রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি


যারা ইতিহাস চর্চা করেন, তারা আলেকক্সিস দ্য একিউভিলের (অষবীরং ফব ঞড়পয়ঁবারষষব) লেখনির সঙ্গে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। যদিও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন না। ফরাসি এই দার্শনিক গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদপত্রের প্রয়োজজনীয়তা ও গুরুত্বের কথা বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেনÑ ‘ও ধস ভড়ৎ ভৎড়স ফবহুরহম ঃযধঃ হবংিঢ়ধঢ়বৎং রহ ফবসড়পৎধঃরপ পড়ঁহঃৎরবং ষবধফ পরঃরুবহং ঃড় ফড় াবৎু রষষ পড়হংরফবৎবফ ঃযরহম রহ পড়সসড়হ; নঁঃ রিঃযড়ঁঃ হবংিঢ়ধঢ়বৎং ঃযবৎব ড়িঁষফ নব যধৎফষু ধহু পড়সসড়হ ধপঃরড়হ ধঃ ধষষ. ঝড় ঃযবু সবহফ সড়ৎব রষষং ঃযধহ ঃযবু পধঁংব’। বাংলা করলে এটা অনেকটা এ রকমÑ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রগুলো যে খুবই অবিবেচক সাধারণ কর্মকাণ্ডের দিকে নাগরিকদের চালিত করে, এটি আমি জোর দিয়ে অস্বীকার করতে চাই না। কিন্তু সংবাদপত্র ছাড়া সাধারণ কর্মকাণ্ড বলতে প্রায় কিছু থাকবেই না। ফলে তারা যত ক্ষত তৈরি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি সারায়। এই একটি বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে সমাজ উন্নয়নে, সমাজ বিকাশে সংবাদপত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। যুগে যুগে সংবাদপত্রের এই ভূমিকা স্বীকৃত। বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্রের বিকাশ যেখানে ঝুঁকির মুখে থাকে, সেখানে সংবাদপত্র গণতন্ত্র বিকাশে একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। তাই বলা যেতে পারে, গণতন্ত্র ও স্বাধীন সংবাদপত্র পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪২ বছরে পা দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার প্রবক্তারা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সেই সঙ্গে স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও সংবাদপত্র কর্মীদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তবে এটা বলতেই হয়, আমাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বীকৃত।
বাংলাদেশে আমরা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। গেল ৪১ বছরে এই সংবিধানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মোট ১৫টি সংশোধনী সংবিধানে যুক্ত হয়েছে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ফলে সংবিধান এখন মূল ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছে। সংবিধান মূল সংবিধানে ফিরে গেলেও, একাধিক ধারা ও উপধারা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দ্বিমত আছে। মূল একটি প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনও দ্বিধা বিভক্ত। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হলেও, এ প্রশ্নে বিরোধী দল এখন জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, তা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটো আরও স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা এবং ‘খ’তে রয়েছে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল’। অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯নং ধারাটিতে একজন সংবাদকর্মীকে যেমনই অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষাকবচ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝে-মধ্যে এই ৩৯নং ধারাটি লংঘিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জš§ হয়, তখন ওই সময়ের জাতীয় নেতারা এটা উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তারা সংবিধানে ৩৯নং ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯নং ধারার সঙ্গে ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদ দুটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তা ৩৯নং অনুচ্ছেদের পরিপূরক। ৩৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরার স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই ধারা বলে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার বা চলাচল করার অধিকার রাখেন। আর ৩৭নং ধারায় বলা হয়েছে, সমাবেশের স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ একজন নাগরিককে জনসভা তথা শোভাযাত্রা করার অনুমতি দিয়েছে। সংবিধানের এই ৩৬, ৩৭ ও ৩৯নং অনুচ্ছেদ যদি একসঙ্গে পড়ি, তাহলে দেখব এখানেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের স্পিরিট। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি লুকিয়ে আছে এই অনুচ্ছেদগুলোর অন্তরালে। এর একটি যদি লংঘিত তাহলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের অনেক কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের এই বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটা স্বীকার করতেই হবে, ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে ৩৯নং অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশিত থাকলেও ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা ৩৯নং অনুচ্ছেদে যে রক্ষাকবচ ছিল, তাতে ছুরি বসিয়েছিলাম। মাত্র ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকি সংবাদপত্রগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমনকি ৪০নং অনুচ্ছেদে যেখানে ‘পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছিল, তাও লংঘিত হয়েছিল। অনেক সংবাদপত্র কর্মীকে বেঁচে থাকার জন্য ভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়েছিল।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে একদলীয় তথা রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে একদলীয় ব্যবস্থা রহিত করা হলেও, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকে। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা আবার সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে এসেছি। আর ১৫ সেপ্টেম্বর (১৯৯১) দ্বাদশ সংশোধনীর ওপর যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সংসদীয় পদ্ধতি অনুমোদিত হয়। এই ফিরে যাওয়াকে আমি বলছি গণতন্ত্রের ‘দ্বিতীয় যাত্রাপথ’। এই ‘দ্বিতীয় যাত্রাপথ’ এ গণতন্ত্রের বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে নির্বাচন হচ্ছে। এক সরকারের বদলে অন্য আরেকটি সরকার আসছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল কথা পরস্পরের প্রতি আস্থা, সেই আস্থা নেই। সংসদ হয়ে পড়ছে একদলীয়। জাতীয় পর্যায়ে অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও সংসদে তা আলোচিত হতে দেখি না। যেখানে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের শ্রদ্ধা জানানোর কথা, সেখানে জাতীয় সংসদে নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করা হয়। সংসদে কালো পতাকা প্রদর্শন কিংবা স্লোগান দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তাই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হয় বটে; কিন্তু শুধু নির্বাচন আয়োজন করার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। নির্বাচনের পাশাপাশি জড়িত মানবাধিকারের প্রশ্নটি। জড়িত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নটি। একটি সমাজে যদি মানবাধিকারের প্রশ্নটি নিশ্চিত করা যায়, যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকে, তাহলে ওই সমাজকে আমরা গণতান্ত্রিক বলতে পারব। যদি সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম ‘সত্যি’ কথা বলতে না পারে, তাহলে সেই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সচেষ্ট রয়েছি বটে, কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন হত্যা কিংবা গুমের সম্মুখীন হন, তখন তা গণতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতদিন হয়ে গেল আমরা আজও জানতে পারলাম না কারা এবং কেন সাগর-রুনী সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করেছিল। সংবাদপত্রের কর্মীরা এই হত্যার বিচারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীরা যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন, তখন গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না। আমরা সেটা চাই বটে, কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীনরা বরাবরই নির্লিপ্ত। সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, একটা ‘ভয়ের আবহ’ তৈরি করে আর যাই হোক সত্যিকারের গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। আমরা চাই সংবাদপত্র লিখুক, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হোক, সরকারর দোষ-ত্র“টি ধরিয়ে দিক, সমাজে সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।
Daily JUGANTOR
91.03.13

দক্ষিণ এশিয়ায় সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা

গত ১০ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রগুলোয় ছাপা হয় একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার পর চতুর্থ স্থানটি দখল করে নেবে ভারত। ওই সময় দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যয় ৬৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। ৫ ফেব্রুয়ারি অন্য এক সংবাদে বলা হয়, ভারত চীনের সীমান্তজুড়ে নতুন একটি পার্বত্য কোর গঠন করবে এবং এ বাহিনী গঠনে খরচ হবে ৬৯ হাজার কোটি রুপি। ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় এ খবর ছাপা হয়েছিল। আর ওই পত্রিকার সূত্র ধরে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও সংবাদটি ছাপা হয়। এর আগে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে যে ৮ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ক্রয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তাও কোনো কোনো মহলে সমালোচিত হয়েছে। অবশ্য ভারতের ৬৯ হাজার কোটি রুপির পাশাপাশি বাংলাদেশের ৮ হাজার কোটি টাকা সমান্যই বলতে হবে। পাকিস্তানও তার অস্ত্র সম্ভার বাড়িয়েছে।
 
