২৫ নভেম্বর ২০১৩ সোমবার সন্ধ্যেবেলায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। আগামী ৫ জানুয়ারি ২০১৪ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে একটি ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ’ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এই নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। বিএনপি এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। আর ২৬ নভেম্বর ২০১৩ মঙ্গলবার থেকেই শুরু হয়েছে লাগাতার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ। যদিও মির্জা ফখরুলের বক্তব্য থেকে আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, সিইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ আবারো তিন দিনের অবরোধ ও হরতালের মুখে পড়তে যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত তাই হলো। যদিও হরতাল আমাদের অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। এ দেশের মানুষ হরতাল দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপটটা কিছুটা ভিন্নতর। নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। এটা অনেকটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সংবিধান অনুসরণ করলে আগামী ২৪ জানুয়ারির আগেই নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আর তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন আয়োজন করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সিইসি বা নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই নেই। সংবিধান অনুযায়ী তিনি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। সেই নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কিনা, সব দলের অংশগ্রহণ তাতে থাকবে কিনা, এই দায়িত্বটি তার নয়। তবে তার মাঝে এক ধরনের আশঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা যে রয়েছে, তা তার বক্তব্যের মাঝে ফুটে উঠেছে। তিনি একাধিকবার বলেছেন সমঝোতার কথা। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন সব রাজনৈতিক দলের প্রতি, সমঝোতায় পৌঁছতে। কিন্তু এই ‘সমঝোতা’ বোধ করি এখন দুরূহ। প্রথমে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন, তারপর বিএনপিকে ‘যত খুশি তত মন্ত্রী হওয়ার’ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, মাঝখানে আশরাফ-ফখরুল সংলাপ নিয়ে ‘নাটক’, সব মিলিয়ে চলমান রাজনীতিতে যে অস্থিরতা তা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার মধ্যে দিয়ে অবসান হবে এমনটি মনে হয় না। বর্তমান ‘সর্বদলীয় সরকার’ এর কাঠামোয় বিএনপি তথা ১৮ দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাদের দাবি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। তাহলে স্পষ্টতই দেশ এক চরম অস্থিরতার মাঝে প্রবেশ করল। বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের জেলে রেখে, সংলাপের নামে এক ধরনের ‘নাটকই’ হলো বলা চলে। এখন সরকার বিদেশিদের উদ্বেগকে কীভাবে কাটিয়ে উঠবে? মার্কিন কংগ্রেসের পাশাপাশি ইউরোপীয় পার্লামেন্টও তো উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
বলা ভালো, মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২১ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে। ‘বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই শুনানিতে দুজন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। ওই শুনানিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দায়ী করা হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। শুনানিতে ৪২ জন কংগ্রেস সদস্য অংশ নেন এবং তারা অভিমত পোষণ করেন যে, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী তার দায় এড়াতে পারেন না। এদিকে অনেকটা একই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে (পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ) বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। এতে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া। অন্যদিকে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়বে এমনকি অবরোধের মধ্যেও পড়তে পারে। এখন মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ, প্রভাবশালী পত্রিকায় বিরূপ মন্তব্য করা কি আসলে কোনো মেসেজ পৌঁছে দিল আমাদের? একসময় যে বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল মুসলিম অধ্যুাষিত দেশ হিসেবে যে বাংলাদেশ একসময় সারাবিশ্বে প্রশংসিতও হয়েছিল, সেই সম্ভাবনা এখন ‘মৃত’। বিদেশে বাংলাদেশের নেতা ও নেত্রী সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করা হয় তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আরো দুঃখজনক হচ্ছে, দেশের ‘রাজনীতি’ সম্পর্কে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিরূপ মন্তব্য করছেন এবং তারা প্রকাশ্যে একটি ‘সমাধানের’ কথা বলছেন। আরো দুঃখ লাগে যখন দেখি বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার একটা ‘সমাধান’ দেয়ার চেষ্টা করছেন নয়াদিল্লির সাউথ ব্লক, আর ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস! মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম্ভাব্য একটি ‘সমাধান’ এর লক্ষ্যে যখন নয়াদিল্লি ছুটে যান, যখন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা দিল্লির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার নির্দেশ দেন, তখন বাংলাদেশের রাজনীতি আমাদের হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। তাই মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যখন উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়, আমি তাতে অবাক হই না। প্রধানমন্ত্রী ২৯ সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে এর নামকরণ করলেন ‘সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা।’ অথচ মূল ধারার প্রধান সংগঠন বিএনপি এতে নেই। সংবিধানে যেমনি ‘সর্বদলীয় সরকার’ এর ধারণা সমর্থন করে না, তেমনি করে না অনির্বাচিতদের উপদেষ্টা করা। এই সংখ্যা এখন ১১ জন। অথচ প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন তিনি অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতি নন। তাহলে ১১ জন উপদেষ্টা তিনি রাখেন কীভাবে? আমরা বারবার বলছি সমঝোতার কথা। সংলাপের কথা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো মির্জা ফখরুলের। কিন্তু দুঃখ লাগে যখন দেখি মির্জা ফখরুলের মতো একজন সিনিয়র নেতাকে ‘গাড়ি ভাংচুর’ এর অভিযোগে আসামি করে মামলা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী তো একাধিকবার বিভিন্ন জনসভায় বলেছেন, ‘দাওয়াত বহাল আছে। নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন নেই।’ বিরোধী দলীয় নেত্রীও প্রেসিডেন্টের কাছে ছুটে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আলোচনার জন্য এখনো অপেক্ষায় আছি আমরা।’ এ ক্ষেত্রে তো একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে সংলাপ হবে, আলোচনা হবে। কিন্তু হঠাৎ করে নেতাদের গ্রেফতার ও পরে নতুন মোড়কে নতুন মন্ত্রিসভা করা হলো। এই ‘একলা চলা নীতি’ এখন বিএনপি তথা ১৮ দলকে আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য করবে। আমরা দেখেছি ১৮ দল আবারো টানা অবরোধ ও হরতাল আহ্বান করেছে। এই হরতাল কারো কাছেই কাম্য নয়। সুধী সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই হরতাল চায় না। হরতালে সহিংসতা বাড়ে। মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ থাকে চরম এক নিরাপত্তাহীনতায়। কিন্তু তারপরও হরতালের মতো চরম কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেয় বড় দলগুলো। অতীতে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখনো তারা হরতাল ডেকেছে। আর সেই হরতালেও সহিংসতা হয়েছে। আজ বিএনপিও একই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। ধারণা করছি আগামীতে আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায় তাহলেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আজ উচ্চ আদালতকে হরতালের ব্যাপারে ‘হস্তক্ষেপ’ করতে বলা হচ্ছে। হাইকোর্টে রিট হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। রাজনৈতিক বিষয় রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। আজ বিএনপি ও ১৮ দল বারে বারে লাগাতার কর্মসূচির কথা বলছে। একটি ‘সমাধান’ না হলে, হয়তো আমরা এর চাইতেও আরো কঠোর কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করব। এর জন্য কাদের দায়ী করব? বিরোধী দলকে? সরকার নিশ্চয়ই তার দায় এড়াতে পারে না। মন্ত্রীদের পদত্যাগ নাটকের পর ২৯ সদস্যবিশিষ্ট ও ১১ জন সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা হলো। তারা কারা? শতকরা মাত্র ৭ ভাগ ভোট জাতীয় পার্টির। এই দলের মন্ত্রী ৭ জন। ইনু-মেননরা কোনোদিন ‘মশাল’ আর ওয়ার্কার্স পার্টির দলীয় মার্কা নিয়ে জিততে পারেননি। নৌকায় (২০০৮) উঠে কোনো রকমে সংসদে এসেছেন। যাদের ভোটের সংখ্যা ০.৭৪ ভাগ (জাসদ, ২০০৮), আর ০.