রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও সামাজিক অসংগতি

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সফরের পাশাপাশি হামবুর্গে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এসব সফরের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বহির্বিশ্বে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে, তেমনি মোদি এসব সফরের মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন একটি ‘ধারা’ সৃষ্টি করলেন। বিশেষ করে মোদির ইসরাইল সফর যে কোনো বিবেচনায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’। ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের হলেও (১৯৯২) এ প্রথম একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইসরাইল সফর করলেন। শুধু তা-ই নয়, এ সফরে তিনি ফিলিস্তিনি এলাকায় যাননি এবং ফিলিস্তিনি কোনো নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে ভারত অতীতে বরাবরই তাদের পাশে থেকেছে। এ প্রথম ভারত সরাসরি ইসরাইলিদের সমর্থন করল। মোদির এ সফরকে ইসরাইলি নেতৃত্ব যে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে, তা বোঝা যায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রটোকল ভেঙে সরাসরি বিমানবন্দরে গিয়ে মোদিকে অভ্যর্থনা জানানোয়। সেখানে মোদির নামে একটি ফুলেরও নামকরণ করা হয়েছে। মোদিকে নেতানিয়াহু ‘দোস্ত’ হিসেবেও সম্বোধন করেন। মোদির এ সফরে কৃষি, মহাকাশ গবেষণা, সন্ত্রাস দমন ও অস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিগত বছরগুলোয় ভারত ও ইসরাইল প্রতিরক্ষা এবং সন্ত্রাস দমনে একসঙ্গে কাজ করে আসছে। বর্তমানে ভারতে তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে ইসরাইল। প্রতি বছর দুই দেশের মাঝে ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র ব্যবসা হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ নেতা ইসরাইল সফরে গেলে রামাল্লায় ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করলেও মোদি তা করেননি। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ভারতের যে সনাতন সমর্থন, তা থেকে ভারত বেরিয়ে এলো। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নতুন দিক। এর আগে মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন। ওই সফরও ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ৬ মাসের শাসনামলে মোদিই হচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সরকারপ্রধান, যিনি হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ পেলেন।
মোদির এ দুইটি সফর খোদ ভারতে ও বহির্বিশ্বে যথেষ্ট গুরুত্ব পেলেও অভ্যন্তরীণভাবে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বড় কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেননি। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকের আত্মহত্যা তিনি বন্ধ করতে পারেননি। তার শাসনামলে কৃষকের আত্মহত্যার হার বেড়েছে বৈ কমেনি। এটি অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা ও বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতের সাময়িকী ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিন অন্তত তিনজন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হন, অথচ এরা জনগোষ্ঠীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ। জাতপাতের সমস্যা ভারতে অনেক বেশি। দীর্ঘ ৬৯ বছরেও এ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।
নিঃসন্দেহে গেল ৩ বছরে মোদি নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানির (যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন) মতো নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড়, তা হচ্ছে তিনি ‘গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী’। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে (জানুয়ারি ২০১৫) তিনি ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে প্রমাণ করেছিলেন, তিনি আসলে ধনী শ্রেণীরই প্রতিনিধি! একসময় যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন (২০১৫ সালের মে মাসে টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন করপোরেট জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্ক বেশি। ট্রেনে চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি ‘অনেক দূরের মানুষ’। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। গেল ৩ বছরে তার শরীরে ১০ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য; কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজম প্রোগ্রামের মতে, জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল; আজ তৃতীয় অবস্থানে (সাধারণ নিয়মে এ অবস্থান সপ্তম)। আর গেল বছর জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল; তাতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এ ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৩৭ ভাগ মানুষ এখনও গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এই ‘কাজটি’ নিত্যসমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায়, প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায়, ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)! ৭ বছর আগের এ পরিসংখ্যানে খুব যে পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দারিদ্র্য কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ শতাংশ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র ১৮৬-কে হিসাবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণের এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) গুলাব গ্যাংয়ের (উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখ-ে গ্রামের সত্য কাহিনী) কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গেল ৩ বছরে এদের জন্য কী করেছেনÑ যদিও মাত্র ৩ বছরে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব নয়, কিংবা বিপুল তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দারিদ্র্য কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার ‘গুজরাট মডেল’ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক-মহাসড়ক করেছেন; কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে গুজরাটে তার আমলে কম ছিল, মাত্র ১৩ দশমিক ৪ ভাগ (২০১২-১৩ সালে আসামে ছিল ২১.১ ভাগ, উত্তরখ-ে ২০.৮ ভাগ, মহারাষ্ট্র ১৯.৮ ভাগ)। শিশুমৃত্যুর হার গুজরাটে হাজারে ৩৮, অথচ কেরালায় ১২, তামিলনাড়– ২১, মহারাষ্ট্র ২১। শিশু জন্ম দেয়ার সময় মাতৃমৃত্যুর হার গুজরাটে ৯.৫, কেরালায় ৩.৩, তামিলনাড়–তে ৫, মহারাষ্ট্র ৫.২। যেখানে গুজরাটে খাওয়ার পানি নিশ্চিত করা হয়েছে জনগোষ্ঠীর ৮৪ দশমিক ১ ভাগ মানুষের, সেখানে পাঞ্জাবে এ সংখ্যা ৯৭.৬, উত্তর প্রদেশে ৮৭.৮, দিল্লিতে ৯৭.২। পাকা ঘর হরিয়ানায় ৯৪ দশমিক ৮ ভাগ মানুষের, দিল্লির ৯৪.৭, উত্তরখ-ের ৯৩.৯, অথচ গুজরাটে মাত্র ৭৫.৭ ভাগ। ইন্ডিয়ান সেনসাস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা। ফলে ‘গুজরাট মডেল’ কীভাবে সারা ভারতের জন্য একটা মডেল হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আসলে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব একটি অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তিনি গড়ে তুলেছেন গুজরাটে; কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের প্রতি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখন এ মানসিকতায় তিনি যদি ভারতকে পরিচালনা করতে চান, তিনি ভুল করবেন। দারিদ্র্য দূর হবে না।
দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা নরেন্দ্র মোদি এখন আর দরিদ্রতম মানুষকে স্মরণ করেন না। কাজপাগলা মানুষ তিনি, সন্দেহ নেই তাতে। মাত্র ৩ ঘণ্টা তিনি ঘুমান এ কথাটা নিজেই স্বীকার করেছেন টাইম প্রতিবেদকের কাছে। ‘কম সরকার, অনেক বেশি প্রশাসন’ এ হচ্ছে তার অ্যাপ্রোচ। তাতে ভারতকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন তিনি? টাইম মোদিকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল। শিরোনাম ছিল Why Modi Matters.মোদি কেন গুরুত্বপূর্ণ? তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গোধরায় ট্রেনে ৫৪ হিন্দু পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে গুজরাটে হাজারের মতো মুসলমান হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প এবং ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় চীনা প্রেসিডেন্ট ছুটে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং মাত্র ৩ বছরে শীর্ষ বিশ্বনেতাদের তালিকায় নিজের নামটাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন (টাইম সাময়িকীর মতে, বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নেতার একজন তিনি)। তাই খুব সংগত কারণেই মোদি বারবার আলোচনায় থাকলেও দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সমাজে যে বৈষম্য, তা দূরীকরণের ব্যাপারে কোনো বড় উদ্যোগ নিতে পারেননি। তাই অসন্তোষ বাড়ছে। মোদির জমানায় দলিত শ্রেণী যে কীভাবে প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইন্ডিয়া টুডের ওই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দলিত শ্রেণীর স্কুল ত্যাগের হার শতকরা ৫০ ভাগ। প্রতিদিন দুইজন করে দলিত ‘খুন’ হচ্ছেন। দুইটি করে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মোদি নিজে নিম্নশ্রেণী থেকে উঠে এলেও এ শ্রেণীর মানুষের তিনি এখন আর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি এখন উচ্চশ্রেণীর প্রতিনিধি। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর মোদি বলেছিলেন, তিনি গেল ৩ বছরে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন! তিনি বলেছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (ভারত নির্মাণ) অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য করা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছে তারা। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে ২০১৫ সালে মোদি সরকারের ১ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতে ‘মোদির ১ বছর উচ্ছ্বাসের পর্ব শেষ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘ভারতে ১ বছর আগে পরিবর্তন ও আর্থিক পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন; কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি সরকার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়ার’ অভিযান শুরু করলেও ভারতের অর্থনীতি খুঁড়িয়েই চলছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি এখনও কথার কথাই রয়ে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনও বেহাল। ব্যবসায়িক উদ্যোগেও তেমন দানা বাঁধছে না। একইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়েছেন মোদি। সমাজের দলিত শ্রেণী তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে এখন।
এসব মূল্যায়ন মোদি সম্পর্কে কোনো ভালো ধারণা দেয় না। নিশ্চয়ই গেল ৩ বছরে মোদি অনেক কিছু শিখেছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত একাই নেন। এখানেই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার পার্থক্য। মনমোহন সিং বেশিমাত্রায় সোনিয়া গান্ধীনির্ভর ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির প্লাস পয়েন্ট এটাই। দলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। তারপরও তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ আছে। দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এটা কেউ স্মরণ করেন কিনা জানি না, ২০১৫ সালের আগস্টে ভারতের ৬৯তম স্বাধীনতা দিবসে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি ভারতকে ঘুণপোকার মতো খেয়ে ফেলেছে। উপরের পর্যায় থেকে আমাদের এ কাজ শুরু করতে হবে।’ ভাষণে তিনি কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মাঝে আছে ১ হাজার দিনের মাঝে সব গ্রামে বিদ্যুৎ। তিনি বলেছিলেন, স্ট্যান্ডআপ ইন্ডিয়া। ঘোষণা করেছিলেন নতুন ভারত গড়ার প্রত্যয়। ভারতে জাঠ আন্দোলন এখন তার ‘স্ট্যান্ডআপ ইন্ডিয়ার’ পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ভারত পৃথিবীর বড় গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ আর মানুষের মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই, এ ‘সত্যটি’ বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। ভারতে গণতন্ত্র আছে এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি এটাও সত্য, সেখানে সমাজে মানুষের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সমাজে মাত্র পাঁচ ভাগ মানুষ ব্রাহ্মণ অর্থাৎ তারা কুলিন শ্রেণী। অন্যদিকে নিচু তথা দলিত শ্রেণীর সংখ্যা শতকরা ১৩ ভাগ ও অনগ্রসর শ্রেণীর সংখ্যা ১৩ ভাগ। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণীকে যদি ধরা হয়, তাহলে এ সংখ্যা শতকরা ২৮ ভাগ। দলিতরা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত হলেও এই দলিতদের নিয়েই ‘রাজনীতি’ করে অনেকে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগই করেননি, বরং ধনী ব্যক্তিতেও পরিণত হয়েছেন। মায়াবতী এর বড় প্রমাণ। ভারতের রাজনীতিবিদরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এ ‘জাতপাত’ এর ব্যবস্থা স্বাধীনতার এত বছর পরও টিকিয়ে রেখেছেন। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে অঙ্গীকার করেছিলেন, কৃষকের উন্নয়নে তিনি কাজ করবেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি ব্যবসা বোঝেন। তাই ব্যবসার স্বার্থেই তিনি বিদেশে যাচ্ছেন। চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষ ইসরাইল। এতে ভারতকে তিনি অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন; কিন্তু তা উত্তরপ্রদেশের কিংবা ঝাড়খ-ের কৃষকের জন্য কোনো ‘ভালো সংবাদ’ নিয়ে আসতে পারেনি। স্যুটেড-বুটেড হয়ে তিনি যখন ট্রাম্পের সঙ্গে ‘ছবির পোজ’ দেন, তখন ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে উত্তর প্রদেশের এক গ্রামের কৃষকের আত্মহত্যার কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই মোদিকে আমি তখন আর মেলাতে পারি না! ২০১৯ সালে সেখানে নির্বাচন। মোদি যদি বিদেশ ভ্রমণের চেয়ে এখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে বেশি নজর দেন, তিনি ভালো করবেন।
সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সফরের পাশাপাশি হামবুর্গে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এসব সফরের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বহির্বিশ্বে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে, তেমনি মোদি এসব সফরের মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন একটি ‘ধারা’ সৃষ্টি করলেন। বিশেষ করে মোদির ইসরাইল সফর যে কোনো বিবেচনায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’। ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের হলেও (১৯৯২) এ প্রথম একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইসরাইল সফর করলেন। শুধু তা-ই নয়, এ সফরে তিনি ফিলিস্তিনি এলাকায় যাননি এবং ফিলিস্তিনি কোনো নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে ভারত অতীতে বরাবরই তাদের পাশে থেকেছে। এ প্রথম ভারত সরাসরি ইসরাইলিদের সমর্থন করল। মোদির এ সফরকে ইসরাইলি নেতৃত্ব যে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে, তা বোঝা যায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রটোকল ভেঙে সরাসরি বিমানবন্দরে গিয়ে মোদিকে অভ্যর্থনা জানানোয়। সেখানে মোদির নামে একটি ফুলেরও নামকরণ করা হয়েছে। মোদিকে নেতানিয়াহু ‘দোস্ত’ হিসেবেও সম্বোধন করেন। মোদির এ সফরে কৃষি, মহাকাশ গবেষণা, সন্ত্রাস দমন ও অস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিগত বছরগুলোয় ভারত ও ইসরাইল প্রতিরক্ষা এবং সন্ত্রাস দমনে একসঙ্গে কাজ করে আসছে। বর্তমানে ভারতে তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে ইসরাইল। প্রতি বছর দুই দেশের মাঝে ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র ব্যবসা হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ নেতা ইসরাইল সফরে গেলে রামাল্লায় ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করলেও মোদি তা করেননি। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে ভারতের যে সনাতন সমর্থন, তা থেকে ভারত বেরিয়ে এলো। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নতুন দিক। এর আগে মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন। ওই সফরও ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ৬ মাসের শাসনামলে মোদিই হচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সরকারপ্রধান, যিনি হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ পেলেন।
Daily Alokito Bangladesh
09.07.2017

0 comments:

Post a Comment