শেষ পর্যন্ত বহুল আলোচিত টিকফা বা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি নির্বাচিত সরকার তার টার্ম শেষ হওয়ার পর দেশে যখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, ঠিক তখনই গত ২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। সাধারণত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। তারা সাধারণত নির্বাচনসংক্রান্ত কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সরকার টিকফার মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করল। যদিও এটা ঠিক, ১৭ জুন মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। তারপরও সরকার পাঁচ মাস সময় নিল এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে। প্রশ্নটা এ কারণেই উঠেছে যে, মহাজোট সরকার জুনে নীতিগতভাবে এই চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিলেও তা ওই সময়ে স্বাক্ষর করল না কেন? কেনই বা একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য সরকার অপেক্ষা করল না? আরও অবাক করার বিষয়, টিকফার মতো একটি জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট চুক্তি নিয়ে জাতীয় সংসদে আদৌ আলোচনা হলো না? খুব সঙ্গত কারণেই তাই টিকফা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকাকে এখন একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিল। যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি, বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এখানেও একটি প্রশ্ন আছে। বিএনপির এই নেতার ‘অভিমত’ কী ব্যক্তিগত অভিমত, নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। কেননা বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনো সভায় এ চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এ তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে এরই মধ্যে বাম সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। সিপিবি-বাসদ ঢাকায় এই চুক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলও বের করেছে। তাদের অভিমত, এই চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। মজার কথা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুটি বাম দলের প্রতিনিধিত্ব (জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি) থাকলেও, টিকফা চুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, চুক্তিটিতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা আমাদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জেএসপির একটা যোগসূত্র আছে বলা হলেও, খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের আমাদের জানিয়েছেন, টিকফার সঙ্গে জেএসপি বা শুল্কমুক্ত ও প্রবেশাধিকারের কোনো যোগসূত্র নেই। তবে বাংলাদেশ জেএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে, এ রকমটিই আমাদের জানিয়েছেন ওয়াশিংটনে আমাদের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। তবে বলতেই হবে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ায়, তা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে।
বলা হচ্ছে, এতে করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে। দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরও টিকফা চুক্তির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, টিকফা স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করেছে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি আশুলিয়ায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল।
ফলে এক পর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এখন বাংলাদেশ সরকারের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে যে, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলে হয়তো বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় যে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছিল। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনও তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশী পণ্যে, তার মধ্যে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে।
গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশী রফতানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা ওই রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই তাহলে এই জিএসপি সুবিধা রফতানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারব না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করি তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলান যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে ‘উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে।’ ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে, কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো।
এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষ করে সেবা খাতে) এবং এসব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চ শিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব, তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত, তা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে।
সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে যে সরকার ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে পাঁচ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিকফা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় নয় ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে, কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পাবে। বাংলাদেশকে এখন চাল আমদানি করতে হয় না; কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষি পণ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, যারা গম ও চাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তাদের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। তিন. বলা হচ্ছে, টিকফা চুক্তি হলে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
কেননা, অত্যন্ত উচ্চ কর দিয়ে (১৫ দশমিক ৩ ভাগ) বাংলাদেশ তার রফতানি বাজার সম্প্রসারিত করেছে। অথচ চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর দেয়, মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। অথচ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিকফা চুক্তি নেই। চার. বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়বে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে। টিকফা চুক্তি কার্যকর হলে এই মেধাস্বত্ব আইনের শক্তি প্রয়োগ হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর, ওষুধ শিল্প ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা।