৩৮ ভাগ (ওয়ার্কার্স পার্টি, ২০০৮), তারাও এখন মন্ত্রী। আর ৩৮ ভাগের ওপরে প্রতিনিধিত্বকারীদের (চার দল) কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। তালে প্রশ্ন হলো, এই সরকার সর্বদলীয় সরকার হয় কী করে? এক দলের এক নেতাও আজ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা। দৈনিক পত্রিকার মালিক, সাংবাদিক নেতা তিনিও উপদেষ্টা। এ সংখ্যা হয়তো বাড়বে। এই সরকার মূলত জোট সরকারেরই নয়া রূপান্তর। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই বলা হচ্ছে সর্বদলীয় সরকার। যেখানে আদৌ কোনো উপদেষ্টার প্রয়োজন নেই, সেখানে উপদেষ্টা রাখা হয়েছে ১১ জন। জনগণ আজ চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। তাদের করণীয় কিছু নেই। যেখানে নির্বাচনকালীন একটি সরকারের যারা নিরপেক্ষ থাকবেন, প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাহলো না। মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা কেউই নিরপেক্ষ নন। তাদের প্রায় সবাই নির্বাচন করবেন। সিইসি যতই বলুন না কেন নির্বাচনী প্রচারণায় তারা নিরপেক্ষ থাকবেন না। থাকতে পারবেন না। সবাই ‘মন্ত্রীর’ প্রটোকল নিয়ে মিডিয়া ব্যবহার করে নির্বাচন করবেন। তখন সিইসির কিইবা করার থাকবে? মিডিয়া হয়তো বিষয়টি তুলে ধরবে। কিন্তু তাতে কি ‘মন্ত্রীদের’ প্রচারণা বন্ধ হবে? তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই প্রশ্ন বারবার উঠবে। বর্তমান সংকট আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে একটি ‘স্থায়ী ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে কিংবা একটি গার্ডিয়ান কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সরকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশনও গঠন করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দীর্ঘ ১৭ বছর আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে একটি নিশ্চয়তা দিয়েছিল। এখন তা ইতিহাস। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই নতুন একটি স্থায়ী ব্যবস্থা দরকার। নির্বাচন কমিশন তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেনি। সিইসি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও কমিশনের সদস্যরা সরকার কর্তৃক মনোনীত। তারা তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারেননি। আমাদের নির্বাচন কমিশনাররা যেভাবে মিডিয়ায় ‘কভার’ পাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন, পৃথিবীর কোথাও এমনটি দেখা যায় না। এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল বিগত নির্বাচন কমিশনের সময় থেকেই। এই প্রবণতা এখনো বহাল। সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে ‘শক্তিশালী’ করার যে কথা বলা হয় তা মূলত ‘কথার কথা।’ বর্তমান কাঠামোয় নির্বাচন কমিশন সরকারের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র ঝুঁকির মুখে। একদিকে নির্বাচন প্রক্রিয়া যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, ঠিক তেমনই ক্ষমতার মোহ ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা নতুন এক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত ভারতীয় গণতন্ত্রের যেমন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনই রাশিয়ায় ব্যক্তিনির্ভর যে গণতন্ত্র, তারও কোনো মিল নেই। আবার মালয়েশিয়ার বহুদলীয় কোয়ালিশননির্ভর যে গণতন্ত্র, তার সঙ্গেও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে স্বমহিমায় যে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, সেখানে ব্যক্তির কর্তৃত্বই প্রধান। সিঙ্গাপুরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গেও এখানে রয়েছে পার্থক্য। প্রধান বিরোধী দলকে আস্থায় না নেয়া, রাজনীতিতে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়া, সুশাসনের অভাব বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। মূল ধারার রাজনৈতিক শক্তিকে আস্থায় না নিলে, কোনো প্রক্রিয়াই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা। এরশাদ পারেননি, পারবেন না শেখ হাসিনাও। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল না করেও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের ভিতকে আরো শক্তিশালী করা যেত। আজ তাই প্রয়োজন ছিল রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার। প্রয়োজন ছিল রিয়্যাল পলিটিকসের। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা প্রমাণ করতে পারলেন না। সিইসি বলেছেন, সমঝোতায় পৌঁছতে। কিন্তু এখন বোধকরি সেই সম্ভাবনা টুকুও নেই। সরকার কি পারবে এক দলীয়ভাবে নির্বাচন করে তার ‘লেজিটেমেসি’ বাড়াতে? জাতীয় পার্টি বাদে বাকিদের গ্রহণযোগ্যতা কী? সরকার ছোট দলের নেতাকে মন্ত্রী তথা উপদেষ্টা করে একটা বাজে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিল। সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ধারণা হয়েছে যে, বড় দল না করেও মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হওয়া যায়। ব্যক্তি এরশাদ চূড়ান্ত মুহূর্তে সরকারি টোপে পা দিয়ে কী পেলেন জানি না; তবে বহুল আলোচিত সেই গুজবটিকেই ‘সত্য’ প্রমাণ করলেন। সরকারি দলের সঙ্গে তার আঁতাতের যে খবর মিডিয়া তথা রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছিল সেটাই এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। নীতি, নৈতিকতা বলে আর কিছু থাকল না। রাজনীতিবিদরা সৎ থাকবেন এটাই কাম্য। কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে যারা মন্ত্রী হলেন, তারা ইতিহাসে কীভাবে চিহ্নিত হবেন এখন? এরশাদ কখনোই গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। তিনি বারবার নির্বাচিত হয়ে আসছেন-এটা সত্য কথা। কিন্তু তার নৈতিকতা আজ তাকে অন্যরকমভাবে চিহ্নিত করেছে। হয়তো আরো কিছুদিন তিনি দাপিয়ে বেড়াতে পারবেন রাজনীতিতে। কিন্তু তার দল? চূড়ান্ত বিচারে এই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে। আর এর জন্য আমাদের আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।
এতদিন আমাদের যে ধারণা তাই সত্য বলে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। দেশে একদলীয় নির্বাচন হচ্ছে! জাতীয় পার্টি এখন মন্ত্রিসভায় থাকলেও দশম জাতীয় সংসদে তার দলকেই পালন করতে হবে বিরোধী দলের ভূমিকা। আর জীবনে প্রতিটি নির্বাচনে ‘জামানত’ হারানো দীলিপ বড়–য়ারা এবার ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আসতে পারেন। ‘একমাত্র নেতা’ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপির সংসদে সদস্য সংখ্যা এবার একের অধিক হবে, তা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আর আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমরা এখন অনেকটা হটকারী রাজনীতির কাছে ‘জিম্মি’ হয়ে গেলাম। মানুষকে এখন সহিংসতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিত্যদিনের কাজ করতে হবে। ‘সব দলের অংশগ্রহণে যে নির্বাচন’ যা গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত, তা এখন স্পষ্টতই লঙ্ঘিত হতে যাচ্ছে। সিইসি জনগণের প্রত্যাশার কথা বলেছেন। তিনি মিথ্যা বলেননি। জনগণের প্রত্যাশা ছিল সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এখন প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান। মন্ত্রীরা দলীয়ভাবে বিভক্ত, সবাই আবার সরকারি জোটের সদস্যও। সেই নির্বাচন কি আদৌ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে? আমরা সিইসির মতো প্রত্যাশা করতেই পারি। আমাদের দুঃখ যে, বিতর্কিত সিইসিদের তালিকায় কাজী রকিব উদ্দীনও শেষ পর্যন্ত নাম লেখালেন। সার্চ কমিটির মাধ্যমে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও ‘সিসটেম’ই শেষ পর্যন্ত তাকে বিতর্কিত করল। তিনি নিজেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারলেন না। সরকারের ‘চাপ’ তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। বাংলাদেশ ২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বরের ‘নাটকের’ পুনরাভিনয়ই আবার দেখতে যাচ্ছে। ওই দিন তৎকালীন সিইসি বিচারপতি এমএ আজিজ একটি নির্বাচনের সিডিউল দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচন অবিশ্যি তিনি আর করতে পারেননি। আজ কি বর্তমান সিইসিও সেই বিচারপতি আজিজের ভাগ্যই বরণ করতে যাচ্ছেন? সম্ভবত বাংলাদেশ এক কঠিন সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উঠে এসেছে সত্য। কিন্তু তা হয়তো হবে না। কিন্তু আমাদের ভাবমূর্তির চরম ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা এটা বোঝেন না, আমাদের দুঃখটা এখানেই।
বলা ভালো, মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২১ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে। ‘বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই শুনানিতে দুজন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। ওই শুনানিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দায়ী করা হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। শুনানিতে ৪২ জন কংগ্রেস সদস্য অংশ নেন এবং তারা অভিমত পোষণ করেন যে, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী তার দায় এড়াতে পারেন না। এদিকে অনেকটা একই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে (পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ) বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। এতে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া। অন্যদিকে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়বে এমনকি অবরোধের মধ্যেও পড়তে পারে। এখন মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ, প্রভাবশালী পত্রিকায় বিরূপ মন্তব্য করা কি আসলে কোনো মেসেজ পৌঁছে দিল আমাদের? একসময় যে বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল মুসলিম অধ্যুাষিত দেশ হিসেবে যে বাংলাদেশ একসময় সারাবিশ্বে প্রশংসিতও হয়েছিল, সেই সম্ভাবনা এখন ‘মৃত’। বিদেশে বাংলাদেশের নেতা ও নেত্রী সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করা হয় তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আরো দুঃখজনক হচ্ছে, দেশের ‘রাজনীতি’ সম্পর্কে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিরূপ মন্তব্য করছেন এবং তারা প্রকাশ্যে একটি ‘সমাধানের’ কথা বলছেন। আরো দুঃখ লাগে যখন দেখি বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার একটা ‘সমাধান’ দেয়ার চেষ্টা করছেন নয়াদিল্লির সাউথ ব্লক, আর ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস! মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম্ভাব্য একটি ‘সমাধান’ এর লক্ষ্যে যখন নয়াদিল্লি ছুটে যান, যখন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা দিল্লির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার নির্দেশ দেন, তখন বাংলাদেশের রাজনীতি আমাদের হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। তাই মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যখন উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়, আমি তাতে অবাক হই না। প্রধানমন্ত্রী ২৯ সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে এর নামকরণ করলেন ‘সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা।’ অথচ মূল ধারার প্রধান সংগঠন বিএনপি এতে নেই। সংবিধানে যেমনি ‘সর্বদলীয় সরকার’ এর ধারণা সমর্থন করে না, তেমনি করে না অনির্বাচিতদের উপদেষ্টা করা। এই সংখ্যা এখন ১১ জন। অথচ প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন তিনি অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতি নন। তাহলে ১১ জন উপদেষ্টা তিনি রাখেন কীভাবে? আমরা বারবার বলছি সমঝোতার কথা। সংলাপের কথা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো মির্জা ফখরুলের। কিন্তু দুঃখ লাগে যখন দেখি মির্জা ফখরুলের মতো একজন সিনিয়র নেতাকে ‘গাড়ি ভাংচুর’ এর অভিযোগে আসামি করে মামলা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী তো একাধিকবার বিভিন্ন জনসভায় বলেছেন, ‘দাওয়াত বহাল আছে। নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন নেই।’ বিরোধী দলীয় নেত্রীও প্রেসিডেন্টের কাছে ছুটে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আলোচনার জন্য এখনো অপেক্ষায় আছি আমরা।’ এ ক্ষেত্রে তো একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে সংলাপ হবে, আলোচনা হবে। কিন্তু হঠাৎ করে নেতাদের গ্রেফতার ও পরে নতুন মোড়কে নতুন মন্ত্রিসভা করা হলো। এই ‘একলা চলা নীতি’ এখন বিএনপি তথা ১৮ দলকে আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য করবে। আমরা দেখেছি ১৮ দল আবারো টানা অবরোধ ও হরতাল আহ্বান করেছে। এই হরতাল কারো কাছেই কাম্য নয়। সুধী সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই হরতাল চায় না। হরতালে সহিংসতা বাড়ে। মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ থাকে চরম এক নিরাপত্তাহীনতায়। কিন্তু তারপরও হরতালের মতো চরম কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেয় বড় দলগুলো। অতীতে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখনো তারা হরতাল ডেকেছে। আর সেই হরতালেও সহিংসতা হয়েছে। আজ বিএনপিও একই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। ধারণা করছি আগামীতে আওয়ামী লীগ যদি বিরোধী দলে যায় তাহলেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আজ উচ্চ আদালতকে হরতালের ব্যাপারে ‘হস্তক্ষেপ’ করতে বলা হচ্ছে। হাইকোর্টে রিট হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। রাজনৈতিক বিষয় রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। আজ বিএনপি ও ১৮ দল বারে বারে লাগাতার কর্মসূচির কথা বলছে। একটি ‘সমাধান’ না হলে, হয়তো আমরা এর চাইতেও আরো কঠোর কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করব। এর জন্য কাদের দায়ী করব? বিরোধী দলকে? সরকার নিশ্চয়ই তার দায় এড়াতে পারে না। মন্ত্রীদের পদত্যাগ নাটকের পর ২৯ সদস্যবিশিষ্ট ও ১১ জন সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা হলো। তারা কারা? শতকরা মাত্র ৭ ভাগ ভোট জাতীয় পার্টির। এই দলের মন্ত্রী ৭ জন। ইনু-মেননরা কোনোদিন ‘মশাল’ আর ওয়ার্কার্স পার্টির দলীয় মার্কা নিয়ে জিততে পারেননি। নৌকায় (২০০৮) উঠে কোনো রকমে সংসদে এসেছেন। যাদের ভোটের সংখ্যা ০.