সাম্প্রতিককালে একাধিক ইস্যুতে ভারত ও চীনের মাঝে এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। গেল ১৬ মে বেইজিংয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবেওআর) শীর্ষক যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে ভারত অংশ নেয়নি। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা মধ্য এশিয়ার প্রায় সব সরকারপ্রধানই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওবেওআরের মাধ্যমে চীন তার দুই অঞ্চলের সঙ্গে প্রায় ৬১ দেশকে সমুদ্র, সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করছে। চীনের এ মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত চলতি জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে একটি সামুদ্রিক নৌ মহড়া করেছে, যা চীন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে। আর সর্বশেষ ঘটনায় ভুটানের পশ্চিমাংশে দোকলাম মালভূমি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে চীন ও ভারত। দোকলাম চীন ও ভুটান উভয়ই দাবি করে। ১৮৯০ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, মাত্র ৮৯ বর্গকিলোমিটারের মালভূমিটি চীন তার নিজের বলে দাবি করে আসছে। ভুটানও মনে করে, এটা তাদের নিজেদের এলাকা। চীন সেখানে অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ শুরু করলে ভুটানের অনুরোধে ভারত সেখানে সেনা মোতায়েন করে। দ্বন্দ্বটা সেখান থেকেই শুরু। সীমান্তে দ্বন্দ্ব চীন ও ভারতের মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। ব্রিকস উন্নয়নেও এর প্রভাব পড়বে। এ দ্বন্দ্বে এ অঞ্চলের দেশগুলোও ‘আক্রান্ত’ হতে পারে! দুই দেশের মাঝে সম্পর্কোন্নয়নের একটা সম্ভাবনার জন্ম হলেও তা এখন বড় হুমকির মাঝে পড়েছে। এটা বলতেই হয়, বেশকিছু বিষয়ে পার্শ্ববর্তী এ দেশ দুইটির মাঝে দ্বিমত এবং বিভাজন আছে; কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক এ বিভাজন আর বিদ্বেষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্য সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তা রয়েই গেছে। চীন অরুণাচল প্রদেশের একটা অংশকে তাদের নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। এ দাবি চীন পরিত্যাগ করেনি। নরেন্দ্র মোদির বেইজিং উপস্থিতির সময় (মে ২০১৫) চীনা সরকারি টিভিতে ভারতের যে ম্যাপ দেখানো হয়েছিল, তাতে কাশ্মীর ও অরুণাচলকে ভারতীয় অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে চীন সড়ক নির্মাণ শেষ করছে ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও। চীন এ সড়ক নির্মাণ বন্ধ করেনি। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণ করছে, যা কিনা জাপানের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের কর্মকা- ভারতের নিরাপত্তা স্ট্রাটেজিস্টদের আতঙ্কিত করেছে। ভারত তার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও চীন তাতে সম্মান দেখায়নি। নেপাল ও মিয়ানমারে চীনা প্রভাব বাড়ছেÑ এটাও ভারতীয়দের উৎকণ্ঠার অন্যতম একটি কারণ। ২০১৫ সালে ভূমিকম্পকবলিত নেপালে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ঠা-া লড়াই’ও আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ভারত গেল বছরও ভারত মহাসাগরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় ধরনের নৌ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে চীনাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ভারত একটি পারমাণবিক শক্তি। ভারত এখন পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। কিন্তু তাতে আপত্তি রয়েছে চীনের। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিপণ্য নিয়ে ভারত চীনা বাজারে ঢুকতে চায়। কিন্তু তাতে রয়েছে চীনাদের আপত্তি। আগামীতে চীনাদের একটা বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভারতের প্রাচীন ‘কটন রুট’ এর পুনরুত্থান। প্রাচীন যুগে ভারত ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে তার সুতি শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে বণিকরা ভারত মহাসাগরের কয়েকটি রুট ব্যবহার করে তাদের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে ভারতীয় সুতি কাপড় নিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত যেত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল এ পথ ধরেই। অথচ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনার সঙ্গে মোদির প্রস্তাবিত ‘কটন রুট’ এর ধারণা সাংঘর্ষিক। প্রাচীন ‘কটন রুট’কে নতুন করে সাজানোর মধ্য দিয়ে ভারত এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন, মোদি ২০১৫ সালের মার্চে মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে যেখানে একটি ভারতীয় নৌঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং এ জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। এটা যদি কার্যকর হয়, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস কিংবা সুদূরের ওমান-মোজাম্বিকও একই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এর অর্থ পরিষ্কারÑ বিশাল ভারত মহাসগরে ভারত তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় এবং ‘ইন্ডিয়ান ওশেন রিম’ বা ভারত মহাসগরভুক্ত অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। অথচ চীন এরই মধ্যে তার ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। জিবুতিতে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ করেছে চীনÑ এ খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তবে চীনের জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় তার যে প্রভাব ছিল, তা এখন কমতির দিকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজা পাকসের ‘অতি চীননির্ভর’ নীতির কারণে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। সেখানে সিরিসেনার নেতৃত্বে একটি ‘ভারত বন্ধু’ সরকার সেখানে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ফলে আগামী দিনে ভারত মহাসগরভুক্ত অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা যে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। ফলে বাধাগ্রস্ত হবে ওবেওআরের বিকাশ।
