রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

বেগম জিয়া কী মেসেজ দিলেন

বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া কী মেসেজ দিলেন গত ২০ জানুয়ারির জনসভায়? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় তিনি যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তার মাঝে নতুনত্ব কিছু নেই। তবে একাধিক কারণে আমার কাছে এই কথাবার্তার গুরুত্ব অনেক। প্রথমত, ওই জনসভায় জামায়াতের উপস্থিতি আদৌ ছিল না। তাদের নেতারা বক্তব্যও রাখেননি। সরকার বিএনপিকে অনুমতি দিয়েছিল এক শর্তে আর তা হচ্ছে জামায়াত কর্মীদের আনা যাবে না কিংবা জামায়াত নেতারা বক্তব্য দিতে পারবেন না। এর আগে বিদেশি দূতরা, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে বিএনপির উচিত হবে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও শর্ত দিয়েছিলেন বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে, যদি বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে আসে। এখন বিএনপি এই কাজটি করল। সরকার বিএনপির এই উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দেয় কি-না, সেটাই দেখার বিষয়। দ্বিতীয়ত, বেগম জিয়া দশম জাতীয় সংসদকে ‘অবৈধ সংসদ’ বলেছেন। তিনি ‘প্রহসনের নির্বাচনে অংশ না নেয়ায়’ জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। নয়া নির্বাচনেরও দাবি তিনি করেছেন। কিন্তু বেগম জিয়ার এই বক্তব্যের তিনটি প্রতিক্রিয়া আমরা পেয়েছি। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী এবং খাদ্যমন্ত্রী অনেকটা একই সুরে বলেছেন, নির্বাচন চাইলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আওয়ামী লীগের অনেক নীতি-নির্ধারকও একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে। কিন্তু ভিন্ন কথাও শুনেছি এরশাদের মুখ থেকে। ২০ তারিখে তিনি বলেছেন, নয়া নির্বাচন কমিশনের অধীনে দ্রুত নির্বাচন হবে। এরশাদ এখন ৫৩ হাজার টাকা বেতনে মন্ত্রীর মর্যাদায় সরকারের বিশেষ দূত। এখন এই ‘বিশেষ দূত’ই বললেন ‘দ্রুত নির্বাচনের’ কথা। এখন কোন বক্তব্যকে আমরা গুরুত্ব দেব? এটা সত্য প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ সম্পর্কে কোনো আগাম মন্তব্য করেননি। এখন যে বিষয়টি আমাদের শঙ্কার কারণ, তা হচ্ছে আমরা কী ২০১৯ সালকেই পরবর্তী নির্বাচনের সময়সীমা ধরে নেব? সংবিধান সে কথাই বলে। কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি, এটা বোধকরি খোদ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও বিশ্বাস করেন। তাহলে ‘এই সংসদ’ নিয়ে কী পাঁচ বছর টিকে থাকা যাবে? তাতে কি অস্থিতিশীলতা বাড়বে না? তৃতীয়ত, বেগম জিয়া বলেছেন তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। এর ব্যাখ্যা সরকার হয়তো দেবে। তবে অভিযোগটি তো গুরুতর। গত এক মাসে দেশে কী হয়েছে, তা মোটামুটিভাবে মিডিয়ার কল্যাণে আমরা সবাই জানি। বেগম জিয়াকে তার বাসস্থান থেকে বের হতে না দেয়া, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে বাধা দান-এসব তো মিডিয়ার কল্যাণেই আমরা জেনেছি। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যখন অভিযোগ করেন, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! নিঃসন্দেহে এটা কাম্য নয়। চতুর্থত, বেগম জিয়া বলেছেন, ‘যৌথবাহিনীর নামে বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে।’ এ অভিযোগটিও গুরুত্বপূর্ণ। অতি সাম্প্রতিককালে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সরকার এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা দিলে ভালো করবে। আরেকটি অভিযোগ বেগম জিয়ার। সেটি হচ্ছে ‘সংখ্যালঘুদের ওপর সরকার হামলা করছে।’ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্থান পাচ্ছে। সুতরাং এটাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বেগম জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বক্তৃতা দেয়ার আগে আমরা ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস আর লন্ডন থেকে তিনটি প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ৬ দফার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এর আগে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান মেনডেজ চিঠি দিয়েছিলেন দুই নেত্রীকে। সিনেটের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ব্রিটেনের হাউস অব কমনসও একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের ব্যাপারে। মোটা দাগে এই তিনটি প্রস্তাব যদি বিশ্লেষণ করি, তাতে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে আমরা অদ্ভুত একটি মিল খুঁজে পাই। এগুলো হচ্ছে ১. অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন। ২. অবিলম্বে স্থগিত হয়ে যাওয়া সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করা। ৩. সহিংসতা বন্ধ করা। এখানে সবাই একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বললেও বর্তমান দশম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা কেউ বলেনি। তবে যে ভাষা তারা ব্যবহার করেছেন তাতে ধারণা করা এটা স্বাভাবিক যে, দশম সংসদ গঠন প্রক্রিয়ায় এরা খুশি নন। সব দলের অংশগ্রহণ এতে হয়নি, এমন অভিমতও দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা। এ ক্ষেত্রে ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে গৃহীত সিদ্ধান্তে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছে, যা অন্য কেউ বলেনি। এটা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ‘সন্ত্রাসে জড়িত দল নিষিদ্ধ করা উচিত’ বলে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এ ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দলকে বোঝানো হয়নি। সাম্প্রতিককালে সহিংস ঘটনাবলির জন্য জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম অভিযুক্ত। সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেবে-ইইউ’র এই সিদ্ধান্ত কি জামায়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে? সরকার কি সিদ্ধান্তটি নেবে? সরকারের হাতে একাধিক ‘অপশন’ আছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। কী করবে সরকার এখন তা স্পষ্ট নয়। এসব প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ আমরা পাচ্ছি আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ‘সংলাপ’ শুরু করা। এদিকে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক ব্রিটিশ সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ। এসব মন্তব্য বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার হার্ড লাইনে গেলে ভুল করবে। গত ১৩ জানুয়ারি বিএনপির নেতারা ঢাকায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে কূটনীতিকরা মন্তব্য করেছেন যে, দশম সংসদ নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। তারা সহিংসতা পরিহার করে সব দলের প্রতি সমঝোতার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সহিংসতা কোনো সমাধান নয়। জাতির জন্য, সমাজের জন্য এই সহিংসতা কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে বিরোধী দলের মধ্যে এই উপলব্ধিবোধটুকু আসতে হবে। তবে এটা ভালো খবর যে, নির্বাচনের পর পরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নির্বাচনের পর তেমন সহিংসতার খবর আসছে না। এ ব্যাপারে সরকার তেমন শক্ত অবস্থানে যায়নি। ওপরে উল্লিখিত তিনটি সিদ্ধান্তেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রসঙ্গটি এসেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, নির্বাচনের আগে ও পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি নির্বাচনের আগে ও পরে এই সম্প্রদায়ের লোকদের টার্গেট করে আক্রমণ করা হয়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এমন অপকাণ্ড অতীতে বারবার হয়েছে। এবারো হলো এবং অভিযোগ আছে এই সহিংস ঘটনার জন্য সরকারি দলের লোকজনও জড়িত। এমনি ধরনের একটি অভিযোগ এনেছেন হিন্দু-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জনৈক নেতা। বিষয়টাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত যেই থাকুক, সে রাষ্ট্রের শত্রু, সমাজের শত্রু। আমরা চাইব সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এসব ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে। এ ঘটনায়ও বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। বিদেশের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে যখন কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখন আগামীতে বিএনপির ভূমিকাও ভবিষ্যতে আরো প্রশ্নের মুখে পড়বে। আশার কথা, বিএনপি কোনো হরতাল আর অবরোধের কর্মসূচি দেয়নি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার। বেগম জিয়া উপলব্ধি করেছেন যে, হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের যেমনি সমর্থন থাকে না, ঠিক তেমনি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও সমর্থন করে না। এখন বিএনপির সভায় জামায়াতকে আমন্ত্রণ না জানানো এবং জামায়াতের কোনো নেতা বক্তৃতা না দেয়ায় স্পষ্টতই বেগম জিয়া একটি মেসেজ দিলেন-আর তা হচ্ছে সংলাপের ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি যে উদারতা দেখিয়েছে, সরকার সেই উদারতা দেখাবে কিনা। বল তো এখন সরকারের কোর্টে। জামায়াতের ব্যাপারে সরকার কী করবে, তাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আইনানুযায়ী সরকারের কাছে একাধিক সুযোগ রয়েছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। সংবিধানের ৩৮ (গ) ও (খ) রিপ্রেজেনটেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স ১৯৭২ দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮-এর ধারা-উপ-ধারা বলে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ কিংবা উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলার ফয়সালা করে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। আগামী নির্বাচনে জামায়াত নামে কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আইনগত ও সাংবিধানিকভাবেই হওয়া উচিত। এটাকে সংলাপের পূর্বশর্ত আরোপ করা উচিত নয়। তবে এটা তো ঠিক বিএনপির নেতৃস্থানীয়দের মাঝে এই উপলব্ধিবোধ এসেছে যে, বিএনপির জামায়াতকে পরিত্যাগ করা উচিত। কিন্তু আমার ভাবনা অন্য জায়গায়। যদি সংলাপ হয়ও, তাতে কি কোনো ‘ফল’ আসবে? সংলাপে মূল আলোচ্য বিষয় কী? একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন? তাতে সরকার হয়তো রাজি হবে। কিন্তু নির্বাচনটা হবে কোন সরকারের অধীনে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? সংবিধানে তো সেভাবেই লেখা আছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই তো নির্বাচন হওয়ার কথা! বিএনপি তা কি মানবে? যদি এটা বিএনপিকে মানতেই হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিল না কেন? আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলা বাদ দিয়ে (যেখানে শেখ হাসিনাই থেকে যাবেন সরকারপ্রধান হিসেবে), অন্য যে কোনো ফর্মুলায় বিএনপি রাজি হবে। ফলে সংলাপ হলেও তা কোনো ফল দেবে না-আমার আশঙ্কা এখানেই। সরকার এখন চাইবে দশম সংসদকে পাঁচ বছর টেনে নিয়ে যেতে। এতে সরকার কতটুকু সফল হবে, তা নির্ভর করছে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কতটুকু সংগঠিত করতে পারবে তার ওপর। সম্ভবত বিএনপি তথা ১৮ দলের স্ট্র্যাটেজি সঠিক ছিল না। এটা সত্য নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। যেখানে ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচন হয়নি এবং অন্য আসনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম, সেখানে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন থাকলেও বিএনপি আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন বাংলাদেশে কায়রোর তাহরির স্কয়ার কিংবা ব্যাংককের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে! সেটা হয়নি। বিএনপিকে এখন বিগত দিনের আন্দোলনের হিসাব মেলাতে হবে। আন্দোলনে বিএনপি কর্মীদের মাঠে না থাকা, জেলের ভয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পালিয়ে বেড়ানো ইত্যাদি ঘটনা সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বিএনপি চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই নতুন করে ‘হিসাবের খাতা’ খুলতে হবে। জামায়াত কৌশলী। তারা আপাতত ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাবে। তবে তারা চূড়ান্তভাবে হারিয়ে যাবে এটা আমার মনে হয় না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও (?) তারা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে। তুরস্কের ইতিহাস আমাদের সামনে আছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা নব্বইয়ের শেষের দিকে নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল তুরস্কে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইসলামপন্থি হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী ট্র– পাথ পার্টির একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল তুরস্কে ১৯৯৬ সালে। এরবাকান ছিলেন ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। যদিও সেই সরকার স্থায়ী হয়নি। একপর্যায়ে ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হলে তারা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে সংগঠিত হন এবং পর পর তিনবার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। সুতরাং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও এরা হারিয়ে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। বেগম জিয়া নতুন করে কোনো কঠোর কর্মসূচি না দেয়ায়, স্পষ্টতই সংকটের জট খোলার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। এমনকি গত ২১ জানুয়ারি রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারও বলেছেন দ্রুত সংলাপে যাওয়ার। কিন্তু সিনিয়র মন্ত্রীদের কথাবার্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান, আমাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে, প্রত্যাশিত এই সংলাপটি নাও হতে পারে। তাই একটি সংলাপ হবে কিংবা একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন ২০১৪ সালেই অনুষ্ঠিত হবে সে ব্যাপারে এখনই কিছু বলা কঠিন। এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হবে। এক. যারা নতুন করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন (?) তারা চাইবেন ৫ বছরের টার্ম পূরণ করতে। দুই. জাতীয় পার্টির সুবিধাভোগীরা জানে ক্ষমতা হারালে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই সংসদ ভেঙে যাক এটা তারা চাইবেন না। তিন. সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মী আছেন, যারা মনে করেন আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারলে বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতা আরো দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হবে। চার. আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, আগামীতে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হবে (রাজনৈতিকভাবে) জামায়াতকে, জামায়াত যে নামেই আত্মপ্রকাশ করুক না কেন। জামায়াতের তরুণ প্রজšে§র নেতৃত্বেই একটি আধুনিক ইসলামিক ফোর্সের (অনেকটা তুরস্কের মডেলে) আত্মপ্রকাশ ঘটবে এবং তারাই হবে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপি অনেকটা ‘রণে ভঙ্গ দিয়েছে’। সুতরাং আওয়ামী লীগ খুব অনায়াসে ৫ বছর ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবে। এটা স্পষ্ট যে, বিএনপি নয়া সংসদ ও নয়া সরকারের ব্যাপারে একটা ‘সফট অ্যাটিচিউড’ গ্রহণ করেছে। অনেকের ধারণা ছিল ২৯ জানুয়ারি (যেদিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে) বিএনপি হরতাল দেবে। কিন্তু বিএনপি তা দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে মেসেজটি পরিষ্কার, বিএনপি এক ধরনের সমঝোতা চায়। আগামী মাসে উপজেলা নির্বাচন। এই নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। তবে সমর্থকরা অংশ নেন। বিএনপির সমর্থকরা এই নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে আমার ধারণা। এই নির্বাচনে অংশ না নিলে স্থানীয়ভাবে বিএনপির যে ভিত্তি তাও হারাতে পারে দলটি। তাই বেগম জিয়াকে এখন পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ করে এগোতে হবে। তার উচিত হবে এখন জেলাপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। বেগম জিয়া এখন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে যাবেন এই সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। নিশ্চয়ই বিগত আন্দোলন থেকে তিনি শিখেছেন। জনসমর্থন থাকলেও সরকারের যে পতন ঘটানো যায় না, তা এবার প্রমাণিত হলো। তবে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়। আর এটা নিশ্চিত করতে হলে দুটি বড় দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে সহাবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে এই সহাবস্থানটি নেই। ফলে খুব দ্রুত একটি সংলাপ হবে, মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে-তা এখনই দৃঢ়ভাবে বলা কঠিন। Daily Manobkontho 24.01.14

