গত ১৩ জুলাই আমাদের সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে। ওই সংবাদে
বলা হয়েছে, মন্ত্রিসভায় রদবদল আসন্ন। প্রতিবেদনটিতে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে
যে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই মন্ত্রিসভায় বেশকিছু পরিবর্তন আসছে। ওই
প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিতর্কিত
কর্মকা-ের জন্য তারা বাদ পড়তে পারেন! মন্ত্রসিভায় রদবদল কিংবা কাউকে কাউকে
অন্তর্ভুক্ত করাÑ এসবই একটি রুটিন ওয়ার্ক। প্রধানমন্ত্রী তার প্রশাসনে গতি
আনার জন্য মন্ত্রসিভায় পরিবর্তন আনতে পারেন। সংবিধান তাকে সে ক্ষমতা
দিয়েছে। তবে আমার বিবেচনায় বর্তমানে যে পরিবর্তনটি তিনি করতে যাচ্ছেন তার
গুরুত্ব অনেক। কেননা আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে
দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নৌকা মার্কার পক্ষে ভোট চাইতে শুরু করেছেন। তাই এমন
একটি মন্ত্রিসভা তিনি গঠন করবেন, যাদের নিয়ে তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। সে জন্য দক্ষতা, দুর্নীতিমুক্ত,
গ্রহণযোগ্য ও সৎ একটি মন্ত্রিসভা দরকার। অতীতে এমন একজন মন্ত্রীর কথা আমরা
জানি, যিনি মাসের পর মাস অফিসে যেতেন না। বাসায় ফাইল নিয়ে যেত তার স্টাফরা।
একজন মন্ত্রী হতে পারেন তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তিনি মন্ত্রণালয়
পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি! আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক মন্ত্রীর
নামও জানি না। চিনিও না। এটা আমার অপরাধ কিনা জানি না, কিন্তু ওইসব মন্ত্রী
মহোদয় তাদের নিজ নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে জনগণের সামনে হাজির হতে পারেননি।
অনেক মন্ত্রীর পারিবারিক সদস্যদের দ্বন্দ্ব সরকারকে বিব্রত অবস্থার মধ্যেও
ফেলে দিয়েছে! তাই পরিবর্তনটা প্রয়োজন। মন্ত্রিসভায় এমন সব ব্যক্তিকে স্থান
দেওয়া উচিত, যারা জাতিকে সত্যিকার অর্থেই নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
শোনা যাচ্ছে কোরবানির পর মন্ত্রিসভায় রদবদল হবে। তখন আরও কিছু পূর্ণমন্ত্রী
অন্তর্ভুক্ত হবেন। এটা প্রধানমন্ত্রীর মর্জির ওপর নির্ভরশীল।
প্রধানমন্ত্রী ভালো মনে করলে তাই করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীদের
সংখ্যা বাড়িয়ে কি কেবিনেটে গতিশীলতা আনা যায়? কিংবা কেবিনেটের দক্ষতা
বাড়ানো যায়? এর জবাব হচ্ছে, না। আমি তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে দেখাতে পারব,
পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ছোট মন্ত্রিসভা নিয়ে অত্যন্ত সাফল্যের
সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। যুক্তরাজ্যে কেবিনেট পদমর্যাদায় মন্ত্রী
রয়েছেন মাত্র ২১ জন। জার্মানিতে তিনটি বড় দলের সমন্বয়ে রয়েছে একটি কেবিনেট।
সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৬ জন। এর মাঝে চ্যান্সেলর (বা প্রধানমন্ত্রী)
অ্যাজ্ঞেলা মের্কেলের সিডিইউ থেকে ৭ জন, এক সময়ের বিরোধী দল ও এখন
কোয়ালিশনের অংশীদার এসপিডি থেকে ৬ জন, আর সিডিইউর ট্রেশিনাল পার্টনার
সিএসইউ থেকে ৩ জন। জার্মানির মতো বড় অর্থনীতির দেশে কেবিনেটের সদস্য সংখ্যা
মাত্র ১৬ জন। চিন্তা করা যায়? যুক্তরাষ্ট্রের কথা চিন্তা করুন। সেখানে
কেবিনেট পদমর্যাদার মন্ত্রীদের সংখ্যা ১৫ জন। তবে ভাইস প্রেসিডেন্টও সেখানে
কেবিনেটের অংশ। ভারতের মতো বিশাল দেশে নরেন্দ্র মোদি মাত্র ৩৪ জন মন্ত্রী
নিয়ে একটি কেবিনেট পরিচালনা করে আসছেন। অথচ বাংলাদেশে? বাংলাদেশে
পূর্ণমন্ত্রী আছেন ৩২ জন, ১৮ জন রয়েছেন প্রতিমন্ত্রী ও ২ জন উপমন্ত্রী। গত
১৪ জুলাই (’১৬ সাল) ৩ জন পর্ণমন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী আমরা পেয়েছি।
পূর্ণমন্ত্রীর ২ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। আর একজন পূর্ণমন্ত্রী আমরা পেয়েছি
নতুন। তিনি চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী।
নুরুল ইসলাম বিএসসি স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে তার জীবন শুরু করলেও তিনি এখন
চট্টগ্রামের একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে বেশ কিছুদিন যাবৎ
