রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। এসব আলোচনায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ খবর আমরা পেয়েছি। এক. চলতি বছরের যে কোনো এক সময় চিনা প্রেসিডেন্ট শি জেনপিং ঢাকায় আসতে পারেন। দুই. চিন অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোনাদিয়া কিংবা পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায়। চিনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনার কথা ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন চিনা সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জোয়াইনইউ। গত ১৩ এপ্রিল ঢাকায় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এর আগে তিনি ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। চিনা প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যে ভারত সফর করে গেছেন। তখন তিনি বাংলাদেশে আসেননি। তবে বাংলাদেশে এসেছিলেন যখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশে আসেননি। অন্যদিকে গত ২১ মার্চ কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত চিনা রাষ্ট্রদূত মা সিং ছিয়াং বলেছিলেন, চিন বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। প্রয়োজনে অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চিন এ কাজটি করতে চায়। এখানে বলা ভালো, চলতি বছরের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ-চিন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪১ বছর পার করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চিন বিরোধিতা করেছিল এটা সত্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৩১ আগস্ট চিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে চিন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নত হতে থাকে। বিশেষ করে চিন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। চিন বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। এক সময় ছিল যখন চিন শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলের নেতা ছিলেন, তখন চিন সরকারিভাবে তাকে চিন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে চিনে গিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকেও চিন গুরুত্ব দেয়। চিনা সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জোয়াইনইউ ঢাকায় এসে বেগম জিয়ার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে চিনে গিয়েছিলেন। তার ওই সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা ওই সফরের সময় বঙ্গোপসাগরের অদূরে সোনাদিয়ায় চিনের সহযোগিতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। সেই প্রস্তুতিও আমাদের ছিল। কিন্তু তা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে গভীর সমুদ্রবন্দর (নির্মিতব্য) পরিচালনার ভার বাংলাদেশ কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চিনা সরকার এটি পেতে চেয়েছিল। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি প্রথমে চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এই নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইউইউস (কনটেইনার টার্মিনাল) কনটেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ সক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেকগুলো দেখার বিষয় রয়েছে। আবার বিবেচনায় বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক। কেননা চিনারা এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চিনা অর্থে ও চিনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চিন। একটি হামবানতোতায়, অপরটি কলম্বোতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হামবানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একটা শহর, যেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান এখানে। চিন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হামবানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হামবানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। আগামী ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই এখানে ‘মেগা শিপ’ অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। বলা হচ্ছে, বন্দর পরিচালনা কার হাতে থাকবেÑ এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চিনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা একশ’ ভাগ মালিকানাই চিনাদের হাতে। এক সময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চিনাদের হাতে রয়েছে পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘিœত না হয়, তাহলে চিনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেওয়া যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চিনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতাম। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চিনারা। তাই তাদের ওপর আস্থা রাখা যেত। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া ছিল নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা সোনাদিয়ায় একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারব ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএসের কর্মকর্তাকে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চিন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই বন্দর দিয়েই তাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সোনাদিয়ায় কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর করছে না। করছে পায়রায়, সেখানে একটি ভারতীয় কোম্পানি (আদানি) এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি করবে। তারপরও চিন সোনাদিয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ হারায়নি। প্রয়োজনে কোনো ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গেও যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী চিন।
চিন বাংলাদেশের ব্যাপারে যে আগ্রহী তার বড় প্রমাণ চিনা প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য বাংলাদেশ ভ্রমণ। নিঃসন্দেহে তার এই সফর বাংলাদেশ-চিন সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে। চিন বাংলাদেশে অনেকগুলো সেতু করে দিয়েছে, যা চিন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত। বাণিজ্যিক সম্পর্ক চিনের দিকে ঝুঁকে পড়লেও আমাদের স্বার্থেই এই সম্পর্ক আরও উন্নত করা প্রয়োজন। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক চিনের অনুকূলে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য চিনে রপ্তানি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রায় ১৩ দশমিক ৮ গুণ পণ্য বেশি আমদানি করে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৪৮.৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছিল ৫৯২.৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০০১-২০০২ সময়সীমায় প্রায় ৬১ গুণ বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল (১১.৬৭ মি.-এর বিপরীতে ৭০৮.৯৪ মি.!) ২০১২-১৩ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮.১২ মি. (রপ্তানি) ও ৬৩২৪ মি. (আমদানি)। অন্যদিকে চিনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চিন ঋণ দিয়েছিল ১৮১ মি. ডলার, যা ছিল সুদমুক্ত। একই সঙ্গে ৭৫ মি. কম সুদে, ৭৬৪ মি. সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট ও ৩২.৯৪ মি. অনুদান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে চিন তার নিজ দেশে ৫০০০ আইটেমের বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ মূলত ফ্রজেন ফুড, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক চিনে রপ্তানি করে। চিনা বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায় ২০০৯ সালে চিন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৩ সালে এসে ১৮৬ জন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা সেক্টরের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ব্যবহৃত সমরাস্ত্রের শতকরা ৭৫ ভাগের উৎস হচ্ছে চিন। চিন থেকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, আর বিমান বাহিনীর জন্য ফাইটার প্লেন চিন থেকে ক্রয় করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই বাংলাদেশ-চিন সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবদ্দশায় জিয়া একাধিকবার চিন সফর করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চিনের ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের বাংলাদেশ সফর ছিল নিয়মিত। এখন এই প্রবণতা কিছুটা কম। ২০০২ সালে বেগম জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ ও চিন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। আর চিন আমাদের নিকট-প্রতিবেশী। আমাদের সীমান্ত থেকে চিনের সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। চিন এই মুহূর্তে এশিয়ায় অর্থনীতিতে এক নম্বরে এবং ভারতের অবস্থান তৃতীয়। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এই দেশ দুটি যে একটি ফ্যাক্টর তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ এই দুটি দেশের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে আসছে। যেখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর প্রশ্ন জড়িত, সেখানে বাংলাদেশ একটি পজিটিভ নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। এ ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
Daily Amader Somoy
25.04.16

চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল বটে, লাভ হবে কি কিছু?

গত ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দফতরে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্যারিসে গেল ডিসেম্বরের সম্মেলনে ১৯৫টি দেশ একটি জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। তার আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে জাতিসংঘে এটি স্বাক্ষরিত হল। ১৭০টির উপরে দেশ জাতিসংঘে এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে, যারা বায়ুমণ্ডলে মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের ৯৩ ভাগ উদ্গিরণ করে। বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসের জন্য এ ধরনের একটি চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। বলা ভালো, এর আগে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে কিয়োটোতে (১৯৯৭) একটি চুক্তি হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, শিল্পোন্নত দেশগুলো সামগ্রিকভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ১৯৯০ সালের তুলনায় ৫ দশমিক ২ ভাগ হারে হ্রাস করবে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, দেশটি হ্রাস করবে ৭ ভাগ, ইইউর দেশগুলো করবে ৮ ভাগ, জাপান ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। ফলে কিয়োটো চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়। এরপর একে একে বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্যারিসে শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা হয়েছিল এবং তারই ধারাবাহিকতায় এখন নিউইয়র্কে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল। কিন্তু