তিনটি সিদ্ধান্ত কিন্তু প্রশ্ন অনেক

তিনটি সিদ্ধান্ত হয়েছে তিনটি দেশে। কিন্তু দেশ একটি। দেশটি বাংলাদেশ। সিদ্ধান্ত হয়েছে ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস আর লন্ডনে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তও বাংলাদেশকে নিয়ে। আর ব্রিটেনের হাউস অব কমনসের সিদ্ধান্তও এলো বাংলাদেশকে নিয়ে। পুরো বিষয়টিই বাংলাদেশকে নিয়ে, ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে নিয়ে। এ সংসদ এখন গঠিত হয়েছে। একটি মন্ত্রিসভাও আমরা পেয়েছি। এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল কম। এ নিয়ে এন্তার আলোচনা হয়েছে। টকশোগুলোয় আলোচনা চলছে আজও। আমি নিজেও একাধিক টকশোতে অংশ নিয়েছি।একটি নির্বাচন হয়েছে। আমরা চাই বা না চাই, জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫২ ভাগ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাক বা না পাক, বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচনটি হয়ে গেছে। আর ২৯ জানুয়ারি বসছে ওই সংসদের প্রথম অধিবেশন। এখানে যে বিষয়টি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে উপরে উল্লিখিত তিনটি পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তগুলো। অতীতে কোনো দেশের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সুনির্দিষ্টভাবে ছয়টি বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ১. রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরাসরি ও সত্যিকার অর্থে সংলাপ, ২. রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ, ৩. শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের পথ সুগম করা, ৪. নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৫. জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারানকোর উদ্যোগের প্রতি সমর্থন এবং ৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার কর্মীদের হেনস্থা বন্ধ ও গ্রামীণ ব্যাংকের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়া। সিনেটে গৃহীত এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সিনেটর রবার্ট মেনডেজ কর্তৃক দুই নেত্রীকে লেখা চিঠির কথাও আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। ওই চিঠিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানো, সহিংসতা বন্ধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনডেজ মার্কিন সিনেটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান।ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ১৬ জানুয়ারি। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে সাতটি বিষয়ে। এগুলো অনেকটা এরকম- ১. নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা, ২. সহিংসতা বন্ধে সংকট উত্তরণের পথ বের করতে সব পক্ষের কার্যকর আলোচনায় বসা, ৩. স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজন, ৪. বিরোধী নেতাদের কারাবন্দি রাখার ঘটনায় নিন্দা এবং সহিংসতার ঘটনায় বিরোধী দলের (নবম সংসদের) জড়িত থাকার নিন্দা ও দল নিষিদ্ধ, ৫. গণগ্রেফতার বন্ধ ও শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন, ৬. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং ৭. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ১৭ জানুয়ারি। সেখানে আছে পাঁচটি প্রস্তাব। ১. একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, ২. সব রাজবন্দির মুক্তি, ৩. সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন, ৪. সহিংসতা বন্ধ এবং ৫. একটি ‘বিতর্কিত’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিলুপ্তি।
মোটা দাগে আমরা এ তিন সিদ্ধান্ত যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে এতে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে আমরা অদ্ভুত একটি মিল খুঁজে পাই। এগুলো হচ্ছে- ১. অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজন, ২. অবিলম্বে স্থগিত হয়ে যাওয়া সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করা এবং ৩. সহিংসতা বন্ধ করা। লক্ষণীয়, সবাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বললেও বর্তমান দশম সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা কেউ বলেনি। তবে যে ভাষা তারা ব্যবহার করেছে, তাতে এটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, দশম সংসদ গঠন প্রক্রিয়ায় তারা খুশি নয়। সব দলের অংশগ্রহণ এতে হয়নি, এমন অভিমতও দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরা। এ ক্ষেত্রে ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে গৃহীত সিদ্ধান্তে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছে, যা অন্য কেউ বলেনি। এটা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ‘সন্ত্রাসে জড়িত দল নিষিদ্ধ করা উচিত’ বলে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এ ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দলকে বোঝানো হয়নি। সাম্প্রতিককালে সহিংস ঘটনাবলীর জন্য জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম অভিযুক্ত। সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেবে- ইইউ’র এ সিদ্ধান্ত কি জামায়াতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে? সরকার কি সিদ্ধান্তটি নেবে? সরকারের হাতে একাধিক ‘অপশন’ আছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। কী করবে সরকার এখন?এসব প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ আমরা পাচ্ছি আর তা হচ্ছে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হল একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ‘সংলাপ’ শুরু করা। এদিকে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি আশংকার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুই বড় দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক ব্রিটিশ সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ।এসব মন্তব্য এখন বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার হার্ড লাইনে গেলে ভুল করবে। ১৩ জানুয়ারি বিএনপি ঢাকায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠক শেষে কূটনীতিকরা মন্তব্য করেছেন, দশম সংসদ নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। তারা সহিংসতা পরিহার করে সব দলের প্রতি সমঝোতার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সহিংসতা কোনো সমাধান নয়। জাতির জন্য, সমাজের জন্য সহিংসতা কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে, বিশেষ করে বিরোধী দলের মাঝে এ উপলব্ধিটা আসতে হবে। তবে এটা ভালো খবর, নির্বাচনের পরপরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নির্বাচনের পর দেশে তেমন সহিংসতার খবর আসছে না। সরকারও তেমন শক্ত অবস্থানে যায়নি।উপরে উল্লিখিত তিনটি সিদ্ধান্তেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রসঙ্গটি এসেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, নির্বাচনের আগে ও পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি, নির্বাচনের আগে ও পরে এ সম্প্রদায়ের লোকদের টার্গেট করে আক্রমণ করা হয়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এটা অতীতে বারবার হয়েছে। এবারও হল এবং খুব আশ্চর্যজনকভাবে আমরা এবার লক্ষ্য করলাম, এ সহিংস ঘটনার সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি দলের লোকজনও জড়িত। এ ধরনের একটি অভিযোগ এনেছেন হিন্দু-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জনৈক নেতা। বিষয়টা হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত যেই থাকুক, সে রাষ্ট্রের শত্র“, সমাজের শত্র“। আমরা চাইব, সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এসব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে। এ ঘটনায়ও বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে।বিদেশের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে যখন কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখন আগামীতে বিএনপি ভূমিকাও একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে অনেকের কাছে। আশার কথা, বিএনপি কোনো হরতাল আর অবরোধের কর্মসূচি দেয়নি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার। খালেদা জিয়া উপলব্ধি করেছেন, হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের যেমন সমর্থন থাকে না, তেমনি বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও তা সমর্থন করে না। বিএনপি ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছিল, তাতে কূটনীতিকরা সবাই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এদিকে বিএনপি ২০ জানুয়ারি ঢাকায় একটি গণসমাবেশ করেছে। সরকারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার জন্য এ ধরনের সমাবেশ বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত। সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপি ২৯ জানুয়ারি কালো পতাকা প্রদর্শনের ডাক দিয়েছে। সবার জানা, ওইদিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে। এরই মধ্যে খালেদা জিয়া আবার প্রতিটি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করার কথা বলেছেন। এটাও ভালো দিক। এতে করে কর্মীদের ধরে রাখা ও উজ্জীবিত করা সহজ হবে। খালেদা জিয়া সংলাপের কথা বলেছেন। এ অ্যাপ্রোচটাও ভালো। মূলত একটি সমঝোতা ও সংলাপের কথা সবাই বলছেন। দাতাদের কাছ থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে এ সংলাপের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার এ আহ্বান নিঃসন্দেহে এখন একটি সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থা না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আপতত সহিংসতানির্ভর রাজনীতির অবসান ঘটল।দু’সপ্তাহ পরই ভাষা আন্দোলনের মাস। সুতরাং ভাষার মাসে বিএনপি কোনো বড় কর্মসূচি দেবে না, এটাই প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস। এ মাসেও বিএনপি হরতাল আর অবরোধের মতো কর্মসূচি দেবে না, এটাও ধারণা করা যায়। কিন্তু তাতে করে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান হবে কি? আমার মনে হয় না। সরকার যদি কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তাই থেকে যাবে। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর ‘রাজনীতির বলটি’ এখন স্পষ্টতই তিনি ঠেলে দিলেন সরকারের কোর্টে। সরকার যদি নমনীয় না হয়, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তা-ই থেকে যাবে। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছেন নতুন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহ্রিয়ার আলম। একেবারেই আনকোরা একজন মানুষ। ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় তিনি প্রস্তুত। তিনি দলের শীর্ষ নেতা নন। নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায়ও তিনি জড়িত নন। তবু তার অ্যাপ্রোচটি আমার ভালো লেগেছে। রাজনীতিতে এ ‘রিয়েল পলিটিকস’টাই হল আসল কথা। বাস্তবতা মেনে নেয়ার মধ্যেই দেশ ও জাতির মঙ্গল নিহিত। আর বাস্তবতা বলে বিএনপি একটি বড় দল। এ দলকে বাইরে রেখে দেশে স্থিতিশীল রাজনীতি প্রত্যাশা করা যাবে না। এতে করে নানা জটিলতা তৈরি হবে। তবে সরকারপ্রধান একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। শর্তটি হচ্ছে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে হবে। বিএনপির জন্য কাজটি কঠিন, সন্দেহ নেই। তবে সরকারের জন্য একটি সুযোগ তো আছে। সংবিধানের ৩৮(গ) ও (ঘ), রিপ্রেজেনটেশন অব পিপলস্ অর্ডিন্যান্স ১৯৭২, দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর ধারা-উপধারা বলে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ কিংবা উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলার ফয়সালা করে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী নামে কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আইনগত ও সাংবিধানিকভাবেই যাওয়া উচিত। এটাকে সংলাপের পূর্বশত করা উচিত নয়। তবে এটা তো ঠিক, বিএনপির নেতৃস্থানীয়দের মাঝে এ উপলব্ধি এসেছে যে, বিএনপির জামায়াতকে পরিত্যাগ করা উচিত।তবে আমার ভাবনা অন্য জায়গায়। যদি সংলাপ হয়ও, তাতে কি কোনো ফল পাওয়া যাবে? সংলাপে মূল আলোচ্য বিষয় কী? একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন? তাতে সরকার হয়তো রাজি হবে। কিন্তু নির্বাচনটা হবে কোন সরকারের অধীনে? অন্তবর্তীকালীন সরকার? সংবিধানে তো সেভাবেই লেখা আছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই তো নির্বাচন হওয়ার কথা। বিএনপি তা কি মানবে? যদি এটা বিএনপিকে মানতেই হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিল না কেন? আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, সংবিধানে বর্ণিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলা বাদ দিয়ে (যেখানে শেখ হাসিনাই থেকে যাবেন সরকারপ্রধান হিসেবে) অন্য কোনো ফর্মুলায় বিএনপি রাজি হবে। ফলে সংলাপ হলেও তা কোনো ফল দেবে না- আমার আশংকা এখানেই। তাহলে কী হতে পারে ভবিষ্যতে? নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে, যেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সত্যিকার অর্থেই ‘ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৮ দলীয় জোট থেকে কেউ যদি মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়, আমি অবাক হব না। গুজব আছে ১৮ দলের দুই দলীয় প্রধানকে নিয়ে। বিএনপির ভেঙে যাওয়া এবং সরকারে যোগ দেয়ার সম্ভাবনাকেও আমি উড়িয়ে দেই না। বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। সরকার উপজেলা নির্বাচন দিতে যাচ্ছে। আমার ধারণা, বিএনপির সমর্থকরা এতে অংশ নেবেন এবং ওই নির্বাচনের ফলাফল বিএনপিকে একসময় বাধ্য করতে পারে প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে। একটা বড় ধরনের অবরোধ আর হরতালের কর্মসূচির পর বিএনপির পক্ষে কঠিন হবে আন্দোলন সংগঠিত করা। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে এবং কোন প্রতিক্রিয়ায় জনগণকে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়।বাংলাদেশে এখন একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাশিয়ার গণতন্ত্র কিংবা মালয়েশিয়ার ঐকমত্যের রাজনীতি এ ক্ষেত্রে একটি মডেল হতে পারে। সরকার যদি এখন সিঙ্গাপুরের গণতান্ত্রিক মডেল ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়, আমার ধারণা তাতে সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি থাকবে না। সেই সঙ্গে দরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সব ধরনের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সংসদ নির্বাচন হয়েছে। বিদেশ থেকে সমর্থনও আসছে। এখন তিনটি দেশের পার্লামেন্টে গৃহীত সিদ্ধান্তে দেশে সরকার পরিচালনায় আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে বলে আমার মনে হয় না। Daily JUGANTOR 23.01.14