ছোট্ট একটি কলাম লিখে আসছেন। নিয়মিত। তিনি চট্টগ্রাম-৮ আসনে জাতীয় সংসদে (৫
জানুয়ারির নির্বাচনে) নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয়
পার্টির সঙ্গে সমঝোতার ফলে ওই আসনটি দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় পার্টির সাধারণ
সম্পাদককে। তখন প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে তাকে তিনি পুরস্কৃত
করবেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে পূর্ণমন্ত্রী বানিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী তার কথা রেখেছেন। এভাবেই প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেন। অতীতেও
তিনি কথা রেখেছিলেন। এখন যিনি ধর্মমন্ত্রী তাকেও কথা দিয়েছিলেন। সে কথা
তিনি রেখেছেন। দিলীপ বড়–য়ার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। জীবনে কোনো
নির্বাচনে সাম্যবাদী দলের এই নেতা ৫০০ ভোটের বেশি পাননি। ২০০৮ সালের
নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। তার দলটি আবার ১৪ দলের শরিক দল।
ফলে সঙ্গত কারণেই তার আসনটিতে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী
তখন দিলীপ বড়–য়াকে কথা দিয়েছিলেন। জীবনে যিনি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে
পারেননি, তিনি শুধু এবং একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদে পূর্ণমন্ত্রী
হয়েছিলেন। তবে দিলীপ বড়–য়া কথা রাখেননি। সারাজীবন বাম রাজনীতি করেও নানারকম
দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, কেউই
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেননি। তবে নুরুল ইসলাম বিএসসি
৭৩ বছর বয়সে এসে মন্ত্রী হয়ে শেষ পর্যন্ত কতটুকু বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে
পারবেন জানি না। একজন ব্যবসায়ী যখন মন্ত্রী হন, তিনি কখনই নিজেকে ব্যবসায়িক
স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ঊর্ধ্বে রাখতে পারেন না। একজন ব্যবসায়ীকে
মন্ত্রী না করাই মঙ্গল। প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই।
সাধারণত তরুণ প্রজন্মের ছোট মন্ত্রীরা সমাজের জন্য মডেল হন। তাদের দেখে
অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। এ ক্ষেত্রে কারো পারিবারিক জীবন নিয়ে যদি
স্ক্যান্ডাল হয়, যদি তিনি মিডিয়ার আলোচনার খোড়াক হন, তিনি তখন আর তরুণ
সমাজের আদর্শ হতে পারেন না। বলতে নেই দু-একজন প্রতিমন্ত্রীর পারফরম্যান্স
ভালো।
মূলত মন্ত্রিসভায় যে কোনো রদবদল অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এতে গুণগত
পরিবর্তন যেন হয়। আশাবাদী হওয়ার মতো ঘটনা যেন ঘটে। এটা কোনোমতেই যেন একটা
‘কসমিক চেঞ্জ’ না হয়। মানুষের প্রত্যাশা যেন পূরণ হয়। আমি নিশ্চিত করেই
বলতে পারি, কোরবানির পর বর্তমান মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ ঘটবে। তখন হয়তো
আমরা আরও বেশ কয়েকজন নতুন পূর্ণমন্ত্রী পাব। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি ভেবে
দেখা দরকার, তা হচ্ছে যোগ্যতা এবং বিতর্কিত নন, এমন ব্যক্তিদেরই যেন
মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়। এক সময় যিনি ‘পাখির মতো’ সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন,
বিদেশি মন্ত্রীদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে
যিনি ছিলেন উদাসীন, তিনি দলের যত ‘বড়’ নেতাই হোন না কেন, মন্ত্রিসভার
ভাবমূর্তির জন্য তিনি ‘যোগ্য’ ব্যক্তি নন। আরেকজনের কথা বলি। সিলেটের শিশু
রাজন হত্যার জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন খালেদা জিয়াকে। মধ্যপ্রাচ্যে
জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থানের জন্যও তিনি দায়ী করেছিলেন খালেদা জিয়াকে। তার
দুর্নীতি নিয়ে যখন যমুনা টিভি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তখন খটকা
লেগেছিল। এভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে কী তিনি নিজের ‘যোগ্যতা’ প্রমাণ করতে
চাচ্ছেন? আমার অবজারভেশনটা হচ্ছে এখানেই। বড় মন্ত্রিসভার প্রয়োজন নেই।
দরকার ছোট মন্ত্রিসভা। কিন্তু তারা হবেন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন। যতদূর