সমঝোতাটি ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বলা হয়েছিল, এটা একটা ‘জগাখিচুড়ি সমঝোতা’। এটা কোনো চুক্তি নয়। চুক্তি সম্পন্ন হবে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিলের মধ্যে। এখন স্বাক্ষর করল ১৭০টি দেশ। বাকি ৩৫টি দেশ আগামী এপ্রিলের মধ্যে স্বাক্ষর করতে পারবে। এবং জাতিসংঘের আওতায় তখন এটি একটি আইনে পরিণত হবে। ৫৫ ভাগ দেশ যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে (যার মাঝে আবার শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মাঝে ৫৫ ভাগ দেশ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে), তাহলেই চুক্তিটি কার্যকর হবে। প্রশ্ন সেখানেই। বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো নিউইয়র্কে উপস্থিত থেকে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর এবং এ ব্যাপারে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী সংস্থাগুলোর চাপ, কর্পোরেট হাউসগুলোর ব্যবসায়িক মনোভিত্তি ইত্যাদি নানা কারণে বড় কিছু দেশ এখন নানা জটিলতা তৈরি করতে পারে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিপাবলিকানদের পেছনে বড় অর্থলগ্নি করেছে আন্তর্জাতিক তেল উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো। সুতরাং প্যারিসে ওবামার এই চুক্তির প্রতি সমর্থন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির নিউইয়র্কে চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একটি আশংকা থেকেই গেল। কেননা নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি রিপাবলিকান পার্টি বিজয়ী হয়, তখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। চীন ও ভারত বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। কার্বন হ্রাসের ব্যাপারে এই দেশ দুটির যুক্তি হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করলে তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। চীন ও ভারত কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর এই কয়লা পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গমন হয়, যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। ফলে দেশ দুটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলই।

বিশ্বের ১৯৫টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রায় সবাই প্যারিস সম্মেলনে যোগ দিয়ে এই সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতির (যাদের একটা বড় অংশ আবার এনজিও প্রতিনিধি) ফলে সেখানে কত টন কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কিন্তু কোপেনহেগেনে (২০০৯ ডিসেম্বর) যে কপ-১৫ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার একটি পরিসংখ্যান আছে। প্রায় ১৫ হাজার প্রতিনিধি ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আর খরচ হয়েছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার। আর জাতিসংঘের মতে, এসব প্রতিনিধির আসা, নেয়া, গাড়ি ব্যবহারের কারণে তারা বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ করেছিল ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড। পাঠক, এ থেকে ধারণা করতে পারেন, প্যারিসে কত টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল কী?

একটি সমঝোতা হয়েছিল। এখন চুক্তি হল কয়েক মাস পর। বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে। এর জন্য বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হবে। প্রশ্ন এখানেই- কে কতটুকু হ্রাস করবে, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে কি একই কাতারে আমরা দেখব? কিংবা রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো কতটুকু কমাবে? এ ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। সমঝোতায় আছে, উন্নত বিশ্ব জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার সাহায্য দেবে। এটা শুনতে ভালোই। কিন্তু এই অর্থ কে দেবে? কোন দেশ কতটুকু দেবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত. ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত (ভালনারেবল, রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন ইত্যাদি)। এই দেশগুলোর মাঝে অর্থ বণ্টনের ভিত্তিটি কী হবে? তৃতীয়ত. ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই অর্থ কীভাবে ম্যানেজ করবে? কেননা উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত। বাংলাদেশে জলবায়ু ফান্ডে প্রাপ্ত টাকা বরাদ্দ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। একসময় কথা হয়েছিল প্রাপ্ত টাকা বিলি-বণ্টনের বিষয়টি দেখভাল করবে বিশ্বব্যাংক। পরে বিশ্বব্যাংক এখান থেকে সরে যায়। বিষয়টি যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। বরং উন্নয়নশীল বিশ্বে, বিশেষ করে সাগর পাড়ের অনেক দেশ নিয়ে এরকম সমস্যা আছে। সমঝোতা স্মারকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ দেখা হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও অত কঠোর নয়। অর্থাৎ সাগর পাড়ের দেশগুলো, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে, সাগর-মহাসাগরে পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে, যাদের বিশাল এলাকা সাগর গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, কোনো ক্ষতিপূরণ এর জন্য দাবি করতে পারবে না। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসবে বড় দেশগুলোর মর্জি-মাফিকের ওপর।

নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এর প্রয়োজন ছিল। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে, সাগর উত্তপ্ত হচ্ছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে- এ সবই বাস্তব। এ ব্যাপারে কারও কোনো বক্তব্য নেই। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, গ্রিনল্যান্ড ও এনটার্কটিকায় বরফ গলছে। এর জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া প্রয়োজন ছিল। এটা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু কর্মপরিকল্পনাটা কী, কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে- তার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্যারিস সম্মেলনে নেয়া হয়নি। এটা বলা যাচ্ছে, বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ শিল্পে, কলকারখানায়, যানবাহনে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু এই জ্বালানির ব্যবহার আমরা কমাবো কীভাবে? জ্বালানি ব্যবহারের সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। জীবাশ্ম জ্বালানি কম ব্যবহার করলে কার্বন নিঃসরণ কম হবে, এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের কাছে কি বিকল্প জ্বালানি আছে? উন্নয়নশীল বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বের কাছে ‘নয়া প্রযুক্তি’ থাকলেও, তাদের অনীহা রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই প্রযুক্তি সরবরাহের। সোলার এনার্জির একটা বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে এই এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে না। বাংলাদেশে যে পরিমাণে এর ব্যবহার বাড়ানো উচিত ছিল, তা কিন্তু হয়নি। কেননা এর জন্য যে খুচরা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, তা বিদেশ থেকে আনতে হয়। খরচ অনেক বেশি পড়ে, যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে পড়ে না। এই সেক্টরে যতদিন পর্যন্ত না বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে, ততদিন এই সেক্টর বিকশিত হবে না। আর এই সেক্টর বিকশিত না হলে মানুষ জ্বালানির জন্য নির্ভরশীল থাকবে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় মানুষের নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো, এমনকি সাগর পাড়ের দেশগুলোর জ্বালানি দরকার। তারা বিকল্প জ্বালানি, অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্ভাবন করতে পারেনি। ফলে তাদের পক্ষে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করাও সম্ভব হবে না।

ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল যে, জলবায়ু চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে? মার্কিন তথা বহুদেশীয় সংস্থাগুলোর স্বার্থ এখানে বেশি। জ্বালানি একটা বিশাল ‘ব্যবসা’। এই ‘ব্যবসা’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা কখনোই চাইবে না বহুদেশীয় সংস্থাগুলো। প্যারিসে একটি সমঝোতা হয়েছিল। এখন চুক্তি হল। এর প্রয়োজন ছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওসিস্টেমের অধ্যাপক মাইলেস এলেন তাই ইতিমধ্যে প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ৩৫০ অঙ্গসংগঠনটির প্রধান বিল মেকিব্বেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত বড় বড় ব্যবসায়িক তথা বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কারণে এই ‘সমঝোতা’ শেষ পর্যন্ত ভণ্ডুল হয়ে যাবে। দাতব্য সংস্থা অক্সফামও তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ফলে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। যারা অনলাইনে নিয়মিত বিভিন্ন জার্নাল পাঠ করেন, তারা দেখবেন প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার সংখ্যাই বেশি। তারপরও একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এতগুলো দেশ একসঙ্গে প্যারিসে মিলিত হয়েছিল। বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই সেখানে গিয়েছিলেন। এবং তারা সবাই একবাক্যে একটি চুক্তির কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশও প্যারিসে গিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবেশমন্ত্রী নিউইয়র্ক গেলেন এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। আমাদের বন ও পরিবেশমন্ত্রী প্যারিসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বাংলাদেশ প্যারিস সমঝোতার আলোকে এখন চুক্তি স্বাক্ষর করল। কিন্তু প্যারিসে অংশ নেয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের কোনো কোনো সদস্য স্বীকার করেছেন, সমঝোতা স্মারকে অনেক বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে। এমনকি শিল্পোন্নত দেশগুলো যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বা আইএনডিসি জমা দিয়েছে, তা রিভিউ করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন ডিগ্রির বেশি বাড়বে। অথচ চুক্তিতে ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ বছর পর কার্বন নিঃসরণ কমানোর পর্যালোচনায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন। এখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক। প্রতিটি দেশের পার্লামেন্টে এ চুক্তিটি অনুস্বাক্ষরিত হতে হবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে লক্ষ্য করার মতো। জন কেরি তার নাতনিকে কোলে নিয়ে এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে একটা মেসেজ দিলেন যে, আগামী ভবিষ্যতের জন্যই এ চুক্তি। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস যদি এ চুক্তিতে বাগড়া দেয় তখন? চীন বলছে, আগামী সেপ্টেম্বরে চীনের হাংজু শহরে যে জি-২০ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার আগেই তারা চুক্তিটির অনুস্বাক্ষর করবে। এখন দেখার পালা চীন তার কথা রাখে কি-না!

