নির্বাচন কমিশনের দুইটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন রাজনীতিতে বড় ধরনের ‘ঝড়’ বইছে। প্রথমটি হচ্ছে কমিশন সাত দফার একটি ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন করেছে এবং তারা বলছে, এ ‘রোডম্যাপ’ ধরে তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নির্বাচন কমশন ডিসেম্বরের শেষে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজন করবে এবং সেখানে দুই-একটি ওয়ার্ডে ইভিএম মেশিন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হবে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন দেশে একটি ‘নির্বাচনী রাজনীতি’ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এ ‘রোডম্যাপ’ আর রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে? অর্থাৎ ইসির এ কর্মকা- কি বড় রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করেছে? প্রশ্নের জবাবটা হবে ‘না’। বিএনপি, সে সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী অনেক পর্যবেক্ষক বলেছেন, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে বিএনপি মহাসচিব মিজা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলে আসছেন একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা, সেখানে একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা আর সাত দফা কর্মপন্থা দিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না। আস্থার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে যদি বেরিয়ে আসা না যায়, তাহলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মূল প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। সব দলের অংশগ্রহণ এখানে দরকার। ইসি কর্তৃক ঘোষিত সাত দফা দিয়ে তাই সবকিছু বিচার করা যাবে না কিংবা আমাদের সব প্রশ্নের জবাবও দেবে না। কতকগুলো সমস্যা তো এখানে আছেই। আওয়ামী লীগ বলে আসছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারই’ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। সিইসির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়ে গেছে। তা তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সিইসি সব দলের আস্থা অর্জন করার কথা বলছেন বটে; কিন্তু তিনি তা কতটুকু পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারি দলের নেতারা বিএনপিবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। এ বিএনপিবিরোধী বক্তব্য আস্থার সম্পর্ক গড়তে কোনো অবদান রাখবে না। পত্রিকা খুললেই ইদানীং একটা কথা শোনা যায়, আর তা হচ্ছে বিএনপি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বিএনপি ভেঙে যাবে! যদি সত্যি সত্যিই এ ধরনের কিছু হয়, তাহলে এর দায় কি কিছুটা হলেও সিইসির ওপর বর্তাবে না? ৭০ বছর বয়সেও সিইসিকে শক্তসামর্থ্য বলেই মনে হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে তো প্রশ্ন একটা থাকলোই সিইসি হিসেবে তার এ নিযুক্তি তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে কিনা? একটি কঠিন ‘জায়গায়’ তিনি এসেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার অতীত-সংশ্লিষ্টতা কতটুকু ছিল, তা তিনি জানেন। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে ব্যর্থ হলে তার সম্মান আরও বাড়বে না, বরং আরও কমবে।নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছি। অনেকটা ‘ধাক্কা’ দিলেই গভীর খাদে পড়ে যাবে! আমরা সে ধরনের একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এর আগে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও (ষষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সে ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সে ‘পরিস্থিতি’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা বলা হয়, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তার শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছিলেন। এ নিয়ে গেল সাড়ে ৩ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩(৪) ধারায় যে কথাটা উল্লেখ আছে, সে কথাটাও সত্য। এ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘দৈবদুর্বিপাকের কারণে এই দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ তবে এখানে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ এর মতে কথাটা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশন যদি মনে করেন ‘দৈবদুর্বিপাকের’ কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ এটা মনে করেননি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরও ‘বিভক্ত’ করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘নির্বাচন বয়কট’ কিংবা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি ‘দৈবদুর্বিপাকের’ শঙ্কার আওতায় পড়ে কিনা? এর জন্য সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। এখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিকে তাকাতে। আমরা চাই ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সে ‘দায়িত্ব’ সিইসি কীভাবে পালন করেন, তার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহুমন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের ৩ মাস আগে যে সরকার থাকবে, তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান থাকলে সে সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সে প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কি বিএনপিকে সে ধরনের একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল; কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কীভাবে? নাকি বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে? বিএনপিকে যে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এ কথাটা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, যেহেতু অতীতে বিএনপি এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, সুতরাং এখন আর সে সুযোগ নেই। যদিও আমি তোয়ায়েল আহমেদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তিনি মন্ত্রী বটে; কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে অন্য কারও বলার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছে পুরো জাতি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচনের আগে দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্ক। যদি আস্থার সম্পর্ক স্থাপিত না হয়, তাহলে রোডম্যাপ কিংবা রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আয়োজন করে কিছু হবে না। রোডম্যাপ হচ্ছে রুটিন ওয়ার্ক। এটা প্রতিটি নির্বাচন কমিশনকে দিতে হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও দিয়েছে। ধরে নিচ্ছি, তারা নির্বাচনটা ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নিশ্চিত করতে চান। এটি নিশ্চিত করতে হলে সব দলকে সমান সুযোগ দিতে হবে। সরকারি দল বেশি সুযোগ পাবে, অন্যদল তেমন সুবিধা পাবে না, অথবা তাদের আদৌ কোনো সুযোগ দেয়া হবে না, এটা তো হতে পারে না। এটা বৈসাদৃশ্য। এতে নির্বাচনের মূল স্পিরিট ভ-ুল হবে। নির্বাচনের আগে যে সমান সুযোগের কথা বলা হয়, যে লেভেলপ্লেয়েং ফিল্ডের কথা বলা হয়, তা তো নিশ্চিত হবে না। নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্বটিই নির্বাচন কমিশনের ওপর। ইসির রোডম্যাপে সেটি নিশ্চিত হয়নি। ইসি যে রোডম্যাপ দিয়েছে, তা কাগুজে এবং রুটিন ওয়ার্ক। যেমন বলা যেতে পারে, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বিধিবিধান অনুসারে ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা ইত্যাদি। এতে নতুনত্ব কই? এতে আস্থার সম্পর্কইবা স্থাপিত হবে কীভাবে? এগুলো সবই রোডম্যাপের অন্তর্ভুক্ত। এ রোডম্যাপে হুদা কমিশন কী দেবে জাতিকে? ৩১ জুলাই থেকে ইসি সুধী সমাজের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। এ সংলাপ ইসিকে কী দেবে? একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুধী সমাজের বক্তব্য আমরা মোটামুটিভাবে জানি। সুধী সমাজও অনেকটা বিভক্ত। এক দল বিএনপিকে সমর্থন করে (যদিও তাদের সংখ্যা কম), আরেক দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বুদ্ধিজীবী কি জাতিকে কিছু দিতে পারবে? সুধী সমাজ নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির সাত দফাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার সুযোগ নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’ এর যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ে কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এরপর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে যদি তিনি দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি আদৌ এ উদ্যোগটি নেবেন কিনা? সবসময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তারপরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। এরই মধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে খালেদা জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আরজি জানিয়েছে। খালেদা জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। সাত দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে তা নিশ্চিত করা যাবে না।
Daily Alokito Bangladesh
23.07.2017
I think our prime minister honorable Sheikh Hasina will solve all these problem.
ReplyDelete