বৃহস্পতিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মানবতাবিরোধী অপরাধে কাদের মোল্লার ফাঁসি যখন
কার্যকর হয়েছে, ঠিক তার পরই বারিধারায় ‘গ্রেফতার’ করা হয়েছে জাতীয় পার্টির
প্রধান এইচএম এরশাদকে। তাকে ‘অসুস্থ’ অবস্থায় সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে
সরকারি ভাষ্যে এমন কথাই বলা হয়েছে। আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে
রেখে একের পর এক ‘ঘটনা’ ঘটছে। ধারণা করছি নির্বাচনের আগে আরো এ ধরনের
‘ঘটনা’ আমরা প্রত্যক্ষ করব। এর আগে বহুল আলোচিত জাতিসংঘের বিশেষ দূত
তারানকো বাংলাদেশে এসেছিলেন। অনেকটা ‘ব্যর্থ’ হয়ে তিনি চলে গেছেন। তার চলে
যাওয়ার পর পরই ঘটল কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনা, যা সব আইনি প্রক্রিয়া
সম্পন্ন করে কার্যকর করা হয়েছে। এরশাদের ‘গ্রেফতার’ ছিল নাটকীয়তায় ভরা।
এরশাদকে ‘নির্বাচনে’ আনার সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়, তখনই তাকে রাজনৈতিক
দৃশ্যপট থেকে আপাতত সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিল সরকার! বাজারে গুজব, রওশন
এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে এবং ‘অসুস্থ’ এরশাদ
চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন! নাটকের ‘পরের দৃশ্য’ দেখার জন্য আমাদের
আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে তারানকোর বাংলাদেশ সফর একটি
সম্ভাবনার জন্ম দিলেও সেই সম্ভাবনা এখন ‘মৃত’।
তারানকো চলে গেছেন। যে প্রত্যাশা নিয়ে তিনি এসেছিলেন, সেই প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখেই তিনি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেছেন একটা ‘কালো চিহ্ন’। তার পাঁচ দিনের ঢাকা সফরে সারাদেশের মানুষ তাকিয়েছিলেন তার দিকে। সংবাদপত্রে তার ঢাকা সফর নিয়ে বেশকিছু প্রত্যাশার ‘গল্প’ ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানতাম তার এই ঢাকা সফর নিয়ে পাওয়ার তেমন কিছু নেই। প্রথমত, তিনি দূতিয়ালি করেছেন সত্য, কিন্তু জাতিসংঘ তাকে কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্তও ছিলেন না। তিনি কথা বলেছেন। সমাধান চেয়েছেন। কিন্তু সমাধান তার হাতে ছিল না। মূল যে দুই ‘স্টেক হোল্ডার’, সমাধান তাদের হাতেই নিহিত এবং যাওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে এটাই তিনি নিশ্চিত করে গেলেন। দ্বিতীয়ত, সংবাদ সম্মেলনে তিনি বেশকিছু ভালো কথা বলেছেন। ‘সংলাপ চালিয়ে যাওয়া’, ‘সমাধানে আসতে হবে নিজেদের মধ্য থেকে’, দু’দলের নেতাদের ‘দায়িত্বশীল আচরণ’ ও ‘ছাড় দেয়ার মানসিকতা’, ‘সহিংসতা বন্ধ ও বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি’ ইত্যাদি যেসব মন্তব্য করেছেন, এসব বিষয়ে আমরা মোটামুটিভাবে অবহিত। আমরা জানি ও বুঝি। এ জন্য তারানকোর মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যুরোক্রেটের প্রয়োজন হয় না। তার সর্বশেষ ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে, আমরা একদিকে যেমনি আমাদের নিজেদের সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারছি না, অন্যদিকে তেমনি বিদেশি কারো মধ্যস্থতাও মানছি না। তৃতীয়ত, তারানকোর এই সফরের মধ্য দিয়ে একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। যে বিষয়টি (নির্বাচন সংক্রান্ত) সমাধান করবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা, সেখানে জাতিসংঘকে আসতে হলো। এই ধরনের ঘটনা আগামীতেও ঘটতে পারে। তাহলে কী প্রতিবারই আমাদের তাকাতে হবে বিদেশিদের দিকে? এটা কোনো সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য ভালো খবর নয়।
দু’দু’বার সংলাপ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা কোনো ফলাফল পাইনি। সরকার যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চিত, তা তাদের কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে আসন ভাগাভাগি করে ফেলেছে। ২২৭টি আসন তারা নিজেরা রেখেছে। অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিকে দিয়েছে ৬১টি আসন। অথচ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ নির্দেশ দিয়েছেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার। তাই জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল।
স্পষ্টতই দেশ আজ বড় ধরনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়েছে। ‘সংলাপ’ অব্যাহত রাখতে হলে তাতে করে ২৪ তারিখের আগে একটা সমাধানে পৌঁছতে হবে। ২৪ তারিখের পর নির্বাচন করার কোনো সুযোগ সংবিধান আমাদের দেয়নি। ফলে একটি সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়তে পারে দেশটি। আবার এটাও সত্য, একটা ‘সমাধান’ যে হবে, সে ব্যাপারেও কেউ নিশ্চিত নয়। এটা অনেকটা সময়ক্ষেপণ করার শামিল। কেননা ১১৬ জন তো এরই মাঝে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন! এখন শুধু গেজেটে নাম প্রকাশ বাকি। এখন এদের বাদ দেব আমরা কীভাবে? এটা তো সত্য, অসাংবিধানিক শক্তির উত্থান ও ক্ষমতা দখল রোধ করতে হলে নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সংবিধান নির্বাচনের কথাই বলছে। আর এই নির্বাচনটি হতে হবে ২৪ জানুয়ারির আগে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিলও ঘোষিত হয়েছে এবং সরকার ও সরকারের সমর্থক কিছু দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে এখন অবধি যেটা স্পষ্ট, তা হচ্ছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশের পর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সংখ্যা কম। অন্যদিকে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দল শুধু নির্বাচন বয়কটই নয়; বরং নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। এখন পরস্পরবিরোধী এই দুই ধারার মাঝে সমন্বয় কীভাবে হবে তার কোনো হিসাব মিলছে না। দিন যতই যাচ্ছে, ততই সংকটের গভীরতা বাড়ছে। বিশ্ব সম্প্রদায় একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা বললেও এর সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন ছিল, তা তারা দিতে পারছেন না। যেখানে সমঝোতা মুখ্য ছিল, সেখানে দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধান বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ ক’জন নেতা এখন জেলে। এর মধ্যে সাদেক হোসেন খোকা একটি ‘রাজনৈতিক বোমা’ ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন তাকে মন্ত্রী হওয়ার ‘অফার’ দেয়া হয়েছিল। কথাটির পেছনে ‘সত্যতা’ কতটুকু আছে, আমরা বলতে পারব না, কিন্তু বাজারে বড় গুজব যে, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকে ‘মন্ত্রী’ হওয়ার টোপ দেয়া হয়েছিল! সরকার যে ‘সর্বদলীয় ঐকমত্যের’ সরকার গঠন করেছে, তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিএনপি তাতে যোগ দেয়নি। ফলে সর্বদলীয় সরকারের চরিত্র পায়নি এ সরকার। এরই মাঝে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। চলমান সংকটে এটা একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। সহিংসতার খবর প্রতিদিনই আসছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব বড় বড় দেশের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা জানি না এ থেকে পরিত্রাণ কীভাবে সম্ভব?
