সংবিধানের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে, ১২৩(৪) অনুচ্ছেদে নির্বাচনের জন্য ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাবার ৯০ দিনের মধ্যে’ একটি কথা বলা আছে বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা কী হবে, তিনি নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনারের কাছে হস্তান্তর করবেন কিনা, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন।’ এবং ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।’ অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের কথাবার্তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। নির্বাচন কমিশন কখনই স্বাধীন নয়। এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কখনই নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে না। বরং স্থানীয় পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা থাকেন (ডিসি, টিএনও ইত্যাদি), তারা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অর্থাৎ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কথা শোনেন। কাগজ-কলমে আছে, ওই তিন মাস তারা নির্বাচন কমিশনের কথা শুনবেন। কিন্তু তা তারা শোনেন না। তাহলে এখন ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখেই ২০১৯ সালের জানুয়ারির ৩ মাস আগেই নির্বাচনটি হবে (একাদশ সংসদ নির্বাচন)। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে যা করতে পারেন (২০১৪ সালেও তিনি তা করেছিলেন) তা হচ্ছে, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ছোট সরকার তিনি গঠন করতে পারেন। তবে তিনি বাধ্য নন। সংবিধান অনুযায়ী তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তবে তিনি কাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এ সিদ্ধান্তটি এককভাবেই প্রধানমন্ত্রীর। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি মনে করেন নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত, তিনি সেটি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করারও প্রয়োজন নেই। তার আন্তরিকতাটাই হল আসল। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন তিনি। যেহেতু বিএনপি সংসদে নেই, তাই ৩ থেকে ৪টি সংসদীয় আসনে তিনি উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন। এবং বিএনপি প্রার্থী উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে- যারা মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন, তারা নিরপেক্ষতার স্বার্থে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। একটি ছোট মন্ত্রিসভা (১০ সদস্যবিশিষ্ট) থাকবে। এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো থেকেই তাদের নেয়া হবে।
আর একটা কথা। জাতীয় পার্টি নিয়ে একটা অস্পষ্টতা আছে। দলটি বিরোধী দলে, নাকি সরকারি দলে এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যদি জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে সরকার দেখতে চায়, তাহলে দলটিকে বিরোধী দল হিসেবেই চলতে দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভায় তারা থাকতে পারবেন না। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারে তারা থাকতে পারেন। জাতীয় পার্টিকে ১৪ দলেও নেয়া যেতে পারে প্রয়োজনে। একদিকে সরকারে, অন্যদিকে বিরোধী দলে, এভাবে থাকার ফলে জাতীয় পার্টির যে সম্ভাবনা ছিল, তা নষ্ট হওয়ার পথে। জাতীয় পার্টি বিএনপির বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারত। সেটি হয়নি। এইচএম এরশাদ যদি বিরোধী দলের নেতা হতেন, আমার ধারণা, সেই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ত। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি। একটি ব্যক্তিগত ইমেজ তার আছে। উপরন্তু তার নামেই জাতীয় পার্টি চলে। উত্তরাঞ্চলে তার নামের কারণেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ব্যক্তিগত ইমেজে এভাবে বিজয়ী হওয়া যেত না বলেই মনে হয়। সুতরাং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন- জাতীয় পার্টি সরকারি দলে থাকবে, নাকি বিরোধী দলে।
এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেনে’ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গলজনক নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন।
সাধারণ মানুষ চায় দুই বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি বিরল। নির্বাচনের বাকি আছে আরও কমপক্ষে ১৭ মাস। কিন্তু এরই মাঝে দুই বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন। ফলে আস্থার যে ঘাটতি ছিল তা রয়েই গেছে। এ আস্থার ঘাটতি নিয়ে ইসি কীভাবে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে? গত ১৬ জুলাই সিইসি যেসব বক্তব্য রেখেছেন, তাতেও এই আস্থা নিশ্চিত হয়নি। একটি রোডম্যাপ দেয়া হয়েছে। এটি মূলত একটি রুটিন ওয়ার্ক। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই ইসিকে এ ধরনের কর্মসূচি দিতে হয়। এটি ইসির কাজেরই অংশ। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। যেমন বলা যেতে পারে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বিধিবিধান অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা ইত্যাদি। এতে নতুনত্ব কই? এতে করে আস্থার সম্পর্কই বা স্থাপিত হবে কীভাবে? এগুলো সবই রোডম্যাপের অন্তর্ভুক্ত। এ রোডম্যাপ নিয়ে হুদা কমিশন কী দেবে জাতিকে?
