বজিয় দিবস উপলক্ষে শনিবার আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খালি মাঠ/খেলোয়াড় নেই। গোল তো হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা বলেননি। সহজ-সরল অর্থে দেখলে, এমনটাই দেখায়। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের দুটো দিক আছে। এক. বাস্তবতা। দুই. নৈতিক। বাস্তবতা বলে একটি নির্বাচন অত্যাসন্ন। তারিখ ঘোষিত হয়েছে, নির্বাচন কমিশন শিডিউল ঘোষণা করেছে। ‘প্রার্থীরাও’ মাঠে আছেন। এখন প্রার্থীরা কাদের, কোন দলের, সেটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিবেচ্য নয়। তিনি ‘রাজনীতির খেলোয়াড়’। রাজনীতির মাঠে তিনি ‘বিজয়ী’ হতে চান। এক্ষেত্রে অপর পক্ষকে যদি তিনি ‘রাজনীতির খেলায়’ মাঠের বাইরে রাখতে চান, সেটা তার ‘কূটকৌশল’। নিঃসন্দেহে, এ ‘কূটকৌশলে’ তিনি বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু তার ‘নৈতিক পরাজয়ও’ হয়েছে। এককভাবে মাঠে খেলে ‘বিজয়ী’ হওয়া যায়; কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করে না। খেলার মাঠে যদি অপর পক্ষ না থাকে, তাহলে ওই খেলা দেখতে ‘দর্শক’ও মাঠে আসে না!
সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন খেলায় ‘বিজয়ী’ হয়ে আনন্দ কোথায়! এটা অবশ্যই সরকারের এক ‘ব্যর্থতা’ যে, ‘রাজনীতির খেলায়’ তিনি অপর পক্ষকে ‘মাঠে’ আনতে পারেননি। এ ‘বিজয়’ সরকারের অবস্থানকে আরও ‘শক্তিশালী’ করবে না বরং সরকারের ‘ভিত’ আরও দুর্বল হবে। আমরা বারবার বলি, রাজনীতিতে আস্থা ও বিশ্বাস যদি স্থাপন করা না যায়, তাহলে সেই ‘রাজনীতি’ শক্তিশালী হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা ৪২ বছর পার করেছি। কিন্তু এখনও আমরা সেই ‘ভিতকে’ শক্তিশালী করতে পারিনি। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস এত বেশি যে, যেখানে রাজনীতি ‘মুখ্য’ হওয়া উচিত ছিল, সেখানে রাজনীতি ‘গৌণ’ হয়ে গেছে। ‘মুখ্য’ হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত কুৎসা আর হিংসা। আমরা একটা কথা ভুলে যাই, এ দেশের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমরা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্ম নিয়ে হাজার বছর টিকে থাকব। এখানে ‘রাজনীতির ভিতটা যদি শক্তিশালী না হয়, তাহলে সমাজের বিনির্মাণটা শক্তিশালী হবে না। এক সময় শক্ত ‘ভিত’ এর অভাবে তাসের ঘরের মতো তা ভেঙে যেতে পারে!
‘রাজনীতির খেলোয়াড়’ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে এ ‘খেলায়’ বিজয়ী হয়েছেন। তিনি ‘গোলকিপারবিহীন’ গোলপোস্টে একের পর এক ‘গোল’ করেছেন। কিন্তু তিনি যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট, তা কিন্তু নয়। আর সন্তুষ্ট নন বলেই তিনি আভাস দিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি দশম সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। এবং একাদশ সংসদেও সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে চান। একটি ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’ও আছে তার বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, বিরোধী দল বিএনপিকে জামায়াত ও সহিংসতা ছাড়তে হবে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, একটা দলের এটা ‘রাজনৈতিক কৌশল’, তারা কার সঙ্গে ঐক্য করবে।
জামায়াত সম্পর্কে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, জামায়াতের যে একটা ‘ভোট ব্যাংক’ আছে, তা কি আমরা অস্বীকার করতে পারব? এখানে প্রধানমন্ত্রী আরও ‘কৌশলী’ হলে পারতেন! জামায়াতের কোনো নিবন্ধন নেই। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেছে। জামায়াত নামে এ দলটি আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এমনকি সরকার ইচ্ছে করলে জামায়াতকে নিষিদ্ধও করতে পারে। কেননা আদালতের নির্দেশনাতেও জামায়াত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য রয়েছে। সরকার এটাকে ব্যবহার করেই তো জামায়াতকে প্রয়োজনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। সুতরাং জামায়াতকে ‘বাদ’ দেয়া-সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও ‘কৌশলী’ হতে পারতেন। যুক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ‘ঘটনার’ পর বিএনপিও বলতে পারে, সরকারকে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এটা কথার পিঠে কথা। কোনো যুক্তির কথা নয়। এটা ঠিকও নয়। জাতীয় পার্টি একটি নিবন্ধিত দল। তাদের একটা জনসমর্থন আছে। রাজনীতি করার এবং যে কোনো ফ্রন্টে থাকার অধিকার তাদের রয়েছে। আমরা সেই ‘অধিকার’ খর্ব করতে পারি না। আমরা বারবার ভুলে যাই, রাজনীতি হচ্ছে একটা ‘খেলা’। এ খেলায় এক পক্ষ জিতবে, এক পক্ষ হারবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ‘খেলায়’ প্রতিযোগিতা থাকতে হয়। প্রতিযোগিতা ছাড়া এ ‘খেলা’ মূল্যহীন। ১৫৪ জন প্রার্থী এরই মধ্যে দশম জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন! এখন তাদের নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হতে হবে। এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু এটা সংসদীয় রাজনীতি নয়। সংসদীয় রাজনীতির যে স্পিরিট, তা এখানে নেই। নেই কোনো শক্ত বিরোধী দলের অবস্থান, যা কিনা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ। আস্থা ও বিশ্বাসের যে কথা গণতন্ত্র বলে, তাও এখানে অনুপস্থিত। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা প্রায় সবাই জেলে। কেউ বা আবার রয়েছেন আত্মগোপনে। মামলা আছে এখনও সবার বিরুদ্ধে। কেউ কেউ আদালত থেকে জামিনও পেয়েছেন। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ জরুরি। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অবরোধের ছবিগুলো দেখি, তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই! যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি, সেখানে তাদের সবার নামেই মামলা! হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেকটি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ গ্রেফতারের কাহিনী! এতে করে কী আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে?