কৃষক আর বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য করা হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এক সময় জিম্মি করে ফেলবে আমাদের কৃষি সেক্টরকে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প উন্নয়নশীল দেশে নাম করলেও টিকফা চুক্তির পর এই শিল্প এক ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা, ওষুধ কোম্পানিগুলো প্যাটেন্ট কিনে কাঁচামাল আমদানি করে সস্তায় ওষুধ তৈরি করে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এই ওষুধ রফতানি হয়। এখন এই টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্যাটেন্ট ক্রয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগটি রয়েছে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে মার্কিন কোম্পানির লাইসেন্স কিনতে হবে। ওই লাইসেন্স দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়ার শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা এখন স্বল্পমূল্যে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে কম্পিউটার এ দেশেই সংযোজিত হয়। ফলে কম্পিউটারের দাম একটা ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু টিকফা চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে এই ‘ক্লোন কম্পিউটার’ আমদানি বা সংযোজন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে তখন ব্র্যান্ড কম্পিউটার আমদানি করতে হবে, যার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে অনেক। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে তা চলে যাবে। বাংলাদেশ যে ‘ডিজিটাল যুগের’ কথা বলছে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে তখন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, টিকফা চুক্তি করে বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাংলাদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলো এলে তাতে বাংলাদেশে ‘সেবার’ মান হয়তো বাড়বে। সেবা সেক্টরে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাস্থ্য খাতে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায়, তাতে সেবার মান বাড়বে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই ‘সেবার’ জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হবে। শিক্ষা খাতে মার্কিনি পুঁজি বিনিয়োগ হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে। যারা সার্টিফিকেট বিক্রি করে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারব। ক্ষতি হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখানে সরকারের বিনিয়োগ কমবে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা সহজলভ্য হয়তো হবে না; কিন্তু মেধাবী ছাত্রদের জন্য তা সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। তাদের বৃত্তির সংখ্যা বাড়বে। মেধার মূল্য হবে। এখন যেভাবে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হয়, তখন তা আর থাকবে না।
টিকফা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো বড় অসময়ে। যুক্তরাষ্ট্র এক যুগ আগেই বাংলাদেশকে এই চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা যে বাংলাদেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি করছে না, পৃথিবীর অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টিকফা চুক্তি রয়েছে। ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো উঠতি অর্থনৈতিক শক্তির দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের চুক্তি রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের ‘অবস্থান’কে কতটুকু শক্তিশালী করতে পেরেছে আমরা তা জানি না। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাংলাদেশ ‘নেগোসিয়েশনস’-এ কখনও সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে টিকফা নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্নে বাংলাদেশ তার স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে, আমরা তা জানি না। আগামী দিনগুলোই এর প্রমাণ করবে। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত করেই বলা যায়Ñ আর তা হচ্ছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ যদি এই চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে করে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি ইস্যু আলাদাভাবে দেখে। এ জন্য জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি কিংবা গার্মেন্ট শিল্পের পরিস্থিতির সঙ্গে টিকফা চুক্তিকে মেলান যাবে না। এটি একটি ভিন্ন ইস্যু।
টিকফার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তা, বিনিয়োগের গ্যারান্টি ও নিরাপত্তা, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, শ্রমমান বাড়ানোর পর এই চুক্তিতে জিএসপি সুবিধার প্রশ্নটি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লাটা এতে ভারি। বাংলাদেশের প্রাপ্তি এতে কম। তবে সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, রাজনীতির এই অনিশ্চয়তার মুখে বিরোধী দল সরকারের বিরোধিতায় গেল না। মেসেজটা পরিষ্কারÑ সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়। মার্কিন নীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন, শুধু টিকফা চুক্তি করে সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়, তা তারা পারবে না। বিভিন্ন ইস্যুতে (যেমন ড. ইউনূস ইস্যু) মহাজোট সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল, শুধু একটি চুক্তি করে, তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। একটি নির্বাচিত সরকার এই চুক্তিটি করলে আরও ভালো করত। আমাদের দুর্ভাগ্য নির্বাচিত সংসদে এ ধরনের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চুক্তির ব্যাপারে আদৌ কোনো আলোচনা হলো না। এখন সরকারের উচিত হবে চুক্তিটি প্রকাশ করা। যাতে করে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হয়েছি। চুক্তি স্বাক্ষরই বড় কথা নয়, বড় কথা আমাদের স্বার্থ। এখন আমাদের দেখতে হবে এই চুক্তি করে আমরা কতটুকু লাভবান হলাম।