আগামী ৩১ জুলাই থেকে ইসি সুধী সমাজের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। এ সংলাপ ইসিকে কী দেবে? একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুধী সমাজের বক্তব্য আমরা মোটামুটিভাবে জানি। সুধী সমাজও অনেকটা বিভক্ত। একদল বিএনপিকে সমর্থন করে (যদিও তাদের সংখ্যা কম), আরেক দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বুদ্ধিজীবী কি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন? এ বুদ্ধিজীবীরা, যাদের মধ্যে সরকারি দলের সমর্থক বেশি, তারা অপেক্ষায় থাকেন কখন তাদের ডাক পড়বে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো একটির উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে!
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ ওই একই দিন অর্থাৎ ১৬ জুলাই, একদিন সময় না নিয়েই বললেন, রোডম্যাপ ভালো হয়েছে, সুন্দর হয়েছে। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বললেন, রোডম্যাপ কোনো সমাধান নয়, দরকার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। এখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তো কমিশনের সংলাপে গিয়ে দলীয় কথাই বলবেন। এ থেকে তাহলে কী পাবে নির্বাচন কমিশন? কিছুই না।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। এতে করেইবা কী পাবে নির্বাচন কমিশন? নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪২। এর মধ্যে ৩ থেকে ৪টি দল বাদে অন্য দলগুলোর কোনো গণভিত্তি নেই। এসব ছোট ছোট দল বড় দল দুটির অপেক্ষায় থাকে। তাদের সংসদে যাওয়ার পথ একটাই- হয় নৌকা মার্কা, না হয় ধানের শীষ। কোনো একটি দলের প্রধান, যিনি ১৪ দলে আছেন, তিনি তার মার্কা নিয়ে জীবনে কোনো নির্বাচনেই ৫০০ ভোটও পাননি। তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন বটে, তবে এসব কাগুজে সংগঠন তাদের নিজেদের স্বার্থে জোটে ‘আশ্রয়’ নেয়। কাজেই এসব কাগুজে সংগঠনের সঙ্গে সংলাপ করে কী লাভ? সংলাপ করতে হবে মূলত তিনটি দলের সঙ্গে- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। কারণ বিগত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোতে এ তিনটি দলই বড় আসন পেয়েছে। জামায়াতের একটি ভোটব্যাংক রয়েছে বটে, কিন্তু নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তারা ২০ দলীয় জোটে থাকলেও আসন বণ্টনের প্রশ্নে তাদের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নিশ্চিত হবে, এটা বেগম জিয়া এখনও খোলাসা করেননি।
আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে কিনা, সে ব্যাপারেও এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। সিইসি বলেছেন, ‘এখনও ইভিএম বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়নি’। এর অর্থ কী? ইভিএম ব্যবহার হতে পারে? ইভিএম নিয়ে বিতর্ক আছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সব রাজ্যের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয় না। ভারতেও সর্বত্র ব্যবহার হয় না। কাজেই ‘বিতর্ক এড়াতে’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না হওয়াই মঙ্গল।
রোডম্যাপ উপস্থাপনকালে সিইসির একটি বক্তব্য ছিল এরকম- ‘আমরা সবার প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বদ্ধপরিকর এবং আমরা তা করতে পারব।’ সিইসির এ আশাবাদকে আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তার একটা ‘অতীত’ আছে। এ নিয়ে কম ‘পানি ঘোলা’ হয়নি। কিন্তু সেসব ‘অভিযোগ’ও এখন অতীত। ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে, নিরপেক্ষতার সঙ্গে এবং প্রভাবমুক্ত থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি যদি পরিচালনা করতে না পারেন, তাহলে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। তিনি ওয়াদা করেছেন, তিনি ‘প্রভাবমুক্ত’ থাকবেন এবং নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনটি পরিচালনা করবেন। সংবিধান তাকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। সেই ক্ষমতা তিনি কতটুকু প্রয়োগ করতে পারবেন- সেটিই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এটা করতে হলে তাকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নিতে হবে। আমরা ২০১৪ সালের জানুয়ারির ঘটনা ভুলে যেতে চাই। আমরা চাই না ওরকম আরেকটি ‘ঘটনা’ ঘটুক। সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না, এটা সত্য। সেই সঙ্গে এটাও আকাক্সক্ষা, সংবিধান যেন আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। আমরা চাই এমন একটি নির্বাচন, যে নির্বাচন নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব এবং তা আগামী নির্বাচনের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
Daily Jugantor
22.07.2017
0 comments:
Post a Comment