রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ বিশ্বরাজনীতি



সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের বিষয়টি বহুল আলোচিত। সীমান্তে সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ দুটির মধ্যে যে উত্তেজনার জন্ম হয়েছিল, তার রেশ গিয়ে পড়েছিল জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে। গত ৮ জুলাই হামবুর্গে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ওই শীর্ষ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি ও শি জিনপিং যোগ দিয়েছিলেন। বৈঠকের এক ফাঁকে শি জিনপিং ও মোদি এক সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে উষ্ণতা ছিল না। এই যখন পরিস্থিতি তখন গত ৭ জুলাই থেকে বঙ্গোপসাগরে শুরু হয়েছে জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নৌমহড়া। এ মহড়ায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী একাধিক যুদ্ধজাহাজ অংশ নিচ্ছে। এ মহড়া চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। পশ্চিমা গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ‘মালাবার ২০১৭’ নামে পরিচালিত এ তিনদেশীয় নৌমহড়া মূলত চীনকে লক্ষ্য করেই পরিচালিত হচ্ছে। কেননা ইদানীং বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে চীনা ডুবোজাহাজের তৎপরতা বেড়েছে। এ ধরনের ঘটনা ভারতের নীতিনির্ধারকদের জন্য চিন্তার কারণ।

সিকিম সীমান্তে টানাপোড়েনের মধ্যে সেখানে যুদ্ধের মতো এক ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি সিকিমের স্বাধীনতাকামীদের সমর্থন দেবে বলে হুমকি দিয়েছিল চীন। চীনের সরকারি পত্রিকা ‘স্পেশাল টাইমস’-এর সম্পাদকীয়তে সিকিমের স্বাধীনতাকামীদের সমর্থনের কথা বলা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তিব্বতে বিশাল সামরিক মহড়া আয়োজন করে চীন নাথুলা দিয়ে কৈলাস ও মানসসরোবরে তীর্থযাত্রীদের যাত্রা বন্ধও করে দিয়েছিল। ফলে একদিকে সিকিম সীমান্তে উত্তেজনা বজায় রাখা আর অন্যদিকে হামবুর্গে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদির সৌজন্য সাক্ষাৎ, দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কতটুকু উন্নত করতে পারবে, তা বলা মুশকিল।

চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে উভয় শক্তিই এক ধরনের ‘প্রভাব বিস্তার করার’ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। প্রভাব বিস্তার করার এই যে প্রতিযোগিতা, তাতে এ অঞ্চলের দেশগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ভারত ইতিমধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ভারত তার ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ করতে শুরু করছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা আগামীতে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এ মেসেজটিই তারা দিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটি দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলংকায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে এ ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন ভারত প্রাচীনকালে তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় পণ্ডিতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌবাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিসর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলংকা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মাল্লাকা প্রণালী), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এ ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা তথা সুতি এ সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। চীনা নেতা শি জিনপিং তার ‘সিল্ক রুট’-এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর বিপরীতে ভারত তার পুরনো ‘কটন রুট’-এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এ দ্বন্দ্ব, শেষ অব্দি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরও বাড়াচ্ছে। ভারত ও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।

বলা হয় একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি- চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। সম্প্রতি শি জিনপিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা ‘অন্য চোখে’ দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এ সিল্ক রোডটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সিল্ক রোডের মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একইসঙ্গে একটি মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়। এমন কথাও বলা হয়, ব্রুনাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি। ২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এ সিল্ক রুটের আগ্রহের কথা জানতে পারি। এই সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সেটার বেশ কিছুটা পথও পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে তার ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও বলেন। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে চীনের যে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠকই জানেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন তা হচ্ছে, চীনের এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের নীতি ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক? কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ভারতীয় মনরো ডকট্রিনের কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। আর এ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে আটলান্টিক ও প্যাসিফিকের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ‘ফায়দা’ উঠাতে চাইবে। আগামী দিনগুলো তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তখন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে এ অঞ্চলের দেশগুলো এতে করে ‘প্রভাবিত’ হবে। সবচয়ে বড় কথা ঝুঁকির মুখে থাকবে ব্রিকস ব্যাংক।

বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থাকে সামনে রেখে ব্রিকসভুক্ত ৫টি দেশ একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা যে কোনো বিবেচনায় গুরুত্বের দাবি রাখে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো- চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া ও ব্রাজিল বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তথা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হ্রাস করার উদ্দেশ্যেই ২০১৫ সালে আত্মপ্রকাশ করে ব্রিকস ব্যাংক বা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) গঠন করে। এ ব্যাংককে বলা হচ্ছে বিকল্প বিশ্বব্যাংক। মোট ৫৭টি দেশ নিয়ে এ ব্যাংকের যাত্রা শুরু। মোট মূলধনের পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলার। এর মাঝে চীন জোগান দিয়েছে ২৯ দশমিক ৭৮ ভাগ অর্থ। এর পরের অবস্থান ভারতের। ভারতের অর্থের পরিমাণ ৮ দশমিক ৩৭ ভাগ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি ৪ দশমিক ৪৮ ভাগ। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অবস্থান আরও অনেক পরে। বলাই বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র যেমন এআইআইবির সদস্য হয়নি, ঠিক তেমনি জাপানও এর সদস্য নয়। বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশ এ ব্যাংকের সদস্য। ২০১৫-১৬ সালে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে এবং রাষ্ট্রপতি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে উন্নয়নশীল বিশ্বে আইএমএফের ঋণনীতি আবারও আলোচনায় আসে। আইএমএফ শর্তসাপেক্ষে গ্রিসকে আরও ঋণ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রিস সরকার তাতে রাজি হয়নি। ফলে রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হয়ে যায়। ইউরো জোন থেকে দেশটির ছিটকে পড়ারও আশঙ্কা ছিল। এমনি একটি পরিস্থিতিতে এআইআইবির জন্ম বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন এক চমক সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। কিন্তু যেভাবে ভারত মহাসাগরে এ দুই দেশের মাঝে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাতে করে এ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। এখন দেখার পালা যৌথভাবে একটি বিকল্প বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেও এ দুই দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে উপনীত হয়।

গত ৯ জুলাই মোদি-শি জিনপিংয়ের ছবি ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। ছবির সঙ্গে কলকাতার আনন্দবাজারের বক্তব্য ছিল এ রকম : ‘নয়াদিল্লির প্রশংসা করে ভারতের নেতৃত্বে ব্রিকসের মঞ্চ গতি পেয়েছে।’ এটা চীনা প্রেসিডেন্টর বক্তব্য, মোদির বক্তব্যও অনেকটা এরকম। এখন দেখার পালা সব কিছু ভুলে এ দুটি দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে কিনা। এখানে আস্থা ও বিশ্বাস রাখাটা জরুরি।
Daily Jugantor
11.07.2017

0 comments:

Post a Comment