টরে যে তার্কিস স্কুল রয়েছে, এটাও তারা পরিচালনা করে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও তাদের স্কুল রয়েছে। তুরস্কে তাদের অনুসারীর সংখ্যা ৬০ লাখ বলে ধারণা করা হয়। এরা প্রশাসনের এত গভীরে প্রবেশ করেছে, যা এরদোগানের জন্য ছিল চিন্তার কারণ। একসময় এরদোগানকে গুলেন অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু ২০১৩ সালের পর থেকে এরদোগানের সঙ্গে গুলেনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরদোগান মনে করতেন, গুলেন তার জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছেন। গুলেন সমর্থকদের দ্বারা উৎখাত হওয়ারও ভয় ছিল তার। দুর্নীতির অভিযোগে এরদোগানের ছেলে, তিন মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে এবং একটি বড় ব্যাংকের বিরুদ্ধে যখন তদন্ত শুরু হয় ২০১৩ সালে, তখনই দেখা গিয়েছিল গুলেনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এরপর ঘটে ইস্তান্বুলে গাজি পার্কের ঘটনা। ইস্তান্বুলের মেয়র ছিলেন এরদোগান (১৯৯৪-৯৮) এবং এই ইস্তান্বুলই হচ্ছে তার ‘ক্ষমতার উৎস’। সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এখানেই বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই ইস্তান্বুুলে তাকসিম গাজি পার্কের ঘটনা যখন ঘটে (২০১৩ জুন, নিউইয়র্কের অকিউপাই মুভমেন্টের আদলে বিশাল এলাকা অকিউপাই করা, পুলিশের উচ্ছেদ অভিযানে ১১ জনের মৃত্যু), তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, খোদ এরদোগানের অনুসারীদের ভেতরেই একটি পক্ষ এই ‘অকিউপাই মুভমেন্টকে’ সমর্থন করেছিল। এরদোগান মনে করতেন, এ আন্দোলনের পেছনে গুলেনের ইন্ধন রয়েছে। এটা সত্য, তিনজন মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে (যার মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন) তদন্ত কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা খুব একটা সহজ ছিল না। এতে করে ধারণা করা স্বাভাবিক, সরকারের ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা একটি ‘শক্তি’ এরদোগান তথা একে পার্টির বিরুদ্ধে তৎপর ছিল। গুলেনের সমর্থকরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে আছে। ফলে তাদের মাধ্যমে এ ধরনের কাজ করা অসম্ভব কিছু নয়। এরদোগান তাই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে গুলেনের যোগসাজশের অভিযোগ এনেছেন। এই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এখন বেশকিছু ঘটনা ঘটতে পারে। এক. গুলেনপন্থীদের সঙ্গে তার সমর্থকদের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটবে। তিনি প্রশাসন, বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগ, পুলিশ বিভাগে শুদ্ধি অভিযান চালাবেন। তথাকথিত গুলেনপন্থী হিসেবে অভিহিত হয়ে অনেকে চাকরি হারাবেন এবং গ্রেফতার হবেন। এতে করে তুরস্কে নব্বইয়ের দশকের শেষদিক থেকে যে ইসলামপন্থীদের উত্থান ঘটেছিল, তা এখন বাধাগ্রস্ত হবে। দুই. এরদোগান এখন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদী লিবারেল দলগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবেন। লক্ষণীয়, বর্তমান সংসদে (মোট সদস্য ৫৫০) যেখানে একে পার্টির আসন সংখ্যা ৩১৭, সেখানে প্রধান বিরোধী দল সিএইচপির আসন ১৩৩, আর এইচডিপির ৫৯। প্রাপ্ত ভোটের ১০ ভাগ না পেলে কোনো দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এ কারণেই সংসদে বিরোধী দলের আসন কম। তবে তারা এরদোগানকে সমর্থন করেছেন। ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সমালোচনা করেছেন। তিন. সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা এরদোগানকে পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে। তিনি এক ধরনের ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের’ জন্ম দিতে পারেন। এবং তুরস্কে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ‘মৃত্যু’ ঘটতে পারে! হার্ভার্ডের স্কুল অব গভর্নমেন্টের অধ্যাপক ডানি রডরিক এক প্রসঙ্গে এমন আভাসই দিয়েছেন। কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের লেখনীতে এমন কথাও এসেছে যে, অটোমান সাম্রাজ্যের শাসক সুলতান মেহমুদ-২-এর শাসনামলে একই ধরনের ঘটনায় সুলতান পুরো সেনাবাহিনীকে নিষিদ্ধ করে নিজের অনুগতদের নিয়ে একটি নতুন সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন, যারা ছিল পুরোপুরি তার বিশ্বস্ত ও অনুগত। হিটলারের আমলে ১৯৩৩ সালে পার্লামেন্ট ভবনে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল। ওই ঘটনার পর হিটলার আরও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের ভুললে চলবে না, হিটলার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা ছিলেন। আজ কোনো কোনো মহল থেকে হিটলারের সঙ্গে এরদোগানের তুলনা করা হচ্ছে। এখন যুগ পাল্টেছে। এরদোগান হয়তো এমনটি করবেন না। তবে তিনি যে ব্যাপক পরিবর্তন আনবেন, একটি শক্তিশালী প্রেসিডেন্সি সৃষ্টি করবেন, তা বলাই বাহুল্য। একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের পথে যাচ্ছে তুরস্ক। পুরো সেনাবাহিনী নিষিদ্ধ না হলেও সেখানে ব্যাপক সংস্কার আনবেন তিনি। অনেক জেনারেল চাকরি হারাবেন। তার একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হুলুসি আকার প্রচণ্ড চাপে থেকেও সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেননি। ফলে অনেক গ্যারিসন কমান্ডারের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেনি অভ্যুত্থানকারীরা। তবে এরদোগান সংস্কারটা আনবেন ধীরে ধীরে। দ্রুত সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন আনতে চাইলে কিংবা নতুন একটি সেনাবাহিনী গড়তে চাইলে সেনাবাহিনী তার কর্পোরেট স্বার্থে এর বিরোধিতা করবে। সে ক্ষেত্রে আরেকটি ক্যু দে’তা অসম্ভব কিছু নয়। চার. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এরদোগান গুলেনকে তুরস্কের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তুরস্ক সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যাতে করে আইনের শাসন তথা গণতান্ত্রিক চর্চা তুরস্কে অব্যাহত রাখা হয়। কেরি এমনও আভাস দিয়েছেন, তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বর্পূণ সদস্য হওয়ায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, মানবাধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদির প্রতি তার ‘কমিটমেন্ট’ অব্যাহত রাখতে হবে। যদি তুরস্ক ব্যর্থ হয়, ন্যাটোর সদস্যপদ স্থগিত করারও হুমকি দিয়েছেন কেরি। বাস্তব ক্ষেত্রে এটি আদৌ কার্যকর হবে কিনা, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তবে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো সদস্যভুক্ত কোনো দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধান সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় এরদোগানকে ফোন করে সহমর্মিতা জানাননি। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ফোন করেছিলেন। এরদোগান ক্যু দে’তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছেন। অনেকে ধারণা করছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এরদোগান রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুঁকতে পারেন। যদিও সিরিয়া সংকট, আইএসের উত্থান, ইরানের পারমাণবিক শক্তি হিসেবে উত্থান ইত্যাদি নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে তুরস্কে। ভূমধ্যসাগরতীরের আদানা শহরে ইনসিরলিক বিমানঘাঁটিসহ ইজমিরেও রয়েছে মার্কিন বিমানঘাঁটি। ইনসিরলিক বিমানঘাঁটিতে প্রায় ৫ হাজার মার্কিন বিমান সেনা রয়েছে। এই বিমানঘাঁটিতে পারমাণবিক বোমা সংরক্ষিত রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র খুব সহজে এই বিমানঘাঁটি থেকে তার সৈন্য ও প্রায় ৬০টির মতো বিমান প্রত্যাহার করে নেবে না। পাঁচ. এরদোগান সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে পুনরায় মৃত্যুদণ্ড বহাল করার কথা বলেছেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর সিএনএনের সঙ্গে দেয়া সাক্ষাৎকারে এরদোগান বলেছেন, পার্লামেন্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল করার (২০০৪ সালে বাতিল) আইন প্রণয়ন করতে পারে। এটা যদি তুরস্ক করে, তাহলে ইইউর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। এমনকি মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার ফলে আগামীতে ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা আসতে পারে। সুতরাং তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর আলোচনার সব কেন্দ্রবিন্দু এখন প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ঘিরে। তার কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে তুরস্কের ভবিষ্যৎ। তার কর্তৃত্ববাদী আচরণ, যা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, তা তুরস্ককে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। তার কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য কেউ কেউ তাকে ইতিমধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসক সুলতানদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একজন ‘সুলতান’ এরদোগান আংকারায় প্রায় এক হাজার কক্ষবিশিষ্ট প্রেসিডেন্ট হাউস (হোয়াইট প্যালেস, নির্মাণ ব্যয় ৬১৫ মিলিয়ন ডলার) নির্মাণ করে নিজের অবস্থানকে সুলতানদের সমতুল্য করতে পারেন বটে; কিন্তু ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশটিতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা যদি দূর করার উদ্যোগ তিনি না নেন, তাহলে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে। তাই প্রতিশোধ নয়, প্রয়োজন সব শ্রেণীর মানুষের আস্থা অর্জন। ২০০২ সাল থেকে বারবার জনগণ তাকে এবং তার দলকে ভোট দিয়েছে। জনপ্রিয়তা তার আছে; কিন্তু এই জনপ্রিয়তাকে যদি তিনি ভিন্ন খাতে নিয়ে যান, তাহলে তা তুরস্কের জন্য আগামীতে কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daily Jugantor 24.07.2016

0 comments:

Post a Comment