বিএনপির রাজনীতি এখন কোন পথে : তারেক শামসুর রেহমান

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন 'প্রতিহত' ঘোষণার 'ব্যর্থতা' এবং দীর্ঘ প্রায় এক মাসজুড়ে চলা হরতাল-অবরোধের পর যে প্রশ্নটি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে বিএনপি এখন কী করবে? কোন পথে এখন বিএনপি? দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও, বাস্তবতা হচ্ছে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপি ওই সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। যেখানে ৩৫ থেকে ৪০টি কেন্দ্রে কোনো ভোট পড়েনি, যেখানে ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠী আদৌ তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি, সেখানে 'নির্বাচন'-এর নামে একটি নির্বাচন হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় 'বিজয়ী হয়েছে গণতন্ত্র'। ওই নির্বাচন নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও, বাস্তবতা হচ্ছে আগামী ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসতে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম বিএনপিকে ছাড়াই সংসদ অধিবেশন বসছে। যদিও এর আগে ১৯৮৬ সালে ও ১৯৮৮ সালেও (তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ) বিএনপি সংসদে ছিল না। তবে ওই সংসদ টিকে ছিল ১৭ মাস ও ৩১ মাস। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। নবনিযুক্ত মন্ত্রীরা বলছেন, এই সংসদ থাকবে ৫ বছর। সংবিধানে এই ৫ বছরের কথাই বলা আছে। যেখানে সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণের কথা, সেখানে বিএনপি তথা ১৮ দলের অংশগ্রহণ না থাকায়, এ সংসদ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বিএনপির ভবিষ্যৎ এখন কী? গেল বুধবার খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে নয়া কর্মসূচি দিয়েছেন। তার বক্তব্যে অনেক দিক আছে। প্রথমত, তিনি কোনো অবরোধ আর হরতালের কর্মসূচি দেননি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার। তিনি বোধ করি উপলব্ধি করেছেন যে হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের যেমনি সমর্থন থাকে না, ঠিক তেমনি বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও তা সমর্থন করে না। বিএনপি ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছিল, তাতে কূটনীতিকরা সবাই এই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি ২০ জানুয়ারি ঢাকায় একটি গণসমাবেশ করেছে। সরকারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করার জন্য এ ধরনের সমাবেশ বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত। তৃতীয়ত, বিএনপি ২৯ জানুয়ারি কালো পতাকা প্রদর্শনের ডাক দিয়েছে। সবার জানা ওই দিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে। চতুর্থত, খালেদা জিয়া আবার প্রতিটি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করার কথা বলেছেন। এটাও ভালো দিক। এতে কর্মীদের ধরে রাখা ও উজ্জীবিত করা সহজ হবে। পঞ্চমত, খালেদা জিয়া সংলাপের কথা বলেছেন। এই অ্যাপ্রোচটাও ভালো। মূলত একটি সমঝোতা ও সংলাপের কথা সবাই বলছেন। দাতাদের কাছ থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে এ সংলাপের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার এ আহ্বান নিঃসন্দেহে এখন একটি সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থা না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আপাতত সহিংসতানির্ভর রাজনীতির অবসান ঘটল। কিছুদিন পরেই ভাষার মাস। সুতরাং ভাষার মাসে বিএনপি কোনো বড় কর্মসূচি দেবে না, এটাই প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস। এ মাসেও বিএনপি হরতাল আর অবরোধের মতো কর্মসূচি দেবে না, এটাও ধারণা করা যায়। কিন্তু তাতে করে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান হবে কি? আমার মনে হয় না। সরকার যদি কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তা থেকে যাবে। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর 'রাজনীতির বল'টা এখন স্পষ্টতই সরকারের কোর্টে। সরকার যদি সংলাপের ব্যাপারে আন্তরিক না হয়, তাহলে সমস্যা যেভাবে ছিল, সেভাবেই থেকে যাবে। বরং তাতে জটিলতা আরো বাড়বে। খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে বলেছেন, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। এর সঙ্গে অনেকেই ঐক্য করেছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন তিনি হয়তো এ ব্যাপারে একটি ঘোষণা দেবেন। কৌশলগত কারণে সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন। এর আগে তো তিনি একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে স্পষ্ট করেছেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। আমরা যারা রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি, আমরা সবাই জানি রাজনীতি বিষয়ে সেই বিখ্যাত উক্তিটি 'রাজনীতিতে স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই, স্থায়ী কোনো শত্রু নেই।' এটা তো সত্যি, এই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। ১৯৮৬ সালে দেশে যখন তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (এরশাদীয় জমানায়), তখন বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। সুতরাং রাজনীতিতে 'স্থায়ী শত্রু, স্থায়ী মিত্র'র ধারণা থেকে বিএনপি-জামায়াত ঐক্য টিকে আছে। আগামীকে এই ঐক্য নাও টিকে থাকতে পারে! তাই বোধ করি খালেদা জিয়া বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি এবার ধীর গতিতে এগুচ্ছেন। নির্বাচনটা হয়ে গেছে। মন্ত্রিসভাও হয়ে গেছে। এটাই বাস্তবতা। এ মন্ত্রিসভা নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, নির্বাচন নিয়ে যত বিরূপ মন্তব্যই আসুক না কেন, সরকার এটাকে আদৌ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। তাই বিএনপি তথা ১৮ দলের কাছে বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ১৮ দল এখন হরতাল নয়, বরং মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখেই তাদের স্ট্রাটেজি ঠিক করছে। এ কারণেই দেখা যায় বিএনপি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার পুরো বিষয়টাই এখন নির্ভর করছে সরকারের ওপর। সরকার কি আদৌ বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাবে? আর যদি সমঝোতায় যায়ও, তাহলে এর ধরন কী হবে? বিএনপির তো দাবি ছিল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকার সেটা মানেনি। এবং আগামীতে যে মানবে, তাও নয়। কিছুটা নমনীয় হয়ে বিএনপির দাবি ছিল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারথ তাও হয়নি। বিএনপির আরো একটি দাবি ছিলথ শেখ হাসিনাকে বাইরে রেখে যে কোনো অন্তর্র্বতীকালীন সরকারে তারা নির্বাচনে যেতে রাজি। তাও হয়নি। তাহলে বিএনপি কোন দাবিকে মুখ্য করে এখন আন্দোলনে যাবে? মধ্যবর্তী নির্বাচন? কিন্তু তাও খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। ভোটকেন্দ্রে কেউ আসুক, না আসুক, নির্বাচন হয়েছে। 'সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন' হয়নি। যারা রাজনীতিতে 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' নিয়ে কাজ করেন, তারা এখন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে একটি 'ষড়যন্ত্র আবিষ্কার' করে ফেলতে পারেন! বলতে দ্বিধা নেই। একটি নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত নির্বাচন এটি হলো না। আমাদের দুর্ভাগ্য এ জাতি আবারো একটি নির্বাচন দেখল, যেখানে প্রধান একটি দলের আদৌ কোনো অংশগ্রহণ নেই। ইতোমধ্যে দশম সংসদের ২৯৬ জন সদস্য শপথ নিয়েছেন। নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হলো ১২ জানুয়ারি রোববার। এর মধ্য দিয়ে দশম সংসদ তার যাত্রা শুরু করল। তবে এ সংসদ নিয়ে 'কিছু' এবং 'কিন্তু' আছে। এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বড় ধরনের সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ৬৫(২) ধারায় বলা আছে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।' এর অর্থ যারা শপথ নিয়েছেন, তারা সংবিধান মোতাবেক বৈধ কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ এখনো বহাল আছে। আরো মজার ব্যাপার এর মধ্য দিয়ে ১২২ আসনে এখনো দুজন করে এমপি! এটা তো স্পষ্টতই সংবিধানে ৬৫(২) ধারার বরখেলাপ। আমি জানিনা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা তাকে বিষয়টির কীভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরো একটা মজার কাহিনী আমাকে শুনিয়ে ছিলেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, যিনি নয়া মন্ত্রিসভায়ও আছেন। তিনি জাতীয় পার্টির নেতা। বৃহস্পতিবার তিনি আমার সঙ্গে এটিএন নিউজের টকশোয় আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন। তিনি বললেন, জাতীয় পার্টি সরকারেও থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। কী অদ্ভুত কথা! গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের কথা কেউ কখনো শোনেনি। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের এ ধরনের কথা শোনাচ্ছেন! রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি কোথাও পাইনি যে দল একই সঙ্গে সরকারে থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। আমরা গণতন্ত্রের এ কোন রূপ বাংলাদেশে দেখছি! এরশাদ সাহেব আরো বিতর্কিত করলেন নিজেকে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন সরকারের 'বিশেষ দূত' তিনি হবেন। এবার হলেন। কিন্তু 'অসুস্থ' হয়ে, গল্ফ খেলে, নিজেকে 'থু থু এরশাদ' হিসেবে পরিচিত করে তিনি কী পেলেন, জানিনা। কিন্তু দেশে রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে একটা বাজে ধারণার জন্ম দিলেন। জনগণের ওপর 'চাপিয়ে' দেয়া এই যে রাজনীতি, এই রাজনীতি আর যাই হোক জনগণের মঙ্গলের জন্য যে রাজনীতি, তা নয়। আরো একটি খবরথ নতুন নির্বাচন চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। রিটটি করেছেন নবম সংসদের বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। এ রিটের ভবিষ্যৎ কী আমরা জানি না। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টিকে আমরা আবারো আদালতে নিয়ে গেলাম। এই প্রবণতা ভালো নয়। মঙ্গলও নয়। রাজনীতির বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হওয়া উচিত। তাই তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবেন আমি জানিনা। কিন্তু আমি বুঝি দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার জন্য বিএনপির সঙ্গে 'সমঝোতা' ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি তার 'অবরোধ আর হরতালের' কর্মসূচি চূড়ান্তভাবে পরিত্যাগ করেছে, এটা মনে হয় না। যদিও রাজধানীতে অবরোধ আর তেমনভাবে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না আগের মতো। কিন্তু 'সংসদের বাইরে' থাকা বিএনপির এ কর্মসূচি ছাড়া বিকল্প কিছু আছে কি? 'নির্বাচন' হয়েছে। সেখানে যত কম ভোটই পড়ুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই নির্বাচন বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার 'মৃত্যু' ঘটাল। সরকার এ নির্বাচন দিয়ে তার 'লেজিটেমেসি' বাড়িয়েছে। সুতরাং আগামী দিনগুলো নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল। আমার বিবেচনায় বিএনপি এখন সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে। হরতাল আর অবরোধ না দিয়ে বহির্বিশ্বে তার ইমেজ বাড়াতে চাইছে বিএনপি। সরকারের উচিত হবে তাই বিএনপির সঙ্গে একটা 'সংলাপ' শুরু করা। এ কাজটি করতে আমাদের যত দেরি হবে, রাজনীতিতে অস্থিরতা তত বাড়বে।

সংসদ মন্ত্রিসভা ও বিবিধ প্রশ্ন

অনেক ‘বিতর্কের’ জন্ম দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভাও শপথ নিয়েছে এবং বোধকরি গণতান্ত্রিক সমাজে এই প্রথম একটি দেশ যেখানে নামমাত্র একটি বিরোধী দল সরকারেও আছে, আবার একইসঙ্গে বিরোধী দলেও আছে। শুধু তাই নয়, এমন একটি নির্বাচন হলো, যেখানে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ও হলেন! আরও অবাক করার বিষয়Ñ নবম জাতীয় সংসদকে রেখেই দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হলো এবং দশম জাতীয় সংসদ থেকে সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভাও গঠিত হলো! পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। পুরো প্রক্রিয়াটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। এরই মধ্যে হাইকোর্টে দু’দুটো রিট করা হয়েছে। এ রিটের ভাগ্য কী, তা আমরা জানি না, তবে সংবিধান যারা বোঝেন, ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারেন, তাদের কারও কারও মতামত আমরা পেয়েছি। আর ওইসব মতামত সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করে না। সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই যেখানে সংবাদপত্রে, টিভি টকশোতে বারবার বলা হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে, সেখানে নয়া মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেন, তাতে করে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সারা বিশ্বেই একটা প্রশ্নের মুখে, সেখানে অনেক সিনিয়র মন্ত্রীকে বলতে শুনলামÑ ‘সরকার থাকবে পাঁচ বছরের জন্য’! সাধারণ নিয়মে একটা সরকার পাঁচ বছরই থাকে। কিন্তু যে ‘নির্বাচন’ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে সংসদ তার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে, সেই সংসদের আয়ুষ্কাল পাঁচ বছর বলা হলে সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বুধবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল নয়া কর্মসূচি দিয়েছে। ২৯ জানুয়ারি নয়া সংসদের উদ্বোধনী দিন। ওইদিন হরতাল দেয়নি প্রধান বিরোধী দল। এটাকে সমঝোতা ও সংলাপের ব্যাপারে শুভ সঙ্কেত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এখন দেখার বিষয়, বিএনপির এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভূমিকা কিরূপ হয় নির্বাচন হয়ে গেছে। ওই ‘নির্বাচন’ নিয়ে যত প্রশ্নই উঠুক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদের ২৯২ জন সদস্যই শপথ নিয়েছেন (বাকি ৮টি আসনে নির্বাচন হয়নি)। সংবিধান অনুযায়ী তারা এখন সংসদ সদস্য, তবে সরকারি ভাষ্য মতে, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ২৪ তারিখের পর। অর্থাৎ নবম সংসদ বিলুপ্ত হলো না। নিয়মমাফিক ২৪ তারিখ ওই সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং দশম সংসদের কার্যক্রম শুরু হবে। এ নির্বাচন এবং শপথ গ্রহণ নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ১৪৮ ২(ক) অনুযায়ী সরকারি গেজেট প্রকাশের ৩ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা অনুসরণ করে সংসদ সদস্যরা (দশম সংসদ) শপথ নিয়েছেন। এটা সংবিধান অনুযায়ী করা হয়েছে। কিন্তু ১৪৮(১) যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে দেখব এ ধারা বলে যে শপথ গ্রহণ করা হলো তা ৬৫(২) ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৪৮(১) ধারাটা এরকম ‘তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত যে কোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যগ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল অনুযায়ী শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন।’ এর অর্থ কী? এমপি সাহেবরা শপথ নিয়েছেন কার্যগ্রহণের আগে। অর্থাৎ ৯ তারিখ থেকেই তিনি সংসদ সদস্য! কিন্তু ১২২টি আসনে যেখানে অন্য এমপি রয়েছেন, তার কী হবে? সংবিধানের কোথাও কিন্তু বলা হয়নি নয়া এমপি দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো এমপি আর তার দায়িত্বে থাকবেন না। এখানে এক ধরনের জটিলতা রয়েছে। দেশের আইনজীবীরাও এ ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত। এ দেশে যিনি আজীবন কোম্পানি আইন পড়েছেন, কোম্পানি আইনে মামলা-মোকদ্দমা করেন, তিনি হয়ে যান সংবিধান বিশেষজ্ঞ! তারা তাদের মতো করে সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন। এখন শপথ গ্রহণের বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে। ব্যাখ্যাটা আদালতই দেবেন। এমনকি সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কিংবা ড. কামাল হোসেন, যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত, তারা আদালতের কাছে স্বউদ্যোগেও একটা ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা ভালো। মন্ত্রিসভা হয়েছে। এই মন্ত্রিসভা ভালো কী মন্দ এ নিয়ে কম কথা হয়নি এ ক’দিনে। বিতর্কিত মন্ত্রীরা বাদ পড়েছেন। বলা হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে, যারা বেশি কথা বলে বারবার বিতর্ক সৃষ্টি করতেন, তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। এটা তো ঠিক, যারা মন্ত্রী হয়ে অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন, তাদের প্রধানমন্ত্রী দূরে সরিয়ে রেখেছেন। নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্ত অন্যদের একটা মেসেজ পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ যারা নতুন মন্ত্রী হয়েছেন, তারা দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবেন। এ সিদ্ধান্তটি ভালো। তরুণ অনেক মুখ ছোট মন্ত্রী হয়েছেন। এটাও ভালো। এর মধ্য দিয়েই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হবে। এটা খুবই দরকার। দলের সিনিয়র নেতারা সম্ভবত শেষবারের মতো কেবিনেটে থাকলেন। আগামীতে আর বয়সের ভারে তারা কর্মক্ষম থাকবেন না। সুতরাং নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তবে মন্ত্রিসভায় দক্ষ ও আধুনিকমনস্ক লোকদের আমি কম দেখেছি। একুশ শতকে বিশ্ব আসরে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আধুনিকমনস্ক, শিক্ষিত ও যোগ্য মন্ত্রী দরকার। যদি সংসদে না থাকেন তাহলে টেকনোক্রেট কোটায় বাইরে থেকে নিতে হবে। কিন্তু যাকে টেকনোক্রেট কোটায় নেয়া হলো তিনি ঠিক এ মানদ-ে পড়েন না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ্য ব্যক্তি দরকার। বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পুনরুদ্ধারে দরকার যোগ্য ব্যক্তি। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে আমাদের দেশ সম্পর্কে একটা বাজে ধারণার জন্ম হয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, সিনেটে অবিলম্বে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাঁচজন সিনেটর রিচার্ড ডারবিন, জজ বুজম্যান, বারবারা বস্ক্রার, মাইকেল রি এন্ডি ও সিনেটর ক্রিস্টোফার এস মার্ফি ১১ ডিসেম্বর এই প্রস্তাবটি পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে পাঠান। এটি নিয়েই আলোচনা হয়। সিনেটে গৃহীত প্রস্তাবে ছয়টি বিষয় রয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সত্যিকার অর্থে সংলাপ, অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা প্রদান, তারানকোর উদ্যোগের প্রতি সমর্থন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনডেজ দুই নেত্রীকে (প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী) যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানো, সহিংসতা বন্ধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনডেজের চিঠিটি ছাপা হয়েছে শনিবার। সিনেটের প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ আমরা পাচ্ছি আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ‘সংলাপ’ শুরু করা। এদিকে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক ব্রিটিশ সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ। এসব মন্তব্য এখন বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার হার্ডলাইনে গেলে ভুল করবে। ১৩ জানুয়ারি বিএনপি ঢাকায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠক শেষে কূটনীতিকরা মন্তব্য করেছেন, দশম নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। তারা সহিংসতা পরিহার করে সব দলের প্রতি সমঝোতার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সহিংসতা কোনো সমাধান নয়। জাতির জন্য, সমাজের জন্য এ সহিংসতা কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে, বিশেষ করে বিরোধী দলের মাঝে এ উপলব্ধি বোধটুকু আসতে হবে। তবে এটা ভালো খবর যে, নির্বাচনের পরপরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নির্বাচনের পর দেশে তেমন সহিংসতার খবর আসছে না। জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব এখন আলোচিত হতে থাকবে বারবার। নির্বাচনের আগে দলটি আরেক দফা ভেঙে গেছে। বলতে দ্বিধা নেই, নির্বাচনের পর বর্তমান মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি মন্ত্রিসভাকে বড় ধরনের বিতর্কের মাঝে ফেলে দিয়েছে। যতদূর জানা যায়, ২০০৬ সালে হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি পর্যবেক্ষণ ছিল। তাতে বলা হয়েছিলÑ একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা অনৈতিক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবিধানবহির্ভূত। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শনিবার হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ঐকমত্যের সরকারের বিরোধিতা করেছেন। এখানে ঐকমত্যের ধারণার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু ঐকমত্যের ব্যানারে যাদের পেলাম তারা সবাই মূলত আগের মহাজোট সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাতে ‘ঐকমত্য’ সরকার হলো কোথায়? অনেকেই এটা স্বীকার করবেন, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে একটা ঐকমত্যের সরকারের প্রয়োজন ছিল। এটা ভালো হতো যদি সব দল ও মতের প্রতিনিধিত্ব এই মন্ত্রিসভায় থাকত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকেও এ মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। কেননা, পরিস্থিতি এটাই দাবি করে। তবে সংবিধান যেহেতু ‘সংসদ সদস্য নন’ এমন লোকদের নিয়ে মন্ত্রী করার বিধান সীমিত, এক্ষেত্রে টেকনোক্রেট কোটায় কিংবা উপদেষ্টা পরিষদে তাদের রাখা যেত। মন্ত্রিসভায় সব মতের প্রতিনিধিত্ব থাকলে, সঙ্কট সমাধানের পক্ষে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা হলো না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। গেজেটে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাকে সে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার দল যখন মন্ত্রিসভায় থাকে, তখন তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ছুরিকাঘাতের শামিল। বেশ কিছুদিন ধরেই জাতীয় পার্টির মাঝে একটা ধারা লক্ষ্য করা গেছেÑ আর তা হচ্ছে, মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ! এখন রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে তারা নিজেরা মন্ত্রী হলেন। আমি এর আগেও বলেছি এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টির একটা অংশ আওয়ামী লীগের মাঝে বিলীন হয়ে যাবে, অপর অংশ চলে যাবে বিএনপিতে। এরশাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও তার সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে তৃতীয় দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। অতীতেও একাধিকবার জাতীয় পার্টি ভেঙেছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জু কিংবা সর্বশেষ কাজী জাফর মূল দল ত্যাগ করে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কিংবা নাজিউর রহমান মঞ্জু ‘এক দল এক নেতা’ হিসেবে বিবৃতির মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখলেও লাভবান হয়েছেন এক জায়গায়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আবারও মন্ত্রী হয়েছেন। আর নাজিউর রহমান মঞ্জুর অবর্তমানে তার ছেলে দলটিকে ভোলাকেন্দ্রিক একটি দলে পরিণত করেছেন। সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত জাতীয় পার্টির কারোরই নেই। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে, মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার জন্যই যেন রাজনীতি! আর এ রাজনীতির কারণেই জাতীয় পার্টি আগামীতে তার অস্তিত্ব হারাবে। বুধবার খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে নয়া কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তার বক্তব্যের অনেক দিক আছে। প্রথমত, তিনি কোনো অবরোধ আর হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেননি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার। তিনি বোধকরি উপলব্ধি করেছেন, হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এ সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের যেমনি সমর্থন থাকে না, ঠিক তেমনি বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও তা সমর্থন করে না। বিএনপি ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছিল, তাতে কূটনীতিকরা সবাই ওই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, ‘চাপ’ প্রয়োগ করার জন্য এ ধরনের সমাবেশ বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত। তৃতীয়ত, বিএনপি ২৯ জানুয়ারি কালো পতাকা প্রদর্শনের ডাক দিয়েছে। সবার জানা ওই দিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে। চতুর্থত, খালেদা জিয়া আবার প্রতিটি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করার কথা বলেছেন। এটাও ভালো দিক। এতে করে কর্মীদের ধরে রাখা ও উজ্জীবিত করা সহজ হবে। পঞ্চমত, খালেদা জিয়া সংলাপের কথা বলেছেন। এই প্রচেষ্টাও ভালো। মূলত একটি সমঝোতা ও সংলাপের কথা সবাই বলছেন। দাতাদের কাছ থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে এ সংলাপের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। খালেদা জিয়ার এ আহ্বান নিঃসন্দেহে এখন একটি সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থা না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আপাতত সহিংসতানির্ভর রাজনীতির অবসান ঘটল। ক’দিন পরই ভাষার মাস। সুতরাং ভাষার মাসে বিএনপি কোনো বড় কর্মসূচি দেবে না, এটাই প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস। এ মাসেও বিএনপি হরতাল আর অবরোধের মতো কর্মসূচি দেবে না, এটাও ধারণা করা যায়। কিন্তু তাতে করে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান হবে কি? আমার মনে হয় না। সরকার যদি কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে সমস্যা যা ছিল, তা থেকে যাবে। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর ‘রাজনীতির বল’টা এখন স্পষ্টতই সরকারের কোর্টে। সরকার যদি সংলাপের ব্যাপারে আন্তরিক না হয়, তাহলে সমস্যা যেভাবে ছিল, সেভাবেই থেকে যাবে। বরং তাতে জটিলতা আরও বাড়বে। খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কছেদের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে বলেছেন, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল, এর সঙ্গে অনেকেই ঐক্য করেছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, তিনি হয়তো এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেবেন। কৌশলগত কারণে সম্পর্কছেদের বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন। এর আগে তো তিনি একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে স্পষ্ট করেছেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। আমরা যারা রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি, তারা সবাই জানি রাজনীতি বিষয়ে সেই বিখ্যাত উক্তিটি ‘রাজনীতিতে স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই, স্থায়ী কোনো শত্রু নেই।’ এটা তো সত্য, এ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। ১৯৮৬ সালে দেশে যখন তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (এরশাদীয় জমানায়), তখন বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। সুতরাং রাজনীতিতে ‘স্থায়ী শত্রু, স্থায়ী মিত্র’-এর ধারণা থেকে বিএনপি-জামায়াত ঐক্য টিকে আছে। আগামীতে এ ঐক্য নাও টিকে থাকতে পারে। তাই বোধকরি খালেদা জিয়া বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি এবার যাচ্ছেন ধীরগতিতে। নির্বাচনটা হয়ে গেছে। মন্ত্রিসভাও হয়ে গেছে। এটাই বাস্তবতা। এই মন্ত্রিসভা নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, নির্বাচন নিয়ে যত বিরূপ মন্তব্যই আসুক না কেন, সরকার এটাকে আদৌ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়নি। তাই বিএনপি তথা ১৮ দলের কাছে বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ১৮ দল এখন হরতাল নয়, বরং মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখেই তাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছে। এ কারণেই দেখা যায়, বিএনপি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার পুরো বিষয়টিই এখন নির্ভর করছে সরকারের ওপর। Daily Alokito Bangladesh 22.01.14

