রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বি এন পির রোডমার্চ ও ভবিষ্যত রাজনীতি

বি এন পির রোডমার্চ ও ভবিষ্যত রাজনীতি

সংসদে আলোচনা ছাড়া ট্রানজিট নয়। দৈনিক ডেসটিনির সাথে বিশেষ সাক্ষাতকারে ড. তারেক শামসুর রেহমান।

সরকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে বহুল আলোচিত ট্রানজিট নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের বিভ্রান্তি। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান দৈনিক ডেসটিনির সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন।
ডেসটিনি : বাংলাদেশের আখাউড়া দিয়ে কয়েক চালান ট্রানজিট পণ্য ভারতে গেছে। প্রথমে পরীক্ষামূলক বলা হলেও এখন সরাসরি ট্রানজিট পণ্য যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য পরিষ্কার যে, ট্রানজিট নিয়ে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলক বলা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে সরাসরি ট্রানজিট দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হল কোনোরকম হিসাব-নিকাশ না করে, পরিবেশগত ও শুল্কের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে সরকার কেন ট্রানজিট দিচ্ছে? জনগণকে অন্ধকারে রেখে সরকার এই ট্রানজিট কেন দিচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছি না। সরকার ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের সঙ্গে অন্য কোনো শর্ত যুক্ত করেছে কি না এ বিষয়ে সন্দেহ দেখা যাচ্ছে। ট্রানজিটকে বহুমাত্রিক যোগাযোগের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করার কথা থাকলেও সরকার ভুটান ও নেপালের ট্রানজিট কার্যকর না করে কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা ও লিখিত চুক্তি ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিটের সুযোগ করে দিল। এটা একপক্ষীয় ট্রানজিট হয়েছে। ভারত তার সুবিধার জন্য এ কাজটি অতি সূক্ষ্মভাবে বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে। এ ট্রানজিট আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। কেননা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিকে উপেক্ষা করে ভারত ওই ট্রানজিট নিয়েছে। পররাষ্ট্র নীতির আওতায় শুল্ক নির্ধারণ, পরিবেশগত বিষয় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো আলোচনা ও চুক্তি হয়নি।
এই ট্রানজিটের ফলে ভারতের ৪২ চাকার পণ্য পরিবহনের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এর জন্য নতুন করে রাস্তা তৈরি করতে হচ্ছে, অনেক খাল ভরাট করে দেওয়া হয়েছে ফলে পানির স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ট্রানজিট নিয়ে জনমনে সংশয় ও সন্দেহ বাড়ছে। মানুষের মনে ভারত বিরোধিতার জন্ম হয়েছে, যার প্রভাবে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। ট্রানজিট নিয়ে সরকারের উচিত ছিল জাতীয় সংসদে আলোচনা করা। জাতীয় সংসদকে পাশ কাটিয়ে ট্রানজিট দেওয়া ঠিক হবে না। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে স্পর্শকাতর বিষয়টি সুরাহা হওয়া উচিত।
ডেসটিনি : সরকারের তরফে প্রথমে বলা হয়েছে এটা পরীক্ষামূলক। এরপর ফি নির্ধারণ করা হবে। এখন বলা হচ্ছে ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী পণ্য যাচ্ছে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ভারত যদি ট্রানজিটের দাবি করে থাকে তবে ৪০ বছর পরে এসে কেন তারা এ দাবি করছে? এতদিনে কেন তারা ট্রানজিট নিয়ে কোনো কথা উচ্চারণ করল না? কেন এতদিন পরে এসে ভারত ট্রানজিটের সুযোগ নিতে চায়? এতদিন দাবি না জানিয়ে যখনই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসেছে তখনই অতি দ্রুততার সঙ্গে ট্রানজিটের বিষয়টি নিয়ে ভারত উঠেপড়ে লাগল। এখন আমাদের বুঝতে হবে এর মধ্যে ভারতের কোনো দুরভিসন্ধিমূলক বিষয় রয়েছে, নতুন কোনো চক্রান্ত রয়েছে এই ট্রানজিটের মধ্যে। ভারতের উদ্দেশ্য যে সৎ নয় তা পরিষ্কার।
সত্যিকার অর্থে ১৯৭২ সালের নৌ প্রটোকল অনুষায়ী যদি ওই ট্রানজিট দেওয়া হয়ে থাকে তবে সরকারের উচিত অতি দ্রুত তা সংসদে উপস্থাপন করা। জাতিকে জানানো উচিত যে আসলে ৭২ সালের চুক্তিতে কী ছিল?
ট্রানজিট নিয়ে একধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা করে ট্রানজিট আদায় করা কোনো যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। আমি মনে করি, স্পর্শকাতর এই বিষয়টি জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ট্রানজিট। সে কারণে ট্রানজিট নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা প্রয়োজন। আমি দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি ট্রানজিট নিয়ে মহাজোটের শরিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারাও স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে_ এটা মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ অথচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বাদ রেখেই সরকারের দুজন উপদেষ্টা এ কাজটি করেছেন। আর এর মধ্যদিয়ে আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও মন্ত্রী প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমনকি ট্রানজিট নিয়ে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও উল্লেখ নেই।
ডেসটিনি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশের সফরের সময় তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণে ট্রানজিট দেওয়া হয়নি বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে ট্রানজিটের মাধ্যমে পণ্য যাচ্ছে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : এটা পরিষ্কার যে, ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট আদায় করে নেওয়া। ওই সময় তিস্তা চুক্তির কথা বলে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিকে আড়াল করার পলিসি নিয়েছিল ভারত। এটা ছিল ট্রানজিট আদায়ের ক্ষেত্রে ভারতের একটি ভাঁওতাবাজি; কেননা ভারতের নীতিনির্ধারকরা জানত তিস্তা চুক্তি নিয়ে আদৌ কিছু হবে না। মূলত জনগণের দৃষ্টি তিস্তার দিকে ধাবিত করে ট্রানজিট আদায় করার একটি কৌশল করেছিল ভারত এবং এতে তারা সফল হয়েছে।
ডেসটিনি : অনেকে বলেছেন এভাবে পণ্য যেতে থাকলে ভারতীয় পণ্যের জন্য উল্টো আমাদের ভর্তুকি দিতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে ভারতীয় পণ্য সরবরাহ কার স্বার্থে?

ড. তারেক শামসুর রেহমান : ট্রানজিট লিখিত বা অলিখিত যাই হোক_ এই ট্রানজিট বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ভারসাম্য আরও বাড়াবে, কেননা ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং ওই পণ্যের দাম বাংলাদেশের পণ্যের চেয়ে কম হবে। প্রাণ ও স্কয়ারের যেসব পণ্য এখন ভারতে যাচ্ছে তার অর্ডার কমে যাবে। এতে করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে।
ডেসটিনি : বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার বলেছেন ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ফি দিয়েই পণ্য যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়নি। যদি ফি পেয়ে থাকে, আর এটি যদি সত্যি হয় এ ব্যাপারে সরকার জনগণকে পরিষ্কার করে জানাচ্ছে না কেন?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : আমি এ বিষয় নিয়ে কনফিউজড। ট্রানজিট নিয়ে ৭২ সালে চুক্তিতে কী আছে, কতটুকু আছে তা স্পষ্ট নয়। সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে। যদি ধরে নেওয়া হয় ৭২ সালের চুক্তি ঠিক, তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ওই চুক্তি ঠিক কি না তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
ডেসটিনি : বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে ভারতের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য পরিবহনকে ট্রানজিট বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে?
ড. তারেক শামসুর রেহমান : এটাকে আমি ট্রান্সশিপমেন্ট বলব।
ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে এবং জনগণের মধ্যে একধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ট্রানজিট রয়েছে, বাংলাদেশেও ট্রানজিন হতে পারে তবে তা অবশ্যই জনমতকে উপেক্ষা করে নয়। এর জন্য জনমত নেওয়া প্রয়োজন, কেননা জনগণের স্বার্থের সঙ্গে এটা জড়িত। স্বচ্ছতার খাতিরে সরকারের উচিত ট্রানজিটের পুরো বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করা।

ইতিহাস গাদ্দাফিকে কীভাবে স্মরণ করবে?


লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে ইতিহাস এখন গাদ্দাফিকে কীভাবে স্মরণ করবে? একজন ডিক্টেটর হিসেবে, নাকি তৃতীয় বিশ্বের একজন 'বন্ধু' হিসেবে? গাদ্দাফির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তাকে হত্যা করা হয়েছে জাতিসংঘ বলছে, এই হত্যাকা-ের তদন্ত করতে হবে পশ্চিমা সংবাদপত্রে যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় সিরতে, তার নিজ শহরে তাকে জীবিত অবস্থাতেই 'ধরা' হয়েছিল তারপর তাকে হত্যা করা হয় এই হত্যাকা- নিয়েও রহস্য আছে শোনা যাচ্ছে পরস্পরবিরোধী কথা কিন্তু যেটা লক্ষ্য করার বিষয়, তা হচ্ছে তার এই মৃত্যুতে সারা লিবিয়াতেই এক ধরনের উল্লাস যদিও পরিস্থিতি গাদ্দাফির অনুকূলে নয় ফলে গাদ্দাফির মৃত্যুতে যে উল্লাস হবে, সেটাই স্বাভাবিক তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, দীর্ঘ ৪২ বছরের শাসনামলে গাদ্দাফি কী লিবিয়ার জন্য কিছুই করেননি? লিবিয়ার সম্পদ তেলকে ব্যবহার করে তিনি লিবিয়াকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন; কিন্তু মানুষের মাঝে অসন্তোষ, অসমতা দূর করতে পারেননি তিনি তিনি যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিলেন (জনগণের রাষ্ট্র), তার ফল জনগণ পায়নি তার সন্তানেরা অনেক ক্ষমতা ভোগ করতেন তার তথাকথিত 'জনগণের রাষ্ট্র' এ জনগণের তেমন কোনো অংশগ্রহণ ছিল না তিনি সব সময় বলতেন জনগণ তাকে ভালোবাসে; কিন্তু সেই জনগণ তার পক্ষে এসে দাঁড়ায়নি বিদ্রোহী বাহিনীকে তিনি বলতেন 'ইঁদুর' আর সেই 'ইঁদুর'দের হাতেই তার মৃত্যু হল

তিনি আফ্রিকার অনেক দেশকেই সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু চরম দুঃসময়ে কোনো দেশই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এমনকি তাঁকে কেউ আশ্রয় দিতেও চায়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে এই পরিণতিই বহন করতে হল। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই অনেকেই সন্দিহান। দেশটি ঐক্যবদ্ধ থাকবে কি-না, সেটাও একটা প্রশ্ন। গেল নভেম্বরে তিউনেসিয়ায় গ্র্যাজুয়েট ফল বিক্রেতা বত্তকুজিজির নিজের শরীরে আগুন লাগানোর মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বে যে পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন, তাতে সর্বশেষ সংযোজিত হল লিবিয়ার নাম। তিউনেসিয়ার বেন আলি, মিসরের হোসনি মুবারক, আর লিবিয়ার গাদ্দাফি এখন ইতিহাসের অংশ। তবে পার্থক্যটা হল বেন আলি ও হোসনি মুবারক বেঁচে আছেন। দু'দেশেই তাদের দুর্নীতির বিচার হচ্ছে। আর গাদ্দাফি বেঁচে নেই। আর মিলটা হলো গণতন্ত্র এখানে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এখন গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়ার রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে কি-না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটিও সহজ হবে না। কেননা লিবিয়ায় একটি সংবিধান প্রণয়ন, কোনো ধরনের সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে এবং দল ব্যবস্থা প্রবর্তন করার ব্যাপারে অন্তবর্তী জাতীয় কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রয়োজন, যা খুব সহজ নয়। উপরন্তু কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে পারে। অস্ত্র উদ্ধার করা হবে একটি বড় কাজ। এই অস্ত্র ইতিমধ্যে আল-কায়েদার হাতে পেঁৗছে গেছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। ইসলামিক জঙ্গিরা গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে পারে। এরা গাদ্দাফি উৎখাতে অংশ নিয়েছে। বিশেষ করে ওংষধসরপ ঋরমযঃরহম এৎড়ঁঢ় কিংবা অনফবষ ঐধশরস ইবষযধফল এৎড়ঁঢ়-এর ভূমিকা লক্ষ্য রাখার মতো। গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। গোত্র ও উপজাতীয়ভাবে লিবিয়া বিভক্ত। এ ক্ষেত্রে গাদ্দাফির নিজস্ব গোত্র প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠতে পারে। জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ বেকার। আর ৪০ ভাগ হচ্ছে তরুণ সমাজ। এরা একটি ফ্যাক্টর। এদের চাকরিতে নিয়োজিত করা হবে নতুন সরকারের প্রধান কাজ। গাদ্দাফি উৎখাতের ঘটনায় পশ্চিমাদের প্রভাব লিবিয়াতে বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের জবনঁরষফরহম অসবৎরপধহ উবভবহংব ংঃৎধঃবমু তে লিবিয়া একটি বড় ভূমিকা পালন করবে আগামী দিনে। লিবিয়া হচ্ছে আফ্রিকার 'গেটওয়ে'। লিবিয়া যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর শাদ, নাইজার এবং তিউনেশিয়া ও আলজেরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। শাদ ও নাইজারে রয়েছে প্রচুর তেল ও ইউরেনিয়াম। ইউরোপ লিবিয়ার তেলের ওপর ৮৫ ভাগ নির্ভরশীল। বিশ্বের তেল রিজার্ভের ৩৫ ভাগ (৬০ বিলিয়ন ব্যারেল) রয়েছে লিবিয়ায়। লিবিয়ার গ্যাস এৎববংঃৎবধস চরঢ়বষরহব-এর মাধ্যমে যায় ইতালিতে। সুতরাং লিবিয়ার তেল ও গ্যাস আগামীতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। তেল ও গ্যাস বিক্রির পয়সায় এখন লিবিয়ার পুনর্গঠন হবে, আর ইরাকের মতো এ কাজ পাবে আমেরিকান কোম্পানিগুলো। লিবিয়ায় অব্যাহত ন্যাটোর বোমা বর্ষণ, গাদ্দাফিকে হত্যা একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সরকার পরিবর্তনে (যাদের যুক্তরাষ্ট্র মিত্র মনে করে না) এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা শক্তিগুলো। সিরিয়া ও ইরানে ন্যাটোর বিমান হামলার সম্ভাবনা এখন বাড়ল। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে (সরকার উৎখাতের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না) যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেবে। যুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে বুশের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (২০০৮) ওবামার কোনো পার্থক্য থাকল না এখন। এভাবে একটি স্বাধীন দেশে ন্যাটোর বিমান বহর দিয়ে হামলা, আন্তর্জাতিক আইনে অনুমোদন করে না। লিবিয়া যুদ্ধ শুরু করার জন্য ওবামা নিজেও আজ যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত। কেননা প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। যুদ্ধ শুরু করার অধিকার কংগ্রেসের। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানও 'আগ্রাসী যুদ্ধের' বিরুদ্ধে। ১৯২৮ সালের কবষষড়মম-ইৎরধহফ চধপঃ ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কোনো যুদ্ধের অনুমোদন দেয় না। জাতিসংঘের সনদে যেখানে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ওবামা লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছেন। অথচ শান্তির জন্য ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। গাদ্দাফি যদি মানবতার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ধিৎ ঞৎরনঁহধষ-এ তার বিচার হতে পারত। এখন লিবিয়াতে ন্যাটোর বিমান হামলা চালানোর অনুমতি দিয়ে এবং ঘধঃরড়হধষ ঞৎধহংরঃরড়হধষ ঈড়ঁহপরষ কে ক্ষমতা দখল করার সুযোগ করে দিয়ে ওবামা আজ নিজেই অপরাধী হলেন। লিবিয়ার পর সিরিয়া ও ইরান এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। এ দেশ দুটিতে যে কোনো সময় হামলা হতে পারে। আসলে ওবামার জন্য যুদ্ধটা দরকার ছিল। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দূরবস্থার মুখে 'যুদ্ধ অর্থনীতি' ওবামাকে একটি 'রাজনৈতিক জীবন' দিতে পারে।
গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি 'ইতিহাসের' অবসান ঘটল। গাদ্দাফি জীবদ্দশায় নিন্দা যেমনি কুঁড়িয়েছেন, তেমনি প্রশংসিতও হয়েছেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ তাকে বন্ধু মনে করত। যে ক'জন ব্যক্তি আন্তর্জাতিক আসরে উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে কথা বলতেন, গাদ্দাফি ছিলেন তাদের একজন। তার মৃত্যু নিঃসন্দেহে একজন 'বন্ধুকে' হারাল তৃতীয় বিশ্ব। তার এই মৃত্যু কাম্য ছিল না। তিনি যদি আগে সংস্কারটা শুরু করতেন, তাহলে তার পতন এভাবে হত না। তবে লিবিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে গেল। তার মৃত্যু সেসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেবে না।
আগামী আট মাসের মধ্যে একটি নির্বাচনের কথা বলেছেন এনটিসির অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল। তিনি জানিয়েছেন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে একটি জাতীয় পরিষদ গঠন করা হবে, যারা দেশটির জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে; কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে না। ইতিমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে লিবিয়া আরেকটি সোমালিয়া অথবা আফগানিস্তানে পরিণত হতে পারে। এ ধারণা একেবারে অমূলক নয়। গৃহযুদ্ধের সুযোগে সোমালিয়া পরিণত হয়েছে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে। রাষ্ট্র এখন নিয়ন্ত্রণ করে আল-শাবাব নামে একটি জঙ্গি গোষ্ঠী। এখানে একটি সরকার আছে বটে; কিন্তু তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। আর আফগানিস্তানের ইতিহাস তো আমরা মোটমুটি সবাই জানি। আফগান যুদ্ধের সম্প্রতি ১০ বছর পার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ সেখানে কোন সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। বরং সেখানে একটি বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং আগের চেয়েও তালেবানরা এখন আরও অনেক শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজলেও, সেই পথ তারা পাচ্ছে না। যদিও ২০১৪ সালের মধ্যে সেখান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলেছেন ওবামা। এখন আগামী দিনগুলোই বলবে ওবামার কথার সত্যতা কতটুকু।
গত ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ায় বিমান আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র 'তৃতীয় যুদ্ধ' শুরু করেছিল। গাদ্দাফিকে হত্যা করার পর ন্যাটো তাদের অপারেশন বন্ধ ঘোষণা করেছে সত্য, কিন্তু এই 'যুদ্ধ' এখনই শেষ হবে না। 'যুদ্ধ' প্রলম্বিত হবে। আর গাদ্দাফির হত্যাকা- তাকে যদি ইতিহাসে একজন খলনায়ক থেকে নায়কে পরিণত করে, আমি অবাক হব না।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com


অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন

মধ্যপ্রাচ্যে 'আরব বসন্ত' যেমনি সারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, ঠিক তেমনি নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্র্রিটবিরোধী আন্দোলন এখন সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে এক শহর থেকে অন্য শহরে। সম্প্রতি ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে এই আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে লেগেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের অর্থলিপ্সা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটে অবস্থিত করপোরেট হাউসগুলো এখন দুর্নীতির এক একটি প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন দিকে দিকে খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন এই করপোরেট হাউসগুলো মুনাফার পাহাড় গড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের আক্রোশটা সেখানেই। কায়রোর তেহরির স্কয়ারের মতো বিক্ষোভকারীরা নিউইয়র্কের ম্যানহাটান এলাকায় অবস্থিত জুকোটি পার্কটি দখল করে নিয়েছিল। সেখানে তারা অবস্থান ধর্মঘট করে আসছিল দিনের পর দিন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নওরিল রুবিনি অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনকে তুলনা করেছেন একটি \'বিপ্লবের\' সঙ্গে। নিউইয়র্কে ওয়ালস্ট্রিটবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ ও যুদ্ধের বাজেট কমাতে যে আন্দোলন চলছে তার সঙ্গে। বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধ বন্ধের এই আন্দোলনকে নামকরণ করেছে ঙপঃড়নবৎ ২০১১.ড়ৎম সড়াবসবহঃ. বিক্ষোভকারীদের দাবি, যুদ্ধের জন্য যে বিশাল বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, তা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।
অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট কিংবা ঙপঃড়নবৎ ২০১১.ড়ৎম সড়াবসবহঃ এমনি এমনি হয়েছে, এটা মনে করা ঠিক হবে না। গত এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। সেখানে প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন গরিব। দেশটির ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষ এখন বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, শতকরা হারে যা ১৫ দশমিক ১। ২০০৯ সালে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবার আফ্রো-আমেরিকানদের এবং হিস্পানিকদের সংখ্যা বেশি। এই হার ২৭ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের গত ৫২ বছরের ইতিহাসে এই হার সর্বোচ্চ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান না করে, তাদের নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ রয়েছে, যাদের \'হেলথ ইন্সু্যুরেন্স\' নেই। স্বাস্থ্যসেবার বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধের খরচ মেটাতে কর দেয়। ওবামা প্রশাসনের যুদ্ধের জন্য বাজেট প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের পেছনে খরচ ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার)। অথচ এর একটা অংশ দিয়ে নতুন চাকরির সংস্থান করা যায়, স্বাস্থ্যবীমার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের নজর এদিকে নেই। যুদ্ধ তাদের দরকার। যুদ্ধ প্রলম্বিত করে করপোরেট হাউসগুলো মুনাফা লুটছে। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। সুতরাং আজ যে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন গড়ে উঠছে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্রেই গবেষণা হচ্ছে যুদ্ধের খরচ যদি কমানো যায়, তাহলে ওই অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে কী কী পরিবর্তন আনা সম্ভব। পেন্টাগনের হিসাব মতে, প্রতি মাসে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, যার ৩ ভাগের ২ ভাগ খরচ হয় আফগানিস্তানে। পেন্টাগন ইরাক ও আফগানিস্তানে গত ৪০ মাসে খরচ করেছে ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা কি-না বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্যবীমা খাতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে গত ১০ বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সেনাদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি তেল (আফগানিস্তানে) বাবদ (অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১১ পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তেল সরবরাহ ও জনশক্তির খরচ হিসাব করা হতো, তাহলে প্রতি গ্যালন তেলের মূল্য গিয়ে দাঁড়াত ১০০ ডলারে। প্রতি বছর আফগানিস্তানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে (সেনাসদস্যদের জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ছিল ৫ লাখ ৭ হাজার ডলার (বছরে)। ২০১০ সালে এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ডলারে। আর ২০১১ সালের হিসাব ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ডলার। এটা কংগ্রেসনাল রিপোর্ট। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ইরাকে ২০০৭ সালে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য বছরে খরচ ছিল ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার, ২০১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২ হাজার ডলারে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আফগানিস্তানে যুদ্ধের খরচের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ১১৩ বিলিয়ন ডলার। ইরাকের জন্য বরাদ্দ ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এখন ওবামা প্রশাসনকে যুদ্ধের জন্য যদি অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে না হতো, তাহলে এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ১. ৫৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন শিশুর (নিম্নআয়ের পরিবারের) স্বাস্থ্যসেবা; ২. ২৩ মিলিয়ন নিম্নআয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা; ৩. ২০২ মিলিয়ন ছাত্রের বৃত্তি; ৪. ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা ও ৫. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ১৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সুতরাং আজকে ওয়াশিংটনে কিংবা নিউইয়র্কে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার পেছনের কারণগুলো কী, তা সহজেই অনুমেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও, ওবামা যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং তিনি লিবিয়ায় নতুন একটি \'ফ্রন্ট ওপেন\' করেছেন। লিবিয়ায় যে যুদ্ধের সূচনা তিনি করেছিলেন তাঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে। লিবিয়ার পর এখন সম্ভাব্য টার্গেট হচ্ছে সিরিয়া ও ইরান। সুতরাং আগামীতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর সঙ্গত কারণেই যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হলে সামাজিক খাতে আরও কাটছাঁট করতে হবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বয়োজ্যেষ্ঠ আর শিশুরা। তাদের স্বাস্থ্য সুবিধা আরও সীমিত হবে। যুদ্ধের কারণে সমাজের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুবিধাভোগী একটি অংশ বরং এতে উপকৃতই হচ্ছে। ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে করপোরেট হাউসগুলো আরও ধনী হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনিকশ্রেণী, যাদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ, তারা দেশটির মোট সম্পদের ৩৩ শতাংশের মালিক। সুতরাং করপোরেট হাউসগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আজ নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে শত শত তরুণ সমবেত হয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করল, তার সঙ্গে কায়রোর তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের বেশ মিল পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহার করে মিসরের তরুণ সমাজ একটি বিপ্লবের সূচনা করেছিল। পতন ঘটেছিল হোসনি মোবারকের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও তরুণরা এই সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করছে। তবে পার্থক্যটা এখানেই যে, এতে করে ওবামা প্রশাসনের পতন ঘটবে না। তবে ওবামা প্রশাসন নিশ্চয়ই এটা থেকে কিছু শিখবে। ২০১২ সালে সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন কোনো প্রভাব ফেলবে না, তা বলা যাবে না। আরও একটা কথা, সারাবিশ্বই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে রোমে, লন্ডনে, অকল্যান্ডে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট রাষ্ট্রটিকে একটি \'ব্যর্থ রাষ্ট্রে\' পরিণত করেছে। ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো এখন অনেকটা অকার্যকর। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। এখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সমস্যার সমাধানে কী উদ্যোগ নেন, সেটাই দেখার বিষয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com

গাদ্দাফির মৃত্যু ও পরবর্তী রাজনীতি

শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন গাদ্দাফি। দীর্ঘ আট মাস বিদ্রোহী বাহিনীর আগ্রাসন তিনি ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না। বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করল। কিন্তু এখন কেমন হবে গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ার রাজনীতি? প্রেসিডেন্ট ওবামা লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু সেই কাজটি কি খুব সহজ হবে? তবে বলতে দ্বিধা নেই, যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটোর বিমান হামলা লিবিয়ায় সরকার পরিবর্তনের ঘটনায় একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এখন সরকার পরিবর্তনে (যাদের যুক্তরাষ্ট্র মিত্র মনে করে না) এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে পশ্চিমা শক্তিগুলো। লিবিয়ায় গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের পতন ঘটতে পারত অন্যভাবে। বিশেষ করে মিসর কিংবা তিউনিসিয়ায় যেভাবে গণ-অভ্যুত্থান হোসনি মুবারক ও বেন আলীর পতন ঘটিয়েছিল, ঠিক সেভাবে গণ-অভ্যুত্থানে পতন ঘটতে পারত গাদ্দাফির। তেমনটি হয়নি। একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গাদ্দাফির উৎখাত ও মৃত্যু ঘটল। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাতে সরকার পরিবর্তনের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। বলা হয়েছিল 'মানবিক হস্তক্ষেপ'-এর কথা। আর তথাকথিত 'মানবিক হস্তক্ষেপ'-এর নামে ন্যাটোর বিমানবহর শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা শক্তির এই ভূমিকা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক আসরে বিতর্ক বাড়াবে। কেমন হবে এখন লিবিয়া?
প্রথমত, সেখানে গণতন্ত্র উত্তরণের পথটি খুব সহজ হবে না। কেননা গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের শাসনামলে সেখানে কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। সেখানে কোনো সংবিধান ছিল না। একটি দেশ সংবিধান ছাড়া কিভাবে চলতে পারে, লিবিয়া ছিল এর বড় উদাহরণ। গাদ্দাফি নিজে দেশটির প্রেসিডেন্টও ছিলেন না। তাঁকে অভিহিত করা হতো নেতা হিসেবে। একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বটে; কিন্তু গাদ্দাফিই ছিলেন মূল ব্যক্তি। তাঁর নামে দেশটি চালিত হতো। গাদ্দাফির ভাষায়, লিবিয়া ছিল 'জনগণের রাষ্ট্র'। 'পিপলস কংগ্রেস' এক ধরনের সংসদ হিসেবে কাজ করত, যার মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিলেন গাদ্দাফি। তাঁর রচিত 'গ্রিন বুক'ই ছিল লিবিয়ার তথাকথিত সংবিধান। ওই গ্রিন বুকে লিপিবদ্ধ ছিল লিবিয়ার সরকার কিভাবে পরিচালিত হবে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লিবিয়ায় একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। লিবিয়া এখন প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে, নাকি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা সেখানে প্রবর্তন করা হবে-এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারব্যবস্থা সেখানে প্রবর্তন করা হয়, তাহলে আরেকজন স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, মুস্তাফা আবদেল জলিলের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন সেখানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং গাদ্দাফি-পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে থাকবে। অতীতে আবদেল জলিল গাদ্দাফির বিচারমন্ত্রী ছিলেন। পক্ষ ত্যাগ করে তিনি বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেন। কিন্তু জিবরিল যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে সেখানেই বসবাস করতেন। সম্ভবত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জলিলের চেয়ে জিবরিল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের খুব কাছের ব্যক্তি হবেন। তৃতীয়ত, যুদ্ধের কারণে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে চলে গেছে। গাদ্দাফি নিজেও অস্ত্রভাণ্ডার খুলে দিয়েছিলেন। ন্যাটোর বিমান থেকেও বিদ্রোহীদের জন্য অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। এসব অস্ত্রের হদিস পাওয়া খুব কঠিন হবে। বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে ওইসব অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে। এই অস্ত্র আল-কায়েদার কাছে পেঁৗছে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ফলে গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় অস্ত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করবে, যা গণতন্ত্রের উত্তরণে কোনো সাহায্য করবে না। চতুর্থত, গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় ইসলামী জঙ্গিরা অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। বেশ কয়েকটি জঙ্গি গ্রুপের খবর পাওয়া যায়, যারা গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। যেমন_-বলা যেতে পারে Islamic Fighting Group (IFG), Abu Ubaidah bin Jamuah Brigade, Abdel Hakim Belhadj Group, Tripoli Military Council wKsev Salafi Group-এর কথা। এদের কারো কারো সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ রয়েছে বলেও ধরে নেওয়া হয়। একসময় IFG-কে পশ্চিমা শক্তি সমর্থন করেছিল। ১৯৯৬ সালে গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনে IFG-কে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী দাঁড়ায়, সেটা দেখার বিষয়। পঞ্চমত, গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থাপনা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা-যা লিবিয়ায় নেই। এখানে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এখন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সদস্যরা একাধিক দলের জন্ম দিতে পারেন এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। ষষ্ঠ, লিবিয়ায় বেকার সমস্যা প্রকট। জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ বেকার। লিবিয়ায় বিশাল তেলের রিজার্ভ থাকলেও, তেলনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। লিবিয়ার জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ হচ্ছে তরুণ। এদের মূল ধারায় নিয়ে আসা, চাকরির ব্যবস্থা করা হবে কঠিন কাজ। না হলে চিরস্থায়ী একটি অস্থিতিশীলতা থাকবেই। সপ্তম, লিবিয়া গোত্রকেন্দ্রিকভাবে বিভক্ত। গোত্রের লোকজন একত্রিত হয়ে মরুভূমি তথা পাহাড়ের নিচে বসবাস করেন। তাঁরা আধুনিকমনস্ক নন। গাদ্দাফি যে গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা গাদ্দাফির মৃত্যুকে সহজভাবে নেবেন না। ফলে এক ধরনের বিরোধিতা থেকেই যাবে। উপরন্তু দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বিরোধের জন্ম হয়েছে। তেলকূপগুলো পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চল থেকে। অষ্টম, গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রভাব বাড়বে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর আগ্রহ মূলত লিবিয়ার তেল ও গ্যাসের কারণে। বিশ্বের রিজার্ভের ৩৫ শতাংশ তেল রয়েছে লিবিয়ায়, যার পরিমাণ ৬০ মিলিয়ন ব্যারেল। গ্যাস রিজার্ভ রয়েছে এক হাজার ৫০০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। যুদ্ধের আগে প্রতিদিন তেল উত্তোলিত হতো ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ব্যারেল। ভূমধ্যসাগরের নিচ দিয়ে পাইপের সাহায্যে এই গ্যাস যায় ইতালিতে (Green-stream Pipeline)। লিবিয়ার অভ্যন্তরে মাত্র এক ডলারে এক ব্যারেল তেল পাওয়া যেত। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি তেলের মূল্য ১০০ ডলার। সুতরাং আন্তর্জাতিক তেল কম্পানিগুলোর স্বার্থটা কোথায়, তা সহজেই অনুমেয়। লিবিয়ার পুনর্গঠনের নামে তখন লিবিয়ায় ব্যবসা খুঁজছে মার্কিন কম্পানিগুলো। আর লিবিয়া সরকারকে তেল বিক্রি করে (অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে) পুনর্গঠনের বিল পরিশোধ করতে হবে। ঠিক যেমনটি হয়েছে ইরাকে। নবম, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিতে লিবিয়ার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেন্টাগন Rebuilding American Defense শীর্ষক যে দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, তাতে লিবিয়া একটি ফ্যাক্টর। লিবিয়ার প্রশাসনকে যদি হাতে রাখা যায়, তাহলে উত্তর আফ্রিকা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। লিবিয়া নিয়ন্ত্রণে এলে পার্শ্ববর্তী শাদ ও নাইজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। শাদ ও নাইজারে রয়েছে তেল ও ইউরেনিয়াম, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই প্রয়োজন। একুশ শতকে যে নতুন অফ্রিকার জন্ম হতে যাচ্ছে, সেখানে ফ্রাঞ্চ ভাষাভাষী অঞ্চলে কর্তৃত্ব বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের। কঙ্গো, রুয়ান্ডা, আইভরি কোস্ট ছিল একসময় ফ্রান্সের কলোনি। ফরাসি ভাষা এখানে সরকারি ভাষা। এ অঞ্চলে তখন বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। ইতিমধ্যেই আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নতুন একটি মিলিটারি কমান্ড AFRICOM। এ জন্য লিবিয়ায় 'বন্ধুপ্রতিম' সরকারের খুব প্রয়োজন ছিল। গাদ্দাফির মৃত্যু এই হিসাবটা সহজ করে দিল। দশম, লিবিয়ার ঘটনাবলি দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রের সরকারকে উৎখাত করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র রাখে। তবে অবশ্যই সেই সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দের হতে হবে। অতীতে গাদ্দাফিকে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ইরাকে সাদ্দামের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় গাদ্দাফিকে চলে যেতে হলো। এভাবে একটি স্বাধীন দেশে ন্যাটোর বিমানবহর দিয়ে হামলা কোনো আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু করার জন্য ওবামা নিজেও আজ যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত। কেননা প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না। যুদ্ধ শুরু করার অধিকার কংগ্রেসের। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানও আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে। ১৯২৮ সালের Kellogg-Briand Pact ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কোনো যুদ্ধের অনুমোদন দেয় না। জাতিসংঘের সনদে যেখানে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ওবামা লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছেন। অথচ শান্তির জন্য ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। গাদ্দাফি যদি মানবতার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে International War Tribunal-এ তাঁর বিচার হতে পারত। এখন লিবিয়ায় ন্যাটোর বিমান হামলা চালানোর অনুমতি দিয়ে এবং National Transitional Council-কে ক্ষমতা দখল করার সুযোগ করে দিয়ে ওবামা আজ নিজেই অপরাধী হলেন। লিবিয়ার পর সিরিয়া ও ইরান এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। এ দেশ দুটিতে যেকোনো সময় হামলা হতে পারে। আসলে ওবামার জন্য যুদ্ধটা দরকার ছিল। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার মুখে 'যুদ্ধ অর্থনীতি' ওবামাকে একটি 'রাজনৈতিক জীবন' দিতে পারে।
গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি 'ইতিহাসের' অবসান ঘটল। গাদ্দাফি জীবদ্দশায় নিন্দা যেমন কুড়িয়েছেন, তেমনি প্রশংসিতও হয়েছেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ তাঁকে বন্ধু মনে করত। যে কয়জন ব্যক্তি আন্তর্জাতিক আসরে উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে কথা বলতেন, গাদ্দাফি ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁর মৃত্যু নিঃসন্দেহে একজন 'বন্ধুকে' হারাল তৃতীয় বিশ্ব। তাঁর এই মৃত্যু কাম্য ছিল না। তিনি যদি আগে সংস্কারটা শুরু করতেন, তাহলে তাঁর পতন এভাবে হতো না। তবে লিবিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে গেল। তাঁর মৃত্যু সেই সব প্রশ্নের কোনো জবাব দেবে না।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 

গাদ্দাফি-পরবর্তী রাজনীতি

গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ার রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটিও সহজ হবে না। কেননা লিবিয়ায় একটি সংবিধান প্রণয়ন, সরকার ব্যবস্থা নির্ধারণ এবং দল ব্যবস্থা প্রবর্তন করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী জাতীয় কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রয়োজন, যা খুব সহজ কাজ নয়। উপরন্তু কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে পারেন। অস্ত্র উদ্ধার করা হবে একটি বড় কাজ। এই অস্ত্র ইতিমধ্যে আল কায়দার হাতে পৌঁছে গেছে বলে অনেকে আশংকা করছেন। ইসলামিক জঙ্গিরা গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে পারে। এরা গাদ্দাফি উৎখাতে অংশ নিয়েছে। বিশেষ করে Islamic Fighting ‡roup wKsev Abdel Hakim Belhadj ‡roup-এর ভূমিকা লক্ষ্য রাখার মতো। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। গোত্র ও উপজাতীয়ভাবে লিবিয়া বিভক্ত। এ ক্ষেত্রে গাদ্দাফির নিজস্ব গোত্র প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে।
জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ বেকার। আর ৪০ ভাগ হচ্ছে তরুণ সমাজ। এরা একটি ফ্যাক্টর। এদের চাকরিতে নিয়োজিত করা হবে নতুন সরকারের প্রধান কাজ। গাদ্দাফি উৎখাতের ঘটনায় পশ্চিমাদের প্রভাব লিবিয়ায় বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের জবনঁরষফরহম অসবৎরপধহ উবভবহংব ঝঃৎধঃবমু-তে লিবিয়া একটি বড় ভূমিকা পালন করবে আগামী দিনে।
লিবিয়া হচ্ছে আফ্রিকার ‘গেটওয়ে’। লিবিয়াকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, চাদ, নাইজার, তিউনেসিয়া ও আলজেরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। চাদ ও নাইজারে রয়েছে প্রচুর তেল ও ইউরেনিয়াম। ইউরোপ লিবিয়ার তেলের ওপর ৮৫ ভাগ নির্ভরশীল। বিশ্বের তেল রিজার্ভের ৩৫ ভাগ (৬০ মিলিয়ন ব্যারেল) রয়েছে লিবিয়ায়। লিবিয়ার গ্যাস reestream Pipeline-এর মাধ্যমে যায় ইতালিতে। সুতরাং লিবিয়ার তেল ও গ্যাস আগামীতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। তেল ও গ্যাস বিক্রির পয়সায় এখন লিবিয়ার পুনর্গঠন হবে, আর ইরাকের মতো এ কাজ পাবে আমেরিকান কোম্পানিগুলো।
লিবিয়ায় অব্যাহত ন্যাটোর বোমাবর্ষণ, গাদ্দাফিকে হত্যা একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সরকার পরিবর্তনে (যাদের যুক্তরাষ্ট্র মিত্র মনে করে না) এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা শক্তিগুলো। সিরিয়া ও ইরানে ন্যাটোর বিমান হামলার আশংকা এখন বাড়ল। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে (সরকার উৎখাতের কোন সিদ্ধান্ত ছিল না) যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা উন্নয়নশীল বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের জš§ দেবে। যুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে বুশের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (২০০৮) ওবামার কোন পার্থক্য থাকল না এখন।  
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 

পরীক্ষামূলক ট্রানজিট বিষয়ক বিশেষ সাক্ষাতকারে অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান


পরীক্ষামূলক ট্রান্সশিপমেন্টের নামে বিনা ফিতে দ্বিতীয় চালানের প্রথম দফায় যেসব পণ্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গেল। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইন লংঘিত হওয়ার পাশপাশি বাংলাদেশ তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কোন ফি নির্ধারণ হওয়ার আগেই এভাবে ৪২ চাকাবিশিষ্ট ভারতীয় ট্রেইলারে পণ্য পরিবহনের ঘটনা দেশবাসীর মনে নানা প্রশ্নের জবাব দেবে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতের জোরজবরদস্তিমূলক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে আমি মনে করি। এতে সরকারের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। ৪২ চাকাবিশিষ্ট বিশালাকার ও ভারি ট্রেইলারের চলাচলে ওই এলাকার রাস্তাঘাট ও পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি এটা স্থানীয় যানবাহনসমূহের চলাচলের ক্ষেত্রেও তৈরি করছে মারাত্বক প্রতিবন্ধকতা। উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা কিভাবে করা হবে তা বিবেচনায় এনে আগেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত ছিল।
ট্রান্সশিপমেন্টের কাজে নিয়োজিত ভারতীয় যানবাহন চলাচলের ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা কিভাবে পুষিয়ে নেয়া হবে, সেটি এখন পর্যন্ত নির্ধারিত হয়নি। ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে ইতিমধ্যে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারও কোন সুস্পষ্ট জবাব সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে এ আলোচনা সামনে রেখে বিরোধী দলের সংসদে যাওয়া অপরিহার্য বলে মনে করি আমি।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূল সাক্ষাতকার পর্বটি পাবেন এখানে

বিএনপির রোডমার্চ সরকারকে কি কোনো বার্তা দিয়েছে?

বিএনপির প্রথম রোডমার্চ শেষ হয়েছে গত ১১ অক্টোবর। প্রথম রোডমার্চ ঢাকা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে সিলেটে। সেখানে খালেদা জিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। প্রায় তিন হাজার গাড়ির বহর নিয়ে এই রোডমার্চের নেতৃত্ব দেন খালেদা জিয়া। দ্বিতীয় আরেকটি রোডমার্চ শুরু হয়েছে গতকাল, যা আজ শেষ হবে। এবার দ্বিতীয় রোডমার্চটি গেল রাজশাহীতে। এই রোডমার্চে সরকার কিংবা সরকার সমর্থকরা কোনো বাধা দেয়নি। এটা একটা ভালো দিক। রোডমার্চ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অংশ। বিরোধী দল সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে এই রোডমার্চের আয়োজন করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা এখন আলোচিত বিষয়। দুর্নীতির বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। পদ্মা সেতু শুরু করার আগেই প্রশ্ন তুলেছে দাতারা। বিশ্বব্যাংক এ খাতে অর্থসাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে যে নষ্ট করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ। মধ্যস্বত্বভোগীরা এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সরাসরি সরকারি দলের লোক না হলেও সরকারি দলের নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধভাবে প্রভাব খাটাচ্ছে। চাঁদা তুলছে। যে কারণে সবজির বাজার এখন চড়া। কিন্তু প্রশাসন এদের নিয়ন্ত্রণ করছে না, অথবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সংসার চালাতে মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন কর্তা যখন ব্যর্থ, তখন দাবি উঠেছে মহার্ঘ ভাতা প্রদানের। বৈদেশিক বাণিজ্যে কোনো আশার খবর নেই। বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে মারাত্মকভাবে। সারা বিশ্বে যেখানে ডলারের মান কমে গেছে, সেখানে আমাদের দেশে বাড়ছে ডলারের দাম। গেল সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, রপ্তানিতে আয় কমেছে ৩৯ শতাংশ। ইউরোপজুড়ে মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে শুরু করেছে। রপ্তানি কমছে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে অনেকেই। ইতিমধ্যে অর্ডার না পাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সাড়ে তিন হাজার ওভেন ও নিট গার্মেন্টস। গেল সেপ্টেম্বরে (২০১১) রপ্তানি আয় হয়েছে ১৪৪৭ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় ১০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকার সমান। এই পরিমাণ অর্থ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) রপ্তানি আয় হয়েছিল ২৩৩৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় ১৭ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার সমান। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আয় কমেছে প্রায় ছয় হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ কম। এমনি এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি লংমার্চ সম্পন্ন করল। খালেদা জিয়া জানিয়ে দিয়েছেন যে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আর ঘরে ফিরে যাবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার, বিএনপি এখন সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে যাচ্ছে। যদিও পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০১৩ সালের শেষের দিকে।
বিএনপি যেসব এজেন্ডা সামনে রেখে রোডমার্চের আয়োজন করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা। পাঁচ দফা সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আওতায় নির্বাচন পরিচালনা করার কোনো সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের একটি রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে হলে সরকারকে নতুন করে সংসদে একটি বিল আনতে হবে। এটা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে নামকরণ করতে হবে, তার কোনো মানে নেই। কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। হতে পারে এটি একটি নির্দলীয় সরকার। এই নির্দলীয় সরকারে কারা থাকবেন, তা সংসদ ঠিক করে দিতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই এই নির্দলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। বর্তমান প্রধান বিচারপতি তাঁর দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। বিকল্প হিসেবে ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে এই দায়িত্বটি দেওয়া যেতে পারে। তিনজন গুণী ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি টিমও গঠন করা যেতে পারে, যাদের দায়িত্ব হবে শুধু একটি নির্বাচন পরিচালনা করা। তবে মূল কথা হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধী দলের সম্মতি না পেলে কোনো প্রস্তাবই জট খুলবে না। এ জন্য একটি সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। সরকারের মন্ত্রীরা বারবার বিএনপিকে সংসদে আনার ও সেখানে গিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে অতীতে বিরোধী দলকে সংসদে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। সংসদে গালাগাল ও অতীত বারবার টেনে আনা হয়েছে। বিচারাধীন মামলা নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সরকার এখন যে কাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে নিজেদের উদ্যোগে একটি নির্দলীয় সরকারের কাঠামো সংসদে উপস্থাপন করা ও তা পাস করানো। মহাজোটের শরিকরাও পারে এ ধরনের একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে। বিএনপি ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে পারে অথবা তাতে সংশোধনী আনতে পারে। এর মাধ্যমে সরকার তার আন্তরিকতা প্রমাণ করতে পারে। সরকার যদি এ ধরনের কোনো প্রস্তাব না আনে, তাহলে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে। ১৯৯৬ সালেও বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। কিন্তু ওই সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পাস হয়েছিল। এখন দেয়ালের লিখন থেকে সরকার কি কিছু শিখবে?
সরকার যদি নমনীয় হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গল। পত্রপত্রিকায় যেসব জনমত প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়, একটি নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত সবচেয়ে বেশি। সরকার যদি একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, আমার বিশ্বাস তাতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে বৈ কমবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শিখি না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে তা হবে আমাদের জন্য দুঃখজনক একটি সংবাদ। সিপিডির আলোচনায় ইতিমধ্যে মন্তব্য করা হয়েছে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর সিপিডির আলোচনা সভায় যিনি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, তিনি এ দেশের একজন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। অধ্যাপক রওনক জাহান যখন এ ধরনের একটি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন, তখন তাকে গুরুত্ব দিতে হয় বৈকি! যারা এ দেশের গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে গবেষণা করেন, তারা এটা স্বীকার করবেন যে ওই মন্তব্যের পেছনে কোনো মিথ্যা নেই। এমনকি একটা সত্য কথাও স্বীকার করেছেন ডেপুটি স্পিকার ওই অনুষ্ঠানে। তিনি বলেছেন, সংসদ সদস্যরা জাতীয় নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বক্তব্য দেন না, প্রস্তাবও রাখেন না, এমনকি কোনো প্রশ্নও উত্থাপন করেন না (সকালের খবর, ১৪ অক্টোবর)। মিথ্যা বলেননি তিনি। দেশের অর্থনীতি যখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে, যখন রপ্তানি আয় কমছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ কমছে_তখন আমাদের করণীয় কী, এ বিষয়টি নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করেন না। সাধারণ জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে বাদ দিয়ে আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী যখন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় না। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি যখন ভারতমুখী, এটা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা আমি শুনিনি। তাই ডেপুটি স্পিকারের বক্তব্যকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। গুরুত্ব দিতে চাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্যকে, যখন তিনি বলেন আমরা সবাই মিলে সংসদকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হয়েছি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি জানেন ও বোঝেন সংসদ কেন কাজ করছে না। আজ সংসদকে শক্তিশালী করার কথা বলা হলেও অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের সুখের নয়। আজ মন্ত্রীরা যখন বিএনপিকে সংসদে এসে নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করার আহ্বান জানান, তখন এটা একটা ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়। কেননা অতীতেও বিএনপিকে হেনস্তা করা হয়েছে। বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নিতে হবে। তাদের আস্থায় নিতে হবে। শুনতে হবে তাদের কথা। এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। বিএনপির রোডমার্চ একটা মেসেজ পেঁৗছে দিয়েছে সরকারকে_আর তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ছাড়া পরবর্তী সংসদ নির্বাচন নয়। দুই পক্ষের মাঝে একটা সংলাপ হওয়া উচিত। সংলাপ ছাড়া সংকট সমাধানের কোনো বিকল্প নেই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 
 

আফগান যুদ্ধের এক দশক

আফগান যুদ্ধের এক দশক পার হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এ যুদ্ধের শেষ কোথায়। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে দেশটি দখল করে নিয়েছিল। সেই থেকে আজও সেখানে যুদ্ধ চলছে। তবে অতি সম্প্রতি এই অঞ্চলে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যা আগামী দিনের আফগান রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন এক. আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আফগানিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে আফগান পিস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বুরহানউদ্দীন রব্বানি। অভিযোগ করা হয়েছে, এই হত্যার সঙ্গে হাক্কানি নেটওয়ার্ক জড়িত, যাদের পরিচালনা করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এই হত্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তালেবানদের সঙ্গে সব ধরনের আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছে কারজাই সরকার। দুই. কারজাই সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন। তার ওই সফরে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি নিরাপত্তা ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় ভারত আফগান নিরাপত্তারক্ষীদের প্রশিক্ষণ দেবে। আফগানিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনাও এখন বাড়ছে। তিন. লাদেনকে পাকিস্তানে আশ্রয় ও পরবর্তী সময়ে হাক্কানি নেটওয়ার্ককে সহযোগিতা করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি। সম্পর্কের এই অবনতি এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
বিশ্বব্যাপী 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এর অংশ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধ পরিচালনা করছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যয় হয়েছে (৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। কারও কারও মতে, ৬ ট্রিলিয়ন ডলার), তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ব্যয় হয়েছিল তার চেয়েও বেশি। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষে আনতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে জনসমর্থন পায়নি। একসময় আফগানরা তালেবান শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আজ সেই তালেবানদের পেছনেই জনসমর্থন বাড়ছে। প্রায় দশ হাজার আফগান নাগরিক এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সঙ্গত কারণেই প্রেসিডেন্ট ওবামার ওপর এক ধরনের চাপ আছে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়ার। ২০১৪ সালকে তিনি টার্গেট করেছেন সেনা প্রত্যাহারের। কিন্তু পরিপূর্ণ সেনা প্রত্যাহার আদৌ হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। কেননা যুক্তরাষ্ট্র কখনও চাইবে না আফগানিস্তানে আবার তালেবানরা ফিরে আসুক। তালেবানদের ফিরে আসার অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত করা। মধ্য এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থকে যুক্তরাষ্ট্র জলাঞ্জলি দিতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এর যে সূচনা করেছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের হিসাবে খরচের পরিমাণ ৩ দর্শমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। পেন্টাগনের হিসাব মতে, প্রতি মাসে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার (যার মাঝে ৩ ভাগের ২ ভাগ খরচ হয় আফগানিস্তানে)। প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ও ড্রোন বিমান হামলা চালাতে এই খরচ হয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রকে মহাশূন্যে একটি শাটল মহাকাশযান পাঠাতে খরচ হয়েছিল ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। পেন্টাগন ইরাক ও আফগানিস্তানে গত ৪০ মাসে খরচ করেছে ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা কি না বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্য বীমা খাতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে গত ১০ বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সেনাদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি তেল (আফগানিস্তান) বাবদ (অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১১) যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তেল সরবরাহ ও জনশক্তির খরচ হিসাব করা হত, তাহলে প্রতি গ্যালন তেলের মূল্য গিয়ে দাঁড়াত ১০০ ডলারে। প্রতি বছর সেখানে, অর্থাৎ আফগানিস্তানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে (শুধু সেনাদের জন্য), যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ছিল ৫০৭০০০ ডলার (বছরে)। ২০১০ সালে এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৬৭০০০ ডলারে। আর ২০১১ সালে এই খরচ গিয়ে দাঁড়াবে ৬৯৪০০০ ডলারে। এটা কংগ্রেসনাল রিপোর্ট। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরাকে ২০০৭ সালে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য বছরে খরচ ছিল ৫১০০০০ ডলার, আর ২০১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮০২০০০ ডলারে। ২০১১ সালে কংগ্রেস আফগানিস্তানে যুদ্ধের খরচের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ১১৩ বিলিয়ন ডলার। ইরাকের জন্য বরাদ্দ ৪৬ বিলিয়ন (২০১২ সালের জন্য বরাদ্দ কিছুটা কমেছে ১০৭ বিলিয়ন ও ১১ বিলিয়ন ডলার)। বলা ভালো ইরাক থেকে 'ক্যামবেট ট্রুপস', অর্থাৎ যুদ্ধরত সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য রয়ে গেছে, যারা শুধু প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে ওবামা ঘোষণা করেছেন ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। (ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য দেখুন গপপষধঃপযু ঘবংিঢ়ধঢ়বৎ এর প্রতিবেদন ১৫ আগস্ট, ২০১১)।
যুক্তরাষ্ট্র 'যুদ্ধ' চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যায় করছে, তা দিয়ে সামাজিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারত। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে (১১৩ বিলিয়ন, ২০১১-১২), সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে (ক) ৫৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন শিশুর (নিম্ন আয়ের পরিবারের) স্বাস্থ্যসেবা, (খ) ২৩ মিলিয়ন নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, (গ) ২০২ মিলিয়ন ছাত্রের বৃত্তি, (ঘ) ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা, (ঙ) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সেই সঙ্গে প্রাথমিক স্কুলে ১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন স্কুল শিক্ষক, ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন পুলিশ অফিসার ও ৬৭ দশমিক ৮ মিলিয়ন অর্থ দিয়ে সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব।
প্রশ্ন এসে যায় আর কতদিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পেছনে এত বিপুল অর্থ ব্যয় করবে? ওবামা শান্তিবাদী নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন। নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, তিনি যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু দেখা গেল, যে শক্তি সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল, তারাই ওবামাকে পরিচালনা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট হাউস, সমরাস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শক্তি প্রেসিডেন্ট ওবামাকে পরিচালনা করছে। ওবামা ওদের ওপর নির্ভরশীলও। অধ্যাপক মিসেল চসুডোভস্কি (গরপযবষ ঈযড়ংঁফড়াংশু) তার একাধিক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কীভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই উপকৃত হয়েছে ও তার নিজ স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। আল কায়দা তথা ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল ১৯৭৯ সালে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল ওসামা বিন লাদেনকে। আজ সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত 'যুদ্ধ' শুরু করলেও, অধ্যাপক পিটার ডেল স্কট দেখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে, যেখানে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি, সেখানে আল-কায়েদাকে ব্যবহার করেছিল 
(দেখুন, Lyb, Prof. Peter Dale Scott, US-Al-Qaeda&_s Alliance; Bosnia, Kosovo & Now Libya-Washington &_s on goning collusion with Terrorist, alobal research, 29.7.11)| । আর অধ্যাপক চসুডোভস্কি তো সরাসরিই মন্তব্য করেছেন, Zyalleged jihadi plotters were the product of us state terrorism। দশ বছর আগে নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ওই ঘটনা নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ ও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রায় সবগুলোই একতরফাভাবে লিখিত। প্রবন্ধগুলোতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- পরিচালনার জন্য অভিযোগ আনা হয়েছে। তবুও এর মাঝেও দু'একজন বিশ্লেষককে দেখা গেছে যারা ওই ঘটনার জন্য মার্কিনি আগ্রাসী শক্তিকে দোষ চাপিয়েছেন। নোয়াস চমস্কি এদের মাঝে অন্যতম। চমস্কির বাইরে যারা বিভিন্ন জার্নালে অধ্যাপক স্টেফেন জুনেস (Prof. Stephen Zunes, University of Sanfrancisco ), অধ্যাপক ম্যারি এলেন ও কনেল (Prof. Marry Ellen O&_ Connell, Notre Dame ), অধ্যাপক মিসেল হাস (Prof. Michael Haas) , অধ্যাপক রর্বাট ফারলের (Prof. robert Farley) লেখা পাঠ করেছেন, তারা দেখেছেন এরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রকে একটি আগ্রাসী শক্তি হিসেবে দেখেছেন। এরা বলার চেষ্টা করেছেন একটি 'বিশেষ উদ্দেশ্য'কে সামনে রেখেই 'নাইন-ইলেভেন'কে সংগঠিত করা হয়েছিল। অধ্যাপক হাস ২০০৯ সালে লিখিত তার গ্রন্থে (George W. Bush : War Criminal?) সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুরু করার জন্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বিচার দাবি করেছিলেন। তিনি ৫টি কারণ উল্লেখ করেছিলেন, যার কারণে বুশকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা যায়। ইতিমধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট রব্বানির হত্যাকা-ের পর কারজাই তলেবানদের সঙ্গে আলোচনা বাতিল ঘোষণা করেছেন। রব্বানির মৃত্যুর সঙ্গে হাক্কানি নেটওয়ার্ক জড়িত, এই অভিযোগ আফগান সরকারের পক্ষ থেকে করা হলেও, হাক্কানি নেটওয়ার্ক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাহলে কারা হত্যা করল রব্বানিকে? রব্বানি ছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত 'শান্তি কমিটির' চেয়ারম্যান। তার মৃত্যুতে শান্তি প্রক্রিয়া এখন বিলম্বিত হবে। রব্বানির মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া হিসেবে কারজাই তালেবানদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা বাতিল করার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা এক ভুল 'সিগনাল' পেঁৗছে দিতে পারে। তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতা ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তালেবানদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সেখানকার প্রশাসনিক কর্মকা- তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাবুলে তালেবানরা কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
এ ধরনের একটি সমঝোতা নিয়ে প্রাথমিক পর্যায় আলোচনা হয়েছিল। এখন কারজাইয়ের নয়া উদ্যোগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে। আফগান-ভারত নিরাপত্তা চুক্তি পাকিস্তানের জন্য তেমন কোনো ভালো সংবাদ নয়। পাকিস্তান এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। সন্ত্রাসবাদ আজ পাকিস্তানের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বেলুচিস্তানে রয়েছে বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলন। উপরন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো কোনো মহল থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও, বাস্তবতা হচ্ছে আফগানিস্তানে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। শুধু তালেবানদের সঙ্গে একটি সমঝোতাই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তবে আফগানিস্তান ভারতের সঙ্গে যে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাতে পাকিস্তানের খুশি হওয়ার কথা নয়। এই চুক্তিকে পাকিস্তান কোনো ভালো চোখে দেখবে না। এতে করে নতুন করে এ অঞ্চলে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে পারে। পাকিস্তান ও ভারত পরোক্ষভাবে আফগান যুদ্ধে নিজেদের জড়িয়ে ফেলতে পারে। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই চুক্তি আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করবে না। 
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি ভেঙে পড়বে?

