রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চীন-ভারত সম্পর্ক কোন পথে


চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন-ভারত সম্পর্ক এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, দুই দেশের মধ্যে আবার যুদ্ধ হবে কি না, এসব এখন খোদ ভারতীয় মিডিয়ায়ও আলোচিত হচ্ছে। দোকা লা অঞ্চলে চীনের সড়ক নির্মাণ ও বিপুল সেনা মোতায়েনের পরিপ্রেক্ষিতে দু-দেশের মধ্যে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। দোকা লা মালভূমিটি ভুটান ও চীন উভয়েই নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করে আসছিল। সম্প্রতি ভুটান এ ব্যাপারে দিল্লির সাহায্য চাইলে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিম থেকে সেখানে সেনা পাঠায়। ফলে চীন কৈলাসে যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়। এই কৈলাস হচ্ছে হিন্দু ও বৌদ্ধদের তীর্থস্থান। প্রতিবছর শত শত পুণ্যার্থী তিব্বতের মধ্যে দুর্গম অঞ্চল কৈলাসে যান। পথটি চীন বন্ধ করে দেওয়ায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায়; যদিও দোকা লা মালভূমিটি ভারতের নয়। তবে এ মালভূমির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক বেশি। সীমান্তে এই উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে চীনের গণমাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারিও আমরা লক্ষ করেছি। সিকিম স্বাধীন করে দেওয়ার কথাও চীনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী চীন এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজার হাজার টন সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। এটি যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য কি না তা নিয়েও ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন সমাজবাদী দলের নেতা মুলায়ম সিং যাদব। তিনি লোকসভায় বলেছেন, ভারতের শত্রু পাকিস্তান নয়, ভারতের শত্রু চীন। লোকসভায় তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন যে ভারতের উচিত ছিল তিব্বত স্বাধীন করে দেওয়া! এ-ই যখন পরিস্থিতি এবং সীমান্ত উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল পেইচিং যাচ্ছেন ২৬ জুলাই। ২৭-২৮ জুলাই পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত ব্রিকস নিরাপত্তা ফোরামে তিনি যোগ দেবেন। সীমান্তে উত্তেজনার বিষয়টি সেখানে আলোচনা হওয়ার কথা। এখন দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ব্রিকস মুখ থুবড়ে পড়বে। অথচ পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির কারণে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিকসের গুরুত্ব বাড়ছে। চীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি। এ অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়নে চীন একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি থেকে ভারতও উপকৃত হতে পারে; যদিও ভারত এতে যোগ দেয়নি। এর পরও কথা থেকে যায়—ভারত এই বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে না।

চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১০ সালে জিএনপির দিক থেকে জাপানকে ছাড়িয়ে যায় চীন। যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল মাত্র ২.২ শতাংশ (যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ), সেখানে বলা হচ্ছে ২০২০ সালে PPP-র হিসাব অনুযায়ী (Purchasing, Price, Parity) চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। উৎপাদিত পণ্যের, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক পণ্যের দিক থেকে চীন এখন এক মহাশক্তি। বিশ্বের যত ফটোকপিয়ার, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উৎপাদিত হয়, তার তিন ভাগের দুই ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। সেই সঙ্গে বিশ্বে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ৬০ শতাংশ, ডিভিডির ৫৫ শতাংশ, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০ শতাংশ, পারসোনাল কম্পিউটারের ৩০ শতাংশ, শিশুদের খেলনার ৭৫ শতাংশ চীন একা উৎপাদন করে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনা পণ্যের একটি বাজার তৈরি হয়েছে। চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ তিন ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে। ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের বড় ৫০০ কম্পানির কথা উল্লেখ করেছে, যেখানে চীনের রয়েছে ৩৭টি কম্পানি। বিশ্বে যত জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে এককভাবে চীনে ব্যবহৃত হয় তার ১৬ শতাংশ। আর বিশ্বে জ্বালানি তেলের ব্যবহারের দিক থেকে তিন ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করে চীন। এ কারণে চীনকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ দূষণকারী দেশ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। পরিবেশদূষণের কারণে চীনে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৯ শতাংশ। চীনে রয়েছে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম, যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রতিবছর ২১ মিলিয়ন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। আর প্রতিবছর তিন লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। তারা ফিরেও আসে। ১৯৪৮ সালে (স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে) যেখানে চীনে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২০ শতাংশ, এখন সেখানে ১০০ শতাংশ শিক্ষিত।
অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে চীনে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে চীন অতি দরিদ্রতম অবস্থা (প্রতিদিন জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ ডলার আয় হিসাবে) থেকে বের করে এনে কিছুটা সচ্ছলতা দিয়েছে; যদিও বলা হয়, এখনো প্রায় ২০৭ মিলিয়ন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চীনে একদিকে যেমন ধনী ও গরিবের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন কর্মজীবী মানুষের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। মানুষের আয় সেখানে বেশি। হাজার হাজার টাউনশিপ এখন তৈরি হয়েছে, যা বদলে দিয়েছে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনযাত্রা। চীনকে নিয়ে খারাপ খবরও আছে। যেখানে ২০০৯ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ, ২০১২ সালে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৭.৮ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতি ৩.৫ শতাংশ। আর শহুরে বেকারসংখ্যা ৪ থেকে ৬ শতাংশের নিচে। এই যে চীন, এই চীনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটি এখন বর্তিয়েছে শি চিনপিংয়ের ঘাড়ে। কোন পথে এখন চীন? শি চিনপিংয়ের এজেন্ডায় রাশিয়া ও ভারতকে প্রাধান্য দিয়েও এটা সত্য, অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। বেশ কিছু বিশ্লেষকের লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে শি চিনপিং এখন প্রথমেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে। এক বিশাল দেশ চীন। প্রায় ৫৫ জাতি ও উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে চীন। ২২টি প্রদেশ, পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, চারটি বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭টি বিশেষ এলাকা নিয়ে যে চীনা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সেই রাষ্ট্রটি ভেঙেও যেতে পারে। এ কারণেই চীনা নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক থাকছেন। যে ভুল করেছিলেন গর্বাচেভ, সেই ভুল করেননি চীনা নেতারা। সেনাবাহিনী এখনো পার্টির প্রতি অনুগত। তাই অর্থনৈতিক সংস্কারকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ফুজিয়ান, ঝে ঝিয়াং কিংবা সাংহাই প্রদেশগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক সমৃদ্ধিশালী।
চীন ও ভারত নিকট প্রতিবেশী দুটি দেশ। প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে দেশ দুটির মধ্যে এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ থাকলেও পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির কারণে ভারতের যেমন প্রয়োজন রয়েছে চীনের সাহায্য ও সহযোগিতার, তেমনি চীনেরও প্রয়োজন রয়েছে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতার। ব্রিকস ব্যাংক বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন চীন ও ভারত যদি নিজেদের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত রাখে, তাহলে ব্রিকস ব্যাংক বিকশিত হবে না। ‘সিকিমকে স্বাধীন করার তথাকথিত যে বক্তব্য, তা-ও গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল। চীন এটা করতে পারে না। সাধারণত চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলায় না। এ ক্ষেত্রে সিকিম প্রশ্নে চীনা গণমাধ্যমের বক্তব্য ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল, যা নিন্দনীয়।
একুশ শতকে আমরা চীনকে দেখব অন্যতম এক শক্তি হিসেবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান বিশ্বের সব অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। ব্রিকসে চীন ও ভারত অন্তর্ভুক্ত হলেও এশিয়ার এই দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ভারতে জনগোষ্ঠীর ৩৭.০২ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করলেও আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। ২০০৭ সালে যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ শতাংশ, তখন অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ। সুতরাং ভারতকে ফেলে দেওয়া যাবে না। তাই কোনো কোনো বিশ্লেষক (জনাথন হোলসলাগ, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন) একটি সম্ভাব্য ‘Chindia’ ধারণার কথা বলেছিলেন, যেখানে চীন ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এই ধারণা অমূলক নয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা নেতারা ভারত সফর করেছেন। সীমান্ত সমস্যা নিয়েও (অরুণাচল) এক ধরনের ‘স্থিতাবস্থা’ বিরাজ করছে। ক্ষমতা গ্রহণ করে শি চিনপিং ভারতবিরোধী তেমন কোনো কথা বলেননি। তিনি ভারত সফরও করেছেন। সদ্য সমাপ্ত জি-২০ (হামবুর্গ) সম্মেলনে শি চিনপিং-মোদির সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি উষ্ণ ছিল না। কিন্তু সাক্ষাৎকারটি না হলেই বরং নানা প্রশ্নের জন্ম দিত। এমনকি সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ারও আশঙ্কা ছিল।
চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যায় বলা মুশকিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের মতো আরেকটি ‘যুদ্ধ’ হোক, এটা বোধ করি উভয় দেশের নেতারা কেউই চাইবেন না। অজিত দোভালের পাশাপাশি পররাষ্ট্রসচিব জয়শংকরও পেইচিং যাচ্ছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। মোদি তখন চীনে যাবেন। আসলে উভয় দেশেই কট্টরপন্থী কিছু লোক আছে, যারা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বজায় রেখে সুবিধা নিতে চায়। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ মুহূর্তে দোকা লা উপত্যকা থেকে উভয় দেশের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া জরুরি। এর বাইরে অন্য বিষয়গুলো আলোচনা না করাই মঙ্গল।
একদিকে অরুণাচল, অন্যদিকে কাশ্মীর—দুটি বিষয়ই খুব স্পর্শকাতর। মাঝেমধ্যে চীন অরুণাচল নিয়ে তার দাবি উত্থাপন করলেও সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সড়কপথটি চলে গেছে, যা বেলুচিস্তানের গাওদারে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই সড়কপথের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। এ দুটি বিষয় বাদ রেখে এ মুহূর্তে সীমান্ত উত্তেজনা হ্রাস করা প্রয়োজন। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুক, আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।
Daily Kaler kontho
23.07.2017

0 comments:

Post a Comment