ভারত এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় তার সীমান্তবর্তী যেসব দেশ রয়েছে, প্রতিটি দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধু ভালোই নয়, বরং সর্বকালের সেরা সম্পর্ক রয়েছে এখন। এ অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে ভারতের মনমোহন সিং সরকার যা করতে পারেনি, তা মোদি সরকার করে দেখিয়েছে। ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ এর অংশ হিসেবে ভারত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে তার পতাকাতলে আনছে। এটা অনেকটা ‘মনরো ডকট্রিনের’ ভারতীয় সংস্করণ, অর্থাৎ ভারত চাইবে না এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তি কর্তৃত্ব করুক অথবা প্রভাব বিস্তার করুক। চীন এ অঞ্চলের নিকটপ্রতিবেশী। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে চীনা সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ভারত কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের আপত্তির কারণে ভুটানে এখন অবধি চীন তার দূতাবাস খুলতে পারেনি। তাই চীন-ভারত সম্পর্কটা অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। এ সম্পর্ককে অনেক পর্যবেক্ষক ‘ভারতের হাতি বনাম চীনের ড্রাগন’(Indian Elephant vs Chinese Dragon)হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ চীনের পরিচিতি যেখানে ড্রাগনকে দিয়ে, ঠিক তেমনই ভারতের পরিচিতি হাতিকে দিয়ে। ‘হাতি বনাম ড্রাগন’ দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে একুশ শতকের মধ্যভাগে শুধু এ অঞ্চলেই নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে ভারতের একটা বিশাল এলাকা চীন দখল করে নিয়েছিল। এর আগে মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ সেøাগান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন যে ‘পঞ্চশীলা নীতি’ গ্রহণ করেছিল, যা ন্যাম বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তি দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পঞ্চশীলা নীতি। যেমন বলা যেতে পারে ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এ পঞ্চশীলার কথা বলা আছে। মধ্য পঞ্চাশের সেই ‘নেহরু-চৌ এন লাই’ ইমেজ আবার ফিরে এসেছিল ‘মোদি-শি জিনপিং’ বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে। এটি এখন কতটুকু কার্যকর হবে, মোদির সেপ্টেম্বরে বেইজিং সফর দুই দেশের সম্পর্ককে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার। ভারতের ব্যুরোক্র্যাসি ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এ প্রভাব কাটানো কঠিন। মনমোহন সিং পারেননি। এখন দেখার পালা, মোদি কতটকু পারেন? তবে এটা তো সত্য, মোদির নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। তিনি রাজনীতিকে পাশে ঠেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তার চাই উন্নয়ন। চাই বিনিয়োগ। চাই ব্যবসা। সে কারণে পুরনো বৈরিতা ভুলে গিয়ে তিনি প্রথম চীন সফরে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। তার বৈদেশিক নীতির এটাই বড় বৈশিষ্ট্য। তার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে সফল করা।
এখন ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত দ্বন্দ্ব যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে মোদি তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নিয়ে বেশি দূর যেতে পারবেন না। তিনি ভারতবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করবেন। প্রতি বছর ১২০ লাখ কর্র্মক্ষম মানুষ ‘জব মার্কেটে’ প্রবেশ করছে। এদের জন্য কাজ দরকার। চীনের মতোই ভারতকে একটি ‘পণ্যের উৎপাদনশীল’ দেশে পরিণত করতে চন মোদি। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়লে সেনাবাহিনী চাইবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ভার বাড়ানোর। ভারত তার নৌ ও বিমান বাহিনী আধুনিকীকরণ করছে। নৌবাহিনীতে মোট ২৮টি সাবমেরিন সংযোজনের (বর্তমানে আছে ১৫টি) উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। বিমান বাহিনীতে নতুন বিমান আসছে। ভারত এখন নিজেই তৈরি করবে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। লকহিডের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আগামীতে আরও বাড়বে। সীমান্ত সমস্যা, বিশেষ করে দোকলাম সমস্যার সমাধান যদি না হয়, তাহলে এ উত্তেজনা অন্য অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হবে। খুব সংগত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাতে আক্রান্ত হবে, যা এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
Daily Alokito Bangladesh
30.07.2017
0 comments:
Post a Comment