রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাজনীতি কোন পথে


আগামী দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এর মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগের আবার ১৩০ জন। বৃহস্পতিবার ছিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর ভিত্তিতেই সংবাদপত্রগুলো এ পরিসংখ্যান আমাদের দিয়েছে। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে ৫ জানুয়ারি। কিন্তু তারপরও দেখি বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংলাপ হচ্ছে। তারানকোর ঢাকা সফরের পর তিন দফা সংলাপ হয়ে গেছে। তাহলে কী নির্বাচন ওই তারিখে হচ্ছেই! এরই মধ্যে এরশাদ গ্রেফতারের ‘নাটক’ হয়েছে। এরশাদ এখন সিএমএইচে। তিনি একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন ওখান থেকে যে, তিনি অসুস্থ নন। ‘তাকে আটকে রাখা হয়েছে’। এর আগে আমরা সংবাদপত্র থেকে জানলাম, র‌্যাব তাকে বারিধারার বাসা থেকে তুলে নিয়ে ‘চিকিৎসার’ জন্য সিএমএইচে নিয়ে গেছে! র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তিনি চিকিৎসা নিতে সিএমএইচে ভর্তি হয়েছেন। র‌্যাব তাকে শুধু নিরাপত্তাই দিয়েছে। তিনি ‘চিকিৎসা নিচ্ছেন’ (?) তিনি বলছেন, তিনি অসুস্থ নন আর র‌্যাব বলছে তিনি অসুস্থ! ‘এরশাদ নাটক’-এর শেষ এখনও হয়নি। তিনি নিজে নির্বাচনে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন করলেও, তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হয়নি। তিনি রংপুরে প্রার্থী রয়ে গেছেন। তার দল থেকে ৬ জন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, তারা এখনও ‘মন্ত্রী’ বা ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে আছেন কিনা, তাও স্পষ্ট নয়। কেননা এ সংক্রান্ত কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি। মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়েও কম ‘নাটক’ হয়নি।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন। ২৪ জানুয়ারির আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবেÑ এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তথা ১৮ দল আন্দোলন করে আসছে একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য। তারা অনেকটা এক জায়গায় এসে তাদের আন্দোলনকে কেন্দ্রীভূত করেছিলÑ শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি ছেড়ে দেন, তাহলে যে কোনো ‘ফর্মুলায়’ তারা সমঝোতায় যেতে রাজি। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। তাই আমরা প্রত্যক্ষ করছি, একের পর এক হরতাল আর অবরোধ। বাড়ছে সহিংসতা। দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা এখন অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রে প্রতিদিন যেসব ছবি আমরা দেখছি, তা কোনো আশার কথা বলে না। রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। শত শত গাছ কেটে অবরোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।
অথচ পরিবেশ রক্ষার জন্য এ গাছগুলো আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। এরই মধ্যে ঘটে গেল কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনা। এতে করে সহিংসতা আরও বেড়েছে। সহিংসতায় জানমালের ক্ষতি হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় কী? সমস্যাটা রাজনৈতিক। এর সমাধান করতে হবে রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের। অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা কোনো সামাধানে আসতে পারছেন না। এমনকি তারানকোর মতো একজন জাতিসংঘের দূত বাংলাদেশে ৫ দিন অবস্থান করেও সে সমাধান দিয়ে যেতে পারলেন না। ‘সংলাপ’ হচ্ছে। তৃতীয় দফা শেষ হয়েছে শুক্রবার। এটা তো সময়ক্ষেপণ করার শামিল। নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তনের আর কোনো সুযোগ নেই। এখন তত্ত্বগতভাবে একটা ‘সমঝোতা’ হলেও, ৫ তারিখ নির্বাচন পেছানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তারানকো ‘ছাড়’ দেয়ার যে মানসিকতার কথা বলেছিলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এটা বড্ড প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো পক্ষ, বিশেষ করে সরকারি পক্ষ এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হয়েছিল বলেও মনে হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা অর্পণ করে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারত। যদিও এ ক্ষেত্রে সংবিধান একটি বাধা। তারপরও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে যদি কোনো ‘সমঝোতায়’ আমরা পৌঁছতে পারতাম, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সংবিধানের আওতায় কীভাবে এটা সম্ভব, সে ব্যাপারে আমরা উচ্চ আদালতের রেফারেন্সের জন্য তা পাঠাতে পারতাম। ঐকমত্যটা যেখানে জরুরি ছিল, সেখানে ‘স্টেট অব নেসেসিটির’ ধারণাকে মাথায় রেখে উচ্চ আদালত থেকে রেফারেন্স নিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারতাম। তারানকোর সেই ‘ছাড়’ দেয়ার আহ্বানে সরকারি দলকে আমরা এতটুকুও নমনীয় হতে দেখলাম না। শেষ অব্দি ‘বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন’ যদি না আসে, তাহলে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হতে যাচ্ছে! যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের ‘পদত্যাগপত্র’ এখন অব্দি গ্রহণ করা হয়নি, একই প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগও আর থাকল না। এ ক্ষেত্রে এরশাদের ‘প্রত্যাহারের সেই নির্দেশ’ কাগজ-কলমেই থেকে গেল! নির্বাচনে একটি ‘বড় পক্ষ’ দরকার। জাতীয় পার্টি হতে যাচ্ছে সেই ‘বড় পক্ষ’, যারা দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে! নিঃসন্দেহে সংবিধান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে।
প্রধানমন্ত্রী জানতেন, বিএনপি না যাওয়ায় এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে নির্বাচনের আগে। এখন আগামীর ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে চিহ্নিত হবেন, জানি না। কিন্তু জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরে তিনি যদি নিজেকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে নিতেন, ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত। এ সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেল এখন। সংলাপ হয়তো আরও হবে। কিন্তু আমাদের ‘মাইন্ড সেটআপ’-এ পরিবর্তন না আসায়, এ থেকে ফল আসা করা যায় না। কেননা এখানে সব পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। তারানকো দু’দলকে সংলাপে বসাতে পেরে নিজেকে ‘সফল’ মনে করেছেন বটে; কিন্তু এই ‘সফলতার’ মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সেটি হচ্ছেও না।
আজ তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন কিংবা আমির হোসেন আমুর মতো ঝানু রাজনীতিবিদ ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়েছেন। তারা তাদের নামের প্রতি কতটুকু ‘সৎ’ থাকলেন, আমি নিশ্চিত নই। তারা অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদ। জাতি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। কিন্তু ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে’ যে সংসদে তারা যাবেন, সেই সংসদ থেকে তাদের পাওয়ার কিছু আছে কি? নির্বাচন মানেই তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জনগণের আস্থা নেয়া। তিনি বা তার দল যে কর্মসূচি নিয়েছে, তার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা। কিন্তু এখন কী হলো?
সরকারি দলের নেতারা বারবার ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলেন। ওই সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। কিন্তু ওই সংসদেও তো এ রকম পরিস্থিতি ছিল না? ওই সংসদে ৪৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু এবার এই সংখ্যা ১৫৪। যে নির্বাচনে আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না, সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার যুক্তি কী? শুধু সংবিধানের দোহাই গ্রহণযোগ্য নয়, পৃথিবীর বহু দেশে ‘জাতির বৃহত্তম স্বার্থের’ খাতিরে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। যেখানে ‘জাতির স্বার্থ’ জড়িত, সেখানে সংবিধান বড় ‘বিষয়’ হতে পারে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের রাজনীতিবিদরা এটা উপলব্ধি করতে পারলেন না। দেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ জরুরি। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অবরোধের ছবিগুলো দেখি, তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই! যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি, সেখানে তাদের সবার নামেই মামলা! হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেকটি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ গ্রেফতারের কাহিনী! এতে করে কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে?
এটা সত্য, বিরোধী দল এই অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাকে কি বিশ্বাস করতে হবে, এ নেতারা বাসে পেট্রল বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু’একজন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি কেন? এ দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রল বোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় একটা পরিবারকে, তারা তো জনগণের ‘বন্ধু’ হতে পারে না। এরা জনগণের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, ‘হুকুমের আসামি’ হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়, তাহলে তো আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। অবরোধের কারণে আমরা এখন ‘জিম্মি’। স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এই পরিস্থিতিতে গুজব যে কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, তার বড় প্রমাণ আমরা দেখলাম গাজীপুরে ২৯ নভেম্বর। পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহতের গুজব ছড়িয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আগুন দেয়া হয়েছিল গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় অবস্থিত স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের পোশাক কারখানাগুলোতে। আগুন লাগার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে ১ হাজার ২০২ কোটি টাকার সম্পদ।
রোববার আলোকিত বাংলাদেশের পাতায় ছাপা হয়েছিল স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের মালিক প্রকৌশলী মোশারফ হোসেনের কান্নার ছবি। এ ঘটনায় আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল, আমাদের রাজনীতিবিদরা কতটুকু বুঝতে পেরেছেন জানি না। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় যখন বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেয় বৈকি! এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের একটি অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের নয়া পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ৬ ডিসেম্বর এসেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো। এরপর এসেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ওয়ারসি। বোঝা যায়, বাংলাদেশের সহিংস ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন বিশ্ব কমিউনিটি। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দল যখন ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে পারছে না, তখন জাতিসংঘ নিজ উদ্যোগে এখন কোনো উদ্যোগ নেবে কিনা? কিংবা তা উভয় পক্ষের মাঝে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা? অনেকে এ ধরনের ধারণা পোষণ করেন; কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগ আমাদের সংবিধান অনুমোদন করে না।
সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন কমিশন গঠন ও এর দায়িত্ব সম্পর্কে (১১৮-১২৬নং ধারা) বলা হয়েছে। সংবিধানের আওতায় জাতিসংঘকে এ ধরনের সুযোগ দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দু’পক্ষ যদি রাজিও হয়, তাহলেও ‘সংবিধানের আওতায়’ কীভাবে জাতিসংঘকে অনুমতি দেয়া যায়, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মতামত নিতে হবে। তবে এটা সত্যÑ সংঘাত, গৃহযুদ্ধকবলিত দেশে জাতিসংঘ এ ধরনের ‘দায়িত্ব’ পালন করে থাকে। যেমন বলা যেতে পারে নেপাল, হাইতি, তিমুর, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, লাইবেরিয়া, কম্পুচিয়ার কথা। কম্পুচিয়ায় ১৯৯৩ সালে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের আওতায় সে নির্বাচন বাংলাদেশের সেনারা পরিচালনা করেছিল। নেপালের কথা বলা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রেজ্যুলেশন ১৭৪০ অনুযায়ী সেখানে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি ‘সহায়তা গ্রুপ’ গঠন করেছিল। এটা সত্য, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এসব দেশে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ওইসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো মিল নেই।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট রয়েছে, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা একটা রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি। একটা সংবিধান আছে। সংবিধানের ধারা-উপধারা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার পরপরই দেশ একটি সংবিধান পেয়েছিল। কঙ্গো বা লাইবেরিয়ায় কোনো স্বীকৃত সংবিধান ছিল না। গৃহযুদ্ধ সেখানকার রাজনীতি নির্ধারণ করত। বাংলাদেশে এমনটি নেই। তবুও এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক যে, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ‘সমঝোতার’ জন্য এ দেশে আসবেন! আমরা বারবার বলে আসছি, সমঝোতা হতে হবে প্রধান দুই শক্তির মাঝে একদিকে সরকার, অন্যদিকে বিরোধী দল। এখানে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দিতে হবে। ‘ছাড়’ না দিলে সমঝোতা হবে না। সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই একটা সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। আর যত ‘বিদেশিদের’ আমরা এড়াতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। এজন্যই দরকার ছিল রাজনৈতিক দূরদর্শিতার। সেইসঙ্গে প্রয়োজন ছিল পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা পারলেন না। বিশেষ করে সরকারি দলের নেতাদের ওপর দায়িত্বটি ছিল আরও বেশি। কিন্তু তারা তা পারলেন না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়ে গেছে। নতুন তফসিল ঘোষণার আর সুযোগও নেই। ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদের জন্য প্রস্তাবিত তফসিল করা হয়েছিল বটে; কিন্তু তা করা হয়েছিল ‘জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট’ বলে। এখন এই মুহূর্তে এটা করা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন এখন উঠতেই স্পষ্টতই একটা সমঝোতা দরকার। এ ক্ষেত্রে সংবিধান কোনো বাধা হবে না বলে আমি মনে করি। আমাদের সামনে অতীত অভিজ্ঞতা আছে। সমঝোতার ক্ষেত্রে, ঐকমত্যের ক্ষেত্রে সংবিধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সংবিধানের ১১তম সংশোধনী (বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের স্বপদে ফিরে যাওয়া) এর বড় প্রমাণ। আজ সহিংসতা বন্ধে একটি সমঝোতা বড় প্রয়োজন। সরকার একটি নির্বাচন করে ফেলতে পারবে, এটা সত্য। কিন্তু ওই নির্বাচনই সব কথা নয়। দেশের স্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাÑ এসব আজ সরকারকে ভাবতে হবে। সরকার এ জাতির অভিভাবক। আমরা চাই না, বারে বারে বিদেশিরা এসে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করুক। অনেক সম্ভাবনা আছে এই দেশটির। প্রয়োজন শুধু স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
একটি ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির একটি প্রস্তাবের খবর আমরা জানতে পেরেছি। তত্ত্বাবধায়ক নয় বরং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করেছে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদলে তারা প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রপতি, স্পিকার অথবা পরিকল্পনামন্ত্রীকে প্রধান করে একটি সরকার, যে সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে। দশম সংসদ নির্বাচনে এই ‘ফর্মুলা’ আদৌ কার্যকরী করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ রাজি হলে, দশম সংসদে এটা সংবিধানের অংশ হতে পারে। তারপর একাদশ সংসদ নির্বাচন এই ফর্মুলার আলোকে হতে পারে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ ফর্মুলার আলোকে আয়োজন করা সম্ভব নয়। তবুও আমরা চাই, একটা সমঝোতা হোক। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই সমঝোতাটি প্রয়োজন।
Daily Alokito Bangladesh
18.12.13

0 comments:

Post a Comment