বাংলাদেশে ঢাকার গুলশানে আর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া জঙ্গি হামলা নিয়ে মিডিয়ায় আলাপ-আলোচনা যখন এখনো অব্যাহত রয়েছে, ঠিক তখনই ফ্রান্সের নিস শহরে জঙ্গি হামলা হলো। জঙ্গি হামলায় মারা গেছেন ৮৪ জন মানুষ, আর আহতের সংখ্যা ১০০-এর ওপরে। ফ্রান্সের পুলিশ জানিয়েছেন এই হামলার সঙ্গে জড়িত যিনি, তিনি তিউনেশিয়ার বংশোদ্ভূত ফ্রান্সের নাগরিক। নাম তার মোহাম্মদ লাউইজ বুলেল। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ আমাদের জানিয়েছেন এটা ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের কাজ। ফ্রান্স যখন তার স্বাধীনতা দিবস পালন করছিল (১৪ জুলাই) তখন ৩১ বছরের বুলেল রাস্তায় থাকা শত শত মানুষের ওপর বিস্ফোরক ভর্তি ট্রাক উঠিয়ে দেয় এবং গুলি করে মানুষ হত্যা করে। ফ্রান্সের নিস শহরে এই ঘটনাটি ঘটল প্যারিসে গত নভেম্বরে (২০১৫) সন্ত্রাসী হামলার পর পরই প্যারিসে ওই সন্ত্রাসী হামলায় মারা গিয়েছিলেন ১৩০ জন মানুষ। এই ঘটনায় এখন অব্দি আইএস তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার না করলেও, বিশ্বব্যাপী আইএস যেভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে, তার সঙ্গে এর একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে গেল এক বছরে সিরিয়া-ইরাক বাদে বিশ্বের সর্বত্র যেসব জঙ্গি হামলা হয়েছে, তাতে এখন অব্দি মারা গিয়েছেন প্রায় ১২০০ মানুষ। যার অর্ধেকই প্রায় পশ্চিমা বিদেশি নাগরিক। গত এক বছরে প্যারিস, ব্রাসেলস, তিউনেশিয়া, মিসর, তুরস্ক, ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা অরল্যান্ডে যেসব আত্মঘাতী হামলা হয়েছে, তার প্রতিটির সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আইএস তার দায় স্বীকার করেছে। গেল রমজান মাসে আইএস যে হামলা চালাবে, তা তারা আগেই ঘোষণা করেছিল। আইএসের একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে তা পশ্চিমা সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছিল। আর ওই রমজান মাসেই ঘটল একাধিক সন্ত্রাসী ঘটনা। অরল্যান্ডে সমকামী ক্লাবে হামলা চালালো ওমর মতিন, যিনি হামলার আগে আইএসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছিলেন। মদিনায় যে হামলা হলো সেখানেও আইএসের কথা বলা হয়েছে। গত জানুয়ারিতে জাকার্তায় তামরির স্ট্রিটের দূতাবাস এলাকায়ও আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল আইএস। অর্থাৎ প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আইএসের একটা যোগসূত্রে রয়েছে ঢাকার হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় আইএস তার দায়ভার স্বীকার করছে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে জেএমবির কথা, যারা সম্ভবত চেষ্টা করছে আইএসের অনুমোদন নিতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে গুলশানের হলি আর্টিজানের পর শোলাকিয়ার ঘটনা আমাদের জন্য অন্যতম একটা চিন্তার কারণ। গত বেশ কিছুদিন ধরে এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা বার বার ঘটছে। এতে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি
নষ্ট হচ্ছে।
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর কেটে গেছে বেশ কয়েকটি দিন। কিন্তু এর রেশ বাংলাদেশে যেমন রয়ে গেছে, তেমনি রয়ে গেছে বিদেশেও। যুক্তরাষ্ট্রে এখনো সংবাদপত্রে, গবেষণামূলক সাময়িকীতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ যে মার্কিনী নীতি-নির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ হয়ে উঠছে, এটা তার বড় প্রমাণ। মার্কিনীরা আসলে জানতে চায় বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে? ঘুরেফিরে স্যোশাল মিডিয়ায় ৫ জঙ্গির ছবি, তাদের নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটা বড় ধরনের ঘটনা। তবে হলি আর্টিজানে হামলা এবং নূ্যনতম ৫ জন জঙ্গির সম্পৃক্ততাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রশ্ন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নীতি-নির্ধারকরা এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে দেখতে পারেন। এর ফলে আগামী দিনে জঙ্গি দমন কার্যক্রম নতুন একটি গতি পাবে। এক. জঙ্গিরা বাংলাদেশি এটা প্রমাণিত। এরা