বিশ্বজুড়ে সহিংসতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আবারও জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে ফ্রান্স। দেড় বছরের মধ্যে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সন্ত্রাসী হামলার শিকার হল দেশটি। বৃহস্পতিবার রাতে ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৪ ব্যক্তি। এর ক’দিন আগে সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে তুরস্কের ইস্তান্বুল নগরী। গত মার্চে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। শুধু ইউরোপ নয়, জঙ্গি হামলার শিকার হচ্ছে এশিয়াও। সম্প্রতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে হামলা হয়েছে ঢাকা, বাগদাদ ও মদিনায়। সহিংসতার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ভিন্ন হলেও এ থেকে মুক্ত নেই আমেরিকাও। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ও লুসিয়ানা অঙ্গরাজ্যে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার কর্তৃক দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরের হত্যাকাণ্ডের পর ডালাসে ৫ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এখন আলোচনার ঝড় বইছে। ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে গত ৮ জুলাই। হত্যাকারী একজন কৃষ্ণাঙ্গ- মিকা জেভিয়ার জনসন। মিকা একজন আফগানফেরত সৈনিক। পরিকল্পিতভাবে সে ৫ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে। পরে পুলিশের ‘রকেটবোমায়’ মিকা নিহত হয়। এই ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন করে আবার জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দিয়েছে। গত ১২ জুলাই ৫ পুলিশ অফিসারের জন্য আয়োজিত স্মরণসভায় ডালাসে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। ওবামা এখানে যে বক্তব্য দেন তাও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি বলেছেন, ‘যতটা বলা হয় আমরা বিভক্ত সমাজ, আমরা অতটা বিভক্ত নই’, তারপরও তার বক্তব্যে ফুটে উঠেছে এক ধরনের হতাশা। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘আফ্রো-আমেরিকানদের দুর্দশার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য যা করা উচিত ছিল, তা আমরা করতে পারিনি।’ ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে বিষয়টি কাজ করেছিল, তা হচ্ছে জাতিগত দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এক ধরনের অবহেলা এবং একই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে দিয়ে এই জাতিগত বিদ্বেষের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এই জাতিগত বিদ্বেষ কত গভীরে। মিনেসোটা ও লুসিয়ানায় দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমি নিউইয়র্কে। এমনকি ৫ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার হত্যার সময়ও আমি ছিলাম নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক অনেক বড় শহর। এই জাতিগত বিদ্বেষের বিষয়টি সেখানে বোঝা যায় না। যেদিন ওবামা ডালাসে ভাষণ দিলেন (১২ জুলাই), সেদিন আমি নিউইয়র্ক থেকে ডালাসের ফ্লাইট ধরেছি। ডালাসে আসব। আমেরিকান এয়ারলাইনসে আমার পাশে বসা ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবয়সী। ৪ ঘণ্টার ফ্লাইট। একসময় পরিচয় হল। কমিউনিটি কলেজের শিক্ষক। বোধকরি আমাকে কিছুটা আস্থায় তিনি নিতে পেরেছিলেন। কেননা আমি কৃষ্ণাঙ্গ নই, এশিয়ান এবং মিক্সড কালার, গায়ের রংটা একেবারে কালো নয়। দীর্ঘ সময় যে আলোচনা হয়েছে তার মোদ্দা কথা একটাই- কৃষ্ণাঙ্গরা অসভ্য, তারা আইন-কানুন মানে না, কাজ করতে চায় না, জঙ্গি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি জানি, টেক্সাস একটি রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এখানকার মানুষ অনেক কনজারভেটিভ। ডালাসে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ৫০ দশমিক ৭ ভাগ শ্বেতাঙ্গ, আর ২৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ। প্রায় ৩ ভাগ হচ্ছেন এশিয়ান বংশোদ্ভূত। প্রতিবছরই আমি ডালাস বেড়াতে আসি। আমি এখানকার মানুষের মনোভাব কিছুটা বুঝতে পারি। সুতরাং ওই কমিউনিটি কলেজের অধ্যাপক একজন শিক্ষিত লোক হলেও যে তার ভেতরে এক ধরনের জাতিগত বিদ্বেষ রয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি তাতে অবাক হইনি। ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে- এটাই ছিল একদিকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক ১১টি কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু কোনো একটি ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত শ্বেতাঙ্গ অফিসারের বিচারে শাস্তি হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযুক্ত অফিসার পদত্যাগ করেছেন, অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে হত্যাকাণ্ডের ‘ফয়সালা’ হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। অতি সম্প্রতি মিনেসোটা ও লুসিয়ানায় যে কিশোরদের হত্যা করা হয়েছে তাতে দেখা যায় (ভিডিও ফুটেজ), জনৈক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে গুলি করেছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার মুভমেন্ট’। আর এ মুভমেন্টের সংগঠকরা যখন ডালাসের রাস্তায় মিনেসোটা-লুসিয়ানায় পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল, তখন অদৃশ্য আততায়ীর গুলিতে মারা যান ৫ পুলিশ অফিসার, যারা ছিলেন সবাই শ্বেতাঙ্গ। মিকা জেভিয়ার জনসন ‘শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার’ হত্যার অঙ্গীকার করেছিল। টেক্সাসে তার বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশ বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও উপাদানও সংগ্রহ করে। স্পষ্টতই মিকা এক ধরনের ‘প্রতিশোধ’ নিতে চেয়েছিল। ডালাস ট্রাজেডি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই জাতিগত বিদ্বেষ কত গভীরে প্রবেশ করেছে। ডালাস হত্যাকাণ্ডের পর সাউথ ক্যারোলিনায় দক্ষিণপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা গৃহযুদ্ধকালীন পুরনো পতাকা পর্যন্ত উড়িয়েছে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানবতাবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত ভাষণ (২৮ আগস্ট ১৯৬৩) : 'I have a dream' -আমার একটি স্বপ্ন আছে। হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের উপস্থিতিতে লুথার কিং বলেছিলেন, ‘তার একটি স্বপ্ন আছে যে একদিন এ জাতি জেগে উঠবে।’ কিং বলেছিলেন, 'I have a dream that one day this nation will rise up and live out the true meaning of its creed : We hold these truth to be self evident, that all men are created equal।’ কিং তার স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন- একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে সাবেক দাস ও দাসের মালিকরা একসঙ্গে বসে ভ্রাতৃত্ববোধকে সমুন্নত রাখবে। একসঙ্গে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সব ভেদাভেদ ভুলে দেশকে গড়ে তুলবে! প্রায় ৫৩ বছর আগের কথা। লুথার কিংয়ের স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে? না, পূরণ হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও মূলধারার রাজনীতিতে আসতে পারেননি। ওবামাকে বলা হয় কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু ওবামার মা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, বাবা কেনিয়ান। অর্থাৎ তিনি মিশ্র। তবে স্ত্রী মিশেল কৃষ্ণাঙ্গ এবং সাবেক এক আফ্রিকান দাসের রক্ত তার শরীরে রয়েছে। ওবামা কোনো দাসের রক্ত বহন করেন না। মার্কিন সমাজে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও অবহেলিত। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ১১৪তম কংগ্রেস (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ) পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪৫ জন সদস্য রয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে (মোট সদস্য ৪৪১) আর সিনেটে রয়েছেন ২ জন কৃষ্ণাঙ্গ (মোট সদস্য ১০০)। এদের পরিচিতি আফ্রো-আমেরিকান হিসেবে। বলা ভালো, প্রায় ৩২ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর এই দেশ যুক্তরাষ্ট্র। জনসংখ্যার ৭২ দশমিক ৪ ভাগ শ্বেতাঙ্গ, ১২ দশমিক ৬ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ, আর ৪ দশমিক ৭৩ ভাগ এশিয়ান (চীনা, ভারতীয়সহ)। সুতরাং কংগ্রেসে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব খুব বেশি এটা বলা যাবে না। মার্কিন সমাজে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বৈষম্য আছে। ওয়াশিংটনের পিউ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যেখানে গড়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গের সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৫,৬৭৭ ডলার, সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গের সম্পদের পরিমাণ ১,১৩,১৪৯ ডলার। অর্থাৎ ২০ গুণেরও বেশি সম্পদের অধিকারী শ্বেতাঙ্গরা। পরিসংখ্যান বলছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ ভাগের কাছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ডলারের সম্পদ আছে। আর শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছে আছে ৩০ ভাগ। ১ ভাগের কম কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ১ মিলিয়ন ডলারের সম্পদের মালিক, অথচ ১০ ভাগ শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছে আছে ৮ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ৪ ভাগের ১ ভাগ মাত্র ১০০০ ডলার করে পেনশন ভাতা পান। আর গড় শ্বেতাঙ্গদের পেনশনের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যকার এই বৈষম্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রতিটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী অনেক পিছিয়ে আছে। শিক্ষায়ও তাদের অগ্রগতি নেই। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা ও শ্বেতাঙ্গবিদ্বেষ থাকা বিচিত্র নয়। আর এরই প্রতিফলন ঘটেছে ডালাস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও দেখা গেছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কিছু সম্পদশালী লোকের কাছে। এসব সম্পদশালী লোকই রাজনীতি তথা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এরা শত শত কর্পোরেট হাউস গঠন করে আজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ১ ভাগ মানুষ। এ কারণেই গড়ে উঠেছিল ‘অকুপাই মুভমেন্ট’। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের সেই জুকোটি পার্কের কাহিনী সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। ম্যানহাটনের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পাশেই জুকোটি পার্ক। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম সেখানে। ছোট একটি পার্ক। মানুষ বসে বিশ্রাম করে। আগের মতো সেই ‘জুকোটি পার্ক’ আন্দোলনের (সেপ্টেম্বর ২০১১) কথা কেউ মনে রাখে না এখন আর। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এ বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ কখনও গ্রহণ করা হয়নি। সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ ছিল। আর সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মিনেসোটা ও লুসিয়ানায় কিশোর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। পুলিশের ভূমিকা এখন সর্বত্র সমালোচিত হচ্ছে। পুলিশ অফিসাররা, যারা সবাই শ্বেতাঙ্গ, তারা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যে বর্বোরোচিত আচরণ করেছে, তা সংগত ছিল না। তাদের ভেতরে এক ধরনের জাতিবিদ্বেষ কাজ করেছিল। কৃষ্ণাঙ্গ গবেষক এবোনি স্লটার জনসন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন সম্প্রতি (Still Second Class Citizens, Other Worlds, 13 July, 2016)। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এই যে অত্যাচার-নিপীড়ন, তা মূলত ১৮৫৭ সালে দেয়া তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রজার তানেহর দেয়া একটি ঐতিহাসিক রায়েরই প্রতিফলন। একটি দাস পরিবারে জন্ম নেয়া জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ ড্রেড স্কট ‘স্বাধীন’ কিনা, এটা জানতেই সেদিন মামলা হয়েছিল। বিচারপতি রজার ওই আবেদন শুধু খারিজই করেননি, বরং একটি বার্তাও দিয়েছিলেন, যা আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল : ‘আফ্রো-আমেরিকান, অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গরা আদৌ এ দেশের নাগরিক নন, তাদের কোনো অধিকারই নেই এ ধরনের মামলা করার।’ প্রধান বিচারপতি রজার তার রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আফ্রো-আমেরিকানদের কোনো অধিকার নেই, যা শ্বেতাঙ্গরা মানতে বাধ্য।’ ইন্সটিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের গবেষক এবোনি স্লটার জনসন মন্তব্য করেছেন এভাবে- 'The fight for full African American citizenship continues।’ অর্থাৎ পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার অব্যাহত থাকবে। এখানে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম, ১৪তম ও ১৫তম সংশোধনী বলে পর্যায়ক্রমে দাসত্ব প্রথা বিলোপ করা হয় এবং আফ্রো-আমেরিকানদের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। কৃষ্ণাঙ্গদের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। যাদের সম্পত্তি ছিল, তারাই শুধু ভোট দিতে পারতেন। কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার নিয়েও সমস্যা ছিল। প্রেসিডেন্ট জনসন ১৯৬৫ সালের ৬ আগস্ট যে আইনে স্বাক্ষর করেন, তাতে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যত ধরনের বাধা ছিল, তা দূর হয়। আসলে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের যে আচরণ, তা পরিপূর্ণভাবে দূর হয়েছে এটা বলা যাবে না। কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে এখনও অনেকটা ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর’ নাগরিকের মতো আচরণ করা হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। নিউইয়র্ক টাইমস ও সিবিএসের সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৬৯ ভাগ আমেরিকান মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বিদ্বেষ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে (১৩ জুলাই ২০১৬)। ১৯৯২ সালে লস এঞ্জেলেসে জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ রডনি কিংয়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর এই প্রথম জাতিগত বিদ্বেষ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এই জাতিগত বিদ্বেষ আরও বাড়বে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন(?)। এই জাতিগত বিদ্বেষের ঘটনায়, বিশেষ করে মিনেসোটা ও লুসিয়ানার ঘটনার পর ডালাসের হত্যাকাণ্ড খোদ প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও ক্ষুব্ধ করেছে। ডালাসের স্মরণসভায় তিনি এই জাতিগত বিদ্বেষকে তুলনা করেছেন 'The deepest fault lines of our democracy' হিসেবে (ভোয়া, ১৩ জুলাই)। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের একটি বড় ত্রুটি হচ্ছে এই জাতিগত বিদ্বেষ। প্রেসিডেন্ট ওবামার এ ধরনের মন্তব্য নিঃসন্দেহে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। পুলিশ বিভাগে শ্বেতাঙ্গ অফিসাররা আইনবহির্ভূতভাবে এমন সব ‘কাজ’ করছেন, যা শুধু অভ্যন্তরীণভাবেই বিতর্কের সৃষ্টি করছে না, বরং জাতিগত বিদ্বেষকে আরও উসকে দিচ্ছে। বলাই বাহুল্য, এটা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Jugantor 17.07.2016
বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গিবাদের কালো ছায়
14:56
No comments
বিশ্বজুড়ে সহিংসতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আবারও জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে ফ্রান্স। দেড় বছরের মধ্যে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সন্ত্রাসী হামলার শিকার হল দেশটি। বৃহস্পতিবার রাতে ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৪ ব্যক্তি। এর ক’দিন আগে সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে তুরস্কের ইস্তান্বুল নগরী। গত মার্চে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। শুধু ইউরোপ নয়, জঙ্গি হামলার শিকার হচ্ছে এশিয়াও। সম্প্রতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে হামলা হয়েছে ঢাকা, বাগদাদ ও মদিনায়। সহিংসতার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ভিন্ন হলেও এ থেকে মুক্ত নেই আমেরিকাও। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ও লুসিয়ানা অঙ্গরাজ্যে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার কর্তৃক দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরের হত্যাকাণ্ডের পর ডালাসে ৫ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এখন আলোচনার ঝড় বইছে। ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে গত ৮ জুলাই। হত্যাকারী একজন কৃষ্ণাঙ্গ- মিকা জেভিয়ার জনসন। মিকা একজন আফগানফেরত সৈনিক। পরিকল্পিতভাবে সে ৫ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে। পরে পুলিশের ‘রকেটবোমায়’ মিকা নিহত হয়। এই ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন করে আবার জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দিয়েছে। গত ১২ জুলাই ৫ পুলিশ অফিসারের জন্য আয়োজিত স্মরণসভায় ডালাসে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। ওবামা এখানে যে বক্তব্য দেন তাও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি বলেছেন, ‘যতটা বলা হয় আমরা বিভক্ত সমাজ, আমরা অতটা বিভক্ত নই’, তারপরও তার বক্তব্যে ফুটে উঠেছে এক ধরনের হতাশা। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘আফ্রো-আমেরিকানদের দুর্দশার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য যা করা উচিত ছিল, তা আমরা করতে পারিনি।’ ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে বিষয়টি কাজ করেছিল, তা হচ্ছে জাতিগত দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এক ধরনের অবহেলা এবং একই সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে দিয়ে এই জাতিগত বিদ্বেষের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এই জাতিগত বিদ্বেষ কত গভীরে। মিনেসোটা ও লুসিয়ানায় দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমি নিউইয়র্কে। এমনকি ৫ শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার হত্যার সময়ও আমি ছিলাম নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক অনেক বড় শহর। এই জাতিগত বিদ্বেষের বিষয়টি সেখানে বোঝা যায় না। যেদিন ওবামা ডালাসে ভাষণ দিলেন (১২ জুলাই), সেদিন আমি নিউইয়র্ক থেকে ডালাসের ফ্লাইট ধরেছি। ডালাসে আসব। আমেরিকান এয়ারলাইনসে আমার পাশে বসা ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবয়সী। ৪ ঘণ্টার ফ্লাইট। একসময় পরিচয় হল। কমিউনিটি কলেজের শিক্ষক। বোধকরি আমাকে কিছুটা আস্থায় তিনি নিতে পেরেছিলেন। কেননা আমি কৃষ্ণাঙ্গ নই, এশিয়ান এবং মিক্সড কালার, গায়ের রংটা একেবারে কালো নয়। দীর্ঘ সময় যে আলোচনা হয়েছে তার মোদ্দা কথা একটাই- কৃষ্ণাঙ্গরা অসভ্য, তারা আইন-কানুন মানে না, কাজ করতে চায় না, জঙ্গি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি জানি, টেক্সাস একটি রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এখানকার মানুষ অনেক কনজারভেটিভ। ডালাসে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ৫০ দশমিক ৭ ভাগ শ্বেতাঙ্গ, আর ২৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ। প্রায় ৩ ভাগ হচ্ছেন এশিয়ান বংশোদ্ভূত। প্রতিবছরই আমি ডালাস বেড়াতে আসি। আমি এখানকার মানুষের মনোভাব কিছুটা বুঝতে পারি। সুতরাং ওই কমিউনিটি কলেজের অধ্যাপক একজন শিক্ষিত লোক হলেও যে তার ভেতরে এক ধরনের জাতিগত বিদ্বেষ রয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি তাতে অবাক হইনি। ৫ পুলিশ অফিসারের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হচ্ছে- এটাই ছিল একদিকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক ১১টি কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু কোনো একটি ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত শ্বেতাঙ্গ অফিসারের বিচারে শাস্তি হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযুক্ত অফিসার পদত্যাগ করেছেন, অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে হত্যাকাণ্ডের ‘ফয়সালা’ হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। অতি সম্প্রতি মিনেসোটা ও লুসিয়ানায় যে কিশোরদের হত্যা করা হয়েছে তাতে দেখা যায় (ভিডিও ফুটেজ), জনৈক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে গুলি করেছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার মুভমেন্ট’। আর এ মুভমেন্টের সংগঠকরা যখন ডালাসের রাস্তায় মিনেসোটা-লুসিয়ানায় পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল, তখন অদৃশ্য আততায়ীর গুলিতে মারা যান ৫ পুলিশ অফিসার, যারা ছিলেন সবাই শ্বেতাঙ্গ। মিকা জেভিয়ার জনসন ‘শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার’ হত্যার অঙ্গীকার করেছিল। টেক্সাসে তার বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশ বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও উপাদানও সংগ্রহ করে। স্পষ্টতই মিকা এক ধরনের ‘প্রতিশোধ’ নিতে চেয়েছিল। ডালাস ট্রাজেডি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই জাতিগত বিদ্বেষ কত গভীরে প্রবেশ করেছে। ডালাস হত্যাকাণ্ডের পর সাউথ ক্যারোলিনায় দক্ষিণপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা গৃহযুদ্ধকালীন পুরনো পতাকা পর্যন্ত উড়িয়েছে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানবতাবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত ভাষণ (২৮ আগস্ট ১৯৬৩) : 'I have a dream' -আমার একটি স্বপ্ন আছে। হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের উপস্থিতিতে লুথার কিং বলেছিলেন, ‘তার একটি স্বপ্ন আছে যে একদিন এ জাতি জেগে উঠবে।’ কিং বলেছিলেন, 'I have a dream that one day this nation will rise up and live out the true meaning of its creed : We hold these truth to be self evident, that all men are created equal।’ কিং তার স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন- একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে সাবেক দাস ও দাসের মালিকরা একসঙ্গে বসে ভ্রাতৃত্ববোধকে সমুন্নত রাখবে। একসঙ্গে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সব ভেদাভেদ ভুলে দেশকে গড়ে তুলবে! প্রায় ৫৩ বছর আগের কথা। লুথার কিংয়ের স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে? না, পূরণ হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও মূলধারার রাজনীতিতে আসতে পারেননি। ওবামাকে বলা হয় কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু ওবামার মা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, বাবা কেনিয়ান। অর্থাৎ তিনি মিশ্র। তবে স্ত্রী মিশেল কৃষ্ণাঙ্গ এবং সাবেক এক আফ্রিকান দাসের রক্ত তার শরীরে রয়েছে। ওবামা কোনো দাসের রক্ত বহন করেন না। মার্কিন সমাজে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও অবহেলিত। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ১১৪তম কংগ্রেস (সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ) পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪৫ জন সদস্য রয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে (মোট সদস্য ৪৪১) আর সিনেটে রয়েছেন ২ জন কৃষ্ণাঙ্গ (মোট সদস্য ১০০)। এদের পরিচিতি আফ্রো-আমেরিকান হিসেবে। বলা ভালো, প্রায় ৩২ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর এই দেশ যুক্তরাষ্ট্র। জনসংখ্যার ৭২ দশমিক ৪ ভাগ শ্বেতাঙ্গ, ১২ দশমিক ৬ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ, আর ৪ দশমিক ৭৩ ভাগ এশিয়ান (চীনা, ভারতীয়সহ)। সুতরাং কংগ্রেসে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব খুব বেশি এটা বলা যাবে না। মার্কিন সমাজে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বৈষম্য আছে। ওয়াশিংটনের পিউ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যেখানে গড়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গের সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৫,৬৭৭ ডলার, সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গের সম্পদের পরিমাণ ১,১৩,১৪৯ ডলার। অর্থাৎ ২০ গুণেরও বেশি সম্পদের অধিকারী শ্বেতাঙ্গরা। পরিসংখ্যান বলছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ ভাগের কাছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ডলারের সম্পদ আছে। আর শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছে আছে ৩০ ভাগ। ১ ভাগের কম কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ১ মিলিয়ন ডলারের সম্পদের মালিক, অথচ ১০ ভাগ শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছে আছে ৮ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ৪ ভাগের ১ ভাগ মাত্র ১০০০ ডলার করে পেনশন ভাতা পান। আর গড় শ্বেতাঙ্গদের পেনশনের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যকার এই বৈষম্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রতিটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী অনেক পিছিয়ে আছে। শিক্ষায়ও তাদের অগ্রগতি নেই। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা ও শ্বেতাঙ্গবিদ্বেষ থাকা বিচিত্র নয়। আর এরই প্রতিফলন ঘটেছে ডালাস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও দেখা গেছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কিছু সম্পদশালী লোকের কাছে। এসব সম্পদশালী লোকই রাজনীতি তথা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এরা শত শত কর্পোরেট হাউস গঠন করে আজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ১ ভাগ মানুষ। এ কারণেই গড়ে উঠেছিল ‘অকুপাই মুভমেন্ট’। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের সেই জুকোটি পার্কের কাহিনী সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। ম্যানহাটনের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পাশেই জুকোটি পার্ক। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম সেখানে। ছোট একটি পার্ক। মানুষ বসে বিশ্রাম করে। আগের মতো সেই ‘জুকোটি পার্ক’ আন্দোলনের (সেপ্টেম্বর ২০১১) কথা কেউ মনে রাখে না এখন আর। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এ বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ কখনও গ্রহণ করা হয়নি। সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ ছিল। আর সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মিনেসোটা ও লুসিয়ানায় কিশোর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। পুলিশের ভূমিকা এখন সর্বত্র সমালোচিত হচ্ছে। পুলিশ অফিসাররা, যারা সবাই শ্বেতাঙ্গ, তারা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যে বর্বোরোচিত আচরণ করেছে, তা সংগত ছিল না। তাদের ভেতরে এক ধরনের জাতিবিদ্বেষ কাজ করেছিল। কৃষ্ণাঙ্গ গবেষক এবোনি স্লটার জনসন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন সম্প্রতি (Still Second Class Citizens, Other Worlds, 13 July, 2016)। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এই যে অত্যাচার-নিপীড়ন, তা মূলত ১৮৫৭ সালে দেয়া তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রজার তানেহর দেয়া একটি ঐতিহাসিক রায়েরই প্রতিফলন। একটি দাস পরিবারে জন্ম নেয়া জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ ড্রেড স্কট ‘স্বাধীন’ কিনা, এটা জানতেই সেদিন মামলা হয়েছিল। বিচারপতি রজার ওই আবেদন শুধু খারিজই করেননি, বরং একটি বার্তাও দিয়েছিলেন, যা আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল : ‘আফ্রো-আমেরিকান, অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গরা আদৌ এ দেশের নাগরিক নন, তাদের কোনো অধিকারই নেই এ ধরনের মামলা করার।’ প্রধান বিচারপতি রজার তার রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আফ্রো-আমেরিকানদের কোনো অধিকার নেই, যা শ্বেতাঙ্গরা মানতে বাধ্য।’ ইন্সটিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের গবেষক এবোনি স্লটার জনসন মন্তব্য করেছেন এভাবে- 'The fight for full African American citizenship continues।’ অর্থাৎ পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার অব্যাহত থাকবে। এখানে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম, ১৪তম ও ১৫তম সংশোধনী বলে পর্যায়ক্রমে দাসত্ব প্রথা বিলোপ করা হয় এবং আফ্রো-আমেরিকানদের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। কৃষ্ণাঙ্গদের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। যাদের সম্পত্তি ছিল, তারাই শুধু ভোট দিতে পারতেন। কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার নিয়েও সমস্যা ছিল। প্রেসিডেন্ট জনসন ১৯৬৫ সালের ৬ আগস্ট যে আইনে স্বাক্ষর করেন, তাতে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যত ধরনের বাধা ছিল, তা দূর হয়। আসলে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের যে আচরণ, তা পরিপূর্ণভাবে দূর হয়েছে এটা বলা যাবে না। কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে এখনও অনেকটা ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর’ নাগরিকের মতো আচরণ করা হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। নিউইয়র্ক টাইমস ও সিবিএসের সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৬৯ ভাগ আমেরিকান মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বিদ্বেষ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে (১৩ জুলাই ২০১৬)। ১৯৯২ সালে লস এঞ্জেলেসে জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ রডনি কিংয়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর এই প্রথম জাতিগত বিদ্বেষ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এই জাতিগত বিদ্বেষ আরও বাড়বে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন(?)। এই জাতিগত বিদ্বেষের ঘটনায়, বিশেষ করে মিনেসোটা ও লুসিয়ানার ঘটনার পর ডালাসের হত্যাকাণ্ড খোদ প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও ক্ষুব্ধ করেছে। ডালাসের স্মরণসভায় তিনি এই জাতিগত বিদ্বেষকে তুলনা করেছেন 'The deepest fault lines of our democracy' হিসেবে (ভোয়া, ১৩ জুলাই)। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের একটি বড় ত্রুটি হচ্ছে এই জাতিগত বিদ্বেষ। প্রেসিডেন্ট ওবামার এ ধরনের মন্তব্য নিঃসন্দেহে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। পুলিশ বিভাগে শ্বেতাঙ্গ অফিসাররা আইনবহির্ভূতভাবে এমন সব ‘কাজ’ করছেন, যা শুধু অভ্যন্তরীণভাবেই বিতর্কের সৃষ্টি করছে না, বরং জাতিগত বিদ্বেষকে আরও উসকে দিচ্ছে। বলাই বাহুল্য, এটা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Jugantor 17.07.2016
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment