ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি অভিযান শেষ হয়েছে। ২৮ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু রেখে গেছে নানা প্রশ্ন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব প্রশ্ন বারবার আলোচিত হতে থাকবে। এক. ‘হলি আর্টিজান বেকারিতে’ যে সন্ত্রাসী হামলা হল, তা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদেরই একটি অংশ। এই সন্ত্রাসী হামলা হল তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দরে জঙ্গি হামলার পর পরই। প্যারিস, ব্রাসেলস্ কিংবা ওরল্যান্ডের পর পরই ঘটল ঢাকায় এই জঙ্গি হামলা- এগুলো সবই একই সূত্রে গাথা। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের যে উত্থান ঘটেছে, তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় এই হামলা হল। তবে এটাই সত্য, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় এই জঙ্গি হামলা হয়েছে। দুই. বাংলাদেশে আইএস আছে, কী নেই, এই বিতর্ক এই জঙ্গি হামলার পর আরও শক্তিশালী হল। সন্ত্রাসীরা যেভাবে জিম্মিদের হত্যা করে এবং তা আইএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে, তা সাধারণত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরাই করে থাকে। অতীতে তাদের প্রকাশিত ভিডিওতে তারা দেখিয়েছে কীভাবে গলা কেটে জিম্মিদের তারা হত্যা করে। হলি আর্টিজানে জিম্মিদের জঙ্গিরা এভাবেই হত্যা করেছে। ফলে এখন বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি ও অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আরও শক্তিশালী হল। আমাদের নীতিনির্ধারকদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আইএসের ব্যাপারে তারা তাদের অবস্থানকে পরিবর্তন করেন কীনা। তিন. জঙ্গি ঘটনায় একাধিক রাষ্ট্র সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের কমান্ডোরা (সেনা, নৌ, বিমান, র্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত) প্রমাণ করল, তারা যে কোনো জঙ্গি হামলা মোকাবেলা করতে সক্ষম। ফলে আদৌ আমাদের বৈদেশিক সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস তথা আইএসবিরোধী জোটে যোগ দিক। বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়নি। যে কোনো বিদেশী শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে সন্ত্রাস দমনে অংশ নিলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এর বড় প্রমাণ। সুতরাং বাংলাদেশ এই ‘ভুল’ করতে পারে না। চার. গুলশানের মতো সুরক্ষিত এলাকায় কী করে ৭ জঙ্গি বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢুকল, এটা খুঁজে দেখা খুবই জরুরি। আমি দেখেছি গুলশান-বারিধারা ঢোকার রাস্তায় অনেকদিন থেকেই পুলিশি তল্লাশি পোস্ট আছে। বারিধারায় যে টিভি চ্যানেলটি রয়েছে, সেখানে আমি নিয়মিত যাই। ওই পুলিশি পোস্ট সেখানে একটি জটলার সৃষ্টি করে। এ রাস্তা ধরেই হলি আর্টিজানে যেতে হয়। পুলিশ এখানে তল্লাশি পোস্ট বসিয়েছে। কিন্তু এর বাইরে আরও যেসব ঢোকার রাস্তা রয়েছে, সেখানে কী কোনো তল্লাশি পোস্ট বসানো হয়েছিল? না হয়ে থাকলে এটা পুলিশ প্রশাসনের বড় ভুল। একইসঙ্গে ইতালির নাগরিক তাভেল্লা সিজারের হত্যাকাণ্ডের পর পুরো গুলশান এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছিল। অর্থাৎ হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা ছিল। সেখানে তাহলে জঙ্গিদের ‘রুকস্যাক’ টিভি ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করার দৃশ্য ধরা পড়ার কথা। এটা কি ধরা পড়েছিল? নাকি তাভেল্লা সিজারের হত্যাকাণ্ডের সময় যেভাবে সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখা হয়েছিল, বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, সে রকম একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। পাঁচ. অভিযোগ উঠেছে আগেই সেখানে গুলি মজুদ করে রাখা হয়েছিল। অথবা অন্য কোনো উৎস কিংবা গুলশান এলাকা থেকে অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করা হয়েছিল। এরও একটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। খোদ রাজধানীতে জঙ্গিরা যদি একে-২২ রাইফেল ব্যবহার করতে পারে, এটা তো আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ছয়. এই সন্ত্রাসী ঘটনা প্রমাণ করল গুলশানের দূতাবাস এলাকা অরক্ষিত। এটা ভিন্ন মেসেজ বিদেশে পৌঁছে দিতে পারে। সাধারণত বিদেশে দেখেছি দূতাবাস এলাকায় সাধারণ চলাচল নিয়ন্ত্রিত। গুলশান-বারিধারায় তা নেই। তাই অবিলম্বে এই এলাকায় জনসাধারণের অবাধ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত হোক। এই এলাকার ভেতর দিয়ে প্রচুর কর্মজীবী মানুষ বাড্ডা তথা কুড়িল এলাকায় নিত্য যাতায়াত করেন। ওদের জন্য বিকল্প যাতায়াতের পথ বের করা জরুরি। যেহেতু দূতাবাস এলাকা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, সে কারণে গুলশান এলাকা থেকে অবিলম্বে সব ধরনের রেস্টুরেন্ট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হোক। না হলে এই এলাকা ঝুঁকির মুখে থাকবে। আমাদের পুলিশ প্রশাসন তাভেল্লা সিজারের হত্যাকাণ্ডকে সিরিয়াসলি নেয়নি। নিলে হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটত না। সাত. যারা জঙ্গিবাদ নিয়ে দেশে ও বিদেশে কাজ করেন, তারা জানেন আইএস এই রমজান মাসে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলার হুমকি দিয়েছিল। এই হুমকির বাস্তবায়ন হয়েছিল আফগান-আমেরিকান এক নাগরিক কর্তৃক ওরল্যান্ডে সমকামী ক্লাবে ৪১ জনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। তারপর ঘটল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে হামলা। যতদূর জানি বাংলাদেশে আইএস হামলা চালাতে পারে, এরকম একটি হুমকি দিয়েছিল আইএস। কিন্তু আমাদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কি এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না? তারা কি এটা মনিটর করেননি? প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তাদের কাজ কী? যারা এই ফোর্সের নেতৃত্বে রয়েছেন, তাদের ভূমিকা নিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করে, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমি বারবার বলে আসছি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ফোর্সের কর্মকাণ্ড শুধু জঙ্গি তৎপরতা মনিটরিং, তথা জঙ্গি নির্মূলে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এই ফোর্সকে আরও শক্তিশালী, তথা যুগোপযোগী করার জন্য এই ফোর্সে সেনা কমান্ডোদের পদায়ন করাও জরুরি। প্রয়োজনে সিভিলিয়ান বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী ঘটনার পর সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা ভেবে দেখতে পারেন। আট. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এই হামলা পূর্বপরিকল্পিত। যদি তাই হয়, তাহলে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে সরকার এই পরিকল্পনারোধে কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? দেশে তো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলছে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, ১২ হাজারের ওপর মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের একটা বড় অংশ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শেষ হওয়ার আগেই হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। ফলে এই হত্যাকাণ্ডে পুরো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতাকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলল। নয়. এই হত্যাকাণ্ড যেসব জঙ্গি অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৫ জনকেই পুলিশ খুঁজছিল বলে দাবি করেছেন আইজিপি। পুলিশের লিস্টে তাদের নাম ছিল বলেও তার দাবি। এদিকে সাইট ইন্টেলিজেন্স ৫ জন জঙ্গির ছবি নামসহ প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র সেই ছবি ছেপেছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখন উচিত হবে এ ব্যাপারে একটি ব্যাখ্যা দেয়া। পুলিশ সূত্র থেকে কয়েকটি নাম দেয়া হয়েছে। ডাকনাম। কিন্তু পূর্ণ পরিচয়, পারিবারিক ইতিহাস জানা দরকার। সাইট ইন্টেলিজেন্স যে ছবি ব্যবহার করেছে, তাতে দেখা যায় জঙ্গিরা অস্ত্র হাতে, পেছনে আইএসের পতাকা ও মনোগ্রাম নিয়ে ছবি তুলেছে। সম্ভবত এটা এমন হতে পারে যে জঙ্গিরা সিরিয়া গিয়েছিল এবং সিরিয়া থেকেই তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থান করে কোনো জঙ্গি এ কাজে অংশ নেয়নি বলে আমার ধারণা। তবে এটা বলা যেতে পারে জঙ্গিরা প্রশিক্ষিত ছিল এবং তারা দীর্ঘদিন ধরে ‘র্যাকি’ করেই তাদের টার্গেট নির্ধারণ করেছিল। বিতর্ক এড়াতে তাই একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা জরুরি। দশ. হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। নিরাপদ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক সময় বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের এই ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বড় ধরনের ‘ক্ষতির’ সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ। বিদেশীরা বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে। ২৫ বিলিয়ন ডলারের যে তৈরি পোশাক শিল্প, তাতে অনিশ্চয়তা আসতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা যেটা জেনেছি তা হচ্ছে- অনেক পুরনো ক্রেতা নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশে আসতে তাদের অপারগতার কথা জানিয়েছেন। নতুন করে অর্ডারও দিচ্ছেন না। ফলে তৈরি পোশাক নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলই। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিএনএন দীর্ঘ সময় ধরে সম্প্রচার করেছে, তা এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে এখানে। মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে এক সময় পরিচিত ছিল এই দেশটি। এখন একটা আশংকার জন্ম হয়েছে যে দেশটিকে সোমালিয়া কিংবা নাইজেরিয়ার কাতারে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। বাংলাদেশে স্বীকৃত আইএস নেই। কিন্তু জেএমবি কিংবা এবিটির মতো জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। হরকাতুল জিহাদ-ই-ইসলামী-বাংলাদেশ (হুজিবি) যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্বীকৃত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের (২০০৮) তালিকায় রয়েছে। এ তালিকায় এখন আরও বেশক’টি সংগঠনের নাম যুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশীদের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি ট্রাম্প নাটকীয়ভাবে বিজয়ী হন, তাহলে বাংলাদেশীরা বিপদে পড়তে পারেন। এ ঘটনায় অনেকেরই সঙ্গে আমি কথা বলেছি। দেখেছি, তারা আতংকে রয়েছেন। এখন বাংলাদেশের ইমেজ থাকল একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী হামলা শেষ ঘটনা নয় বলেই আমার ধারণা। সাধারণত সন্ত্রাসীরা প্রতিশোধ নেয়। ফলে কমান্ডো হামলায় ৬ জন জঙ্গি নিহত হওয়ায় জঙ্গিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হতে হবে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক কারখানায় নজরদারি বাড়াতে হবে। যেন কোনো শৈথিল্য না থাকে। জঙ্গিদের হত্যা করে কিছু জিম্মিকে আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি বটে, কিন্তু বেশ ক’জন বিদেশীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। রাতে উদ্ধার অভিযান চালানো যেত কিনা, এটা নিয়ে এখন বিতর্ক করার সময় নয়। এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে দুটি বড় দল যদি পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করে, তা সুযোগ তৈরি করে দেবে জঙ্গিদের। খালেদা জিয়ার উচিত হবে সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। আর সরকার প্রধানেরও উচিত হবে জঙ্গি দমনে বিএনপির সহযোগিতা চাওয়া। এই সহযোগিতা যদি তিনি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে তা হবে তার বড় ‘রাজনৈতিক বিজয়’। অতীত ঘেঁটে আক্রমণাত্মক বক্তব্য শুধু তিক্ততাই বাড়াবে। হলি আর্টিজানের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর একটি সদূরপ্রসারী প্রভাব আছে, আমরা যেন এ কথাটা ভুলে না যাই। Daily Jugantor 04.07.2016
বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও বাংলাদেশ
20:04
No comments
ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি অভিযান শেষ হয়েছে। ২৮ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু রেখে গেছে নানা প্রশ্ন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব প্রশ্ন বারবার আলোচিত হতে থাকবে। এক. ‘হলি আর্টিজান বেকারিতে’ যে সন্ত্রাসী হামলা হল, তা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদেরই একটি অংশ। এই সন্ত্রাসী হামলা হল তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দরে জঙ্গি হামলার পর পরই। প্যারিস, ব্রাসেলস্ কিংবা ওরল্যান্ডের পর পরই ঘটল ঢাকায় এই জঙ্গি হামলা- এগুলো সবই একই সূত্রে গাথা। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের যে উত্থান ঘটেছে, তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় এই হামলা হল। তবে এটাই সত্য, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় এই জঙ্গি হামলা হয়েছে। দুই. বাংলাদেশে আইএস আছে, কী নেই, এই বিতর্ক এই জঙ্গি হামলার পর আরও শক্তিশালী হল। সন্ত্রাসীরা যেভাবে জিম্মিদের হত্যা করে এবং তা আইএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে, তা সাধারণত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরাই করে থাকে। অতীতে তাদের প্রকাশিত ভিডিওতে তারা দেখিয়েছে কীভাবে গলা কেটে জিম্মিদের তারা হত্যা করে। হলি আর্টিজানে জিম্মিদের জঙ্গিরা এভাবেই হত্যা করেছে। ফলে এখন বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি ও অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আরও শক্তিশালী হল। আমাদের নীতিনির্ধারকদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আইএসের ব্যাপারে তারা তাদের অবস্থানকে পরিবর্তন করেন কীনা। তিন. জঙ্গি ঘটনায় একাধিক রাষ্ট্র সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের কমান্ডোরা (সেনা, নৌ, বিমান, র্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত) প্রমাণ করল, তারা যে কোনো জঙ্গি হামলা মোকাবেলা করতে সক্ষম। ফলে আদৌ আমাদের বৈদেশিক সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস তথা আইএসবিরোধী জোটে যোগ দিক। বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়নি। যে কোনো বিদেশী শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে সন্ত্রাস দমনে অংশ নিলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এর বড় প্রমাণ। সুতরাং বাংলাদেশ এই ‘ভুল’ করতে পারে না। চার. গুলশানের মতো সুরক্ষিত এলাকায় কী করে ৭ জঙ্গি বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢুকল, এটা খুঁজে দেখা খুবই জরুরি। আমি দেখেছি গুলশান-বারিধারা ঢোকার রাস্তায় অনেকদিন থেকেই পুলিশি তল্লাশি পোস্ট আছে। বারিধারায় যে টিভি চ্যানেলটি রয়েছে, সেখানে আমি নিয়মিত যাই। ওই পুলিশি পোস্ট সেখানে একটি জটলার সৃষ্টি করে। এ রাস্তা ধরেই হলি আর্টিজানে যেতে হয়। পুলিশ এখানে তল্লাশি পোস্ট বসিয়েছে। কিন্তু এর বাইরে আরও যেসব ঢোকার রাস্তা রয়েছে, সেখানে কী কোনো তল্লাশি পোস্ট বসানো হয়েছিল? না হয়ে থাকলে এটা পুলিশ প্রশাসনের বড় ভুল। একইসঙ্গে ইতালির নাগরিক তাভেল্লা সিজারের হত্যাকাণ্ডের পর পুরো গুলশান এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছিল। অর্থাৎ হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা ছিল। সেখানে তাহলে জঙ্গিদের ‘রুকস্যাক’ টিভি ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করার দৃশ্য ধরা পড়ার কথা। এটা কি ধরা পড়েছিল? নাকি তাভেল্লা সিজারের হত্যাকাণ্ডের সময় যেভাবে সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখা হয়েছিল, বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, সে রকম একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। পাঁচ. অভিযোগ উঠেছে আগেই সেখানে গুলি মজুদ করে রাখা হয়েছিল। অথবা অন্য কোনো উৎস কিংবা গুলশান এলাকা থেকে অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করা হয়েছিল। এরও একটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। খোদ রাজধানীতে জঙ্গিরা যদি একে-২২ রাইফেল ব্যবহার করতে পারে, এটা তো আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ছয়. এই সন্ত্রাসী ঘটনা প্রমাণ করল গুলশানের দূতাবাস এলাকা অরক্ষিত। এটা ভিন্ন মেসেজ বিদেশে পৌঁছে দিতে পারে। সাধারণত বিদেশে দেখেছি দূতাবাস এলাকায় সাধারণ চলাচল নিয়ন্ত্রিত। গুলশান-বারিধারায় তা নেই। তাই অবিলম্বে এই এলাকায় জনসাধারণের অবাধ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত হোক। এই এলাকার ভেতর দিয়ে প্রচুর কর্মজীবী মানুষ বাড্ডা তথা কুড়িল এলাকায় নিত্য যাতায়াত করেন। ওদের জন্য বিকল্প যাতায়াতের পথ বের করা জরুরি। যেহেতু দূতাবাস এলাকা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, সে কারণে গুলশান এলাকা থেকে অবিলম্বে সব ধরনের রেস্টুরেন্ট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হোক। না হলে এই এলাকা ঝুঁকির মুখে থাকবে। আমাদের পুলিশ প্রশাসন তাভেল্লা সিজারের হত্যাকাণ্ডকে সিরিয়াসলি নেয়নি। নিলে হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটত না। সাত. যারা জঙ্গিবাদ নিয়ে দেশে ও বিদেশে কাজ করেন, তারা জানেন আইএস এই রমজান মাসে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলার হুমকি দিয়েছিল। এই হুমকির বাস্তবায়ন হয়েছিল আফগান-আমেরিকান এক নাগরিক কর্তৃক ওরল্যান্ডে সমকামী ক্লাবে ৪১ জনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। তারপর ঘটল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে হামলা। যতদূর জানি বাংলাদেশে আইএস হামলা চালাতে পারে, এরকম একটি হুমকি দিয়েছিল আইএস। কিন্তু আমাদের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কি এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না? তারা কি এটা মনিটর করেননি? প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তাদের কাজ কী? যারা এই ফোর্সের নেতৃত্বে রয়েছেন, তাদের ভূমিকা নিয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করে, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমি বারবার বলে আসছি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ফোর্সের কর্মকাণ্ড শুধু জঙ্গি তৎপরতা মনিটরিং, তথা জঙ্গি নির্মূলে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এই ফোর্সকে আরও শক্তিশালী, তথা যুগোপযোগী করার জন্য এই ফোর্সে সেনা কমান্ডোদের পদায়ন করাও জরুরি। প্রয়োজনে সিভিলিয়ান বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী ঘটনার পর সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা ভেবে দেখতে পারেন। আট. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এই হামলা পূর্বপরিকল্পিত। যদি তাই হয়, তাহলে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে সরকার এই পরিকল্পনারোধে কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? দেশে তো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলছে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, ১২ হাজারের ওপর মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের একটা বড় অংশ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শেষ হওয়ার আগেই হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। ফলে এই হত্যাকাণ্ডে পুরো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতাকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলল। নয়. এই হত্যাকাণ্ড যেসব জঙ্গি অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৫ জনকেই পুলিশ খুঁজছিল বলে দাবি করেছেন আইজিপি। পুলিশের লিস্টে তাদের নাম ছিল বলেও তার দাবি। এদিকে সাইট ইন্টেলিজেন্স ৫ জন জঙ্গির ছবি নামসহ প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র সেই ছবি ছেপেছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখন উচিত হবে এ ব্যাপারে একটি ব্যাখ্যা দেয়া। পুলিশ সূত্র থেকে কয়েকটি নাম দেয়া হয়েছে। ডাকনাম। কিন্তু পূর্ণ পরিচয়, পারিবারিক ইতিহাস জানা দরকার। সাইট ইন্টেলিজেন্স যে ছবি ব্যবহার করেছে, তাতে দেখা যায় জঙ্গিরা অস্ত্র হাতে, পেছনে আইএসের পতাকা ও মনোগ্রাম নিয়ে ছবি তুলেছে। সম্ভবত এটা এমন হতে পারে যে জঙ্গিরা সিরিয়া গিয়েছিল এবং সিরিয়া থেকেই তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থান করে কোনো জঙ্গি এ কাজে অংশ নেয়নি বলে আমার ধারণা। তবে এটা বলা যেতে পারে জঙ্গিরা প্রশিক্ষিত ছিল এবং তারা দীর্ঘদিন ধরে ‘র্যাকি’ করেই তাদের টার্গেট নির্ধারণ করেছিল। বিতর্ক এড়াতে তাই একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা জরুরি। দশ. হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। নিরাপদ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক সময় বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের এই ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বড় ধরনের ‘ক্ষতির’ সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ। বিদেশীরা বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে। ২৫ বিলিয়ন ডলারের যে তৈরি পোশাক শিল্প, তাতে অনিশ্চয়তা আসতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা যেটা জেনেছি তা হচ্ছে- অনেক পুরনো ক্রেতা নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশে আসতে তাদের অপারগতার কথা জানিয়েছেন। নতুন করে অর্ডারও দিচ্ছেন না। ফলে তৈরি পোশাক নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলই। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিএনএন দীর্ঘ সময় ধরে সম্প্রচার করেছে, তা এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে এখানে। মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে এক সময় পরিচিত ছিল এই দেশটি। এখন একটা আশংকার জন্ম হয়েছে যে দেশটিকে সোমালিয়া কিংবা নাইজেরিয়ার কাতারে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। বাংলাদেশে স্বীকৃত আইএস নেই। কিন্তু জেএমবি কিংবা এবিটির মতো জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। হরকাতুল জিহাদ-ই-ইসলামী-বাংলাদেশ (হুজিবি) যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্বীকৃত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের (২০০৮) তালিকায় রয়েছে। এ তালিকায় এখন আরও বেশক’টি সংগঠনের নাম যুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশীদের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি ট্রাম্প নাটকীয়ভাবে বিজয়ী হন, তাহলে বাংলাদেশীরা বিপদে পড়তে পারেন। এ ঘটনায় অনেকেরই সঙ্গে আমি কথা বলেছি। দেখেছি, তারা আতংকে রয়েছেন। এখন বাংলাদেশের ইমেজ থাকল একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। হলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী হামলা শেষ ঘটনা নয় বলেই আমার ধারণা। সাধারণত সন্ত্রাসীরা প্রতিশোধ নেয়। ফলে কমান্ডো হামলায় ৬ জন জঙ্গি নিহত হওয়ায় জঙ্গিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হতে হবে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক কারখানায় নজরদারি বাড়াতে হবে। যেন কোনো শৈথিল্য না থাকে। জঙ্গিদের হত্যা করে কিছু জিম্মিকে আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি বটে, কিন্তু বেশ ক’জন বিদেশীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। রাতে উদ্ধার অভিযান চালানো যেত কিনা, এটা নিয়ে এখন বিতর্ক করার সময় নয়। এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে দুটি বড় দল যদি পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করে, তা সুযোগ তৈরি করে দেবে জঙ্গিদের। খালেদা জিয়ার উচিত হবে সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। আর সরকার প্রধানেরও উচিত হবে জঙ্গি দমনে বিএনপির সহযোগিতা চাওয়া। এই সহযোগিতা যদি তিনি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে তা হবে তার বড় ‘রাজনৈতিক বিজয়’। অতীত ঘেঁটে আক্রমণাত্মক বক্তব্য শুধু তিক্ততাই বাড়াবে। হলি আর্টিজানের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর একটি সদূরপ্রসারী প্রভাব আছে, আমরা যেন এ কথাটা ভুলে না যাই। Daily Jugantor 04.07.2016
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment