রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা!



একটি 'সর্বদলীয়' মন্ত্রিসভা হয়েছে। এই মন্ত্রিসভায় আছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি। তবে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে 'জাতীয় পার্টি'। ব্যক্তি এরশাদ তার 'শক্তি ইমেজ' নিয়ে কতটুকু চিন্তিত আমি জানি না। কিন্তু তার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত তাকে আরো বিতর্কিত করেছে। পটুয়া কামরুল ইসলাম তাকে নিয়ে এক সময় বিখ্যাত কার্টুন 'বিশ্ব বেহায়া' এঁকেছিলেন। অন লাইন মিডিয়ায় এখন ভরা সেই ছবি। বলা হচ্ছে পটুয়া কামরুল হাসান বেঁচে থাকলে দ্বিতীয় আরেকটি কার্টুন তিনি অাঁকতেন এরশাদকে নিয়ে।
গত এক সপ্তাহে তার বক্তব্যগুলো যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, তিনি বারবার বলে আসছেন তিনি এককভাবে আর নির্বাচন করবেন না, বিএনপি নির্বাচনে না এলে সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না, তিনি 'জাতীয় বেঈমান' হিসেবে পরিচিত হতে চান না ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি হাটহাজারীতে গিয়েছিলেন মওলানা শফীর দোয়া নিতে। এই দোয়া নেয়ার কাহিনী তার আরো আছে। আটরশির পীরের মুরিদ ছিলেন তিনি এক সময়। এখন মওলানা শফীর 'বাজার' ভালো। ছুটে গেলেন সেখানে। দোয়া নিলেন। বললেন 'বড় হুজুর' তাকে দোয়া করেছেন। কিন্তু পরদিনই মওলানা শফীর পক্ষ থেকে বলা হলো হুজুর তাকে আদৌ দোয়া করেননি। এতে এরশাদের কিছু যায় আসে না। 'স্বপ্নে দেখা নামাজ পড়ার' কাহিনী তিনি আমাদের শোনাননি। কিন্তু মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই তার দলের 'লোকজনরা' আবার মন্ত্রী হয়ে গেলেন। একজন হলেন উপদেষ্টা। তিনি যে নিজেকে বারবার হাস্যস্পদ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, এ কথাটা সম্ভবত তিনি মাঝে-মধ্যে ভুলে যান। বিকল্প একটি জোট হতে পারে। কিন্তু তিনি আবারো প্রমাণ করলেন আওয়ামী লীগের প্রভাব বলয়ের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রিক জাতীয় পার্টির রাজনীতি আজকের নয়। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হলে জাতীয় পার্টি সেই সরকারে যোগ দিয়েছিল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রীও হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে মঞ্জুকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেও মঞ্জু তা মানেননি। শেষ পর্যন্ত দলটি ভেঙে গিয়েছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০০৯ সালে, যখন আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে। এবারো এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে মন্ত্রিসভায় পাঠান। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় পার্টির এই ভূমিকা তৃতীয় একটি জোট গঠনে আদৌ সহায়ক কিনা?
জাতীয় পার্টির যে রাজনীতি, তার সাথে বিএনপির রাজনীতিরই 'মিল' বেশি। দুই পার্টির আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্যই গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। প্রথমে জনদল (১৯৮৩) ও পরে জাতীয় পার্টি (১৯৮৬) গঠনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী (১৯ দফা) 'অপর একটি' দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও গত ২৭ বছরে দলটি সঠিক একটি নীতি ও আদর্শের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। ব্যক্তি এরশাদকে কেন্দ্র করে দলটি আবর্তিত হলেও দলটি বাংলাদেশে বিকল্প একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। উত্তরবঙ্গে ব্যক্তি এরশাদের জনপ্রিয়তাই হচ্ছে দলটির মূল শক্তি। তবে বলতেই হবে দুই প্রধান দলের বাইরে নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি। সর্বজন গ্রহণযোগ্য পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) জাতীয় পার্টি ২৭২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (ভোটের হার ১১.৯২)। সপ্তম সংসদে (১৯৯৬) ২৯৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছিল ৩২ (প্রাপ্ত ভোট ১৬.৩৯) ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন ১৪ (প্রতিদ্বন্দ্বিতা ২৮১ আসনে, প্রাপ্ত ভোট ৭.২৫ ভাগ)। এই সময় এরশাদ কিছু ইসলামিক দল নিয়ে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। এবং ফ্রন্ট তার অস্তিত্বও বজায় রাখেনি। আর সর্বশেষ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসন ২৬, আর প্রাপ্ত ভোট ৭.০৫ ভাগ। এখন যে দল মাত্র শতকরা ৭ ভাগ ভোট পায় (যেখানে সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার যথাক্রমে শতকরা ৪৮.০৬ ও ৩২.৪৫ ভাগ) সেখানে ওই দলের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের ভিত্তি কতটুকু শক্তিশালী? যদিও কাজী জাফর বলেছিলেন তারা 'নির্বাচনী জোট' করছেন না, বরং 'আন্দোলনের জোট' করছেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছেন। এখানে প্রশ্ন আছে। কাদের সাথে জোট হচ্ছে? কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা, আসম আবদুর রবের জেএসডি, কিংবা ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম? ওদের গণভিত্তি কী? কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধা। দেশের মানুষ তাকে সম্মান করে। কিন্তু তিনিও বিতর্কের ঊধর্ে্ব নন। এই প্রজন্ম তাকে চেনে না। (২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল পেয়েছিল ০.৪৭ ভাগ ভোট)। গণফোরাম? ড. কামাল হোসেন নামি-দামি ব্যক্তি। কিন্তু তার কোনো গণভিত্তি নেই। তরুণ প্রজন্ম তাকে চেনে না (১৯৯৬ সালে দলের প্রাপ্তভোট ০.১২ ভাগ)। আর জেএসডি? আসম আবদুর রবের দলের প্রাপ্তভোট ০.২৩ ভাগ (১৯৯৬)। এরা মূলত ব্যক্তি সর্বস্ব। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্লিন ইমেজের লোক। মুন্সীগঞ্জের বাইরে তার অবস্থান কোথায়? তার ছেলে মাহি বি চৌধুরী বাবার ইমেজে চলেন। আর মেজর (অব.) মান্নান প্রচুর টাকার মালিক। কিন্তু টাকা দিয়ে কি সবসময় রাজনীতি হয়? এরা সবাই মূলত ব্যক্তিনির্ভর এক একটি দল, যাদের কোনো গণভিত্তি নেই। এদের দিয়ে 'মিডিয়া কভারেজ' হতে পারে, কিন্তু কোনো তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার আদৌ সম্ভাবনা নেই।
বিবিসিকে দেয়া কাজী জাফরের বক্তব্য আর এরশাদের 'সর্বদলীয়' সরকারে যোগ দেয়ার মধ্যে কোনো মিল নেই। জাফর নিজেও অবাক হয়েছেন, যখন তিনি শুনেছেন যে তার দল সরকারে যোগ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিতে যে বিভক্তি তা স্পষ্ট হলো। আসলে সত্যিকার অর্থেই জাতীয় পার্টি কোনো দল হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তি এরশাদই হচ্ছেন মূল ব্যক্তি। 'হামগো ছাওয়াল'-এর যে ইমেজ, সেই ইমেজ তাকে বারবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে। একজন জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসেবে যে ইমেজ, সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা, কমিটমেন্ট লক্ষ্য দরকার, তার তার নেই। তিনি সুযোগ-সন্ধানী, যেখানে সুযোগ পাবেন, সেখানেই যাবেন। বেগম জিয়া এখন অনেকটা বেকায়দায় আছেন। তাই তার কাছে তিনি যাননি। নতুবা বেগম জিয়ার ছত্রচ্ছায়াই তিনি থাকতেন। জাতীয় পার্টি ভেঙে যাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা জাতীয় পার্টিতে যারা আছেন, তারা মূলত 'সুযোগের' অপেক্ষায় থাকেন। যারা মন্ত্রী হলেন, তাদের গণভিত্তি নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা আদৌ নির্বাচিত হতে পারবেন কিনা, আমার সন্দেহ রয়েছে। তারা গণমানুষের জন্য রাজনীতি করেন না, রাজনীতি করেন নিজেদের জন্য। তাই দলের নেতার ভূমিকার ব্যাপারে যতই সোচ্চার হোন না কেন চূড়ান্ত বিচারে তাদের মধ্যে এই সুবিধাবাদী প্রবণতা কাজ করে বেশি। জাতীয় পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দলীয় প্রধানের বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা, তার ব্যক্তিচরিত্র, রাজনীতির প্রতি কোনো কমিটমেন্ট না থাকা, নিজেকে বেঈমান হিসেবে তুলে ধরা_ সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টির সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছে। জাতীয় পার্টির এরশাদের অবর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে বিলীন হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এখন একটি 'সর্বদলীয়' সরকার গঠিত হয়েছে। সংবিধানে এভাবে কোথাও 'সর্বদলীয়' সরকারের ব্যাখ্যা নেই। সরকারপ্রধান সংবিধানের ৫৬(২) ধারা বলে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন, কিন্তু তাকে যে কোনো নামে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু 'সর্বদলীয় সরকার' নামে ডাকা যাবে না। সর্বদলীয় সরকার হতে পারত যদি সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকত। এখন মূলত যাদের মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তাদের গণভিত্তি নেই। যেমন বলা যেতে পারে জাসদের কথা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাসদ ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কওে একটিতে বিজয়ী হয়েছিল। প্রাপ্তভোটের হার ৬ দশমিক ৫২ ভাগ। ১৯৭৯ সালে ২৪০টি আসনে (দ্বিতীয় সংসদ) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮টিতে বিজয়ী হয়েছিল। প্রাপ্তভোটের হার ৪ দশমিক ৮৩ ভাগ। ১৯৮৬ সালে রবের জাসদ পেয়েছিল ৪ দশমিক ৫৪ ভাগ ভোট। ১৯৯১ সালে একটি আসন (১৬১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে) ০.৭৯ ভাগ ভোট। ১৯৯৬ সালে রব জাসদ একটি আসন, প্রাপ্তভোট ০.২৩ ভাগ ভোট। আর ইনু জাসদ কোনো আসন নেই, ০.০২ ভাগ ভোট মাত্র। অথচ এরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ৬৭ ও ৩১টি আসনে। ২০০১ সালে জাসদ ৭৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোনো আসন পায়নি, প্রাপ্তভোট ০.২১ ভাগ। ২০০৮ সালে আসন ৩, প্রাপ্তভোট ০.৭৪ ভাগ। মজার কথা ইনু আর মঈনুদ্দিন বাদলরা 'নৌকা' মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল। ওইসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল না। এবার আসুন ওয়ার্কার্স পার্টির ক্ষেত্রে। ২০০৮ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে মেনন ও বাদশা সাহেব দুটো আসন নিশ্চিত করেছেন, কিন্তু প্রাপ্তভোট মাত্র ০.৩৮ ভাগ। ২০০১ সালে প্রাপ্তভোট (বাম দলগুলোর সঙ্গে) ০.২৫ ভাগ। ১৯৯৬ ও ১৯৯১ সালে প্রাপ্তভোট যথাক্রমে ০.১৩ ভাগ ও ০.১৯ ভাগ। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ সালে ৩টি আসন পেয়েছিল বটে (০.৫৩ ভাগ), কিন্তু ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। জাতীয় পার্টিকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা দেয়া যেতে পারে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রাপ্তভোট গড়ে ৭ শতাংশের উপরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যাদের গণভিত্তি এত দুর্বল, তাদের নিয়ে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্য কিভাবে নিশ্চিত করবেন? একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। সমঝোতা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বললেন সে কথা। সংলাপ, সমঝোতা কিছুই হলো না। বরং বিএনপির ৫ নেতা এখন কারাগারে। বেগম জিয়া দেখা করেছেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা সীমিত। তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি তা করবেনও না। সিদ্ধান্ত এখনো প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কিন্তু বিএনপির দাবি অনুযায়ী একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার তিনি গঠন করবেন, সেটা এখন চিন্তাও করা যায় না। এর অর্থ এখন পরিষ্কার_ একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। যারা মন্ত্রী হলেন, তারা মন্ত্রী থেকেই নির্বাচন করবেন। এখানে প্রশাসন কতটুকু নিরপেক্ষ থাকবে সে প্রশ্ন করাই যায়।
আর সে নির্বাচনে বিএনপি তথা ১৮ দল অংশ নেবে, তা মনে হয় না। ফলে সঙ্কট থেকেই গেল। এখন বিএনপি কী কর্মসূচি নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। বিএনপি যদি লাগাতার কর্মসূচির সিদ্ধান্তও নেয় তাতে করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আটকে রাখা যাবে না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই নির্বাচন হবে এবং একটি সংসদ হবে। হয়তো আমরা সেই পুরনো মুখগুলোকেই দেখতে পাব দশম জাতীয় সংসদে। তবে প্রশ্ন তো থাকলই_ ওই সংসদের মেয়াদ হবে কত দিনের।
Daily Jai Jai Din 25.11.13

বিদেশি মধ্যস্থতা কেন কোনো সমাধান বয়ে আনবে না

বাংলাদেশে এসেছিলেন নিশা দেশাই। জন্মগতভাবে তিনি ভারতীয় নন, মার্কিন নাগরিক। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একজন। তার দায়িত্ব দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়া। তিনি এ দায়িত্বটি নিয়েছেন অতিসম্প্রতি। সঙ্গত কারণেই তিনি বাংলাদেশে আসবেন। কেননা, বাংলাদেশের রাজনীতি, এর গতি-প্রকৃতি, এখানকার সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া তার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে একশ্রেণীর মিডিয়ার অতি উৎসাহ আমি লক্ষ্য করেছি। আকার-ইঙ্গিতে বলা হচ্ছিল, তিনি বোধকরি এক ধরনের মধ্যস্থতা করার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন! এ আশঙ্কা আরও বদ্ধমূল হয়েছে যখন ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণও আমাদের জানালেন, বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।

বাংলাদেশ একটি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এ সঙ্কটে কী বিদেশিরা কোনো সমাধান দিয়ে যেতে পারবে? অতীত ইতিহাস, তা বলে না। স্যার নিনিয়ানের বাংলাদেশ সফরের পর থেকে একাধিকবার সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। আর একাধিকবার আমরা দেখেছি, বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আসছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করছেন। তারা উভয়পক্ষকে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা দৃষ্টিকটু এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। আমাদের সঙ্কট মোকাবিলায় আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা এক সময় পরিপূর্ণভাবে বিদেশিদের ওপর নির্ভর হয়ে যাব। তখন দাতাগোষ্ঠীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে। যে কোনো বিবেচনায় এটা কোনো ভালো খবর নয়। নিশা দেশাই এসেছিলেন। দেখা করলেন দুই নেত্রীর সঙ্গে। এমনকি সাতজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধির সঙ্গেও তিনি কথা বললেন। এরা কারা? জনগণের সঙ্গে এদের সম্পর্ক কতটুকু? এর আগে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসম্পর্কিত পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবট। স্মরণ থাকার কথা, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা বাংলাদেশের বিষয়ে আলোচনার জন্য নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। নয়াদিল্লি থেকেই তিনি উড়ে গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। এখন আবার ঢাকায়। তার ঢাকায় ফিরে আসার পর এলেন নিশা দেশাই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশিদের এ ‘হস্তক্ষেপ’ বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমাদের যে ‘অর্জন’ সেই ‘অর্জন’ নষ্ট হতে চলেছে শুধু একটি সমঝোতার অভাবে। সরকারি দল এরই মধ্যে আগামী নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন তাদের মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। কারা কারা প্রার্থী হতে চাচ্ছেন, তার একটি তালিকাও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ভাবখানা এই, নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে একবার হলেও সংসদে যেতে চাই! সরকারি দল বাদে অন্য কোনো দলের কোনো তৎপরতা নেই। জাতীয় পার্টিও আছে মহাফ্যাসাদে। দল স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত। তৃতীয় একটি ফ্রন্টের ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং কাজী জাফর আহমদ, এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী। টাঙ্গাইলের সখীপুরে এক মঞ্চে বি. চৌধুরী আর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও বক্তৃতা করলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। স্বয়ং কাদের সিদ্দিকীই বললেন, আগে মহাজোট সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে। সমস্যা এখানেই। এরশাদ সব কিছুই বোঝেন। দুই নৌকায় পা রাখতে চান তিনি। বারবার বলে আসছেন মহাজোট থেকে তিনি নির্বাচন করবেন না, আর বিএনপি না গেলে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না। কিন্তু এরশাদ বলে কথা! তিনি কথা রাখতে পারেন না। তিনি সকালে মহাজোট ছেড়ে বিকালে মহাজোট সরকারের সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। তার দল সেখানে পাঁচজন মন্ত্রী ও একজন উপদেষ্টার পদ পেয়েছে। মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে তিনি বিএনপিকেও আহ্বান জানিয়েছেন যোগ দিতে। এই হচ্ছে এরশাদ! যাকে নিয়ে কোন অনুমানই করা দুরূহ নয়, অসম্ভবও বটে।

এটা এখন স্পষ্ট বিদেশি দাতারা যাই বলুক, নিশা দেশাই ঢাকায় এসে যে কথাই বলে যান না কেন, একটি নির্বাচন হবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে। আর বিএনপি তথা ১৮ দল যত কথাই বলুক, তারা ওই নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। নির্বাচন হবে। ১৮ দল নির্বাচন বয়কট করবে। সরকারকে ‘সহযোগিতা’ করার জন্য দল বা লোকের অভাব হবে না।

আমরা ১৯৮৬ সালের পুনরাবৃত্তিই দেখতে পাব আরেকবার। কিন্তু তারপর কী? দেশ কী এভাবেই চলবে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে, যে কোনো ফর্মেই হোক একটি নির্বাচনকালীন সরকার হবে। তবে তা কোনো অবস্থাতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। এ নিয়ে দু’পক্ষের মাঝে আলোচনা হবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। ওই আলোচনায় বিএনপি যোগ দেবে এবং একটি নির্বাচনকালীন সরকারের আওতায় বাংলাদেশে একাদশতম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এর আগে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান কাঠামোয়। প্রধানমন্ত্রী আবারও ‘নির্বাচিত’ হবেন। আর ওই সরকার ক্ষমতায় থাকবে ন্যূনতম দু’বছর। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের এক ধরনের স্থিতিশীলতা দিয়েছিল।

পঞ্চম, ৭ম, ৮ম এবং ৯ম সংসদ নির্বাচন বিতর্কমুক্ত ছিল এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। তখন আমরা আবার সেই পুরনো বৃত্তে ফিরে গেলাম। একপক্ষ কর্তৃক অপরপক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা, ব্যক্তি প্রতিহিংসা, ক্ষমতা ধরে রাখার নানা অপকৌশল, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সহিংসতার আশ্রয়, বাংলাদেশের রাজনীতির এই যে চিত্র, এ চিত্র বদলে দিতে না পারলে এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটির একটি সম্ভাবনা আছে। এখন এ দেশের রাজনীতিবিদদেরই এ সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই, শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমরা চাই, আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের স্থিতিশীলতা উপহার দেবেন। এ জাতি তো বারবার তাদের দিকেই তাকিয়েছে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনটা জরুরি। আর সেই সঙ্গে প্রয়োজন দোষারোপের রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়া। তাহলেই দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। অথচ এরই মধ্যে আমরা ৪২ বছর পার করেছি। সময়টা তো একেবারে কম নয়। একটা জাতি তো এ সময় কম উন্নতি করে না। আমরা মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরের দৃষ্টান্ত দিই। এ দুটি দেশের গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু একটা প্রশ্নে কারও কোনো দ্বিমত নেইÑ আর তা হচ্ছে এ দুই দেশের জাতীয় নেতারা দেশ দুটিকে শুধু এক ধরনের স্থিতিশীলতাই উপহার দেননি, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে দেশ দুটিকে দাঁড় করিয়েছেন।

ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। এক সময় সিঙ্গাপুর ছিল জেলেপাড়া। মাছ শিকার ছিল তাদের পেশা। আর আজ সেই সিঙ্গাপুর কোথায়? আর মালয়েশিয়া? ২০-২৫ বছর আগেও মালয়েশিয়াকে কেউ চিনতো না। আর এখন মালয়েশিয়া উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার এই যে অবদানÑ এটা সম্ভব হয়েছে সে দেশের নেতাদের দূরদর্শিতা, দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, সুশাসন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। লি কুয়ান ইউ কিংবা মাহাথির মোহাম্মদ যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সেখানে বিনির্মাণ করেছিলেন, সেখানে রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন বেশি। সিঙ্গাপুরের নিজস্ব কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। অথচ শুধু ব্যবসা করে, অন্যের সম্পদ ব্যবহার করে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে ও ব্যবহার করে সিঙ্গাপুর আজ একটি উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। সিঙ্গাপুরকে বলা হয় ‘ভার্চুয়াল স্টেট’। শুধু আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করে সিঙ্গাপুর আজ বিশ্বে এক অনন্য স্থান স্থাপন করেছে। সিঙ্গাপুরের রাজনীতিবিদরা শিক্ষিত। স্কুল থেকেই বাচ্চাদের আধুনিক তথা প্রযুক্তিগত শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতি যে বেতন পান, আমেরিকার রাষ্ট্রপতির চেয়ে তা পাঁচগুণ বেশি। সিঙ্গাপুর এটা সম্ভব করেছে। সেখানে দুর্নীতি এক রকম নেই বললেই চলে। আর মালয়েশিয়ার দৃষ্টান্তও এর থেকে পার্থক্য নয়। সুশাসন সেখানে নিশ্চিত হয়েছে। রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তাদের কাছে অন্যতম অগ্রাধিকার। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে উল্টোটি। দুর্নীতি আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে দুর্নীতি ‘খুঁজে’ পাওয়া যাবে না। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতা আজ খুব বেশি। খুব বেশি স্পষ্ট। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের তা-বÑ এসব ‘ঘটনা’ সরকারের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটল, তার ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই দিন না কেন, বিদেশে এ ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি, এ ধরনের বক্তব্য কী সত্যের অপলাপ নয়? যদি আদৌ ‘কিছু’ না হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাংক কেন এত কঠোর হলো, কেন তদন্ত করল, কেনই বা কানাডাতে মামলা হলো? আমরা তা অস্বীকার করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। প্রধানমন্ত্রী তার এক ভাষণে হলমার্ক-ডেসটিনির অনিয়মের কথা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মানুষ প্রত্যাশা করেÑ যারাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। একজন ব্যাংক উপমহাব্যবস্থাপকের পক্ষে হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রভাবশালী যারাই নেপথ্যে থেকে এই ‘কাজটি’ করেছেন, তাদের শাস্তি হোক।

প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই ভারত তথা পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক সমাজের কথা বলেন। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কী এ ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে? ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন এক মন্ত্রীকে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় ফাইন দিতে হয়েছিল। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী তিন-তিনবার) হেলমুট কোহল ঘুষ গ্রহণ করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় দলের কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশে কী এ ধরনের ঘটনা চিন্তা করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, মাগুরা উপনির্বাচনের কথা বলেন। এটা মিথ্যা নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ভোলায় উপনির্বাচনে কী হয়েছিল, তার সাক্ষী সংবাদপত্রগুলো। আসলে ওই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে হবে। আইনের শাসন চালু করতে হবে। দোষী যিনিই হোন, তাকে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। একবার শাস্তি যদি নিশ্চিত করা যায়, আমার বিশ্বাস, দুর্নীতির প্রবণতা কমে যাবে। আর তাই আইনের শাসনটা জরুরি। ভারতে বিচার বিভাগ কম ক্ষমতাসম্পন্ন নয়। বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনের কোনো খবরদারি নেই। সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার মতো দেশে আইনের শাসন আছে বিধায়, দুর্নীতি সেখানে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। তাই বিদেশিদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই। মনে রাখতে হবে, ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সমস্যা সমাধানে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো ‘মডেল’ দিয়ে যেতে পারবে না। আমরা যদি পরস্পরের ওপর আস্থা স্থাপন করি, তাহলে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা কঠিন কিছু নয়। আমাদের মূল সমস্যা, এ মুহূর্তে নির্বাচনকালীন একটি সরকার। এখানে সংবিধান মূল বাধা নয়। মূল বাধা আন্তরিকতা। এই আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বড় দুটো দল বিশেষ করে সরকারি দলের। তাই নিশা দেশাই কিংবা মজিনার ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের যে ঘাটতি, তা কমতে পারে সংলাপের মাধ্যমে। একজন নিশা দেশাই এসেছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। 

Daily ALOKITO BANGLADESH
25.11.13



টিকফা চুক্তি ও বাংলাদেশের স্বার্থ


গত ৩ নভেম্বর কালের কণ্ঠের শেষের পাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে। ওই সংবাদে বলা হয়েছে চলতি মাসেই টিকফা বা Trade and Investment Co-operation Framework Agreement (TICFA) চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাবে। বহুল আলোচিত এই চুক্তিটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হলেও এই চুক্তি নিয়ে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। এমনকি এই চুক্তিটির ব্যাপারে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিরও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকার যখন এ ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়, তখন তা নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এতে করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো উন্নত হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরও টিকফা চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী। সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে টিকফা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করেছে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি আশুলিয়ায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল। ফলে একপর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এখন বাংলাদেশ সরকারের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে যে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলে হয়তো বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি যে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাক জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছিল। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ শতাংশ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনো তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশি পণ্যে, এর মাঝে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা উন্নত রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই, তাহলে এই জিএসপি সুবিধা রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করি, তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলানো যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার ও সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির (প্রস্তাবিত) ৫ ও ১৯ ধারা মতে উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে। ৮ নম্বর ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কিভাবে আরো বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেওয়া। ৯ নম্বর ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে, কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেক। যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে বিশেষ করে সেবা খাতে এবং এসব কম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলি কমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে, শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনা মূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চ শিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে 'সেবা' পেত, তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে ৫ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিকফা চুক্তির ১৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় ৯ শতাংশ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন, বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পাবে। বাংলাদেশকে এখন চাল আমদানি করতে হয় না। কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষি পণ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। মার্কিন বহুজাতিক কম্পানিগুলো, যারা গম ও চাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাদের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। বলা হচ্ছে টিকফা চুক্তি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, অত্যন্ত উচ্চ কর দিয়ে (১৫ দশমিক ৩ ভাগ) বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত করেছে। অথচ চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর দেয় (মাত্র শতকরা ৩ শতাংশ)। অথচ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিকফা চুক্তিও নেই। বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়বে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে। টিকফা চুক্তি কার্যকর হলে এই মেধাস্বত্ব আইনের শক্ত প্রয়োগ হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর, ওষুধ শিল্প ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা। কৃষক আর বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। বহুজাতিক কম্পানিগুলোর কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য করা হবে। বহুজাতিক কম্পানিগুলো একসময় জিম্মি করে ফেলবে আমাদের কৃষি সেক্টরকে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প উন্নয়নশীল দেশে নাম করলেও টিকফা চুক্তির পর এই শিল্প এক ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা, ওষুধ কম্পানিগুলো প্যাটেন্ট কিনে কাঁচামাল আমদানি করে সস্তায় ওষুধ তৈরি করে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এই ওষুধ রপ্তানি হয়। তখন এই টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ কম্পানিগুলোর প্যাটেন্ট ক্রয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগটি রয়েছে। বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে মার্কিন কম্পানির লাইসেন্স কিনতে হবে। ওই লাইসেন্স দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়্যার শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা, এখন স্বল্পমূল্যে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে কম্পিউটার এ দেশেই সংযোজিত হয়। ফলে কম্পিউটারের দাম একটা ক্রয় সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু টিকফা চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে এই ক্লোন কম্পিউটার আমদানি বা সংযোজন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে তখন ব্র্যান্ড কম্পিউটার আমদানি করতে হবে, যার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে অনেক। সাধারণ মানুষের ক্রয় সীমার বাইরে তা চলে যাবে। বাংলাদেশ যে 'ডিজিটাল যুগের' কথা বলছে, তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে তখন।
টিকফা চুক্তি নিয়ে আরো আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। সামনে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন অনেকের মাঝেই যে প্রশ্নটি উঠবে, তা হচ্ছে মার্কিন আস্থা ফিরে পেতেই কী সরকার তড়িঘড়ি করে টিকফা চুক্তিটি করতে যাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা পুনর্বিবেচনা করবে, তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। তাহলে কার স্বার্থে এই চুক্তিটি হতে যাচ্ছে? বিএনপির নীরবতাও আমাদের নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিএনপির নীরবতা কি শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে 'খুশি' করার জন্যই? কোনো চুক্তি যদি জাতীয় স্বার্থে করা হয়, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু কোনো চুক্তি করে আমরা যদি উপকৃত না হই, তাহলে কেন করব আমরা এই চুক্তি? টিকফা চুক্তি তাই অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে, সন্দেহ নেই তাতে।