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির আলোচনা সভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে ১৩ অক্টোবর। মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা জানেন, এ ধরনের মন্তব্য কোন হালকা মন্তব্য নয়। এ ধরনের মন্তব্যের পেছনে যুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রবর্তিত হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট, যখন সংসদে দ্বাদশ সংশোধনী আইন গৃহীত হয়। বিএনপি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার পক্ষে থাকলেও সংবিধান সংশোধনীতে সেদিন বিএনপি সংসদীয় সরকারব্যবস্থার পক্ষে তার মত দিয়েছিল। সম্ভবত ওই একটি ইস্যুতেই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। এরপর আও কোন ইস্যুতেই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এক হতে পারেনি। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আরও তিনটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যেখানে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হওয়ার কথা, সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি শক্তিশালী তো হয়ইনি, বরং দুটি বড় দলের মাঝে অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গণতন্ত্রের বিকাশকে শক্তিশালী করছে না।
গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে, একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’-এর আবহ তৈরি করা, অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা স্থাপনের নামই হচ্ছে গণতন্ত্র। কিন্তু এর বড় অভাব বাংলাদেশে। যে দলই ক্ষমতায় যায়, বিরোধী দলকে তারা গ্রহণযোগ্যতায় না নিয়ে তাদের ‘শত্র“’ মনে করে। তাদের আচরণও গণতন্ত্রসম্মত নয়। নির্বাচন একটি দল বা গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসায় বটে, কিন্তু নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। যুক্তরাষ্ট্রের Foreign Policy Research Institute এর সিনিয়র ফেলো আদ্রিয়ান এ বাসোরা তাই মন্তব্য করেছেন এভাবে `Regime change does not make democratization a foregone conclusionÕ (FP, 1 October 2005)। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ক্ষমতার পরিবর্তন গণতন্ত্রকে নিশ্চিত করে না। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পর বারবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হয়েছে, তা বলা যাবে না। বরং যে ‘আস্থার রাজনীতি’ আমরা ১৯৯১ সালে লক্ষ্য করেছিলাম, সেই আস্থার রাজনীতিতে ধস নেমেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এক ধরনের ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ দরকার, যাতে করে সরকার অগণতান্ত্রিক আচরণ না করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের Council on Foreign Relations-এর ফেলো জোসেফ সিগলের মতে, ‘ Democratization of some countries has had a more successful developmental outcome, primarily due to institutional accountability, a free press and a system of checks and balances exist between the partiesÕ’।
‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’-এর অভাবেই রাষ্ট্র একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। ইতিহাসে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে এই ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’-এর অভাবটি অত্যন্ত প্রবল। সরকার এককভাবে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। সরকার বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সংসদকে কার্যকর না করা। পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে সংসদ বয়কটের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, বিশ বছর পরও সেই সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল পঞ্চম সংসদে ১১৮ দিন (৯টি অধিবেশনে), সপ্তম সংসদে ১৬৫ দিন (৯টি অধিবেশনে) ও অষ্টম সংসদে ২২৩ দিন (৯টি অধিবেশনে) সংসদ বয়কট করে। নবম সংসদের সংসদ বয়কটের হিসাব-নিকাশ আমরা আরও পরে পাব। তবে সংসদ বয়কট অব্যাহত রয়েছে।
উপরোল্লিখিত তিনটি সংসদেই মারাÍক কোরাম সংকট পরিলক্ষিত হয়। সপ্তম সংসদের নবম অধিবেশনে মোট ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট কোরাম সংকটের কারণে ব্যয় হয়। অষ্টম সংসদে ২২৭ ঘণ্টা অপচয় হয় কোরাম সংকটে, যা সংসদের মোট কার্যকালের এক-পঞ্চমাংশ। এর জন্য আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ২০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা (টিআইবি রিপোর্ট)। এই যে পরিসংখ্যান, এটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কার্যকরী জাতীয় সংসদ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। নির্বাচন হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সংসদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে সংসদকে শক্তিশালী করা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সংসদকে শক্তিশালী করতে পারিনি। সরকারে যারা থাকেন তাদের দায়িত্বটি বেশি। কিন্তু এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। তৃতীয়ত, সংসদ হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা। জাতীয় নীতি এখানে প্রণীত হবে। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে সংসদে ডিবেট হবে। সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিরোধী দল বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করবে। কিন্তু এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যে কারণে সরকারি নীতি হয়ে যাচ্ছে একপক্ষীয়। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তা সংসদে উপস্থাপিত হয় না। আলোচনাও হয় না। সিপিডির অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি স্পিকার। তিনি বলেছেন, সংসদ সদস্যরা জাতীয় নীতি-নির্ধারণ বিষয়ে বক্তব্য দেন না, প্রস্তাবও রাখেন না, এমনকি কোন প্রশ্নও উত্থাপন করেন না।
অতি সম্প্রতি ট্রানজিট ফি ছাড়াই ট্রান্সশিপমেন্টের দ্বিতীয় চালান ত্রিপুরা গেছে। যেখানে এখনও ট্রানজিট ফি নির্ধারিত হয়নি, সেখানে কী করে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হয়? বিষয়টি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অথচ বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ৪২ চাকার যান চলাচলের ফলে বাংলাদেশ যে পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেই ক্ষতি আমরা কীভাবে পূরণ করব, সে ব্যাপারেও কোন ব্যাখ্যা নেই। ইতিমধ্যে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারও কোন সুস্পষ্ট জবাব আমরা পাইনি। অথচ সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। ডেপুটি স্পিকার এটা স্বীকার করলেও সংসদে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার কোন পরিবেশ তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি।
চতুর্থত, সংসদীয় রাজনীতিতে একটি ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ থাকে। এটা সংসদীয় রাজনীতির একটি সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। বর্তমান বিরোধী দলও সংসদে একটি ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন করতে পারেনি। এই ‘ছায়া মন্ত্রিসভায়’ যারা থাকবেন, তারা সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করে বিকল্প একটি নীতি উপস্থাপন করবেন। বাংলাদেশে এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। পঞ্চমত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনিবার্যভাবে দুটি শক্তি। গণতন্ত্র বিনির্মাণে এদের মাঝে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এটি না থাকলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি পেয়েছিল প্রাপ্ত ভোটের ৩০.৮১ ভাগ, আর আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ ভাগ, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট, আর বিএনপি ৩৩.৬১ ভাগ, অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি ৪০.৯৭ ভাগ ভোট, আর আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ ভাগ ভোট। আর সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্তি ৪৮.০৬ ভাগ আর বিএনপি ৩২.৪৫ ভাগ। পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে একটি ‘সমঝোতা’ কেন প্রয়োজন। এই সমঝোতা নেই বিধায় গণতন্ত্র এখানে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
সিপিডির আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হল এমন এক সময় যখন বিরোধী দল সরকার পতনের লক্ষ্যে রোডমার্চ কর্মসূচি শুরু করেছে। এই রোডমার্চ কর্মসূচি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিরই একটি অংশ। সরকারের নানা ব্যর্থতা যখন দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই বিএনপি তথা চারদল সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করল। দুঃখজনক হলেও সত্য, একটি নির্বাচিত সরকার তার টার্ম শেষ করার আগেই বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে পড়ল। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে সরকারের হয়তো পতন ঘটবে না। কিন্তু বিরোধী দল একটি মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে আর তা হচ্ছে বিরোধী দলকে গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে মারাÍকভাবে। গেল সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী রফতানিতে আয় কমেছে ৩৯ ভাগ। ইউরোপজুড়ে মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে শুরু করেছে। রফতানি কমছে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশংকা করছেন অনেকেই। ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে তিন হাজার ওভেন ও নিট গার্মেন্টস। গেল সেপ্টেম্বর মাসে রফতানি আয় হয়েছে ১৪৪৭ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় ১০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকার সমান। এই পরিমাণ অর্থ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। বিশ্বমন্দা কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের একটা মতামত থাকা প্রয়োজন। এমনকি বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করাও জরুরি। সেটি হচ্ছে না। সরকার বিরোধী দলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলÑ এটা মনে করারও কোন কারণ নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর তা গণতন্ত্রের পথযাত্রাকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে।
সিপিডির আলোচনা সভায় যারা প্রবন্ধ পড়েছেন, যারা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, তারা সবাই নামিদামি ব্যক্তি। আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সুতরাং তারা যখন বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, তখন এদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। বিরোধী দলের সহযোগিতা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের যে দাবি উঠেছে, সে ব্যাপারে একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। সংবিধানে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন নেই বটে, কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা সম্ভব। উচ্চ আদালতের রায়ের মাঝেও এই নিরপেক্ষ সরকার গঠনের ইঙ্গিত রয়েছে। শুধু নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। এমনকি এককভাবে (যা হয়তো সরকার পারে) সিইসি তথা অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়াও ঠিক হবে না। তাতে জটিলতা আরও বাড়বে। এ মুহূর্তে যা জরুরি, তা হচ্ছে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং বিরোধী দলের সঙ্গে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা। নির্বাচন হতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। ২০১৩ সালের শেষের দিকে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগেই বেশকিছু ইস্যুতে (নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্দলীয় সরকার কাঠামো) দুটি বড় দলের মাঝে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন। না হলে বাংলাদেশে বিকাশমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে থাকবে। তাই সিপিডির আলোচনায় যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে, এদিকে সরকার যদি দৃষ্টি দেয়, তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গল।
দৈনিক যুগান্তর ১৯ অক্টোবর, ২০১১.
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com