সবাই ৫-৬ মাস আগে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এরা পরস্পর পরস্পকে সম্ভবত চিনত না। এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা কোনো একটি 'শক্তি' তাদের একত্রিত করে 'অপারেশন'-এর জন্য তৈরি করে। দুই. জঙ্গিরা কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, এ ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়েছে। এক জঙ্গির বাবা স্বীকার করেছেন তিনি তার ছেলের পাসপোর্ট সরিয়ে রেখেছিলেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অনেক সম্ভাবনা আমাদের মধ্যে উঁকি দেয়। তাহলে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলো কোথায়? সিরিয়ায় নাকি বাংলাদেশের ভেতরে কোথাও? এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। যদি সিরিয়ায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তারা কোন পথে সিরিয়া গেছে? বিমানবন্দর হয়ে, নাকি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মধ্যদিয়ে তারা গেছে সিরিয়ায়? গত ৬ মাসের ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রীদের চেকলিস্ট অনুসন্ধান করলে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। আমার যতটুকু ধারণা সাম্প্রতিককালে বিমানবন্দরে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছিল এবং বিদেশে যারা যাচ্ছেন তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয়েছিল। জঙ্গিরা তুরস্ক হয়ে সিরিয়ার কায়রোয় (তথাকথিত আইএসের রাজধানী) থাকার কথা। জঙ্গিরা মালয়েশিয়ার রুট ব্যবহার করে থাকতে পারে। গোয়েন্দারা এই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন। আরো একটি সম্ভাবনাকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে ২০১৪ সালের অক্টোবর যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল, তাতে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। যেটা খুব উদ্বেগের বিষয়, তা হচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বর্ধমানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জেএমবির ঘাঁটি রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হাফিজ শেখ (জানুয়ারি ২০১৬), কিংবা সেলিম রেজার (জানুয়ারি ২০১৬) জঙ্গি কালেকশনে গ্রেপ্তারের কাহিনী সেখানকার পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। পাঠক স্মরণ করতে পারেন ভারতীয় গোয়েন্দারা ওইসব কর্মকা-ে (বিশেষ করে বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণ) জেএমবির সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে ঢাকায়ও এসেছিলেন। ফলে হলি আর্টিজানে যে ৫ জন জঙ্গি মারা গেছে, তারা পশ্চিমবঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকতে পারে। আমাদের গোয়েন্দাদের এখন বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তুরস্কে আইএসের হামলায় যে তিন জঙ্গি অংশ নিয়েছিল, তারা কেউই তুরস্কের নাগরিক নন। ওই তিনজন ছিলেন রাশিয়ার চেচেন উজবেকিস্তান ও ফিলিস্তিনের নাগরিক। আইএস এখন মধ্য এশিয়ার নাগরিকদের ব্যবহার করছে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে। এটা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে যেসব বিদেশি নাগরিক, ভ্রমণ বা ধর্মীয় কাজে আসেন, বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া মুসলিম রিপাবলিকগুলো থেকে আসা নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে আফগান, পাকিস্তানি ও তুরস্কের নাগরিকদের গতিবিধিও লক্ষ্য রাখতে হবে। তাবলিক জামাতে যোগ দিতে এরা আসেন। অনেকে থেকেও যান বিনা ভিসায়। পুলিশের কাছে এদের তথ্য আছে কিনা জানি না; কিন্তু এদিকে দৃষ্টি দেয়া এখন প্রয়োজন। জঙ্গিরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। যে অ্যাপ ব্যবহার করে তারা তথ্য আদান-প্রদান করেছে কিংবা ছবি আপলোড করেছে, তাতে কী বিষয় কথা হয়েছে, কার সঙ্গে কথা হয়েছে, তার কোনো তথ্য থাকে না। ফলে খুব সহজেই জঙ্গিরা পার পেয়ে যায়। সুতরাং আমাদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে জরুরি ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে জঙ্গি তৎপরতা মনিটর করা সহজ হয়। হলি