ইতিহাসে কীভাবে চিহ্নিত হবে?

গত বৃহস্পতিবার দশম সংসদের ২৮৩ সদস্য শপথ নিয়েছেন। আর শনিবার নিলেন এরশাদ। পুরো মন্ত্রিসভা গঠিত হলো রোববার। এর মধ্য দিয়ে দশম সংসদ তার যাত্রা শুরু করল। তবে এই সংসদ নিয়ে ‘কিছু’ এবং ‘কিন্তু’ আছে। বৃহস্পতিবারের ওই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বড় ধরনের সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ৬৫ (২) ধারায় বলা আছে ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।’ এর অর্থ যারা শপথ নিয়েছেন তারা সংবিধান মোতাবেক বৈধ কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ এখনো বহাল আছে। আরো মজার ব্যাপার ১২২ আসনে এখন দুজন করে এমপি! এটা তো স্পষ্টতই সংবিধানের ৬৫(২) ধারার বরখেলাপ। আমি জানি না প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা তাকে বিষয়টির কীভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরো একটা মজার কাহিনী আমাকে শুনিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ যিনি নয়া মন্ত্রিসভায়ও আছেন। তিনি জাতীয় পার্টির নেতা। বৃহস্পতিবার তিনি আমার সঙ্গে এটিএন নিউজের টকশোতে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। তিনি বললেন, জাতীয় পার্টি সরকারেও থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। কী অদ্ভুত কথা! গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের কথা কেউ কখনো শোনেনি। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদের এ ধরনের কথা শোনাচ্ছেন! রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি কোথাও পাইনি যে, দল একইসঙ্গে সরকারের থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে। আমরা গণতন্ত্রের এ কোন রূপ বাংলাদেশে দেখছি?
বৃহস্পতিবার এমপিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি সম্পর্কে যে ‘গুজব’ এতদিন ভাসছিল তা বাস্তবে রূপ পেল। শপথ গ্রহণের আগেরদিন রওশন এরশাদ ‘জীবনের প্রথমবারের মতো’ সংবাদ সম্মেলনে করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তিনিই হতে যাচ্ছেন সংসদ বিরোধী দল নেতা। এরশাদ নন কেন? জবাবটা সোজাসাপ্টা। যেহেতু এরশাদ রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাই তার পক্ষে বিরোধীদলীয় প্রধান হওয়া শোভা পায় না। অথচ তিনি কিনা বিশেষ দূত হলেন এখন। কি দুর্ভাগ্য এ জাতির! সংবাদ সম্মেলনে একটা কথা বললেই হলো। এর পেছনে সত্যতা আছে কী নেই, এর বাছবিচার অনেকেই করেন না। পৃথিবীর অনেক দেশের দৃষ্টান্ত দেখা যাবে, যেখানে সরকারপ্রধানরা ক্ষমতা হারানোর পর বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। বেগম রওশন এরশাদের সংবাদ সম্মেলনে তার ডান পাশে বসা ছিলেন পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। হাওলাদার সাহেব এতদিন বারবার বলে আসছেন তিনি প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন করেছেন, তার দল নির্বাচন বয়কট করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই হাওলাদার সাহেব কিনা শপথ নিলেন! তারাই আমাদের জাতীয় নেতা! তারাই মন্ত্রী হন! জনগণের সেবক! বিভ্রান্তিকর কথার্বাতা আর সুবিধাবাদিতার রাজনীতি পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপির বিকল্প হিসেবে জাতীয় পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল। এখন জাতীয় পার্টির এই ভূমিকা বিশেষ করে এইচএম এরশাদের দ্বৈত ভূমিকা জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে। একসময় ১৯৮৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব দেশে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবর্তমানে (নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণে) সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছিলেন আ স ম আবদুর রব। কিন্তু মানুষ রব সাহেবকে সেদিন কীভাবে সম্বোধন করেছিল, তা নিশ্চয়ই আমাদের অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা! এরশাদ সাহেবও নিশ্চয়ই তা ভুলে যাননি। গত শনিবার ‘অনেক নাটকের পর’ তিনি শপথ নিলেন। গণমাধ্যম জানাচ্ছে, শপথ অনুষ্ঠানে তিনি হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। আগে যেভাবে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বারবার বলে আসছিলেন তার দল নির্বাচনে যাবে না, তিনি তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন কী হলো? ‘অসুস্থ’ হয়ে তিনি আবার চলে গেলেন সিএমএইচএ তারপর বাড়িতে। এরশাদের এই ভূমিকাকে আমরা কী বলব? নাটক? তিনি সেনাবাহিনীপ্রধান ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ৯ বছর দেশ চালিয়েছেন। একবারও কী মনে হলো না তার এই ‘অভিনয়’ মানুষ বোঝেন! আমরা অসাংবিধানিক শক্তিকে চাই না। সাংবিধানিক শক্তিকেই চাই। কিন্তু এই সাংবিধানিক শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিরা যখন বিভ্রান্তিকর কথা বলেন, তখন আস্থার জায়গা আর থাকে না। আমরা তো  রাজনীতিবিদদের কাছেই বারবার ফিরে যেতে চাই। তারাই দেশ চালাবেন। দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি ‘অসুস্থ’ হলেন। ‘অসুস্থ’ হয়ে গলফ খেললেন। আবার শপথ নিতেও ভুললেন না। তরুণ প্রজন্ম এসব রাজনীতিবিদের কাছ থেকে কী শিখবে? তরুণ প্রজন্ম যারা রাজনীতি করতে আগ্রহী তারা কী এসব ঘটনায় অনুপ্রাণিত হবে  আদৌ? একজন ‘অসুস্থ এরশাদ’ এখন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত!
‘নির্বাচন’ হয়ে গেছে। এই ‘নির্বাচন’ নিয়ে যত প্রশ্নই উঠুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদের ২৯২ জন সদস্য শপথ নিয়েছেন। সংবিধান মোতাবেক তারা এখন সংসদ সদস্য তবে সরকারি ভাষ্যমতে, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ২৪ তারিখের পর। নবম সংসদ বিলুপ্ত হলো না। নিয়মমাফিক ২৪ তারিখ ওই সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং দশম সংসদ তার কার্যক্রম শুরু হবে। এই নির্বাচন এবং শপথ গ্রহণ নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংবিধানের ১৪৮ ২(ক) অনুযায়ী সরকারি গেজেট প্রকাশের ৩ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণের যে কথা বলা হয়েছে, সেটা অনুসরণ করে সংসদ সদস্যরা (দশম সংসদ) শপথ নিয়েছেন। এটা সংবিধান অনুযায়ী করা হয়েছে কিন্তু ১৪৮(১) যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে দেখব এই ধারাবলে যে শপথ গ্রহণ হলো তা ৬৫(২) ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৪৮(১) ধারাটা এ রকম তৃতীয় তফসিলে উল্লেখিত যে কোন পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যগ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল অনুযায়ী শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন। এর অর্থ কী? এমপি সাহেবরা শপথ নিয়েছেন কার্যগ্রহণের পূর্বে। অর্থাৎ ৯ তারিখ থেকেই তিনি সংসদ সদস্য! কিন্তু ১২২টি আসনে যেখানে অন্য এমপি রয়েছেন তাদের কী হবে? সংবিধানের কোথাও কিন্তু বলা হয়নি নয়া এমপি দায়িত্বগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো এমপি আর তার দায়িত্বে থাকবেন না। এখানে এক ধরনের জটিলতা রয়েছে। দেশের আইনজীবীরাও এ ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত। এ দেশে যিনি আজীবন কোম্পানি আইন পড়েছেন, কোম্পানি আইনে মামলা-মোকাদ্দমা করেন, তিনি হয়ে যান সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তারা তাদের মতো করে সংবিধানের ব্যাখ্যা দেন। এখন শপথ গ্রহণের বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, সে ব্যাপারে যে কেউ উচ্চ আদালতের কাছে একটা রেফারেন্স চাইতে পারেন। এমনকি সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কিংবা ড. কামাল হোসেন যারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত তারা স্ব-উদ্যোগে একটা রিট করতে পারবেন। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা ভালো। এমনকি সরকার নিজেও সব বিতর্ক এড়াতে উচ্চ আদালতের কাছে মতামত চাইতে পারত। আরো জটিলতা আছে। রোববার মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। দশম সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী নেয়া হয়েছে। এটাই নিয়ম। কিন্তু এই শপথ যদি ২৪ জানুয়ারির পরে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। এখানে ‘সংসদ সদস্যদের’ ব্যাপারটি নিয়ে একটা গোলমাল লেগে যেতে পারে। একটা মন্ত্রিসভা হলো যখন নবম জাতীয় সংসদ বহাল। আর মন্ত্রিসভা হলো দশম জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে। তাহলে কেউ তো প্রশ্ন করতেই পারেন এটা সংবিধানের বরখেলাপ নয় কি? এই মন্ত্রিসভা ২৪ তারিখের পরে গঠিত হলে ভালো হতো। শোভন হতো। কোনো জটিলতা থাকত না। কোনো প্রশ্নও থাকত না। নিশ্চই সরকারপ্রধান তথা সরকারের উপদেষ্টারা সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সংবিধানের প্রসঙ্গটি বাদই দিলাম। নির্বাচনের পর কোনো দেশ থেকে অভিনন্দন বার্তা এসেছে কি? এমনকি ভারতের কাছ থেকে যে বার্তা এসেছে, সেখানে সেই অর্থে অভিনন্দন সূচক কোনো বক্তব্য ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ খবর এসেছে। গত ৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের ১১৩তম কংগ্রেসে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৫ জন সিনেটর রিচার্ড ডারবিন, জন বুজম্যান, বারবারা বস্কার, মাইকেল বি, এজি ও সিনেটর ক্রিস্টোফার এস মার্ফি গত ১১ ডিসেম্বর এই প্রস্তবাটি পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে পাঠান। এটি নিয়েই আলোচনা হয়। সিনেটর গৃহীত প্রস্তাবে ৬টি বিষয় রয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সত্যিকার অর্থে সংলাপ, অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ, নির্বাচক পর্যবেক্ষদের নিরাপত্তা প্রদান, তারানকোর উদ্যোগের প্রতি সমর্থন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনডেজ দু’নেত্রীকে (প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী) যে চিঠি দিয়েছেন তাতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানো, সহিংসতা বন্ধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনডেজের চিঠিটি ছাপা হয়েছে গত শনিবার। সিনেটের প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্যে দিয়ে যে মেসেজ আমরা পাচ্ছি, তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ‘সংলাপ’ শুরু করা। এদিকে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক ব্রিটিশ সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ।
এমনি এক পরিস্থিতিতে একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে গত রোববার। সংবিধানের ৫৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে ‘একজন প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকিবেন।’ একই সঙ্গে (২) ধারায় বলা হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে তাহাদের সংখ্যার কমপক্ষে নয় দশমাংশ সংসদ সদস্যদের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন...।’ সমস্যাটা হয়েছে এখানেই। যেখানে ‘সংসদ সদস্যদের’ মধ্য থেকে কথাটা বলা হয়েছে, সেখানে দুই সংসদের (নবম ও দশম) অস্তিত্ব বজায় থাকায় সেখানে দশম সংসদ থেকে মন্ত্রী নেয়ায় একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এই মন্ত্রিসভার বৈধতা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। একইসঙ্গে মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি মন্ত্রিসভাকে বড় ধরনের বিতর্কের মাঝে ফেলে দিয়েছে। যতদূর জানা যায়, ২০০৬ সালে হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি পর্যবেক্ষণ ছিল। তাতে বলা হয়েছিল একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা অনৈতিক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবিধানবহির্ভূত। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত শনিবার হাইকোর্টের ওই পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ঐকমত্যের সরকারের বিরোধিতা করেছেন। এখানে ঐকমত্যের ধারণার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু ঐকমত্যের ব্যাপারে যাদের পেলাম, তারা সবাই মূলত আগের মহাজোট সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাতে ‘ঐকমত্য সরকার’ হলো কোথায়? অনেকেই এটা স্বীকার করবেন যে, বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে একটা ঐকমত্যের সরকারের প্রয়োজন ছিল। এটা ভালো হতো যদি সব দল ও মতের প্রতিনিধিত্ব এই মন্ত্রিসভায় থাকত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকেও এই মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতে পারতেন। কেননা পরিস্থিতি এটাই দাবি করে। তবে সংবিধান যেহেতু ‘সাংসদ নন’ এমন কাউকে নিয়ে মন্ত্রী করার বিধান সীমিত, এক্ষেত্রে টেকনোক্র্যাট কোটায় কিংবা উপদেষ্টা পরিষদে তাদের রাখা যেত। মন্ত্রিসভায় সব মতের প্রতিনিধিত্ব থাকলে, সংকট সমাধানের পথে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা হলো না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা দরকার। গেজেটে রওশন এরশাদকে বিরোধী দল নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাকে সেই মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার দল যখন মন্ত্রিসভায় থাকে, তখন তা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর ছুরিকাঘাতের শামিল। বেশকিছু ধরেই জাতীয় পার্টির মাঝে একটা ধারা লক্ষ্য করা গেছে আর তা হচ্ছে মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ! এখন বেগম রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে তারা নিজেরা মন্ত্রী হলেন। আমি এর আগেও বলেছি এরশাদের অবর্তমানের জাতীয় পার্টির একটা অংশ আওয়ামী লীগের মাঝে বিলীন হয়ে যাবে, অপর অংশ চলে যাবে বিএনপিতে। এরশাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও তার সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে তৃতীয় দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। অতীতেও একাধিকবার জাতীয় পার্টি ভেঙেছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জু কিংবা সর্বশেষ কাজী জাফর মূল দল ত্যাগ করে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কিংবা নাজিউর রহমান মঞ্জুর ‘এক দল এক নেতা’ হিসেবে বিবৃতির মাধ্যমে তাদের অস্থিত্ব বজায় রাখলেও লাভবান হয়েছেন এক জায়গায়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আবারো মন্ত্রী হয়েছেন। আর নাজিউর রহমান মঞ্জুর অর্বতমানে তার ছেলেরা দলটিকে ‘ভোলাকেন্দ্রিক’ একটি দলে পরিণত করেছেন। আগামীতে বিএনপি যদি সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে পার্থ কিংবা কাজী জাফর আবারো মন্ত্রী হতে পারেন। বিতর্কিত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা ৪৮ সদস্যবিশিষ্ট যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন তাতে তেমন কোনো চমক নেই। তবে এটা ঠিক বেশকিছু বিতর্কিত ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ‘সাবেক মন্ত্রীদের’ নয়া মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেননি। অযোগ্য, অতি কথার প্রিয় ব্যক্তিরাও ঠাঁই পাননি। এতে তিনি প্রশংসা পেতেই পারেন। আবার যখন দেখি বিতর্কিত নির্বাচনে এবারে ‘বিজয়ী’ হয়েই সরাসরি শপথ নিয়েছেন, তখন আস্থার জায়গাটা ফিকে হয়ে আসে। আসলে কোন নীতিমালার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এই মন্ত্রিসভা জাতির আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। যারা অতি কথা বলেন এবং বিরোধী দলের সঙ্গে যে কোনো সমঝোতায় যেতে প্রধান অন্তরায়, তারাও রয়ে গেছেন মন্ত্রিসভায়। এতে কি ঐকমত্যের সরকার হবে?
গতকালের আরো একটি খবর নতুন নির্বাচন চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। এই রিটটি করেছেন নবম সংসদের বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক। এই রিটের ভবিষ্যৎ কী আমরা জানি না। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টিকে আমরা আবারো আদালতে নিয়ে গেলাম। এ প্রবণতা ভালো নয়। রাজনীতির বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হওয়া উচিত। তাই তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবেন, জানি না। কিন্তু এটা সত্য যে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার জন্য বিএনপির সঙ্গে ‘সমাঝোতা’ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ‘অবরোধ আর হরতালের’ কর্মসূচি পরিত্যাগ করেছে, এটা মনে হয় না। যদিও রাজধানীতে অবরোধ আর তেমনভাবে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না আগের মতো। কিন্তু ‘সংসদের বাইরে’ থাকা, বিএনপির এই কর্মসূচি ছাড়া বিকল্প কিছু আছে কি? ‘নির্বাচন’ হয়েছে। সেখানে যত কম ভোটই পড়–ক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই নির্বাচন বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার ‘মৃত্যু’ ঘটাল। সরকার এই নির্বাচন দিয়ে তার ‘লেজিটেমেসি’ বাড়িয়েছে। সুতরাং আগামী দিনগুলো নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। 
Daily Manobkontho 16.01.14