এখনো সময় আছে একটা সমঝোতার। সুজাতা সিং কিংবা তারানকো আমাদের কোনো সমাধান দিয়ে যাবেন না। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। তাই প্রয়োজন দূরদর্শিতার। প্রয়োজন আন্তরিকতার। প্রয়োজন ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর বাস্তব প্রয়োগ। রাজনীতিবিদরা সেই কাজটিই করবেন, আমাদের এটাই প্রত্যাশা। সংবাদপত্রের পাতা কিংবা টক শোতে আমরা বারবার এ কথাটিই বলে আসছি। রাজনীতিবিদরা যদি দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাহলে তা দেশকে আরো বড় ধরনের সংকটের মাঝে ফেলে দেবে। দুঃখ লাগে, যারা সরকারে আছেন, তারা এই ‘সরল অঙ্কটি’ বুঝতে পারছেন না। গত তিন সপ্তাহে দেশজুড়ে যে তাণ্ডব চলেছে, তা কারো কাছেই ‘কাম্য’ নয়, প্রত্যাশিত নয়। একটা ‘মেসেজ’ কিন্তু এর মাঝে পৌছে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা! আমি যখন সংবাদপত্রে কানসার্টে গোলাম রব্বানীর বাড়ি পুড়তে দেখি, তখন আমাকে মনে করিয়ে দেয় তার সেই অবিসাংবাদিত ভূমিকার কথা। তিনি স্থানীয় একটি ইস্যু নিয়ে (কয়লা উত্তোলন) আন্তর্জাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা তাকে অবিসাংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘নেতা’। যে জনগণ তাকে ‘হিরোতে’ পরিণত করেছিল, তারাই আবার তাকে ‘পরিত্যাগ’ করল। তার বাড়িতে আগুন দিল। এর অর্থ পরিষ্কার, স্থানীয় জনগণের সায় নেই এই নির্বাচনের। যেভাবে তথাকথিত প্রার্থীদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে তা সুস্থতার কোনো কথা বলে না। এটা সুস্থ রাজনীতির লক্ষণও নয়। এটা ‘অসুস্থ’ রাজনীতির লক্ষণ। এই ‘অসুস্থ রাজনীতি’ থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। আর উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। যারা সাধারণ নির্বাচনে জামানত হারায়, যাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, চাঁদাবাজির ওপর যাদের সংগঠন চলে, তাদের মন্ত্রী বানিয়ে, উপদেষ্টা করে প্রধানমন্ত্রী তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে জনসমর্থন পেয়েছেন বলে মনে হয় না; বরং তার উপদেষ্টারা তাকে সঠিক ‘উপদেশটি’ দিতে পারেননি। সুবিধাভোগীরা সবসময় ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পেতে উৎসাহী হয়। চাঁদা নিয়ে যার সারা জীবন চলেছে, প্রধানমন্ত্রীর বদন্যতায়, তিনি মন্ত্রী-উপদেষ্টা হয়েছেন বটে, কিন্তু এতে করে মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। মূল সংগঠনকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন, সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই এখনো সময় আছে। জরুরি অবস্থাও কোনো সমাধান নয়। রাষ্ট্রপতি একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। এটা নৈতিক, সাংবিধানিক নয়। সংবিধান তাকে কোনো ক্ষমতায় দেয়নি। কিন্তু যিনি ৫০ বছর শুধু রাজনীতিই করেছেন, তিনি তো সাধারণ মানুষের ‘পালস’ বুঝতে পারবেন। গতকাল শুক্রবার লাগাতার অবরোধ শেষ হলো। শুধু রাজনীতিই নয়, অর্থনীতিও আজ হুমকির মুখে। এক ধরনের আতঙ্কের মাঝে বাস করছে মানুষ। মানুষের জন্যই সংবিধান। সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। তাই প্রয়োজনে আবারো সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সমঝোতা। নির্বাচনের তফসিল বাতিল করাও সম্ভব। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সংবিধান মুখ্য হয়ে দেখা দেয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হয়েছিল, তখন সংবিধানকে অনুসরণ করা হয়নি। স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিএনপিকে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়ার স্বার্থে নির্বাচনের শিডিউলে পরিবর্তন আনা। নির্বাচন আরো দুই থেকে তিন মাস পিছিয়ে দেয়া যায় কি-না এবং সংবিধানের আলোকে তা সম্ভব কি-না, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতে একটি রেফারেন্স চাওয়া। উচ্চ আদালত ‘স্টেট অব নেসেসিটি’র আলোকে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। অতীতে উচ্চ আদালত সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধারের জন্য এভাবে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বর্তমান সংকটকালীনও আদালত একটা দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সহিংস ঘটনাবলির যে ‘চিত্র’ আমরা সংবাপদত্রে দেখছি, তা যে কোনো বিবেকবান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কোনো রাজনীতিবিদ এ ঘটনায় মারা যাননি কিংবা আহত হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হননি। মারা গেছে সাধারণ মানুষ। গত ১২ ডিসেম্বরের সংবাদপত্র যারা পাঠ করেছেন, তারা জেনেছেন একজন মাসুমার মৃত্যুর খবর। শাহবাগের বাসে বোমা হামলায় তিনি আহত হয়েছিলেন গত ২৮ নভেম্বর। তারপর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি হেরে গেলেন। কী অপরাধ ছিল তার? এ প্রশ্নই করেছিলেন তার স্বামী মাহবুবুর রহমান। মাত্র ২৯ বছরের জীবন ছিল মাসুমার। এ জীবন আরো অনেক দীর্ঘায়িত হতে পারত, কিন্তু দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে এই ‘নষ্ট রাজনীতির’ প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েই তিনি চলে গেলেন ‘ফিরে না আসার জগতে।’ কিন্তু কপাল ভালো গীতা সরকারের। তিনি আহত হয়েছিলেন। বার্ন ইউনিটে তাকে যখন প্রধানমন্ত্রী দেখতে যান, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করেছি। আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না...আমরা ভালো সরকার চাই। আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’
একজন গীতা সরকার যেন বলতে চেয়েছেন সবার কথা। এ কেমন রাজনীতি! অসুস্থ রাজনীতির কারণে এখন বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটের এক একজনের কাহিনী যখন পত্রিকায় পড়ি, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাও রেহাই পাননি দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায়। ঢাকা কলেজের এক ছাত্র, যে আমার সন্তান হতে পারত, সেও রেহাই পায়নি বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হেরে গেল বাবু। এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাজনীতি তো সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্যই, কিন্তু এ কোন রাজনীতি? যে রাজনীতি গীতা সরকারকে দগ্ধ করে, যে রাজনীতি ‘আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ অহিদুর রহমান বাবুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়; এই রাজনীতি আমাদের কী মঙ্গল আনবে? আমার মনে আছে বছর দুয়েক আগে তুরস্কের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তুরস্কের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন মওলানা ভাসানী সম্পর্কে, আজীবন যিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। ক্ষমতার ‘দৌড়ে’ তিনি কোনো দিন হরতাল ডাকেননি! অবরোধ ডাকেননি এভাবে! মানুষ মারার রাজনীতি তিনি করেননি। ‘নষ্ট রাজনীতি’র কারণে জিম্মি হয়ে গেছে সাধারণ মানুষ।
আবারো হরতাল শুরু হচ্ছে! আজ জামায়াত কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। এর আগেই অনলাইনে যেসব খবরাখবর পাচ্ছি, তা আমাদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি? নির্বাচন মানেই একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। কিন্তু ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে একটা ভয়ের আবহ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। তাদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হব
Daily Manobkontho
15.12.13
তারানকো চলে গেছেন। যে প্রত্যাশা নিয়ে তিনি এসেছিলেন, সেই প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখেই তিনি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেছেন একটা ‘কালো চিহ্ন’। তার পাঁচ দিনের ঢাকা সফরে সারাদেশের মানুষ তাকিয়েছিলেন তার দিকে। সংবাদপত্রে তার ঢাকা সফর নিয়ে বেশকিছু প্রত্যাশার ‘গল্প’ ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানতাম তার এই ঢাকা সফর নিয়ে পাওয়ার তেমন কিছু নেই। প্রথমত, তিনি দূতিয়ালি করেছেন সত্য, কিন্তু জাতিসংঘ তাকে কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্তও ছিলেন না। তিনি কথা বলেছেন। সমাধান চেয়েছেন। কিন্তু সমাধান তার হাতে ছিল না। মূল যে দুই ‘স্টেক হোল্ডার’, সমাধান তাদের হাতেই নিহিত এবং যাওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে এটাই তিনি নিশ্চিত করে গেলেন। দ্বিতীয়ত, সংবাদ সম্মেলনে তিনি বেশকিছু ভালো কথা বলেছেন। ‘সংলাপ চালিয়ে যাওয়া’, ‘সমাধানে আসতে হবে নিজেদের মধ্য থেকে’, দু’দলের নেতাদের ‘দায়িত্বশীল আচরণ’ ও ‘ছাড় দেয়ার মানসিকতা’, ‘সহিংসতা বন্ধ ও বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি’ ইত্যাদি যেসব মন্তব্য করেছেন, এসব বিষয়ে আমরা মোটামুটিভাবে অবহিত। আমরা জানি ও বুঝি। এ জন্য তারানকোর মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যুরোক্রেটের প্রয়োজন হয় না। তার সর্বশেষ ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে, আমরা একদিকে যেমনি আমাদের নিজেদের সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারছি না, অন্যদিকে তেমনি বিদেশি কারো মধ্যস্থতাও মানছি না। তৃতীয়ত, তারানকোর এই সফরের মধ্য দিয়ে একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। যে বিষয়টি (নির্বাচন সংক্রান্ত) সমাধান করবেন আমাদের রাজনীতিবিদরা, সেখানে জাতিসংঘকে আসতে হলো। এই ধরনের ঘটনা আগামীতেও ঘটতে পারে। তাহলে কী প্রতিবারই আমাদের তাকাতে হবে বিদেশিদের দিকে? এটা কোনো সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য ভালো খবর নয়।
দু’দু’বার সংলাপ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা কোনো ফলাফল পাইনি। সরকার যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চিত, তা তাদের কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে আসন ভাগাভাগি করে ফেলেছে। ২২৭টি আসন তারা নিজেরা রেখেছে। অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিকে দিয়েছে ৬১টি আসন। অথচ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ নির্দেশ দিয়েছেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার। তাই জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল।
স্পষ্টতই দেশ আজ বড় ধরনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়েছে। ‘সংলাপ’ অব্যাহত রাখতে হলে তাতে করে ২৪ তারিখের আগে একটা সমাধানে পৌঁছতে হবে। ২৪ তারিখের পর নির্বাচন করার কোনো সুযোগ সংবিধান আমাদের দেয়নি। ফলে একটি সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়তে পারে দেশটি। আবার এটাও সত্য, একটা ‘সমাধান’ যে হবে, সে ব্যাপারেও কেউ নিশ্চিত নয়। এটা অনেকটা সময়ক্ষেপণ করার শামিল। কেননা ১১৬ জন তো এরই মাঝে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন! এখন শুধু গেজেটে নাম প্রকাশ বাকি। এখন এদের বাদ দেব আমরা কীভাবে? এটা তো সত্য, অসাংবিধানিক শক্তির উত্থান ও ক্ষমতা দখল রোধ করতে হলে নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সংবিধান নির্বাচনের কথাই বলছে। আর এই নির্বাচনটি হতে হবে ২৪ জানুয়ারির আগে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিলও ঘোষিত হয়েছে এবং সরকার ও সরকারের সমর্থক কিছু দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে এখন অবধি যেটা স্পষ্ট, তা হচ্ছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশের পর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সংখ্যা কম। অন্যদিকে বাস্তবতা হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দল শুধু নির্বাচন বয়কটই নয়; বরং নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। এখন পরস্পরবিরোধী এই দুই ধারার মাঝে সমন্বয় কীভাবে হবে তার কোনো হিসাব মিলছে না। দিন যতই যাচ্ছে, ততই সংকটের গভীরতা বাড়ছে। বিশ্ব সম্প্রদায় একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ ও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের কথা বললেও এর সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন ছিল, তা তারা দিতে পারছেন না। যেখানে সমঝোতা মুখ্য ছিল, সেখানে দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রধান বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ ক’জন নেতা এখন জেলে। এর মধ্যে সাদেক হোসেন খোকা একটি ‘রাজনৈতিক বোমা’ ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন তাকে মন্ত্রী হওয়ার ‘অফার’ দেয়া হয়েছিল। কথাটির পেছনে ‘সত্যতা’ কতটুকু আছে, আমরা বলতে পারব না, কিন্তু বাজারে বড় গুজব যে, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকে ‘মন্ত্রী’ হওয়ার টোপ দেয়া হয়েছিল! সরকার যে ‘সর্বদলীয় ঐকমত্যের’ সরকার গঠন করেছে, তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিএনপি তাতে যোগ দেয়নি। ফলে সর্বদলীয় সরকারের চরিত্র পায়নি এ সরকার। এরই মাঝে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। চলমান সংকটে এটা একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। সহিংসতার খবর প্রতিদিনই আসছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব বড় বড় দেশের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা জানি না এ থেকে পরিত্রাণ কীভাবে সম্ভব?
এখনো সময় আছে একটা সমঝোতার। সুজাতা সিং কিংবা তারানকো আমাদের কোনো সমাধান দিয়ে যাবেন না। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। তাই প্রয়োজন দূরদর্শিতার। প্রয়োজন আন্তরিকতার। প্রয়োজন ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর বাস্তব প্রয়োগ। রাজনীতিবিদরা সেই কাজটিই করবেন, আমাদের এটাই প্রত্যাশা। সংবাদপত্রের পাতা কিংবা টক শোতে আমরা বারবার এ কথাটিই বলে আসছি। রাজনীতিবিদরা যদি দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাহলে তা দেশকে আরো বড় ধরনের সংকটের মাঝে ফেলে দেবে। দুঃখ লাগে, যারা সরকারে আছেন, তারা এই ‘সরল অঙ্কটি’ বুঝতে পারছেন না। গত তিন সপ্তাহে দেশজুড়ে যে তাণ্ডব চলেছে, তা কারো কাছেই ‘কাম্য’ নয়, প্রত্যাশিত নয়। একটা ‘মেসেজ’ কিন্তু এর মাঝে পৌছে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা! আমি যখন সংবাদপত্রে কানসার্টে গোলাম রব্বানীর বাড়ি পুড়তে দেখি, তখন আমাকে মনে করিয়ে দেয় তার সেই অবিসাংবাদিত ভূমিকার কথা। তিনি স্থানীয় একটি ইস্যু নিয়ে (কয়লা উত্তোলন) আন্তর্জাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা তাকে অবিসাংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘নেতা’। যে জনগণ তাকে ‘হিরোতে’ পরিণত করেছিল, তারাই আবার তাকে ‘পরিত্যাগ’ করল। তার বাড়িতে আগুন দিল। এর অর্থ পরিষ্কার, স্থানীয় জনগণের সায় নেই এই নির্বাচনের। যেভাবে তথাকথিত প্রার্থীদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে তা সুস্থতার কোনো কথা বলে না। এটা সুস্থ রাজনীতির লক্ষণও নয়। এটা ‘অসুস্থ’ রাজনীতির লক্ষণ। এই ‘অসুস্থ রাজনীতি’ থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। আর উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই। যারা সাধারণ নির্বাচনে জামানত হারায়, যাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, চাঁদাবাজির ওপর যাদের সংগঠন চলে, তাদের মন্ত্রী বানিয়ে, উপদেষ্টা করে প্রধানমন্ত্রী তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে জনসমর্থন পেয়েছেন বলে মনে হয় না; বরং তার উপদেষ্টারা তাকে সঠিক ‘উপদেশটি’ দিতে পারেননি। সুবিধাভোগীরা সবসময় ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পেতে উৎসাহী হয়। চাঁদা নিয়ে যার সারা জীবন চলেছে, প্রধানমন্ত্রীর বদন্যতায়, তিনি মন্ত্রী-উপদেষ্টা হয়েছেন বটে, কিন্তু এতে করে মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। মূল সংগঠনকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন, সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই এখনো সময় আছে। জরুরি অবস্থাও কোনো সমাধান নয়। রাষ্ট্রপতি একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। এটা নৈতিক, সাংবিধানিক নয়। সংবিধান তাকে কোনো ক্ষমতায় দেয়নি। কিন্তু যিনি ৫০ বছর শুধু রাজনীতিই করেছেন, তিনি তো সাধারণ মানুষের ‘পালস’ বুঝতে পারবেন। গতকাল শুক্রবার লাগাতার অবরোধ শেষ হলো। শুধু রাজনীতিই নয়, অর্থনীতিও আজ হুমকির মুখে। এক ধরনের আতঙ্কের মাঝে বাস করছে মানুষ। মানুষের জন্যই সংবিধান। সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। তাই প্রয়োজনে আবারো সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সমঝোতা। নির্বাচনের তফসিল বাতিল করাও সম্ভব। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সংবিধান মুখ্য হয়ে দেখা দেয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হয়েছিল, তখন সংবিধানকে অনুসরণ করা হয়নি। স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে বিএনপিকে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়ার স্বার্থে নির্বাচনের শিডিউলে পরিবর্তন আনা। নির্বাচন আরো দুই থেকে তিন মাস পিছিয়ে দেয়া যায় কি-না এবং সংবিধানের আলোকে তা সম্ভব কি-না, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতে একটি রেফারেন্স চাওয়া। উচ্চ আদালত ‘স্টেট অব নেসেসিটি’র আলোকে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। অতীতে উচ্চ আদালত সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধারের জন্য এভাবে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বর্তমান সংকটকালীনও আদালত একটা দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সহিংস ঘটনাবলির যে ‘চিত্র’ আমরা সংবাপদত্রে দেখছি, তা যে কোনো বিবেকবান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কোনো রাজনীতিবিদ এ ঘটনায় মারা যাননি কিংবা আহত হয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হননি। মারা গেছে সাধারণ মানুষ। গত ১২ ডিসেম্বরের সংবাদপত্র যারা পাঠ করেছেন, তারা জেনেছেন একজন মাসুমার মৃত্যুর খবর। শাহবাগের বাসে বোমা হামলায় তিনি আহত হয়েছিলেন গত ২৮ নভেম্বর। তারপর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি হেরে গেলেন। কী অপরাধ ছিল তার? এ প্রশ্নই করেছিলেন তার স্বামী মাহবুবুর রহমান। মাত্র ২৯ বছরের জীবন ছিল মাসুমার। এ জীবন আরো অনেক দীর্ঘায়িত হতে পারত, কিন্তু দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে এই ‘নষ্ট রাজনীতির’ প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েই তিনি চলে গেলেন ‘ফিরে না আসার জগতে।’ কিন্তু কপাল ভালো গীতা সরকারের। তিনি আহত হয়েছিলেন। বার্ন ইউনিটে তাকে যখন প্রধানমন্ত্রী দেখতে যান, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করেছি। আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না...আমরা ভালো সরকার চাই। আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’
একজন গীতা সরকার যেন বলতে চেয়েছেন সবার কথা। এ কেমন রাজনীতি! অসুস্থ রাজনীতির কারণে এখন বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটের এক একজনের কাহিনী যখন পত্রিকায় পড়ি, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাও রেহাই পাননি দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায়। ঢাকা কলেজের এক ছাত্র, যে আমার সন্তান হতে পারত, সেও রেহাই পায়নি বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হেরে গেল বাবু। এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাজনীতি তো সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্যই, কিন্তু এ কোন রাজনীতি? যে রাজনীতি গীতা সরকারকে দগ্ধ করে, যে রাজনীতি ‘আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ অহিদুর রহমান বাবুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়; এই রাজনীতি আমাদের কী মঙ্গল আনবে? আমার মনে আছে বছর দুয়েক আগে তুরস্কের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তুরস্কের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন মওলানা ভাসানী সম্পর্কে, আজীবন যিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। ক্ষমতার ‘দৌড়ে’ তিনি কোনো দিন হরতাল ডাকেননি! অবরোধ ডাকেননি এভাবে! মানুষ মারার রাজনীতি তিনি করেননি। ‘নষ্ট রাজনীতি’র কারণে জিম্মি হয়ে গেছে সাধারণ মানুষ।
আবারো হরতাল শুরু হচ্ছে! আজ জামায়াত কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। এর আগেই অনলাইনে যেসব খবরাখবর পাচ্ছি, তা আমাদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি? নির্বাচন মানেই একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। কিন্তু ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে একটা ভয়ের আবহ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। তাদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হব
Daily Manobkontho
15.12.13
0 comments:
Post a Comment