রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন


যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর বাকি আছে মাত্র কয়েকটি দিন। ৮ নভেম্বর সেখানে নির্বাচন। কিন্তু এরই মাঝে এই নির্বাচন যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তা কেউই আশা করেনি। শুধু তাই নয়, এই বিতর্ক ও প্রার্থীদের অশোভন আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে বিশেষ করে তিন তিনটি প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে রিপাবলিকান পার্টি মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিপক্ষ প্রার্থী হিলারি কিনটনকে ব্যক্তিগতভাব আক্রমণ করে যেসব বক্তব্য রেখেছেন, তাতে বিস্মিত হয়েছেন অনেকে। এ ধরনের অশোভন বক্তব্য একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর কাছ থেকে কেউ আশা করেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ওইসব বক্তব্যের মধ্য দিয় শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই কলুষিত করলেন না বরং তার দলকেও বিতর্কিত করলেন। খোদ রিপাবলিকান পার্টি শিবিরে এ নিয়ে বড় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টির অনেক সিনিয়র নেতা ট্রাম্পকে সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। রিপাবলিকান পার্টি সমর্থক অনেক বুদ্ধিজীবীও হিলারিকে সমর্থন করেছেন। হিলারির ড্রাগ টেস্ট করা, তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানোর হুমকি, ‘নষ্ট মহিলা’, ‘মিথ্যাবাদী’Ñ এ ধরনের শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুরো নির্বাচনীব্যবস্থাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলে, সেখানে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্যে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিনি প-িতরা। তারা বলেছেন, ট্রাম্প মার্কিন গণতন্ত্রকে ছুরিকাঘাত করেছেন। ফ্রান্সের অন্যতম বুদ্ধিজীবী ডমিনিক মইসি (উড়সরহরয়ঁব সড়রংর) ফ্রান্সের লেস ইকোস পত্রিকায় এক কলাম লিখেছেন, ‘ট্রাম্প এন্ড দি এন্ড অব ডেমোক্রেসি (ইংরেজি অনুবাদ)। সেখানে তিনি ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের নব্যমুসোলিনী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ট্রাম্প গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য বড় ধরনের হুমকি। লন্ডনের বিখ্যাত ‘দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস’-এ গিডন রাকমান এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্প খোদ যুক্তরাষ্ট্রর জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করেছেন। তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয় বরং বিশ্বর সর্বত্র গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছেন। এই সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প, একজন ব্যবসায়ী, পৃথিবীর অনেক দেশে তার ব্যবসা রয়েছে, তিনি হতে চান যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট! তিন তিনটি প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক আমি দেখেছি। একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যে ভাষায় কথা বলেন, তার বডি ল্যাংগুয়েজ, তার ভাষাজ্ঞান আমাকে অবাক করেছে। যখন অক্টোবরের শেষের দিকে আমি এই নিবন্ধটি রচনা করছি তখনো কোনো কোনো রানী দাবি করছেন, অতীতে তিনি ট্রাম্প কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এখানকার টিভি চ্যানেলগুলো দেখেছে একজন পর্নোস্টারও অভিযাগ করেছেন ট্রাম্প তাকে দশ হাজার ডলারের বিনিময়ে তার সঙ্গ উপভোগ করতে চেয়েছিলেন। আরেকজন অভিযোগ করেছেন, ট্রাম্প তার শরীরের সংবেদনশীল অংশে স্পর্শ করেছিলেন। এর পেছনে সত্যতা আছে কী নেই সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান, তার সম্পর্কে যখন একের পর এক অভিযোগ ওঠে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দেয় বৈকি!
বেশ কয়েক মাস ধরে আমি ডালাস আর নিউইয়র্কে অবস্থান করে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রত্যক্ষ করছি। প্রথম থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বিতর্কিত ছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি একের পর এক বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। আমি অবাক হয়েছি যখন দেখেছি তিনি রিপাবলিকান পার্টির চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন। এর কারণ হচ্ছে তিনি রিপাবলিকান পার্টির উঁচু স্তরের কোনো নেতা ছিলেন না। কোনোদিন আইনসভার সদস্য, কোনো রাজ্যের গভর্নরও তিনি ছিলেন না কখনো। তিনি ব্যবসায়ী। ব্যবসা নিয়েই পার করেছেন সারাটা জীবন। হঠাৎ করেই তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হয়ে গেলেন। এটা অনেককেই অবাক করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে যেটা কাজ করছে, তা হচ্ছে তার উগ্র বক্তব্য। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের এক নম্বর শক্তিতে পরিণত করার তার অভিপ্রায়। যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠী মনে করে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব করার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়ে গেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হলে একজন ‘শক্ত নেতা’ দরকার। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাঝে সেই ‘শক্ত নেতার’ ছবি খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়া, তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না দেওয়া, মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করাÑ ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্য শুধু তার জাতিগত বিদ্বেষের চরিত্রটিই ফুটে ওঠে না বরং তা এক বিপজ্জনক পরিস্থিতিও সৃষ্টি করেছে। মুসলমানরা এক ধরনের শঙ্কার মাঝেই আছেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে তারা বিপদে পড়তে পারেন, এমন শঙ্কা তাদের মধ্যে কাজ করছে। তুলনামূলক বিচারে হিলারি কিনটনের আচরণ এত উগ্র নয়। তিনটি টিভি বিতর্কে আমি তাকে দেখেছি অত্যন্ত ভদ্রজনিত আচরণের মধ্য দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে। কখনো তাকে উত্তেজিত অবস্থায় দেখিনি। এ জন্যই জনমত জরিপে তিনি এখনো এগিয়ে আছেন এবং জনমত জরিপ সত্য হলে তিনি হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। হিলারি কিনটন একজন তরুণ আইনজীবী হয়ে রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। করপোরেট আইনজীবী না হয়ে তিনি শিশু অধিকার, মাতৃ অধিকার নিয়ে তার কর্মময় জীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে ফার্স্ট লেডি, নিউইয়র্কের সিনেটর এবং সর্বশেষ ছিলেন সেক্রেটারি অব স্টেট বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তুলনামূলক বিচারে রাজনীতি, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে তার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে এবং তিনি অভিন্ন। পররাষ্ট্র তথা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো ধারণাই নেই। ন্যাটো প্রশ্নে, আইএস প্রশ্নে, ব্রেক্সিট প্রশ্নে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার অজ্ঞতাই প্রমাণ করেছে। বাফটা ও টিপিপি চুক্তির ব্যাপারেও তার অবস্থান হিলারির বিপরীতে। তিনি মনে করেন বাফটা ও টিপিপি চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়েছে। অথচ হিলারি মনে করেন ওই দুটো চুক্তির কারণে মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে বেশি। ট্রাম্প মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে চান। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন মেক্সিকানরা মার্কিন অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে। চিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে ট্রাম্পের। ডেমোক্র্যাটরা গত আট বছরে (ওবামা প্রশাসন) যুক্তরাষ্ট্রকে চিনের হাতে তুলে দিয়েছেÑ এ অভিযোগ ট্রাম্পের। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন চিনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কই নয়াবিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার অন্যতম শর্ত। ওবামার শাসনামলে আইএসের জন্ম হয়েছে এবং এ জন্য ডেমোক্র্যাটরাই দায়ীÑ ট্রাম্পের এ ধরনের অভিযোগ স্বীকার করেন হিলারি কিনটন। হিলারি বলেছেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় ১২২টি দেশ সফর করেছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মাইল পথ ভ্রমণ করেছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্যই। অথচ ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। তবে ট্রাম্পের একটা প্রমাণ পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি সোজাসাপটা কথা বলেন। আক্রমণ করে কথা বলেন, যা হিলারি করেন না কখনো। তিনি তার বক্তৃতায় ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন সত্য, কিন্তু তা অনেক মার্জিত ভাষায়। তাই একটি প্রাক-গবেষণায় (সিন কোলার‌্যান্সি কর্তৃক পরিচালিত) যখন হিলারিকে সর্বোচ্চ নির্বাচনম-লীর ভোটে বিজয়ী হবেন বলে মন্তব্য করা হয়, আমি তাতে অবাক হই না। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ৫৩৮টি নির্বাচকম-লীর ভোটে হিলারি পাবেন ৩৪৭ ভোট আর ট্রাম্প পাবেন ১৯১ ভোট। নির্বাচকম-লী গঠিত হয় কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ে। অর্থাৎ হাউস অব কংগ্রেসের ৪৩৫ আর সিনেটের ১০০ সিট নিয়েই ৫৩৮টি নির্বাচকম-লীর ভোট। ৫০টি রাজ্যের নির্বাচকম-লীর ভোটও আলাদা। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচকম-লীর ভোট ৫৫ আর নিউইয়র্কের ২৯। জনগণ ভোট দেন বটে। কিন্তু তারা প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকম-লীর ভোটে। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাজ্যে যে প্রার্থী বিজয়ী হবেন তিনি নির্বাচকম-লীর প্রতিটি ভোট পেয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হয়।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বিতর্ক ঘিরে ধরেছে দুই প্রার্থীকে। হিলারি কিনটনের ইমেইল বিতর্ক তাকে যথেষ্ট ভোগাচ্ছে। সর্বশেষ টিভি বিতর্কেও তিনি এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত ইমেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত ইমেইল ব্যবহার করে বিদেশে যোগাযোগ করেছেন। ওইসব ইমেইলের কিছু অংশ ফাঁস হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের দাবি ট্রাম্পের প্ররোচনায় রাশিয়ার হ্যাকাররা ওই ইমেইল ফাঁস করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প দাবি করেছেন হিলারি কিনটনের বাকি সব ইমেইল প্রকাশ করা হোক। এটা নিঃসন্দেহে হিলারি কিনটনের জন্য একটি মাইনাস পয়েন্ট। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও বিপদে আছেন। ডেমোক্র্যাট শিবির তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার। দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি ফেডারেল সরকারকে কোনো ট্যাক্স দেননি। এটা ট্রাম্প স্বীকারও করেছেন। তবে নির্বাচনী ফলাফল যাই হোক না কেন, এখন ট্রাম্পের নানা বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর একটা কালো দাগ এঁকে দিয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে তিনি বিতর্কিত করেছেন। মানুষের কাছে প্রচুর টাকা হলে তিনি যে কী করতে পারেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বড় প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মন্তব্য করে। সমালোচনা করে। এখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হলো। নির্বাচন একটি হবে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একজন নয়া প্রেসিডেন্ট পাবে, যিনি ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেবেন। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে কী পরিবর্তন আসে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক দেশের সম্পর্কের অবনতি হবে। বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে। আর যদি হিলারি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, তাতে করে তিনি ওবামার অনুসৃত নীতি অনুসরণ করবেন। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি পরিবর্তন আনবেন- এটা সত্য। তবে বড় পরিবর্তন আসবে না। যুক্তরাষ্ট্রের গত ২৪০ বছরের ইতিহাসে এটা একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে, যদি একজন নারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।
Daily Amader Somoy
01.11.2016

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও প্রসঙ্গ কথা

 
  

