রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তারানকো কতটুকু সফল হলেন

তারানকোর বাংলাদেশ সফরের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এই সফরে বাংলাদেশ কী পেল? বহুল প্রত্যাশিত এই সফর শেষ হয়েছে। তারানকো গত বুধবারই নিউ ইয়র্ক চলে গেছেন। সারা বাংলাদেশ যখন একের পর এক লাগাতার অবরোধ প্রত্যক্ষ করছে, সহিংস ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা যখন বাড়ছে, তখন তারানকোর এই সফর 'সমস্যার' সমাধানে একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। দেশ যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমরা কী সেই সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি? আমি তিন ভাগে তারানকোর এই সফরকে দেখছি। এক, তারানকো এক ধরনের 'দূতিয়ালির' জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। এটা জাতিসংঘ মহাসচিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ যেসব নির্বাচন সম্পন্ন করেছে (বিশেষ করে সর্বশেষ নেপালের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি), তার সঙ্গে তারানকোর দূতিয়ালিকে মেলানো যাবে না। নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, লাইবেরিয়াসহ যেখানেই জাতিসংঘ নির্বাচন আয়োজন করেছে, সেখানেই নিরাপত্তা পরিষদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ছিল। নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকেই জাতিসংঘ সেসব দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করে ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রকমটি হয়নি। এখানে নিরাপত্তা পরিষদ তারানকোকে কোনো দায়িত্ব দেয়নি। সুতরাং তাঁর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। দ্বিতীয়ত, সংবাদ সম্মেলনে তিনি 'কিছু' কথা বলেছেন। কিছু মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এ ধরনের 'মন্তব্য' সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে না। তৃতীয়ত, তারানকোর এই সফরে একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। যে বিষয়টি (নির্বাচন) আমাদের দেশের নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট 'স্টেকহোল্ডার'দের দেখার কথা, তাদের ব্যর্থতাই তারানকোর মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যুরোক্রেটকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। এর একটা খারাপ দিক হচ্ছে- আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ। আমরা তাকিয়ে থাকি বিশ্বের দিকে- তারা এসে আমাদের সমস্যার 'সমাধান' করে দিয়ে যাবে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তারানকো এলেন। তাহলে কী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালেও 'আরেকজন তারানকোকে' আমাদের প্রয়োজন হবে! আমাদের রাজনীতিবিদদের বিষয়টি বুঝতে হবে। তাঁদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। ৪২ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য 'অন্যের দিকে' তাকানো, 'সমাধান করে দিয়ে যাওয়ার' আহ্বান কোনো সুস্থ চিন্তার লক্ষণ নয়।
এক কথায় তারানকোর এবারের ঢাকা সফরের ফলাফল 'শূন্য'। আমরা স্পষ্ট করে বলছি না বটে, কিন্তু বাস্তবতা এটাই। তাঁর উপস্থিতিতে দুই দফা সংলাপ হয়েছে দুই দলের মধ্যে, এর পরেও আরেক দফা সংলাপ হয়েছে। তারানকো বলেছেন, 'আলোচনায় এনেছি, তা চালিয়ে যেতে হবে।' সেটা হয়তো হবে। তৃতীয় দফা কিংবা চতুর্থ দফা 'সংলাপ' হলেও ফলাফল কী? দুটি বড় দল, বিশেষ করে সরকারি দল কি তাদের অবস্থান (প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন) থেকে কিছুটা সরে এসেছে! না, আমার কাছে তা দৃশ্যমান নয়। তাহলে এই 'সংলাপ' সংবাদপত্রগুলোর জন্য সংবাদ হলেও আমজনতার জন্য তা কোনো আশার বাণী বয়ে আনছে না। লোক দেখানো সংলাপ কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। কেননা ১২ ডিসেম্বরের খবর- আওয়ামী লীগ আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করেছে। নিজেরা ২২৭টি আসন রেখেছে। ৭৩টি আসন তারা দিয়েছে শরিকদের। এর মধ্যে ৬১টি আসন জাতীয় পার্টির। যদিও পার্টিপ্রধান এরশাদ বারবার বলে আসছেন তাঁর দল নির্বাচন করবে না, কিন্তু সাধারণ একজন মানুষও এখন জানে তাঁর কথায় বিশ্বাস রাখা যায় না।
