রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একজন কেজরিওয়াল ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি


একজন অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদপত্রগুলো আমাদের বলছে, তিনি হচ্ছেন দিল্লির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী। বয়স মাত্র ৪৫ বছর। যদিও বয়সটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। এর চাইতেও কম বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জনএফ কেনেডি কিংবা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। ওবামার কথা না হয় নাইবা বললাম। কিন্তু কে চিনত কেজরিওয়ালকে? কিংবা সদ্য গঠিত আম আদমি পার্টিকে? কিন্তু এই কেজরিওয়ালই শীলা দিক্ষিতের মতো কংগ্রেসের হেডিওয়েট নেতাদের পরাজিত করে দিল্লির মসনদে বসেছেন। একজন কেজরিওয়াল পেরেছেন। কারণ তিনি টার্গেট করেছিলেন দুর্নীতি উৎখাতের। দিল্লির মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছেন। এটা নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় প্রশাসনের জন্য কোনো ‘সিগন্যাল’ কি-না আমি জানি না। কিন্তু একটা সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো ‘কমিটমেন্ট’ যদি ঠিক থাকে, তাহলে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। আর কেজরিওয়ালের ‘দিল্লি দখল’-এর ঘটনা ঘটল, এমন এক সময় যখন বাংলাদেশেও দুর্নীতির বিষয়টি বহুল আলোচিত। বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হতে বাকি আছে মাত্র কয়েকটি দিন। এরই মাঝে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একটা হাস্যস্পদ ব্যাপারে পরিণত করেছে। এর চাইতেও বড় কথা, নির্বাচনের আগে সরকারি দলের এমপি প্রার্থীরা, বিশেষ করে সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন, তাদের দেয়া তথ্য নয়া বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তাদের দেখা তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় অনেকেই গেল ৫ বছরের মধ্যে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়টি যে বৈধভাবে হয়েছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, সেটা যেমন একটা প্রশ্ন, ঠিক তেমন একটা প্রশ্ন, কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন সরকারি দলের সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা। তবে এটা মানতেই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক রকম ‘যুদ্ধ’ শুরু করে ভারতে গান্ধীবাদী নেতা আন্না হাজারে আর তার ভাবশিষ্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল ভারতজুড়ে আলোচনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হলেও বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষয়টি খুব একটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রধান বিরোধী দল ও জোটের (১৮ দল) কর্মসূচিতেও এই দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সাধারণ মানুষের কাছে সহিংসতা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিষয়টি যত বেশি আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি দলের নেতাদের ‘অবৈধ আয়’-এর বিষয়টি তেমন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এক সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে ড. কামাল হোসেন সরব হয়েছিলেন। কিন্তু কেজরিওয়ালের মতো তিনি কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেননি।
চলতি বছর রাজনীতিতে দুটি বিষয় বেশি করে আলোচিত হয়। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিরোর্ধ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাটা বছর আন্দোলন করেছে। তারা সংবিধান সংশোধনেরও দাবি করে। এই দাবির পক্ষে একটা সর্বজন গ্রহণযোগ্যতাও লক্ষ্য করা যায়। বছরের শেষের দিকে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ এ সরকারকে কিছুটা নমনীয় হতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর বদলে (যিনি সংবিধান সংশোধনীর ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের দায়িত্ব পান) রাষ্ট্রপতি অথবা স্পিকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করারও প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সরকার তাতে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। ফলে সংকটের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে বছরের শেষ দিকে বিএনপি নেত্রীকে একটি চূড়ান্ত কর্মসূচি দিতে দেখা যায়। বেগম জিয়া গত ২৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’-এর আহ্বান জানান। গণতন্ত্র রক্ষায় তিনি এই গণতন্ত্র অভিযাত্রার ডাক দেন। এমনকি স্থবির হয়ে যাওয়া সংলাপ শুরু করারও আহ্বান জানান তিনি। এটা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য নতুন একটি মাত্রা এনে দেয়।
সরকার তার টার্ম শেষ করলেও সরকারের জন্য এটা ছিল একটা বড় ব্যর্থতা যে, তারা দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে পারেনি।
এমনকি ১৫৪ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, নির্বাচন কমিশন এই ভোটারবিহীন নির্বাচন রোধ করতে পারেনি; বরং কমিশন সরকারের একটি অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে।  একজন দলীয় প্রধান হিসেবে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী যদি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তাহলে তিনি বা তার দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন। পঞ্চম সংসদে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী (সংসদীয় রাজনীতি) এনে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রবর্তন করেছিলাম। কিন্তু বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড শুধু ভঙ্গই করল না; বরং গণতান্ত্রিক চর্চার পেছনে ছুরিকাঘাত করল। জাতীয় পার্টির ঘটনা (নির্বাচনে আছে, নির্বাচনে নেই। মন্ত্রিসভায় আছে, মন্ত্রিসভায় নেই, পার্টি প্রধানের অসুস্থতা ইত্যাদি) প্রমাণ করে রাজনীতিবিদদের মাঝে সুবিধাবাদিতা চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্ব সংকটের মাঝে থাকবে।
দেশে সুশাসনের অভাব নানাভাবে অনুভূত হয়েছে চলতি বছর। দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচিত হয়েছে এবং একাধিকবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মানবাধিকার কর্মী ও একজন সিনিয়র আইনজীবী আদিলুর রহমান খানের গ্রেফতার কিংবা ড. মুহম্মদ ইউনূস ইস্যুতেও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে অরাজকতা, পোশাক কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা, রানা প্লাজার হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে একটি ভিন্ন মেসেজ দিয়েছে।
২০১৩ সালটি ছিল রাজনৈতিক দল ও এর নেতাদের জন্য একটি খারাপ খবর। সারাটা বছর জামায়াতে ইসলামী একটা বিতর্কের মাঝে থেকেছে। তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির সব সহিংস ঘটনার জন্য বারবার অভিযুক্ত হয়েছে। তাদের এক শীর্ষ নেতা কাদের মোল্লা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত এবং উচ্চ আদালত কর্তৃক তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। এর আগে উচ্চ আদালতের অপর একটি পর্যবেক্ষণে স্বাধীনতা আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার নিন্দা ও সমালোচনা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত যদি তার অস্তিত্ব বজায় রাখে, তাহলেও নির্বাচনে জামায়াত হিসেবে অংশ নিতে পারবে না। অন্যদিকে অপর একটি ইসলাম পছন্দ সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থান ছিল অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। অতীতে বাংলাদেশের মানুষের এই সংগঠনটি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। ৫ মে শাপলা চত্বরে তাদের সমাবেশ ও ওই সমাবেশে পুলিশের হামলা এবং মৃত্যুর পর সংগঠনটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। তাদের উত্থাপিত ১৩ দফা নিয়েও সারা বছর বিতর্ক চলে এবং নারীবাদী সংগঠনগুলো এর সমালোচনা করে। মূলত বেসরকারি কওমি মাদ্রাসায় পড়–য়া শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়েই এই সংগঠন। বছরের প্রায় শেষ দিকে এরা ঢাকায় জনসভা করতে চাইলেও সরকার তাদের অনুমতি দেয়নি। গেল বছর পুরোটা সময় বিএনপি আন্দোলনে থেকেছে। শীর্ষ স্থানীয় অনেক নেতাই শেষ দিন পর্যন্ত জেলে ছিলেন। নাটকীয়ভাবে অফিসের তালা ভেঙে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকে (রিজভী আহমেদ) গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপির অফিসের সম্মুখে তাদের জনসভায় পুলিশেল গুলিবর্ষণ, নির্বাচিত এমপিদের পুলিশের লাঠিপেটা, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয় সব মিলিয়ে জনমত বিএনপির পক্ষে গেলেও আন্দোলনে বিএনপি তেমন সুবিধা করতে পারেনি। এতে করে কর্মী ও শুভনবুধ্যায়ীদের মাঝে এক ধরনের হতাশা লক্ষ্য করা যায়। বছরের শেষ দিকে এসে বেগম জিয়া তার কার্যালয়ে অনেকটা ‘গৃহবন্দি’ হয়ে পড়েন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও এই নির্বাচন বিএনপিকে এক ধরনের অস্তিত্বহীনতার মাঝে ফেলে দিতে পারে। বিএনপি এখন মূলত বেগম জিয়ার ক্যারিসমেটিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে চিন্তাও করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিঃসন্দেহে বেগম জিয়া-পরবর্তী বিএনপির হাল ধরবেন। কিন্তু তার অসুস্থতাজনিত কারণে বিদেশে অবস্থান, মানি লন্ডারিং মামলাসহ দুর্নীতির মামলার কারণে তার পক্ষে এই মুহূর্তে দেশে আসাও সম্ভব নয়। সিনিয়র নেতারা অনেকেই তৎপর নন। তরুণ প্রজন্মকে বিএনপির তরুণ নেতৃত্বে আকৃষ্ট করতে পেরেছে বলেও মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে দশম জাতীয় সংসদ যদি সংবিধান অনুযায়ী ৫ বছর থাকে, তাহলে বিএনপি তার অস্তিত্ব নিয়ে বড় সংকটে থাকবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা আভাস দিয়েছেন একাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের। আমার ধারণা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় গঠিত দশম সংসদ দুই বছর ক্ষমতায় থাকবে। আর এরই মাঝে এই সংসদেই ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ একটা রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে এবং তা সংসদে পাস হবে। অনেকটা ষষ্ঠ সংসদে পাস হওয়া ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো। এটা না হলে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া যাবে না। এটা সত্য, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই নির্বাচনটি সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। সরকারের এটা বড় ব্যর্থতা যে, সরকারবিরোধী দলকে আস্থায় নিতে পারেনি। আস্থায় নিতে না পারার অর্থ হচ্ছে সংকট থেকে যাওয়া। আর এই রাজনৈতিক সংকটের নতুন যে একটি মাত্রা আমরা দেখতে পেয়েছি অর্থাৎ সহিংসতা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় বটে, কিন্তু তাতে আস্থা অর্জন করা যায় না। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে দরকার সুশাসন নিশ্চিত করা। দরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। এটা সত্যিই একটা উল্লেখ করার বিষয় যে, নয়াদিল্লিতে শুধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আম আদমি পার্টি ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘দিল্লির মসনদ’ দখল করতে পেরেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ড. কামাল হোসেন কিংবা নাগরিক ঐক্য দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েও আদৌ কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। গণফোরাম এখন শুধু ‘বেইলি রোডকেন্দ্রিক’ তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। ২০১৪ সালে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা এটা চিন্তা করতে পারেন তাদের ব্যর্থতা কোথায়। ডিসেম্বরে (২০১৩) পত্র-পত্রিকায় আমাদের রাজনীতিবিদদের (ইসিতে দেয়া হলফনামা অনুযায়ী) অর্থ-সম্পদের যে বিবরণ ছাপা হয়েছে, তাতে অবাক হতে হয়। কী বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক তারা হয়েছেন! রাজনীতি কী তাহলে শুধু অর্থ-সম্পদ বানানোর একটি মাধ্যম! আবার অর্থমন্ত্রীর মতো একজন প্রবীণ ও শিক্ষিত ব্যক্তি যখন বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকলে অর্থ-সম্পদ বাড়ে’, তখন অবাক হতে হয়! একজন শিক্ষিত ব্যক্তি কীভাবে এভাবে কথা বলতে পারেন! একজন কেজরিওয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন রাজনীতিতে যদি সততা ও কমিটমেন্ট থাকে, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। আমাদের রাজনীতিবিদরা কেজরিওয়ালের কাছ থেকে শিখবেন, এটা আশা করি না। ভারতের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এখানেই।
একজন কেজরিওয়াল আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করে যেসব বিষয়, সেই বিষয়গুলোকে যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে জনসমর্থন তাতে বাড়ে। গণতন্ত্রের অপর নামই তো আস্থা। এই আস্থা অর্জন করা সম্ভব, যদি সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো নিয়ে রাজনীতিবিদরা সোচ্চার হন। নিঃসন্দেহে দুর্নীতি একটা বিষয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারা যদি অবৈধভাবে অর্থ ও বিত্তের মালিক হয়ে থাকেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা। বিগত জোট সরকার বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের একটি নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে একশ্রেণীর শ্রমিক নেতার (যারা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত) ইন্ধনে অবৈধভাবে প্রচুর গ্যাসলাইন সংযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ এখান থেকে সরকার কোনো রেভিনিউ পাচ্ছে না। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নও করা যাচ্ছে না। এটা সুশাসনের অন্তরায়। কেজরিওয়াল নয়াদিল্লিতে বিনামূল্যে প্রতি বাড়িতে ৭০০ লিটার পানি আর সস্তায় বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঢাকা শহরের সমস্যা হচ্ছে পানির অবৈধ ব্যবহার এবং বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ। এই অবৈধ সংযোগের কারণে বিদ্যুৎ ও পানির ‘সিস্টেম লস’ একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। বিদ্যুৎমন্ত্রী আছেন বটে, কিন্তু কেউ কখনো এই ‘সিস্টেম লস’ কমাতে পারেননি। উদ্যোগও নেননি। এ জন্য দরকার এ সেক্টরে শক্ত নেতৃত্ব। প্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। পানি ও বিদ্যুৎ লস কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রয়োজন উদ্যোগের। বাংলাদেশে মানুষ বেড়েছে। কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। কৃষি জমিতে গড়ে উঠছে বসতি, ঘর ও শিল্প কলকারাখানা। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। গ্রামাঞ্চলেও হাইরাইজ ভবন তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে বিনাসুদে ঋণ দিতে হবে। তবে মনিটর করতে হবে, যাতে এই ঋণ শুধু ভবন নির্মাণ  কাজেই ব্যয় হয়। কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে, যাতে করে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য হিস্যা পান। না হলে কৃষক এ পেশা ছেড়ে দেবেন। উন্নত দেশগুলোতে এটা একটা সমস্যা। বাংলাদেশে প্রচুর জনশক্তি রয়েছে। এই জনশক্তির ব্যবহার হচ্ছে না। বেশকিছু পেশার বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে (নার্সিং, আইটি) অথচ আমরা এসব সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছি না। ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আমরা স্থাপন করেছি। কিন্তু দক্ষ নেতৃত্বের অভাবে, দলীয়করণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক একটি অদক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত ৭-৮ মাস ধরে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। সেখানে শিক্ষা কাঠামো এক রকম ভেঙে পড়েছে। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই।
আগামী ৫ জানুয়ারির পর শেখ হাসিনাকে আমরা ‘নয়া প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে দেখতে পাব। তার কাছে প্রত্যাশা আমাদের অনেক। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরতে হলে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি।
Daily Manobkontho
31.12.13

0 comments:

Post a Comment