রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইস্তাম্বুলে বোমা হামলা ব্রেক্সিট ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে

সারা বিশ্বের মানুষ যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, ঠিক তখনই ইস্তানবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নতুন করে ব্রিটেনে জাতিগত বিদ্বেষের জš§ দিয়েছে। আর ইস্তাম্বুলে হামলা বিশ্বের সর্বত্র মুসলমান বিদ্বেষকে আরো শক্তিশালী করেছে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এই হামলার জন্য সরাসরি আইএস জঙ্গিদের দায়ী করেছেন। এই হামলা চলতি বছরের মার্চ মাসে ব্রাসেলসে সন্ত্রাসী হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। সিরিয়া থেকে আইএসের বিরুদ্ধে আসাদ বাহিনীর বিজয়ের খবর যখন আসছে এবং আইএস যখন তাদের দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, ঠিক তখনই বহির্বিশ্বে আইএস তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছে। পাঠক মনে করতে পারবেন চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডে একটি সমকামী ক্লাবে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছিল (যাতে মারা গিয়েছিলেন ৪১ জন মানুষ), সেখানেও আইএসের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গিয়েছিল। ইস্তানবুলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের কোনো মিল নেই, এটা সত্য। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে একটা মিল আছে উভয় ঘটনাতেই মুসলিমবিরোধী জনমত শক্তিশালী হচ্ছে। ব্রিটেনে জাতিগত বিদ্বেষের ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটেনে আশ্রয় নেয়া প্রায় ৩০ লাখ অভিবাসী, যাদের প্রায় সবাই মুসলমান, তারা টার্গেট হয়েছেন। তাদের ব্রিটেন ত্যাগ করার হুমকি দিয়ে পোস্টার টানানো হয়েছে। আমি যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে স্থানীয়ভাবে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক দেখেছি। আর নিউইয়র্কে এসেও দেখলাম অনেক বাংলাদেশি মুসলমান যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তাদের সবার মাঝেই এক ধরনের শঙ্কা ও আতঙ্ক। কেউ কেউ কোনো কারণ ছাড়াই হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ৯/১১ পরবর্তী পরিস্থিতি এখনো ফিরে আসেনি বটে, কিন্তু মানুষ এসব নিয়ে আলোচনা করছে। কেননা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্যতম প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব ঘটনা তার স্বার্থে ব্যবহার করছেন এবং মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। তবে এটা তো স্বীকার করতেই হবে সমসাময়িক ইতিহাসে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের ঢেউ তুলেছে। ইইউ মূলত একটি অর্থনৈতিক জোট হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে এর গুরুত্ব বেড়েছে। প্রায় ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৭৮২ বর্গকিলোমিটার আয়তন বেষ্টিত ইইউর জনসংখ্যা ৫০৮ মিলিয়ন। ২৮টি দেশ একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নে আবদ্ধ হলেও নিজস্ব পার্লামেন্ট, নিজস্ব সরকার ও নিজস্ব সংবিধান তারা বজায় রেখেছে। ফলে দেখা যায় পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই ইইউর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর নিজস্ব দূতাবাস রয়েছে। ওই দেশগুলোতে আবার ইইউর মিশনও রয়েছে (যেমন বাংলাদেশ)। নিঃসন্দেহে ইইউ অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ইইউর জিডিপির পরিমাণ ১৯ দশমিক ২০৫ ট্রিলিয়ন ডলার (সাধারণ হিসেবে ১৬ দশমিক ২২০ ট্রিলিয়ন ডলার), যা বিশ্বের তৃতীয় বড় অর্থনীতি। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ৩৭ হাজার ৮৫২ ডলার (পিপিপি, সাধারণ হিসেবে ৩১ দশমিক ৯১৮ ডলার), যা বিশ্বের ১৮তম। এই অর্থনৈতিক শক্তির বলেই ইইউ বর্তমানে অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেখা গেছে অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ ইস্তাম্বুলে বোমা হামলা ব্রেক্সিট ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গেএকটি ‘অবস্থান’ নিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইইউর সেই ‘অবস্থান’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘অবস্থান’ এর বাইরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রায়ন ও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে ইইউ সোচ্চার। এখন খুব সঙ্গতকারণেই ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইইউ দুর্বল হয়ে যাবে। এতে করে বিশ্ব আসরে তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে ব্রিটেন কি এখনই ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে? জনমতে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় হয়েছে বটে, কিন্তু এর আইনগত ভিত্তি কি? ইইউর গঠনের জন্য যে লিসবন চুক্তির প্রয়োজন ছিল, তার ৫০তম ধারায় বলা আছে যে কোনো দেশ ইইউর কাঠামো থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ওই দেশের সাংবিধানিক আইন প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ওই দেশের পার্লামেন্ট, জনগণ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। ব্রিটেনের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন ব্রিটেনের পার্লামেন্ট তা অনুমোদন করবে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবে না। তবে ব্রিটেন এখন থেকে দু’বছর সময় পাবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। তবে এই গণভোটের রায়ের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ আইনজীবী ডেভিড অ্যালেন গ্রিন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, এই রায়টি বাধ্যতামূলক নয়, বরং এক ধরনের উপদেশমূলক। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সরকার এই রায় ‘উপেক্ষা’ করতে পারে। এ ব্যাপারে পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেবে, এটা তার অভিমত। বাস্তবতা হচ্ছে এই রায় উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। পার্লামেন্টে এই রায় অনুমোদিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছিলেন। কিন্তু ভোটাররা তার কথা শোনেনি। ব্রেক্সিটবিরোধী ক্যাম্পেনে বিরোধী লেবার পার্টির যে ভূমিকা রাখা উচিত ছিল তা তারা করেনি। অথচ লেবার পার্টির এমপিদের প্রায় ৯০ ভাগই ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। যে অভিযোগটি উঠেছিল ইইউ ছাড়লে ব্রিটিশ আরো গরিব হয়ে যাবে। এই অভিযোগটির কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি ভোটাররা। মূলত ইউরোপে ব্যাপক অভিবাসন এই গণভোটে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অতি সাম্প্রতিকালে ব্যাপক হারে সিরীয়, ইরাকি ও আফগান নাগরিকদের ইউরোপে আগমন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের ভোটারদের মাঝে একটি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাদের মাঝে এমন একটা শঙ্কার জš§ হয় যে, ব্যাপকসংখ্যক অভিবাসন গ্রহণের ফলে ব্রিটেন তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে। এদের মাঝে একটা ‘ইসলামফোবিয়াও’ কাজ করেছিল। এটা উস্কে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন এবং গণভোটে বেক্সিটের পক্ষে রায় পড়লে, তিনি তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ক্যামেরন ব্রেক্সিটের বিপক্ষে, অর্থাৎ ইইউর পক্ষে জনসংযোগ করলেও মন্ত্রিসভার দুই সদস্য মাইকেল নেভি ও বরিস জনসন এর বিরোধিতা করেছিলেন। অর্থাৎ তারা ছিলেন ব্রেক্সিটের পক্ষে। ব্রিটেনের প্রবীণদের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি ক্যামেরন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধীরা যুক্তি তুলে ধরেছিলেন একটিই ইইউ না যুক্তরাজ্য? ইইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির নেতা নাইজেন ফরাজ সেøাগান তুলে ধরেছিলেন যুক্তরাজ্যের পক্ষেই। তাতে তিনি জয়ী হলেন। এই জয় তাকে যদি ভবিষ্যৎ ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নিঃসন্দেহে ফরাজ এখন যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। মানুষ তার কথায় আস্থা রেখেছে। গেল বছর ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অভিবাসন আগমন, ব্রিটেনের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি কারণে ক্যামেরন বাধ্য হয়েছিলেন গণভোট দিতে। সেই গণভোটেই শেষ পর্যন্ত তার পরাজয় ঘটল। তিনি যা চেয়েছিলেন, তাতে কোনো সমর্থন ছিল না যুক্তরাজ্যবাসীর। তিনি পরাজয় মেনে নিয়েছেন। তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী অক্টোবরে পার্টি কনভেনশনে নতুন নেতা নির্বাচিত হবে। শুধু কনজারভেটিভ পার্টি কেন বলি, বিরোধী লেবার পার্টিতেও এর বড় ধাক্কা লেগেছে। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের চেয়ারও এখন টলটলয়মান। তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন লেবার পার্টির অনেক এমপি। যদিও করবিন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। বলেছেন তিনি নেতৃত্বের প্রশ্নে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পশ্চিমা গণতন্ত্রের এটাই সৌন্দর্য যখন দলীয় নেতা তার নীতি জাতীয় পর্যায়ে অনুমোদন করতে পারেন না, তখন তিনি পদত্যাগ করেন। অতীতে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এ রকমটি হয়েছে। নেতা পদত্যাগ করেছেন। নির্বাচনে হেরে গিয়ে দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ক্যামেরন সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করলেন। সম্ভবত জেরেমি করবিনকেও যেতে হবে। ব্রিটেনের এই গণভোট আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। যুক্তরাজ্যে রয়েছে আমাদের পোশাক শিল্পের বড় বাজার। তৈরি পোশাক রফতানিতে এখন ধস নামতে পারে। কেননা পাউন্ডের মুদ্রামান হ্রাস পাওয়ায় যুক্তরাজ্যের আমদানিতে শ্লথগতি আসতে পারে। বাংলাদেশিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত ‘কারিশিল্প’ হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশিদের অভিবাসন প্রক্রিয়াতেও নানা প্রতিবন্ধকতা আসবে এখন। অন্যদিকে আগামী ২ বছরের মধ্যে ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় নতুন করে ব্রিটেনের সঙ্গে আমাদের নানা চুক্তি করতে হবে। পাউন্ডের মান কমে যাওয়ায় ব্রিটেনের বিনিয়োগেও শ্লথগতি আসবে। একই সঙ্গে ইইউ’র সহযোগিতাও সংকুচিত হবে। বাংলাদেশ নিজেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আক্রান্ত। এনিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদের ব্যাপারে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণার জš§ হয়েছে। বাংলাদেশে আইএস আছে কি নেই, এ বিতর্কেও সমাধান হয়নি। বরং গুলশানে স্প্যানিশ হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংস হামলা এবং আইএস কর্তৃক ঘটনার দায় স্বীকারের মধ্য দিয়ে এই বিতর্ক আরো উসকে দিল। অরল্যান্ডের পর ইস্তানবুলে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য অনেক চিন্তার কারণ। আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ব্রেক্সিট কিংবা ইস্তানবুলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কোনোটাই আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে Daily Manobkontho 10.07.2016

0 comments:

Post a Comment