ক’দিন আগে রাতে দুটি ফোন। একটি সিঙ্গাপুর থেকে অপরটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সিঙ্গাপুরে পিএইচডি করছে আমার এক অনুজপ্রতিম যে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অপরজন আমার বন্ধুপ্রতিম, নিউইয়র্কের বাসিন্দা। দুজনের প্রশ্ন একটাই-কোন পথে এখন দেশ? আমরা যাচ্ছি কোন দিকে? এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হই আমি প্রায়শই। সপ্তাহতিনেক আগে যখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম, তখনো এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি আমি। যুক্তরাষ্ট্রে চার মাসের ওপরে ছিলাম। নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন, হিউস্টন, ডালাস, হাইল্যান্ড ভিলেজ, যেখানেই আমি গেছি, প্রতিটি জায়গাতে বাংলাদেশিদের মাঝে আমি উৎকণ্ঠা দেখেছি। হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি প্রতিনিয়ত। আমরা কি সত্যি সত্যিই এ দেশ চেয়েছিলাম? আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? এ জন্য আমরা কাদের দায়ী করব? গত দু’সপ্তাহের সারাদেশের যে পরিস্থিতি, তাতে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না। এ ধরনের দৃশ্য আগে কেউ কখনো দেখেনি। এমনকি সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ক্ষমতা নিল, তখনো আমরা এ দৃশ্য দেখিনি! ঢাকা তৃতীয়বারের মতো অবরোধ হয়ে আছে। ৭ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখ থেকে আবার ৭২ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হয়েছে। এরপর আসছে আরো কর্মসূচি। এর মাঝে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো। এরশাদের নাটকীয়ভাবে ‘তথাকথিত সর্বদলীয়’ সরকারে যোগদান ও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণার পর আবার আরেক ‘নাটকের’ জন্ম দিলেন তিনি গেল ৩ ডিসেম্বর, এবারে তার ঘোষণা তিনি নির্বাচন বয়কট করেছেন! তার সেই বিখ্যাত ‘বেইমান তত্ত্ব’ এরপর এবার তিনি হাজির হলেন ‘এক চুলও নড়বো না তত্ত্ব’ নিয়ে। না! তিনি যাচ্ছেন না নির্বাচনে! ৬ ডিসেম্বর আবার দিলেন নতুন দুটি শর্ত। এরশাদ কি এর মাধ্যমে কোনো মেসেজ দিয়ে দিলেন? সব কথাই কি সাজানো? দেশে জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট রচনার জন্যই কি এসব ‘নাটক!’ যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নিয়ে কথা বলেন, তারা এরশাদের সব কিছুতেই একটি ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এরই মাঝে ঢাকায় ঘুরে গেলেন সুজাতা সিং, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। বললেন, তার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আলোচনা’ ফলপ্রসূ হয়েছে। ৫ দিনের জন্য এসেছেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ও রাজনীতি বিভাগের প্রধান অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ৯ তারিখে আসছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি। ১৫ তারিখে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক মন্ত্রী। অনেকটা যেন কোরামিনের মতো, ‘রোগীকে’ মৃত্যুর আগে শেষ চেষ্টা করা। যাতে রোগী বাঁচে। তারানকোর ‘রাজনৈতিক কোরামিন’ কি বাংলাদেশের ‘মৃত্যু পথযাত্রী’, ‘রাজনীতিকে’ বাঁচাতে পারবে? এর আগে নিশা দেশাই ঘুরে গেলেন। গত ৩ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে নিশা দেশাই বললেন, ‘বিদেশিরা নয়। দেশেই এর সমাধান খুঁজতে হবে।’ এখন সুজাতা, তারানকো আমরা কি বিদেশিদের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছি না বারবার। টকশোতে দেখলাম বিদগ্ধজনরা খুব উৎসাহী। তারানকো একটা সমাধান দিয়ে যাবেন?
জাতিসংঘের এই দূত সরকারের কাছে কী ধরনের প্রস্তাব রাখবেন? এর আগে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে দু’দুবার বাংলাদেশে এসেছিলেন তারানকো। দু’দুবারই তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ইতোমধ্যেই পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্রথমবারের টানা অবরোধের পর দ্বিতীয়বারের টানা ৭২ ঘণ্টার অবরোধ শেষ করেছে বিরোধী ১৮ দল। শুরু হয়েছে তৃতীয়বার অবরোধ। সরকারও হার্ডলাইনে গেছে। ‘শাহবাগে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়’ হুকুমের আসামি হয়েছেন বিএনপির তথা জামায়াতের ১৭ শীর্ষ নেতা। এর আগেই বিএনপির আরো ৫ নেতা জেলে আটক। তাদেরও রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে বোধকরি সরকার একটা মেসেজই দিতে চাচ্ছে আর তা হচ্ছে সরকার ‘সংলাপ’ এর কথা বললেও এতটুকুও ছাড় দিতে নারাজ! ‘সংলাপ’ এর কথা বারে বারে বললেও, ‘সংলাপ’ এখন ডিপফ্রিজে। এর সম্ভাবনা আদৌ নেই। এর মধ্যে ঘটল রুহুল কবির রিজভীর ‘নাটকীয়’ গ্রেফতারের ঘটনা। তিনি ‘শাহবাগে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়’ অভিযুক্ত। কিন্তু তাকে এভাবে গ্রেফতার করতে হবে কেন? গভীর রাতে, মই বেয়ে, গ্রিল কেটে ডিবি যে অভিযান ‘পরিচালনা’ করেছে তা কি একটি গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব? একজন অসুস্থ মানুষ রিজভী। স্টিক ছাড়া তিনি হাঁটতে পারেন না এটা পুলিশ অফিসারদের না জানার কথা নয়। তাকে গ্রেফতারের সময় তাকে স্টিকটি বহন করার সুযোগ দেয়া হলে কী ক্ষতি হতো? এমন কোনো পরিবেশও সৃষ্টি হয়নি এই সময় যে তিনি পালিয়ে যাবেন! এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তে পুলিশের ভাবমূর্তি কতটুকু উজ্জ্বল হবে আমি জানি না। কিন্তু আমি বুঝি সমঝোতা যেখানে অগ্রাধিকার, সেখানে এ ধরনের ‘ঘটনা’ এই সমঝোতায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ। ওই তারিখে নির্বাচন আদৌ হবে সে আস্থাটা রাখতে পারছি না। সারাদেশ যেখানে ‘জ্বলছে’, যেখানে প্রার্থীদের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, বিক্ষুব্ধ জনতা একাধিকবার রেলের ফিশপ্লেট তুলে রেল যোগাযোগে বিঘœ ঘটাচ্ছে, সেখানে নির্বাচন হবে, সেই আস্থাটা রাখতে পারছি না। নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে পারল না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সিইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নিজেকে ‘সাবেক বিচারপতি এমএ আজিজের’ জায়গায় নিয়ে গেলেন। এমনকি সরকারের মিত্র এরশাদ সাহেবও তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার দাবি ছিল আরেকটু বেশি সময় দেয়ার। কিন্তু সিইসির নজর সেদিক ছিল না। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, অতীতে বিতর্কিত সিইসিরা যা করলেন, তিনি তাই করলেন। এখন ১৮ দল দাবি করেছে তার অপসারণের। কিন্তু তার পরও কি নির্বাচন হচ্ছে? ওবায়দুল কাদেরের ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’র তত্ত্ব বাস্তবে রূপ দেবে কিনা জানি না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণা সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ৩ ডিসেম্বর তার সরকারি বাসভবনে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করেছেন। তিনি বৈঠক করেছেন সেনাপ্রধানের সঙ্গে। সংবাদপত্র আমাদের এ খবর দিয়ে বলছে, গণভবনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে (সমকাল)। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ বাদে, জাতীয় পার্টি, ১৪ দল ও জেপির নেতারা। যেখানে এরশাদের ‘এক চুলও নড়বো না তত্ত্ব’ আমাদের জানান দিচ্ছে এরশাদের জাতীয় পার্টির নির্বাচনে না যাওয়ার কথা, সেখানে তার প্রতিনিধিরা ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এটাই হচ্ছে এরশাদের রাজনীতি! দেরিতে হলেও কাজী জাফর বুঝেছেন এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার ‘সংবাদপত্রের পাতায়’ আলোচনার প্রস্তাব দিলেও যখন শীর্ষ স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন, তখন তার ‘উদ্দেশ্য’ বুঝতে কারো বাকি থাকে না। আবারো বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ‘হত্যা-মামলা’ ও ‘গাড়ি পোড়ানোর’ মামলা দেয়া হয়েছে! একদিকে ‘সংলাপ’-এর কথা বলা আর অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া প্রকারান্তরে যে সরকারের একটা ভাওতাবাজি, এটা বুঝতে সাধারণ মানুষের বেশি বিদ্যার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই একটি আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সরকার যে ‘যেনতেন প্রকারে’ একটা নির্বাচন করতে চায়, এটা তাদের কর্মকাণ্ডেই প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের মাঝে বিরোধীপক্ষকে সহ্য করার কোনো মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। সরকারই চায় না ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটা নির্বাচন হোক। কেননা সরকারের কাছে এটা স্পষ্ট যে, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে ২০টা থেকে ৩০টার বেশি আসন পাবে না। তাই একটা নির্বাচন চাই যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ থাকবে না? কিন্তু তাতে ক্ষতি তো দেশের। গোটা বিশ্বেই আমাদের সেনা সদস্যরা চষে বেড়াচ্ছেন। তারা যেখানে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত, সেখানে আমাদের দেশে অশান্তি বিরাজ করবে এটা কাম্য নয়। অবরোধ-হরতালে সহিংসতা বাড়ে। অনেক পরিবার হয়েছেন অভিভাবকহীন। এদের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। কে এদের দেখবে। সুতরাং স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা জরুরি। উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। বিশ্বে তৈরি পোশাকে আমরা দ্বিতীয়। আমরা তৈরি পোশাকে একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরি করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা বা জেএসপি সুবিধা পাই না বটে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের বাজার আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। এর বড় অংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক। শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে আমরা আমাদের তৈরি পোশাকের বাজার ধরে রেখেছি। আমাদের ওষুধ শিল্প ৬২টি দেশে রফতানি হয়। ভারতের মতো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ শিল্পের একটা বিশাল বাজার গড়ে তুলেছে। আমাদেরও একটা সম্ভাবনা আছে আমাদের ওষুধ শিল্পের একটি বাজার যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তুলতে। ওইসব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে যদি আমরা একটা সমঝোতায় উপনীত হতে না পারি। সারাবিশ্ব যেখানে অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত, প্রবৃদ্ধি যেখানে ১ থেকে ২-এর কোটায় নেমে এসেছে, সেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি একেবারে কম নয়। কিন্তু সহিংসতা, সংলাপে সরকারের অনাগ্রহ ও সরকারের কঠোর মনোভাব আমাদের সব অর্জনকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেছে। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ নিয়ে শুনানি হয়েছে। সেখানে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো আশার কথা বলে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টেও শুনানি হয়েছে বাংলাদেশের ওপরে। তাদের অভিমত ‘পজেটিভ’ নয়। প্রভাবশালী আমেরিকান কোনো কোনো সংবাদপত্রে অভিমত দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশ অচিরেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে! আমরা এটা কেউই চাই না। বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বারে বারে নাক গলাচ্ছেন। একটা দেশের সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়।
এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের খবর। যে প্রতিষ্ঠান বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির জন্য বয়ে আনত ১ হাজার ২২০ কোটি টাকার যার সম্পদ ছিল, সেই সম্পদ এখন আগুনে পুড়ে কয়লা। কারা ওই প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগাল? পুলিশ কজনকে গ্রেফতার করেছে বটে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে গেছে পর্দার অন্তরালে। অবরোধের সুযোগ নিয়েছে সুযোগসন্ধানীরা। জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষতি করল দেশটির।
প্রধানমন্ত্রী একটি নির্বাচন চান। এই নির্বাচন তাকে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় না। প্রধানমন্ত্রী একটি ‘সর্বদলীয়’ (?) সরকার গঠন করেছেন। এর মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এর প্রয়োজন ছিল না। অথচ সংবিধানে এভাবে কোথাও ‘সর্বদলীয়’ সরকারের ব্যাখ্যা নেই। সরকারপ্রধান সংবিধানের ৫৬(২) ধারা বলে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। কিন্তু তাকে যে কোনো নামে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু ‘সর্বদলীয় সরকার’ নামে ডাকা যাবে না। সর্বদলীয় সরকার হতে পারত, যদি সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকত। এখন মূলত যাদের মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তাদের গণভিত্তি নেই। যেমন বলা যেতে পারে জাসদের কথা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাসদ ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১টিতে বিজয়ী হয়েছিল। প্রাপ্ত ভোটের হার ৬ দশমিক ৫২ ভাগ। ১৯৭১ সালে ২৪০টি আসনে (দ্বিতীয় সাংসদ) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮টিতে বিজয়ী হয়েছিল। প্রাপ্ত ভোটের হার ৪ দশমিক ৮৩ ভাগ। ১৯৮৬ সালে রবের জাসদ পেয়েছিল ৪ দশমিক ৫৪ ভাগ ভোট। ১৯৯১ সালে ১টি আসন (১৬১টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে) ০.৭৯ ভাগ ভোট। ১৯৯৬ সালে রব জাসদ ১টি আসন, প্রাপ্ত ভোট ০.২৩ ভাগ ভোট। আর জাসদ ইনু কোনো আসন নাই, ০.০২ ভাগ ভোট মাত্র। অথচ এরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ৬৭ ও ৩১টি আসনে। ২০০১ সালে জাসদ ৭৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোনো আসন পায়নি, প্রাপ্ত ভোট ০.২১ ভাগ। ২০০৮ সালে ৩টি আসন পায়, প্রাপ্ত ভোট ০.৭৪ ভাগ। মজার কথা ইনু আর মঈনুদ্দিন বাদলরা ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওইসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল না। এবার আসুন, ওয়ার্কাস পার্টির ক্ষেত্রে। ২০০৮ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে মেনন ও বাদশা সাহেব দুটি আসন নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু প্রাপ্ত ভোট মাত্র ০.৩৮ ভাগ। ২০০১ সালে প্রাপ্ত ভোট (বাম দলগুলোর সঙ্গে) ০.২৫ ভাগ। ১৯৯৬ সালে, ১৯৯১ সালে প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে ০.১৩ ভাগ ও ০.১৯ ভাগ। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ সালে ৩টি আসন পেয়েছিল বটে (০.৫৩ ভাগ)। কিন্তু ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। জাতীয় পার্টিকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা দেয়া যেতে পারে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত ভোট গড়ে ৭ শতাংশের ওপরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যাদের গণভিত্তি এত দুর্বল, তাদের নিয়ে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্য কীভাবে নিশ্চিত করবেন? অবশ্যই একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। সমঝোতা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছিলেন সে কথা। সংলাপ, সমঝোতা কিছুই হলো না। বরং বিএনপির ৫ নেতা এখন কারাগারে। বেগম জিয়া দেখা করেছিলেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা সীমিত। তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি তা করবেনও না। সিদ্ধান্ত এখনো প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কিন্তু বিএনপির দাবি অনুযায়ী একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার তিনি করবেন। সেটা এখন চিন্তাও করা যায় না। এর অর্থ এখন পরিষ্কার। একটি নির্বাচন যদি হয়ও (?) সেখানে বিএনপি তো বটেই, জাতীয় পার্টিও থাকছে না। তাহলে এই নির্বাচন করে সরকারের অর্জন হবে কতটুকু? এরই মাঝে একটি ‘নাটকীয় ঘটনার’ অবতারণা হয়েছে গত বুধবার গভীর রাতে। দীর্ঘ ২৭ ঘণ্টার পর এরশাদের নিজ বাসায় ফিরে আসা সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠকের পর নির্বাচন না যাওয়া ও মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশের পর পুলিশ ও র্যাব তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে তিনি আত্মহত্যা করারও হুমকি দেন! সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে তার কথোপকথনও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সুজাতা সিং তাকে (এরশাদ) নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। সুজাতা সিংয়ের ভাষায় জাপা নির্বাচন অংশ না নিলে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে! ভারত আমাদের বন্ধু দেশ। আমাদের উন্নয়নে ভারত আমাদের পার্টনার। কিন্তু ভারতের ‘একজন আমলা’ আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবে এটা প্রত্যাশিত নয়। আমাদের রাজনীতিবিদরাই আমাদের সমস্যার সমাধান করবেন এ বিশ্বাস আমাদের আছে। আজ তাই প্রয়োজন রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার প্রমাণ দেয়া। সহিংসতা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া সরকারের হাতে যেমন আর কোনো সুযোগ বাকি থাকবে না। অন্যদিকে তেমনি সরকারের হার্ডলাইনে আবার সিদ্ধান্তও কোনো ‘ভালো’ ফল বয়ে আনবে না। এতে মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ বাড়তে থাকবে। আমরা বারে বারে অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শক্তিকে দোষারোপ করছি। কিন্তু পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে ওই অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর দিকেই চোখ থাকবে সবার। এখনো সময় আছে একটা সমঝোতার। সুজাতা সিং কিংবা তারানাকো আমাদের কোনো সমাধান দিয়ে যাবে না। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। তাই প্রয়োজন দূরদর্শিতার। প্রয়োজন আন্তরিকতার। প্রয়োজন ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর বাস্তব প্রয়োগ। রাজনীতিবিদরা সেই কাজটিই করবেন আমাদের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক
জাতিসংঘের এই দূত সরকারের কাছে কী ধরনের প্রস্তাব রাখবেন? এর আগে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে দু’দুবার বাংলাদেশে এসেছিলেন তারানকো। দু’দুবারই তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ইতোমধ্যেই পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্রথমবারের টানা অবরোধের পর দ্বিতীয়বারের টানা ৭২ ঘণ্টার অবরোধ শেষ করেছে বিরোধী ১৮ দল। শুরু হয়েছে তৃতীয়বার অবরোধ। সরকারও হার্ডলাইনে গেছে। ‘শাহবাগে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়’ হুকুমের আসামি হয়েছেন বিএনপির তথা জামায়াতের ১৭ শীর্ষ নেতা। এর আগেই বিএনপির আরো ৫ নেতা জেলে আটক। তাদেরও রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে বোধকরি সরকার একটা মেসেজই দিতে চাচ্ছে আর তা হচ্ছে সরকার ‘সংলাপ’ এর কথা বললেও এতটুকুও ছাড় দিতে নারাজ! ‘সংলাপ’ এর কথা বারে বারে বললেও, ‘সংলাপ’ এখন ডিপফ্রিজে। এর সম্ভাবনা আদৌ নেই। এর মধ্যে ঘটল রুহুল কবির রিজভীর ‘নাটকীয়’ গ্রেফতারের ঘটনা। তিনি ‘শাহবাগে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়’ অভিযুক্ত। কিন্তু তাকে এভাবে গ্রেফতার করতে হবে কেন? গভীর রাতে, মই বেয়ে, গ্রিল কেটে ডিবি যে অভিযান ‘পরিচালনা’ করেছে তা কি একটি গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব? একজন অসুস্থ মানুষ রিজভী। স্টিক ছাড়া তিনি হাঁটতে পারেন না এটা পুলিশ অফিসারদের না জানার কথা নয়। তাকে গ্রেফতারের সময় তাকে স্টিকটি বহন করার সুযোগ দেয়া হলে কী ক্ষতি হতো? এমন কোনো পরিবেশও সৃষ্টি হয়নি এই সময় যে তিনি পালিয়ে যাবেন! এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তে পুলিশের ভাবমূর্তি কতটুকু উজ্জ্বল হবে আমি জানি না। কিন্তু আমি বুঝি সমঝোতা যেখানে অগ্রাধিকার, সেখানে এ ধরনের ‘ঘটনা’ এই সমঝোতায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ। ওই তারিখে নির্বাচন আদৌ হবে সে আস্থাটা রাখতে পারছি না। সারাদেশ যেখানে ‘জ্বলছে’, যেখানে প্রার্থীদের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, বিক্ষুব্ধ জনতা একাধিকবার রেলের ফিশপ্লেট তুলে রেল যোগাযোগে বিঘœ ঘটাচ্ছে, সেখানে নির্বাচন হবে, সেই আস্থাটা রাখতে পারছি না। নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে পারল না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সিইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নিজেকে ‘সাবেক বিচারপতি এমএ আজিজের’ জায়গায় নিয়ে গেলেন। এমনকি সরকারের মিত্র এরশাদ সাহেবও তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার দাবি ছিল আরেকটু বেশি সময় দেয়ার। কিন্তু সিইসির নজর সেদিক ছিল না। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, অতীতে বিতর্কিত সিইসিরা যা করলেন, তিনি তাই করলেন। এখন ১৮ দল দাবি করেছে তার অপসারণের। কিন্তু তার পরও কি নির্বাচন হচ্ছে? ওবায়দুল কাদেরের ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’র তত্ত্ব বাস্তবে রূপ দেবে কিনা জানি না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণা সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ৩ ডিসেম্বর তার সরকারি বাসভবনে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করেছেন। তিনি বৈঠক করেছেন সেনাপ্রধানের সঙ্গে। সংবাদপত্র আমাদের এ খবর দিয়ে বলছে, গণভবনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে (সমকাল)। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ বাদে, জাতীয় পার্টি, ১৪ দল ও জেপির নেতারা। যেখানে এরশাদের ‘এক চুলও নড়বো না তত্ত্ব’ আমাদের জানান দিচ্ছে এরশাদের জাতীয় পার্টির নির্বাচনে না যাওয়ার কথা, সেখানে তার প্রতিনিধিরা ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এটাই হচ্ছে এরশাদের রাজনীতি! দেরিতে হলেও কাজী জাফর বুঝেছেন এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার ‘সংবাদপত্রের পাতায়’ আলোচনার প্রস্তাব দিলেও যখন শীর্ষ স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন, তখন তার ‘উদ্দেশ্য’ বুঝতে কারো বাকি থাকে না। আবারো বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ‘হত্যা-মামলা’ ও ‘গাড়ি পোড়ানোর’ মামলা দেয়া হয়েছে! একদিকে ‘সংলাপ’-এর কথা বলা আর অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া প্রকারান্তরে যে সরকারের একটা ভাওতাবাজি, এটা বুঝতে সাধারণ মানুষের বেশি বিদ্যার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই একটি আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সরকার যে ‘যেনতেন প্রকারে’ একটা নির্বাচন করতে চায়, এটা তাদের কর্মকাণ্ডেই প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের মাঝে বিরোধীপক্ষকে সহ্য করার কোনো মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। সরকারই চায় না ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটা নির্বাচন হোক। কেননা সরকারের কাছে এটা স্পষ্ট যে, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে ২০টা থেকে ৩০টার বেশি আসন পাবে না। তাই একটা নির্বাচন চাই যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ থাকবে না? কিন্তু তাতে ক্ষতি তো দেশের। গোটা বিশ্বেই আমাদের সেনা সদস্যরা চষে বেড়াচ্ছেন। তারা যেখানে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত, সেখানে আমাদের দেশে অশান্তি বিরাজ করবে এটা কাম্য নয়। অবরোধ-হরতালে সহিংসতা বাড়ে। অনেক পরিবার হয়েছেন অভিভাবকহীন। এদের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। কে এদের দেখবে। সুতরাং স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা জরুরি। উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। বিশ্বে তৈরি পোশাকে আমরা দ্বিতীয়। আমরা তৈরি পোশাকে একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরি করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা বা জেএসপি সুবিধা পাই না বটে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের বাজার আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। এর বড় অংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক। শতকরা ১৫ ভাগ হারে শুল্ক পরিশোধ করে আমরা আমাদের তৈরি পোশাকের বাজার ধরে রেখেছি। আমাদের ওষুধ শিল্প ৬২টি দেশে রফতানি হয়। ভারতের মতো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ শিল্পের একটা বিশাল বাজার গড়ে তুলেছে। আমাদেরও একটা সম্ভাবনা আছে আমাদের ওষুধ শিল্পের একটি বাজার যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তুলতে। ওইসব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে যদি আমরা একটা সমঝোতায় উপনীত হতে না পারি। সারাবিশ্ব যেখানে অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত, প্রবৃদ্ধি যেখানে ১ থেকে ২-এর কোটায় নেমে এসেছে, সেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি একেবারে কম নয়। কিন্তু সহিংসতা, সংলাপে সরকারের অনাগ্রহ ও সরকারের কঠোর মনোভাব আমাদের সব অর্জনকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেছে। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ নিয়ে শুনানি হয়েছে। সেখানে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য কোনো আশার কথা বলে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টেও শুনানি হয়েছে বাংলাদেশের ওপরে। তাদের অভিমত ‘পজেটিভ’ নয়। প্রভাবশালী আমেরিকান কোনো কোনো সংবাদপত্রে অভিমত দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশ অচিরেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে! আমরা এটা কেউই চাই না। বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বারে বারে নাক গলাচ্ছেন। একটা দেশের সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়।
এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের খবর। যে প্রতিষ্ঠান বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির জন্য বয়ে আনত ১ হাজার ২২০ কোটি টাকার যার সম্পদ ছিল, সেই সম্পদ এখন আগুনে পুড়ে কয়লা। কারা ওই প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগাল? পুলিশ কজনকে গ্রেফতার করেছে বটে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে গেছে পর্দার অন্তরালে। অবরোধের সুযোগ নিয়েছে সুযোগসন্ধানীরা। জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষতি করল দেশটির।
প্রধানমন্ত্রী একটি নির্বাচন চান। এই নির্বাচন তাকে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় না। প্রধানমন্ত্রী একটি ‘সর্বদলীয়’ (?) সরকার গঠন করেছেন। এর মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এর প্রয়োজন ছিল না। অথচ সংবিধানে এভাবে কোথাও ‘সর্বদলীয়’ সরকারের ব্যাখ্যা নেই। সরকারপ্রধান সংবিধানের ৫৬(২) ধারা বলে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। কিন্তু তাকে যে কোনো নামে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু ‘সর্বদলীয় সরকার’ নামে ডাকা যাবে না। সর্বদলীয় সরকার হতে পারত, যদি সেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকত। এখন মূলত যাদের মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তাদের গণভিত্তি নেই। যেমন বলা যেতে পারে জাসদের কথা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাসদ ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১টিতে বিজয়ী হয়েছিল। প্রাপ্ত ভোটের হার ৬ দশমিক ৫২ ভাগ। ১৯৭১ সালে ২৪০টি আসনে (দ্বিতীয় সাংসদ) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮টিতে বিজয়ী হয়েছিল। প্রাপ্ত ভোটের হার ৪ দশমিক ৮৩ ভাগ। ১৯৮৬ সালে রবের জাসদ পেয়েছিল ৪ দশমিক ৫৪ ভাগ ভোট। ১৯৯১ সালে ১টি আসন (১৬১টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে) ০.৭৯ ভাগ ভোট। ১৯৯৬ সালে রব জাসদ ১টি আসন, প্রাপ্ত ভোট ০.২৩ ভাগ ভোট। আর জাসদ ইনু কোনো আসন নাই, ০.০২ ভাগ ভোট মাত্র। অথচ এরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ৬৭ ও ৩১টি আসনে। ২০০১ সালে জাসদ ৭৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোনো আসন পায়নি, প্রাপ্ত ভোট ০.২১ ভাগ। ২০০৮ সালে ৩টি আসন পায়, প্রাপ্ত ভোট ০.৭৪ ভাগ। মজার কথা ইনু আর মঈনুদ্দিন বাদলরা ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওইসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল না। এবার আসুন, ওয়ার্কাস পার্টির ক্ষেত্রে। ২০০৮ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে মেনন ও বাদশা সাহেব দুটি আসন নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু প্রাপ্ত ভোট মাত্র ০.৩৮ ভাগ। ২০০১ সালে প্রাপ্ত ভোট (বাম দলগুলোর সঙ্গে) ০.২৫ ভাগ। ১৯৯৬ সালে, ১৯৯১ সালে প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে ০.১৩ ভাগ ও ০.১৯ ভাগ। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ সালে ৩টি আসন পেয়েছিল বটে (০.৫৩ ভাগ)। কিন্তু ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। জাতীয় পার্টিকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা দেয়া যেতে পারে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত ভোট গড়ে ৭ শতাংশের ওপরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যাদের গণভিত্তি এত দুর্বল, তাদের নিয়ে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্য কীভাবে নিশ্চিত করবেন? অবশ্যই একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। সমঝোতা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছিলেন সে কথা। সংলাপ, সমঝোতা কিছুই হলো না। বরং বিএনপির ৫ নেতা এখন কারাগারে। বেগম জিয়া দেখা করেছিলেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা সীমিত। তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি তা করবেনও না। সিদ্ধান্ত এখনো প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কিন্তু বিএনপির দাবি অনুযায়ী একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার তিনি করবেন। সেটা এখন চিন্তাও করা যায় না। এর অর্থ এখন পরিষ্কার। একটি নির্বাচন যদি হয়ও (?) সেখানে বিএনপি তো বটেই, জাতীয় পার্টিও থাকছে না। তাহলে এই নির্বাচন করে সরকারের অর্জন হবে কতটুকু? এরই মাঝে একটি ‘নাটকীয় ঘটনার’ অবতারণা হয়েছে গত বুধবার গভীর রাতে। দীর্ঘ ২৭ ঘণ্টার পর এরশাদের নিজ বাসায় ফিরে আসা সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠকের পর নির্বাচন না যাওয়া ও মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশের পর পুলিশ ও র্যাব তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে তিনি আত্মহত্যা করারও হুমকি দেন! সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে তার কথোপকথনও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সুজাতা সিং তাকে (এরশাদ) নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। সুজাতা সিংয়ের ভাষায় জাপা নির্বাচন অংশ না নিলে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে! ভারত আমাদের বন্ধু দেশ। আমাদের উন্নয়নে ভারত আমাদের পার্টনার। কিন্তু ভারতের ‘একজন আমলা’ আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবে এটা প্রত্যাশিত নয়। আমাদের রাজনীতিবিদরাই আমাদের সমস্যার সমাধান করবেন এ বিশ্বাস আমাদের আছে। আজ তাই প্রয়োজন রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার প্রমাণ দেয়া। সহিংসতা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া সরকারের হাতে যেমন আর কোনো সুযোগ বাকি থাকবে না। অন্যদিকে তেমনি সরকারের হার্ডলাইনে আবার সিদ্ধান্তও কোনো ‘ভালো’ ফল বয়ে আনবে না। এতে মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ বাড়তে থাকবে। আমরা বারে বারে অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক শক্তিকে দোষারোপ করছি। কিন্তু পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে ওই অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর দিকেই চোখ থাকবে সবার। এখনো সময় আছে একটা সমঝোতার। সুজাতা সিং কিংবা তারানাকো আমাদের কোনো সমাধান দিয়ে যাবে না। আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। তাই প্রয়োজন দূরদর্শিতার। প্রয়োজন আন্তরিকতার। প্রয়োজন ‘রিয়েল পলিটিকস’-এর বাস্তব প্রয়োগ। রাজনীতিবিদরা সেই কাজটিই করবেন আমাদের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক
দৈনিক মানবকন্ঠ, ৮ ডিসেম্বর ২০১৩।
- See more at: http://manobkantha.com/2013/12/08/150034.html#sthash.7zogJwwK.dpuf
- See more at: http://manobkantha.com/2013/12/08/150034.html#sthash.7zogJwwK.dpuf
0 comments:
Post a Comment