এটা সত্য, বিরোধী দল এ অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাকে কী বিশ্বাস করতে হবে, এসব নেতা বাসে পেট্রলবোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু’একজন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ এদের গ্রেফতার করতে পারেনি কেন? এসব দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় একটা পরিবারকে, তারা তো জনগণের ‘বন্ধু’ হতে পারে না। এরা জনগণের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, ‘হুকুমের আসামি’ হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়, তাহলে তো আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
অবরোধের কারণে আমরা এখন ‘জিম্মি’। স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সেক্টর থেকে পাচ্ছি একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ। বৈদেশিক আয়ের একটা বড় উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাক রফতানিতে এখন স্থবিরতা এসেছে। কমে গেছে অর্ডার। এর প্রভাব কারখানাগুলোতে পড়তে পারে। বাদ হয়ে যেতে পারে অনেক কারখানা। এমনকি বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারেন গার্মেন্ট মালিকরা। তাদের সাদা পতাকা মিছিল প্রমাণ করে, তারা আজ কত অসহায়। কিন্তু অর্থনীতিতে সুবাতাস যে বইবে, তার কোনো লক্ষণ দেখছি না।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক সঙ্কট দেশকে পিছিয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা এসব নিয়ে ভাবেন না। খবর বের হয়েছে, প্রতিটি ট্যানারিতে চার কোটি টাকার চামড়াজাত পণ্য আটকে আছে। রফতানি করা যাচ্ছে না। শিল্প খাতে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চরম আতঙ্কে আছেন উদ্যোক্তারা। সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছেন তৈরি পোশাকের মালিকরা। হরতাল আর অবরোধজনিত কারণে তাদের মাথায় হাত। তাদের সংস্থা বিজেএমইএ’র হিসাব মতে, হরতাল ও অবরোধজনিত কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে গত দেড় মাসে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একটা দেশের জন্য এ বিপুল ‘ক্ষতি’ কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রেশ আগামীতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়! আর একটা জিনিস আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না, অবরোধ যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি সচল না হলে ভ্যাট আদায় হবে না। আর ভ্যাট আদায় না হলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে। এক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-পাওনা পরিশোধ করায় একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বলতে পারে, তাতে করে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি গেল বছর ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, তা কমে এসে ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এনবিআর আমাদের জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো আমাদের জানাচ্ছে, (১৭ ডিসেম্বর) বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখন আমদানি-রফতানি বাণিজ্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশগুলো এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে। একটি উদ্বেগজনক সংবাদও দিয়েছেন এক প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত বিশ্বের আমদানিকারক দেশগুলো। তাদের এ শঙ্কার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে ৩৫ দেশের বায়ার্স প্রতিষ্ঠান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে তারা ব্যবসার পরিবেশ না পেলে ভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন।
বেশ ক’টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আমি জানি না; কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে বলে আমার ধারণা। কেননা নির্বাচন বাতিল করার আর কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ৫ জানুয়ারির আগে আর দু’পক্ষের মধ্যে কোনো সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংলাপ কার্যত এখন ব্যর্থ। আমরা বারবার বলছি, আমাদের রাজনীতিবিদদেরই উদ্যোগটি নিতে হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা সমস্যার সমাধানে যদি ব্যর্থ হন, তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। সাধারণ মানুষকে ‘জিম্মি’ করে যে রাজনীতি, তা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না। বরং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখার যে সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতি জাতির মঙ্গল ডেকে আনতে পারে।
Daily Alokito Bangladesh
25.12.13
0 comments:
Post a Comment