দোষারোপের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন


প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে এভাবে : স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশে সুষ্ঠুভাবে কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবারই নির্বাচনের সময় কোনও না-কোনও অঘটন ঘটেছে। অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করেছে (সমকাল, ১৫ নভেম্বর)। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, আমরা ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন করি এবং বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে দেশকে পিছিয়ে দেয় (ওই)। এর আগে গত ১৩ নভেম্বর বাগেরহাটে এক নির্বাচনি জনসভায় তিনি বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী দল। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সোজা-সাপটা। তিনি রেখে-ঢেকে কথা বলেন না, যা বলেন তা স্পষ্ট করেই বলেন। সাম্প্রতিক সময়ের তার প্রতিটি বক্তব্যে বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা আছে। এটা কতটুকু যৌক্তিক কিংবা তার বক্তব্যের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, আমি সেই বিতর্কে যাব না। কিন্তু আমার কাছে যা প্রাধান্য তা হচ্ছে আমরা যখন এ মুহূর্তে একটি সমাধান আশা করছি, তখন দোষারোপের এই রাজনীতি সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনও সাহায্য করবে কি না! এদিকে বেগম জিয়াও জানিয়ে দিয়েছেন, নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে তিনি কোনও আপস করবেন না। এর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার। সংকটের গভীরতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না।
এদিকে সরকার জোরেশোরেই নির্বাচনিপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মাঝে একধরনের
নির্বাচনি উত্সব বিরাজ করছে। সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই অনেকের নাম-ধাম ছাপা হচ্ছে, যারা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। অথচ এর বাইরে অন্য কোনও দলের কোনও নির্বাচনি তত্পরতা নেই। সরকার কোনও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এটা আমি বলব না। তবে সংবিধান তার পক্ষে। বর্তমান সংবিধান যে অবস্থায় আছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে অনেক শক্তিশালী করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থান খুব ভালো, এটা আমি বলব না। বাজার উত্তপ্ত। পেঁয়াজের মূল্য কমেনি। চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষক প্রকৃত মূল্য পাচ্ছেন না এ ধরনের অভিযোগ আছে। এটি দেখার ও মনিটরিং করার দায়িত্ব সরকারের। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। এতে সরকারের কৃতিত্ব নেই। এর কৃতিত্ব প্রবাসী বাংলাদেশিদের। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের তাণ্ডব এসব ঘটনা সরকারের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটল তার ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রী যেভাবেই দিন না কেন, বিদেশে এ ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতুতে কোনও দুর্নীতি হয়নি এ ধরনের বক্তব্য কী সত্যের অপলাপ নয়? যদি আদৌ কিছু না হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাংক কেন কঠোর হল, কেন তদন্ত করল, কেনই বা কানাডায় মামলা হল? আমরা তা অস্বীকার করতেই পারি। বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। প্রধানমন্ত্রী তার এক ভাষণে হলমার্ক-ডেসটিনির অনিয়মের কথা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মানুষ প্রত্যাশা করে, যারাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। একজন ব্যাংক উপমহাব্যবস্থাপকের পক্ষে হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রভাবশালী যারাই নেপথ্যে থেকে এ কাজটি করেছেন, তাদের শাস্তি হোক। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বিদেশের গণতান্ত্রিক সমাজের কথা বলেন। কিন্তু ইউরোপের কোনও গণতান্ত্রিক সমাজে কী এ ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারেন? ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন এক মন্ত্রীকে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করায় ফাইন দিতে হয়েছিল। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর (তিনবার প্রধানমন্ত্রী) হেলমুট কোহল ঘুষগ্রহণ করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় দলের কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশে কি এ ধরনের ঘটনা চিন্তা করতে পারি? প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, মাগুরার উপনির্বাচনের কথা বলেন। এটা মিথ্যা নয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ভোলায় উপনির্বাচনে কী হয়েছিল, তার সাক্ষী সংবাদপত্রগুলো। আসলে এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা প্রয়োজন, যা আমরা পারছি না। প্রধানমন্ত্রী অতীতে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে দু-একজনের যোগসাজশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে ওই ব্যক্তিরা যদি সত্যি-সত্যিই জড়িত থাকেন, তাহলে সরকার তাদের গ্রেপ্তার করছে না কেন? একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই রিপোর্টে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের কি আইনের আওতায় আনা হয়েছিল? আর যদি আইনের আওতায় আনা না হয়, তাহলে আমরা বিদেশের গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত দিতে পারব না। বিদেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, সেভাবেই নির্বাচন হবে এটা বাংলাদেশে আমরা চিন্তা করতে পারি না। কেননা বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার সঙ্গে কি আমরা বিদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনও মিল খুঁজে পাব? আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা পৃথিবীর কোনও সংবিধানে এভাবে দেওয়া হয়নি। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা মুখ্য। আমি জানি না প্রধানমন্ত্রী এটা স্বীকার করলেন কি না যে, বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। সমঝোতা যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সমঝোতা একটি কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত হয়েছে। আর দশম নির্বাচন ঘিরে যদি কোনও সমঝোতা না হয়, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই আরেকটি ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রত্যক্ষ করব! সরকার এককভাবেই নির্বাচন করবে, যা সংকটকে আরও গভীরতর করবে।

সংসদে কিংবা বিভিন্ন জনসভায় বিরোধী দলনেতা যে বক্তব্য রাখেন, সে ব্যাপারেও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বেগম জিয়া সংবিধানে নির্দলীয় সরকার বিধান সংযোজন করা, সংলাপ আহ্বান করা, ড. ইউনূসকে অসম্মানিত করা, জাতীয় নেতাদের সম্মান দেওয়া, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। বাজেট নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, উচ্চ সুদের হার, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহে ঘাটতি, চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগ-পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে হেফাজতে ইসলামের প্রসঙ্গও টেনেছেন। তুলনামূলক বিচারে বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনা যতটা আক্রমণাত্মক থাকেন, বেগম জিয়া অতটা আক্রমণাত্মক নন। কিন্তু আমরা যারা আমজনতা, আমাদের কাছে সংসদ নেত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কোনও সমাধান বা দিক নির্দেশনার পথ আমরা খুঁজে পাইনি। আগামীতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেসব সমস্যার সম্মুখীন আমরা হব, তার সমাধান কীভাবে হবে, তার কোনও দিকনির্দেশনা নেই। সরকার যে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছে, বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সেই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। অর্থমন্ত্রীর মুখের কথায় প্রবৃদ্ধির টার্গেট অর্জিত হবে না। এর জন্য দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা, শিল্পোত্পাদন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যার কোনও একটিও এ মুহূর্তে নেই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশিদের এক ধরনের
হস্তক্ষেপ বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমাদের যে অর্জন, সেই অর্জন নষ্ট হতে চলেছে শুধু একটি সমঝোতার অভাবে। সরকারি দল ইতোমধ্যে আগামী নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন, তাদের কাছে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করেছে। কারা-কারা প্রার্থী হতে চাচ্ছেন, তার একটি তালিকাও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ভাবখানা এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে একবার হলেও সংসদে যেতে চাই। সরকারি দল বাদে অন্য কোনও দলের কোনও তত্পরতা নেই। জাতীয় পার্টি অবশ্য নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে। দলটি মনোনয়ন ফরমও বিক্রি করছে। কিন্তু এ নিয়ে দলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে।

এটা এখন স্পষ্ট
বিদেশি দাতারা যা-ই বলুক, নিশা দেশাই ঢাকায় এসে যে কথাই বলে যান না কেন, একটি নির্বাচন হবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে। আর বিএনপি তথা ১৮ দল যত কথাই বলুক, তারা ওই নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। নির্বাচন হবে। ১৮ দল নির্বাচন বয়কট করবে। সরকারকে ‘সহযোগিতা’ করার জন্য দল বা লোকের অভাব হবে না। আমরা ১৯৮৬ সালের পুনরাবৃত্তিই দেখতে পাব আরেকবার। কিন্তু তারপর কী? দেশ কী এভাবেই চলবে? সমঝোতার জন্য কোনও সংলাপ বা আলোচনা কি হবে না?

ইতিমধ্যে একটি নির্বাচনকালীন সরকার যাত্রা করেছে। তবে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হচ্ছে, এ নিয়ে দুই পক্ষের মাঝে আলোচনা হবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। ওই আলোচনায় বিএনপি যোগ দেবে এবং একটি নির্বাচনকালীন সরকারের আওতায় বাংলাদেশে একাদশতম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এর আগে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান কাঠামোয়। প্রধানমন্ত্রী আবারও ‘নির্বাচিত’ হবেন। আর ওই সরকার ক্ষমতায় থাকবে ন্যূনতম দুই বছর।

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের এক ধরনের স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম এবং নবম সংসদ নির্বাচন বিতর্কমুক্ত ছিল। বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। এখন আমরা আবার সেই পুরনো বৃত্তে ফিরে গেলাম। একপক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা, ব্যক্তি প্রতিহিংসা, ক্ষমতা ধরে রাখার নানা অপকৌশল, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সহিংসতার আশ্রয়, বাংলাদেশের রাজনীতির এই যে চিত্র, এই চিত্র বদলে দিতে না পারলে এ জাতির ভবিষ্যত্ অন্ধকার। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটির একটি সম্ভাবনা আছে। এখন এ দেশের রাজনীতিবিদদেরই সে সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমরা চাই আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের স্থিতিশীলতা উপহার দেবেন। এ জাতি তো বারবার তাদের দিকেই তাকিয়েছে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনটা জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন দোষারোপের রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া। তা হলেই দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।

সর্বদলীয় সরকার, তৃতীয় জোট আর নিশার ঢাকা সফর

চলতি সপ্তাহে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। সোমবার বহুল আলোচিত একটি ‘সর্বদলীয় সরকার’ শপথ নিয়েছে। মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেও রোববারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টি নেতা এইচএম এরশাদ ‘তেঁতুল তত্ত্ব’-এর প্রবক্তা মাওলানা শফীর আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ আর তৃতীয় একটি ফ্রন্ট গঠন করার কথা বলেছেন। আর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই ঢাকা ঘুরে গেছেন। সব কিছুই আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘিরে। রাজনীতিতে উত্তেজনা আছে। সংকট আছে। কিন্তু বড় প্রশ্ন যা, তা হচ্ছে সর্বদলীয় সরকার, একটি তৃতীয় ফ্রন্ট কিংবা নিশা দেশাইর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক সংকট, এর আদৌ কোনো সমাধান হবে কিনা? বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কিনা? আমার বিবেচনায় এই পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
একটি তথাকথিত সর্বদলীয় সরকার হয়েছে, কিন্তু তাতে প্রধান বিরোধী দল নেই। যারা যোগ দিলেন, তারা তো সবাই মহাজোটেরই শরিক। তবে পার্থক্য একটাই যারা মহাজোটে ‘মন্ত্রী’ হতে পারেননি, এখন তারা মন্ত্রী হয়েছেন। তিন মাসের মন্ত্রী। কিন্তু সর্বদলীয় হলো কোথায়? আর এ সরকার সাংবিধানিকভাবে বৈধ কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কেননা সংবিধানের কোথাও ‘সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার বলে কিছু নেই। সংবিধানের ২য় পরিচ্ছেদে ৫৫ থেকে ৫৮ ধারা মন্ত্রিসভা গঠনসংক্রান্ত। এখানে কারা মন্ত্রী হবেন, এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি এ ধরনের সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।
দুই. মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়ে যা ঘটেছিল তাকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন, ‘মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা বৈধ ও সংবিধানসম্মত’ (মানবকণ্ঠ, ১৪ নভেম্বর)। আইনমন্ত্রী বললেন, সাংবিধানিকভাবে পদত্যাগ জমা দেয়া ঠিক হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বললেন, তার দফতরে পদত্যাগপত্র আসেইনি। অন্য মন্ত্রীদের কথা বাদই দিলাম। সুরঞ্জিত বাবু কিছুটা আইনকানুন বোঝেন বলেই আমার ধারণা। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি যখন বলেন, এটা বৈধ ও সংবিধানসম্মত, তারপরও তিনি ওই বৈঠকে যোগ দেন কীভাবে? বাংলাদেশের অনেকেই এখন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। মনগড়া সব সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দেন। আমি শুধু সংবিধানে কী লেখা আছে, সেটাই উল্লেখ করতে পারি। ৫৮ ১(ক) তে উল্লেখ আছে ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ সংবিধানের সর্বশেষ সংস্করণে এভাবেই লেখা আছে। তাহলে কী হয়েছিল ওই দিন? আমরা সবাই টিভিতে দেখলাম (পরদিন পত্রপত্রিকায় ছাপাও হলো), মন্ত্রীরা সব পদত্যাগ করলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে এক গাদা পদত্যাগপত্র। ৫ জন প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে কদমবুচি করেছেন-সে খবরও আছে। তারা পদত্যাগ করেছেন এবং সংবিধানের ৫৮ ১(ক) ধারা অনুযায়ী মন্ত্রীদের পদ ‘শূন্য’ হয়েছে। তাহলে রোববার (১৭ নভেম্বর) তারা মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন কীভাবে? সংবিধান বাদই দিলাম। নৈতিকতা বলে তো একটা কথা আছে। কেউ পদত্যাগ করে তো ‘মন্ত্রী’ হিসেবে মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে যোগ দিতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা কিংবা মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রধানমন্ত্রীকে কী উপদেশ দিয়েছিলেন, আমি জানি না। কিন্তু ‘উপদেশটি’ যে সঠিক ছিল না, তা বলতে পারি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবার ‘সচিবি মেজাজে’ সাংবাদিকদের বললেন, তারা কোনো ‘উকিল নোটিশের’ গুরুত্ব দেন না। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মন্ত্রীদের তাদের স্বপদে থাকা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে। তিনি বড় আমলা। তার মাঝে অহংকার থাকারই কথা। এসব দলবাজ আমলারা যে ক্ষমতাসীন দলকে কত ক্ষতি করতে পারে, এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। বেগম জিয়ার এক অতি ক্ষমতাধর আমলার খবর সবাই জানেন। তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায়। গবেষণা করেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব আমলাকে বড় বেশি তোয়াক্কা করে চলেন। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কথায় আমি কষ্ট পেয়েছি। যখন রিটের কথা ওঠে, তখন বিষয়টি আইনের। তিনি আইনি ব্যাখ্যা দিতে পারতেন অথবা উত্তরটা এড়িয়ে যেতে পারতেন। আমাদের আমলাদের নিয়ে সমস্যা এখানেই। এদিকে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব আমাদের জানালেন (বিবিসি বাংলা, প্রভাতি, ১৮ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতিকে দেননি। তাহলে কেমন হয়ে গেল না ব্যাপারটা? নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করার মধ্যে দিয়েই কি পুরনো মন্ত্রিসভা বাতিল হয়ে গেল? সংবিধানে কিন্তু এরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রধানমন্ত্রী এখানেও ‘চমক’ দেখালেন।
তিন. শেষ পর্যন্ত আসল কথাটি বলে ফেলেছেন এইচএম এরশাদ। হাটহাজারীতে ‘বড় হুজুর’ মাওলানা শফীর সঙ্গে দেখা করে তিনি জানিয়ে দিলেন তিনি নির্বাচন করছেন এবং তৃতীয় একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছেন! তিনি আর মহাজোটে নেই, এ কথাটা জানাতেও ভোলেননি তিনি। এর মধ্যে দিয়েই কি সেই সত্যটাই প্রমাণিত হলো যে, এরশাদই হতে যাচ্ছেন দশম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা? অতীতে এরশাদ তো বারে বারে একটা কথাই বলে আসছেন-বিএনপি না এলে তিনি নির্বাচন করবেন না এবং সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না! তিনি ‘জাতীয় বেইমান’ হিসেবে পরিচিত হতে চান না, এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। তিনি যে নিজেকে বারে বারে হাস্যস্পদ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, এ কথাটা সম্ভবত তিনি মাঝে মধ্যে ভুলে যান। বিকল্প একটি জোট হতেই পারে। কিন্তু তিনি আবারো প্রমাণ করলেন আওয়ামী লীগের প্রভাব বলয়ের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক জাতীয় পার্টির রাজনীতি আজকের নয়। ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হলে, জাতীয় পার্টি সেই সরকারে যোগ দিয়েছিল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রীও হয়েছিলেন। পরে মঞ্জুকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেও মঞ্জু তা মানেননি। শেষ পর্যন্ত দলটি ভেঙে গিয়েছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে। এবারো এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে মন্ত্রিসভায় পাঠান। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় পার্টির এই ভূমিকা তৃতীয় একটি জোট গঠনে আদৌ সহায়ক কি?
জাতীয় পার্টির যে রাজনীতি এর সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিরই ‘মিল’ বেশি। দুই পার্টির আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্যই গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। প্রথমে জনদল (১৯৮৩) ও পরে জাতীয় পার্টি (১৯৮৬) গঠনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী (১৯ দফা) ‘অপর একটি’ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও গত ২৭ বছরে দলটি সঠিক একটি নীতি ও আদর্শের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। ব্যক্তি এরশাদকে কেন্দ্র করে দলটি আবর্তিত হলেও, দলটি বাংলাদেশে বিকল্প একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। উত্তরবঙ্গে ব্যক্তি এরশাদের জনপ্রিয়তাই হচ্ছে দলটির মূল শক্তি। তবে বলতেই হবে দুই প্রধান দলের বাইরে নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি। সর্বজন গ্রহণযোগ্য পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) জাতীয় পার্টি ২৭২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮ আসনে বিজয়ী হয়েছিল (ভোটের হার ১১.৯২)। সপ্তম সংসদে (১৯৯৬) ২৯৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছিল ৩২ (প্রাপ্ত ভোট ১৬.৩৯)। ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন ১৪ (প্রতিদ্বন্দ্বিতা ২৮১ আসনে, প্রাপ্ত ভোট ৭.২৫ ভাগ)। এই সময় এরশাদ কিছু ইসলামিক দল নিয়ে ইসলামি জাতীয় ঐকফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি এবং ফ্রন্ট তার অস্তিত্বও বজায় রাখেনি। আর সর্বশেষ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসন ২৬, আর প্রাপ্ত ভোট ৭.০৫ ভাগ। এখন যে দল মাত্র শতকরা ৭ ভাগ ভোট পায় (যেখানে সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার যথাক্রমে শতকরা ৪৮.০৬ ও ৩২.৪৫ ভাগ), সেখানে ওই দলের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের ভিত্তি কতটুকু শক্তিশালী? যদিও কাজী জাফর বলেছেন, তারা ‘নির্বাচনী জোট’ করছেন না, বরং ‘আন্দোলনের জোট’ করছেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছেন! এখানেও প্রশ্ন আছে। কাদের সঙ্গে জোট হচ্ছে? কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, কিংবা ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম? এদের গণভিত্তি কী? কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধা। দেশের মানুষ তাকে সম্মান করে। কিন্তু তিনিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। এই প্রজন্ম তাকে চেনে না (২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল পেয়েছিল ০.৪৭ ভাগ ভোট)। গণফোরাম? ড. কামাল হোসেন নামিদামি ব্যক্তি। কিন্তু তার কোনো গণভিত্তি নেই। তরুণ প্রজন্ম তাকে চেনে না (১৯৯৬ সালে দলের প্রাপ্ত ভোট ০.১২ ভাগ)। আর জেএসডি? আ স ম আবদুর রবের দলের প্রাপ্ত ভোট ০.২৩ ভাগ (১৯৯৬)। এরা মূলত ব্যক্তিসর্বস্ব। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্লিন ইমেজের মানুষ। মুন্সীগঞ্জের বাইরে তার অবস্থান কোথায়? তার ছেলে মাহি বি চৌধুরী বাবার ইমেজে চলেন। আর মেজর (অব.) মান্নান প্রচুর টাকার মালিক। কিন্তু টাকা দিয়ে কি সব সময় রাজনীতি হয়? এরা সবাই মূলত ব্যক্তিনির্ভর এক একটি দল, যাদের কোনো গণভিত্তি নেই। এদের দিয়ে ‘মিডিয়া কভারেজ’ হতে পারে, কিন্তু কোনো তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
চার. নিশা দেশাই বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিশা দেশাই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে এবং ড. ইউনূসের সঙ্গেও। আমার বিবেচনায় এটাই গুরুত্বপূর্ণ বেশি, যা পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। যারা দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিনি নীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা জানেন বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যে নীতি তা পরিচালিত হয় ভারতকেন্দ্রিক মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। মনে রাখতে হবে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিতে ভারতের অগ্রাধিকার বেশি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা কখনো ভারতকে পাশ কাটিয়ে কিছু করবে না। কিছুদিন আগে মজিনার নয়াদিল্লি সফরের পর বাংলাদেশি কোনো কোনো পত্রপত্রিকায় এমন একটি ধারণা দেয়া হয়েছিল, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ও ভারতীয় অবস্থান পরস্পরবিরোধী। অর্থাৎ দুটি দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন! অনেকে এমন অভিমতও পোষণ করেছেন যে, দু’দেশের অবস্থান সাংঘর্ষিক। এই ধারণা ভুল। পরে মজিনার একটি বক্তব্যে সেটা আরো স্পষ্ট হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মনোভাবকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে আলাদাভাবে কোনো নীতি প্রণয়ন করেনি এবং আগামীতে করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ‘বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে’ যে নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের, এই দাবি নিশাও করেছেন। তবে এই দাবিতে যুক্তরাষ্ট্র আদৌ কোনো ‘চাপ’ প্রয়োগ করবে না। এ ক্ষেত্রে এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে এক ধরনের ‘লেজিটেমেসি’ খুঁজতে চেষ্টা করবে সরকার। ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরনের একটি বক্তব্যও এখানে স্মরণ করা দরকার। শ্রী শরণ গত ১৬ নভেম্বর ঢাকায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে।’ তিনি এও বলেছেন, দু’দেশের মাঝে (অর্থাৎ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) নিয়মিত আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে এ আলোচনা চালানো হচ্ছে বলেও তিনি অভিমত পোষণ করেছিলেন (মানবকণ্ঠ)।
পাঠক, লক্ষ্য করুন ভারতীয় হাইকমিশনার গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘিœত হোক, তা দেশ দুটি কখনোই চাইবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই ভারত কখনোই চাইবে না বাংলাদেশ অস্থিতিশীল থাকুক। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও অনেকটা তেমনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চায় না বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা বাড়–ক। নিশা দেশাই এলেন। দেখলেন। মতবিনিময় করলেন। কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-ব্যবস্থা তিনি নিশ্চিত করতে পারলেন কিনা, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। পাঁচ. এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। আমাদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের অগ্রযাত্রাকে অনেক পেছনে ঠেলে দিতে পারে। বাইরের কোনো শক্তি আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করুক, আমরা তা চাই না। কিন্তু সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পঙ্কজ শরণের বক্তব্যেই তা প্রমাণিত হলো। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এরশাদের তৃতীয় জোট গঠনের ঘোষণাও সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেবে বলে মনে হয় না। এতে সাময়িক একটা সমাধান পাওয়া যাবে। কিন্তু অস্থিতিশীলতা, অস্থিরতা, বিরোধ থেকে যাবেই। একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সমঝোতা দরকার। এটা আওয়ামী লীগের জন্যও মঙ্গল।
দৈনিক মানব কন্ঠ, ১৮ নভেম্বর২০১৩
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীনগর, বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক - See more at: http://manobkantha.com/2013/11/20/147559.html#sthash.dceldNje.QtU7buN8.dpuf

মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই

নিশা দেশাই বাংলাদেশে এসেছিলেন। আবার চলেও গেছেন। নিশা দেশাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি সম্প্রতি রবার্ট ব্লেকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নিশা দেশাইয়ের সফরকে কোনো কোনো মহল থেকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হলেও এ সফর বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে না। বাংলাদেশে আসা তার রুটিন ওয়ার্ক। দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে তিনি কাজ করবেন। পররাষ্ট্র সচিবকে, এমনকি প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেবেন। তাই তার বাংলাদেশে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। তবে কোনো কোনো মহল তার এ সফরকে ভিন্নভাবে নিলেও নিতে পারে। মোদ্দা কথা, তার এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আসার সম্ভাবনাও কম।
যারা দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে মার্কিনি নীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যে নীতি, তা পরিচালিত হয় ভারতকেন্দ্রিক মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিতে ভারতের অগ্রাধিকার বেশি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা কখনও ভারতকে পাশ কাটিয়ে কিছু করবেন না। কিছুদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনার নয়াদিল্লি সফরের পর দেশের কোনো কোনো পত্রপত্রিকায় এমন একটি ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন ও ভারতীয় অবস্থান পরস্পরবিরোধী। অর্থাৎ দুটি দেশের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন! অনেকে এমন অভিমতও পোষণ করেছেন যে, দু’দেশের অবস্থান সাংঘর্ষিক! এ ধারণা ভুল। পরে মজিনার একটি বক্তব্যে সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মনোভাবকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের ব্যাপারে আলাদাভাবে কোনো নীতি প্রণয়ন করেনি এবং আগামীতে করার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ভারতের মনোভাবের সঙ্গে সমন্বয় করেই বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি প্রণীত হয়েছে এবং কোনো অবস্থাতেই তা ভারতীয় স্বার্থকে ক্ষুণœ করে নয়। মনে রাখতে হবে, এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ভারত একটি ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়। কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই ভারতীয় স্বার্থকে আঘাত বা উপেক্ষা করে নয়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা) চুক্তিতে রাজি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে নেবে। কিন্তু তাতে করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (জিএসপি) দেবে, এটা আমার মনে হয় না।
মূল বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবহরের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আগামী বছরের শুরুতে একটি নৌ-মহড়া হবে ভারত মহাসাগরে। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ভারত ওই মহড়ায় অংশ নিক। মালদ্বীপের সঙ্গেও একটি ‘সোফা’ চুক্তি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো ২০১০ সালে তার লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা জানেন, এই ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফ্লিটের বেশ ক’টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। যে কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য মার্কিন ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। অনেকেরই জানার কথা, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এরই মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তির আওতায় দৃশ্যত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ, শ্রমমান, পণ্যের শুল্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করলেও মূল বিষয় একটিই- যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যৌথ কর্মসূচি গ্রহণে’র আড়ালে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না! বলা ভালো, প্রতিবছর একবার ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি’র আওতায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হবে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল গেল বছরের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে। আর এবার দ্বিতীয় সংলাপ হল ঢাকায় গত ২৬ মে। সংলাপ শেষে একটি ব্রিফিং করা হয় বটে, কিন্তু ভেতরের অনেক কথাই জানানো হয় না। বাংলাদেশ এর আগে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তাই গুজবের ডালপালা বেড়েছে এবং আগামীতে তা আরও ছড়াবে।
গেল বছরের ১৮ জুন ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় ন্যাটোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ন্যাটোর ২৫টি সদস্য দেশের বাইরেও মোট ৫৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনকে তারা বলছে স্ট্র্যাটেজিক মিলিটারি পার্টনারশিপ কনফারেন্স। যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়, তারাও এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করতে পারে এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতিনির্ধারকরা মোট চার ভাগে ভাগ করেছে, যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন ইউরোপের ১২টি দেশকে নিয়ে গঠিত হয়েছে দ্য পার্টনারশিপ ফর পিস। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া, তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে মেডিটেরিয়ান ডায়ালগ মেমবার্স। সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ইসতান্বুল কোঅপারেশন ইনিশিয়েটিভ। অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো ‘পার্টনার্স অ্যাক্রস দ্য গ্লোবে’র ব্যানারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানও এ ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এখন এল সালভাদর ও কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সঙ্গে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল, ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার এডমিরাল স্টাভরিডিস সম্প্রতি বলেছেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন এবং আশা করছেন এ দেশ দুটি ‘পার্টনার্স অ্যাক্রস দ্য গ্লোবে’র ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকাণ্ডে শরিক হবে। ২০১০ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ায় সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল, একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে।
ন্যাটোর এ ভূমিকা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিশ্বকে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাব বলয়কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হলেও ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়া হয়নি বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাটো ও ওয়ারশ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল যে ইউরোপে একাধিকবার ‘পারমাণবিক যুদ্ধে’র আশংকা দেখা দিয়েছিল। সেই যুদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এ দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটি- রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। যে কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এ অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের জন্মের আশংকাও ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভয় ও শংকা’ এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখন আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এখন বিশ্বকে কর্তৃত্ব করছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ায় তা এখন মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখছে। এটা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই অপছন্দের। গত ৮ জুন নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এ সফরে ওবামার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারপরও বেশকিছু ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা মার্কিনিদের চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের আশংকার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য ও সেই সঙ্গে সব বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই তথাকথিত ‘অংশীদারিত্ব চুক্তি’ করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি ন্যাটোকে ব্যবহার করে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। আর ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম এক ধরনের কর্মসূচি যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভারতকে প্রয়োজন রয়েছে ওবামা প্রশাসনের। ভুলে গেলে চলবে না জাতিসংঘের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৩) যোগ দেয়া যে ক’জন সরকারপ্রধানকে ওবামা হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তার মাঝে অন্যতম ছিল ভারত। গত ২৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে হলে তার ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারত উঠতি শক্তি। সামাজিক তো বটেই, অর্থনৈতিক শক্তিও বটে। মার্কিন স্বার্থ বিঘ্নিত হবে যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সেটা কখনোই চাইবে না।
বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনও একক কোনো নীতি গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি ভারতীয় মনোভাব দ্বারা প্রভাবান্বিত। বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। দাতা দেশগুলোর উদ্যোগ কিংবা জাতিসংঘের মহাসচিবের ফোনের পরও সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। সরকার এককভাবে হাঁটছে। আর বিএনপি যাচ্ছে হার্ডলাইনে। সংলাপ প্রত্যাশিত হলেও সংলাপের কোনো সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সংলাপ নিয়ে পরস্পরবিরোধী মন্তব্যও লক্ষ্য করা যায়। তাই স্পষ্টতই মজিনার নয়াদিল্লি সফর নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছিল। নয়াদিল্লি সফর শেষ করে মজিনা ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনে যে তিনি বাংলাদেশের সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের অবস্থান এক ও অভিন্ন কি-না? অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে এ দু’দেশের মনোভাব এক কি-না? এখানে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অবস্থান স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এর আগে বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কিত পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবট। তিনিও বলেছিলেন ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে’র কথা। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে। তার ওই সফরের পরপরই ঢাকা সফরে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক নবনিযুক্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি কি ভারতীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক? ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা কি চান ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হোক? আমার মনে হয়, ভারতও এটা চায়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ভারতের স্বার্থেই মঙ্গল। নিশা দেশাই দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশী নেতাদের মনোভাব জানলেন। এক্ষেত্রে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র চায় ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন। নিশা দেশাইয়ের সফরের পর এতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না।
দৈনিক যুগান্তর, ২১ নভেম্বর ২০১৩।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : 
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
- See more at: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2013/11/21/43058#sthash.hBNtQOCp.nlscp0mV.dpuf