রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন ও অসমতার গল্প

বিশ্বের ধনী দেশগুলোর সংস্থা জি-২০-এর শীর্ষ সম্মেলন জামার্নির হামবুর্গে শেষ হয়েছে গত ৮ জুলাই। নানা কারণে এবারের শীর্ষ সম্মেলন গুরুত্ব পেয়েছে অনেক বেশি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই প্রথমবারের মতো জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিলেন। পুতিনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকও হয়েছে প্রথমবারের মতো। কিন্তু বৈঠক হয়নি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের। কিন্তু সব ছাপিয়ে যে বিষয়টি গণমাধ্যমে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অসম অন্যায় বাণিজ্যনীতি আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এই আন্দোলন সহিংসতার রূপ নিয়েছিল হামবুর্গে। বিদেশি গণমাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের হাতে প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছিল। তাতে লেখা ছিল—‘ওয়েলকাম টু হেল’, ‘Kapitalism kills’, ‘G-20 welcome 2 HELL’। প্ল্যাকার্ডের আর ফেস্টুনের ভাষা বলে দেয়, বিক্ষোভকারীরা বড় দেশগুলোর অসম বাণিজ্য, করপোরেট হাউসগুলোর একচ্ছত্র ব্যবসা, আর অসমতা জার্মানির মতো একটি পুঁজিবাদী দেশের সমাজেও কিভাবে আঘাত করেছে। এই অসমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে আমরা দেখেছি ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এ। নিউ ইয়র্কের ছোট্ট জুকোটি পার্কে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, সেই আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি সত্য; কিন্তু একটা মেসেজ পৌঁছে দিয়েছিল। বিশ্বের বড় বড় শহরে এই ‘অকুপাই মুভমেন্টের’ জন্ম হয়েছিল। এই মুভমেন্টের টার্গেট ছিল পুঁজিবাদীব্যবস্থা। অসমতা দূর করার দাবি তারা জানিয়েছিল। আজ হামবুর্গে বিক্ষোভকারীরা যখন বড় ধরনের বিক্ষোভের জন্ম দিল, তারা প্রকারান্তরে একটা মেসেজই দিল। আর তা হচ্ছে, অসমতা ও অসম বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের এখনো পরিসমাপ্তি ঘটেনি।

পাঠকদের এখানে জি-২০ দেশগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের ধনী দেশগুলো এই জি-২০-এর অন্তর্ভুক্ত। এ দেশগুলোই বিশ্ব অর্থনীতি, তথা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। পৃথিবীর অনেক দেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের সঙ্গে জি-২০-এর কোনো কোনো দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরিভাবে জড়িত। জি-২০ দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ১০৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার (পিপিপি অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে)। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের (১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার), চীনের (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন  ডলার) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (১৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার) মতো বড় অর্থনৈতিক শক্তিও রয়েছে। এসব দেশে দুর্নীতি রয়েছে, কর ফাঁকি দেওয়ার কাহিনি রয়েছে। পানামা পেপারসের কর ফাঁকির কাহিনি গেল বছর সারা বিশ্বে বড় ধরনের ঝড় তুলেছিল। ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল বিশ্বের দুর্নীতির কথা বলে। অথচ ওই পানামা পেপারস থেকে জানা গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি চীনের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁরা নানা ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ ক্ষমতাসীনরা অন্যত্র পাচার করে দিয়েছেন। ফলে ওই সব সমাজে বৈষম্য ছিল এবং এখনো আছে। চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশেও বৈষম্য আছে। সেখানে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য আছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান (১৩ অক্টোবর, ২০১৫) আমাদের জানিয়েছিল যে বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কাছে বিশ্বের মোট সম্পদের অর্ধেক এখন কেন্দ্রীভূত। ক্রেডিট সুইসের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন কিংবা কর ফাঁকির কারণে বিশ্বে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্বের বর্তমান জনগোষ্ঠী (মার্চ ২০১৬) প্রায় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৪বিলিয়ন  জনগোষ্ঠীকে ধরা হয় কর্মক্ষম, যাদের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ডলারের নিচে (৭০ শতাংশ)। বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের হাতে কী পরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত, অক্সফাম তার একটি হিসাব দিয়েছে। বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫০ ট্রিলিয়ন ডলার। এখান থেকে ৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদের মালিক ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী। আবার ৩১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ (১২ দশমিক ৫ শতাংশ) রয়েছে এক হাজার তিন মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কাছে। ১১২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার (৪৫ দশমিক ২ শতাংশ) সম্পদ রয়েছে ০ দশমিক ৭ শতাংশ, অর্থাৎ ৩৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কাছে, যাদের সবার সম্পদের পরিমাণ ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি করে। এই পরিসংখ্যান আমাদের বলে দেয় বিশ্বে ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে এবং ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য বাড়ছে। আমরা যে পরিসংখ্যান পাই, তাতে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি ধনী লোকের বাস যুক্তরাষ্ট্রে। তবে আশ্চর্যের বিষয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী লোকের বাস চীনে। চিন্তা করা যায়? চীন এখনো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখনো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। তবে চীনের রাজনীতিতে প্রয়াত তেং শিয়াও পিংয়ের উত্থানের পর অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এটাকে তারা বলছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। এর ফলে চীনে অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমানো হয়েছে। ব্যক্তি পুঁজির সেখানে বিকাশ ঘটেছে। ফলে হাজার হাজার ধনী ব্যবসায়িক শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা অসৎ পন্থা অবলম্বন করে ‘ধনী’ হয়েছে। অথচ চীনে দারিদ্র্য আছে। যে ২০টি দেশে ধনী লোকের সংখ্যা বেশি সেখানে প্রতিটি দেশে দারিদ্র্য আছে। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (১ দশমিক ৯০ ডলার, প্রতিদিন) সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষের (চরম দারিদ্র্য) বাস এশিয়ায়। এমনকি উত্তর আমেরিকায় (যেখানে ধনী লোকের বাস বেশি), সেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ০ দশমিক ৩ মিলিয়ন। ধনী লোকের কাছে ওই যে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত, তা দিয়ে সব ধরনের রোগবালাই দূর করা সম্ভব। ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাথাপিছু পাঁচ ডলার ব্যয়ে বিশ্বের ৪০ লাখ মা ও শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব। নিম্ন আয়ের দেশে মা ও শিশুর সেবা পৌঁছে দিতে তাদের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন ৬২০ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু ৬ দশমিক ৭ ডলার। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্পদ আরো বাড়ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। আর ধনী ব্যক্তিদের সম্পদকে আরো বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠান। যারা থাকছে আইনের ঊর্ধ্বে। তারা সাধারণ কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান নয়। গ্রাহকদের গোপন নথি তারা সুরক্ষা করবে না, এটা বিশ্বাস করা যায় না। সে কারণেই প্রশ্নটা এসে যায়, কোনো বৃহৎ শক্তি কি এর পেছনে আছে? একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদ লিখেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবার্ট পেরি (Robert Parry)। প্রবন্ধের নাম ‘করাপশন অ্যাজ এ প্রপাগান্ডা উইপন’। এটি ছাপা হয়েছে ‘গ্লোবাল রিসার্চ’-এ ৫ এপ্রিল ২০১৬ সালে। গ্লোবাল রিসার্চ টরন্টোতে নিবন্ধিত একটি গবেষণা সংস্থা। এটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক মিসেল চসুডোভস্কি (Michel Chossudovsky)। বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং তিনি নিজে কাজ করেন। এখানে রবার্ট পেরি দুটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এক. এই গোপন তথ্য ফাঁসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘রেজিম চেঞ্জ’ (Regime change) বা ‘সরকার পরিবর্তনের’ (বিভিন্ন দেশের) যে ‘নীতি’, তার সঙ্গে একটা মিল থাকতে পারে। তিনি উল্লেখ করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে কালার রেভল্যুশন’ হয়েছে (জর্জিয়া, কিরঘিজস্তান, ইউক্রেন, এমনকি আরব বসন্তেও), তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ একটা যোগসূত্র আছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ নামে অর্থ সহায়তা করে থাকে। আমি নিজে ‘আরব বসন্ত’-এর ওপর গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, কিভাবে তরুণ নেতৃত্বকে (মিসরের) যুক্তরাষ্ট্র উদ্বুদ্ধ করেছিল মুবারকবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে। ইউক্রেনে রুশ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ একটি ‘গণ-আন্দোলনে’ উত্খাত হয়েছিলেন ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ক্ষমতায় এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত প্রোসেনকো, যিনি এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। অভিযোগ আছে, ওই ‘গণ-আন্দোলনের’ পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল। কেননা যুক্তরাষ্ট্র চায় ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক, তাতে করে রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিনি সেনা মোতায়েন করে রাশিয়াকে একটি স্নায়ুবিক চাপে রাখা যায়। এই ‘আন্দোলন’ সফল হয়েছিল এবং ইয়ানোকোভিচ (যিনি ছিলেন সে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট) অপসারিত হয়েছিলেন। মজার ব্যাপার, ইয়ানোকোভিচ উত্খাত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল শুধু অর্থনীতিতে কিছুটা ‘গতি’ আনার জন্য। অভিযোগ আছে, এই অর্থ প্রেসিডেন্ট প্রোসেনকো আত্মসাৎ করেছেন। তাঁর নামে টাকা পাচার হয়েছে এবং মোসাক ফনসেকা তাঁকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। প্রশ্নটা এ কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ যেখানে বেশি (যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই), সেখানে তারা সরকার পরিবর্তন ঘটায়। ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ। একসময় হোসনি মুবারকের প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় আসমা মাহফুজদের (মিসরের তাহরির স্কোয়ার আন্দোলনের নেত্রী) দিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ড. মুরসিকে কিছুদিন ক্ষমতায় রেখে ‘গণতন্ত্র চর্চা’ মিসরে চালু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন সেসব অতীত। ফিল্ড মার্শাল সিসিকে নিয়েই রচিত হবে এখন নয়া স্ট্র্যাটেজি। তাই আমার ধারণা, পারসীয় অঞ্চলের সাম্প্রতিক সময়ের যে রাজনীতি, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনার ফল পাওয়া যায় না। তবে একটি প্রয়াস হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই জি-২০ভুক্ত দেশগুলো প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই দেশগুলো বলেছে, প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যৌথ ঘোষণায় জলবায়ু চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
জি-২০ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ট্রাম্প-পুতিন আলোচনায় সিরিয়ার এক অংশে যুদ্ধবিরতিতে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। বোধ করি এটাই জি-২০-এর সাফল্য। কিন্তু যে সহিংসতা ও বিক্ষোভ সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল, তা একটি বার্তা দিয়ে গেল ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থেই ‘এক’ থাকবে। উন্নয়নশীল বিশ্বের সমস্যা, দারিদ্র্য কিংবা বাণিজ্যে সমতা আনা, কোনোটাই তাদের কাছে প্রাধান্য পাবে না। অতীতেও পায়নি।
Daily Kalerkontho
11.07.2017

0 comments:

Post a Comment