তারানকো গত পাঁচ দিনে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কিন্তু এ দেশের মানুষ একটা ফলাফল দেখতে চায়। ফলাফলের খাতায় এখন একটা বড় 'শূন্য'। তিনি বলেছেন 'সংলাপ' চালিয়ে যেতে হবে। এটা ভালো কথা। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা নেই। যদি কোনো 'সমঝোতা' আদৌ হয়, তা হতে হবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য। তারানকো বলেছেন, 'সমাধান এখনো সম্ভব, তবে তা আসতে হবে নিজেদের মধ্য থেকে।' সমস্যাটা এখানেই। সমাধান তাঁরা বের করতে পারবেন না। তারানকো আরো বলেছিলেন, 'সংঘাত বন্ধ, আটক রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির কথা।' কিন্তু নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়নি। সুতরাং দুই দলের সংলাপের নামে এক ধরনের নাটক হলো! আমি সমঝোতার এতটুকু চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না। প্রকারান্তরে চতুর্থ দফা সংলাপের পরও যদি 'ট্যানেলের শেষ প্রান্তে' কোনো 'আলো' দেখতে না পাই, এটা বিদেশিদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট করবে। তারানকো আর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসবেন- এই বিশ্বাস রাখতে পারছি না।
তারানকো 'ছাড়' দেওয়ার যে মানসিকতার কথা বলেছিলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো পক্ষ, বিশেষ করে সরকারি পক্ষ এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হয়েছিল বলেও মনে হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করে তাঁর নেতৃত্বে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারত। যদিও এ ক্ষেত্রে সংবিধান একটি বাধা। তর পরও রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে যদি কোনো 'সমঝোতায়' আমরা পৌঁছতে পারতাম, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সংবিধানের আওতায় কিভাবে এটা সম্ভব, সে ব্যাপারে আমরা উচ্চ আদালতের রেফারেন্সের জন্য তা পাঠাতে পারতাম। ঐকমত্যটা যেখানে জরুরি ছিল, সেখানে 'স্টেট অব নেসেসিটির' ধারণাকে মাথায় রেখে উচ্চ আদালত থেকে রেফারেন্স নিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারতাম। তারানকোর সেই 'ছাড়' দেওয়ার আহ্বানে সরকারি দলকে আমরা এতটুকুও নমনীয় হতে দেখলাম না। শেষ পর্যন্ত 'বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন যদি না আসে, তাহলে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সে প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। একই প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের অনেকেরই মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে এরশাদের 'প্রত্যাহারের সেই নির্দেশ' কাগজে-কলমেই থেকে গেছে! নির্বাচনে একটি বড় পক্ষ দরকার। জাতীয় পার্টি হতে যাচ্ছে সেই বড় পক্ষ, যারা দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। নিঃসন্দেহে সংবিধান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে।
প্রধানমন্ত্রী জানতেন এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে নির্বাচনের আগে। এখন ভবিষ্যতের ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে চিহ্নিত হবেন, জানি না। কিন্তু জাতির বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরে তিনি যদি নিজেকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে নিতেন, ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত। এই সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেল এখন। সংলাপ হয়তো আরো হবে। কিন্তু আমাদের 'মাইন্ড সেট-আপে' পরিবর্তন না আসায় এ থেকে ফলাফল আশা করা যায় না। আর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা, এখানে সব পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। তারানকো দুই দলকে সংলাপে বসাতে পেরে নিজেকে সফল মনে করেছেন। কিন্তু এই সফলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পাবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Daily Kalerkontho
17.12.13

0 comments:

Post a Comment