বিরোধীদল বিরোধীদলই,এর অভাব অপূরণীয় : ড. তারেক

সরকারের শুদ্ধিতার ও সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার জন্য বিরোধীদলের কোন বিকল্প নেই।

দশম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ এক তরফা জয়ী হলেও বিরোধীদলহীন নির্বাচনকে কখনই গণতান্ত্রিক পর্যায়ে ফেলা সম্ভব নয়। বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে এ কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আšত্মর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান। এই অনুষ্ঠানে অন্য অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।

অডিও ক্লিপটি শুনতে নিচে ক্লিক করুন...



ঐকমত্যের সরকারের বৈধতা প্রসঙ্গে ড. তারেক বলেন, বিরোধীদল ব্যতিরেকে নির্বাচন কখনই ঐকমত্যের পর্যায়ে আসে না। আওয়ামী লীগ জাসদ, ওয়াকার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি ও জেপিকে নিয়ে নির্বাচন করে। বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় সংসদ গঠনে জাতীয় পার্টি বাদে বাকি তিনটি দলের ভোট সংখ্যা খুবই সামান্য। এক্ষেত্রে সরকারকে ঐকমত্যের বলা গেলেও বা¯ত্মবে জাতীয় ঐকমত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন আছে।

এই প্রসঙ্গে মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, যদিও অর্ধেকেরও বেশি ভোটা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নি কিন্তু এই নির্বাচনে প্রধানদল ও বিরোধীদলের উপস্থিতি প্রমাণ করে এই সরকার ঐকমত্যের। তারপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায় সেটা হল প্রধান বিরোধীদল। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি যদি আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে তবেই সরকার ঐকমত্যের সরকার হিসেবে আখ্যায়িত হবে। প্রধানত সবদলকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার গঠনে সরকারের উদ্যেগ প্রয়োজন।

ড. তারেক আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দশম জাতীয় সংসদ অন্যতম ব্যতিক্রমি অধ্যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত বিরোধী দল কিভাবে সরকারের সমালোচনা করবে? তিনি এমন প্রশ্ন রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, এক অর্থে সরকার অন্য অর্থে বিরোধীদল এটাই প্রমাণ করে দশম সংসদ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ জগাখিচুড়ি সমতুল্য। গণতন্ত্রের যাত্রায় এই নির্বাচন একটা বড় বাধা এবং এটা বাজে দৃষ্টাšত্ম।


দেশি বিদেশি মহলের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাসে বাংলাদেশই একমাত্র নজিরবিহীন উদাহরণ তৈরি করেছে। বিরোধীদল বরাবরই সরকারের সমালোচক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক অপরের বিরোধীদল থাকাবস্থায় সংসদে আসার প্রবণতা মোটামুটি কম। সেই অর্থে বাংলাদেশে সক্রিয় বিরোধীদল কখনই ছিল না। গ্রহণযোগ্যতা তখনই স্বার্থকতা পায় যখন জনমনে স্ব¯িত্মর আস্থা তৈরি হয় । শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নকরণ, অর্থনীতির চাকা সচলীকরণ এবং সংলাপের দরজা উন্মুক্ত রাখাই যেন হয় সরকারের একনিষ্ঠ প্রত্যয়।এই প্রত্যয় ঐকমত্য সরকার গঠনের একমাত্র চাবিকাঠি।