ভারতের উৎক্ষেপনকৃত অগ্নি-৫ মিসাইল
  তবে ভারতের এ অস্ত্র ক্রয়ের সিদ্ধান্তটি দেশটিতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রথমত. ভারতে দারিদ্র্য অনেক বেশি। গেল সপ্তাহেই দারিদ্রের একটি করুণ কাহিনী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এক মা তার ১১ বছরের মেয়েকে মুম্বাইয়ের এক পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। মেয়েটি বুদ্ধি করে পুলিশের কাছে যাওয়ায় তা জানাজানি হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত. চীন যখন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিচ্ছে, তখন বিপুল অর্থ ব্যয়ে একটি বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিঃসন্দেহে ভারতের এ সিদ্ধান্ত শুধু চীন-ভারত সীমান্তেই উত্তেজনা ছড়াবে না, বরং তা পাকিস্তান সীমান্তেও উত্তেজনা বাড়াবে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, উপমহাদেশে পাক-ভারত এক ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে। ভারত সাম্প্রতিক সময়ে অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। ভারতের অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর পর পাকিস্তান হাতেফ গজনবি নামক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। অগ্নির মতো হাতেফও পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য। অগ্নির পর ভারত নতুন ক্ষেপণাস্ত্র আকাশ ও পাকিস্তান হাতেফ-৯ নামে আরো দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে দেশ দুটো এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এতে দেশ দুটোর দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি ব্যাহত হতে বাধ্য।
এর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে, বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্রতার মধ্যে রেখে দুই দেশের এ ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি কার বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে? পাঠকদের একটা ধারণা দিয়ে রাখি। একটা দূরপাল্লার (যেমন অগ্নি-৫) মিসাইলের দাম ৫ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫ কোটি টাকা। একটি ব্রুজ মিসাইলের (সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য) দাম ১ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা) আর বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের (যা ভারত এরই মধ্যে অজর্ন করেছে) ৬ লাখ ডলার। এ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় না করে তা হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যেত। এমনকি ভারতে চরম দরিদ্রতম রাজ্য হিসেবে পরিচিত (দারিদ্র্যের কারণে যেখানে মাওবাদীদের তত্পরতা বেশি) মধ্য প্রদেশে, উত্তর প্রদেশ কিংবা ঝাড়খণ্ডে ক্ষুদ্র ঋণদান প্রকল্প চালু করতে পারত। ভারত তা করেনি। মুম্বাইয়ের চাকচিক্যময় ছবি দেখে ভারতের সব মানুষের জীবনযাত্রার মান বিচার করা যাবে না। ভারতে ১ লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আত্মহত্যা করেছে— এ রকম একটি সংবাদ সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পাকিস্তান থেকে এ ধরনের সংবাদ তেমন একটা শোনা যায় না। এ কারণেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছিলেন এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস) অর্জনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ভারতের চেয়ে ভালো।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে যথেষ্ট ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সিপরির (SIPRI) বার্ষিক গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে ৮০ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে। জিডিপিতে প্রতিরক্ষা খাতে প্রবৃদ্ধির হার আড়াই থেকে ৩ শতাংশ। ২০০০ সালের পর প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। এ সময়সীমায় ভারতে যে অস্ত্রসস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তার মধ্যে রাশিয়া একাই সরবরাহ করেছে ৮২ শতাংশ। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ভারত এরই মধ্যে তার নৌবহরে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হতে চায় দেশটি। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চীনের নৌবাহিনীতে যেখানে জাহাজের সংখ্যা ১৩৫, সেখানে ভারতের জাহাজ রয়েছে ১০৩টি। অর্থাৎ প্রায় কাছাকাছি। ভারতের উদ্দেশ্য যে কী, তা সহজেই অনুমেয়। পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন, প্রেসিডেন্ট ওবামার ভারত সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ১১ বিলিয়ন ডলার দামে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ১২৬টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে। যেখানে জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ ন্যূনতম টয়লেট সুবিধা পায় না, ৩১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা কিনা জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত অতিদরিদ্রের মানদণ্ড), সেখানে শত শত কোটি রুপি ভারত ব্যয় করছে অস্ত্র খাতে। এরই মধ্যে প্রমাণ হয়েছে যে, অগ্নি-৫ উেক্ষপণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র চায়, ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম পারমাণবিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হোক। সুদূরপ্রসারী এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করছে। তার টার্গেট মূলত চীন, চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা। এ লক্ষ্যেই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে উঠছে। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে অন্যতম শত্রু বলে মনে করে না। ভারতের অন্যতম শত্রু এখন চীন। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এখানে এক ও অভিন্ন।

সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। গেল বছর বাংলাদেশ ঘুরেও গেছেন সাবেক মার্কিন ফার্স্ব লেডি আর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। হিলারি ক্লিনটনের ঝুড়িতে যে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় যে মার্কিন কৌশল অর্থাৎ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিক বলয়, সে বলয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভারতকে দিয়ে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগ্নি-৫ ও আকাশ উেক্ষপণ এ কৌশলেরই একটি অংশ। ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো কিংবা ভারতকে ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত করার উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে বলতে পারব না, কিন্তু যে দেশ তার দারিদ্র্য দূরীকরণে কোনো বড় কর্মসূচি নিতে পারে না কিংবা কৃষকের আত্মহত্যা রোধ করার উদ্যোগ নিতে পারে না বা অগ্নি-৫ মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবন করে তারা আমাদের জন্য কোনো ‘মডেল’ হতে পারে না। আগামী দিনে ভারতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার প্রবণতা; একটি সভ্য সমাজে যা কল্পনাও করা যায় না। অগ্নি-৫ উেক্ষপণ ছিল একটি প্রহসন। আর পাকিস্তানের পরিস্থিতি যে ভারতের চেয়ে ভালো, তা বলা যাবে না। পাকিস্তান বাহ্যত আরেকটি ‘তালেবানি রাষ্ট্রে’ পরিণত হতে যাচ্ছে। একুশ শতকে এসেও দেশটির কোনো কোনো প্রদেশে মেয়েদের শিক্ষা সীমিত। তালেবান জঙ্গিরা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে— এ রকম সংবাদ আমরা একাধিকবার পাঠ করেছি। পাকিস্তানের মতো দেশে যেখানে তারা জঙ্গি তত্পরতা দমন করতে পারছে না, সেখানে শাহীন (১ হাজার ৮০০ মাইল দূরপাল্লা) কিংবা হাতেফ গজনবির (১৮০ মাইল দূরে আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন) মতো মিসাইল উদ্ভাবন করে পাকিস্তান পারমাণবিক প্রতিযোগিতাকে উসকে দিল। পাকিস্তান বা ভারতের এ থেকে লাভবান হওয়ার কিছু নেই। এতে দুই দেশের দারিদ্র্য আরো বাড়বে। আর লাভবান হবে যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র ব্যবসায় তাদের প্রসার ঘটবে। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে, ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬৬ কোটি ডলার ব্যয়ে ১৪৫টি হালকা কামান আমদানি করছে। একসময় তথাকথিত ‘নিরাপত্তা সুরক্ষা’র নাম করে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সাহায্য করেছিল (বিবিসি, ডিসেম্বর ১৬, ২০১০)। এখানে বলা ভালো, ভারত ও পাকিস্তান এনপিটি চুক্তিতে সই করেনি। পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতের ক্ষেত্রে তার নীতির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। উপমহাদেশে আগামী দিনগুলোয় এ প্রতিযোগিতা বাড়বে বলেই মনে হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় এ পারমাণবিক প্রতিযোগিতায় অন্য দেশগুলোও আক্রান্ত হতে পারে। প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দুই ব্লকে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৮১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৫৪৯ মিলিয়ন (প্রতিদিনের আয় ১ ডলার ২৫ সেন্ট হিসেবে)। ২০০৫ সালে তা দাঁড়ায় ৫৯৫ মিলিয়নে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা ৬৫০ মিলিয়নের কাছাকাছি। পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, ২৫০ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টির শিকার। ৩০ মিলিয়ন শিশু কোনো দিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না। মোট নারী জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের এক ভাগ রক্তশূন্যতায় ভোগে। ভারতে প্রতি তিনজনের একজন দরিদ্র। ১২১ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য টয়লেট সুবিধা নেই। প্রতিদিন ভারতে মারা যায় পাঁচ হাজার শিশু। এ পরিসংখ্যান কোনো আশার কথা বলে না। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে দারিদ্র্য কমেনি। অথচ দুটি বড় দেশ ভারত ও পাকিস্তান আজ কোটি কোটি ডলার খরচ করছে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ভাবনে। দক্ষিণ এশিয়ার এ মুহূর্তে সমস্যা হচ্ছে দারিদ্র্য দূর করা, জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং সেই সঙ্গে জেন্ডার সমতা আনা। ব্যাপক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির ব্যবস্থা করাও জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন।
লেখক: অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com




শাহবাগ আন্দোলনের শেষ কোথায়?


একটা প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহলে প্রকাশ্যেই আলোচিত হচ্ছে। তা হল শাহবাগ গণঅভ্যুত্থানের শেষ কোথায়? নতুন নতুন কর্মসূচি আসছে। তবে মূল দাবি থেকে তরুণরা ফিরে আসেনি। তাদের দাবি এখন দুটি বিষয়ে আবদ্ধ হয়ে গেছে। এক. যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। দুই. জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা। গত ২২ ফেব্র“য়ারি জামায়াত সমর্থিত ইসলামপন্থী দলগুলোর দেশজুড়ে তাণ্ডবের পর শাহবাগ চত্বরের তরুণরা মিরপুরেও গণসমাবেশ করেছে। তারা ঘোষণা করেছে, তাদের অবস্থান কর্মসূচি আগের মতোই চলবে। অন্যদিকে ইসলামপন্থীরা কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে হরতাল পালন করল ২৪ ফেব্র“য়ারি। এটা তো ঠিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনসংখ্যার একটা বড় অংশের মাঝে এক ধরনের ‘ঐক্য’ হয়েছে। এ কথাটা যেমন অস্বীকার করা যাবে না, ঠিক তেমনি এটাও সত্য, এ আন্দোলন থেকে সবচেয়ে বেশি ফায়দা নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

‘অক্যুপাই শাহবাগ’ আন্দোলনের প্লাস-মাইনাস

‘অক্যুপাই শাহবাগ’ আন্দোলন আপাতত: একটি পরিসমাপ্তির দিকে গিয়েছিল। গত ২১ ফেব্র“য়ারি গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় ছয় দফা কর্মসূচি। আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের নেতারা। চব্বিশ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি আর থাকবে না; তবে আন্দোলন চলবে ভিন্ন মাত্রায় এই ছিল সেদিনের সিদ্ধান্ত। কিন্তু গত শুক্রবার বিপক্ষরা ঢাকাসহ সারাদেশে যে কর্মকাণ্ড চালায় এর পরিপ্রেক্ষিতে তরুণরা আবার অবস্থান নেয় শাহবাগে। এই আন্দোলন থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার আছে। এদেশে তরুণ সমাজ যে একটি শক্তি, তা প্রমাণিত হলো। আগামী দিনের রাজনীতিতে এ তরুণ সমাজকে গ্রহণ করে নিতে হবে বড় দলগুলোকে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দাবি করে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তাতে একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই এ ‘সত্যটি’ অস্বীকার করা এখন কঠিন। তবে শুধু যে জামায়াতে ইসলামীর মাঝেই যুদ্ধাপরাধী আছে তা নয়; বরং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির মধ্যেও যুদ্ধাপরাধী আছে এই অভিযোগ নানা মহল থেকে উঠেছে। বর্তমান সমাজে নানা সমস্যা বিরাজমান। বিশেষ করে সব স্তরে দুর্নীতি এখন ‘ওপেনসিক্রেট’।
দুর্নীতিবাজদের বিচার হয় না। ক্ষমতাসীনদের এখন এ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে; না হলে ‘দ্বিতীয় আরেকটি শাহবাগে’র জš§ হওয়া বিচিত্র কোনো বিষয় নয়। নিঃসন্দেহে এই আন্দোলন বিএনপিকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। তবে তাই বলে সরকারের উৎফুল্ল হওয়ারও কোনো কারণ নেই। বরং এখান থেকে সরকার আÍস্থ করার মতো অনেক কিছু নিতে পারে। একই সঙ্গে নানা বিষয়ে তাদের অধিকতর সতর্কতার ব্যাপারটিও আমলে রাখা দরকার।
বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি তথা আগামী রাজনীতির জন্য এ আন্দোলন একটি বড় ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে এ আন্দোলনের নেতা ব্লগার ডা. ইমরানের একটি কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন, এই আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। এখন দেখতে হবে শাহবাগ আন্দোলনকারীরা এ আন্দোলনকে একটি সাংগঠনিক রূপ দেন কি না, কিংবা কীভাবে এ আন্দোলনকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেন। তাদের সঙ্গে সরকারি দলের সম্পর্কও কোন পর্যায়ে যায়, তা-ও দেখার বিষয়।
কেননা ইমরানের অতীত ইতিহাস ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে এ আন্দোলনে তার সহযোদ্ধারা বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং বিভিন্ন বাম সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এই আন্দোলন যদি বেশি মাত্রায় সরকার ঘেঁষা হয়ে যায় ও জনমনে স্পর্শ করে এমন সব বিষয় নিয়ে কোনো বক্তব্য না আসে, তাহলে এ আন্দোলন তার আবেদন হারিয়ে ফেলবে। যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে একটা জনমত সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে আইনও সংশোধন করেছে। ৬০ দিনে চূড়ান্ত বিচার সম্পন্ন হবে। তবে জামায়াতের কর্মকাণ্ড যদি আমাদের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে হোক জামায়াত নিষিদ্ধ। আমরা তাতে স্বস্তি পাই। কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। অতীতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ, জাসদ তথা বাম মনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল।
একসঙ্গে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি এখনও ফেসবুকে আছে। এর যুক্তি যা-ই হোক না কেন, সেদিন আমাদের রাজনীতিবিদদের মাঝে জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধ বড় হয়ে দেখা দেয়নি। আমি ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সৈয়দা ওয়ার্সির সঙ্গে একমতÑগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে যুক্তরাজ্য। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজš§ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে, তাই বিষয়টি সরকার জনমত যাচাই করে দেখতে পারে।  আর যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধও করা হয়, কিন্তু তাদের শত শত কর্মীকে নিষিদ্ধ করা যাবে কী? এরা তখন কোথায় যাবে? তারা তখন বাধ্য হবে আরেকটি দল করতে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পর জামায়াত প্রথমবারের মতো ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ব্যানারে আÍপ্রকাশ করেছিল। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের সঙ্গে ঐক্য করে তারা নির্বাচনও করেছিল। পরবর্তীকালে তারা জামায়াতে ইসলামী নাম নিয়ে আবার রাজনীতি শুরু করে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ‘ঐক্য’ নিয়ে নানা কথা হয়। কিন্তু এই জামায়াতই ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ‘মিত্র’ ভেবে একসঙ্গে নির্বাচন করেছিল। ওই নির্বাচনে জামায়াত পেয়েছিল ১০টি আসন। আর আওয়ামী লীগ ৭৬টি। বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
১৯৯১ সালের নির্বাচনেও জামায়াত বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করেনি। ওই নির্বাচনে জামায়াত ২১২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছিল ১৮টিতে। তবে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হয়েছিল নির্বাচনের পর। তুরস্কে ইসলামপন্থি হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টিকে সেনা নেতৃত্ব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। অথচ দলটির নেতা নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে এবং ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে পরিচিত ট্র–পাথ পার্টির (সাবেক প্রধানমন্ত্রী তানসু সিলারের নেতৃত্বে) সমন্বয়ে নব্বইয়ের শেষের দিকে একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। সেনাবাহিনীর চাপে ১৯৯৭ সালের জুন মাসে এরবাকান পদত্যাগ করেন।
পরে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অতঃপর সংগঠনের কর্মীরা সেখানে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে সংগঠিত হন। দলটি পর পর তিনবার (২০০২, ২০০৭, ২০১২) জনগণের ভোটে ক্ষমতায়। আরো একটি কথা, ইসলামপন্থিরা আর ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা যে একসঙ্গে কাজ করতে পারেন, সরকার গঠন করতে পারেন, আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক রাজনীতি তার বড় প্রমাণ। শুধু তুরস্কের কথা কেন বলি, তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’-এর পর ২০১১ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে বিজয়ী হয়েছিল ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিত এন্নাহদা পার্টি। জয়নুল আবেদিন বিন আলির দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসনামলে এ দলটি সেখানে নিষিদ্ধ ছিল।
দলটির নেতা ঘান্নুচি দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর এন্নাহদা ধর্মনিরপেক্ষবাদী দল কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক ও এত্তাকাতুল পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। একই ঘটনা আমরা দেখেছি মরক্কোতে। সেখানে ২০১২ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে ইসলামপন্থি দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু তারা ধর্মনিরপেক্ষ তথা সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে একটি জোট সরকার গঠন করেছে। সুতরাং দল নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। বাংলাদেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও তারা অন্য ব্যানারে আবির্ভূত হবে। এমন নজির বাংলাদেশে আছে।
এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু হারিয়ে গেছে। আন্দোলনকারী তথা সুুশীল সমাজ এ ইস্যু নিয়ে এখন আর কথা বলেন না। মানুষের কেন্দ্রবিন্দু এখন শাহবাগ। বিএনপি এ আন্দোলনকে আবার চাঙ্গা করতে পারবে কি না কিংবা জনগণকে আবার এই ইস্যুতে একত্রিত করতে পারবে কি না, তা এক কঠিন প্রশ্ন।
যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, ১৮ মার্চের কাউন্সিলের পর তারা আন্দোলনে নামবেন। কিন্তু বিষয়টি যত সহজভাবে বলা হচ্ছে, তত সহজ নয়। শাহবাগ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের লাভ হয়েছে অনেক এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু হারিয়ে গেছে। দুর্নীতির বিষয়গুলো, বিশেষ করে পদ্মা সেতুর বিষয়টি এখন চাপা পড়ে গেছে। দুই. জামায়াতকে চাপের মুখে রেখে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছে। তিন. জামায়াতের নেতৃত্বে একটি বিকল্প ‘ইসলামী জোট’ গঠন, যাতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে, তা হয়তো এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। চার. তরুণ প্রজš§কে বিএনপির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সরকার সক্ষম হয়েছে। পাঁচ, তরুণ প্রজš§ এ আন্দোলন সংগঠিত করলেও এর অন্যতম ‘বেনিফিশিয়ারি’ আওয়ামী লীগ।
শাহবাগ আন্দোলন এখন নতুন দিকে টার্ন নিয়েছে। তারা ২১ ফেব্র“য়ারি গণজাগরণ মঞ্চে ছয় দফা দিয়েছে। শাহবাগে তরুণ প্রজšে§র ডাকে আবার সর্বস্তরের মানুষ জড়ো হয়েছে। তারা চূড়ান্ত সময়সীমা (২৬ মার্চ) নির্ধারণ করে দিয়েছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার। এখন রাজনীতিকে সঠিক পথে চালিত করার দায়িত্ব সরকারের। শাহবাগ আন্দোলন বাংলাদেশের আগামী দিনের আন্দোলনকে আরো প্রভাবিত করবে। শাহবাগ আন্দোলনের বার্তাগুলো খুব স্পষ্ট। আগেই বলেছি এই আন্দোলন সরকারকে অনেক কিছু দিয়েছে কিন্তু এর মর্ম আÍস্থ করতে না পারলে সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা মাঠে মারা যাবে। এখন সরকার কতটুকু সচেতন হবে, তা দেখার বিষয়। তত্ত্বাবধায়ক না হোক, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে কথা বলা ও একটি ‘ডায়ালগ ওপেন’ করা বাঞ্ছনীয়।
মনে রাখতে হবে, এককভাবে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। দাতাগোষ্ঠী সবাই সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন চান। বিএনপিকে অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। আর সেই নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের। শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে আÍতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। ২০১১ সালে নিউইয়র্কে যে ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’-এর জš§ হয়েছিল, আজ সেই আন্দোলনের খবর কেউ জানে না। তিউনিসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ শুধু বেন আলির পতনই ত্বরান্বিত করেনি, বরং ‘আরব বসন্ত’ শুরু করেছিল। আর ‘আরব বসন্ত’ মিসর, ইয়েমেন, লিবিয়ায় পরিবর্তন ডেকে এনেছিল।
কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতন ডেকে এনেছিল। সেই আবেদনও এখন আর নেই। ‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। ক্ষমতাসীনদের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। বাংলাদেশে পার্থক্য এখানেই যে, তারা সরকারের পতন ঘটায়নি; তাদের উদ্দেশ্যও তেমনটি নয়। তবে সরকারকে তারুণ্যের এই স্পিরিটকে বুঝতে হবে। তরুণ সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে (যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ডাক দিয়ে তারা সমাজে পরিবর্তন আনতে চেয়েছে)। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তারা চায়। চায় সুশাসন। জনগণের অধিকার।
শাহবাগের আন্দোলন সব অন্ধকারের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সময়ের তাগিদ অনুভব করে তারুণ্যের আহ্বানে এ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তারুণ্যই এখানে মূল শক্তি। এই তারুণ্য সব দেশে সব সমাজেই বড় শক্তি। এই অধিকার যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে ‘আরেকটি শাহবাগে’র জš§ হওয়া বিচিত্র কোনো বিষয় নয়। আমার বিশ্বাস, সরকার এটা অনুধাবন করতে পারবে এবং সমাজে যে অসংগতি, তা দূর করার উদ্যোগ নেবেন। শাহবাগ আন্দোলন আমাদের চোখ খুলে দিল। বিরোধী দল নয়, বরং সরকারকেই এখন এ আন্দোলন থেকে বেশি শিক্ষা নিতে হবে।
অনেকের অনেক ভুল শুধরে নেয়ার তাগিদটাও শাহবাগ আন্দোলন থেকে এসেছে। ২১ ফেব্র“য়ারি গণজাগরণ মঞ্চে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতি এ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। অভিযোগ উঠতে পারে, ছাত্রলীগের উদ্যোগে(?) এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে এবং এর পেছনে সরকারের ইন্ধন আছে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, কেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওখানে গেলেন। তারা তো আগেই সংহতি জানিয়েছিলেন। কর্মসূচি দেয়ার সময় তাদের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। তরুণ প্রজš§ আগামীতে এসব ব্যাপারে যদি সতর্ক থাকে, তাহলে ভালো। সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনকে দলনিরপেক্ষ আন্দোলন হিসেবেই দেখাতে চাচ্ছে। সুতরাং আন্দোলনের সংগঠকরা যদি এটা বোঝেন, তাহলেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন হবে, জাতিরও মঙ্গল হবে। বারবার এমন গণসাধারণ ঘটে না।
Daily Manobkontho
26.2.13

