রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি' এবং প্রসঙ্গ কথা




বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ২৯ ডিসেম্বর রবিবার 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি'তে অংশ নেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এটা অনেকটা লং মার্চের মতো। সব শ্রেণীর মানুষকে তিনি ওই দিন ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি তথা ১৮ দল সরকারবিরোধী যে আন্দোলন করছে, তার অংশ হিসেবেই তিনি এই আহ্বান জানালেন। তিনি গণতন্ত্র রক্ষায় যে ডেমোক্রেসি মার্চের আহ্বান জানিয়েছেন, তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে এটা তিনি আহ্বান করলেন এমন একটা সময়, যখন নির্বাচনের বাকি আছে আর মাত্র ১১ দিন। আগামী ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। যদিও এরই মধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় 'নির্বাচিত' হয়েছেন এবং বাকি ১৪৬ আসনে সেই অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা নির্বাচনের অর্থই হচ্ছে জয়-পরাজয়। কিন্তু ওই আসনগুলোয় আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কিংবা সেখানে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এখন যে অভিযোগটি সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে, তা হচ্ছে সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে আরো আলোচনার সুবিধার্থে নির্বাচনের তারিখ আরো ৯০ দিন পিছিয়ে দিতে পারত। সংবিধানের ১২৩(৪) ধারা অনুসরণ করে এবং উচ্চ আদালতের একটি রেফারেন্স নিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সরকার তা করেনি। সরকার 'ভোটারবিহীন' একটি নির্বাচন করতে চায়। সরকারের দরকার একটি সংসদ। সেই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও সরকারের কাছে ওই সংসদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে নানা কারণে। এমনি এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া মার্চ ফর ডেমোক্রেসির আহ্বান জানালেন। অতীতে বারবার দেখা গেছে বিএনপি কোনো কর্মসূচি দিলে নেতাদের কাউকে মাঠে পাওয়া যায় না। যদিও এটা ঠিক, বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা এখন জেলে অন্তরীণ। কিন্তু তার পরও যাঁরা বাইরে আছেন কিংবা ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের কাউকে দেখা যায় না। ফলে একটা বাজে ইমেজ তৈরি হয়েছে। কর্মসূচি দিয়ে মাঠে না থাকলে দল সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম হয়। খালেদা জিয়া যে চার দফা দাবি করেছেন, তার মধ্যে গণভোটের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, 'বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে।' তাঁর এই প্রস্তাবটি একটি ভালো প্রস্তাব। সংবিধানে যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং যা এখন সংবিধানের অংশ, সে ব্যাপারে জনগণের সমর্থন চাওয়া যেতে পারে। গণভোটে এটা যদি সমর্থন পায়, তাহলে বিরোধী পক্ষের আর বলার কিছু থাকবে না। খালেদা জিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জান-মাল রক্ষা করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা লক্ষ করেছি যে প্রায়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে। অতীতেও এটা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। অতীতে আওয়ামী লীগ এই সংখ্যালঘুর বিষয়টিকে ইস্যু করেছিল। আজ তাদের সরকারের সময় এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটবে? এ ব্যাপারে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, তাঁর দল আলোচনায় রাজি। এটা সত্য যে তারানকোর উপস্থিতিতে যে সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যাকে তারানকো তাঁর রিপোর্টে 'সফল' বলে দাবি করেছেন, সেই সংলাপ এখন 'ডিপফ্রিজে'। বর্তমান সংকটের জন্য খালেদা জিয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে দায়ী করেছেন এবং বলেছেন, সব পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব সরকারের। এটা অবশ্য মিথ্যা বলেননি তিনি। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল না করলে আজ আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচনটি দেখতাম (দশম সংসদ নির্বাচন)। উচ্চ আদালতের যে রায়ের ওপর নির্ভর করে এটা বাতিল করা হলো, তাতে আরো দুই টার্মের জন্য এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা ছিল উত্তম। এটি বাদ দেওয়ার পর থেকেই সব ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির একটি উদ্যোগের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। সংলাপ ও বিএনপির প্রস্তাবে এ রকমটি ছিল। এটা সত্য, সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নৈতিক অধিকার তাঁর রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীকে এই নির্বাচনে জড়িত না করানোর আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। যেখানে আদৌ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না, সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করাই মঙ্গল ছিল।
খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যে সমঝোতার একটি জট খোলার আহ্বান থাকলেও সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিতে তা দেখবে বলে মনে হয় না। সরকার ৫ তারিখের নির্বাচনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে গেছে। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে 'নাটক' করা হলো, তা সাধারণ একজন মানুষও বোঝে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি আরো কয়েক দফা ভাঙনের মুখোমুখি হলো। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি জাতিসংঘের আহ্বান (সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন) উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে কোনো ইতিবাচক সংবাদ বয়ে আনবে না। অর্থনীতি এখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। একটি দৈনিক আমাদের জানাচ্ছে, শুধু তৈরি পোশাক খাতে গত ২১ দিনে আমাদের ক্ষতি হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এই ক্ষতি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।
আমি জানি না আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব সংবাদ পড়েন কি না। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন কংগ্রেস বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যাতে করে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে পারে। সংঘাত যদি চলতেই থাকে, তাহলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি তাতে এড়াবে না। যেকোনো সদস্য দেশ 'প্রশ্ন' তুলতে পারে সেখানে। তাই সমঝোতাটা প্রয়োজন। খালেদা জিয়া কোনো হার্ড লাইনে যাননি। 'গণতন্ত্র অভিযাত্রা' মূলত সরকারকে চাপে রাখার একটি কৌশল। সরকার এই অভিযাত্রায় হস্তক্ষেপ না করে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারে এবং ভেঙে যাওয়া সংলাপ শুরু করে তার সদিচ্ছার পরিচয় দিতে পারে। আর বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে পারে সরকার। বল এখন সরকারের কোর্টে।
Daily Kalerkontho
26.12.13

0 comments:

Post a Comment