গুলশানের
হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ এবং শোলাকিয়া ঈদগাহ মসজিদের পাশে হামলার পর
সরকারের জঙ্গি দমন কার্যক্রম নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে সন্দেহ নেই তাতে।
কিন্তু যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হচ্ছে, এই জঙ্গি দমন কার্যক্রম কি বাংলাদেশ
থেকে জঙ্গিদের পরিপূর্ণভাবে উৎখাত করতে পারবে? দু’ দুটি ঘটনাই আন্তর্জাতিক
অঙ্গনে বড় ধরনের সংবাদের জš§ দিয়েছে। কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া এবং সরকারের
সিদ্ধান্তের খবর আমরা জেনেছি। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের
সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা বিসওয়াল ঘুরে গেছেন। জঙ্গি হামলার পর তার এই
সফর নিঃসন্দেহে গুরুত্বের। নিশা বিসওয়াল তার সফরের সময় জঙ্গি দমনে
বিশেষজ্ঞ দিয়ে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এফবিআইয়ের স্টাফরা ইতোমধ্যে জঙ্গি দমনের
কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। নিশা বিসওয়াল ঢাকায় এসে ভারতীয় হাইকমিশনার
হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। এর অর্থ পরিষ্কার। যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে এই জঙ্গিবাদের উত্থানকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত,
যুক্তরাষ্ট্র এই জঙ্গি দমন কার্যক্রমে ভারতকে সঙ্গে রাখতে চায়। প্রশ্ন
হচ্ছে, জঙ্গি দমনে এই ত্রিদেশীয় উদ্যোগ (বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র-ভারত) আদৌ
কোনো ফল দেবে কিনা?
সরকার আরো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নর্থ সাউর্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘নিয়ন্ত্রণের’ মধ্যে আনতে চায় সরকার। যে ছাত্র ১০ দিনের বেশি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকবে তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে জঙ্গি দমন কার্যক্রম কতটুকু সফল হবে? এটা সত্য সম্প্রতি জঙ্গি হামলার সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র জড়িত। কিন্তু কিছু ছাত্রের জন্য পুরো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ব্লাক লিস্ট’ করা ঠিক হবে না। অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি এবং সেই সঙ্গে কিছু মাদরাসার ছাত্রও জড়িত। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে, তাদের কাছে ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়া ছাত্রদের কোনো তথ্য নেই। যারা সম্প্রতি যাত্রীবেশে তুরস্ক গেছে সিরিয়ায় যাওয়ার জন্য তাদের ওপর নজরদারিও রাখতে পারেননি আমাদের গোয়েন্দারা এবং যখন তারা ফিরে এসেছে তখনো তা তারা মনিটর করতেও ব্যর্থ হয়েছেন।
শোলাকিয়া ও হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর আমাদের নীতি-নির্ধারকরা কতগুলো বিষয়ের দিকে এখন দৃষ্টি দিতে পারেন। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাকালে আমরা ভুল করব। ৩৭ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেও তাকাতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবলিক) যেমনি নারী নির্যাতন সেল রয়েছে, ঠিক তেমনি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে (পাবলিক ও প্রাইভেট) নিজস্ব উদ্যোগে একটি ‘জঙ্গি পর্যবেক্ষণ সেল’ গঠন করতে হবে। একজন সিনিয়র অধ্যাপক এর দায়িত্বে থাকবেন। এই সেলের কাজ হবে ক্যাম্পাসে সব অনিয়মিত ছাত্রের তালিকা তৈরি করে তা মনিটর করা, তাদের অভিভাবকদের সহায়তা দেয়া এবং প্রতি মাসে একটা রিপোর্ট পুলিশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে দেয়া। কাজটা পুলিশি কাজ সন্দেহ নেই তাতে। তবুও এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটি ডাটাবেজ তৈরি করাও জরুরি, যাতে ছাত্রের পূর্ণ তথ্য তাতে থাকবে। বিশেষ করে আইটি সেক্টরে পড়–য়া ছাত্রদের দিকে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। যে তরুণ প্রজš§কে নিয়ে আমাদের এত আশাবাদ, সেই তরুণ প্রজšে§র একটা অংশ বিভ্রান্ত হচ্ছে জঙ্গিবাদী আদর্শে। ইন্টারনেট এর একটা বড় মাধ্যম যার মাধ্যমে তরুণ প্রজš§ ‘ভ্রান্ত আদর্শে’ আকৃষ্ট হচ্ছে। এটা যে প্রকৃত ইসলাম নয়, এটা তারা বোঝে না। ইন্টারনেট বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদের ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করা হচ্ছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যা করা দরকার তা হচ্ছে ইন্টারনেটে নজরদারি বাড়ানো। প্রযুক্তিবিদদের সহযোগিতা নিয়ে এটা সম্ভব। ইন্টারনেট আমাদের জন্য অপার এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু ক্ষতিও করছে। বিভ্রান্তকারীরা তরুণ সমাজকে জঙ্গিবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করছে। যে তরুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখবে, নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তিতে নিজেদের নিয়োজিত রাখবে, সেই তরুণের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে পরজšে§র কথা। নেটের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে জিহাদি মনোভাব। জানানো হচ্ছে কীভাবে বোমা তৈরি করতে হয়।
গুলশানে হামলাকারীরা আত্মঘাতী ছিল। তারা জানত তাদের পরিণতি কী হবে। তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল ‘বেহেস্তের’ কথা। তাই সেনা কমান্ডো হামলার চূড়ান্ত মুহূর্তে তারা বলেছিল ‘বেহেস্তে’ যাওয়ার কথা। তাদের এই যে মগজ ধোলাই, এটা করা হয়েছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তাই ইন্টারনেটের কার্যকলাপ, গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। কারা কারা ওইসব ‘সাইট’ ভ্রমণ করে তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়ানোও জরুরি। যেসব তরুণ এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল, তারা ৫ থেকে ৬ মাস আগে বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। তাদের অভিভাবকরা সবাই পুলিশ স্টেশনে জিডি করেছিলেন। পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। পুলিশ সেই সহযোগিতা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই অভিভাবকদের দোষ দেয়া যাবে না। বিশ বছরের এক তরুণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। পুলিশের ভূমিকাকে আমরা তাই গুরুত্ব দিতে চাই। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন শৈথিল্য এসেছে। তারা দায়িত্ব পালনে শতকরা এক শ’ ভাগ সফল, এটা বলতে পারছি না। তাই মোটিভেশন দরকার। প্রশিক্ষণ দরকার। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দুর্বলতা এই ঘটনায় আরো একবার প্রমাণিত হলো। একজন তরুণ ছয় মাস আগে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, তার হদিস পুলিশ পাবে নাÑএটা বিস্ময়কর বিষয়। নিবরাস ইসলাম, মীর মুবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল কিংবা রায়ান মিনহাজরা ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়ার পর গত ৫-৬ মাস কোথায় ছিল, কীভাবে ছিল তা জানা দরকার। ধারণা করা যায় তাদের সিরিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য। যদি তাই হয় তাহলে এর পেছনে কোন ‘শক্তি’ সক্রিয় ছিল তা অভ্যন্তরীণ কোনো ‘শক্তি’ কিনা, তা জানা দরকার। অভ্যন্তরীণ শক্তির যোগসাজশ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এদের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই হলি আর্টিজান কিংবা শোলাকিয়ায় অপারেশন চালাতে পারত না জঙ্গিরা। তাই অভ্যন্তরীণ সহযোগীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আরো একটা কথা বলা দরকার। সিরিয়ায় আইএসের উত্থানের পর থেকে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ থেকে কিছু তরুণ সিরিয়ায় গেছে। সাধারণত এরা তুরস্ক হয়েই সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ধরে নেয়া যেতে পারে তারা বিমানবন্দর ব্যবহার করেছে। যদি তাই হয়ে থাকে, বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য থাকার কথা। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা দরকার। কোনো ধরনের শৈথিল্য যেন এ কাজে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।
আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশি জঙ্গিদের পশ্চিম বাংলার বর্ধমান ও নদিয়া জেলায় আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ। এরা জেএমবির সদস্য। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে ২০১৪ সালের অক্টোবরে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল তাতে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় গোয়েন্দাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, বর্ধমানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জেএমবির ঘাঁটি রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হাফিজ শেখ (জানুয়ারি ২০১৬) কিংবা সেলিম রেজার (জানুয়ারি ২০১৬) জঙ্গি কানেকশনে গ্রেফতারের কাহিনী সেখানকার পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। পাঠক স্মরণ করতে পারেন ভারতীয় গোয়েন্দারা ওইসব কর্মকাণ্ডে (বিশেষ করে বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণ) জেএমবির সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে ঢাকায়ও এসেছিলেন। ফলে হলি আর্টিজানে যে জঙ্গিরা মারা গেছে তারা পশ্চিমবঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকতে পারে। আমাদের গোয়েন্দাদের এখন বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তুরস্কে আইএসের হামলায় যে তিন জঙ্গি অংশ নিয়েছিল তারা কেউই তুরস্কের নাগরিক নয়। ওই তিনজন ছিল রাশিয়া (চেচেন), উজবেকস্তিান ও ফিলিস্তিনের নাগরিক। আইএস এখন মধ্য এশিয়ার নাগরিকদের ব্যবহার করছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। এটা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে যেসব বিদেশি নাগরিক ভ্রমণ বা ধর্মীয় কাজে আসেন, বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া মুসলিম রিপাবলিকগুলো থেকে আসা নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে আফগান, পাকিস্তান ও তুরস্কের নাগরিকদের গতিবিধিও লক্ষ্য রাখতে হবে। তবলিগ জামাতে যোগ দিতে এরা আসেন। অনেকে থেকেও যান বিনা ভিসায়। পুলিশের কাছে এদের তথ্য আছে কিনা জানি না, কিন্তু এদিকে দৃষ্টি দেয়া এখন প্রয়োজন। জঙ্গিরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তারা তথ্য আদান-প্রদান করেছে কিংবা ছবি আপলোড করেছে, তাতে কী বিষয়ে কথা হয়েছে, কার সঙ্গে কথা হয়েছে তার কোন তথ্য থাকে না। ফলে খুব সহজেই জঙ্গিরা পার পেয়ে যায়। সুতরাং আমাদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে জরুরিভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যাতে জঙ্গি তৎপরতা মনিটর করা সহজ হয়।
হলি আর্টিজানের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে জঙ্গিরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ধনী ঘরের সন্তান। সুতরাং এ ধারণা এখন পরিতাজ্য যে, শুধু কওমি মাদরাসাগুলোই জঙ্গি উৎপাদন করে। মাদরাসার ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতা শোলাকিয়ার ঘটনায় পাওয়া গেছে। কিন্তু আমাদের চিন্তার জায়গাটা হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টার্গেট না করে বরং সরকারের উচিত ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতা করা। নর্থ সাউথ প্রয়োজনে একদল মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করতে পারে, যাদের কাজ হবে ছাত্রদের কাউন্সিলিং করা। মনিটর করার পাশাপাশি কাউন্সিলিং করাটা খুব জরুরি। কেননা কিছু তরুণ বিভ্রান্ত হয়েছে। এদের সঠিক পথে আনার দায়িত্বটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি তিন বাংলাদেশি আইএস জঙ্গি রাকা থেকে (আইএস-এর রাজধানী সিরিয়াতে) ভিডিও বার্তায় বাংলা ভাষায় আবারো জঙ্গি হামলার হুমকি দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এদের পরিচয় ইতোমধ্যে জানা গেছে। সবাই উচ্চশিক্ষিত। বিষয়টি আরো খতিয়ে দেখার জন্য এদের অভিভাবকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। একজন সাবেক সচিবের সন্তান যখন বিপথগামী হয় তিনি জেনেও তা যদি পুলিশকে না জানিয়ে থাকেন তাহলে তিনি অন্যায় করেছেন। সাবেক সচিব হিসেবে তিনি ক্ষমা পেতে পারেন না। সন্তানের দায়ভার তাকে বহন করতে হবেই। বিষয়টি যদি পুলিশ আগে জানত বোধকরি পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না। বিবিসি বাংলা আমাদের জানাচ্ছে, ওই সচিবের ছেলে শাফি (যে বাংলায় রাকা থেকে হুমকি দিয়েছিল), ৬-৭ মাস আগে তুরস্ক চলে গিয়েছিল। ওই সচিবের ব্যর্থতা এখানেই যে, ছেলের চাল-চলন দেখেও তাকে তিনি সংশোধন করতে পারেননি এবং পুলিশ প্রশাসনকে তা জানাননি। ইতোমধ্যে কিছু সময় পার হয়ে গেছে। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দেশে ডেকে এনে কতটুকু জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। এতে বিদেশি বিশেষ করে মার্কিনিদের ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়বে এবং বিদেশিরা আমাদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়াদির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়ে যাবেন। আমি মনে করি আমাদের সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এ কাজের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। জঙ্গি দমনে সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। সেই সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্যেরও প্রয়োজন।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daily Manobkontho 20.07.2016 >
সরকার আরো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নর্থ সাউর্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘নিয়ন্ত্রণের’ মধ্যে আনতে চায় সরকার। যে ছাত্র ১০ দিনের বেশি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকবে তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে জঙ্গি দমন কার্যক্রম কতটুকু সফল হবে? এটা সত্য সম্প্রতি জঙ্গি হামলার সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র জড়িত। কিন্তু কিছু ছাত্রের জন্য পুরো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ব্লাক লিস্ট’ করা ঠিক হবে না। অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি এবং সেই সঙ্গে কিছু মাদরাসার ছাত্রও জড়িত। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে, তাদের কাছে ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়া ছাত্রদের কোনো তথ্য নেই। যারা সম্প্রতি যাত্রীবেশে তুরস্ক গেছে সিরিয়ায় যাওয়ার জন্য তাদের ওপর নজরদারিও রাখতে পারেননি আমাদের গোয়েন্দারা এবং যখন তারা ফিরে এসেছে তখনো তা তারা মনিটর করতেও ব্যর্থ হয়েছেন।
শোলাকিয়া ও হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর আমাদের নীতি-নির্ধারকরা কতগুলো বিষয়ের দিকে এখন দৃষ্টি দিতে পারেন। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাকালে আমরা ভুল করব। ৩৭ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেও তাকাতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবলিক) যেমনি নারী নির্যাতন সেল রয়েছে, ঠিক তেমনি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে (পাবলিক ও প্রাইভেট) নিজস্ব উদ্যোগে একটি ‘জঙ্গি পর্যবেক্ষণ সেল’ গঠন করতে হবে। একজন সিনিয়র অধ্যাপক এর দায়িত্বে থাকবেন। এই সেলের কাজ হবে ক্যাম্পাসে সব অনিয়মিত ছাত্রের তালিকা তৈরি করে তা মনিটর করা, তাদের অভিভাবকদের সহায়তা দেয়া এবং প্রতি মাসে একটা রিপোর্ট পুলিশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে দেয়া। কাজটা পুলিশি কাজ সন্দেহ নেই তাতে। তবুও এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটি ডাটাবেজ তৈরি করাও জরুরি, যাতে ছাত্রের পূর্ণ তথ্য তাতে থাকবে। বিশেষ করে আইটি সেক্টরে পড়–য়া ছাত্রদের দিকে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। যে তরুণ প্রজš§কে নিয়ে আমাদের এত আশাবাদ, সেই তরুণ প্রজšে§র একটা অংশ বিভ্রান্ত হচ্ছে জঙ্গিবাদী আদর্শে। ইন্টারনেট এর একটা বড় মাধ্যম যার মাধ্যমে তরুণ প্রজš§ ‘ভ্রান্ত আদর্শে’ আকৃষ্ট হচ্ছে। এটা যে প্রকৃত ইসলাম নয়, এটা তারা বোঝে না। ইন্টারনেট বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদের ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করা হচ্ছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যা করা দরকার তা হচ্ছে ইন্টারনেটে নজরদারি বাড়ানো। প্রযুক্তিবিদদের সহযোগিতা নিয়ে এটা সম্ভব। ইন্টারনেট আমাদের জন্য অপার এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু ক্ষতিও করছে। বিভ্রান্তকারীরা তরুণ সমাজকে জঙ্গিবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করছে। যে তরুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখবে, নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তিতে নিজেদের নিয়োজিত রাখবে, সেই তরুণের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে পরজšে§র কথা। নেটের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে জিহাদি মনোভাব। জানানো হচ্ছে কীভাবে বোমা তৈরি করতে হয়।