জানি, অতীতে কোনো একটি কমিটির সুপারিশ ছিল এমনটাই ২০ থেকে ২৫ জনের মধ্যে
মন্ত্রিসভার সদস্য সীমাবদ্ধ রাখা। এটাই সঠিক। সাধারণত ‘জেলা কোটা’,
ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে কেবিনেট সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বিষয়টি খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। তবে বলতেই
হবে, বর্তমান কেবিনেটে বেশ ক’জন সদস্য রয়েছেন, যারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়
পরিচালনায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাধারণত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নেওয়া হয়। তবে
সংবিধানের ৫৬(২) ধারা মতে, টেকনোক্রেট কোটায়ও মন্ত্রী নেওয়া হয় (মোট
সদস্যদের দশ ভাগের এক ভাগ)। এই ধারাটি পরিবর্তন প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন
ক্ষেত্রে যারা যোগ্য এবং আন্তর্জাতিক আসরে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন, এমন
কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া যায়। বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যনির্ভর
বিশ্বব্যবস্থায় যেখানে নেগোসিয়েশনের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কোনো
কোনো মন্ত্রণালয় (বাণিজ্য, শিল্প, পররাষ্ট্র, মানবসম্পদ) পরিচালনায় দক্ষ ও
যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রী প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, দলকে
তারা সংগঠিত করেন। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিল প্যাঁচ ও আন্তর্জাতিক
আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা নাও থাকতে পারে। প্রয়োজনটা এ কারণেই। মন্ত্রিসভার
সম্ভাব্য সম্প্রসারণ নিয়ে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে,
উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি! কোনো কোনো মিডিয়ায় এমন আভাস দেওয়া হচ্ছে যে,
পুনরায় দেশে কেবিনেটে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্যÑ
কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে আরও বড় দায়িত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই নাকি
উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে! যদিও এর সত্যতা পওয়া যায়নি। এ
ধরনের সিদ্ধান্ত দলের অভ্যন্তরে আরও বিতর্ক বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা
যাবে, একসঙ্গে একাধিক উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে কাউকে কাউকে
‘অ্যাকোমোডেট’ করার জন্য! এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। জার্মানিতে একজন
উপ-প্রধানমন্ত্রী বা ভাইস চ্যান্সেলর আছেন বটে। যেহেতু তিনি কোয়ালিশনের
অন্যতম অংশীদার, সেটা বিবেচনায় নিয়েই এসপিডির সভাপতিকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর
পদ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যেও অবশ্য একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী আছেন।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রী নেই। ভারতেও নেই। আমাদের
সংবিধানে কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ নেই। যদি উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে
কাউকে নিয়োগ দিতে হয়, তাহলে সংবিধানে সংশোধন আনতে হবে। সংসদে বিল আকারে তা
উপস্থাপন করে পাস করাতে হবে। বলা ভালো, অতীতে বাংলদেশে উপ-প্রধানমন্ত্রীর
পদ ছিল, যা পরে অবলুপ্ত করা হয়।
বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের
গ্রহণযোগ্যতা ও ভূমিকা বেড়েছে। ফলে বিশ্ব আসরে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে
হলে চাই দক্ষ, শিক্ষিত ও প্রতিনিধিত্বশীল একটি কেবিনেট। অযোগ্য ও
বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া হোক। আধুনিকমনস্ক একটি কেবিনেটই বাংলাদেশকে সঠিকভাবে
প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের চেয়ে এই মুহূর্তে বড়
প্রয়োজন মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে ছোট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা।
Daily Amader Somoy
27.07.2017
0 comments:
Post a Comment