যেতে হবে অনেক দূর


শাহবাগ আন্দোলন এখন কোন পথে? গত ২১ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের টানা ১৭ দিনের অবস্থান কর্মসূচি পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও গত শুক্রবার জামায়াত সমর্থিত ইসলামী দলগুলোর তাণ্ডবের পর শাহবাগ চত্বরে আবার ফিরে এসেছে আন্দোলনকারীরা। রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, এ দেশের তরুণ প্রজন্মের বড় বিজয় অর্জিত হয়েছে। ৬ দফা তারা দিয়েছে বটে, কিন্তু এখন যেতে হবে অনেক দূর। যে প্রত্যাশা তরুণরা সৃষ্টি করেছে, সে প্রত্যাশা ধরে রাখতে হবে। ইতিহাসের কি পুনরাবৃত্তি হয়? আমরা বলি হয় না। নিউইয়র্কের \'অকুপাই মুভমেন্ট\' আর দ্বিতীয়বার সংঘটিত করা যাবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয় আরেকটি \'তাহরির স্কয়ার\' আর সৃষ্টি হয়নি কায়রোতে। অথচ কায়রোতে এখনও অসন্তোষ আছে। অসন্তোষ আছে নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে। অসমতা, বৈষম্য সেখানে দূর হয়নি। একজন ওবামার পক্ষে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। কিংবা একজন মুরসি ধীরে ধীরে মিসরকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন, যা তাহরির স্কয়ারে যারা জমায়েত হয়েছিলেন, তারা চেয়েছিলেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। দীর্ঘ ৩০ বছর পর ফুঁসে উঠেছিল তাহরির স্কয়ার। সমসাময়িক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ ধরনের \'অকুপাই মুভমেন্ট\' কেউ কখনও দেখেনি। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লব ক্ষমতাচ্যুত করেছিল দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলিকে। মাত্র দুই বছরের মাথায় সেই প্রত্যাশায় এখন চিড় ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী হামাদি জেবালি পদত্যাগ করেছেন। \'জেসমিন বিপ্লব\' প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ইয়েমেনে কারমান গৃহবধূ, সাংবাদিক আর ছাত্রদের সংগঠিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সানা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করে বাধ্য করেছিলেন আবদুল্লাহ সালেহকে দেশ ত্যাগ করতে। একজন তাওয়াকুল কারমান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু ইয়েমেনে অস্থিরতা রয়ে গেছে। সেখানেও পূরণ হয়নি মানুষের প্রত্যাশা।
\'অকুপাই শাহবাগ\' আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয়েছে, এটা বলা যাবে না। একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে একটি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। রাজীবসহ এই আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, সাতদিনের মধ্যে তাদের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে হবে। জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের উৎস অনুসন্ধান করতে হবে ইত্যাদি।
এসব দাবি-দাওয়ার মধ্যে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত দাবি কী আছে? আমি খুশি হতাম যদি তরুণ প্রজন্ম বলত সমাজে অসমতা দূর করার কথা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করার কথা। যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, গুম, বাল্যবিয়ে, ছাত্রলীগের তাণ্ডব_ এসব কথা একবারও উচ্চারিত হলো না। হয়তো \'এক বাক্সে সব ডিম এক সাথে\' রাখতে চায়নি তারা। শুধু একটি দাবিকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছে_ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। তবে তাদের বিজয় তো হয়েছেই। আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে এবং চূড়ান্ত বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন আপিল বিভাগের ওপর আস্থাটা রাখতে হবে।
এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে। \'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে\'র কথা বলেছে তরুণ প্রজন্ম। আসলেই তো এটা \'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ\'! এই গণজাগরণ আগে কেউ কখনও দেখেনি। মানুষ শাহবাগে গেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। শাহবাগ হয়ে উঠেছে একটি জুকোটি পার্ক, একটি তাহরির স্কয়ার। সাধারণ মানুষের এই যে \'উত্থান\' এটাকে \'বিপ্লব\' হিসেবে আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেননি সমাজবিজ্ঞানীরা। যুগে যুগে সাধারণ মানুষ এভাবেই প্রতিবাদী হয়েছে। তবে ধরন পাল্টেছে। আজ সামাজিক নেটওয়ার্ক \'বিপ্লবে\'র অন্যতম হাতিয়ার। আজ তরুণরা \'বিপ্লবে\'র অন্যতম পথপ্রদর্শক। নোয়াম চমস্কি তার সর্বশেষ গ্রন্থ ঙপপঁঢ়ু-এ এই গণঅবস্থানকে সমর্থন করেছেন। এটা বিপ্লবের একটা ধরন। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৮১৫) সংগঠিত করেছিল কৃষকরা, রুটির দাবিতে দোকান আক্রমণ করেছিল। ফরাসি সমাজে বৈষম্য ছিল। রাজা ছিলেন স্বৈরাচারী। সাধারণ মানুষ ছিল অবহেলিত, নিষ্পেষিত, শোষিত। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই জনতা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সে জন্ম দিয়েছিল আইনের শাসন ও একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে রাশিয়ার বিপ্লবের (১৯১৭) কোনো মিল হয়তো নেই। রাশিয়ার বিপ্লবের পর সেখানে সমাজতন্ত্রনির্ভর একটি সমাজব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল, যে সমাজব্যবস্থা বিংশ শতাব্দীর অনেক দেশ গ্রহণ করেছিল। তবে এই দুই \'বিপ্লবের\' সঙ্গে মিল আছে এক জায়গায়_ অসমতা, দারিদ্র্য আর বৈষম্য। আজ নিউইয়র্কের অকুপাই মুভমেন্টেও শুনি, এই অসমতা আর দারিদ্র্যের কথা। তাহরির স্কয়ারের গণজোয়ার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও তরুণ সমাজের বেকারত্ব আর দারিদ্র্য এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল। আজ শাহবাগ আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধীদের চরম বিচারের দাবি শুনি বটে, কিন্তু অনেক বেকার তরুণের ক্ষোভও মিলিত হয়েছে এই শাহবাগে।
আইন তার পথে চলুক। সুলতানা কামাল একটি কথা বলেছেন গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। তিনি বলেছিলেন, \'বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে রায় আদায় করা ঠিক নয়\'। তাই আইন তার পথে চলুক। একটি আলটিমেটাম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। এখন সরকারকে কাজ করতে দেওয়াই ভালো। তবে \'নষ্ট\' এই সমাজকে সঠিক পথে চলতে এ তরুণ প্রজন্ম একটি \'ওয়াচ ডগ\' হিসেবে কাজ করতে পারে। দুর্নীতি আজ আমাদের বড় সমস্যা। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি আজ \'অক্টোপাসের থাবায়\' আক্রান্ত। দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। \'সিডর\' ও \'আইলা\' আক্রান্ত অঞ্চলে মানুষ অসহনীয় দিনযাপন করছে। সুপেয় পানি নেই। শিশুদের স্কুল নেই। সমাজে বৈষম্য আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক তরুণ প্রজন্ম। ২১ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে ব্লগার আর অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের আহ্বায়ক যখন ছয় দফা দাবি পাঠ করেন, তখন এ দেশের লাখ লাখ দর্শক টিভির পর্দায় দেখেছে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি সফল \'বিপ্লবের\' পর পরই প্রতিবিপ্লবীরা তৎপর হয়। ফরাসি বিপ্লবের পর জ্যাকোবিনরা বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিল। রাশিয়াতেও বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবীরা তৎপর ছিল। শাহবাগ গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের সমকালীন ঘটনাবলিতে একটি স্থান করে নিয়েছে। এখন আর ফেরার পথ নেই। যেতে হবে অনেক দূর। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি থাকুক। আইন তার নিজ পথে চলুক। শাহবাগ যে \'শক্তির\' জন্ম দিয়েছে, সেই \'শক্তি\' সমাজের সব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, সব রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করুক। আমার বিশ্বাস, ইতিহাসে তারা নাম লেখাবেন। একাত্তরের প্রজন্ম যেমনি ইতিহাসে আছে স্বর্ণাক্ষরে, ঠিক তেমনি এই প্রজন্মও ইতিহাসে থেকে যাবে অনুপ্রেরণার এক উৎস হয়ে।
Daily Samakal
24.2.13

শাহবাগ চত্বরে গণমানুষের কথা নেই

 
 তরুণদের আবেগকে আমি সমর্থন করি। ওরাই পারে সমাজটা বদলে দিতে। অনেক আগে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার’। যৌবনের এই তাগিদ হাজার হাজার তরুণকে শাহবাগে নিয়ে এসেছে। সেখানে স্লোগানের ভাষায় গণমানুষের কোনো কথা নেই। তরুণরা প্রতিবাদী হবে, এটা আমরা চাই। কিন্তু তাদের মুখে দুর্নীতি, শেয়ারবাজার, পদ্মাসেতু, হলমার্ক, ডেসটিনির দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান নেই কেন? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতিতে প্রতিক্রিয়া নেই কেন? সারা দেশ ও জাতি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন চায়। একবারও আমি শুনলাম না নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি। তাহলে কী আমরা ধরে নেব সাধারণ মানুষের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমাদের শাহবাগে জড়ো হওয়া তরুণ সমাজকে স্পর্শ করেনি? কেন করেনি? অতীতে তো আমরা দেখেছি বামমনা ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ মানুষের পক্ষে স্লোগান দিতো। কিছুদিন আগে বামমনা সংগঠনগুলো ঢাকায় হরতালের ডাক দিয়েছিল (যদিও বলা হয় সেটি ছিল ‘সরকারের হরতাল’)। সেখানে কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতির প্রশ্নটিও ছিল। তাহলে বামমনা সংগঠনগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলো, যারা শাহবাগে জমায়েত হয়েছিল, তাদের মুখে এই স্লোগান নেই কেন? শেয়ারবাজার থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ‘লুট’ করে নিয়ে যাওয়া হলো। সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল (ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে), সেখানেও অনিয়ম ও আর্থিক লুটপাটের তথ্য প্রমাণিত হলো। কমিটি কিছু ব্যক্তিকে চিহ্নিতও করেছিল। সুশীল সমাজ তাদের গ্রেফতার ও লুটপাটকৃত টাকা ফেরত আনার দাবি করে আসছে। আজ কেন শাহবাগে এ দাবি উচ্চারিত হলো না? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ আজ অসহায়। নতুন ভিত্তি বছর (২০০৫-০৬) অনুযায়ী ডিসেম্বরে (২০১২) মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। অথচ নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বর (২০১২) মাসে চাল, আটা, ডাল, মাছ-মাংস, মসলা, দুধ ও তেলের দাম বেড়েছে। ওই সময় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ৩৫ শতাংশ। একই সঙ্গে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়েছে দশমিক ৩৮ শতাংশ। আমরা জানুয়ারির (২০১৩) পরিসংখ্যান যদি নেই, তাহলে দেখবো, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। এই মূল্যস্ফীতি কী আমাদের তরুণদের স্পর্শ করে না? শাহবাগের তরুণ নেচেগেয়ে উৎসব করে, শাহবাগ চত্বরে ঘুমিয়ে দিন কাটাল। কিন্তু জানল না তাদের বাবারা কী কষ্ট করে সংসার চালান? জিজ্ঞেস করল না বাবাকে, সীমিত আয়ে বাবা কীভাবে সংসার চালান? নিউইয়র্কে ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’ হয়েছিল অসমতা, বৈষম্য ও দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে। মার্কিন সমাজে শ্রেণীতে শ্রেণীতে ব্যবধান বাড়ছে। একটি ধনিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যাদের কাছে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব ছিল ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’। কায়রোতে তাহরির স্কোয়ারে আন্দোলন হয়েছিল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৮১ সাল থেকেই ক্ষমতায় ছিলেন হোসনি মোবারক। গণতন্ত্র চর্চা সেখানে ছিল না। তরুণ প্রজন্ম সেখানে বিক্ষোভকে সংগঠিত করেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। আজ দেখলাম ভিন্ন চিত্র। সরকারই মদদ দিচ্ছে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ধর্মঘট করতে! তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ‘সিসি ক্যামেরা’ বসিয়েছে। ভাল, সন্দেহ নেই।
পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিক আসরে অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়। কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। ট্রিআই’র রিপোর্টেও আছে এই দুর্নীতির খবর। কিন্তু শাহবাগে দুর্নীতির কোনো স্লোগান নেই। পদ্মা সেতু আর আবুল হোসেন পরস্পর সম্পর্কিত। কিন্তু কোনো স্লোগান নেই। কেন নেই? শুভঙ্করের ফাঁকিটি এখানেই। গণমানুষের দাবি ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করার। এই দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল। বেগম জিয়া এই অসুস্থ শরীর নিয়ে রোড মার্চ করেছেন একাধিক। ঢাকায় সর্বকালের বৃহৎ গণজমায়েত করেছে বিএনপি। বিএনপি যখন ধীরে ধীরে এই আন্দোলনকে একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি করা হলো এই  গণআন্দোলন। এখানে আবেগ আছে। কিন্তু বাস্তবতার কোনো মিল নেই। আদালতে একটি রায় হয়েছে। এই রায় নিয়ে কেউ খুশি হতে পারেন। কেউ অখুশি হতে পারেন। কিন্তু রায় বাতিল করা ও প্রকাশ্যে ফাঁসি দাবি করা, এসব কর্মকাণ্ড কী ‘আদালত অবমাননার’ পর্যায়ে পড়ে না? আদালত কী কারো দাবিতে চলে? আদালত বিচার করেন আইন, সাক্ষী-সাবুদ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে। আদালত তো অন্ধ। আদালতকে তো ‘হুকুম’ দেয়া যায় না? এতে করে কী আইনের শাসনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় না? তরুণদের আবেগ থাকতে পারে। আবেগ দিয়ে বিচার হয় না।
 আমি চাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয়মূল্য আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকবে। আমি চাই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত ছিল, তার বিচার। যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, তাদের দাঁড় করানো হোক আসামির কাঠগড়ায়। যারা শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনির অর্থ পাচারের সাথে জড়িত, তাদের বিচার। আমি বিশ্বাস করি তরুণ প্রজন্ম যদি এসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে সাধারণ মানুষ তাদের পাশে থাকবে।  এ দেশের তরুণদের একটি ‘ঐতিহ্য’ রয়েছে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন, কিংবা পরবর্তীতে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সম্প্রদায়ের অবদান ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।   


বদলে যাওয়ার দিন


সেই কবে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, 'এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।' তারপর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি বয়ে গেছে। সরকার এসেছে। গেছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই। ভাষার মাসে সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে দেখল এক ভিন্ন বাংলাদেশকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সারা জাতিকে একত্র করেছিল। গুটিকয়েক স্বাধীনতাবিরোধী বাদে সারা জাতি এক পতাকাতলে একত্র হয়েছিল- স্বাধীনতা। আজ ৪২ বছর পর বিশ্ব দেখছে এক 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ'। দিনের পর দিন শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান করে তারা যে ইতিহাস রচনা করল, সেই ইতিহাসকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তরুণ প্রজন্ম আজ একটি ইস্যুতে সমাবেত হয়েছে- একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। দলমত-নির্বিশেষে সবাই তরুণদের এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে। কিছুটা দেরিতে হলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এই দাবিকে অস্বীকার করতে পারেনি।
বিশ্বজুড়েই তরুণদের জয়-জয়কার। নিউ ইয়র্কের জুকোট্টি পার্ক থেকে শুরু করে ঢাকার শাহবাগ। মিলটা এক জায়গায়- তরুণরা প্রতিবাদী হয়েছে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে তারা চ্যালেঞ্জ করেছে। আর তাদের আন্দোলনের পাশে তারা পেয়েছে সাধারণ মানুষকে। জুকোট্টি পার্কে জন্ম হওয়া 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'-এ যেমনি সাধারণ মানুষ সমবেত হয়েছিল, ঠিক তেমনি তাহরির স্কয়ারেও আমরা দেখেছি সেসব মুখ, যারা সুবিধাবঞ্চিত। রাষ্ট্র যাদের জন্য কিছু করেনি। সেই একই ছবি আমরা দেখেছি নয়াদিল্লিতে, যখন 'দামিনীর' ধর্ষণ ও মৃত্যুর পর প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিবাদী হতে পারেনি, সেদিন প্রতিবাদী হয়েছিল তরুণরা। আর সাধারণ মানুষ সেই প্রতিবাদে শরিক হয়ে রচনা করেছিল এক ইতিহাস। আজ প্রজন্ম চত্বরে যা ঘটল, তার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী চলা 'অক্যুপাই মুভমেন্টের' কোনো পার্থক্য নেই।
এই তরুণরাই পারে সব কিছু বদলে দিতে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার ফিরে এসেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্পিরিট। ফিরে এসেছে ছেষট্টি, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন আর একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন। যে তরুণ একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে গিয়েছিল, এ প্রজন্মের 'সেই তরুণ' আবার ফিরে এসেছে শাহবাগে, যা এখন প্রজন্ম চত্বর। আমাদের সনাতন রাজনীতিবিদদের দেখিয়ে দিল, এই 'নষ্ট' সমাজের সুবিধাভোগী মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন এই তরুণরা সারা রাত জেগে প্রতিবাদের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। লাকি আক্তারের এক-একটি স্লোগান যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার বড় প্রমাণ ওই প্রজন্ম চত্বর। লাকির সেই স্লোগান ছুঁয়ে গেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে। ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া লাকিরা একুশ শতকের তোফায়েল আর মেনন। আগামীর ইতিহাস ওদের কিভাবে চিহ্নিত করবে, আমি জানি না। তবে এ দেশের অনেক কষ্টে থাকা মানুষের প্রত্যাশা ওদের কাছে অনেক বেশি। প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা কবি জলিল চৌধুরীর কবিতার উদ্ধৃতি উল্লেখ করে লিখেছেন, 'ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি। এখানে থেমো না।' লাকিরা কী থামবে এখানে? আমি জানি না। 'শাহবাগ অক্যুপাই মুভমেন্টের শেষই বা কোথায়?
প্রতিটি আন্দোলনেরই একটি সমাপ্তি থাকে। নিউ ইয়র্কের অক্যুপাই মুভমেন্টের সেই আবেদন এখন আর নেই। 'দ্বিতীয় আরেকটি তাহরির স্কয়ার আর জন্ম হবে না মিসরে। তাই শাহবাগ অক্যুপাই মুভমেন্টেরও সমাপ্তি প্রয়োজন। এই প্রজন্মের তরুণদের আন্দোলনের প্রাপ্তি একেবারে কম নয়।
এক. সোশ্যাল মিডিয়া যে কত বড় একটি শক্তি, বাংলাদেশের তরুণসমাজ তা আবার প্রমাণ করল। এই সোশ্যাল মিডিয়াকে এখন সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব। একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া একটি 'ওয়াচ ডগ' হিসেবেও কাজ করতে পারে। সমাজে নানা অনিয়ম, অসমতা, দরিদ্রতা, দুর্নীতি, ধর্ষণ, শিশু অধিকার, গুম, হত্যাকাণ্ড নানা কারণে সমাজটা নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে 'কমিটমেন্ট'-এর বড় অভাব। দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। তরুণরা প্রতিবাদী হোক এসব ঘটনায়। শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি প্রভৃতি নানা ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে। এই তরুণরাই পারে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে।
দুই. বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বাংলাদেশকে একটি 'সফ্ট পাওয়ার'-এর মর্যাদা দিয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্ব ঢাকায় এ কথা বলে গেছেন। তারুণ্যের এই শক্তি যদি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা নেয়, যদি দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিজেদের নিয়োজিত করে, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশকে বিশ্ব গণ্য করতে বাধ্য।
তিন. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে একটি 'প্রতীক', যা আমাদের রাজনীতিবিদদের একটা মেসেজ দিয়ে গেল। কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি এটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনি এটাও সত্য, ক্ষমতাসীন সরকার তথা সরকার সমর্থক ১৪ দলের নেতাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের ছাত্র নেতাদের মধ্যে বক্তৃতা দেওয়া, সারাক্ষণ উপস্থিত থাকা ও আন্দোলন তদারকি করা কোনো কোনো মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তরুণ নেতৃত্বকে আজ এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
চার. আমাদের তরুণ সমাজ এখন 'সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে' প্রতিবাদের একটি প্লাটফর্ম গড়ার উদ্যোগ নিতে পারে। তারা যদি তাদের আন্দোলনে বিরোধী দলকে সংযুক্ত করতে পারে, সেটা হবে তাদের জন্য বড় পাওয়া। জাতীয় 'ঐক্য' প্রতিষ্ঠার একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে তারা। এ মুহূর্তে এটাই চাওয়া। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি দাবি। পর্যায়ক্রমে অন্য দাবিগুলোও সামনে নিয়ে আসতে হবে। 'পচা সমাজ'কে বিশুদ্ধ করার সময় এখনই।
পাঁচ. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু শুধু এক দাবিতে তরুণরা যদি অনড় থাকে এবং আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে আন্দোলনকারীরা বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করছে কি না! এই প্রশ্ন সম্প্রতি তুলেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে রায় আদায় করা ঠিক নয়। তার এই বক্তব্যের মেরিট আছে। অনেক সিনিয়র আইনজীবীর অভিমতও অনেকটা তাই। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা যায় না। স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি রায় হয়েছে। এই রায়ে সংযুক্ত হয়েছে অনেকেই। চরম শাস্তি হয়নি। তাই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইন সংসদে পাস হয়েছে। এখন হয়তো সরকার আপিল করবে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা শুনবেন। উচ্চ আদালতকে কিছুটা সময় তো দিতে হবে। এখন যদি আদালতকে চাপ প্রয়োগ করার আন্দোলন অব্যাহত থাকে, তাহলে সুলতানা কামালের মতো অনেকেই বলতে শুরু করবেন বিচার বিভাগে প্রভাব খাটানো ঠিক নয়। সুলতানা কামাল কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোক ও সরকারের খুব কাছের মানুষ। সুতরাং তার অভিমতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ছয়. শাহবাগ অক্যুপাই মুভমেন্টের ফসল লাকি আক্তার সর্বত্র রাজাকারবিরোধী ব্রিগেড গঠন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটাও ঠিক নয়। এ আহ্বান আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার শামিল এবং রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজে প্রতিপক্ষকে 'রাজাকার' হিসেবে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা দেখা যাবে। এটা হবে আইনের শাসনের অন্তরায়। প্রচলিত আইনেই রাজাকারদের বিচার হোক। ব্রিগেড গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই।
সাত. প্রতিবাদী তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সংগঠনের জন্ম দিতে পারে। তবে দলনিরপেক্ষদের নেতৃত্বে স্থান দেওয়াই মঙ্গল। কেননা ব্লগারদের কারো কারো বিরুদ্ধে সরকারি ছাত্র তথা যুব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং নিরপেক্ষতার স্বার্থেই এদের কোনো পর্যায়ে স্থান না দেওয়াই মঙ্গল।
আট. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ন্যায়সংগত। এটা তরুণ প্রজন্ম আবার প্রমাণ করল। তারা যদি একটা 'ঐক্য' প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমাদের রাজনীতিবিদরা পারবেন না কেন? এই আন্দোলন দেখিয়ে দিল জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যের প্রয়োজন অনেক জরুরি।
নোয়াম চমস্কি তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ Occupy-এ বিশ্বব্যাপী যে 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' পরিচালিত হচ্ছে, সে ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। তিনি এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। সেখানে চমস্কি বলেছেন, 'More Human Course-এর কথা। শাহবাগ 'অক্যুপাই মুভমেন্ট' সমাজকে একটা বড় ধাক্কা দিল। এ ধরনের 'মুভমেন্ট' সমাজে বারবার জন্ম হয় না। দশকে একবারই হয়। বাংলাদেশের অতীত এর বড় প্রমাণ। তাই শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম এই আন্দোলনকে যদি আগামীতে More Human Course-এর আলোকে পরিচালিত করতে পারে, তাদের সাফল্য সেখানেই নিহিত।Daily Kalerkontho20.2.13

‘অক্যুপাই শাহবাগ’ যে আবেদন সৃষ্টি করেছে


গত শুক্রবার ১৫ ফেব্র“য়ারি প্রজন্ম চত্বরে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য এ আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে, তা বোঝা। প্রচুর মানুষ। একদিকে বইমেলা, অন্যদিকে প্রজন্ম চত্বরের স্লোগান। সাধারণ মানুষ হয়ে প্রজন্ম চত্বরে আগেও গেছি সংহতি জানাতে, গত শুক্রবারও গেলাম। সেই মুখ, সেই স্লোগান। আদিবাসী ছাত্ররাও এসেছে। তারাও স্লোগান দিচ্ছে তাদের ভাষায়। আর সে স্লোগানে সুর মিলিয়েছে বাঙালিরা। এ এক মহামিলন মেলা। এ মেলা দেখেনি কেউ কোনো দিন। কিন্তু এর শেষ কোথায়? শুক্রবার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল সমাবেশ সাত ঘণ্টার মাঝে সীমিত রাখার। কিন্তু রাতে এক ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনের (থাবা বাবা) মৃত্যু বদলে দিল আগের সিদ্ধান্তকে। সমাবেশ চলবে লাগা চব্বিশ ঘণ্টা। তারুণ্যের এ ‘প্রতিবাদ’-এর সঙ্গে দ্বিমত করার যেমন কোনো সুযোগ নেই, ঠিক তেমনি অনির্দিষ্টকালের জন্য এ সমাবেশ চলতে পারে না, কারো কারো এ কথাটাও আজ অস্বীকার করা যাবে না। এ আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতির এক মাইলস্টোন। তরুণ সমাজ যে একটি শক্তি, তা রাজনৈতিক নেতারা এখন উপলব্ধি করবেন। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বের সারিতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে সরকার আরো সতর্ক হবে এবং ইতিমধ্যেই আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা এ আন্দোলন থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে চাইবে এবং তারা নিয়েছেও। সরকারের অবস্থান এ মুহূর্তে তাদের অনুকূলে রয়েছে, এটা ভেবে তারা যদি আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তাহলে তারাও ভুল করবে। এ গণঅসন্তোষ এক সময় সরকারের বিরুদ্ধেও চলে যেতে (?) পারে। ইস্যু তো অনেক রয়েছেই। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সাংবাদিক দম্পত্তি রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি নানা ইস্যুতে মাঠ আবার ‘গরম’ হয়ে যেতে পারে। সরকার যদি এসব বিষয়েও দৃষ্টি দেয় ভালো করবে। বিএনপির ‘প্রায় নীরবতা’ বিএনপির ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিতে পারে। নিঃসন্দেহে বিএনপি একটি ‘ডায়নামা’ ফেস করছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং লাখ লাখ লোকের ‘সেন্টিমেন্ট’, অন্যদিকে শরিক দল জামায়াতকে সমর্থন। কাদের মোল্লার ফাঁসির ব্যাপারে বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এর একটা ভালো দিক আছে। বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। এমনিতেই বিএনপির সিনিয়র নেতারা নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমার মাঝে আছেন। আবার কোনো মন্তব্য করে আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যেতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু এখন চাপা পড়ে যেতে পারে। মানুষের দৃষ্টি এখন আদালতের দিকে, চূড়ান্ত রায়ের দিকে। আগামীতে আরো অন্তত দুটি রায় আসছে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এখন  সেদিকেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি এ মুহূর্তে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের’ ইস্যুতে হারিয়ে যেতে পারে। শাহবাগ চত্বরের ‘অক্যুপাই আন্দোলন’ জামায়াতকে বিএনপির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। জামায়াত ১৮ দল ছেড়ে গেলে (?) অবাক হব না। যদিও জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তারা ঐক্য ধরে রাখবেন এবং সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো ‘সমঝোতা’ হয়নি। প্রথম কথা, জামায়াত কর্মীরা চলমান আন্দোলনে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে না পেয়ে এক ধরনের হতাশা ও বিভ্রান্তিতে ভুগতে পারেন। দ্বিতীয় কথা, ‘সমঝোতা’ হয়নি বলে দাবি করলেও কেউ কেউ মনে করেন ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ‘সমঝোতা’ (?) হয়েছে। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে।
‘অক্যুপাই শাহবাগ’ কতদিন চলবে এ মুহূর্তে তা স্পষ্ট নয়। ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনেরও আর কোনো আবেদন নেই। তাহরির স্কয়ার একটা ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করলেও আবার তাহরির স্কয়ার আগের মতো ফুঁসে উঠবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
‘অক্যুপাই শাহবাগ’ একটি আবেদন সৃষ্টি করেছে। তাদের সে দাবি ছুঁয়ে গেছে দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষকে। তাদের বিজয় তো হয়েছেই। এখন এর একটা পরিসমাপ্তি টানা প্রয়োজন। গত ক’দিনে ঢাকা শহরে গণদুর্ভোগ বেড়েছে। এক ঘণ্টার জায়গা যেতে হচ্ছে তিন ঘণ্টায়। আন্দোলনকারীরাও তা স্বীকার করেছেন। প্রথম দিকে মানুষ এ গণদুর্ভোগকে গুরুত্ব দেয়নি। বৃহত্তম স্বার্থে তারা এটা মেনে নিয়েছেন। এখন দু’একজন দুর্ভোগের কথা বলছেন। শুক্রবার গণজাগরণ সভা হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সবাই সেখানে ছিলেন, বক্তৃতা করেছেন। সেখানেও আমি দু’একটি কথা শুনেছি; হাল্কা একটি বিভেদের প্রতিধ্বনিও শুনেছি। কেউ কেউ বলছেন, ব্লগার আর ছাত্র ইউনিয়ন চাচ্ছে আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করতে। আর সরকারের সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র মৈত্রীর সমর্থকরা চাচ্ছেন আপাতত পরিসমাপ্তি টানতে। কেননা যে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে, এটাকেই তারা বিজয় হিসেবে মনে করছে। আরো একটা কথা। আইন ও সালিশ কেন্দে র নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল গত ১৪ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে রায় আদায় করা ঠিক নয়।’ সুলতানা কামাল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তিনি যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তা গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। প্রজন্ম চত্বরের যে আন্দোলন এখানে আবেগ আছে, কিন্তু বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে। আদালতে একটি রায় হয়েছে। এ রায় নিয়ে কেউ খুশি হতে পারেন, কেউ অখুশি হতে পারেন। আদালত বিচার করেন আইন, সাক্ষী-সাবুদ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে। আদালতকে ‘হুকুম’ দেয়া যায় না। আবেগ দিয়ে বিচার হয় না। আমি বিশ্বাস করি, তরুণদের এ দাবি এখন গণদাবি। কিন্তু তরুণদের এ আন্দোলনের সুফল কেউ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবে, আমরা তা চাই না।
গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো আন্দোলনই চূড়ান্ত বিচারে স্থায়ী হয় না। আমরা একইসঙ্গে চাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকবে। চাই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তার বিচার। যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, তাদের দাঁড় করানো হোক আসামির কাঠগড়ায়। যারা শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনির অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার। আমি বিশ্বাস করি, তরুণ প্রজন্ম যদি এসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে সাধারণ মানুষ তাদের পাশে থাকবে। এদেশের তরুণদের একটি ‘ঐতিহ্য’ রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা পরবর্তীকালে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তরুণ সম্প্রদায়ের অবদান ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসবের সঙ্গে তরুণ সমাজ একটি নতুন ইতিহাস রচনা করল। ‘অক্যুপাই শাহবাগ’ আজ আন্তর্জাতিক মিডিয়া। বিশ্বের বড় বড় সংবাদপত্রে আজ অক্যুপাই শাহবাগের নাম। এ নাম যুক্ত হলো ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের’ সঙ্গে। যুক্ত হলো তাহরির স্কয়ারের সঙ্গে। এ আন্দোলন সৃষ্টি করল ‘বাংলা বসন্ত’-এর। মূল দাবি অবশ্যই থাকবে। তবে মনে রাখতে হবে আমরা আদালতকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারি না। সরকারের একটি উদ্যোগও লক্ষণীয়। সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করে আইন পরিবর্তন হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে আপিল বিভাগের হাতে। তবে এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি সব অনাচারের, দুর্নীতির বিচার হয়, এ আন্দোলনের সাফল্য সেখানেই নিহিত।
Daily Manobkontho
18.2.13

যেন এক টুকরো তাহরির স্কয়ার



কায়রোর তাহরির স্কয়ারের নাম জানে না, এমন লোক বাংলাদেশে আমার ধারণা খুব কমই আছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজš§, যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের কাছে তাহরির স্কয়ার বিস্ময়ের একটি ‘সিম্বল’। ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারি মাস। উত্তাল তাহরির স্কয়ার। হাজার হাজার মানুষ। বেশির ভাগই তরুণ। তাদের দাবি হোসনি মোবারকের পদত্যাগের, যিনি ১৯৮১ সাল থেকে তখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছেন। আরও থাকতে চান। ২০০৬ সালে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, তিনি আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকবেন। থাকছিলেনও। বড় ধরনের কোন আন্দোলনও হয়নি মিসরে। কিন্তু ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে (২০১০) তিউনিশিয়ার একটা ছোট্ট শহর সিদি বওজিদ বদলে দিল পুরো দৃশ্যপট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েও বেকারত্ব বাধ্য করেছিল মোহাম্মদ বওয়াজিজিকে ফল বিক্রি করতে। কিন্তু তাও সহ্য হচ্ছিল না পুলিশের। গায়ে আগুন দিয়ে আÍহত্যা করে বওয়াজিজি প্রতিবাদ করে গেলেন। তার এই প্রতিবাদ আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে গেল এক শহর থেকে অন্য শহরে। জš§ হল জেসমিন বিপ্লবের। ১৪ জানুয়ারি (২০১১) পালিয়ে জীবন বাঁচালেন তিউনিশিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলী।
কিন্তু জেসমিন বিপ্লব থেমে থাকল না তিউনিশিয়ায়। বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে গেল ইয়েমেনে, মিসরে। মিসর তখন উত্তপ্ত। তৈরি হচ্ছিল ‘বিপ্লবে’র জন্য। তাহরির স্কয়ার পরিণত হল জনতার সমুদ্রে। দীর্ঘ ১৭ দিন অবস্থান করে মিসরের তরুণ প্রজš§ প্রমাণ করল তারাও পারে। আজ শাহবাগের ‘প্রজš§ চত্বরে’ আমি যখন গণজোয়ারের ধ্বনি শুনতে পাই, আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়Ñ ওরাও পারে। হ্যাঁ, মিসরে আহমেদ মাহের ইব্রাহিম আর আসমা মাহফুজরা পেরেছিলেন। হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন মিসরে। এবার আমাদের লাকীদের পালা।
তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন সংঘটিত করেছিল তরুণরা। মিসরে সনাতন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছিলেন ব্যর্থ। তবে কট্টর ইসলামপন্থী ব্রাদারহুডের তরুণ প্রজš§ এ আন্দোলনে জড়িত ছিল, নেতৃত্বে ছিল না। মোবারকের স্বৈরশাসনে সনাতন রাজনৈতিক দলগুলো যখন ছিল ব্যর্থ, ঠিক তখনই ২৯ বছরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ মাহের ইব্রাহিম ফেসবুকের মাধ্যমে তরুণ সমাজকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল তিনি প্রশাসনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন করার আহ্বান জানান ফেসবুকের মাধ্যমে। তার এই আহ্বানে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ধর্মঘট সফল হয়। সেই থেকে ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ ফেসবুক তথা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীদের কাছে আন্দোলনের একটি প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহƒত হতো। তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনকে এই এপ্রিল ৬ মুভমেন্টই সংগঠিত করেছিল। ২৫ বছর বয়সী আসমা মাহফুজও এপ্রিল ৬ মুভমেন্টের অন্যতম সংগঠক। আরব বিশ্বের ‘আরব বসন্তে’র নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণ প্রজš§। ইয়েমেনেও সাধারণ মানুষ ও একজন তরুণ গৃহবধূ আবদুল্লাহ সালেহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ওই গৃহবধূ, যিনি আজ আন্তর্জাতিক আসরে পরিচিত একটি মুখ, তাওয়াকুল কারমান, তিনি ইয়েমেনে মহিলা সাংবাদিকদের সংগঠিত করেছিলেন। কারমান তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
‘আরব বসন্ত’ কোন রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়নি। তরুণ প্রজš§ ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে ওই পরিবর্তনকে সংগঠিত করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তরুণ প্রজš§ ‘বিপ্লব’কে সংঘটিত করলেও তারা কেউই ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। মিসরে তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব ইসলামপন্থীদের সেখানে ক্ষমতায় বসায়। ইয়েমেনের সানায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমান দিনের পর দিন অবস্থান ধর্মঘট করে বাধ্য করেছিলেন আবদুল্লাহ সালেহকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে। কিন্তু কারমানও ক্ষমতায় যেতে পারেননি। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই ইন্টারনেট, সামাজিক নেটওয়ার্ক একটি ‘শক্তি’। এই ‘শক্তি’ একটি দেশে পরিবর্তন আনার জন্য যথেষ্ট। এই বিকল্প মিডিয়া ‘স্মার্ট পাওয়ারে’র অন্যতম উপাদানও বটে। মার্কিন রাজনীতিক জোসেফ নাই (ঘুব) তিন ধরনের ‘শক্তি’র কথা বলেছিলেন। হার্ড পাওয়ার, সফ্ট পাওয়ার ও স্মার্ট পাওয়ার। তিনি লিখেছেন, আজকের তথ্যযুগে তথ্যজগতে প্রবেশাধিকারের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা হবে স্মার্ট পাওয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাহরির স্কয়ারে ‘বিপ্লবে’র ৩ বছর আগে মিসরের বিখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ হেইকেল এই ‘বিকল্প মিডিয়া’ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, স্যাটেলাইটের প্রভাবে এমন একটি প্রজš§ আসছে, যাদের প্রচলিত পন্থায় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সাধারণভাবে একটি প্রজš§ নিজেরাই নিজেদের তৈরি করে। কিন্তু বর্তমানে অন্য কিছু ঘটছে (ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ১ ফেব্র“য়ারি ২০১১)।
এই বিকল্প মিডিয়া একুশ শতকে ‘বিপ্লবে’র অন্যতম উপাদান। নিউইয়র্কের জুকোট্টি পার্কে ২০১১ সালে যে ‘অকুপাই মুভমেন্টে’র জš§ হয়েছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাহরির স্কয়ারে। এক সময় সেই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ জুকোট্টি পার্ক থেকে ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। ঠিক দুই বছর পর এই ‘অকুপাই মুভমেন্টে’র খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেনি। মিসর, গ্রিস ও স্পেনে কোন না কোন ফর্মে এই অকুপাই মুভমেন্ট চলছে। আর নিউইয়র্কের জুকোট্টি পার্কে আন্দোলনকারীরা অনেক আগেই উৎখাত হয়েছিলেন। এখন তারা সীমিত পরিসরে ফ্রি ইউনিভার্সিটিতে আশ্রয় নিয়েছেন।
আজ যখন শাহবাগে তরুণ প্রজš§ আন্দোলন সংগঠিত করল, আমি এর সঙ্গে তাহরির স্কয়ার কিংবা নিউইয়র্কের অকুপাই মুভমেন্টের মিল খুঁজে পাই। শ্যামলা ছিপছিপে গড়নের তরুণীটি, যিনি ক্লান্তিহীনভাবে একনাগাড়ে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন, সেই লাকী আক্তারের সঙ্গে আমি আসমা মাহফুজ বা তাওয়াকুল কারমানের একটা মিল খুঁজে পাই। তরুণ সমাজ সব সময়ই পরিবর্তনের পক্ষে। তারা পরিবর্তন চায়। একুশ শতকে তরুণ প্রজš§ই বিশ্বকে বদলে দেবে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজš§ও এর বাইরে নয়। তবে বৈশ্বিক আন্দোলনের সঙ্গে এর কিছুটা পার্থক্য তো আছেই। নিউইয়র্কে অকুপাই মুভমেন্টের পেছনে কাজ করেছিল মার্কিন সমাজের অসমতা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের আবেদন সৃষ্টি করতে পারলেও মার্কিন সমাজে অসমতা দূর হয়নি। তরুণ সমাজ সবাই চাকরি পেয়েছে, এটাও বলা যাবে না। তবে আন্দোলনকারীরা মার্কিন সমাজকে যে একটা ধাক্কা দিতে পেরেছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাহরির স্কয়ার আন্দোলনের পর মিসরে পরিবর্তন এসেছে। ধর্মভিত্তিক একটা সংবিধান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি মিসর পেয়েছে। কিন্তু মিসরের অর্থনীতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। আবার তাহরির স্কয়ার উত্তপ্ত হচ্ছে। মুরসির বিরুদ্ধে তরুণদের কণ্ঠ আবারও উচ্চকিত হচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে আসমা মাহফুজের উত্তরসূরিরা যে আন্দোলন সংগঠিত করেছেন, তা সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে না। পার্থক্যটা এখানেই। তবে তাদের দাবি একাত্তরে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সেই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার। এই দাবিতে এখন গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। শাহবাগের ‘প্রজš§ চত্বরে’ আবার জয় বাংলা স্লোগান ফিরে এসেছে।
মহাসমাবেশে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ কোন কোন মহল থেকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও তা তরুণদের মূল স্পিরিটকে এতটুকুও স্পর্শ করতে পারেনি। তরুণ প্রজšে§র এই আন্দোলন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এক. তরুণ সমাজ যে একটি শক্তি, তা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখন উপলব্ধি করবেন। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্ব সারিতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। দুই. একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে সরকার আরও সতর্ক হবে এবং ইতিমধ্যেই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিন. ক্ষমতাসীনরা এই আন্দোলন থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে চাইবে। তারা নিয়েছেও। সরকারের অবস্থান এ মুহূর্তে তাদের অনুকূলে রয়েছে, এটা ভেবে তারা যদি আÍতুষ্টিতে ভোগেন, তাহলে তারা ভুল করবেন। এই গণঅসন্তোষ এক সময় সরকারের বিরুদ্ধেও চলে যেতে পারে। ইস্যু তো অনেকগুলো রয়েছেই। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার কেলেংকারি, সাংবাদিক দম্পতি রুনী-সাগর হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি নানা ইস্যুতে মাঠ আবার ‘গরম’ হয়ে যেতে পারে। সরকার যদি এদিকে দৃষ্টি দেয়, ভালো করবে। চার. বিএনপির ‘প্রায় নীরবতা’ দলটির ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। নিঃসন্দেহে বিএনপি একটি ‘ডিলেমা’ ফেস করছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং লাখ লাখ লোকের সেন্টিমেন্ট, অন্যদিকে শরিক দল জামায়াতকে সমর্থন। কাদের মোল্লার ফাঁসির ব্যাপারে বিএনপি কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এর একটা ভালো দিক আছে। বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। এমনিতেই বিএনপির সিনিয়র নেতারা নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমার মধ্যে আছেন। আবার কোন মন্তব্য করে আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যেতে পারেন। পাঁচ. তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু এখন চাপা পড়ে যেতে পারে। মানুষের দৃষ্টি এখন আদালত ও চূড়ান্ত রায়ের দিকে। শিগগিরই আরও অন্তত দুটি রায় আসছে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এখন এদিকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি এই মুহূর্তে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের’ ইস্যুতে হারিয়ে যেতে পারে। শাহবাগ চত্বরের ‘অকুপাই আন্দোলন’ জামায়াতকে বিএনপির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। জামায়াত ১৮ দল ছেড়ে গেলেও(?) আমি অবাক হব না। যদিও জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তারা ঐক্য ধরে রাখবেন এবং সরকারের সঙ্গে তাদের কোন ‘সমঝোতা’ হয়নি। প্রথম কথা, জামায়াত কর্মীরা চলমান আন্দোলনে বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে না পেয়ে এক ধরনের হতাশা ও বিভ্রান্তিতে ভুগতে পারে। দ্বিতীয় কথা, ‘সমঝোতা’ হয়নি বলে দাবি করলেও সাধারণ মানুষের একটা অংশ মনে করেন, ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ‘সমঝোতা’(?) হয়েছে। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে।
‘অকুপাই শাহবাগ’ কতদিন চলবে এ মুহূর্তে তা স্পষ্ট নয়। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনেরও আর কোন আবেদন নেই। তাহরির স্কয়ার একটা ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করলেও আবার তাহরির স্কয়ার আগের মতো ফুঁসে উঠবে, তা মনে করার কোন কারণ নেই। ‘অকুপাই শাহবাগ’ একটি আবেদন সৃষ্টি করেছে। তাদের সেই দাবি ছুয়ে গেছে দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষকে। তাদের ‘বিজয়’ তো হয়েছেই। তাদের লাল সালাম। মনোবিজ্ঞানে Festinger theory of Cognitive Dissonance নামে একটা তত্ত্ব আছে। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘পরস্পর সম্পর্কিত অনৈক্য’। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,
ÔWhen the people are confronted with contradictory ideas, they will usually pick the path of least resistance or energy in resolving conflict। ‘অকুপাই শাহবাগ’ রাজনীতিকে যে ‘ধাক্কা’ দিল, তাতে করে Festinger theory
এ দেশে কিভাবে বিকশিত হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Daily JUGANTOR
15.02.13