আগামী ৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নিয়ে সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। এরই মধ্যে দুজন মূল প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন (ডেমোক্র্যাট পার্টি) ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের (রিপাবলিকান পার্টি) মধ্যকার তিন-তিনটি ‘প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক’ সম্পন্ন হয়েছে। একটি কমিশন এই বিতর্কের আয়োজন করে এবং তিনটি বড় মিডিয়া হাউস (সিএনএন, এনবিসি ও ফক্স নিউজ) এই বিতর্ক ‘লাইভ’ সম্প্রচার করে। মোটামুটি তিনটি বিতর্ক আয়োজনের ‘মডেল’ অনেকটা একই ধরনের। সিএনএন ও ফক্স নিউজে উপস্থাপক বিশেষ কয়েকটি বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করেন এবং প্রার্থীদের মতামত জানতে চান। অন্যদিকে এবার এনবিসি কর্তৃক আয়োজিত বিতর্কে কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্নকর্তাকে তাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রশ্ন করার জন্য। বলা ভালো, ১৯৬০ সাল থেকেই এই ‘প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সমসাময়িক ঘটনাবলি, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা রাখবে ভবিষ্যতে—এসব বিষয় মাথায়  রেখেই আলোচনা হয়। প্রার্থীরা তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। এই বিতর্ক জনমত জরিপে প্রভাব ফেলে এবং প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এখানে জনগণ ভোট দেয় বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। প্রতিটি রাজ্যের সিনেট সদস্য ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের নিয়ে এই নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত। প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলী আবার সমান সংখ্যক নন। যেমন নিউ ইয়র্ক স্টেট ও ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা আলাদা। এই সংখ্যা এখন ৫৩৮। তাঁরাই ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করবেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো রাজ্যে কোনো প্রার্থী বিজয়ী হলে তিনি ওই রাজ্য বা স্টেটের যে কয়টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট রয়েছে, তার সব কয়টি পেয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হয়। এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু এটাই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে প্রার্থীকে ২৭০টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট পেতে হয়।
এবার নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন কট্টরপর্ন্থী এবার রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি কখনোই রিপাবলিকান শিবিরে কোনো বড় ধরনের নেতা ছিলেন না। কোনো দিন আইনসভার সদস্য ছিলেন না। কোনো রাজ্যের গভর্নরও ছিলেন না। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। কিন্তু তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য, বিশেষ করে মুসলমানদের বের করে দেওয়া ও তাদের এ দেশে ঢুকতে না দেওয়া, মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে ‘ওবামার চেয়ে যোগ্য নেতা’ হিসেবে গণ্য করা ইত্যাদি তাঁর সম্পর্কে এখানে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। তিনি যোগ্য নেতা নন, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ইত্যাদি প্রশ্ন উঠেছে এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দ্বিতীয়ত, হিলারি ক্লিনটন এই প্রথমবারের মতো একজন ‘নারী’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী অতীতে কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি এবং জনমত জরিপ বলছে, তিনি হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। তিন-তিনটি ‘প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে’ তিনি বিজয়ী হয়েছেন এবং দিন যত যাচ্ছে, ততই তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তৃতীয়ত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নানা উসকানিমূলক বক্তব্য খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ভবিষ্যেক একটি প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ট্রাম্প প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি, তিনি যদি নির্বাচনে হেরে যান তাহলে ফলাফল মানবেন কি না। অর্থাৎ ‘হেরে গেলে’ তিনি ফলাফল মানবেন না! উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন! তৈরি হতে পারে নানা সংকটের। এটা গণতন্ত্রের জন্য এক ধরনের অশনি সংকেত। ফ্রান্সের দার্শনিক ডমিনিক মইস (Dominique Moisi) ট্রাম্পকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের মুসোলিনী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মানুষ এখন অনেকটাই আতঙ্কিত। একদিকে তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করছেন, অন্যদিকে ‘হিলারিকে জেলে পাঠাবেন’, ‘নষ্ট মহিলা’ ইত্যাদি আখ্যায়িত করে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের আভাস দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ গণতন্ত্রের এই চরিত্রকে কখনো দেখেনি। এক ধরনের সম্প্রীতি, সহনশীলতার দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের এই চরিত্রকে বদলে দিয়েছে। সুতরাং তিনি যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন (?) তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিদ্বেষ, হিংসা, হানাহানি বাড়বে—এমন আশঙ্কাই করছে কেউ কেউ। চতুর্থত, এবারের নির্বাচনে কোনো একটি ‘ইস্যু’ প্রাধান্য পায়নি। দুজন প্রার্থী নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। তাতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন উঠে এলেও কোনো একটি বিষয়কে কেউই প্রাধান্য দেননি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই মুহূর্তে বড় সমস্যা সিরীয় সংকট। হিলারি ক্লিনটন সিরিয়ার আকাশে একটি ‘নো ফ্লাই জোন’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলছেন বটে, কিন্তু দেখা গেছে তাতে করে তা রাশিয়ার বিমান হামলার (আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে) বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আইএস জঙ্গিদের কিভাবে ধ্বংস করা যায়, তার কোনো পরিকল্পনাও শোনা যাচ্ছে না দুজন প্রার্থীর কাছ থেকে। পঞ্চমত, দুজন প্রার্থীর বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থান ভিন্ন। এর অর্থ যদি হিলারি বিজয়ী হন, তাহলে ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা তিনি বজায় রাখবেন। অন্যদিকে ট্রাম্প বিজয়ী হলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। ষষ্ঠত, এটা যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচন প্রমাণ করল আবারও যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি দুটি বড় দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এবারের নির্বাচনে আরো দুজন প্রার্থী আছেন (জিল স্টাইন, গ্রিন পার্টি ও লিবারটারিয়ান পার্টির গেরি জনসন), তাঁদের মানুষ খুব কমই চেনে ও জানে। এর কারণ হচ্ছে নির্বাচনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। প্রার্থীদের বিভিন্ন স্টেটে যেতে হয় নির্বাচনী প্রচারণায়। পত্রিকায় ও টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতে হয়, যাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়—যা সব প্রার্থীর পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। দুটি বড় দলের প্রার্থীরা বিভিন্ন সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। বিভিন্ন কম্পানি চাঁদা দেয়। যাঁরা পার্টির রেজিস্টার্ড ভোটার, তাঁরা পার্টির প্রার্থীকে চাঁদা দেন। পাঠকদের একটু জানিয়ে রাখি, এই নির্বাচনে এই অক্টোবর পর্যন্ত হিলারি সংগ্রহ করেছেন ৯৪৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে ৭৭৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। হাতে আছে ১৭৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ট্রাম্পের সংগ্রহ ৪৪৯ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। খরচ হয়েছে ৩৫২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। হাতে আছে ৯৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার (সূত্র : ব্লুমবার্গ পলিটিকস, ২১ অক্টোবর)। সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টিগ্রিটির মতে, নির্বাচনে এরই মধ্যে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়ে গেছে। ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের মতে ট্রাম্প তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৫৬ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন। আর হিলারি সমর্থক প্যাক কমিটি দিয়েছে ১১৭ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং বোঝাই যায় নির্বাচনে অর্থ একটি ফ্যাক্টর। সব প্রার্থীর পক্ষে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সপ্তমত, জনমত জরিপে হিলারি এগিয়ে আছেন। সর্বশেষ রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিলারির বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর ৩২৬ ভোট পাবেন। আর ট্রাম্প পাবেন ২১২ ভোট। একই সঙ্গে এবিসি নির্বাচনী জনমতে হিলারি ক্লিনটনকে ১২ পয়েন্টে এগিয়ে থাকার কথা বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ১৭৮৯ সাল থেকে শুরু করে ১৮০০ সাল পর্যন্ত নির্বাচন হয়েছে চারবার। ১৭৮৯ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তাঁর কোনো দল ছিল না। ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন জন অ্যাডামস (১৭৯৭-১৮০১)। ফেডারেলিস্ট দলের প্রার্থী ছিলেন তিনি। অন্যদিকে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের সময় (১৮০১-১৮০৯) ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান পার্টির ধারা অব্যাহত থাকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত। এরপর আসেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন (১৮২৯-১৮৩৭), তিনি ছিলেন সপ্তম প্রেসিডেন্ট, তাঁর আমলে ডেমোক্র্যাট পার্টির আলাদাভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে আব্রাহাম লিংকনের (১৬তম প্রেসিডেন্ট) শাসনামলে (১৮৬১-১৮৬৫)। এই দুটি বড় দলের পাশাপাশি ‘উইগ’ পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চারজন ‘উইগ’ পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৮৪১ সালে উইলিয়াম হ্যারিসন ‘উইগ’ পার্টির পক্ষ হয়ে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন আর এই পার্টির অস্তিত্ব নেই। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪০ বছরের ইতিহাসে (১৭৮৯ থেকে) ৪৪ জন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। অর্থাৎ বারাক ওবামা হচ্ছেন ৪৪তম প্রেসিডেন্ট। তবে একই ব্যক্তি গ্রোভার ক্লেভেল্যান্ড দু-দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডেমোক্র্যাট গ্রোভার ক্লেভেল্যান্ড (২২তম) ১৮৮৫-১৮৮৯ সালে প্রথমবার এবং ১৮৯৩-১৮৯৭ (২৪তম) দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। এই দীর্ঘ সময়ে রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ হয়ে ১৮ জন, ডেমোক্র্যাট পার্টির পক্ষ হয়ে ১৫ জন, উইগ পার্টির পক্ষ হয়ে চারজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকরা বলেন, প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের কোনো দল ছিল না। তবে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস (১৭৯৭-১৮০১) ফেডারেলিস্ট পার্টির হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাধারণত একজন প্রেসিডেন্ট চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে (১৯৩৩-১৯৪৫) ১২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন।
এখানে পাঠকদের আরো কিছু তথ্য দিই। একসময় যাদের কোনো সম্পদ ছিল না (মূলত কৃষ্ণাঙ্গরা, যারা দাস হিসেবে এ দেশে এসেছিল), তারা ভোট দিতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৫তম, ১৯তম ও ২৬তম সংশোধনীতে যাদের ১৮ বছর বয়স তাদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। আর নারীদের ভোটের অধিকারের বয়স মাত্র ৯৬ বছরের। এখন জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। কিন্তু প্রথম দিকে স্টেটের আইনসভা নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করত।
নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনকে সম্ভাব্য ‘বিজয়ী’ হিসেবে মিডিয়া তুলে ধরছে। কিন্তু এই নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে বিভক্ত করেছে। ই-মেইল বিতর্ক নিয়ে হিলারি বেশ অসুবিধায় আছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নারী কেলেঙ্কারি আর ১৮ বছর ধরে কোনো ট্যাক্স না দেওয়ার কাহিনী তাঁর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে এই নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বেরই আগ্রহ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রকে আগামী দিনে কিভাবে নেতৃত্ব দেবে এটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েকটি দিন। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি নয়া প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়িত্ব নেবেন।
Daily Kalerkontho
31.10.2016

একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

                 

একজন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশ্বের মানুষ এখন চিনেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে। তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী। ৮ নভেম্বর এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন, যিনি ডেমোক্র্যাট পার্টির হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন। নির্বাচনে আরও দুইজন প্রার্থী রয়েছেন বটে। কিন্তু নির্বাচনে তাদের কোনো ভূমিকা বা গুরুত্ব নেই। মিডিয়া তাদের নিয়ে খুব একটা মাতামাতিও করে না। এর কারণ অর্থ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় রাজনীতি। তবে এবারের নির্বাচন নানা কারণে এরই মধ্যে বিতর্কিত হয়ে উঠছে। ট্রাম্প সনাতন রাজনীতিক নন। তিনি ধনী ব্যবসায়ী। একাধিক নারী কেলেঙ্কারিতে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। নারীরা প্রকাশ্যেই মিডিয়ায় তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। অতীতে কখনও এমনটি দেখা যায়নি। তিনি নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা টিভি বিতর্কে যে ভাষা ব্যবহার করছেন, তা অশোভন ও দৃষ্টিকটু। এভাবে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী প্রকাশ্যে বিরোধী দল প্রার্থীকে ‘নষ্ট মহিলা’, ‘মিথ্যাবাদী’ হিসেবে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন। এটা অতীতে কেউ কখনও দেখেননি। এমনকি তিনি মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবেন, মেক্সিকান-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে দেয়াল তুলবেন, তার এ ধরনের বক্তব্য ‘নেতৃত্বসুলভ’ কোনো বক্তব্য নয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্পর্কে একটি খারাপ ধারণা দিয়েছেন।
প্রায় ১০ কোটি মানুষ ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে তিন-তিনবার টিভি পর্দায় হিলারি আর ট্রাম্পকে বিতর্কে অংশ নিতে দেখেছেন। এই নিউইয়র্কে বসে আমি এ বিতর্ক দেখেছি। কিন্তু একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এ মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হিসেবে দুইজন প্রার্থীর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত ছিল, তা তারা করেননি। এমনকি উপস্থাপকও এ ধরনের তেমন কোনো প্রশ্ন করেননি। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তার কাছ থেকে এ ধরনের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়ের একটি ব্যাখ্যা আশা করেছিল এখানকার সাধারণ মানুষ। তারা তা পাননি। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আফগান যুদ্ধের ১৫ বছর পার করেছে। ২ হাজার ২০০ মার্কিন সেনা এ যুদ্ধে মারা গেছেন। আফগানিস্তানের ১০ ভাগ এলাকা এখন তালেবানদের দখলে এবং আরও ২০ ভাগ এলাকা তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছে, এ ব্যাপারে হিলারি ও ট্রাম্পের কোনো বক্তব্য ছিল না। এমনকি ইরাক বিভক্তিকে কীভাবে রোধ করা যায়, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি দুইজন প্রার্থী। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। চীন সেখানে তার শক্তি বৃদ্ধি করছে। এ ব্যাপারেও কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না হিলারি ও ট্রাম্পের। বিতর্কে দুই প্রার্থী এটা নিশ্চিত করেননি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে তারা কী পরিবর্তন আনতে চান। হিলারি যখন সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন, বেতন বৃদ্ধি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন, সেখানে ট্রাম্প গুরুত্ব দিয়েছেন অভিবাসন রোধ করা ও চাকরির সংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদির ওপর। ইরাক ও সিরিয়ার সমস্যার সমাধান কীÑ তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
৮ নভেম্বর নির্বাচন। দুই প্রার্থী এখনও বিতর্কের পর প্রচারণায় ব্যাপক অংশ নিচ্ছেন। হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য, অভিবাসীদের পক্ষে কথা বলা, মধ্যবিত্তকে আকৃষ্ট করা, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা, টিম কেইনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেয়াÑ সব মিলিয়ে তার অবস্থান এখন শক্তিশালী বলেই মনে হয়। অন্যদিকে ট্রাম্পের কোনো বক্তব্যই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। তিনি পুরনো রাজনীতিবিদও নন। ওয়াশিংটন ডিসির রিপাবলিকান শিবিরেও তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প বিপুল অর্থবিত্তের (ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার) মালিক হলেও, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি একবার রিফর্ম পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি অতীতে কখনও কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ গ্রহণ করেননি। টিভি উপস্থাপকও ছিলেন (রিয়েলটি শো, এবিসি)। অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটনের রাজনৈতিক জীবন বেশ বর্ণাঢ্যময়। তরুণ আইনজীবী হয়ে তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। করপোরেট আইনজীবী না হয়ে তিনি শিশু অধিকার, মাতৃ অধিকার নিয়ে তার কর্মময় জীবন শুরু করেন। পরে ফার্স্ট লেডি, নিউইয়র্কের সিনেটর এবং সর্বশেষ ছিলেন সেক্রেটারি অব স্টেট বা বিদেশমন্ত্রী। তুলনামূলক বিচারে রাজনীতি, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে তার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে এবং তিনি অভিজ্ঞ। পররাষ্ট্র তথা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো ধারণাই নেই। ন্যাটো প্রশ্নে, আইএস প্রশ্নে, ব্রেক্সিট প্রশ্নে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার অজ্ঞতাই প্রমাণ করেছে। নাফটা ও টিপিপি চুক্তির ব্যাপারেও তার অবস্থান হিলারির বিপরীতে। তিনি মনে করেন, নাফটা ও টিপিপি চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়েছে। অথচ হিলারি মনে করেন, এই দুইটি চুক্তির কারণে মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে বেশি। ট্রাম্প মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে চান। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন, মেক্সিকানরা মার্কিন অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে ট্রাম্পের। ডেমোক্র্যাটরা গত আট বছর (ওবামা প্রশাসন) যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের হাতে তুলে দিয়েছেÑ এই অভিযোগ ট্রাম্পের। অন্যদিকে হিলারি মনে করেন, চীনের সঙ্গে ‘সহযোগিতামূলক’ সম্পর্কই নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ার অন্যতম শর্ত। ওবামার শাসনামলে আইএসের জন্ম হয়েছে এবং এ জন্য ডেমোক্র্যাটরাই দায়ীÑ ট্রাম্পের এ ধরনের অভিযোগ স্বীকার করেন না হিলার ক্লিনটন।  হিলারি বলেছেন, তিনি বিদেশমন্ত্রী থাকার সময় ১২২টি দেশ সফর করেছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মাইল ভ্রমণ করেছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্যই। অথচ ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। তবে ট্রাম্পের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি সোজাসাপটা কথা বলেন। আক্রমণ করে কথা বলেন, যা হিলারি করেন না কখনও। তিনি তার বক্তৃতায় ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন সত্য; কিন্তু তা অনেক মার্জিত ভাষায়। তাই একটি প্রাক-গবেষণায় (সিন কোলারোসি কর্তৃক পরিচালিত) যখন হিলারিকে সর্বোচ্চ নির্বাচকম-লীর ভোটে বিজয়ী হবেন বলে মন্তব্য করা হয়, আমি তাতে অবাক হই না। উক্ত গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ৫৩৮টি নির্বাচকম-লীর ভোটে হিলারি পাবেন ৩৪৭ ভোট আর ট্রাম্প পাবেন ১৯১ ভোট। নির্বাচকম-লী গঠিত হয় কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ে। অর্থাৎ হাউস অব কংগ্রেসের ৪৩৫ আর সিনেটের ১০০ সিট নিয়েই ৫৩৮টি নির্বাচকম-লীর ভোট। ৫০টি রাজ্যের নির্বাচকম-লীর ভোটও আলাদা আলাদা। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার নির্বাচকম-লীর ভোট ৫৫, আর নিউইয়র্কের ২৯। জনগণ ভোট দেন বটে; কিন্তু তারা প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকম-লীর ভোটে। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, রাজ্যে যে প্রার্থী বিজয়ী হবেন, তিনি নির্বাচকম-লীর প্রতিটি ভোট পেয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিতর্ক ঘিরে ধরেছে দুই প্রার্থীকে। হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল বিতর্ক তাকে যথেষ্ট ভোগাচ্ছে। সর্বশেষ টিভি বিতর্কেও তিনি এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি যখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি বিদেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার করে বিদেশে যোগাযোগ করেছেন। ওইসব ই-মেইলের কিছু অংশ ফাঁস হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের দাবি, ট্রাম্পের প্ররোচনায় রাশিয়ার হ্যাকাররা ওই ই-মেইল ফাঁস করেছে। অন্যদিকে ট্রাম্প দাবি করেছেন, হিলারি ক্লিনটনের বাকি সব ই-মেইল প্রকাশ করা হোক। এটা নিঃসন্দেহে হিলারি ক্লিনটনের জন্য একটি মাইনাস পয়েন্ট। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও বিপদে আছেন। ডেমোক্র্যাট শিবির তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার। তার স্ত্রী (তৃতীয়) মেলানিয়ার মধ্য নব্বইয়ে তোলা নগ্ন ছবি (তিনি ফটো মডেল ছিলেন) প্রকাশিত হয়েছে, যা ট্রাম্পকে বিব্রত করেছে। সব মিলিয়ে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক, অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। তবে চূড়ান্ত বিচারে পাল্লা হিলারির দিকে হেলে পড়েছে এখন। ট্রাম্প পিছিয়ে পড়েছেন। ১১টি রাজ্যের কথা বলা হচ্ছে (কলোরাডো, ফ্লোরিডা, আইওয়া, মিসিগান, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহিও, পেনসেলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া এবং উইনকিনসন), যাদের বলা হচ্ছে ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটস’ (Battleground states). এ রাজ্যগুলো বিগত দুইটি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এসব রাজ্যের ভোটাররা এখনও দ্বিধাবিভক্ত। তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট সমর্থন কোনো প্রার্থীর পক্ষেই নেই। কখনও তারা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে, কখনও রিপাবলিকানদের। এতদিন পর্যন্ত জনমত জরিপে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও, ট্রাম্প ব্যবধান এতদিনে আর কমিয়ে আনতে পারেননি। ফলে সুনির্দিষ্ট করে হয়তো বলা যাচ্ছে না। তবে মিডিয়া বলছে, হিলারি হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। দুইজন প্রার্থীকে আর কোনো ‘প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক’ এ অংশ নিতে হবে না। তারা প্রচারণা চালাবেন। এ সময়সীমার মধ্যে ট্রাম্প তার রেটিং বাড়াতে পারবেন কিনা, পারলে কতটুকু পারবেন, এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেক রিপাবলিকান সমর্থক এরই মধ্যে হিলারিকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছেন। প্রথম বিতর্কের পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে কিউবার সঙ্গে অবৈধ ব্যবসা করেছেন। বিতর্ক শেষ হওয়ার এক সপ্তাহও পার হয়নি, নতুন একটি জনমত জরিপ প্রকাশ করেছে মিডিয়া (টাইমস-পিকেউন/লুসিড প্রেসিডেন্সিয়াল ট্রাকিং পোল)। তাতে হিলারিকে ৫ পয়েন্টে এগিয়ে থাকার কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে নতুন বিতর্ক উঠেছে ট্রাম্প নাকি একসময় ‘পর্নো স্টার’ ছিলেন! সব মিলিয়ে নানা বিতর্ক, নানা প্রশ্নে আটকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারণা। মিডিয়াগুলোও এখন অনেকটা প্রো-হিলারি। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সমর্থন করছে হিলারিকে। তারপরও কথা থেকে যায়। তিনটি ‘প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক’ এ ‘জয়’ পাওয়া হিলারি ক্লিনটন কী তার এ বিজয়ের ধারা ধরে রাখতে পারবেন? ৮ নভেম্বর নির্বাচন। মাত্র বাকি আছে এক সপ্তাহ। সময়টা খুব বেশি নয়। এরই মাঝে হিলারি ক্লিনটনের জয় একরকম নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু ঈশানকোণে কোথায় যেন একটি কালো মেঘ! সর্বশেষ তৃতীয় বিতর্কে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি যদি নির্বাচনে হেরে যান(?), তাহলে কী তিনি নির্বাচনের ফল মেনে নেবেন? ট্রাম্প সরাসরি হ্যাঁ বা না বলেননি। ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন, নির্বাচনে কারচুপি হবে! তার এ  কারচুপির বক্তব্য এবং নির্বাচনের ফল মেনে নেয়ার স্পষ্ট ঘোষণা না থাকায় রাজনৈতিক পন্ডিতরা এখন নানা অঙ্ক করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচন হবে। নির্বাচকম-লীর ভোট যদি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তিনি কি উচ্চ আদালতে যাবেন? কংগ্রেসকে ব্যবহার করবেন তার স্বার্থে? এরই মধ্যে খোদ রিপাবলিকান শিবিরে তার বিরুদ্ধে একটা মত শক্তিশালী হচ্ছে। পল রায়ানের মতো উঠতি নেতারা ট্রাম্পের বিরোধিতা করছেন। তবে নির্বাচনী ফল যাই হোক না কেন, ট্রাম্পের নানা বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর একটা কালো দাগ এঁকে দিয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে তিনি বিতর্কিত করেছেন। মানুষের কাছে প্রচুর টাকা হলে তিনি যে কী করতে পারেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বড় প্রমাণ। যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মন্তব্য করে। সমালোচনা করে। এখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হলো। নির্বাচন একটি হবে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একজন নয়া প্রেসিডেন্ট পাবে, যিনি ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নেবেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে কী পরিবর্তন আসে, সেটাই দেখার বিষয়।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
30.10.2016
 

চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

 
 
 
সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পরপরই তিনি ভারতে যান ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিট সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ দিয়েছিলেন। ভারতে গোয়ায় ব্রিকসের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে ভারত ও চীনের মধ্যে মতানৈক্য লক্ষ্য করা গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্রিকস সম্মেলনকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন 'পাকিস্তান বিরোধী' একটা প্লাটফর্ম হিসেবে। তাতে তিনি সফল হননি বলে খোদ ভারতের পত্রপত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে। চীন ও রাশিয়া মোদির 'পাকিস্তান সন্ত্রাসের অাঁতুরঘর' এই বক্তব্যে সায় দেয়নি। একটি প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে, বাংলাদেশ কী এখন ভারতের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে! কেননা যেখানে ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্যের, সেখানে চীনের প্রতিশ্রুতি ২৪ বিলিয়ন ডলার। ১৯ অক্টোবর ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের এক প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানে এ ধরনের প্রশ্নেরই মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা তিনজন। নিউইয়র্ক থেকে আমি, ঢাকা থেকে অধ্যাপক আমেনা মোহসিন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম। শ্রোতাদের প্রশ্নের ধরন ছিল অনেকটা এরকমই_ বাংলাদেশ কী এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে। ভারতের পত্রপত্রিকায়ও আমি এ ধরনের ইঙ্গিত দেখেছি। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী। এশিয়ার দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় অর্থনীতির দেশ। আর চীন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। চীনের সঙ্গে সরাসরি কোনো সীমান্ত না থাকলেও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে চীনের সীমান্ত ২০০ কিলোমিটারও হবে না। যেখানে চীনের জিডিপির পরিমাণ ১১ দশমিক ৩৯২ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং দুটো বড় অর্থনীতির দেশ যখন আমাদের পাশে থাকে তখন তা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সেই আলোকেই রচিত। সুতরাং চীনের প্রেসিডেন্ট যখন বাংলাদেশ সফর করে যান, এর একটি প্রতিক্রিয়া থাকবেই। ওই সফরের সময় বাংলাদেশ চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এটি হচ্ছে 'ব্রেন চাইল্ড'। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে শি জিনপিংয়ের আফ্রিকা সফরও এই আলোকে রচিত হয়েছিল। চীন ইতোমধ্যে 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' বাস্তবায়নের জন্য একটি সিল্ক রোড ফান্ড গঠন করেছে। এই ফান্ডের পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ডলার। চীন-পাকিস্তান যে ইকোনমিক করিডোর গড়ে উঠছে, তাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেশ এই ফান্ড থেকে সাহায্য পাবে এবং তা দিয়ে মূলত সড়ক ও রেল পথ তৈরি করা হবে। অর্থাৎ অবকাঠামো খাতে চীন এই বরাদ্দ করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন এই ফান্ড উন্মুক্ত হবে।
বাংলাদেশ 'ওয়ান বেল্ড ওয়ান রোড' মহাপরিকল্পনায় এখন সংযুক্ত হয়েছে। তবে এতে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে_ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। ভারত এই মহাপরিকল্পনাটি খুব সহজভাবে নিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত ফাঁদ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভারত-চীন ফাঁদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন দেশে এই দুটো দেশ নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। জিবুতি, গাওদার, হামবানতোতা (শ্রীলংকা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীন নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ভারত একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই দ্বীপরাষ্ট্র দুটো সফরের সময় নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। ভারত এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করবে আগামীতে। ফলে চীনের 'মেরিটাইম সিল্ক রুট' নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে আমরা বাংলাদেশের 'জাতীয় স্বার্থ'কে অবশ্যই বিবেচনায় নেব। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে তেলের পাইপ লাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য অঞ্চলের জ্বালানি তেল চীন এ পথে খুব অল্প সময়ে এবং মধ্য এশিয়ার তেল চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই জ্বালানি তেলের ওপর চীন নির্ভরশীল। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-মান্দালয়-কক্সবাজার সড়কপথ (যাতে পরে কলকাতা সংযুক্ত হবে) নির্মাণ শেষ করতে হবে। ২০১৩ সালে চারটি দেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল এই সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১৪ সালে চীনে যান তখন তিনি কুনমিংয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন বাংলাদেশ কুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী। অতি সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফও বলেছেন বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। এখন যৌথ ইশতেহারে বিসিআইএস অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। তাতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হতে পারে। এতে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক করিডোর ব্যবহার করে মধ্য এশিয়া থেকে জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) আমদানি করতে পারে। সুতরাং চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচি চীনের স্বার্থে রচিত ও বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থকে একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হলে চীনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। এতে আমরা লাভবান হতে পারতাম। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলা (শ্রীলংকার হামবানতোতায় নির্মিত গভীর সমুদ্র বন্দরের ব্যাপারেও চীন নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছিল), চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি এবং সর্বশেষ চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা_ সব মিলিয়ে চীনের 'মেরিটাইম সিল্ক রোড'-এর ব্যাপারে একটা প্রশ্ন রেখে গেল। পাঠকদের জানিয়ে রাখি চীনের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় (২০১৪) সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু তখন তা হয়নি। তখন এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মতান্তরের কথা পত্রিকায় ছাপা হলেও মূল বিষয় ছিল ভারতের আপত্তি।
আরো বেশকিছু বিষয় আমাদের গভীরভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রযোজন। এক. যেসব প্রকল্পে এই চীনা ঋণ নেয়া হচ্ছে তা আমাদের উন্নয়নে কতটুকু কাজে লাগবে? প্রশ্ন এ কারণেই যে, ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। দুই. চীনা ঋণের শর্ত ও সুদের হার কতটুকু? এ ক্ষেত্রে ওইসব প্রকল্পে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহযোগিতা নিতে পারতাম কিনা? আমরা আদৌ বিশ্বব্যাংকের কাছে এ ব্যাপারে অ্যাপ্রোচ করেছিলাম কিনা, এটাও একটা প্রশ্ন। কেননা আমরা এটা মোটামুটিভাবে সবাই জানি যে, বিশ্বব্যাংক সাধারণত সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। তাদের দেয়া শর্তও সহনীয়। চীনা ঋণে চীনের ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। বিশ্বব্যাংকও তাই করে। কিন্তু চীনা ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে কতটুকু সততা ও 'ট্রান্সপারেন্সি' থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তিন. পদ্মা সেতুতে রেলযোগাযোগ স্থাপনে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এটা ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে 'তৃতীয় কোনো দেশ' এটা থেকে ফায়দা নেবে কিনা? কিংবা এটা ব্যবহার করলে এর 'মডালিটি' কী হবে? চার. পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা সহযোগিতা আদৌ নেয়া হবে কিনা? কেননা এটি একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান 'আদানি' গ্রুপ নির্মাণ করছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে চীনও এই প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়। সুতরাং পায়রা বন্দর নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্যদিয়ে দুদেশের সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হলো। এখন দেখতে হবে আগামী দিনগুলোয় আমরা এই সফরকে আমাদের স্বার্থে কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। ১১ দশমিক ৩৯২ ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সেই অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি সংযুক্ত হয় তাহলে তা থেকে বাংলাদেশেরই লাভবান হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা ভারতকে উপেক্ষা করে নয়। ভারত ও চীনকে সঙ্গে নিয়েই এবং এক ধরনের 'ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি' অনুসরণ করে আমরা ২০২১ সালের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারি।

(নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে)
Daly jai Jai Din25.10.2016

ঐতিহাসিক বিজয়ের পথে হিলারি ক্লিনটন

 
গত ১৯ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তৃতীয় ‘প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক’। ওই দিন নিউইয়র্কে বেশ গরম পড়েছিল। এর আগে দু’দিন বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল। পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল রাজনৈতিক উত্তাপও। আগের দুটি বিতর্কের মতো এবারও সর্বশেষ বিতর্কে অংশ নিলেন হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফক্স নিউজ এ টিভি বিতর্কের আয়োজন করেছিল। সারা দেশের মানুষ এবং আমাদের মতো ‘বিদেশীরাও’ প্রত্যক্ষ করলাম এক নোংরা বিতর্কের। আমেরিকার মতো একটি ‘সভ্য’ দেশে দু’জন প্রার্থীর একজন যিনি যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন, কিংবা হতে চান, তাদের বক্তব্য, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ‘নগ্ন চরিত্রটাকেই’ উšে§াচন করেছে। তৃতীয় বিতর্কের প্রথম ২০ মিনিট পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক ও শান্ত থাকলেও বেশি সময় লাগেনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আসল চরিত্র’ ফুটে উঠতে। তিনি প্রকাশ্যেই বললেন, হিলারি একজন ‘নষ্ট মহিলা’। মিথ্যাবাদী বলতেও তিনি দ্বিধা করলেন না।

আমি আগের কয়েকটি নির্বাচনের টিভি বিতর্কও দেখেছি। তখনও আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। কিন্তু এবারের বিতর্ক এবং পরস্পরকে আক্রমণ করে যেভাবে বক্তব্য রাখা হয়েছে এমনটি অতীতে আমি কখনও দেখিনি। দ্বিতীয় বিতর্কের সময়ও আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। লাখ লাখ মানুষ দ্বিতীয় বিতর্কের সময়ও প্রত্যক্ষ করেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে হিলারি ক্লিনটনকে জেলে পাঠাবেন! কী উদ্ধত আচরণ। একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট কি এমন কথা প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে বলতে পারেন? তাহলে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের গণতন্ত্রের পার্থক্য রইল কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র তো বিশ্বে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ সবক দেয়। গণতন্ত্রের তত্ত্ব দেয়। শর্ত দেয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার। কিন্তু এবার কেমন গণতন্ত্র দেখছে মার্কিন নাগরিকরা? অভিযোগের তীরটা যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে বেশি যাচ্ছে। তবে হিলারি ক্লিনটনও কম যান না।

গত ক’দিন ধরেই দেখছি মার্কিন টিভি চ্যানেলগুলোতে একাধিক মহিলা বক্তব্য দিচ্ছেন- তারা ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক অতীতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এসব মহিলার প্রায় সবাই এখন প্রৌঢ়, বয়স ৫০ অতিক্রম করেছেন আগেই। তারাই এখন বলছেন একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত বছর পর এ যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এলো কেন? কেন তারা আগে অভিযোগ করেননি? একজন মহিলা বললেন, ট্রাম্প তাকে তার ফ্লোরিডার ম্যানশনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার শরীরের সংবেদনশীল অংশে স্পর্শ করেছিলেন। এসব অভিযোগ ট্রাম্প নিজে অস্বীকার করেছেন বটে; কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব উপভোগ করছে। যদিও যৌনতা মার্কিন সমাজের একটি সাধারণ বিষয়। হিলারি ক্লিনটনের স্বামী বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় মনিকা লিউন্স্কির সঙ্গে এক ‘যৌন সম্পর্কে’ জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ট্রাম্প এ প্রসঙ্গটিও এনেছেন বিভিন্ন সময়ে। তবে ট্রাম্পের তৃতীয় স্ত্রী মেলেনিয়া তার স্বামীর এসব ‘কর্মকাণ্ডের’ জন্য ক্ষমা চেয়েছেন; এবং বলেছেন, ‘এই ট্রাম্পকে তিনি চেনেন না।’ স্পষ্টতই তিনি মহিলা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কতটুকু সফল হয়েছেন, বলা মুশকিল। ইতিমধ্যে ট্রাম্পের বিপক্ষে একটা জনমত শক্তিশালী হয়েছে। সর্বশেষ টিভি বিতর্কের পর সিএনএন/ওআরসি জরিপে দেখা গেছে, হিলারির পক্ষে ৫২ ভাগ মানুষ তাদের মতামত দিয়েছে। আর ট্রাম্পের পক্ষে দিয়েছে ৩৯ ভাগ। এ নিয়ে আরও দুটি টিভি বিতর্কের পর যে জনমত পাওয়া গেছে, তাতেও হিলারির পক্ষে ৫০ ভাগের ওপর রায় পড়েছিল। এর অর্থ, জনমত জরিপকারীদের মতে, স্পষ্টতই হিলারিই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। আর এর ফলে রচিত হতে যাচ্ছে একটি ইতিহাস। হিলারি ক্লিনটন ঢুকে যাচ্ছেন ইতিহাসের পাতায়।

তবে হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধেও যে অভিযোগ নেই, তা নয়। তার বিরুদ্ধে ট্রাম্প বারবার অভিযোগ আনছেন। প্রথম অভিযোগটি ছিল ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’ নিয়ে। ক্লিনটনের পরিবার এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। ক্লিনটন ও হিলারি এ ফাউন্ডেশনের জন্য বিদেশ থেকে অবৈধ অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং তাদের স্বার্থে কাজ করেছেন- এমন অভিযোগ বারবার করা হয়েছে। সর্বশেষ টিভি বিতর্কেও ট্রাম্প বললেন, সৌদি আরব থেকে হিলারি বেশ কয়েক মিলিয়ন ডলার গ্রহণ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে ৯/১১-এর ঘটনায় সৌদি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা এবং এ ব্যাপারে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত কংগ্রেস গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এ নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এমনই এক সময়ে খোদ ট্রাম্প যখন বলেন, হিলারি সৌদি আরব থেকে টাকা নিয়েছেন, তখন বিষয়টি বড় বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু ট্রাম্প বলেই বোধহয় তা হয়নি। এমনকি হিলারির ‘যোগ্যতা’ নিয়েও ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছেন। হিলারি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি বেনগাজি (লিবিয়া) দূতাবাসে জঙ্গি হামলা, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মৃত্যু রোধ করতে পারেননি। ট্রাম্প ছয়জনকে হাজির করেছিলেন, যাদের স্বজনরা বেনগাজি দূতাবাসে হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। এমনকি তিনি কেনিয়া থেকে ওবামার সৎ ভাইকেও নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। অন্যদিকে হিলারি বারবার ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের ‘সখ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তৃতীয় বিতর্কেও বলেছেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি হবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ‘পুতিনের পুতুল’।

তৃতীয় টিভি বিতর্কের পরদিন আমি যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া পর্যালোচনা করে দেখেছি। প্রায় সবাই হিলারির পক্ষে কথা বলেছেন। ৮ নভেম্বর নির্বাচন। কিন্তু তার আগেই মিডিয়া হিলারিকে প্রেসিডেন্ট ভাবতে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, বিতর্কে হিলারি প্রেসিডেন্টের মতোই আচরণ করেছেন। এমনকি ইউরোপের সংবাদপত্রগুলোর সুরও হিলারির পক্ষে। বলা ভালো, ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার পর বিগত ২৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। এই প্রথম একজন নারী এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সেটা হবে আরেক ইতিহাস। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নারী আন্দোলন তথা নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে এটা হবে একটি মাইলফলক। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বড় অর্থনীতি ও বড় গণতন্ত্রের দেশ হলেও এখানে নারীদের ভোটের অধিকারের ইতিহাস মাত্র ৯৬ বছরের। দীর্ঘদিন এখানে নারীদের ভোটের অধিকার দেয়া হয়নি। এ নিয়ে নারী আন্দোলনের ইতিহাসও বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে হিলারি ক্লিনটনের মনোনয়ন পাওয়া এখানকার নারী আন্দোলনকে আরও উজ্জীবিত করবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো কনজারভেটিভ সোসাইটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব সীমিত। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলে, কংগ্রেসের ৫৩৫টি আসনে (সিনেট ১০০, প্রতিনিধি পরিষদ ৪৩৫) মাত্র ১০৭ নারী আইনপ্রণেতা রয়েছেন (ডেমোক্রেট ৭৬, রিপাবলিকান ২৮ জন)। সিনেটে নারী প্রতিনিধি রয়েছেন ২০ জন (১০০ জনের মধ্যে, অর্থাৎ শতকরা ২০ ভাগ), আর প্রতিনিধি পরিষদে রয়েছেন মাত্র ৮৪ জন (শতকরা ১৯ দশমিক ৩ ভাগ)। সুতরাং এই সীমিত প্রতিনিধিত্বের মধ্যে দিয়ে নারীর পূর্ণ অধিকার রক্ষিত হয়েছে, এটি বলা যাবে না। হিলারি ক্লিনটনের সম্ভাব্য বিজয় যুক্তরাষ্ট্রের নারী সমাজের জন্য বড় ধরনের একটি অগ্রগতি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ভোটাররা সাধারণভাবে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নেন। অতীতে কখনও কখনও অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি প্রাধান্য পেয়েছে। ভোটাররা দেখতে চান এসব বিষয়ে প্রার্থীদের ভাবনা কী। এবার নির্দিষ্ট কোনো একটি বিষয় উঠে আসেনি। ট্রাম্প ইমিগ্রেশন তথা মুসলিমবিদ্বেষী একটা মনোভাব নিলেও জনমত জরিপে তা গুরুত্ব পায়নি। তৃতীয় বিতর্কের সময়ও এ ধরনের কিছু বিষয় উঠে এসেছে। বিশেষ করে আইএস, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে ট্রাম্প ও হিলারি বিতর্ক করলেও তারা ভবিষ্যতে কী করবেন, তা স্পষ্ট হয়নি। তবে হিলারি বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ১০০ দিনের মধ্যে ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে একটা রূপরেখা উপস্থাপন করবেন। সেটা কী তা তিনি বলেননি। ট্রাম্পের অভিযোগ, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে ওবামা প্রশাসনের নীতিই তিনি অব্যাহত রাখবেন। ট্রাম্পের অভিযোগ, ডেমোক্রেটরা আইএসকে সৃষ্টি করেছে, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে আইএস আরও শক্তিশালী হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা আরও বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে। ট্রাম্পের আরও অভিযোগ, ওবামা টিপিপি (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি করে অনেক মার্কিনির চাকরি হারানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে এই চুক্তি ও নাফটা চুক্তির (কানাডা, মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে মুক্তবাজার) বিষয়টির পুনর্বিবেচনা করবেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেছেন ট্রাম্প। তার অভিযোগ, মার্কিন নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের অর্থনৈতিক ‘প্রভাব’ বাড়ছে। এই ‘প্রভাব’ তিনি কমাতে চান।

অন্যদিকে ডেমোক্রেট শিবিরের বক্তব্য- ট্রাম্প অতিমাত্রায় দক্ষিণপন্থী ও যুদ্ধংদেহী। তিনি প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু করে দিতে পারেন। তিন অতিমাত্রায় রাশিয়াপন্থী। রাশিয়ায় তার বিশাল বিনিয়োগ আছে। পুতিনকে তিনি ওবামার চেয়েও যোগ্য নেতা মনে করেন! ফলে ট্রাম্পের অতি ‘রাশিয়াপ্রীতি’ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত করতে পারে। ট্রাম্প মূলত মুনাফা অর্জনের বিষয়টিই বেশি বোঝেন। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের সামাজিক কাঠামোর মানোন্নয়নের ব্যাপারে তার কোনো কমিটমেন্ট নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মুসলমানবিদ্বেষী ও মেক্সিকানবিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি সেনাবাহিনীর ‘গৌরবকে’ আঘাত করেছেন, এমন অভিযোগও উঠেছিল ডেমোক্রেট শিবিরের পক্ষ থেকে।

ইতিমধ্যে কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। পোস্টাল ব্যালটও শুরু হয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে তৃতীয় বিতর্কের পর হিলারির অবস্থান অনেক শক্তিশালী। তবে একটি প্রশ্ন বেশ আলোচিত হচ্ছে। তৃতীয় বিতর্কের শেষ সময়ে এসে ফক্সের উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস যখন ট্রাম্পকে শেষ প্রশ্নটি করেন- তিনি হেরে গেলে এ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন কিনা- তখন ট্রাম্প স্পষ্ট করে কোনো জবাব দেননি। অর্থাৎ প্রশ্ন থেকেই গেল, ফলাফল তিনি মেনে নিতে নাও পারেন! কারণ এর আগে তিনি বারবার বলে আসছিলেন, নির্বাচনে কারচুপি হতে পারে! তবে কীভাবে কারচুপি হবে, কারা কারচুপি করবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটা আদৌ সম্ভব কিনা- সেসব ট্রাম্প স্পষ্ট করেননি। তিনি মিডিয়াকে দুষছেন বারবার। মিডিয়া অসত্য কথা বলছে, এমনটি তিন একাধিকবার বলেছেন। এটা সত্য, মিডিয়া তার নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো প্রভাবশালী পত্রিকা হিলারিকে সমর্থন করছে।

নির্বাচনের আর বেশিদিন বাকি নেই। এ নিয়ে মানুষের মনে খুব যে আগ্রহ আছে, তা বলা যাবে না। কর্পোরেট হাউসগুলোও ট্রাম্পের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। মহিলাদের সম্পর্কে বারবার কটূক্তি করা, তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা, যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা- এসব কারণে ট্রাম্প মহিলা ভোটারদের ভোট কম পাবেন বলেই মনে হয়। এটা হিলারির জন্য প্লাস পয়েন্ট। ট্রাম্প দীর্ঘ প্রায় দু’দশক কোনো ট্যাক্স পরিশোধ করেননি। যিনি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক, পৃথিবীর অনেক দেশে যার ব্যবসা রয়েছে, তিনি কিনা আদৌ ট্যাক্স দেন না! এটা ট্রাম্প স্বীকার করে বলেছেন, তিনি আইন মেনেই এ কাজটি করেছেন। আইন তাকে এই সুযোগ এনে দিচ্ছে। এটাকে ইস্যু করেছেন হিলারি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ৫৩৮টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। কোনো রাজ্যে কোনো প্রার্থী কম ভোট পেলে যিনি বিজয়ী হবেন, তিনি ওই রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর সব ভোট পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। এখন যতই দিন যাচ্ছে, ততই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন হিলারি। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
25.10.2016

তিনি আসলেন, দেখলেন কিন্তু জয় করতে পারলেন কতটুকু



তিনি শি জিনপিং। চীনের প্রেসিডেন্ট এবং চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি ২২ ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার সফরের সময়। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে তিনি যাননি বটে কিন্তু সাভারে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন অথচ এই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল চীন। এখন আর বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চীনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলে না। কেননা চীন আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। তাই প্রশ্ন থেকে গেল একটাই শি জিনপিং আসলেন, দেখলেন কিন্তু জয় করতে পারলেন কি? চীনকে এখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত অংশীদার।’ ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুই লাখ কোটি টাকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। বেসরকারি পর্যায়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি। ৬টি প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে। সাদা চোখে দেখলে দেখা যাবে এটা একটা বিশাল পাওনা আমাদের জন্য। কিন্তু প্রশ্নও আছে অনেক। কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় দু’ দুটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সারকারখানা স্থাপন এসবই আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় চীনের সহযোগিতা, সামুদ্রিক সহযোগিতা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুটি বিষয়ে আমার এক ধরনের আশঙ্কা থেকেই গেল। একটি হচ্ছে বাংলাদেশে ‘চীনের ওয়ান বেল্ট ও ওয়ান রোড’ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছে। তবে আমি নিশ্চিত নই এর ধরন কী হবে? দ্বিতীয়ত, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে (কুনমিং) বাংলাদেশের কক্সবাজারকে সংযুক্ত করা। আমি নিশ্চিত নই কিভাবে এটি বাস্তবায়ন হবে। 
‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে চীনের বড় আগ্রহ রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও উপকৃত হতে পারে। ইতোমধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মধ্য এশিয়া, মস্কো ও পাকিস্তানও সফর করেছেন তার মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে। চীনের প্রেসিডেন্টের আফ্রিকা সফরও এই আলোকে রচিত হয়েছিল। চীনের ইতোমধ্যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বাস্তবায়নের জন্য একটি সিল্ক রোড ফান্ড গঠন করেছে। এই ফান্ডের পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ডলার। চীন-পাকিস্তান যে ইকোনমিক করিডর গড়ে উঠছে তাতে ব্যয় রাখা হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার, যার মাঝে ১১ বিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেশ এই ফান্ড থেকে সাহায্য পাবে এবং তা দিয়ে মূলত সড়ক ও রেলপথ তৈরি করা হবে। অর্থাৎ অবকাঠামো খাতে চীন এই অর্থ বরাদ্দ করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন এই ফান্ড উš§ুক্ত হবে। 
বাংলাদেশ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনায় এখন সংযুক্ত হয়েছে। তবে এতে করে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। ভারত এই মহাপরিকল্পনাটি খুব সহজভাবে নিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত বৈরী পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভারত-চীন বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি আসলেন, দেখলেন কিন্তু জয় করতে পারলেন কতটুকুদেখা যায় ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন দেশে এই দুটি দেশ নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। জিবুতি, গাওদার, হামমানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মুজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীন নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ভারত একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই দীপ রাষ্ট্র দুটি সফরের সময় এই নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। ভারত এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সখ্য গড়ে উঠছে, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করবে আগামীতে। ফলে চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে আমরা বাংলাদেশের ‘জাতীয় স্বার্থ’কে অবশ্যই বিবেচনায় নেব। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য অঞ্চলের জ্বালানি তেল চীন এ পথে খুব অল্প সময়ে এবং মধ্য এশিয়ার তেল চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই জ্বালানি তেলের ওপর চীন নির্ভরশীল। চীনের অর্থনৈকি উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক পথ (যাতে পরে কলকাতা সংযুক্ত হবে) নির্মাণ শেষ করতে হবে। ২০১৩ সালে চারটি দেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল এই সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১৪ সালে চীন যান তখন তিনি কুনমিংয়ে এক বৈঠকে বলেছিলেন বাংলাদেশ কুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী। অতি সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফও বলেছেন চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপানের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। এখন যৌথ ইশতিহারে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। তাতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হতে পারে। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক করিডর ব্যবহার করে এশিয়া থেকে জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) আমদানি করতে পারে। সুতরাং চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি চীনের স্বার্থে রচিত ও বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থকে একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হলে চীনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। এতে করে আমরা লাভবান হতে পারতাম। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলায় শ্রীলঙ্কার হামমামতোতায় নির্মিত গভীর সমুদ্র বন্দরের ব্যাপারেও চীন নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি এবং সর্বশেষ চীন-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা সব মিলিয়ে চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’-এর ব্যাপারে একটা প্রশ্ন রেখে গেল। চীনে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় (২০১৪) সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু তখন তা হয়নি। তখন এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মতান্তরের কথা পত্রিকায় ছাপা হলেও মূল বিষয় ছিল ভারতের আপত্তি। 
আরো বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এক. যে সব প্রকল্পে এই চীনা ঋণ নেয়া হয়েছে তা আমাদের উন্নয়নের কতটুকু কাজে লাগবে? প্রশ্ন এ কারণেই যে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। দুই. চীনা ঋণের শর্ত ও সুদের হার কতটুকু? এক্ষেত্রে এসব প্রকল্পে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহযোগিতা নিতে পারতাম কিনা? আমরা আদৌ বিশ্বব্যাংকের কাছে এ ব্যাপারে এপ্রোচ করেছিলাম কিনা এটাও এটা প্রশ্ন। কেননা আমরা এটা মোটামুটিভাবে সবাই জানি যে, বিশ্বব্যাংক সাধারণত সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। চীনা ঋণে চীনের ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। বিশ্বব্যাংকও তাই করে। কিন্তু চীনা ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে কতটুকু সততা ও ‘ট্রান্সপারেন্সি’ থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তিন. পদ্মা সেতুতে রেল যোগাযোগ স্থাপনে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এটা ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘তৃতীয় কোনো দেশ’ এটা থেকে ফায়দা নেবে কিনা। কিংবা এটা ব্যবহার করলে এর ‘মডালিটি’ কি হবে। চার. পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা সহযোগিতা আদৌ নেয়া হবে কিনা। কেননা এটি একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘আদানি’ গ্রুপ নির্মাণ করছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে চীনও এই প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়। সুতরাং পায়রা বন্দর নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। 
শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হলো। এখন দেখতে হবে আগামী দিনগুলোতে আমরা এই সফরকে আমাদের স্বার্থে কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। ১১ দশমিক ৩৯২ ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সেই অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি সংযুক্ত হয় তাহলে তা থেকে বাংলাদেশেরই লাভবান হওয়ার কথা। 
নিউইর্য়ক, যুক্তরাষ্ট্র 
Daily Manobkontho
25.10.2016

আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে

  
             

চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর ও গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য নয়। কিন্তু বিমসটেক বা ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’ এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ১৯৯৭ সালে সংস্থাটি গঠনের পর থেকে বাংলাদেশ অন্তত দুইটি সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রথমটি হচ্ছে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আর দ্বিতীয়টি পরিবেশ সংক্রান্ত। বিশ্বের বড় অর্থনীতির জোট হতে যাচ্ছে ব্রিকস। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ ভাগ মানুষ আর ১৬ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি নিয়ে ব্রিকস গড়ে উঠছে। আর এখন ব্রিকস-বিমসটেক শীর্ষ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ব্রিকসের মতো বড় অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত হলো। নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। একই সঙ্গে ৩০ বছর পর চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর প্রমাণ করেছে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কত শক্তিশালী। এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী (আন্তর্জাতিক সহযোগিতা) রোয়ি স্টুয়ার্টও বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। এর মাঝে জন কেরির সফর ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
জন কেরির ঢাকা সফর অনেক আগেই প্রত্যাশিত ছিল। গত ৪ বছরে এটা ছিল কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিতীয় ঢাকা সফর। ২০১২ সালের মে মাসে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফর করে গেছেন। হিলারি ক্লিনটন বর্তমানে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী হিসেবে নভেম্বরের (২০১৬) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে জন কেরির সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেরির সঙ্গে এসেছিলেন নিশা দেশাই বিসওয়াল, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নিশা দেশাই এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তার যথেষ্ট ধারণা রয়েছে। সুতরাং কেরি তার ঢাকা সফরে যখন নিশা দেশাইকে সঙ্গে নিয়ে আসেন, তখন বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশকে কত গুরুত্ব দেয়। মূলত এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশ একটি শক্ত অবস্থানে আছে। দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা ও ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর তৎপরতার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে, এটা কেরি স্বীকার করেছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। কেননা বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন এখনও শ্লথ চলছে, তখন বাংলাদেশ তার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের উপরে ধরে রেখেছে। তৈরি পোশাক নিয়ে হাজারটা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য বাংলাদেশের অনুকূলে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে ৩ হাজার ৫২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছে ৪৩৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মাত্র ৬ মাসে ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৬১২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৪৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শক্ত অবস্থানে আছে। সুতরাং কেরি যখন বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেন, তখন সত্যটাই তিনি তুলে ধরেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০১২ সালে হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। অর্থাৎ বিশ্ব আসরে বাংলাদেশ যে একটি শক্তি এবং বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা যে রয়েছে, হিলারি ক্লিনটন সেটা স্বীকার করে গিয়েছিলেন। আর আজ ৪ বছর পর কেরিরও স্বীকারোক্তি মিলল। চীনা প্রেসিডেন্টও ঢাকায় এটা স্বীকার করে গেলেন।
কেরির ঢাকা সফরে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রশ্নটিও এসেছিল। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চেয়েছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করতে ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করতেও দুই দেশ রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। জঙ্গিবাদ, জেএসপি সুবিধা ইত্যাদি প্রশ্নে বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি এবং যুক্তরাষ্ট্র কার্যত বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে সমর্থন করে গেছে। একটা জিনিস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। সত্তর দশকের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। বাংলাদেশ আজ বিশ্বকে দিতে পারে। বাংলাদেশের সামর্থ্য বেড়েছে। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা আজ বিশ্বে স্বীকৃত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশংসা করার মতো। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সংলাপ পার্টনার। নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর একবার সংলাপে মিলিত হয়। দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেই সঙ্গে ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সন্দিহান। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তার ভূমিকা পালন করে আসছে। দক্ষিণ চীন সাগরের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং ভারত মহাসাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব দিনে দিনে বাড়ছেই। ফলে খুব সঙ্গত কারণেই চীনের যে এ অঞ্চলের ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ শরিক হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের কোনো নজির নেই। বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করেই তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে এ জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় যে ক’টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এ জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। বাংলাদেশ ‘ছোট’ দেশ হতে পারে। কিন্তু উঠতি অর্থনীতির ১১টি দেশের মাঝে বাংলাদেশ রয়েছে। আমরা চীনের অভিজ্ঞতাকে বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারি। বাংলাদেশ আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় অবদান রাখবে। যে ১১টি দেশকে আগামীতে অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। বাংলাদেশের এ উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় চীন আমাদের সহযাত্রী হতে পারে। উন্নয়নের একটা অন্যতম শর্ত হচ্ছে, এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলকে সংযুক্ত করা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। চীন এ ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। চীন এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে, যাতে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। চীন এখন বড় শিল্পের দিকে ঝুঁকছে। ছোট ছোট কলকারখানা চীন অন্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে কম্বোডিয়া উপকৃত হচ্ছে। আমরাও এ সুযোগটি গ্রহণ করতে পারি। আমরা চীনাদের জন্য বেশ কয়েকটি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পাঞ্চল (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠা করতে পারি। এমনকি চীনাদের সহযোগিতা নিয়ে আমরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালু করতে পারি। আমাদের রয়েছে একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু এ প্রজন্ম প্রশিক্ষিত নয়। দক্ষ নয়। যুক্তিহীনভাবে তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে এ তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশে বেকার সমস্যাকে প্রকট করছে। আমরা এ তরুণ প্রজন্মকে একটি প্রশিক্ষত জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। এক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা আমরা নিতে পারি। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আমাদের প্রতিকূলে। এ বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা কমিয়ে আনতে হবে। চীন যে ৫ হাজার পণ্যের (বাংলাদেশী) চীনা বাজারে প্রবেশের (শুল্কমুক্ত) সুযোগ করে দিয়েছিল, আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। অর্থাৎ ওই ৫ হাজার পণ্যের মাঝে অনেক পণ্যই বাংলাদেশ উৎপাদন করে না। এক্ষেত্রে পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। শুধু তৈরি পোশাক আর ওষুধ রফতানির ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। এজন্য চীনের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। চীন আফ্রিকায় বিপুল বিনিয়োগ করছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগ কম। এটা আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর আমাদের একটা সুযোগ করে দিয়ে গেল। এ  সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় ৬১টি দেশের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে সংযুক্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’ এর মাধ্যমে ইউরোপ হয়ে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে চীন। চীন এরই মধ্যে ১২টি দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আরও বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, কোনো একটি ক্ষেত্রেও আমরা চীনের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত নই। চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’ এর সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হলে   উপকৃত হবে। চীনের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে পারলে আমাদের পণ্যের একটি বাজার সৃষ্টি হতে পারত চীনে। এ থেকে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতকে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দিলেও নিকট প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক রেখে একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। তবে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় বেশি। চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের’ কোনো নজির নেই। চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির ধারাকে কোনো কোনো চীনা পর্যবেক্ষক ‘চীনা মার্শাল প্লান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপকে পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল, যা ‘মার্শাল প্লান’ নামে অভিহিত হয়েছিল। অনেকটা সেই পরিকল্পনার ধাঁচেই চীন এখন পুনর্গঠন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যা চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘চায়না মার্শাল প্লান’ হিসেবে। প্রেসিডেন্ট শি এ পরিকল্পনার তিনটি অংশের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমনÑ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করা, অন্য কোনো দেশকে ‘প্রভাব বলয়’ এর আওতায় না নেয়া এবং অন্য দেশে আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা না করা। সাম্প্রতিক চীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক রক্ষা করছে, তাতে এ নীতি প্রতিফলিত হচ্ছে। তাই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ‘আধিপত্য’ বা ‘কর্তৃত্ব’ করার প্রশ্নটি কখনও বড় হয়ে দেখা দেয়নি। যেহেতু বাংলাদেশ আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি বড় অবদান রাখছে এবং উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ আজ স্বীকৃত। সুতরাং বাংলাদেশকে তার অবস্থান ধরে রাখতে হলে তার পররাষ্ট্রনীতি সেই আঙ্গিকে সাজাতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর এবং ব্রিকস-বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন তার অবস্থান শক্তিশালী করল।
Daily Alokito Bangladesh
23.10.2016

জাতিসংঘের নতুন মহাসচিব কি পারবেন?


জাতিসংঘের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে লিখছি। ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের জন্মদিন। বিশ্বসংস্থাটি একজন নতুন মহাসচিব পেয়েছে। তিনি হচ্ছেন পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এন্টোনিও গুটেররেস। তিনি হতে যাচ্ছেন জাতিসংঘের নবম মহাসচিব। চলতি ডিসেম্বরে বর্তমান মহাসচিব বান কি মুনের মেয়াদ শেষ হবে এবং আগামী জানুয়ারিতে (২০১৭) গুটেররেস তার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন (৭১তম) শেষ হয়েছে। এ অধিবেশনে ১৩ অক্টোবর এন্টোনিও গুটেররেসের মনোনয়ন অনুমোদিত হয়। এর আগে তিনি জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান ছিলেন (২০০৫-২০১৫)। তার মনোনয়ন সর্বজন গ্রহণযোগ্য হলেও একটি প্রশ্ন উঠেছে- আগামীতে জাতিসংঘ কি বিশ্ব সমস্যার সমাধানে কোনো বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে? যদি না পারে, তাহলে জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু? শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের নীতিনির্ধারণী কাঠামোয় তৃতীয় বিশ্বের, এমনকি মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত বলেও অনেকে মনে করেন।
 
বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য, মধ্যপ্রাচ্যে উগ্রপন্থী রাজনীতির বিকাশ, বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা রোধে ব্যর্থতা একুশ শতকে জাতিসংঘের ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অভিবাসন সমস্যা। এ নিয়ে সাধারণ পরিষদের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন শুরুর আগে একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেও তা ছিল অনেকটা ‘লোক দেখানো’- সেখানে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। ফলে একটা প্রশ্ন থাকলই। প্রতি বছর একবার করে শীর্ষ সম্মেলন করে লাভ কী? বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানরা শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ৫ মিনিট করে সবাই বক্তৃতা দেন (মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আবার একটু বেশি সময় দেয়া হয়)। তারপর ফটোসেশন হয়। ছবি তোলা হয়। পার্টি হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠকও করেন। সাইড লাইনে কেউ কেউ কথাও বলেন। তারপর যে যার মতো চলে যান। লাখ লাখ ডলার খরচ করে এ ধরনের শীর্ষ সম্মেলন করার অর্থ কী, যদি কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা না-ই যায়?

এ শীর্ষ সম্মেলনটি এবার অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন এক সময়, যখন সিরিয়ায় শিশুরা বোমাবর্ষণে মারা যাচ্ছে। আলেপ্পোতে মানুষ আটকে আছে। তাদের কাছে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। এমনকি খাদ্যদ্রব্য বহনকারী রেডক্রসের গাড়ি বহরের ওপর বোমাবর্ষণ করা হলে রেডক্রস তাদের তৎপরতা বন্ধ করেও দিয়েছিল। জাতিসংঘ সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, এমনকি আফগানিস্তানে ‘যুদ্ধ’ বন্ধ করতে পারেনি। এ যুদ্ধ ওইসব দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এ প্রশ্ন যুক্তিযুক্ত যে, জাতিসংঘ যদি যুদ্ধ থামাতে না পারে, যদি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে এ সংস্থার প্রয়োজন কী? উন্নত বিশ্ব নিজেদের স্বার্থেই জাতিসংঘকে টিকিয়ে রাখছে। ‘যুদ্ধ’ তাদেরই সৃষ্টি। সুতরাং ‘যুদ্ধ’ থেমে যাবে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, ১৯৪৫ আর ২০১৬ এক নয়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের সান-ফ্রান্সিসকো শহরে যে প্রতিষ্ঠানটির জš§ হয়েছিল, আজ সেই জাতিসংঘের সদস্য ১৯৫টি রাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে মাত্র ৫০টি দেশ নিয়ে জাতিসংঘ তার যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৪৫ সালে যে বিশ্ব পরিস্থিতি ছিল, আজকের বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাকে মেলানো যাবে না। তবে এটা সত্য- কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাফল্য রয়েছে। ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় প্রথম যুদ্ধ ও কুয়েতকে শত্র“মুক্ত করা, এল সালভাদর, কম্বোডিয়া ও নামিবিয়ায় পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া এবং শান্তি ফর্মুলায় রাজি করানোর মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছিল, স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যবস্থায় জাতিসংঘের একটি ভূমিকা রয়েছে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে সেখানে শান্তিরক্ষী পাঠানো, কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে শান্তিরক্ষী পাঠানো এবং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, নেপালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জাতিসংঘের উদ্যোগ যে কোনো বিবেচনায় প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ বছর ধরে আফগানিস্তান, ইরাক আর সিরিয়ায় যে ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করে আসছে, জাতিসংঘ তা বন্ধ করতে পারেনি। কোনো বড় উদ্যোগও নিতে দেখা যায়নি সংস্থাটিকে। একটি পরিসংখ্যান দেই। ‘যুদ্ধে’ ইরাকি নাগরিকের মৃত্যুর সংখ্যা ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯০। আর যুক্তরাষ্ট্র এরই মাঝে এ যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে (ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মতে) ৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ২০১৭ সালের যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটে যা যুক্ত হবে, তা যোগ করলে এর পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৭৯ ট্রিলিয়ন ডলার। চিন্তা করা যায়, কী বিপুল পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করছে শুধু যুদ্ধের পেছনে! অথচ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি। বিশ্বে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের ব্যাপারে দেশটির ভূমিকা বড়। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মাধ্যমে আফ্রিকা ও দারিদ্র্যপীড়িত দক্ষিণ এশিয়ায় বড় অবদান রাখতে পারত। ব্রাজিলের মতো দেশ, যারা কিনা অলিম্পিক গেমসের আয়োজন করল, সেটি একটি ‘বস্তির নগরীর’ দেশে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জাতিসংঘের ভূমিকা এখানে গৌণ। সিরিয়া ও ইরাক থেকে প্রায় ৫০ লাখ অভিবাসী দেশান্তরিত হয়েছে। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করার সময় কত নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব কারও কাছে নেই। জাতিসংঘ এ অভিবাসীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। জীবনের বেঁচে থাকার আশায় এরা যখন ইউরোপের বনে-জঙ্গলে, রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়িয়েছে, জাতিসংঘ তাদের সাহায্যে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। প্রশ্নটা তাই ঘুরেফিরে আসবেই- জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা তাহলে কী? নতুন মহাসচিব এক্ষেত্রে কী ভূমিকা নেবেন?

আসলে জাতিসংঘের বর্তমান কাঠামোয় উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো ভূমিকা নেই। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই ইরাকে হামলা চালিয়েছিল এবং দেশটি দখল করে নিয়েছিল, যা ছিল জাতিসংঘ সনদের বরখেলাপ। অথচ এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেনি জাতিসংঘ। অতি সম্প্রতি ব্রিটেনের ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্বীকার করেছেন, ইরাক আক্রমণ ছিল ভুল। কিন্তু তার এই ‘ভুল’ স্বীকারের জন্য ব্লেয়ার কিংবা ব্রিটেনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (হেগ) বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি। ২০১১ সালে তথাকথিত ‘মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ তুলে লিবিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। ওই হামলার ফলে গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু দেশটি কার্যত এখন একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়া একসময় ছিল সমৃদ্ধ দুটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, মানুষ সেখানে শান্তিতে ছিল। রাষ্ট্র নাগরিক সুবিধা সেখানে নিশ্চিত করেছিল। আজ দেশ দুটি মূলত অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং কার্যত কয়েক টুকরায় ভাগ হয়ে গেছে। এর জন্য দায়ী কে? জাতিসংঘের ভূমিকাই বা এক্ষেত্রে কী? সিরিয়ায় যখন ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটল, যখন লাখ লাখ লোক দেশান্তরিত হল, তখন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ‘মানবাধিকার রক্ষায় হস্তক্ষেপ’ করে সেখানে মেরিন সেনা পাঠায়নি। ১৯৯০ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো জাতিসংঘ সিরিয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষায় সেখানে বহুজাতিক সৈন্য পাঠায়নি। অর্থাৎ জাতিসংঘ এক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তির স্বার্থের বাইরে যেতে পারেনি। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থেই সিরিয়ায় ‘যুদ্ধ’ জিইয়ে রাখছে।

জাতিসংঘের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধিতে তার শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ নেই। স্থায়ী পরিষদের সদস্যপদ ৫টি, যাদের ‘ভেটো’ ক্ষমতা রয়েছে। অস্থায়ী সদস্য ১৫টি। স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। জাতিসংঘের উদ্যোগে অনেক আগেই Commission on Global Governance নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জাতিসংঘে কীভাবে সংস্কার আনা যায়, সে ব্যাপারে একটি সুপারিশ করা। সিদ্ধার্থ রামপাল ও ইনভার কার্লসন ছিলেন ওই কমিশনের যুগ্ম চেয়ারম্যান। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। ওই কমিশনের সুপারিশে নিরাপত্তা পরিষদে এক ধরনের ‘স্ট্যান্ডিং’ সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যার সদস্য সংখ্যা হবে ৫। এর মধ্যে দুটি দেশ আসবে উন্নত বিশ্ব থেকে, বাকি ৩টি দেশ আসবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে। তাদের কোনো ‘ভেটো’ ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছরেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে উন্নত দেশগুলোর মধ্য থেকে জাপান ও জার্মানি ভেটো ক্ষমতাসহ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ চায়। উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে ভারত স্থায়ী সদস্যপদের দাবিদার। সেখানে আবার চীন ও পাকিস্তানের আপত্তি রয়েছে। ভারতের দাবি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু ভারতের প্রতি স্থায়ী সদস্যভুক্ত সবার সমর্থন রয়েছে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে উন্নত বিশ্বকে। বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণের কারণেই বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘কপ’ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও এবং সর্বশেষ প্যারিস সম্মেলনে (কপ-২১) একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা জাতিসংঘের নেই। জাতিসংঘের সর্বশেষ সম্মেলনে (২০১৫) Sustainable Development Goalsকর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে বেশকিছু কর্মসূচি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। এর আগে Millennium Development Goals কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। এটা বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১৫ সালে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক দেশ এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে Sustainable Development Goals নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্য ও সহযোগিতার। সেই সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তরের। এ কাজটি জাতিসংঘ করতে পারবে বলে মনে হয় না।

উদ্বাস্তু সমস্যা এ মুহূর্তে অন্যতম আলোচিত সমস্যা। ৫০ লাখ মানুষ (সিরিয়া-ইরাকের) এখন ‘যুদ্ধের’ কারণে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়েছেন। কিন্তু ইউরোপে এটা একটা বড় সমস্যার জন্ম দিয়েছে। ‘ইন্টিগ্রেশন’ নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। উপরন্তু রয়ে গেছে ধর্মীয় সমস্যা। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের কোনো বড় ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এবারও আমরা জাতিসংঘকে কোনো বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখলাম না।

জাতিসংঘের ৭১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সময়টা একেবারে কম নয়। প্রতি বছর আয়োজিত শীর্ষ সম্মেলনে আমরা অনেক ভালো ভালো কথা শুনি বটে; কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য তা কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি। শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব যে অর্থ ব্যয় করে, তা অর্থহীন। জাতিসংঘ মূলত একটি ‘টকিং ক্লাবে’ পরিণত হয়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতারা আসেন, ছবি তোলেন, বক্তৃতা করেন। ব্যাস এ পর্যন্তই। বিশ্ব এক ভয়াবহ সংকটের দিকে যাচ্ছে। একটি ‘মুসলমানবিদ্বেষী’ মনোভাব সারা বিশ্বে অত্যন্ত সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যার শতকরা ২৩ ভাগ (১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ) ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অথচ শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে এক করে দেখানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনে জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকলই- প্রায় ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক ব্যয় নিয়ে (২০১৬-১৭ বাজেট) এ প্রতিষ্ঠানটি আর কতদিন টিকে থাকবে? শুধু ফটোসেশন আর বক্তৃতা দেয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না। সুতরাং জাতিসংঘের সংস্কার জরুরি। নতুন মহাসচিব এন্টোনিও গুটেররেস এ ব্যাপারে কতদূর যেতে পারবেন? অভিবাসী সমস্যাটা তিনি ভালো বোঝেন। তিনি এ সংস্থার প্রধান ছিলেন। কিন্তু সমস্যার মূলে তিনি যেতে পারেননি। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ার মূল সমস্যা রাজনৈতিক। বিশ্ব সম্প্রদায় এ সমস্যাটাকে দেখছে ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। সিরিয়ায় দুই বড় শক্তির (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া) সামরিক হস্তক্ষেপ ও বিমান হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এন্টোনিও গুটেররেস যখন মহাসচিব হিসেবে অনুমোদন পেলেন, তখনও সিরিয়ার অভিবাসীদের দেশত্যাগের খবর পশ্চিমা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জাতিসংঘ এখানে নিশ্চুপ। অর্থাৎ জাতিসংঘ অতীতে যেমন পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি, তেমনি আজও যে যেতে পারবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এন্টোনিও গুটেররেস মহাসচিবের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। এবার একজন নারীর (১৫ জনের মধ্যে মোট সাতজন নারী এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন) মহাসচিব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তা হয়নি। জাতিসংঘের শীর্ষ পদগুলোয় ‘জেন্ডার বৈষম্য’ থেকেই গেল। আগামী ৫ বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত গুটেররেস দায়িত্বে থাকবেন। সময়টা খুব ভালো, তা বলা যাবে না একেবারেই। বিশ্বে নানা সমস্যা বাড়ছে। স্নায়ুযুদ্ধ ২-এর ধারণা শক্তিশালী হচ্ছে। জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বৈষম্য বাড়ছে। সাইবার ক্রাইম, পরিবেশ বিপর্যয় নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আগের মহাসচিবদের তুলনায় নতুন মহাসচিবের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি।

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Jugantor
20.10.2016

চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের তাৎপর্য




চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং তাঁর ঢাকা সফর শেষ করেছেন ১৫ অক্টোবর। যেকোনো বিবেচনায় এটি কোনো সাধারণ সফর ছিল না। পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতি, আঞ্চলিক রাজনীতি, ভারত মহাসাগরে ভারত ও চীনের মধ্যে কর্তৃত্ব করার প্রবণতা, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ইত্যাদি নানা কারণে শি চিনপিংয়ের সফর হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি চীনা প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য, চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মন্তব্য কিংবা যৌথ ঘোষণাপত্রের বক্তব্য প্রমাণ করে, চীনকে বাংলাদেশ যেমন গুরুত্ব দেয়, ঠিক তেমনি চীনও বাংলাদেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। শি চিনপিং বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, শি চিনপিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উপনীত হবে। চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অভিহিত করা হয়েছে ‘কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে। তবে এই ‘কৌশলগত অংশীদার’ বলতে চীন কী বোঝাতে চাচ্ছে, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এর সঙ্গে ‘সামরিক উপাদান’ আদৌ জড়িত নেই কিংবা চীন যে মেরিটাইম সিল্ক রুটের প্রস্তাব বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কতটুকু থাকছে, এ বিষয়টিও স্পষ্ট হয়নি। যদিও পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট করা হয়েছে যে ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
যৌথ ঘোষণাপত্রে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ কর্মসূচির প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনের কথা বলা হয়েছে। বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) অর্থনৈতিক করিডর প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দেওয়ার বিষয়েও উভয় পক্ষ একমত হয়েছে—যৌথ বিবৃতিতে এমন কথাও উল্লেখ আছে। প্রশ্ন এখানেই। সোনাদিয়ায় (কক্সবাজার) যদি গভীর একটি সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হয়, তাহলে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে কিভাবে? চীনের এই মহাপরিকল্পনা একদিকে চীনের একটি অংশ শি আনকে (xi AN) মধ্য এশিয়ার সঙ্গে হল্যান্ডের রটারডাম হয়ে জার্মানির হামর্বুগ ও মাদ্রিদকে সংযুক্ত করবে। একই সঙ্গে ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর মাধ্যমে চীনের অন্য একটি অংশের (Fuzhou) সঙ্গে আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হবে। শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর ও মিয়ানমার এই পরিকল্পনায় সংযুক্ত হচ্ছে। এখন কি বাংলাদেশও সংযুক্ত হলো? কিভাবে? প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া, মধ্য এশিয়াসহ প্রায় ৬০টি দেশ এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ (মেরিটাইম সিল্ক রুটসহ) পরিকল্পনায় সংযুক্ত হলেও ভারত এখন অবধি তার অবস্থান এ ব্যাপারে স্পষ্ট করেনি। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার অতীতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টির ব্যাপারে আদৌ চিন্তাভাবনা না করলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক্যাল স্টাডিজে’ (বিস) দুই-একবার সেমিনার হয়েছে। বিসের কর্মকর্তারা চীন সফর করেছেন। কিন্তু খুব সিরিয়াস ধরনের কোনো গবেষণা সেখানে হয়নি। আমার কাছে কখনো মনে হয়নি, বাংলাদেশ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’, বিশেষ করে ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর ব্যাপারে খুব আগ্রহী। তবে বাংলাদেশ বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কপথ নির্মাণের যে প্রস্তাব, তাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। বস্তুত, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ এবং ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’-এর আওতায় চীন দুটি ‘ইকোনমিক করিডর’ সৃষ্টি করছে। একটি কুনমিং থেকে কক্সবাজার সড়ক তথা রেলপথ। দ্বিতীয়টি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের খাসগর থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত রেল ও সড়কপথ। এই অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। কেননা এই সড়কপথ বিতর্কিত ‘আজাদ কাশ্মীর’ এবং ইসলামাবাদ হয়ে বেলুচিস্তান প্রদেশের ভেতর দিয়ে গাওদার সমুদ্রবন্দরে গিয়ে মিশেছে। এই অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে বেলুচি নেতাদের আপত্তি রয়েছে। বেলুচ নেতা ব্রাহামদাগ বুগতি চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত এই অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে!
‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে চীনের বড় আগ্রহ রয়েছে—এটি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও উপকৃত হতে পারে। ইতিমধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং মধ্য এশিয়া, মস্কো ও পাকিস্তানও সফর করেছেন তাঁর মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে। চীনের প্রেসিডেন্টের আফ্রিকা সফরও এই আলোকে রচিত হয়েছিল। চীন ইতিমধ্যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ বাস্তবায়নের জন্য একটি সিল্ক রোড ফান্ড গঠন করেছে। এই ফান্ডের পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ডলার। চীন-পাকিস্তান যে ইকোনমিক করিডর গড়ে উঠছে, তাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেশ এই ফান্ড থেকে সাহায্য পাবে। তা দিয়ে মূলত সড়ক ও রেলপথ তৈরি করা হবে। অর্থাৎ অবকাঠামো খাতে চীন এই অর্থ বরাদ্দ করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন এই ফান্ড উন্মুক্ত হবে।
বাংলাদেশ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ মহাপরিকল্পনায় এখন সংযুক্ত হয়েছে। তবে এতে করে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে—বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। ভারত এই মহাপরিকল্পনাটি খুব সহজভাবে নিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইতিমধ্যে ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভারত-চীন দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন দেশে এই দুটি দেশ নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। জিবুতি, গাওদার, হামবানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়ায় চীনের নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ভারত একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই দ্বীপরাষ্ট্র দুটি সফরের সময় এই নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। ভারত এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করবে আগামীতে। ফলে চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে আমরা বাংলাদেশের ‘জাতীয় স্বার্থ’কে অবশ্যই বিবেচনায় নেব। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য অঞ্চলের জ্বালানি তেল এ পথে খুব অল্প সময়ে এবং মধ্য এশিয়ার তেল চীনের জিন জিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই জ্বালানি তেলের ওপর চীন নির্ভরশীল। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটি করতে হলে কুনমিং-মান্দালয়-কক্সবাজার সড়কপথ (যাতে পরে কলকাতা সংযুক্ত হবে) নির্মাণ শেষ করতে হবে। ২০১৩ সালে চারটি দেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল এই সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১৪ সালে চীনে যান, তখন তিনি কুনমিংয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ কুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী। অতি সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফও বলেছেন, চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। এখন যৌথ ইশতেহারে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে, বাংলাদেশ সড়কপথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। তাতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হতে পারে। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক করিডর ব্যবহার করে মধ্য এশিয়া থেকে জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) আমদানি করতে পারে। সুতরাং চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ কর্মসূচি চীনের স্বার্থে রচিত ও বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থ একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হলে চীনের পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। এতে করে আমরা লাভবান হতে পারতাম। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলা (শ্রীলঙ্কার হামবানতোতায় নির্মিত গভীর সমুদ্রবন্দরের ব্যাপারেও চীন নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছিল), চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি এবং সর্বশেষ চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা—সব মিলিয়ে চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’-এর ব্যাপারে একটি প্রশ্ন রেখে গেল। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’-এর ধারণা অনেক পুরনো। প্রাচীন চীনের মিং সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে জেং হি (১৩৭১-১৪৩৩), যিনি মা হি নামেও পরিচিত ছিলেন, তিনি বিশাল এক নৌবহর নিয়ে প্রায় ৬০০ বছর আগে দক্ষিণ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশে ঘুরে বেড়াতেন। ১৪০৫ থেকে ১৪১৩ সালের মধ্যে তিনি দু-দুবার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়েও এসেছিলেন। জেং হিয়ের সেই সমুদ্রযাত্রারই আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’। শি চিনপিং একাধিকবার জেং হির সেই অবদান স্মরণ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শি চিনপিংয়ের সফরকে ‘নিবিড় সহযোগিতার নতুন যুগ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং দুই লাখ কোটি টাকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, বেসরকারি পর্যায়ে ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর প্রমাণ করে, চীন সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের উন্নয়নের ‘গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’। বাংলাদেশকে বিশ্বের ১১টি উঠতি অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে পরিণত হতে চায়। চীনের এই সহযোগিতা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে। তবে চুক্তির শর্তগুলো আমাদের জানা দরকার। বিশেষ করে সুদের হার নির্ধারণে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে—এটি দেখা দরকার। তার পরও চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ যে একটি ‘শক্তি’, তা আবারও প্রমাণিত হলো।
Daily Kalerkontho
18.10.2016

ব্রিকস-বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন প্রসঙ্গে কিছু কথা

 

    
             
ভারতের গোয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সম্মেলন চলছে। ১১টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তথা সরকারপ্রধানরা এ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি তথা আঞ্চলিক রাজনীতির আলোকে এ শীর্ষ সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক। গতকাল অনুষ্ঠিত হলো ব্রিকসের অষ্টম শীর্ষ সম্মেলন। এতে ভারতের পাশাপাশি ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধান তথা সরকারপ্রধানরা যোগ দেন।  আজ ব্রিকস-বিসমটেক যৌথ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিমসটেক বা ‘বে অব বেঙ্গল ইনেশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল কো-অপারেশন’ এর ছয়জন সরকার তথা রাষ্ট্র্রপ্রধান (বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড) এ ব্রিকস-বিমসটেক যৌথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ যৌথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিবেন। ব্রিকস সম্মেলন ও ব্রিকস বিমসটেক যৌথ শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন একসময়, যখন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। শুধু তাই নয়, চীন পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে যে ‘অর্থনৈতিক করিডোর’ গড়ে তুলছে (যাতে ব্যয় হবে ১১ বিলিয়ন ডলার), তাতে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত বেলুচিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করছে; এমন অভিযোগ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারত অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা কিনা চীন খুব সহজভাবে নেয়নি। এমনকি অনেক পশ্চিমা পর্যবেক্ষকও মনে করছেন, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ একটি উদ্যোগ! তৃতীয়ত, চীন যে ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’র এক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, তা ভারত সন্দেহের চোখে দেখছে। ভারতের এ ‘সন্দেহের’ কারণেই কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হয়নি। ফলে চীন ও ভারত পরস্পর পরস্পরকে এক ধরনের সন্দেহের চোখে দেখছে। এ ‘সন্দেহ’ ও ‘আস্থার অভাব’ চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। এতে করে ব্রিকস যে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা বিস্মিত হবে। ভারতের ভূমিকা, বিশেষ করে চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক চুক্তিটি চীনা নেতাদের খুশি করেনি কোনোভাবেই। ওই চুক্তিটি, যা লামোয়া (LEMOA- Logistic Exchange Memorandum of Agreement) নামে অভিহিত, তা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। এ চুক্তির ফলে ভারতকে আরও বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্র আরও দুইটি চুক্তি নিয়ে বর্তমানে ভারতের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে এবং ধারণা করছি, অতি শিগগিরই ভারত এ দুইটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করবে। এর একটি হচ্ছে, সিসমোয়া (CISMOA- Communications Interoperability and Security Memorandum of Agreement) এবং অপরটি হচ্ছে, বেকা (BECA- Basic Exchange and Cooperation Agreement for Geospatial cooperation) । ‘সিসমোয়া’ চুক্তির ফলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব তথ্য পাবে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ‘বেকা’ চুক্তির আওতায় বিভিন্ন স্থানের ডিজিটাল মানচিত্র ও সমীক্ষা রিপোর্ট ব্যবহারের সুযোগ পাবে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং এ ধরনের চুক্তির ধরন এবং এর ব্যবহার যে ভারতকে আরও বেশি মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রমুখী করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৬ বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে, বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০০৮ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ফলে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণসহ সব ধরনের পারমাণবিক প্রযুক্তি, যা শুধু অসামরিক কাজে ব্যবহৃত হবে, তা যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সরবরাহ করছে। ভারত এখন নিউক্লিয়ার সাপ্লাইস গ্রুপ বা এনএসজির সদস্য হতে চায়, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রও সমর্থন করছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক বৃদ্ধির পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ করে ভারতকে এ অঞ্চলে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন মনে করে, ২১ শতকের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। বাংলাদেশ ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য প্রণীত নীতির আওতাভুক্ত। এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন, এ অঞ্চলের তিনটি শক্তির (চীন, ভারত, জাপান) মধ্যকার সম্পর্ক ২১ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ অঞ্চলের গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ওবামার ‘Pivot to Asia’ পলিসির প্রধান বিষয় হচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। এ অঞ্চলের উত্থান-পতনে এবং বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র একটি ভূমিকা রাখতে চায়। চীনের ভূমিকাকে খর্ব করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা দুই-দুইবার ভারত সফর করেছেন। প্রতিবারই তিনি বিশাল এক ভারতীয় ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল নিয়ে ভারত গেছেন এবং একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। শুধু তাই নয়, ওবামা তার ভারত সফরের সময় ভারতের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। এতেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ অঞ্চলের ব্যাপারে আর একটা স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে এবং সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণে একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ২০১৬ সালের মার্চে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘রাইসিনা ডায়ালগে’ যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ষষ্ঠ ফ্লিটের প্রধান অ্যাডমিরাল হ্যারি হারিস এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিলেন। তবে এ ধরনের একটি প্রস্তাব নতুন নয়। জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজে আবে এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিলেন ২০০৬-০৭ সালে। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রস্তাব Quadrilateral Initiative হিসেবে পরিচিত। এ থেকেই বোঝা যায়, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের Pivot to Asia পলিসির আসল উদ্দেশ্য কী। চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধি ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও গুয়ামে সাপ্লাই লাইনের জন্য রীতিমতো হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তাই পরিষ্কার এ অঞ্চলভুক্ত জাপান ও অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতকে সংযুক্ত করে একটি সামরিক অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজি বুঝতে আমাদের সহজ হবে যদি আমরা অতি সাম্প্রতিককালে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে, তার দিকে তাকাই। যুক্তরাষ্ট্র জুলাইয়ে ফিলিপাইনের নৌবাহিনীকে USA Bout well নামে একটি বড় ধরনের ডেস্ট্রয়ার সরবরাহ করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ রাখা ও প্রয়োজনে চীনা জাহাজকে চ্যালেঞ্জ করা। বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সঙ্গে ঊহEnhanced Defense cooperation নামে একটি চুক্তি করার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে আসছে। এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন সেনা অথবা মেরিন সেবাকে স্থায়ীভাবে মোতায়েনের সুযোগ পাবে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে South East Asia Maritime Security Initiative (MSI) এর আওতায় ৪২৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র South East Asia Maritime Law Enforcement Initiative গ্রহণ করেছিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমুদ্রসীমার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও প্রশিক্ষণ দেয়া। মূল কথা একটাই, চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে দাঁড় করানো।
চীনা নেতারা এটা যে বোঝেন না তেমনটিও নয়। ফলে আজ যখন গোয়ায় নরেন্দ্র মোদি ও শি জিনপিং হাত ধরাধরি করে এক টেবিলে বসতে যাচ্ছেন, তখন এ ‘দ্বন্দ্বের’ খবরটি তারা অস্বীকার করবেন কীভাবে? পাঠকদের এখানে আরও জানিয়ে রাখি, ভারত ও চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতা সুদূর চীন সাগরেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এরই মধ্যে চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে একদিকে চীনের সঙ্গে ফিলিপাইন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ‘দ্বন্দ্বে’ জড়িয়ে গেছে চীন। ভারত এ দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত এ অঞ্চলে ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যস্ত। অতি সম্প্রতি চারটি ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগরে রয়েছে বিশাল জ্বালানি সম্পদ (১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল, ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস)। চীন এ সম্পদের একক ভাগিদার হতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তাতে আপত্তি রয়েছে। এক্ষেত্রে চীন ভারতের সহযোগিতা প্রত্যাশা করলেও, তা চীন পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, তাদের সাপ্লাই রুটের জন্য দক্ষিণ চীন সাগরের সামুদ্রিক পথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুয়াম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনে মার্কিন মেরিন সেনাদের সহায়তার জন্য এ রুটটির নিরাপত্তা তারা চায়। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ভিন্নÑ সাপ্লাই রুটের নাম করে এ অঞ্চলে যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের ওপর এক ধরনের ‘চাপ’ প্রয়োগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যে সৎ নয়, তা বোঝা যায়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।Foreign military financing কিংবা Development of Asian reassurance এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামকে সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে, যার অন্যতম একটি দিক হচ্ছে প্রশিক্ষণ দেয়া ও ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, চীনের বিরুদ্ধে ওই অঞ্চলের দেশগুলোকে সহযোগিতা করা। এখানে বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্যদিকে ভারতও ভিয়েতনামকে ৫০ কোটি ডলারের সামরিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে চীনবিরোধী কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে। আজ তাই গোয়ায় যখন দুই দেশের নেতারা মিলিত হতে যাচ্ছেন, তখন একটা প্রশ্ন উঠবেই দুই দেশের মাঝে যে আস্থাহীনতার জন্ম হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কিনা?
অন্যদিকে ব্রিকস-বিমসটেক শীর্ষ বৈঠক নিয়েও কথা আছে। ভারত এখন সার্কের পরিবর্তে বিমসটেক উপআঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত বিমসটেক সদস্য নয়, এমন দুইটি দেশকে (মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান) এ যৌথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার, ভারত চায় সার্ক বিলুপ্ত হোক! এবং পাকিস্তান ‘একঘরে’ হয়ে যাক। এরই মধ্যে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন (ইসলামাবাদ, ২০১৬) বাতিল ঘোষিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ব্যাংককে বিমসটেকের জন্ম। তবে বিমসটেক একটি কার্যকরী উপআঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এরই মাঝে ১৪টি অগ্রাধিকার এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং একেকটি দেশকে একেকটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই বিষয়ে কাজ করার জন্য। যেমন বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে, সন্ত্রাস দমনে ভারতকে, দারিদ্র্য দূরীকরণে নেপালকে, জ্বালানি ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের বিশাল জ্বালানি রিজার্ভ কাজে লাগিয়ে এ দেশগুলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারে। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সমস্যাও রয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক যতটুকু বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি।
উপরন্তু রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যা ছিল, মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও  সেই সমস্যা রয়ে গেছে। ফলে ব্রিকস-বিমসটেক যৌথ শীর্ষ সম্মেলন কী ফল বয়ে আনবে, সে প্রশ্ন থাকলোই। ব্রিকসের জনসংখ্যাকে যদি একসাথ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, বিশ্বের জনসংখ্যার ৪২ ভাগ মানুষ এ পাঁচটি দেশে বাস করে। এ পাঁচটি দেশের মোট অর্থনীতির পরিমাণ ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর দুইটি বড় অর্থনীতি, চীন ও ভারত ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ভারত ও চীন যদি নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে ব্রিকস তার সাফল্য পাবে না। এক্ষেত্রে ব্রিকস-বিমসটেক শীর্ষ বৈঠকও কোনো ফল দেবে না। এর আগে ২০১৪ সালে ব্রাজিলে ব্রিকসের যে ষষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ব্রাজিল লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ব্রিকসের সঙ্গে ওই দেশের নেতারা শীর্ষ সম্মেলনে অংশও নিয়েছিলেন। ২০০১ সালে রাশিয়ার উদ্যোগে ব্রিকস সম্মেলনে ‘সাংহাই কোঅপারেটিভ অর্গানাইজেশন’ (এসসিও) এর সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাতে কাজের কাজ হয়নি। ফটোসেশন হয়েছে মাত্র। এবারও গোয়ায় সে ধরনের একটি ফটোসেশনের সম্ভাবনা বেশি। নিজেদের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতার মনোভাব বৃদ্ধি করতে না পারলে কোনো সংস্থাই দাঁড়াতে পারবে না। ব্রিকসের ক্ষেত্রে এ কথাটা প্রযোজ্য। তবে গোয়ায় ১১টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা মিলিত হচ্ছেন এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় সংবাদ। খুব বড় কিছু এতে অর্জিত হবে, তা মনে হয় না।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Alokito Bangladesh
16.10.2016