আর্টিজানের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে জঙ্গিরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ধনী ঘরের সন্তান। এ ক্ষেত্রে আমরা এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো তদন্ত করার জন্য আমাদের দরজা বিদেশিদের খুলে দিতে পারি না। বরং আমাদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে আরো দক্ষ, প্রশিক্ষিত করা যায়। তাদের জঙ্গি দমনে প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশেই বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। এই ইউনিটের সঙ্গে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ নেয়া কমান্ডোদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই ইউনিটকে অন্যসব কাজ থেকে দূরে রাখতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা জঙ্গি দমনে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বিভেদ, রেষারেষি ও অনৈক্য যদি থাকে, তাতে জঙ্গিরাই লাভবান হবে। এ ধরনের জঙ্গি হামলাকে আমরা একপাশে ঠেলে সরিয়ে রাখতে পারি না। এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের বিষয়টির (প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে) নীতি-নির্ধারকরা বিবেচনায় নিতে পারেন। মোদ্দা কথা 'নাইন-ইলেভেন'-এর পর সারাবিশ্ব জঙ্গিবাদের এক ধরনের উত্থান দেখেছিল। তখন আল-কায়েদার টার্গেট ছিল মার্কিন নাগরিক, মার্কিন স্থাপনা কিংবা যেখানে মার্কিনী স্বার্থ রয়েছে সেখানে তাদের আক্রমণ তারা পরিচালনা করেছে। কিন্তু আইএস এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আর্বিভূত হয়েছে। তাদের আক্রমণের টার্গেট হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং এক আত্মঘাতী সন্ত্রাসী সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে আইএস। এই সন্ত্রাসীদের দমনে জাতিসংঘে যে আইনটি পাস হওয়া জরুরি ছিল, তা পাস হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী যদি ইরাক ও লিবিয়ায় আক্রমণ চালিয়ে ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করতে পারে, তাহলে সিরিয়া-ইরাকের একটা অংশ দখল করে নেয়া আইএস জঙ্গিদের উৎখাত করতে পারবে না কেন? এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছা, ইসরাইলি কানেকশন, রাশিয়ার ভূমিকা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আছে তাই আইএস এর উত্থান ও তাদের যে কোনো হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এতদিন আমাদের একটা ধারণা ছিল আইএসের কর্মকা- শুধু সিরিয়া ও ইরাকের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু আইএস তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা- এখন বিশ্বের সর্বত্র সম্প্রসারিত করছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত আইএসের 'অপারেটিভ'রা হামলা চালিয়েছে। অরল্যান্ডের ঘটনা এর বড় প্রমাণ অরল্যান্ডের পর ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, বাংলাদেশ এবং আবারো ফ্রান্স। ফলে বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গিবাদের যে বিস্তার ঘটছে, তাকে কোনো অবস্থাতেই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এই জঙ্গিবাদ বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র কিংবা প্যারিসের মতো দেশও আজ আক্রান্ত। বিশ্ব নেতারা এই বিষয়টি নিয়ে যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও বিষয়টি গরুত্বের দাবি রাখে।
আমরা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছি। ভবিষ্যতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাকেও আমি উড়িয়ে দিতে পারি না। তাই জনসচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। মনে রাখতে হবে জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যায় আমরা আক্রান্ত হতে বাধ্য! এ ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় নেতারা যদি দূরদর্শিতার পরিচয় না দেন, যদি জঙ্গি দমন প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে আমাদের জন্য এক মহাদুর্যোগ অপেক্ষা করছে।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
Daily Jai Jai Din
18.07.2016
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment