পরস্যীয়
অঞ্চলে সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে কাতারের যে দ্বন্দ্ব সে দ্বন্দ্ব
কী শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবকে কাতার আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করবে? ঈদের আগে
একটি ১৩ দফা দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে এই ১৩ দফা
মানতে হবে। না মানলে কী হবে এটা বলা হয়নি। তবে সৌদি আরব কর্তৃক কাতার
আক্রমণের একটি সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। জুলাই মাসের প্রথম
সপ্তাহেই এই ১০ দিনের আলটিমেটাম শেষ হবে। তখন কী হবে? অনেক সম্ভাবনা এখানে
আছে। ১. সৌদি আরব সীমিত পাল্লার বিমান আক্রমণ চালাতে পারে, ২. সৌদি আরব
তার নেতৃত্বাধীন যে সামরিক জোটটি রয়েছে, তা ব্যবহার করতে পারে, ৩. ইতিমধ্যে
যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে তাতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে; ৪.
সৌদি আরব বিষয়টি জাতিসংঘে তুলতে পারে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক কাতারের বিরুদ্ধে
একটি অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ এবং পরবর্তীতে একটি শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠনের
উদ্যোগ নিতে পারে; ৫. 'রিজেন চেঞ্জ'-এর উদ্যোগ নিতে পারে সৌদি আরব।
এক্ষেত্রে মার্কিন সহযোগিতা পাবে কাতার। এই পাঁচটি 'অপশনে'র কোনটি সৌদি
আরব নেবে বলা মুশকিল। তবে সৌদি-কাতার দ্বন্দ্ব যে আরও ঘণীভূত হবে তা বলার
আর অপেক্ষা রাখে না। এখানে বলা ভালো যে, ১৩টি শর্ত দেয়া হয়েছে তার মধ্যে
উল্লেখযোগ্য শর্তাবলি হচ্ছে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন, আলজাজিরা টিভি
স্টেশন বন্ধ, ব্রাদারহুড, হামাসের মতো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন,
তুরস্কের সেনা ঘাঁটি বন্ধ, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। তবে এসব দাবি কাতার মানবে
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, দোহা
আলোচনার জন্য প্রস্তুত। তার আগে কাতারের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নেয়া
হয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তুরস্ক সেনা ঘাঁটি প্রত্যাহার করতে
অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে তুরস্ক ও কুয়েত মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে। এই
মধ্যস্থতার আদৌ কোনো ফল দেবে কিনা বলা মুশকিল। ইতিমধ্যে কুয়েত ও তুরস্কের
নেতা সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। সৌদি আরব এর আগে
ইয়েমেনের সঙ্গে এক অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ইয়েমেনে 'হুথি' বিদ্রোহীদের
ওপর সৌদি বিমান হামলা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে, এটা বলা যাবে না। এই 'হুথি'
বিদ্রোহীদের সমর্থন করছে ইরান। হুথিরা মূলত শিয়া ধর্মাবলম্বী। ইরান এদের
অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। ফলে এখানেও সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব লক্ষ্য
করা যায়।
তাহলে পারস্যীয় উপমহাসাগরের রাজনীতি এখন কোন পথে? সেখানে আরেকটি যুদ্ধ কী আসন্ন? সৌদি আরবসহ উপমহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আরব আমিরাত, লেবানন এবং সেই সঙ্গে মিসর, ইয়েমেন এবং মালদ্বীপ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে। রমজান ও ঈদের পরও কাতারে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি সেখানে দিন দিন উত্তপ্ত হচ্ছে এবং সম্ভাব্য একটি যুদ্ধের সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ। অতীতেও পারস্যীয় অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছে। পাঠক মাত্রই স্মরণ করতে পারেন ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম গালফ যুদ্ধ হয়েছিল। ইরাক ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে কুয়েত দখল করে নিলে কুয়েতের সমর্থনে এবং জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৩৯টি দেশের সেনাবাহিনী দখলদার ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে উৎখাত করেছিল। ওই যুদ্ধে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। দ্বিতীয় গালফ যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৩ সালের মার্চে। এবার ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ইরাকের কাছে মারণাস্ত্র রয়েছে, যা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইরাক দখল করে নিয়েছিল। এর পরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ইরাক আজ বাহ্যত তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সেখানে জন্ম হয়েছিল ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি সংগঠনের, যারা সিরিয়ার একটি অংশ দখল করে সেখানে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। সেখানে দীর্ঘদিন যাবত এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে এবং আইএসকে সেখান থেকে উৎখাত করা যায়নি। এখন যে প্রশ্নটি খুব সহজেই করা যায় তা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থানকে কেন্দ্র করে সেখানে যে 'যুদ্ধ' চলছে, তা কী এখন গালফ অঞ্চলের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে? একটি সৌদি-কাতার যুদ্ধ কী আসন্ন? আর যদি 'যুদ্ধ' আদৌ শুরু হয় তাহলে বিশ্ব রাজনীতি কোনদিকে যাবে? আর বাংলাদেশের অবস্থানই বা কী হবে? এ বিষয়ে আলোচনার আগে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন তা হচ্ছে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে হঠাৎ এই দ্বন্দ্ব কেন? এই দ্বন্দ্বের পেছনে সৌদি আরবের যুক্তি হচ্ছে কাতার ইসলামিক ব্রাদারহুড ও হামাসের মতো ইসলামিক সংগঠনগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে আসছে, যা সৌদি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এর পেছনে কিছুটা হয়ত সত্যতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যা সত্য, তা হচ্ছে ইসলামিক বিশ্বের নেতৃত্ব কে দেবে, এ নিয়ে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে এক ধরনের 'সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা' চলছে। সৌদি আরবে দুটি পবিত্র মসজিদ রয়েছে_ আল মসজিদ আল হারাম (মক্কা শরিফ) ও আল মসজিদ আল নববী (মদিনা শরিফ)। বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য এই মসজিদ দুটি পবিত্রতম স্থান। আর সৌদি বাদশাহ হচ্ছেন এই মসজিদ দুটির জিম্মাদার। এর মধ্যদিয়ে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দাবিদার। মুসলিম বিশ্বের উন্নয়ন, মুসলিম বিশ্বের দরিদ্রতা দূর করার জন্য যে দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব সৌদি আরব যেমন পালন করে আসছে তেমনি যখন ইসরায়েলি বোমায় ফিলিস্তিনের গাজা শহর (২০১৪) ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল তখন অন্যান্য মুসলিম বিশ্ব তথা ওআইসির যে 'ভূমিকা' পালন করার কথা ছিল তা তারা করেনি। এখানে এগিয়ে এসেছিল কাতার। কাতারের বর্তমান যে শাসক তার একটি আলাদা 'এপ্রোচ' রয়েছে। যদিও সৌদি অর্থনীতি আর কাতারের অর্থনীতি_ একসঙ্গে মেলানো যাবে না। সৌদি অর্থনীতি অনেক বড় ও অনেক শক্তিশালী। এই বিশাল অর্থনীতি বিশ্বের দরিদ্রতম মুসলমান বিশ্বের জন্য তেমন ব্যয় হয় না। সুতরাং এমনি এক পরিস্থিতিতে যদি সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে বিরোধ বাঁধিয়ে দেয়া যায় তাহলে এ থেকে ফায়দা নিতে পারবে ইসরায়েল। ইনন পরিকল্পনায় এমনটিই ছিল। মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত লাগিয়ে রাখা। আর চূড়ান্ত বিচারে এই অঞ্চলের রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তৈরি করা। মুসলমান বিশ্ব যত বেশি বিভক্ত থাকবে তত বেশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল হবে। একসময় একটি বৃহত্তর ইসরায়েলি রাষ্ট্র গঠিত হবে এবং ইসরায়েলের স্বপ্ন সফল হবে। তাই এ অঞ্চলের প্রতিটি উত্থান-পতনের সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার একটি যোগসূত্র আছে। অতি সম্প্রতি ইরানি পার্লামেন্টে ও ইমাম খোমেনির মাজারে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে ইরান এর জন্য সৌদি আরবকে দায়ী করলেও এর পেছনে মূলত রয়েছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতি সৃষ্টি করা ও এ অঞ্চলে নতুন একটি 'ফ্রন্ট' ওপেন করে উত্তেজনা জিইয়ে রাখা এবং ইরানকে উসকে দেয়া। ইরানের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে 'স্ট্রেইট অব হরমুজ' যে প্রণালি দিয়ে পারস্যীয় উপসাগরের তেল বহিঃবিশ্বে যায়। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয় তার ২০ ভাগ এই পথে পরিবাহিত হয়, যার পরিমাণ ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল (প্রতিদিন)। সুতরাং এ অঞ্চলে যে কোনো দ্বন্দ্বে এই জ্বালানি তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। অন্যদিকে কাতারে রয়েছে বিশ্বের বড় গ্যাস রিজার্ভ। প্রতিমাসে বিশ্বে যে পরিমাণ তরল গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানি হয় তার মধ্যে কাতার একাই সরবরাহ করে ৮ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। কাতারের এলএনজি ও পাইপ লাইনে বরবরাহকৃত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল আরব আমিরাত। এমনকি ভারত, জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া কাতার থেকে এলএনজি ক্রয় করে। এই এলএনজি সরবরাহে যদি বিঘ্ন ঘটে তাহলে বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে। কাতারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তুরস্ক ও ইরান। একমাত্র সীমান্ত বন্দর (সৌদি আরবের সঙ্গে) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাতারে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তুরস্ক সেখানে খাদ্য ও সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনিতেই সেখানে একটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে প্রায় ১১ হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আগামীতে কী হবে সেটাও দেখার বিষয়। সব মিলিয়ে পারস্যীয় উপসাগরে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। এই উত্তেজনা সৌদি-কাতারকে কোনো ধরনের 'যুদ্ধের' দিকে ঠেলে দেবে না এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। কেননা কোনো যুদ্ধই এ অঞ্চলের জনগণের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। ইতোমধ্যে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান ও মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছেন কুয়েতের আমির। আমরা বিশ্বাস করি সৌদি ও কুয়েতের নেতৃত্বের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে উত্থাপিত তের দফার কী হবে? আলজাজিরা আরব বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রে আমি নিজে আলজাজিরা নিয়মিত দেখতাম। এখন তা যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কাতার আলজাজিরা বন্ধ করে দেবে এটা মনে হয় না। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি লবি চাচ্ছে আলজাজিরা বন্ধ হোক। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত এ ফাঁদে পা দিল মাত্র। তুরস্ক তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেবে এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তুরস্ক সেটা স্পষ্ট করেছে। কাতার ইসলামিক ব্রাদারহুড কিংবা হামাসের মতো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে আনতে পারে। ইরানের সঙ্গে সম্পর্কও নিম্ন পর্যায়ে রাখতে পারে। এতে করে একটা 'স্ট্যাটাস কো' বজায় থাকতে পারে। তবে বলাবাহুল্য এ অঞ্চলে উত্তেজনা থাকবে। সৌদি আরব চাচ্ছে তার নেতৃত্বে যে সামরিক জোটটি গঠিত হয়েছে, তাতে কাতার আর্থিকভাবে আরও ব্যাপক অংশ নিক। প্রিন্স সালমান, যিনি এখন ভবিষ্যৎ সৌদি রাজা। মাত্র ৩১ বছর বয়স তার। তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবেন। তার নিজস্ব কিছু চিন্তাধারা আছে। তিনি শুধু ইরানের কাছ থেকেই সম্ভাব্য একটি 'আক্রমণ' আশা করছেন। তার ভয় ইরানকে নিয়ে, কাতারকে নিয়ে নয়। তাই সামরিক জোটকে তিনি ন্যাটোর আদলে গড়ে তুলতে চান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও সমর্থন রয়েছে তাতে। আজকে এই যে সৌদি-কাতার দ্বন্দ্ব তার পেছনে কাজ করছে এই সমীকরণটি_ কাতারকে চাপে রেখে সুবিধা আদায় করে নেয়া। তাই সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে যুদ্ধ হয়ত হবে না এবং কাতার হয়ত শেষ অবধি কোনো না কোনো সৌদি ফর্মুলায় রাজিও হয়ে যেতে পারে। জুলাই মাসে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় সেটাই আমাদের দেখার বিষয়।Daily Jai Jai Din03.07.2017
তাহলে পারস্যীয় উপমহাসাগরের রাজনীতি এখন কোন পথে? সেখানে আরেকটি যুদ্ধ কী আসন্ন? সৌদি আরবসহ উপমহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আরব আমিরাত, লেবানন এবং সেই সঙ্গে মিসর, ইয়েমেন এবং মালদ্বীপ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে। রমজান ও ঈদের পরও কাতারে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি সেখানে দিন দিন উত্তপ্ত হচ্ছে এবং সম্ভাব্য একটি যুদ্ধের সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ। অতীতেও পারস্যীয় অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছে। পাঠক মাত্রই স্মরণ করতে পারেন ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম গালফ যুদ্ধ হয়েছিল। ইরাক ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে কুয়েত দখল করে নিলে কুয়েতের সমর্থনে এবং জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৩৯টি দেশের সেনাবাহিনী দখলদার ইরাকি বাহিনীকে কুয়েত থেকে উৎখাত করেছিল। ওই যুদ্ধে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। দ্বিতীয় গালফ যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৩ সালের মার্চে। এবার ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ইরাকের কাছে মারণাস্ত্র রয়েছে, যা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইরাক দখল করে নিয়েছিল। এর পরের কাহিনী আমরা সবাই জানি। সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ইরাক আজ বাহ্যত তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সেখানে জন্ম হয়েছিল ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি সংগঠনের, যারা সিরিয়ার একটি অংশ দখল করে সেখানে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। সেখানে দীর্ঘদিন যাবত এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে এবং আইএসকে সেখান থেকে উৎখাত করা যায়নি। এখন যে প্রশ্নটি খুব সহজেই করা যায় তা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থানকে কেন্দ্র করে সেখানে যে 'যুদ্ধ' চলছে, তা কী এখন গালফ অঞ্চলের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে? একটি সৌদি-কাতার যুদ্ধ কী আসন্ন? আর যদি 'যুদ্ধ' আদৌ শুরু হয় তাহলে বিশ্ব রাজনীতি কোনদিকে যাবে? আর বাংলাদেশের অবস্থানই বা কী হবে? এ বিষয়ে আলোচনার আগে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন তা হচ্ছে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে হঠাৎ এই দ্বন্দ্ব কেন? এই দ্বন্দ্বের পেছনে সৌদি আরবের যুক্তি হচ্ছে কাতার ইসলামিক ব্রাদারহুড ও হামাসের মতো ইসলামিক সংগঠনগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে আসছে, যা সৌদি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এর পেছনে কিছুটা হয়ত সত্যতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যা সত্য, তা হচ্ছে ইসলামিক বিশ্বের নেতৃত্ব কে দেবে, এ নিয়ে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে এক ধরনের 'সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা' চলছে। সৌদি আরবে দুটি পবিত্র মসজিদ রয়েছে_ আল মসজিদ আল হারাম (মক্কা শরিফ) ও আল মসজিদ আল নববী (মদিনা শরিফ)। বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য এই মসজিদ দুটি পবিত্রতম স্থান। আর সৌদি বাদশাহ হচ্ছেন এই মসজিদ দুটির জিম্মাদার। এর মধ্যদিয়ে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দাবিদার। মুসলিম বিশ্বের উন্নয়ন, মুসলিম বিশ্বের দরিদ্রতা দূর করার জন্য যে দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব সৌদি আরব যেমন পালন করে আসছে তেমনি যখন ইসরায়েলি বোমায় ফিলিস্তিনের গাজা শহর (২০১৪) ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল তখন অন্যান্য মুসলিম বিশ্ব তথা ওআইসির যে 'ভূমিকা' পালন করার কথা ছিল তা তারা করেনি। এখানে এগিয়ে এসেছিল কাতার। কাতারের বর্তমান যে শাসক তার একটি আলাদা 'এপ্রোচ' রয়েছে। যদিও সৌদি অর্থনীতি আর কাতারের অর্থনীতি_ একসঙ্গে মেলানো যাবে না। সৌদি অর্থনীতি অনেক বড় ও অনেক শক্তিশালী। এই বিশাল অর্থনীতি বিশ্বের দরিদ্রতম মুসলমান বিশ্বের জন্য তেমন ব্যয় হয় না। সুতরাং এমনি এক পরিস্থিতিতে যদি সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে বিরোধ বাঁধিয়ে দেয়া যায় তাহলে এ থেকে ফায়দা নিতে পারবে ইসরায়েল। ইনন পরিকল্পনায় এমনটিই ছিল। মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত লাগিয়ে রাখা। আর চূড়ান্ত বিচারে এই অঞ্চলের রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তৈরি করা। মুসলমান বিশ্ব যত বেশি বিভক্ত থাকবে তত বেশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল হবে। একসময় একটি বৃহত্তর ইসরায়েলি রাষ্ট্র গঠিত হবে এবং ইসরায়েলের স্বপ্ন সফল হবে। তাই এ অঞ্চলের প্রতিটি উত্থান-পতনের সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার একটি যোগসূত্র আছে। অতি সম্প্রতি ইরানি পার্লামেন্টে ও ইমাম খোমেনির মাজারে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে ইরান এর জন্য সৌদি আরবকে দায়ী করলেও এর পেছনে মূলত