৭৪ ভাগ (জাসদ, ২০০৮), আর ০.৩৮ ভাগ (ওয়ার্কার্স পার্টি, ২০০৮), তারাও এখন মন্ত্রী। আর ৩৮ ভাগের ওপরে প্রতিনিধিত্বকারীদের (চার দল) কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। তালে প্রশ্ন হলো, এই সরকার সর্বদলীয় সরকার হয় কী করে? এক দলের এক নেতাও আজ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা। দৈনিক পত্রিকার মালিক, সাংবাদিক নেতা তিনিও উপদেষ্টা। এ সংখ্যা হয়তো বাড়বে। এই সরকার মূলত জোট সরকারেরই নয়া রূপান্তর। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই বলা হচ্ছে সর্বদলীয় সরকার। যেখানে আদৌ কোনো উপদেষ্টার প্রয়োজন নেই, সেখানে উপদেষ্টা রাখা হয়েছে ১১ জন। জনগণ আজ চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। তাদের করণীয় কিছু নেই। যেখানে নির্বাচনকালীন একটি সরকারের যারা নিরপেক্ষ থাকবেন, প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাহলো না। মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা কেউই নিরপেক্ষ নন। তাদের প্রায় সবাই নির্বাচন করবেন। সিইসি যতই বলুন না কেন নির্বাচনী প্রচারণায় তারা নিরপেক্ষ থাকবেন না। থাকতে পারবেন না। সবাই ‘মন্ত্রীর’ প্রটোকল নিয়ে মিডিয়া ব্যবহার করে নির্বাচন করবেন। তখন সিইসির কিইবা করার থাকবে? মিডিয়া হয়তো বিষয়টি তুলে ধরবে। কিন্তু তাতে কি ‘মন্ত্রীদের’ প্রচারণা বন্ধ হবে? তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এই প্রশ্ন বারবার উঠবে। বর্তমান সংকট আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে একটি ‘স্থায়ী ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে কিংবা একটি গার্ডিয়ান কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সরকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশনও গঠন করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দীর্ঘ ১৭ বছর আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে একটি নিশ্চয়তা দিয়েছিল। এখন তা ইতিহাস। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থেই নতুন একটি স্থায়ী ব্যবস্থা দরকার। নির্বাচন কমিশন তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেনি। সিইসি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও কমিশনের সদস্যরা সরকার কর্তৃক মনোনীত। তারা তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারেননি। আমাদের নির্বাচন কমিশনাররা যেভাবে মিডিয়ায় ‘কভার’ পাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন, পৃথিবীর কোথাও এমনটি দেখা যায় না। এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল বিগত নির্বাচন কমিশনের সময় থেকেই। এই প্রবণতা এখনো বহাল। সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে ‘শক্তিশালী’ করার যে কথা বলা হয় তা মূলত ‘কথার কথা।’ বর্তমান কাঠামোয় নির্বাচন কমিশন সরকারের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র ঝুঁকির মুখে। একদিকে নির্বাচন প্রক্রিয়া যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, ঠিক তেমনই ক্ষমতার মোহ ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা নতুন এক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত ভারতীয় গণতন্ত্রের যেমন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনই রাশিয়ায় ব্যক্তিনির্ভর যে গণতন্ত্র, তারও কোনো মিল নেই। আবার মালয়েশিয়ার বহুদলীয় কোয়ালিশননির্ভর যে গণতন্ত্র, তার সঙ্গেও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে স্বমহিমায় যে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, সেখানে ব্যক্তির কর্তৃত্বই প্রধান। সিঙ্গাপুরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গেও এখানে রয়েছে পার্থক্য। প্রধান বিরোধী দলকে আস্থায় না নেয়া, রাজনীতিতে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়া, সুশাসনের অভাব বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। মূল ধারার রাজনৈতিক শক্তিকে আস্থায় না নিলে, কোনো প্রক্রিয়াই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা। এরশাদ পারেননি, পারবেন না শেখ হাসিনাও। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল না করেও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের ভিতকে আরো শক্তিশালী করা যেত। আজ তাই প্রয়োজন ছিল রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার। প্রয়োজন ছিল রিয়্যাল পলিটিকসের। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা প্রমাণ করতে পারলেন না। সিইসি বলেছেন, সমঝোতায় পৌঁছতে। কিন্তু এখন বোধকরি সেই সম্ভাবনা টুকুও নেই। সরকার কি পারবে এক দলীয়ভাবে নির্বাচন করে তার ‘লেজিটেমেসি’ বাড়াতে? জাতীয় পার্টি বাদে বাকিদের গ্রহণযোগ্যতা কী? সরকার ছোট দলের নেতাকে মন্ত্রী তথা উপদেষ্টা করে একটা বাজে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিল। সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ধারণা হয়েছে যে, বড় দল না করেও মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হওয়া যায়। ব্যক্তি এরশাদ চূড়ান্ত মুহূর্তে সরকারি টোপে পা দিয়ে কী পেলেন জানি না; তবে বহুল আলোচিত সেই গুজবটিকেই ‘সত্য’ প্রমাণ করলেন। সরকারি দলের সঙ্গে তার আঁতাতের যে খবর মিডিয়া তথা রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছিল সেটাই এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। নীতি, নৈতিকতা বলে আর কিছু থাকল না। রাজনীতিবিদরা সৎ থাকবেন এটাই কাম্য। কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে যারা মন্ত্রী হলেন, তারা ইতিহাসে কীভাবে চিহ্নিত হবেন এখন? এরশাদ কখনোই গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। তিনি বারবার নির্বাচিত হয়ে আসছেন-এটা সত্য কথা। কিন্তু তার নৈতিকতা আজ তাকে অন্যরকমভাবে চিহ্নিত করেছে। হয়তো আরো কিছুদিন তিনি দাপিয়ে বেড়াতে পারবেন রাজনীতিতে। কিন্তু তার দল? চূড়ান্ত বিচারে এই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে। আর এর জন্য আমাদের আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।
এতদিন আমাদের যে ধারণা তাই সত্য বলে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। দেশে একদলীয় নির্বাচন হচ্ছে! জাতীয় পার্টি এখন মন্ত্রিসভায় থাকলেও দশম জাতীয় সংসদে তার দলকেই পালন করতে হবে বিরোধী দলের ভূমিকা। আর জীবনে প্রতিটি নির্বাচনে ‘জামানত’ হারানো দীলিপ বড়–য়ারা এবার ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আসতে পারেন। ‘একমাত্র নেতা’ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপির সংসদে সদস্য সংখ্যা এবার একের অধিক হবে, তা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আর আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমরা এখন অনেকটা হটকারী রাজনীতির কাছে ‘জিম্মি’ হয়ে গেলাম। মানুষকে এখন সহিংসতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিত্যদিনের কাজ করতে হবে। ‘সব দলের অংশগ্রহণে যে নির্বাচন’ যা গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত, তা এখন স্পষ্টতই লঙ্ঘিত হতে যাচ্ছে। সিইসি জনগণের প্রত্যাশার কথা বলেছেন। তিনি মিথ্যা বলেননি। জনগণের প্রত্যাশা ছিল সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এখন প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান। মন্ত্রীরা দলীয়ভাবে বিভক্ত, সবাই আবার সরকারি জোটের সদস্যও। সেই নির্বাচন কি আদৌ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে? আমরা সিইসির মতো প্রত্যাশা করতেই পারি। আমাদের দুঃখ যে, বিতর্কিত সিইসিদের তালিকায় কাজী রকিব উদ্দীনও শেষ পর্যন্ত নাম লেখালেন। সার্চ কমিটির মাধ্যমে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও ‘সিসটেম’ই শেষ পর্যন্ত তাকে বিতর্কিত করল। তিনি নিজেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারলেন না। সরকারের ‘চাপ’ তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। বাংলাদেশ ২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বরের ‘নাটকের’ পুনরাভিনয়ই আবার দেখতে যাচ্ছে। ওই দিন তৎকালীন সিইসি বিচারপতি এমএ আজিজ একটি নির্বাচনের সিডিউল দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচন অবিশ্যি তিনি আর করতে পারেননি। আজ কি বর্তমান সিইসিও সেই বিচারপতি আজিজের ভাগ্যই বরণ করতে যাচ্ছেন? সম্ভবত বাংলাদেশ এক কঠিন সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উঠে এসেছে সত্য। কিন্তু তা হয়তো হবে না। কিন্তু আমাদের ভাবমূর্তির চরম ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা এটা বোঝেন না, আমাদের দুঃখটা এখানেই।
দৈনিক মানবকন্ঠ, ২৭ নভেম্বর ২০১৩।
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও
দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক
0 comments:
Post a Comment