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকাকে এখন একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিল। যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি, বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এখানেও একটি প্রশ্ন আছে। বিএনপির এই নেতার ‘অভিমত’ কী ব্যক্তিগত অভিমত, নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। কেননা বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনো সভায় এ চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এ তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে এরই মধ্যে বাম সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। সিপিবি-বাসদ ঢাকায় এই চুক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলও বের করেছে। তাদের অভিমত, এই চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। মজার কথা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুটি বাম দলের প্রতিনিধিত্ব (জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি) থাকলেও, টিকফা চুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, চুক্তিটিতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা আমাদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জেএসপির একটা যোগসূত্র আছে বলা হলেও, খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের আমাদের জানিয়েছেন, টিকফার সঙ্গে জেএসপি বা শুল্কমুক্ত ও প্রবেশাধিকারের কোনো যোগসূত্র নেই। তবে বাংলাদেশ জেএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে, এ রকমটিই আমাদের জানিয়েছেন ওয়াশিংটনে আমাদের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। তবে বলতেই হবে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ায়, তা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে।
বলা হচ্ছে, এতে করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে। দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরও টিকফা চুক্তির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, টিকফা স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করেছে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি আশুলিয়ায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল।
ফলে এক পর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এখন বাংলাদেশ সরকারের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে যে, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলে হয়তো বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় যে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছিল। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনও তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশী পণ্যে, তার মধ্যে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে।
গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশী রফতানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা ওই রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই তাহলে এই জিএসপি সুবিধা রফতানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারব না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করি তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলান যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে ‘উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে।’ ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে, কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো।
এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষ করে সেবা খাতে) এবং এসব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চ শিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব, তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত, তা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে।
সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে যে সরকার ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে পাঁচ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিকফা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় নয় ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে, কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পাবে। বাংলাদেশকে এখন চাল আমদানি করতে হয় না; কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষি পণ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, যারা গম ও চাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তাদের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। তিন. বলা হচ্ছে, টিকফা চুক্তি হলে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
কেননা, অত্যন্ত উচ্চ কর দিয়ে (১৫ দশমিক ৩ ভাগ) বাংলাদেশ তার রফতানি বাজার সম্প্রসারিত করেছে। অথচ চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর দেয়, মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। অথচ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিকফা চুক্তি নেই। চার. বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়বে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে। টিকফা চুক্তি কার্যকর হলে এই মেধাস্বত্ব আইনের শক্তি প্রয়োগ হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর, ওষুধ শিল্প ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা।
কৃষক আর বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য করা হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এক সময় জিম্মি করে ফেলবে আমাদের কৃষি সেক্টরকে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প উন্নয়নশীল দেশে নাম করলেও টিকফা চুক্তির পর এই শিল্প এক ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা, ওষুধ কোম্পানিগুলো প্যাটেন্ট কিনে কাঁচামাল আমদানি করে সস্তায় ওষুধ তৈরি করে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এই ওষুধ রফতানি হয়। এখন এই টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্যাটেন্ট ক্রয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগটি রয়েছে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে মার্কিন কোম্পানির লাইসেন্স কিনতে হবে। ওই লাইসেন্স দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়ার শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা এখন স্বল্পমূল্যে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে কম্পিউটার এ দেশেই সংযোজিত হয়। ফলে কম্পিউটারের দাম একটা ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু টিকফা চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে এই ‘ক্লোন কম্পিউটার’ আমদানি বা সংযোজন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে তখন ব্র্যান্ড কম্পিউটার আমদানি করতে হবে, যার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে অনেক। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে তা চলে যাবে। বাংলাদেশ যে ‘ডিজিটাল যুগের’ কথা বলছে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে তখন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, টিকফা চুক্তি করে বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাংলাদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলো এলে তাতে বাংলাদেশে ‘সেবার’ মান হয়তো বাড়বে। সেবা সেক্টরে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাস্থ্য খাতে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায়, তাতে সেবার মান বাড়বে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই ‘সেবার’ জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হবে। শিক্ষা খাতে মার্কিনি পুঁজি বিনিয়োগ হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে। যারা সার্টিফিকেট বিক্রি করে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারব। ক্ষতি হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখানে সরকারের বিনিয়োগ কমবে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা সহজলভ্য হয়তো হবে না; কিন্তু মেধাবী ছাত্রদের জন্য তা সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। তাদের বৃত্তির সংখ্যা বাড়বে। মেধার মূল্য হবে। এখন যেভাবে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হয়, তখন তা আর থাকবে না।
টিকফা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো বড় অসময়ে। যুক্তরাষ্ট্র এক যুগ আগেই বাংলাদেশকে এই চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা যে বাংলাদেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি করছে না, পৃথিবীর অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টিকফা চুক্তি রয়েছে। ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো উঠতি অর্থনৈতিক শক্তির দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের চুক্তি রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের ‘অবস্থান’কে কতটুকু শক্তিশালী করতে পেরেছে আমরা তা জানি না। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাংলাদেশ ‘নেগোসিয়েশনস’-এ কখনও সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে টিকফা নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্নে বাংলাদেশ তার স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে, আমরা তা জানি না। আগামী দিনগুলোই এর প্রমাণ করবে। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত করেই বলা যায়Ñ আর তা হচ্ছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ যদি এই চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে করে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি ইস্যু আলাদাভাবে দেখে। এ জন্য জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি কিংবা গার্মেন্ট শিল্পের পরিস্থিতির সঙ্গে টিকফা চুক্তিকে মেলান যাবে না। এটি একটি ভিন্ন ইস্যু।
টিকফার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তা, বিনিয়োগের গ্যারান্টি ও নিরাপত্তা, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, শ্রমমান বাড়ানোর পর এই চুক্তিতে জিএসপি সুবিধার প্রশ্নটি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লাটা এতে ভারি। বাংলাদেশের প্রাপ্তি এতে কম। তবে সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, রাজনীতির এই অনিশ্চয়তার মুখে বিরোধী দল সরকারের বিরোধিতায় গেল না। মেসেজটা পরিষ্কারÑ সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়। মার্কিন নীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন, শুধু টিকফা চুক্তি করে সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়, তা তারা পারবে না। বিভিন্ন ইস্যুতে (যেমন ড. ইউনূস ইস্যু) মহাজোট সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল, শুধু একটি চুক্তি করে, তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। একটি নির্বাচিত সরকার এই চুক্তিটি করলে আরও ভালো করত। আমাদের দুর্ভাগ্য নির্বাচিত সংসদে এ ধরনের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চুক্তির ব্যাপারে আদৌ কোনো আলোচনা হলো না। এখন সরকারের উচিত হবে চুক্তিটি প্রকাশ করা। যাতে করে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হয়েছি। চুক্তি স্বাক্ষরই বড় কথা নয়, বড় কথা আমাদের স্বার্থ। এখন আমাদের দেখতে হবে এই চুক্তি করে আমরা কতটুকু লাভবান হলাম।
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ।
শেষ
পর্যন্ত বহুল আলোচিত টিকফা বা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন
ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি নির্বাচিত সরকার
তার টার্ম শেষ হওয়ার পর দেশে যখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব
গ্রহণ করেছে, ঠিক তখনই গত ২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত
হলো। সাধারণত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করে না।
তারা সাধারণত নির্বাচনসংক্রান্ত কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সরকার টিকফার মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করল। যদিও এটা ঠিক, ১৭ জুন মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। তারপরও সরকার পাঁচ মাস সময় নিল এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে। প্রশ্নটা এ কারণেই উঠেছে যে, মহাজোট সরকার জুনে নীতিগতভাবে এই চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিলেও তা ওই সময়ে স্বাক্ষর করল না কেন? কেনই বা একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য সরকার অপেক্ষা করল না? আরও অবাক করার বিষয়, টিকফার মতো একটি জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট চুক্তি নিয়ে জাতীয় সংসদে আদৌ আলোচনা হলো না? খুব সঙ্গত কারণেই তাই টিকফা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকাকে এখন একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিল। যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি, বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এখানেও একটি প্রশ্ন আছে। বিএনপির এই নেতার ‘অভিমত’ কী ব্যক্তিগত অভিমত, নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। কেননা বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনো সভায় এ চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এ তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে এরই মধ্যে বাম সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। সিপিবি-বাসদ ঢাকায় এই চুক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলও বের করেছে। তাদের অভিমত, এই চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। মজার কথা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুটি বাম দলের প্রতিনিধিত্ব (জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি) থাকলেও, টিকফা চুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, চুক্তিটিতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা আমাদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জেএসপির একটা যোগসূত্র আছে বলা হলেও, খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের আমাদের জানিয়েছেন, টিকফার সঙ্গে জেএসপি বা শুল্কমুক্ত ও প্রবেশাধিকারের কোনো যোগসূত্র নেই। তবে বাংলাদেশ জেএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে, এ রকমটিই আমাদের জানিয়েছেন ওয়াশিংটনে আমাদের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। তবে বলতেই হবে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ায়, তা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে।
বলা হচ্ছে, এতে করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে। দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরও টিকফা চুক্তির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, টিকফা স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করেছে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি আশুলিয়ায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল।
ফলে এক পর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এখন বাংলাদেশ সরকারের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে যে, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলে হয়তো বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় যে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছিল। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনও তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশী পণ্যে, তার মধ্যে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে।
গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশী রফতানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা ওই রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই তাহলে এই জিএসপি সুবিধা রফতানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারব না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করি তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলান যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে ‘উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে।’ ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে, কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো।
এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষ করে সেবা খাতে) এবং এসব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চ শিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব, তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত, তা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে।
সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে যে সরকার ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে পাঁচ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিকফা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় নয় ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে, কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পাবে। বাংলাদেশকে এখন চাল আমদানি করতে হয় না; কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষি পণ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, যারা গম ও চাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তাদের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। তিন. বলা হচ্ছে, টিকফা চুক্তি হলে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
কেননা, অত্যন্ত উচ্চ কর দিয়ে (১৫ দশমিক ৩ ভাগ) বাংলাদেশ তার রফতানি বাজার সম্প্রসারিত করেছে। অথচ চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর দেয়, মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। অথচ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিকফা চুক্তি নেই। চার. বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়বে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে। টিকফা চুক্তি কার্যকর হলে এই মেধাস্বত্ব আইনের শক্তি প্রয়োগ হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর, ওষুধ শিল্প ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা।
কৃষক আর বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য করা হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এক সময় জিম্মি করে ফেলবে আমাদের কৃষি সেক্টরকে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প উন্নয়নশীল দেশে নাম করলেও টিকফা চুক্তির পর এই শিল্প এক ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা, ওষুধ কোম্পানিগুলো প্যাটেন্ট কিনে কাঁচামাল আমদানি করে সস্তায় ওষুধ তৈরি করে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এই ওষুধ রফতানি হয়। এখন এই টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্যাটেন্ট ক্রয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগটি রয়েছে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে মার্কিন কোম্পানির লাইসেন্স কিনতে হবে। ওই লাইসেন্স দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়ার শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা এখন স্বল্পমূল্যে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে কম্পিউটার এ দেশেই সংযোজিত হয়। ফলে কম্পিউটারের দাম একটা ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু টিকফা চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে এই ‘ক্লোন কম্পিউটার’ আমদানি বা সংযোজন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে তখন ব্র্যান্ড কম্পিউটার আমদানি করতে হবে, যার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে অনেক। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে তা চলে যাবে। বাংলাদেশ যে ‘ডিজিটাল যুগের’ কথা বলছে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে তখন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, টিকফা চুক্তি করে বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাংলাদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলো এলে তাতে বাংলাদেশে ‘সেবার’ মান হয়তো বাড়বে। সেবা সেক্টরে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাস্থ্য খাতে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায়, তাতে সেবার মান বাড়বে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই ‘সেবার’ জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হবে। শিক্ষা খাতে মার্কিনি পুঁজি বিনিয়োগ হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে। যারা সার্টিফিকেট বিক্রি করে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারব। ক্ষতি হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখানে সরকারের বিনিয়োগ কমবে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা সহজলভ্য হয়তো হবে না; কিন্তু মেধাবী ছাত্রদের জন্য তা সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। তাদের বৃত্তির সংখ্যা বাড়বে। মেধার মূল্য হবে। এখন যেভাবে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হয়, তখন তা আর থাকবে না।
টিকফা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো বড় অসময়ে। যুক্তরাষ্ট্র এক যুগ আগেই বাংলাদেশকে এই চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা যে বাংলাদেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি করছে না, পৃথিবীর অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টিকফা চুক্তি রয়েছে। ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো উঠতি অর্থনৈতিক শক্তির দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের চুক্তি রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের ‘অবস্থান’কে কতটুকু শক্তিশালী করতে পেরেছে আমরা তা জানি না। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাংলাদেশ ‘নেগোসিয়েশনস’-এ কখনও সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে টিকফা নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্নে বাংলাদেশ তার স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে, আমরা তা জানি না। আগামী দিনগুলোই এর প্রমাণ করবে। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত করেই বলা যায়Ñ আর তা হচ্ছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ যদি এই চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে করে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি ইস্যু আলাদাভাবে দেখে। এ জন্য জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি কিংবা গার্মেন্ট শিল্পের পরিস্থিতির সঙ্গে টিকফা চুক্তিকে মেলান যাবে না। এটি একটি ভিন্ন ইস্যু।
টিকফার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তা, বিনিয়োগের গ্যারান্টি ও নিরাপত্তা, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, শ্রমমান বাড়ানোর পর এই চুক্তিতে জিএসপি সুবিধার প্রশ্নটি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লাটা এতে ভারি। বাংলাদেশের প্রাপ্তি এতে কম। তবে সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, রাজনীতির এই অনিশ্চয়তার মুখে বিরোধী দল সরকারের বিরোধিতায় গেল না। মেসেজটা পরিষ্কারÑ সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়। মার্কিন নীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন, শুধু টিকফা চুক্তি করে সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়, তা তারা পারবে না। বিভিন্ন ইস্যুতে (যেমন ড. ইউনূস ইস্যু) মহাজোট সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল, শুধু একটি চুক্তি করে, তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। একটি নির্বাচিত সরকার এই চুক্তিটি করলে আরও ভালো করত। আমাদের দুর্ভাগ্য নির্বাচিত সংসদে এ ধরনের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চুক্তির ব্যাপারে আদৌ কোনো আলোচনা হলো না। এখন সরকারের উচিত হবে চুক্তিটি প্রকাশ করা। যাতে করে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হয়েছি। চুক্তি স্বাক্ষরই বড় কথা নয়, বড় কথা আমাদের স্বার্থ। এখন আমাদের দেখতে হবে এই চুক্তি করে আমরা কতটুকু লাভবান হলাম।
য়ড. তারেক শামসুর রেহমান
কলাম লেখক ও শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। - See more at: http://www.alokitobangladesh.com/editorial/2013/11/29/36973#sthash.H68wuPBA.0LJ1dsYQ.dpuf
তারা সাধারণত নির্বাচনসংক্রান্ত কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সরকার টিকফার মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করল। যদিও এটা ঠিক, ১৭ জুন মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। তারপরও সরকার পাঁচ মাস সময় নিল এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে। প্রশ্নটা এ কারণেই উঠেছে যে, মহাজোট সরকার জুনে নীতিগতভাবে এই চুক্তির পক্ষে অবস্থান নিলেও তা ওই সময়ে স্বাক্ষর করল না কেন? কেনই বা একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য সরকার অপেক্ষা করল না? আরও অবাক করার বিষয়, টিকফার মতো একটি জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট চুক্তি নিয়ে জাতীয় সংসদে আদৌ আলোচনা হলো না? খুব সঙ্গত কারণেই তাই টিকফা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকাকে এখন একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিল। যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি, বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এখানেও একটি প্রশ্ন আছে। বিএনপির এই নেতার ‘অভিমত’ কী ব্যক্তিগত অভিমত, নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। কেননা বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনো সভায় এ চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এ তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে এরই মধ্যে বাম সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। সিপিবি-বাসদ ঢাকায় এই চুক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলও বের করেছে। তাদের অভিমত, এই চুক্তিতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। মজার কথা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুটি বাম দলের প্রতিনিধিত্ব (জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি) থাকলেও, টিকফা চুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। চুক্তিটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, চুক্তিটিতে ১৬টি অনুচ্ছেদ আর ৭টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা আমাদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০টি দেশের এ রকম চুক্তি রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তিটির সঙ্গে জেএসপির একটা যোগসূত্র আছে বলা হলেও, খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের আমাদের জানিয়েছেন, টিকফার সঙ্গে জেএসপি বা শুল্কমুক্ত ও প্রবেশাধিকারের কোনো যোগসূত্র নেই। তবে বাংলাদেশ জেএসপি সুবিধার দাবি অব্যাহত রাখবে, এ রকমটিই আমাদের জানিয়েছেন ওয়াশিংটনে আমাদের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। তবে বলতেই হবে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ায়, তা বিতর্কের মাত্রা বাড়িয়েছে।
বলা হচ্ছে, এতে করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে। দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরও টিকফা চুক্তির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, টিকফা স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পাবে। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে কিছু পণ্যের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাংলাদেশকে দিত, তা স্থগিত করেছে। স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল কারণটি ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমমান নিশ্চিত করার ব্যর্থতা। এমনকি আশুলিয়ায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে না পারা, তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট ছিল।
ফলে এক পর্যায়ে কংগ্রেস সদস্যদের চাপের মুখে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যায়। এখন বাংলাদেশ সরকারের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে যে, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলে হয়তো বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে টিকফা চুক্তির কোনো যোগসূত্র নেই। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় যে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, জিএসপি সুবিধা ফিরে পেলেও তাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বাড়বে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছিল। কিন্তু তৈরি পোশাকে আমাদের কোনো জিএসপি সুবিধা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের। এর মাঝে মাত্র ০.৫ ভাগ পণ্য এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। এর পরিমাণ মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার কর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখনও তার পণ্য নিয়ে টিকে আছে। মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় যেসব বাংলাদেশী পণ্যে, তার মধ্যে রয়েছে তামাক, সিরামিক, ফার্নিচার, প্লাস্টিক, খেলনা ইত্যাদি। এর খুব কম পণ্যই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে।
গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাকে বাংলাদেশী রফতানিকারকরা শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে বাজার ধরে রেখেছে। অথচ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিচ্ছে না। এই সুবিধা ওই রাষ্ট্রগুলো পায়। তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং তৈরি পোশাকে আমরা যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাই তাহলে এই জিএসপি সুবিধা রফতানির ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারব না। আজ যদি জিএসপি সুবিধার আশ্বাসে আমরা টিকফা চুক্তি করি তাতে আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিকফা চুক্তির সঙ্গে তাই জিএসপি সুবিধাকে মেলান যাবে না। জিএসপি সুবিধা একটি ভিন্ন বিষয়।
এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে টিকফা চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশে মার্কিনি বিনিয়োগ বাড়বে, এটা সত্য কথা। এতে করে আমাদের বাজার, সেবা খাত উন্মুক্ত হয়ে যাবে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য। ব্যাপক প্রাইভেটাইজেশন ঘটবে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যক্তিগত খাত। টিকফা চুক্তির আওতায় ৫ ও ১৯ ধারা মতে ‘উভয় দেশ (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) বাণিজ্যে বেশ নমনীয় নীতি গ্রহণ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে।’ ৮নং ধারায় ব্যাপক ব্যক্তিগত খাত প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারায় একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কমিশন গঠন করার কথাও আছে। এদের কাজ হবে ব্যক্তিগত খাত কীভাবে আরও বিকশিত করা যায়, সে ব্যাপারে উভয় সরকারকে উপদেশ দেয়া। ৯নং ধারায় বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে, কিন্তু উৎপাদন খাতে জড়াবে না। অর্থাৎ কোনো পণ্য উৎপাদন করবে না। এখানে সমস্যা হবে অনেকগুলো।
এক. যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করবে (বিশেষ করে সেবা খাতে) এবং এসব কোম্পানিকে ট্যাক্স সুবিধা দিতে হবে। আইনে যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সেই আইন সংশোধন করতে হবে। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা মার খাবে। তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। দুই. চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ব্যবহার, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে গেলে শিক্ষা খাত পণ্যে পরিণত হবে। বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে। উচ্চ শিক্ষা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা ধনী, তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে, আর যারা গরিব, তারা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বেড়ে যাবে। এসব সেবামূলক খাত থেকে সাধারণ মানুষ যে ‘সেবা’ পেত, তা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে তখন বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে।
সাধারণ গ্রাহককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস কিনতে হবে। সরকারি ভর্তুকির কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে কৃষি ও আইটি সেক্টর। কৃষিতে যে সরকার ভর্তুকি দেয়, তা আর দিতে পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষিতে পাঁচ ভাগের বেশি ভর্তুকি দিতে পারবে না। টিকফা চুক্তির ১৮নং ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। মজার ব্যাপার, যুক্তরাষ্ট্র নিজে কৃষিতে ভর্তুকি দেয় নয় ভাগ। এখন বাংলাদেশে কৃষি সেক্টরে ভর্তুকি কমানো হলে, কৃষিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। কৃষক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে চাল উৎপাদন হ্রাস পাবে। বাংলাদেশকে এখন চাল আমদানি করতে হয় না; কিন্তু উৎপাদন হ্রাস পেলে মার্কিন কৃষি পণ্যের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, যারা গম ও চাল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তাদের এক বিশাল বাজার তৈরি হবে বাংলাদেশে। তিন. বলা হচ্ছে, টিকফা চুক্তি হলে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই।
কেননা, অত্যন্ত উচ্চ কর দিয়ে (১৫ দশমিক ৩ ভাগ) বাংলাদেশ তার রফতানি বাজার সম্প্রসারিত করেছে। অথচ চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর দেয়, মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। অথচ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো টিকফা চুক্তি নেই। চার. বাংলাদেশ বড় সমস্যায় পড়বে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে। টিকফা চুক্তি কার্যকর হলে এই মেধাস্বত্ব আইনের শক্তি প্রয়োগ হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের কৃষি সেক্টর, ওষুধ শিল্প ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা।
কৃষক আর বীজ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বীজ কিনতে বাধ্য করা হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এক সময় জিম্মি করে ফেলবে আমাদের কৃষি সেক্টরকে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প উন্নয়নশীল দেশে নাম করলেও টিকফা চুক্তির পর এই শিল্প এক ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কেননা, ওষুধ কোম্পানিগুলো প্যাটেন্ট কিনে কাঁচামাল আমদানি করে সস্তায় ওষুধ তৈরি করে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এই ওষুধ রফতানি হয়। এখন এই টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্যাটেন্ট ক্রয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগটি রয়েছে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে মার্কিন কোম্পানির লাইসেন্স কিনতে হবে। ওই লাইসেন্স দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে হবে। ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ওষুধ ক্রয় করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়ার শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা এখন স্বল্পমূল্যে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে কম্পিউটার এ দেশেই সংযোজিত হয়। ফলে কম্পিউটারের দাম একটা ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। কিন্তু টিকফা চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে এই ‘ক্লোন কম্পিউটার’ আমদানি বা সংযোজন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশকে তখন ব্র্যান্ড কম্পিউটার আমদানি করতে হবে, যার মূল্য গিয়ে দাঁড়াবে অনেক। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে তা চলে যাবে। বাংলাদেশ যে ‘ডিজিটাল যুগের’ কথা বলছে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে তখন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, টিকফা চুক্তি করে বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাংলাদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলো এলে তাতে বাংলাদেশে ‘সেবার’ মান হয়তো বাড়বে। সেবা সেক্টরে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাস্থ্য খাতে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায়, তাতে সেবার মান বাড়বে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই ‘সেবার’ জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হবে। শিক্ষা খাতে মার্কিনি পুঁজি বিনিয়োগ হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে। যারা সার্টিফিকেট বিক্রি করে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারব। ক্ষতি হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখানে সরকারের বিনিয়োগ কমবে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়িয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা সহজলভ্য হয়তো হবে না; কিন্তু মেধাবী ছাত্রদের জন্য তা সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। তাদের বৃত্তির সংখ্যা বাড়বে। মেধার মূল্য হবে। এখন যেভাবে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হয়, তখন তা আর থাকবে না।
টিকফা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো বড় অসময়ে। যুক্তরাষ্ট্র এক যুগ আগেই বাংলাদেশকে এই চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এটা যে বাংলাদেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি করছে না, পৃথিবীর অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টিকফা চুক্তি রয়েছে। ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো উঠতি অর্থনৈতিক শক্তির দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের চুক্তি রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের ‘অবস্থান’কে কতটুকু শক্তিশালী করতে পেরেছে আমরা তা জানি না। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাংলাদেশ ‘নেগোসিয়েশনস’-এ কখনও সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে টিকফা নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্নে বাংলাদেশ তার স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে, আমরা তা জানি না। আগামী দিনগুলোই এর প্রমাণ করবে। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত করেই বলা যায়Ñ আর তা হচ্ছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ যদি এই চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে করে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি ইস্যু আলাদাভাবে দেখে। এ জন্য জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি কিংবা গার্মেন্ট শিল্পের পরিস্থিতির সঙ্গে টিকফা চুক্তিকে মেলান যাবে না। এটি একটি ভিন্ন ইস্যু।
টিকফার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তা, বিনিয়োগের গ্যারান্টি ও নিরাপত্তা, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, শ্রমমান বাড়ানোর পর এই চুক্তিতে জিএসপি সুবিধার প্রশ্নটি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লাটা এতে ভারি। বাংলাদেশের প্রাপ্তি এতে কম। তবে সরকারের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, রাজনীতির এই অনিশ্চয়তার মুখে বিরোধী দল সরকারের বিরোধিতায় গেল না। মেসেজটা পরিষ্কারÑ সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়। মার্কিন নীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন, শুধু টিকফা চুক্তি করে সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করতে চায়, তা তারা পারবে না। বিভিন্ন ইস্যুতে (যেমন ড. ইউনূস ইস্যু) মহাজোট সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল, শুধু একটি চুক্তি করে, তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। একটি নির্বাচিত সরকার এই চুক্তিটি করলে আরও ভালো করত। আমাদের দুর্ভাগ্য নির্বাচিত সংসদে এ ধরনের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চুক্তির ব্যাপারে আদৌ কোনো আলোচনা হলো না। এখন সরকারের উচিত হবে চুক্তিটি প্রকাশ করা। যাতে করে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে চুক্তি করে আমরা কতটুকু উপকৃত হয়েছি। চুক্তি স্বাক্ষরই বড় কথা নয়, বড় কথা আমাদের স্বার্থ। এখন আমাদের দেখতে হবে এই চুক্তি করে আমরা কতটুকু লাভবান হলাম।
য়ড. তারেক শামসুর রেহমান
কলাম লেখক ও শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। - See more at: http://www.alokitobangladesh.com/editorial/2013/11/29/36973#sthash.H68wuPBA.0LJ1dsYQ.dpuf
২৯ নভেম্বর , ২০১৩।
0 comments:
Post a Comment