রয়েছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতি সৃষ্টি করা ও এ অঞ্চলে নতুন একটি 'ফ্রন্ট' ওপেন করে উত্তেজনা জিইয়ে রাখা এবং ইরানকে উসকে দেয়া। ইরানের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে 'স্ট্রেইট অব হরমুজ' যে প্রণালি দিয়ে পারস্যীয় উপসাগরের তেল বহিঃবিশ্বে যায়। বিশ্বে সমুদ্রপথে যে পরিমাণ তেল পরিবহন করা হয় তার ২০ ভাগ এই পথে পরিবাহিত হয়, যার পরিমাণ ১৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল (প্রতিদিন)। সুতরাং এ অঞ্চলে যে কোনো দ্বন্দ্বে এই জ্বালানি তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। অন্যদিকে কাতারে রয়েছে বিশ্বের বড় গ্যাস রিজার্ভ। প্রতিমাসে বিশ্বে যে পরিমাণ তরল গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানি হয় তার মধ্যে কাতার একাই সরবরাহ করে ৮ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। কাতারের এলএনজি ও পাইপ লাইনে বরবরাহকৃত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল আরব আমিরাত। এমনকি ভারত, জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া কাতার থেকে এলএনজি ক্রয় করে। এই এলএনজি সরবরাহে যদি বিঘ্ন ঘটে তাহলে বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে। কাতারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তুরস্ক ও ইরান। একমাত্র সীমান্ত বন্দর (সৌদি আরবের সঙ্গে) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাতারে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তুরস্ক সেখানে খাদ্য ও সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনিতেই সেখানে একটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে প্রায় ১১ হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আগামীতে কী হবে সেটাও দেখার বিষয়। সব মিলিয়ে পারস্যীয় উপসাগরে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। এই উত্তেজনা সৌদি-কাতারকে কোনো ধরনের 'যুদ্ধের' দিকে ঠেলে দেবে না এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। কেননা কোনো যুদ্ধই এ অঞ্চলের জনগণের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। ইতোমধ্যে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান ও মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছেন কুয়েতের আমির। আমরা বিশ্বাস করি সৌদি ও কুয়েতের নেতৃত্বের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে উত্থাপিত তের দফার কী হবে? আলজাজিরা আরব বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রে আমি নিজে আলজাজিরা নিয়মিত দেখতাম। এখন তা যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কাতার আলজাজিরা বন্ধ করে দেবে এটা মনে হয় না। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি লবি চাচ্ছে আলজাজিরা বন্ধ হোক। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত এ ফাঁদে পা দিল মাত্র। তুরস্ক তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেবে এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তুরস্ক সেটা স্পষ্ট করেছে। কাতার ইসলামিক ব্রাদারহুড কিংবা হামাসের মতো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে আনতে পারে। ইরানের সঙ্গে সম্পর্কও নিম্ন পর্যায়ে রাখতে পারে। এতে করে একটা 'স্ট্যাটাস কো' বজায় থাকতে পারে। তবে বলাবাহুল্য এ অঞ্চলে উত্তেজনা থাকবে। সৌদি আরব চাচ্ছে তার নেতৃত্বে যে সামরিক জোটটি গঠিত হয়েছে, তাতে কাতার আর্থিকভাবে আরও ব্যাপক অংশ নিক। প্রিন্স সালমান, যিনি এখন ভবিষ্যৎ সৌদি রাজা। মাত্র ৩১ বছর বয়স তার। তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবেন। তার নিজস্ব কিছু চিন্তাধারা আছে। তিনি শুধু ইরানের কাছ থেকেই সম্ভাব্য একটি 'আক্রমণ' আশা করছেন। তার ভয় ইরানকে নিয়ে, কাতারকে নিয়ে নয়। তাই সামরিক জোটকে তিনি ন্যাটোর আদলে গড়ে তুলতে চান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও সমর্থন রয়েছে তাতে। আজকে এই যে সৌদি-কাতার দ্বন্দ্ব তার পেছনে কাজ করছে এই সমীকরণটি_ কাতারকে চাপে রেখে সুবিধা আদায় করে নেয়া। তাই সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে যুদ্ধ হয়ত হবে না এবং কাতার হয়ত শেষ অবধি কোনো না কোনো সৌদি ফর্মুলায় রাজিও হয়ে যেতে পারে। জুলাই মাসে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় সেটাই আমাদের দেখার বিষয়।Daily Jai Jai Din03.07.2017
0 comments:
Post a Comment