গুলশানে হামলাকারীরা আত্মঘাতী ছিল। তারা জানত তাদের পরিণতি কী হবে। তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল ‘বেহেস্তের’ কথা। তাই সেনা কমান্ডো হামলার চূড়ান্ত মুহূর্তে তারা বলেছিল ‘বেহেস্তে’ যাওয়ার কথা। তাদের এই যে মগজ ধোলাই, এটা করা হয়েছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তাই ইন্টারনেটের কার্যকলাপ, গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। কারা কারা ওইসব ‘সাইট’ ভ্রমণ করে তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি বাড়ানোও জরুরি। যেসব তরুণ এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল, তারা ৫ থেকে ৬ মাস আগে বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। তাদের অভিভাবকরা সবাই পুলিশ স্টেশনে জিডি করেছিলেন। পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। পুলিশ সেই সহযোগিতা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই অভিভাবকদের দোষ দেয়া যাবে না। বিশ বছরের এক তরুণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। পুলিশের ভূমিকাকে আমরা তাই গুরুত্ব দিতে চাই। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন শৈথিল্য এসেছে। তারা দায়িত্ব পালনে শতকরা এক শ’ ভাগ সফল, এটা বলতে পারছি না। তাই মোটিভেশন দরকার। প্রশিক্ষণ দরকার। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দুর্বলতা এই ঘটনায় আরো একবার প্রমাণিত হলো। একজন তরুণ ছয় মাস আগে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, তার হদিস পুলিশ পাবে নাÑএটা বিস্ময়কর বিষয়। নিবরাস ইসলাম, মীর মুবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল কিংবা রায়ান মিনহাজরা ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়ার পর গত ৫-৬ মাস কোথায় ছিল, কীভাবে ছিল তা জানা দরকার। ধারণা করা যায় তাদের সিরিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য। যদি তাই হয় তাহলে এর পেছনে কোন ‘শক্তি’ সক্রিয় ছিল তা অভ্যন্তরীণ কোনো ‘শক্তি’ কিনা, তা জানা দরকার। অভ্যন্তরীণ শক্তির যোগসাজশ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। এদের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই হলি আর্টিজান কিংবা শোলাকিয়ায় অপারেশন চালাতে পারত না জঙ্গিরা। তাই অভ্যন্তরীণ সহযোগীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আরো একটা কথা বলা দরকার। সিরিয়ায় আইএসের উত্থানের পর থেকে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ থেকে কিছু তরুণ সিরিয়ায় গেছে। সাধারণত এরা তুরস্ক হয়েই সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ধরে নেয়া যেতে পারে তারা বিমানবন্দর ব্যবহার করেছে। যদি তাই হয়ে থাকে, বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য থাকার কথা। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা দরকার। কোনো ধরনের শৈথিল্য যেন এ কাজে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।
আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশি জঙ্গিদের পশ্চিম বাংলার বর্ধমান ও নদিয়া জেলায় আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ। এরা জেএমবির সদস্য। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে ২০১৪ সালের অক্টোবরে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল তাতে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় গোয়েন্দাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, বর্ধমানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জেএমবির ঘাঁটি রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হাফিজ শেখ (জানুয়ারি ২০১৬) কিংবা সেলিম রেজার (জানুয়ারি ২০১৬) জঙ্গি কানেকশনে গ্রেফতারের কাহিনী সেখানকার পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। পাঠক স্মরণ করতে পারেন ভারতীয় গোয়েন্দারা ওইসব কর্মকাণ্ডে (বিশেষ করে বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণ) জেএমবির সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে ঢাকায়ও এসেছিলেন। ফলে হলি আর্টিজানে যে জঙ্গিরা মারা গেছে তারা পশ্চিমবঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকতে পারে। আমাদের গোয়েন্দাদের এখন বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তুরস্কে আইএসের হামলায় যে তিন জঙ্গি অংশ নিয়েছিল তারা কেউই তুরস্কের নাগরিক নয়। ওই তিনজন ছিল রাশিয়া (চেচেন), উজবেকস্তিান ও ফিলিস্তিনের নাগরিক। আইএস এখন মধ্য এশিয়ার নাগরিকদের ব্যবহার করছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। এটা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশে যেসব বিদেশি নাগরিক ভ্রমণ বা ধর্মীয় কাজে আসেন, বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া মুসলিম রিপাবলিকগুলো থেকে আসা নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে আফগান, পাকিস্তান ও তুরস্কের নাগরিকদের গতিবিধিও লক্ষ্য রাখতে হবে। তবলিগ জামাতে যোগ দিতে এরা আসেন। অনেকে থেকেও যান বিনা ভিসায়। পুলিশের কাছে এদের তথ্য আছে কিনা জানি না, কিন্তু এদিকে দৃষ্টি দেয়া এখন প্রয়োজন। জঙ্গিরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তারা তথ্য আদান-প্রদান করেছে কিংবা ছবি আপলোড করেছে, তাতে কী বিষয়ে কথা হয়েছে, কার সঙ্গে কথা হয়েছে তার কোন তথ্য থাকে না। ফলে খুব সহজেই জঙ্গিরা পার পেয়ে যায়। সুতরাং আমাদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে জরুরিভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যাতে জঙ্গি তৎপরতা মনিটর করা সহজ হয়।
হলি আর্টিজানের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে জঙ্গিরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ধনী ঘরের সন্তান। সুতরাং এ ধারণা এখন পরিতাজ্য যে, শুধু কওমি মাদরাসাগুলোই জঙ্গি উৎপাদন করে। মাদরাসার ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতা শোলাকিয়ার ঘটনায় পাওয়া গেছে। কিন্তু আমাদের চিন্তার জায়গাটা হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টার্গেট না করে বরং সরকারের উচিত ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতা করা। নর্থ সাউথ প্রয়োজনে একদল মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করতে পারে, যাদের কাজ হবে ছাত্রদের কাউন্সিলিং করা। মনিটর করার পাশাপাশি কাউন্সিলিং করাটা খুব জরুরি। কেননা কিছু তরুণ বিভ্রান্ত হয়েছে। এদের সঠিক পথে আনার দায়িত্বটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি তিন বাংলাদেশি আইএস জঙ্গি রাকা থেকে (আইএস-এর রাজধানী সিরিয়াতে) ভিডিও বার্তায় বাংলা ভাষায় আবারো জঙ্গি হামলার হুমকি দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এদের পরিচয় ইতোমধ্যে জানা গেছে। সবাই উচ্চশিক্ষিত। বিষয়টি আরো খতিয়ে দেখার জন্য এদের অভিভাবকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। একজন সাবেক সচিবের সন্তান যখন বিপথগামী হয় তিনি জেনেও তা যদি পুলিশকে না জানিয়ে থাকেন তাহলে তিনি অন্যায় করেছেন। সাবেক সচিব হিসেবে তিনি ক্ষমা পেতে পারেন না। সন্তানের দায়ভার তাকে বহন করতে হবেই। বিষয়টি যদি পুলিশ আগে জানত বোধকরি পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না। বিবিসি বাংলা আমাদের জানাচ্ছে, ওই সচিবের ছেলে শাফি (যে বাংলায় রাকা থেকে হুমকি দিয়েছিল), ৬-৭ মাস আগে তুরস্ক চলে গিয়েছিল। ওই সচিবের ব্যর্থতা এখানেই যে, ছেলের চাল-চলন দেখেও তাকে তিনি সংশোধন করতে পারেননি এবং পুলিশ প্রশাসনকে তা জানাননি। ইতোমধ্যে কিছু সময় পার হয়ে গেছে। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দেশে ডেকে এনে কতটুকু জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। এতে বিদেশি বিশেষ করে মার্কিনিদের ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়বে এবং বিদেশিরা আমাদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়াদির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়ে যাবেন। আমি মনে করি আমাদের সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এ কাজের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। জঙ্গি দমনে সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। সেই সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্যেরও প্রয়োজন।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র Daily Manobkontho 20.07.2016 >
0 comments:
Post a Comment