কেমন হবে ২০১৪ সালের বিশ্ব

কেমন হবে ২০১৪ সালের বিশ্ব রাজনীতি? ২০১৩ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব থাকলেও তা কি ২০১৪ সালের রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গেল বছর কংগ্রেসের সঙ্গে বাজেট তথা সরকারের ব্যয় নিয়ে বড় ধরনের বিবাদে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, এর রেশ কি চলতি বছরেও থাকবে? যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, গেল বছরের বিশ্ব রাজনীতির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা চলতি বছরের বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনা থাকবে। বিশেষ করে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের ব্যাপ্তি এবং সেখানে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র গ্র“পগুলোর উত্থান শুধু ওই অঞ্চলের রাজনীতিই নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে এবং মার্কিন নীতিনির্ধারকদের একটা বড় চিন্তায় ফেলে দেবে। 
চলতি বছর ভারতসহ বেশ ক’টি গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং ভারত একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পাবে। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও মনমোহন সিং আর প্রধানমন্ত্রী হবেন না। চলতি বছরের শুরুতে তিনি এ কথা জানিয়ে এটা বলতেও ভুল করেননি, তিনি চান রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি নিক। যদিও এটা স্পষ্ট নয় রাহুলের আদৌ প্রস্তুতি রয়েছে কিনা। দলীয় রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও প্রশাসনে তিনি কখনও থাকেননি। তার অভিজ্ঞতা নেই। কংগ্রেস জোট ক্ষমতা পেলেও রাহুল গান্ধীর জন্য বিষয়টি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার আরও অনেকে। অন্যদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজেপির প্রার্থী। গেল বছরের শেষের দিকে ভারতে ৫টি রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির বড় বিজয় নরেন্দ্র মোদির জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির মনোনয়ন লাভ খোদ ভারতের গণতন্ত্রের জন্য একটি কলংক। কারণ ২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য মোদিকে অভিযুক্ত করা হয়। ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। যাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলমান। গত ১০ বছরেও মোদি এ অভিযোগ কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
 তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে কখনও ভিসা দেয়নি। আগামী এপ্রিল-মে মাসে ভারতে লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে ভারতের রাজনীতিতে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা প্রবণতা চলছে, আর তা হচ্ছে কোয়ালিশন রাজনীতি। কংগ্রেসের নেতৃত্বে রয়েছে ইউপিএ বা ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স। ইউপিএ জোটে রয়েছে বেশ ক’টি আঞ্চলিক দল। বিজেপির নেতৃত্বেও রয়েছে একটি জোট- ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স (এনডিএ)। বামদের নেতৃত্বেও রয়েছে একটি জোট। ধারণা করা হয়, চলতি লোকসভা নির্বাচনের পরও এ জোট রাজনীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। কংগ্রেস অথবা বিজেপির পক্ষে এককভাবে বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। তবে এটা বলতেই হবে, দিল্লির রাজ্য সরকারের নির্বাচনে আম আদমি পার্টি তথা অরবিন্দ কেজরিওয়ালার উত্থান (যিনি এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী) ঘটলেও জাতীয় রাজনীতিতে তার দলের আদৌ কোনো ভূমিকা থাকবে না। কেননা ভারতব্যাপী এ দলের কোনো অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় নির্বাচনে তিনি ‘চমক’ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনটা একটা ভিন্ন বিষয়। চলতি বছর ভারতের পাশাপাশি আফগানিস্তান, ইরাক, দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। 
সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে দ্বিতীয় দফা ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাশিদ তা মেনে নিয়েছেন। গেল বছর পাকিস্তানে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং নওয়াজ শরিফ আরও একবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে পাকিস্তানে। প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান অবসরে গেছেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী নিয়মমাফিক অবসরে যাওয়ার পর তাসাদ্দুক হোসেন জিলানি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। আর জেনারেল কায়ানির টার্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পর জেনারেল রাহিল শরীফ নয়া সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে চলতি বছর শরিফের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাহরিক-ই-তালিবানকে নিষ্ক্রিয় করা এবং তাদের জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা। মূলত তাহরিক-ই-তালিবান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ অঞ্চলে বর্তমানে ইমরান খানের দল তাহরিক-ই-ইনসাফ সরকার গঠন করেছে। ধারণা করা হয়, ইমরান খানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দল হিসেবে পরিচিত তাহরিক-ই-তালিবানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে সীমান্ত অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শরিফ এ হামলা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানালেও তা রক্ষিত হয়নি। এটা খোদ নওয়াজ শরিফের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের জন্য একটা বড় খবর হল, একটা নির্বাচিত সরকার তার ৫ বছরের টার্ম পূরণ করেছে। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। ওবামা এ প্রতিশ্র“তি দিলেও তিনি তা কতটুকু রাখতে পারবেন, সেটা একটা প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সঙ্গে একটা নিরাপত্তা চুক্তি করতে চাইলেও তা হয়নি। এক্ষেত্রে চলতি বছর আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ৬ এপ্রিল সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কারজাই আর তৃতীয়বারের মতো দাঁড়াতে পারছেন না। অনেকেরই ধারণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটা উপস্থিতি সেখানে থাকবেই। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়বে। খোদ নেপালও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করল। পাকিস্তান ও নেপাল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। নেপালে মাওবাদীরা সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচনে ভালো ফলাফল করেনি। তবে ভালো খবর হল, তারা শেষ অবধি অধিবেশনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যেসব দেশ গণতন্ত্র চর্চা করে, তাদের জন্য ‘খারাপ’ খবর আছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ড আর ইউক্রেনে সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। থাইল্যান্ডে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি মূলত দু’পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে ‘রেড শার্ট’, আন্দোলন, যারা সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলন, যারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী ইংলাক ২ ফেব্র“য়ারি নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলনকারীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। একপর্যায়ে সেনাপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ‘রেড শার্ট’ আর ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলনের কারণে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র একটি বড় প্রশ্নের মাঝে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইংলাক এভাবে ‘রেড শার্ট’ আন্দোলনকারীদের উস্কে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি তার ভাই থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে (সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) দায়মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে সংসদে একটি বিল এনেছেন। ইউক্রেনের অবস্থাও ঠিক তেমনি। ২০০৪ সালের ‘কমলা বিপ্লব’ এখন ব্যর্থ হতে চলেছে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি বাতিল এবং রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গেল বছর (২০১৩) ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের মৃত্যু এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাসান রুহানির অভিষেক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ করে একসময় হেরে গেছেন হুগো শ্যাভেজ। তার মৃত্যুর পর তিনি যে ‘সমাজতন্ত্রের নতুন এক ধারা’ প্রবর্তন করেছিলেন, তা কতদিন স্থায়িত্ব পায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। আরব বিশ্বে ‘আরব বসন্ত’ যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, তার এখন ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। ‘আরব বসন্ত’ সেখানকার দীর্ঘদিনের শাসকদের (তিউনিশিয়ায় জইন আবেদিন বেন আলী, মিসরে হোসনি মোবারক, ইয়েমেনে সালেহ, লিবিয়ায় গাদ্দাফি) ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলেও সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। উপরন্তু মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তিউনিশিয়ায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। চলতি বছরে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে ‘আরব বসন্ত’ পুরো আরব বিশ্বে জঙ্গিবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটিয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে সেখানে একটি বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে ইসলামী জঙ্গিদের একটি কোয়ালিশন। লিবিয়ায়ও এরা শক্তিশালী। আর ইরাকে জঙ্গিদের তৎপরতা দেশটির অস্তিত্বকেই একটি বড় হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সিরিয়ায় গেল বছর মার্কিন বিমান হামলা এড়ানো গেছে সত্য, কিন্তু যদি সেখানে কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে বিমান হামলা হতে পারে। জেনেভা-২ আলোচনা জানুয়ারিতে শুরু হবে। কিন্তু একটা প্রশ্নের কোনো সমাধান এখনও হয়নি- আর তা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট আসাদ ক্ষমতায় থাকবেন নাকি একটা নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিহার করবেন? চলতি বছরের মাঝামাঝি সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনে তিনি যদি প্রার্থী না হন, তাহলে সমাধানের একটা পথ বের হতে পারে। তাই জেনেভা আলোচনার দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। তবে চূড়ান্ত বিচারে এ আলোচনায় সিরীয় সরকারের প্রতিনিধিরা যদি অংশ না নেন, তাহলে তা কোনো ‘ফল’ বয়ে আনবে না। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ নিয়ে আরও একটা ভয়- তা হচ্ছে, প্রায় ৫৫ হাজার শরণার্থী বর্তমানে জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের যদি স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে তারা জর্ডানে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে সেখানকার সরকারের পতন ঘটাতে পারে। এ শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘকে ব্যয় করতে হবে ৫৩০ কোটি ডলার। দীর্ঘদিন এ ব্যয় বহন করা জাতিসংঘের জন্য সম্ভবও নয়। তাই জেনেভা আলোচনায় কোনো ফল পাওয়া না গেলে সীমিত বিমান হামলার (লিবিয়ার মতো) সম্ভাবনা ২০১৪ সালে বাড়বে। তুরস্কে কী পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের। আগস্টে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই প্রথমবারের মতো সেখানে সরাসরি জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এরদোগান তিনবারের বেশি আর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। ধারণা করা হচ্ছে, তায়িপ এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। তুরস্কের রাজনীতির উত্থান-পতনের সঙ্গে সিরিয়ার রাজনীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় স্বার্থ রয়েছে তুরস্কে। কারণ সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনে (যা তুরস্কও চাইছে) পশ্চিমা বিশ্বের তুরস্কের সমর্থন প্রয়োজন। সুতরাং এ অঞ্চলের রাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সেই সঙ্গে পূর্ব চীন সাগরে উত্তেজনা কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন (৯ জুলাই) দৃষ্টি কাড়বে অনেকের। সুতরাং ২০১৩ সালের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের বিশ্ব রাজনীতিতেও উত্তেজনা থাকবে। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের এক-তৃতীয়াংশ (সিনেটের ৩৫) আসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী। এক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। বাংলাদেশে একটি নতুন সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। তারা কীভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করেন, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেক পর্যবেক্ষকের। মোদ্দাকথা, ২০১৪ সালেও বিশ্ব রাজনীতিতে থাকবে উত্তেজনা ও সংকট। 
Daily JUGANTOR ১৪ জানুয়ারি, ২০১৪

মন্ত্রিসভা নিয়ে নানা প্রশ্ন

শেষ পর্যন্ত নয়া মন্ত্রিসভা রবিবার শপথ নিল। বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই এই মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। আর এই মন্ত্রিসভা গঠিত হলো এমন একসময়, যখন নবম জাতীয় সংসদ এখনো বহাল আছে। সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নবম জাতীয় সংসদের আয়ুষ্কাল। নবম জাতীয় সংসদকে বহাল রেখে দশম জাতীয় সংসদের সদস্যদের শপথ ও মন্ত্রিসভা গঠন একটি সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, সংবিধানের ৫৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'একজন প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী থাকিবেন'। এ ধারা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু প্রশ্ন আছে ৫৬(২) ধারা নিয়ে। এখানে বলা হয়েছে, 'প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে তাহাদের সংখ্যার অনূন্য নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন...'। সমস্যাটা হয়েছে এখানেই। যেখানে 'সংসদ সদস্যের' মধ্যে থেকে কথাটা বলা হয়েছে, সেখানে দুই সংসদের (নবম ও দশম) অস্তিত্ব বজায় থাকায় দশম সংসদ থেকে মন্ত্রী নেওয়ায় একটি জটিলতা তৈরি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তিতে একটি রাজনৈতিক ও একই সঙ্গে সাংবিধানিক বিতর্কও সৃষ্টি হতে পারে। এরশাদ মন্ত্রী পদমর্যাদায় বিশেষ দূত হয়েছেন, যা তিনি দাবি করে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। এর বাইরে জাতীয় পার্টি একজন পূর্ণ মন্ত্রী ও দুজন প্রতিমন্ত্রী পেয়েছে। অথচ বেগম রওশন এরশাদ এখন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। সেভাবেই গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের 'সুবিধাতন্ত্র', 'গোষ্ঠীতন্ত্র' চালু হলো। সংসদীয় গণতন্ত্রে যেখানে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে, সেখানে জাতীয় পার্টির এই ভূমিকা শুধু গণতন্ত্রের বিকাশকেই বাধাগ্রস্ত করবে না, বরং রাজনীতিবিদদেরই হেয়প্রতিপন্ন করবে। যত দূর জানা যায়, ২০০৬ সালে উচ্চ আদালতে এ-সংক্রান্ত একটি পর্যবেক্ষণ ছিল। তাতে বলা হয়েছিল, একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা অনৈতিক, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবিধানবহির্ভূত। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত শনিবার হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে ঐকমত্যের সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন। তৃতীয়ত, এরশাদের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি কলঙ্ক। তাঁর মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিশেষ দূতের দায়িত্ব নেওয়া রওশন এরশাদের বক্তব্যের বরখেলাপ। রওশন এরশাদ এর আগে বলেছিলেন, 'এরশাদ সাহেব রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে বিরোধীদলীয় প্রধান হওয়া শোভা পায় না।' এখন মন্ত্রীর পদমর্যাদা তিনি পেলেন বটে; কিন্তু তিনি তাঁর হারানো সম্মান ফিরে পাবেন বলে মনে হয় না। তিনি ইতিহাসে ধিক্কৃত একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে চিহ্নিত হবেন এখন। চতুর্থত, সৈয়দ আশরাফের কথা অনুযায়ী 'যাঁরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি, মন্ত্রিসভায় তাঁদের জায়গা হয়নি।' কিন্তু নয়া মন্ত্রিসভায় অনেক অদক্ষ মন্ত্রী রয়েছেন। তা সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে সমর্থন করে না। পঞ্চমত, অতিকথন, দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি বলা হলেও এটাও ধোপে টেকে না। কেননা 'অতিকথক' হিসেবে খ্যাত জনৈক প্রতিমন্ত্রী পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন এমন অনেক ব্যক্তির ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। এখন এসব ব্যক্তির কারণে সরকার বিতর্কিত হয়ে পড়তে পারে। ষষ্ঠত, সংস্কারবাদী হিসেবে খ্যাত কয়েকজন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন। তাঁরা এখন দল বা সরকারে কতটুকু সংস্কার আনতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। সপ্তমত, পররাষ্ট্র কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোনো পূর্ণ মন্ত্রী নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যিনি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন, তিনি একেবারেই আনকোরা। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর নূ্যনতম অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বে যে ইমেজ সংকটের মুখে বাংলাদেশ পড়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। সরকারের উচিত হবে দক্ষ একজন টেকনোক্র্যাটকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া। মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি ছিলেন, তিনি গেল সাড়ে চার বছর পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেড়িয়েছেন। মন্ত্রী হয়েও প্রটোকল ভেঙে নিজে ছবি তুলেছেন। অটোগ্রাফ নিয়েছেন ভিআইপিদের। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারেননি। তাঁকে বাদ দেওয়া ভালো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও একজন দক্ষ লোক দরকার। তবে বিতর্কিত ও কট্টর লোকদের এ পদে না দেওয়াই মঙ্গল। মহাজোট সরকারের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাঁরাই ছিলেন, তাঁরা বিতর্কিত হয়েছেন নানা কারণে। অষ্টমত, প্রধানমন্ত্রী এই সরকারকে ঐকমত্যের সরকার বলেছেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এটা মহাজোট সরকারেরই সম্প্রসারণ। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপিকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার হয় না। তাদের কোনো গণভিত্তিও নেই। বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে ভোট প্রাপ্তি ১ শতাংশের ওপরে নয়। উপরন্তু 'নৌকা' নিয়েই তাঁরা নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। নবমত, উপদেষ্টারা সবাই পুরনো। তাঁদের এ মুহূর্তে আদৌ প্রয়োজন ছিল না। তবু রাখা হয়েছে। দশমত, মন্ত্রিসভায় নারী নেতৃত্ব একেবারেই কম। একজন পূর্ণ মন্ত্রী মাত্র আছেন ক্যাবিনেটে। এতে ক্যাবিনেটে নারীকুলের সঠিক প্রতিনিধিত্ব হয়নি। মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো 'চমক' নেই। তবে এ মন্ত্রিসভা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, তা কিভাবে মোকাবিলা করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। গত ৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের ১১৩তম কংগ্রেসের প্রথম সেশনেই বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাঁচজন সিনেটর রিনডি ডারবিন, জন বুজম্যান, বারবারি বস্ক্রার, মাইকেল বি এহি ও সিনেটর ত্রিস্টোফার এস মাফি গত ১১ ডিসেম্বর এ প্রস্তাব পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে পাঠান। এটি নিয়েই সিনেটে আলোচনা হয় ও প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। সিনেটে গৃহীত প্রস্তাবে ছয়টি বিষয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সত্যিকার অর্থে সংলাপ, অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা প্রদান, তারানকোর উদ্যোগের প্রতি সমর্থন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। একই সঙ্গে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনডেজ দুই নেত্রীকে (প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী) যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানো, সহিংসতা বন্ধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। সিনেটর মেনডেজের চিঠিটি ছাপা হয়েছে গত শনিবার। সিনেটের প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ আমরা পাচ্ছি, আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সংলাপ শুরু করা। একই সঙ্গে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তা বিবেচনায় নেওয়াও প্রয়োজন। টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মধ্যে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ। এখন একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। বিতর্কিত ও অযোগ্যদের একটা বড় অংশই নয়া মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি, এটা প্রধানমন্ত্রীর 'অবস্থানকে' শক্তিশালী করবে সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু একুশ শতকে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে মেধা, মনন ও যোগ্যতা থাকা দরকার, তা নয়া মন্ত্রিসভায় আছে বলে মনে হয় না। এমন দু-একজন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, যাঁদের সংসদীয় কার্যক্রম তেমন উজ্জ্বল নয়। অতীতে সংসদীয় কার্যক্রমে তাঁরা তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারেননি। ফলে তাঁদের অনভিজ্ঞতা মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তাঁদেরকে আমলানির্ভর করে তুলবে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত যিনি, তিনি যখন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। টেকনোক্র্যাট কোটায় যাঁকে পূর্ণ মন্ত্রী করা হলো, তিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা। বরং ভালো হতো, যদি সুধীসমাজের মধ্যে থেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় দু-একজন মন্ত্রী নেওয়া হতো। একুশ শতকে বাংলাদেশের জন্য এ রকম মন্ত্রী প্রয়োজন রয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব মন্ত্রিসভায় এসেছে, তবে সংখ্যায় কম। এই নয়া মন্ত্রিসভা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিয়ম রক্ষা করলেন, কিন্তু 'চমক' সৃষ্টি করতে পারলেন না। প্রধানমন্ত্রীর অনেক আস্থাভাজন ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বাঁধবে এই সরকারের বয়স নিয়ে। নয়া মন্ত্রীরা দক্ষতা কতটুকু দেখাতে পারেন, সেদিকেই আগ্রহ থাকবে এখন সবার।
 Daily KALER KONTHO 14.01.14

অনিশ্চয়তা কাটল না

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল, নির্বাচনের পরও সেই অনিশ্চয়তা কাটল না। নির্বাচনের পর দেশের প্রধান দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। এ প্রতিক্রিয়া জট খোলার জন্য যথেষ্ট নয়। যখন প্রধানমন্ত্রী 'জিরো টলারেন্স'-এর কথা বলছেন, তখন বিরোধীদলীয় নেতা জানালেন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ৫ জানুয়ারি একটি 'গ্রহণযোগ্য' নির্বাচন হয়নি। বিভিন্ন কারণে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে যা ঘটল, তা আমাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীকে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেছে। তিনি এখন অনেক কনফিডেন্ট। তবে 'গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে' বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। কেননা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য নির্বাচনটা হয়েছে সত্য, কিন্তু আন্তর্জাতিক আসরে এটি কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ৭ জানুয়ারি কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও আমরা পেয়েছি; যা কি না প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে না। যেমন, নতুন একটি নির্বাচনে বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও কমনওয়েলথ। সেই সঙ্গে তাদের উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশিত হয়েছে। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক টাইম বলছে 'গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম।' আর ইকোনমিস্টের মন্তব্য 'নষ্ট নির্বাচন'। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাও মন্তব্য করেছে এটি ছিল একটি 'অদ্ভুত নির্বাচন'। প্রভাবশালী এ পত্রিকাটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব মন্তব্য বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এমনকি 'স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নেয়নি' বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও হতাশা প্রকাশ করেছেন আ স ম আবদুর রব, কাদের সিদ্দিকী ও কর্নেল (অব.) অলির মতো মুক্তিযোদ্ধা। এরা কেউই নির্বাচনে অংশ নেননি। গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকার যেমন থাকে, ঠিক তেমনি থাকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলও। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অন্যতম একটি শর্ত। তাই আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থা নেই। আর নেই বলেই আমরা সবাই মিলে 'সব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ'-এর একটি আবহ তৈরি করতে পারলাম না। এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এর মধ্যে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের, ওয়ার্কার্স পার্টির ২ জন, জাসদের ৩ জন, জাতীয় পার্টির ২০ জন, জাতীয় পার্টি জেপির ১ জন। ১৪৭ আসনে যেখানে তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে, সেখানে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহীরা। ওইসব আসনে ভোটার ছিল ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন। মোট ১৮ হাজার ২০৮টি ভোট কেন্দ্রের সব কটিতে সুষ্ঠু ভোটও হয়নি। ভোটারের উপস্থিতির হার সম্পর্কে ইসির ব্যাখ্যা ৪০ ভাগ। তবে অনেকেই তা মানতে নারাজ। আওয়ামী লীগ এখন নতুন করে 'দ্বিতীয় আরেকটি মহাজোট সরকার' গঠন করবে, যাকে তারা বলছে 'জাতীয় ঐকমত্যের সরকার' এবং প্রয়োজনে ২৩৩টি আসন নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করে সংবিধানে আরো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। এরই মধ্যে নবম সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল আওয়ামী লীগ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারো সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। সংসদীয় রাজনীতির একটা বড় সৌন্দর্য হলো সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা। কিন্তু দশম সংসদ নিয়ে এরই মধ্যে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে কোন দল? জাতীয় পার্টি। কিন্তু মুশকিল হলো জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশীদার। উপরন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন একাধিক। ২৭টি আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না। ফলে জাতীয় পার্টিকে কেন্দ্র করে গুজবের ডালপালা বাড়বেই। তবে জাতীয় পার্টি ও এর নেতা এইচ এম এরশাদ এরই মধ্যে বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। 'অসুস্থ' হয়ে গলফ খেলে তিনি 'চিকিৎসা' নিচ্ছেন সিএমএইচে। আর এ গলফ খেলাটা বাকি তার চিকিৎসার অংশ! আমাদের দুর্ভাগ্য ওবায়দুল কাদেরের মতো লোকের কাছ থেকেও এ ধরনের কথা শুনতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের এ বক্তব্য যখন পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। বলতে দ্বিধা নেই, অতীতে ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্য ও নেতৃত্বের গুণে নিজেকে একজন যোগ্য ও খাঁটি নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। যে কারণে দীর্ঘ দিন তিনি মন্ত্রিসভায় না থাকলেও, মহাজোট সরকারের শেষের দিকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এখন তিনিই কি না বললেন এ কথা! যারা সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করেন, তারা দেখেছেন এ নির্বাচনকে ঘিরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে ধারণার জন্ম হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমনকি রাশিয়া কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বলেছিল বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার বলেছিল 'খুব দ্রুত একাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছে ভারত'। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। যে ১০টি দেশকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। কী দুর্ভাগ্য, যেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী পাঠাতে অনুরোধ করেন, সেই বাংলাদেশই কি না এখন ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হলো! যে যুক্তি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। অনেকেই জানেন প্রভাবশালী এ সাময়িকীটি মার্কিন নীতিনির্র্ধারণে প্রভাব খাটায়। নির্বাচন হয়ে গেল। কিন্তু 'সব দলের অংশগ্রহণ' তাতে থাকল না। আমাদের দুঃখ এখানেই যে আমাদের রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলেন না। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। আস্থার সম্পর্কটা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। পশ্চিম বিশ্বের যে উৎকণ্ঠা, সে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। কেননা বিএনপি বড় দল। দলটিকে আস্থায় না নিলে তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে না। নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি। এর জন্য কে দায়ী, কে দায়ী নয় সে হিসাব নিয়ে আমরা যদি 'ব্যস্ত' থাকি, তাহলে আমাদের এত দিনের অর্জন আরো বাধাগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ আরো 'ক্ষতি' সহ্য করতে পারবে না। মনে রাখতে হবে অর্থনীতির চাকা যদি না চলে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতা না হলে, এ অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা থেকেই যাবে। আর তা অর্থনীতিকে আঘাত করবে, যা আমাদের কারোর জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। রাজনীতিবিদদের কাছে তাই আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে সেই প্রত্যাশা তারা পূরণ করতে পারবেন না। প্রশাসনকে ব্যবহার করে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় বটে, কিন্তু মানুষের মনে স্থান করে নেয়া যায় না। নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী 'বিজয়ী' হয়েছেন। কিন্তু একে 'গণতন্ত্রের বিজয়' বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী আরো উদার মনের পরিচয় দিতে পারেন, যদি তিনি তার দলের সাধারণ সম্পাদককে ভেঙে যাওয়া সংলাপ পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দেন। ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন, যদি তিনি এ কাজটি করেন। জাতি এখনো সঙ্কটের মধ্যে আছে। হরতাল-অবরোধের কারণে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক, এটা বলা যাবে না। তাই প্রধানমন্ত্রী যে কাজ করতে পারেন, তা হলো : ১. খালেদা জিয়াকে তার 'গৃহবন্দি'র অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়া। খালেদা জিয়া তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করবেন। তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করলে, আমার বিশ্বাস সংলাপের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ২. বিএনপির নেতাকর্মীরা যাতে জামিনে মুক্তি পান, সে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া। এতে বিশ্ববাসী দেখবে তিনি সত্যিকার অর্থেই সমঝোতার ব্যাপারে আগ্রহী। ৩. সরকার যদি সত্যিকারভাবেই মনে করে জামায়াত জঙ্গিবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অভিমত, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের (গ) ও (ঘ) উপ অনুচ্ছেদ, রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭২ ও দ্য পলিটিকাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর বিধিবিধান অনুসরণ করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যায়। সে ক্ষেত্রে জামায়াতকে ছাড়াই বিএনপি সংলাপে অংশ নিতে পারবে। সরকার হার্ডলাইনে গেছে। শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৭ জানুয়ারি। এতে একটা ভুল মেসেজ পেঁৗছে যেতে পারে বিএনপির কাছে। নির্বাচনের সময় ও পরবর্তী সময়ে যশোর, গাইবান্ধা, পঞ্চগড় ও বাঁশখালীতে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছেন। ভোটবিরোধীরা ৫৩১টি স্কুলে আগুন দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত করা কিংবা স্কুলগুলো পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা কোনো সভ্য দেশে চিন্তাও করা যায় না। একজন স্কুলশিক্ষক নিজে স্কুলে আগুন লাগানোর সময় গ্রেফতার হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা সভ্যতার ওপর একটি আঘাত। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত। একটি নতুন সরকার গঠিত হবে, রোববার শপথ নেয়ার কথা। সাংবিধানিকভাবে এ সরকারের পাঁচ বছর থাকার কথা। কিন্তু সময়টা অনেক লম্বা। একটা সমঝোতার উদ্যোগ নতুন সরকারকে নিতে হবে। এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। Daily JAI JAI DIN 10.01.14

বরফ গলবে কি?

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বেশ কতগুলো কথা বলেছেন। একই দিন রাতে বিবিসি বাংলার সঙ্গে খালেদা জিয়া একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিবিসি পুরো বিষয়টির ওপর মন্তব্য করার জন্য আমাকে তাদের স্টুডিওতে ডেকেছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ দুটি সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি মন্তব্য করেছি। প্রথমে আসা যাক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পাওয়া যায়-১. নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে, ২. সন্ত্রাসবাদ তথা জঙ্গিবাদী তৎপরতা সহ্য করা হবে না, ৩. স্বাধীনতাবিরোধীরাই নির্বাচনে অংশ নেয়নি, ৪. বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে, যদি বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে আসে, ৫. আগামী নির্বাচন সম্পর্কে এখনই তিনি কিছু বলতে চান না ইত্যাদি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া বিবিসিকে যা বলেছেন, তা অনেকটা এরকম- ১. আলোচনায় তিনি রাজি, তবে সরকারকে পরিবেশ তৈরি করতে হবে, ২. দলীয় নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে, ৩. জামায়াতের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখবেন কিনা, সেটা সম্পূর্ণ তার দলের নিজস্ব ব্যাপার, ৪. তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এখন যে প্রশ্নটি দাঁড়ায় তা হচ্ছে দুই নেত্রীর এই বক্তব্য কি পরস্পরবিরোধী নয় এবং তা কি বরফ গলার জন্য যথেষ্ট? আলোচনায় যেতে উভয় পক্ষই রাজি। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী একটি শর্ত দিয়েছেন। আর খালেদা জিয়ার অভিমতÑ বিষয়টি তার দলের এখতিয়ার এবং স্পষ্টতই তিনি চান না আলোচনায় কোনো পূর্বশর্ত থাকুক। আমি বিবিসিকে একই কথা বলেছিÑ এই একটি ইস্যুতে আলোচনা শুরু করাটা আটকে যেতে পারে। জামায়াতের এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনে কোনো নিবন্ধন নেই। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে জামায়াত অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এটা তো অস্বীকার করা যাচ্ছে না যে, অতীতে একটি নিবন্ধিত দল হিসেবেই জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে যেখানে বিএনপি অংশ নেয়নি, কিন্তু আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল, ওই নির্বাচনে জামায়াতও অংশ নিয়েছিল এবং ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতও অংশ নেয়নি। এখন দশম সংসদে আওয়ামী লীগের হাতে রয়েছে ২৩৩ জন সংসদ সদস্য। তারা আবার সংবিধান সংশোধনও করতে পারে। এক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে জামায়াত নিষিদ্ধও হতে পারে। জামায়াত প্রশ্নে যদি কোনো ‘শর্ত’ আরোপ করা হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। আর সে প্রশ্নটিই তুলেছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। তবে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির সঙ্গে সরকার গ্রেফতারকৃত বিএনপির নেতা ও কর্মীদের ছেড়ে দিতে পারে। খালেদা জিয়াকে ‘অন্তরীণ’ অবস্থা থেকেও ‘মুক্তি’ দিতে পারে সরকার। এতে করে সরকারের উদারতা প্রমাণিত হবে। তবে খালেদা জিয়ার বক্তব্যে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছে, তা হচ্ছে কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এর অর্থ হরতাল আর অবরোধের যে কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল বিএনপি, তা চলতে থাকবে। এই কর্মসূচি চলতে থাকলে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ। নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীকে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেছে। তিনি এখন অনেক কনফিডেন্ট। তবে ‘গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। কেননা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য নির্বাচনটা হয়েছে সত্য, কিন্তু আন্তর্জাতিক এটি কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ৭ জানুয়ারি কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও আমরা পেয়েছি। যা কিনা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে না। যেমনÑ নতুন একটি নির্বাচনে বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটেন, কানাডা ও কমনওয়েলথের উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশিত হয়েছে। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক টাইম বলেছে, গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। আর ইকোনমিস্টের মন্তব্য ‘নষ্ট নির্বাচন’। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাও মন্তব্য করেছে- এটি ছিল একটি ‘অদ্ভুত নির্বাচন’। প্রভাবশালী এ পত্রিকাটি বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব মন্তব্য বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এমনকি ‘স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নেয়নি’ বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও হতাশা প্রকাশ করেছেন কাদের সিদ্দিকী ও কর্নেল (অব.) অলির মতো মুক্তিযোদ্ধারা। এরা কেউই নির্বাচনে অংশ নেননি। গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকার যেমনি থাকে, ঠিক তেমনি থাকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলও। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অন্যতম একটি শর্ত। এই আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্র পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থা নেই। আর নেই বলেই আমরা সবাই মিলে ‘সকল দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের’ একটি আবহ তৈরি করতে পারলাম না। এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এর মাঝে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের, ওয়ার্কার্স পার্টির দু’জন, জাসদের তিনজন, জাতীয় পার্টির ২০ জন, জেপির একজন। ১৪৭ আসনে যেখানে তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে, সেখানে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই। ওইসব আসনে ভোটার ছিল ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন। মোট ১৮ হাজার ২০৮টি ভোট কেন্দ্রের সবক’টিতে সুষ্ঠু ভোটও হয়নি। ভোটারের উপস্থিতির হার সম্পর্কে ইসির ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। তবে সরকারি মতে ৬০ ভাগ। আওয়ামী লীগ এখন নতুন করে দ্বিতীয় আরেকটি মহাজোট সরকার গঠন করবে এবং প্রয়োজনে ২৩৩টি আসন নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করে সংবিধানে আরও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। এরই মধ্যে নবম সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল আওয়ামী লীগ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারও সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। সংসদীয় রাজনীতির একটা বড় সৌন্দর্য হচ্ছে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা। কিন্তু দশম সংসদ নিয়ে এরই মধ্যে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে কোন দল? জাতীয় পার্টিকে আপাতত ভাবা হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশীদার। উপরন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন একাধিক। ২৭টি আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না। ফলে জাতীয় পার্টিকে কেন্দ্র করে গুজবের ডালপালা বাড়বেই। তবে জাতীয় পার্টি ও এর নেতা এইচএম এরশাদ এরই মধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ‘অসুস্থ’ হয়ে গলফ খেলে তিনি ‘চিকিৎসা নিচ্ছেন’ সিএমএইচে। আর এই গলফ খেলাটা নাকি তার চিকিৎসার অংশ। আমাদের দুর্ভাগ্য ওবায়দুল কাদেরের মতো লোকের কাছ থেকেও আমাদের এ ধরনের কথা শুনতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের এ বক্তব্য যখন পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। বলতে দ্বিধা নেই, অতীতে ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্য ও নেতৃত্বের গুণে নিজেকে একজন যোগ্য ও খাঁটি নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। যে কারণে দীর্ঘদিন তিনি মন্ত্রিসভায় না থাকলেও মহাজোট সরকারের শেষের দিকে তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এখন তিনিই কিনা বললেন এ কথা। যারা সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করেন, তারা দেখেছেন এ নির্বাচনকে ঘিরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে ধারণার জন্ম হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি রাশিয়া কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বলেছিল, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার বলেছিল, খুব দ্রুত একাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ‘ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় বাংলাদেশের’ নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। যে ১০টি দেশকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তার মাঝে বাংলাদেশের নামও আছে। কী দুর্ভাগ্য, যেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী পাঠাতে অনুরোধ করেন, সেই বাংলাদেশই কিনা এখন ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হলো। যে যুক্তি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের গবেষকরা উল্লেখ করেছেন তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। অনেকেই জানেন, প্রভাবশালী এই সাময়িকীটি মার্কিন নীতিনির্ধারণে প্রভাব খাটায়। নির্বাচন হয়ে গেল। কিন্তু সব দলের অংশগ্রহণ তাতে থাকল না। আমাদের দুঃখ এখানেই যে, আমাদের রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলেন না। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। আস্থার সম্পর্কটা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। পশ্চিমা বিশ্বের যে উৎকণ্ঠা, সেই উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। কেননা বিএনপি বড় দল। দলটিকে আস্থায় না নিলে তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে না। নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি। এর জন্য কে দায়ী, কে দায়ী নয়, সে হিসাব না করে এখন যদি বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়, তাতে করে দাতাগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজনেই দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে এ আস্থার সম্পর্কটা থাকা দরকার। বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে না তুললে তা ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। এরই মধ্যে অর্থনীতিতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২-এর কাছাকাছি নেমে আসবে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে তৈরি পোশাক খাতে। এরই মধ্যে অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। ক্রেতারা কম্পুচিয়া ও ভিয়েতনামে চলে গেছে। শিপমেন্টে মালিকদের খরচ বেড়েছে। এক্ষেত্রে অর্ডার পাওয়া না গেলে অনেক কোম্পানি তার কর্মচারীদের বেতন দিতে পারবে না। বন্ধ হয়ে যাবে কারখানা। ফলে একটা দীর্ঘমেয়াদি অসন্তোষ বিরাজ করবে এ সেক্টরে। পরোক্ষভাবে আন্দোলনের ব্যাপারে একটা নেতিবাচক ধারণাও তৈরি হয়েছে। সুতরাং বিরোধী দলকেও এখন চিন্তা করতে হবে সহিংসতা কীভাবে পরিহার করে এই আন্দোলন পরিচালনা করা যায়। যদিও একটা অভিযোগ আছে যে, একটি ‘বিশেষ মহলের’ নির্দেশে এসব সহিংসতা পরিচালিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ায় ‘খুশি’ হয়েছেন। তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি ও হালকা রসিকতা (সংবাদ সম্মেলনে) প্রমাণ করে তিনি ‘কনফিডেন্ট’ অর্থাৎ আস্থাশীল। ক্ষমতা সব দলের সমর্থন ছাড়া ধরে রাখাতে গৌরবের কিছু নেই। বরং সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কৃতিত্ব রয়েছে অনেক। ‘নষ্ট নির্বাচন’ (ইকোনমিস্ট) আমরা আর চাই না। চাই অর্থবহ নির্বাচন। আলোচনা হোক। নির্বাচনকালীন সরকারের একটা রূপরেখা প্রণীত হোক। সংলাপ হোক। আমাদের মাঝে স্বস্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরে আসুক। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল তাই সব প্রশ্নের জবাব আমাদের দিল ন Daily ALOKITO BANGLADESH 09.01.14

অতঃপর কী, এমন প্রশ্ন আছে অনেক

প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়ার নির্বাচন বয়কটের আহ্বান, টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আর সহিংস ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৫ জানুয়ারি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই নির্বাচনের ও আন্তর্জাতিক আসরে এর আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না, এটা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই বিশ্বাস করেন। আর তাই অর্থমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘সমঝোতা হলে যে কোনো সময় আরেকটি নির্বাচন হতে পারে।’ আমাদের দেশে সাচ্চা গণতন্ত্রের বয়স খুব বেশি দিনের নয়। বলা যেতে পারে পঞ্চম সংসদ (১৯৯১) থেকেই আমরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম! ওই সংসদে গণতন্ত্রকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ২২ বছরের মধ্যে এই গণতন্ত্রচর্চা মুখ থুবড়ে পড়ল। দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো অনেকটা একদলীয়ভাবে। ১৫৩ সংসদ সদস্যের ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি অনেক কিছু ম্লান করে দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ‘নাটক’ প্রমাণ করার জন্য ক্ষমতাসীনরা ‘গণতন্ত্রের নামে’ যা কিছু করেছেন তা কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করল। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে একটি দলের বিজয় যে একটি দেশের জন্য কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, ক্ষমতাসীন সরকার এর বড় প্রমাণ। এ ঘটনা ‘গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে’ যেমনি বাধাগ্রস্ত করল, ঠিক তেমনি একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল ভবিষ্যতের জন্য। ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারাও ঠিক একই ‘কাজ’ করবেন! একটি অন্যায় যেমনি আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে, ঠিক তেমনি দশম সংসদ নির্বাচনের অনিয়মতান্ত্রিকতা ভবিষ্যতে আরো একটি ‘দশম সংসদ নির্বাচন’-এর মতো সংসদ নির্বাচনের জন্ম দেবে। এই প্রবণতা আমরা রোধ করতে পারব না। গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকার যেমনি থাকে, ঠিক তেমনি থাকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলও। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অন্যতম একটি শর্ত। এই আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি, কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থা নেই। আর নেই বলেই আমরা সবাই মিলে ‘সকল দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের’ একটি আবহ তৈরি করতে পারলাম না। এখন দশম সংসদ নির্বাচনকে আমরা কীভাবে বিশ্লেষণ করব? ১৫৩ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এর মাঝে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের, ওয়ার্কার্স পার্টির ২ জন, জাসদের ৩ জন, জাতীয় পার্টির ২০ জন ও জেপির ১ জন। ১৪৭ আসনে যেখানে তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে, সেখানে অনেক জায়গায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের’ প্রার্থীরাই। ওইসব আসনে ভোটার ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন। মোট ১৮ হাজার ২০৮টি ভোটকেন্দ্রের সবটিতে সুষ্ঠু ভোট হয়নি। ভোটারের উপস্থিতির হার ছিল বিএনপির মতে ৪ শতাংশ আর সরকারি মতে ৬০ শতাংশ। আওয়ামী লীগ এখন নতুন করে ‘দ্বিতীয় আরেকটি মহাজোট সরকার’ গঠন করতে পারে। কিন্তু আরো ৭৩টি আসন নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করে সংবিধানেও আরো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে আওয়ামী লীগ। নবম সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে আওয়ামী লীগ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারো সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে এই সন্দেহ এখন কোনোভাবেই অমূলক নয়। সংসদীয় রাজনীতির একটা বড় সৌন্দর্য হচ্ছে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব। কিন্তু দশম সংসদ নিয়ে ইতোমধ্যে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এই সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে কোন দল? জাতীয় পার্টিকে আপাতত ভাবা হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশীদার। উপরন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন একাধিক। ২৭টি আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। ফলে জাতীয় পার্টিকে কেন্দ্র করে গুজবের ডালপালা বাড়বেই। তবে জাতীয় পার্টি ও এর নেতা এইচএম এরশাদ ইতোমধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ‘অসুস্থ’ হয়ে গল্ফ খেলে তিনি ‘চিকিৎসা নিচ্ছেন’ সিএমএইচে। এই গল্ফ খেলাটা নাকি তার চিকিৎসার অংশ! আমাদের দুর্ভাগ্য, ওবায়দুল কাদেরের মতো রাজনীতিকের কাছ থেকেও আমাদের এ ধরনের কথা শুনতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য যখন পত্রিকায় ছাপা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। বলতে দ্বিধা নেই, অতীতে ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্য ও নেতৃত্বের গুণে নিজেকে একজন যোগ্য এবং খাঁটি নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। যে কারণে দীর্ঘদিন তিনি মন্ত্রিসভায় না থাকলেও মহাজোট সরকারের শেষের দিকে তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এখন তিনিই কি-না বললেন এ কথা! যারা সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করেন তারা দেখেছেন এই নির্বাচনকে ঘিরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে ধারণার জন্ম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি রাশিয়া কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার বলছে, ‘খুব দ্রুত একাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছে ভারত।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ‘ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় বাংলাদেশের’ নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে। যে ১০টি দেশকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মাঝে বাংলাদেশের নামও আছে। কী দুর্ভাগ্য, যেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী পাঠাতে অনুরোধ করেন, সেই বাংলাদেশই কি-না এখন ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হলো! যে যুক্তি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের গবেষকরা উল্লেখ করেছেন তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। অনেকেই জানেন প্রভাবশালী এই সাময়িকীটি মার্কিন নীতি-নির্ধারণে প্রভাব খাটায়। নির্বাচন হয়ে গেল, কিন্তু ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ তাতে থাকল না। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাস্তবতাকে অনুসরণ করতে পারলেন না। নির্বাচন পেছানোর সুযোগ ছিল। সংবিধানের ১২৩ (৪) ধারা অনুযায়ী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পেছানো সম্ভব ছিল। সংবিধানের এই ধারায় ‘দৈব দুর্বিপাকের’ যে কথা বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যা এই ক্রান্তিকালে উচ্চ আদালতই দিতে পারতেন। একমাত্র সরকারই উচ্চ আদালতের কাছে একটা রেফারেন্স চাইতে পারত। বিরোধী দল এই রেফারেন্স চাইতে পারে না। আমরা এ সুযোগটাও হারালাম। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতার যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা যে কোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। এই সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সুস্থ রাজনৈতিকচর্চা এখন আরো ঝুঁকির মুখে পড়ল। আগামীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজšে§র রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তারা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। নিউইয়র্কের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু যে দেশটি এখন বিশ্বে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মডেল (শান্তি রক্ষায় অংশগ্রহণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনা, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ইত্যাদি), সেই দেশটির সব উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা এখন কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়ল। আমাদের নেতারা ব্যর্থ হলেন সমঝোতায় পৌঁছতে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে একদলীয় নির্বাচন সম্পন্ন হলো। তাই ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘গৃহযুদ্ধের’ মূল্যায়ন আমাদের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিতে পারে। এই প্রতিবেদনটি যা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ২ জানুয়ারি; ঠিক তার একদিন পর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) বার্ষিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বিএমবিএস বলছে ২০১৩ সালে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছে, তাতে মারা গেছেন ৫৭৩ জন মানুষ, যার মাঝে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আর আহতদের সংখ্যা ১০ হাজার ৪০৩ জন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে মানুষ মারা যাবে, এটা অকল্পনীয়। ‘গৃহযুদ্ধের’ ধারণা যারা দেন, তারা এই পরিসংখ্যানকে এখন ইস্যু করতে পারেন। এই নির্বাচনে ১৫৩ প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় শতকরা ৫২ ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হলেন। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদের এটা পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ‘প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর (১৯৯১) মাধ্যমে এই শব্দগুলো সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। আমাদের সবার মাঝে একটা ধারণা রয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব, কিন্তু ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর বিজয়(?) প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। তাদের এই ব্যর্থতার প্রশ্নটিই তুলেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সরকারের প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারে না, তা আরো একবার প্রমাণিত হলো। একাধিক ক্ষেত্রে ইসির ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। সরকারের চাপ উপেক্ষা করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা কমিশনের সফলতা হিসেবেই বিবেচিত, কিন্তু ‘সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি না জানিয়ে’ ইসি বিতর্কিত হয়েছে। কমিশন ২৮ জুলাই নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১ (ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে তার নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ওই নির্বাচন বাতিল করার সক্ষমতাও ইসির নেই। আর্থিক ব্যাপারগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্তি করার দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর মধ্য দিয়ে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে যায়। সুতরাং ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারো প্রমাণিত হলো। এমনকি দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার সমর্থকরা বিগত ৫ বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। ‘সুজন’ নামক সংস্থাটি এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একটি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শীর্ষস্থানীয় সরকারি দলের নেতাদের অর্থ-সম্পদ কীভাবে বেড়েছে। সুস্থ রাজনীতিচর্চার জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। ক্ষমতায় গেলেই বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হতে হবে এটা যদি ‘স্টাবলিস্ট’ হয়ে যায়, তাহলে রাজনীতি শুধু অর্থবানদেরই টানবে। অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তি, দুর্নীতিপরায়ণ আমলা শুধু অর্থ-সম্পদ বানানোর জন্য ‘রাজনীতির’ খাতায় নাম লেখাবেন। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকারি দলের যারা নির্বাচিত(?) হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে পার্টি ফান্ডে জমা দিতে বলা হয়েছে। এটাও একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং তাদের পরোক্ষভাবে দুর্নীতিতে উৎসাহিত করা হলো। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিদেশি দূতদের ‘শেষবারের মতো’ দৌড়ঝাঁপ করতে আমরা দেখেছি। এর আগে এক এক করে তারানকো, সুজাতা সিং, ওয়ার্সি কিংবা নিশার মতো বিদেশি দূতদের একটা ‘সমঝোতা’ করার উদ্যোগ নিতে আমরা দেখেছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বিদেশি দূতদের বারবার ‘হস্তক্ষেপের’ ঘটনা বিদেশিদের কাছে প্রমাণ করল, আমরা আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারি না। এটা শুধু বাজে দৃষ্টান্তই নয়; বরং ভবিষ্যতে এ আবারো ‘হস্তক্ষেপের’ পথ প্রশস্ত করল। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যমআয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার কথা বলেছেন। শুনতে এটা ভালোই শোনায়। আমি নিজেও মনে করি বাংলাদেশ হচ্ছে একটি ‘সফট পাওয়ার’ সক্ষমতার দিক থেকে শক্তি। কিন্তু এই ‘শক্তি’ এখন মুখ থুবড়ে পড়ল। বিএনপি দাবি করেছে বেগম জিয়া গৃহবন্দি। বেগম জিয়া যে এক রকম ‘অন্তরীণ’ অবস্থায় তা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দলের নেতাদের তো বটেই, এমনকি নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতাকে পর্যন্ত বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এ থেকেই এটা স্পষ্ট, তিনি এক রকম অন্তরীণ। প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্ট আমাদের জানাচ্ছে যে, নতুন সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই অন্তরীণ থাকবেন! যদিও বেগম জিয়ার অন্তরীণ অবস্থা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট সরকারি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের আগের দিন ও নির্বাচনের দিন দেশজুড়ে নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে সহিংসতা চলে। বেশক’টি কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পাবনায় এক মন্ত্রীপুত্রের কাহিনী সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। এসব কি সরকারের জন্য আদৌ সুখের? সরকার একটা ‘বাজে’ দৃষ্টান্ত তৈরি করল। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা তো আসেনইনি, যারা এসেছেন (মোট ৪ জন), তাদের একজন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নির্বাচনী কর্মকর্তা আশুতোষ জিন্দালও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেননি। উৎসবমুখর পরিবেশে যে ভোট হয়নি, তা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে অতঃপর কী? বিএনপি ও ১৮ দল আবারো ৪৮ ঘণ্টার হরতাল এবং অবরোধের ডাক দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি একটি মেসেজ দিচ্ছে এবং তা হচ্ছে সমঝোতা না হলে তারা তাদের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এতে লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু দেশটির তো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। বাংলাদেশ এ ক্ষতি মেনে নিতে পারে না। অর্থনীতিতে তা বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এখন সরকারের নীতি-নির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা ভেঙে যাওয়া সংলাপ অব্যাহত রাখবেন, নাকি ‘নির্বাচিত সংসদ’-এর যুক্তি তুলে ধরে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবেন। সংলাপ যদি শুরু না হয়, অবরোধ যদি চলতে থাকে আর সহিংসতার মাত্রা যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে তা যে অসাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহ জোগাবে, এমনটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, আমরা এটাই প্রত্যাশা করি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘বিজয়’ প্রকারান্তরে দলটির ‘পরাজয়’ই ডেকে আনল Daily Manobkontho 07.01.14