বিশ্ব এখন রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভারতে খরা দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ভারতকে পানি আমদানি করতে হতে পারে! ইতিমধ্যে খরায় মারা গেছে একশ’র অধিক মানুষ। ফলে বিশ্বে তাপমাত্রা যাতে নির্দিষ্ট সীমায় রাখা যায়, সে লক্ষ্যেই প্যারিস সমঝোতা ও নিউইয়র্ক চুক্তির বাস্তবায়নটা জরুরি। Daily Jugantor 25.04.16

বৈশ্বিক কর ফাঁকির রাজনীতি ও অসমতার গল্প

বৈশ্বিক কর ফাঁকির ঘটনা নিয়ে সারা বিশ্বে এখন রাজনীতির ঝড় বইছে। এরই মধ্যে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থাও নড়বড়ে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। সারা বিশ্ব এখন জেনে গেছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজন সবাই নিজ দেশের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে পানামার একটি কম্পানির মাধ্যমে (মোসাক ফনসেকা) অফশোর কম্পানিতে কোটি কোটি ডলার সরিয়ে নিয়েছেন। এই কর ফাঁকি ব্যবসাকে মোসাক ফনসেকা একটি আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে, যার জন্য পৃথিবীর ৪০টি দেশে তাদের অফিস কাজ করছে। এই কর ফাঁকির ঘটনা একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি ব্যাংক (ডয়েচে ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, এইচএসবিসি) কিছু কিছু দ্বীপপুঞ্জ শাসিত দেশ বা অঞ্চলে শত শত তথাকথিত কম্পানি খুলে সেখানে বেনামে ওই অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকা সরিয়ে নিয়েছে। এর বিস্তারিত ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি কর ফাঁকি আর পাচার করা অর্থের পরিমাণ বছরে ২০০ মিলিয়ন ডলার। আর ইতিমধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। গত পাঁচ বছরে টাকা পাচারের হার বেড়েছে ২৫ শতাংশ। পাঠক চিন্তা করতে পারেন ৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার কী পরিমাণ অর্থ? এবং এই অর্থ দিয়ে আমরা কী করতে পারতাম? বিশ্বে যে অসমতা, ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য—তা আমরা দূর করতে পারতাম। গরিব দেশের লোকগুলো তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারত। আফ্রিকায় এইডস, এবোলা আর অতি সম্প্রতি লাতিন আমেরিকায় জিকা রোগের যে প্রাদুর্ভাব তা আমরা নির্মূল করতে পারতাম। এসব সংক্রামক রোগের জন্য যে গবেষণা প্রয়োজন এবং তার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, আমরা তার সংস্থান করতে পারতাম। বিশ্বকে আরো রোগমুক্ত করতে পারতাম। গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করতে পারতাম। আফ্রিকার দেশগুলোর দরিদ্রতা দূর করতে পারতাম। একটি সমতাময় বিশ্ব আমরা পেতে পারতাম। ক্ষমতাসীনরা, ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীরা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ পাচার করে দিয়েছেন এসব অফশোর দ্বীপপুঞ্জে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। তাঁরা কর ফাঁকি দিয়েছেন। অর্থ পাচার করেছেন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তাঁদের আইনের আশ্রয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এসব অর্থ নিজ নিজ দেশে ব্যবহৃত হলে সেসব দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাটাই বদলে যেত। আমরা কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করব যে বিশ্বে ধনী শ্রেণির মানুষ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈষম্যও। ধনী রাষ্ট্র আরো ধনী হয়েছে। কিন্তু আইনের কড়াকড়ি উপেক্ষা করেও সেখান থেকে অর্থপাচার হয়েছে। চীনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেও তাঁর আত্মীয়স্বজনই (শ্যালক) অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। অভিযোগ উঠেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে যাওয়ায়, অর্থ এখন এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান (১৩ অক্টোবর ২০১৫) আমাদের জানিয়েছিল যে বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কাছে বিশ্বের মোট সম্পদের অর্ধেক এখন কেন্দ্রীভূত। ক্রেডিট সুইসের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন কিংবা কর ফাঁকির কারণে বিশ্বে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্বের বর্তমান জনগোষ্ঠী (মার্চ ২০১৬) প্রায় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীকে ধরা হয় কর্মক্ষম, যাদের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ডলারের নিচে (৭০ শতাংশ)। বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের হাতে কী পরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত—অক্সফাম তার একটি হিসাব দিয়েছে। বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫০ ট্রিলিয়ন ডলার। এখান থেকে ৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদের মালিক ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী। আবার ৩১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ (১২.৫ শতাংশ) রয়েছে ১০০৩ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কাছে। ১১২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের (৪৫.২ শতাংশ) সম্পদ রয়েছে ০.৭ শতাংশ অর্থাৎ ৩৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কাছে, যাদের সবার সম্পদের পরিমাণ এক মিলিয়ন ডলারের বেশি করে। এই পরিসংখ্যান আমাদের বলে দেয় বিশ্বে ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে এবং ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য বাড়ছে। আমরা যে পরিসংখ্যান পাই, তাতে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি ধনী লোকের বাস যুক্তরাষ্ট্রে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী লোকের বাস চীনে। চিন্তা করা যায়? চীন এখনো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখনো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। তবে চীনের রাজনীতিতে প্রয়াত তেং শিয়াও পিংয়ের উত্থানের পর অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এটাকে তারা বলছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। এর ফলে চীনে অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমানো হয়েছে। ব্যক্তি পুঁজির সেখানে বিকাশ ঘটেছে। ফলে হাজার হাজার ধনী ব্যবসায়িক শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা অসৎ পন্থা অবলম্বন করে ‘ধনী’ হয়েছে। অথচ চীনে দরিদ্রতা আছে। যে ২০টি দেশে ধনী লোকের সংখ্যা বেশি সেখানে প্রতিটি দেশে দরিদ্রতা আছে। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (১ দশমিক ৯০ ডলার, প্রতিদিন) সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষের (চরম দরিদ্রতা) বাস এশিয়ায়। এমনকি উত্তর আমেরিকায় (যেখানে ধনী লোকের বাস বেশি), সেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৩ মিলিয়ন। ধনী লোকের কাছে এই যে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত, তা দিয়ে সব ধরনের রোগবালাই দূর করা সম্ভব। ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাথাপিছু পাঁচ ডলার ব্যয়ে বিশ্বের ৪০ লাখ মা ও শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব। নিম্ন আয়ের দেশে মা ও শিশুর সেবা পৌঁছে দিতে, তাদের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন ৬২০ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু ৬ দশমিক ৭ ডলার। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্পদ আরো বাড়ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। আর ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ আরো বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠান, যারা থাকছে আইনের ঊর্ধ্বে। তারা সাধারণ কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান নয়। গ্রাহকদের গোপন নথি তারা সুরক্ষা করবে না, এটা বিশ্বাস করা যায় না। সে কারণেই প্রশ্নটা এসে যায় কোনো বৃহৎ শক্তি কি এর পেছনে আছে? সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদ লিখেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবার্ট পেরি (Robert Parry)। প্রবন্ধের নাম ‘করাপশন অ্যাজ এ প্রোপাগান্ডা উইপন’। এটি ছাপা হয়েছে ‘গ্লোবাল রিসার্চ’-এ ৫ এপ্রিল ২০১৬-তে। গ্লোবাল রিসার্চ টরন্টোতে নিবন্ধিত একটি গবেষণা সংস্থা। এটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক মিসেল চসুডোভস্কি (Michel Chossudousky)। বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং তিনি নিজে কাজ করেন। এখানে রবার্ট পেরি দুটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এক. এই গোপন তথ্য ফাঁসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের  রেজিম চেঞ্জ (regime chanse) বা ‘সরকার পরিবর্তনের’ (বিভিন্ন দেশের) যে ‘নীতি’, তার সঙ্গে একটা মিল থাকতে পারে। তিনি উল্লেখ করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে ‘কালার রেভল্যুশন’ হয়েছে (জর্জিয়া, কিরগিজিস্তান, ইউক্রেন, এমনকি আরব বসন্তেও), তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ একটা যোগসূত্র আছে। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ নামে অর্থ সহায়তা করে থাকে। আমি নিজে ‘আরব বসন্ত’-এর ওপর গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি কিভাবে তরুণ নেতৃত্বকে (মিসরের) যুক্তরাষ্ট্র উদ্বুদ্ধ করেছিল মুবারকবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে। ইউক্রেনে রুশ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ একটি ‘গণ-আন্দোলনে’ উত্খাত হয়েছিলেন ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ক্ষমতায় এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত প্রোসেনকো, যিনি এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। অভিযোগ আছে, এই গণ-আন্দোলনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল। কেননা যুক্তরাষ্ট চায় ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক, তাতে রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন সেনা মোতায়েন করে রাশিয়াকে একটি স্নায়বিক চাপে রাখা যায়। ওই ‘আন্দোলন’ সফল হয়েছিল এবং ইয়ানোকোভিচ (যিনি ছিলেন সে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট) অপসারিত হয়েছিলেন। মজার ব্যাপার, ইয়ানোকোভিচ উত্খাত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল শুধু অর্থনীতিতে কিছুটা গতি আনার জন্য। অভিযোগ আছে, এই অর্থ প্রেসিডেন্ট প্রোসেনকো আত্মসাৎ করেছেন। তাঁর নামে টাকা পাচার হয়েছে এবং মোসাক ফনসেকা তাঁকে আইনি সহায়তা দিয়েছে। প্রশ্নটা এ কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ যেখানে বেশি (যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই), সেখানে তারা সরকার পরিবর্তন ঘটায়। ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ। একসময় হোসনি মুবারকের প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় আসমা মাহফুজদের (মিসরের তাহ্রীর স্কয়ার আন্দোলনের নেত্রী) দিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ড. মুরসিকে কিছুদিন ক্ষমতায় রেখে ‘গণতন্ত্রচর্চা’ মিসরে চালু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন সেসব অতীত। ফিল্ড মার্শাল সিসিকে নিয়েই সূচিত হবে এখন নয়া স্ট্র্যাটেজি। আমার ধারণা, ইউক্রেনেও সরকার পরিবর্তন আসন্ন। তাই রবার্ট পেরি যে আশঙ্কার কথা বলেছেন তা ফেলে দেওয়ার নয়। দ্বিতীয় যে বিষয়টির দিকে পেরি দৃষ্টি দিয়েছেন, তা হচ্ছে ব্রিকস ব্যাংক গঠন। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে চীনের নেতৃত্বে এবং ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে চীন বিকল্প একটি ‘বিশ্বব্যাংক’ গড়ে তুলেছে। এখানে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশও যোগ দিয়েছে। বিশ্বের অর্থনীতির বড় শক্তি এবং উঠতি শক্তি হচ্ছে চীন ও ভারত। ব্রিকস নিয়ে একটা ভয় ও উত্কণ্ঠা তাই যুক্তরাষ্ট্রের থাকতে পারে। ফলে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বকে দুর্বল করার জন্য তথ্য ফাঁস, অর্থপাচারের ঘটনা যে ঘটেনি, তা হলফ করে বলা যাবে না। ওই যে সরকার পরিবর্তন তত্ত্ব! কিন্তু এটা যদি ‘সত্য’ হয়ে থাকে, তাহলে স্ট্র্যাটেজিতে কিছু ভুল আছে। চীন বা রাশিয়ায় সরকার পরিবর্তন এত সহজ নয়। শি চিনপিং আর পুতিনকে সাদ্দাম হোসেন কিংবা গাদ্দাফির সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। এখানে যে প্রশ্নটা অনেকেই করেন তা হচ্ছে টাকা পাচারের জন্য কিংবা ট্যাক্স ফাঁকির জন্য এ ধরনের অফশোর শেল কম্পানিগুলোকে বেছে নেওয়া হয় কেন? আর পানামাই বা কেন? যেটা বলা দরকার, তা হচ্ছে পৃথিবীতে বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ শাসিত দেশ বা এলাকা রয়েছে (যেমন—ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ড, সিসিলি, কুক আইল্যান্ড), যেখানে হাজার হাজার কম্পানি রেজিস্ট্রি করে ওই কম্পানির নামে সেখানকার ব্যাংকে অর্থ রাখা যায়। এসব দ্বীপপুঞ্জের কোনোটাতে এখনো ব্রিটিশ কর্তৃত্ব রয়েছে (ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ড। কুক আইল্যান্ডের কর্তৃত্ব নিউজিল্যান্ডের হাতে)। এসব দেশে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো (যেমন জার্মানির ডয়চে ব্যাংক, হংকংভিত্তিক এইচএসবিসি, যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাংক, ফ্রান্সের সোসাইটি জেনারেল) এসব দ্বীপপুঞ্জে হাজার হাজার কম্পানি রেজিস্ট্রি করে ওই কম্পানির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যবসা করে। যেমন ডয়চে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে ৫০০ কম্পানি। ব্যাংক সোসাইটি জেনারেল করেছে ২৩০০ কম্পানি। যে কেউ নাম গোপন করে এসব ব্যাংকের সহযোগিতা নিয়ে কম্পানি খুলতে পারে। ব্যবসা করতে পারে। আর মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এদের আইনি সহযোগিতা করে। এখানে কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। ফলে এসব দ্বীপপুঞ্জ ব্যবসায়ীদের জন্য স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে কম্পানি রেজিস্ট্রি করে, এখান থেকে পৃথিবীর বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। তারা যদি নিজ দেশে ব্যবসা করত, তাহলে তাদের প্রচুর ট্যাক্স দিতে হতো। ট্যাক্স ফাঁকি দিতেই তারা অফশোর কম্পানিগুলোতে টাকা পাচার করছে। অথচ রাষ্ট্রীয় খাতে কর যদি জমা হতো, তাহলে রাষ্ট্র সামাজিক খাতে এ টাকা ব্যয় করতে পারত। আমরা মা ও শিশু মৃত্যুর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ডায়াবেটিস একটি প্রাণঘাতী রোগ, যা ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। একটি পরিসংখ্যান দিই। ২০১২ সালে বিশ্বে ডায়াবেটিসে মারা গেছে ১৫ লাখ মানুষ। ৩৫ মিলিয়ন মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইচআইভি তথা এইডস নিয়ে বসবাস করছে। অথচ মহামারি এসব রোগ নির্মূলে গবেষণায় যে অর্থ দরকার, তা পাওয়া যায়নি।
এখন পানামা পেপারসের মাধ্যমে কর ফাঁকির যে তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাতে বড় ধরনের অনিয়মের কথা আমরা জানতে পেরেছি বটে; কিন্তু তা ধনী ও গরিবের মাঝে বৈষম্য কমাতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। কর ফাঁকি ও অর্থপাচার রোধে আন্তর্জাতিক আইন আছে বটে; কিন্তু তা যথেষ্ট কার্যকর নয়। প্রশ্নটা এখানেই। আন্তর্জাতিক পরিসরে যদি এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে অর্থপাচার রোধ করা যাবে না। Daily Kalerkontho 25.04.16

কেমন হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন?


তৃতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শেষ হয়েছে ২৩ এপ্রিল। কেমন হচ্ছে এ নির্বাচন? প্রথম দুই দফা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারা, কেন্দ্র দখল করে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের বের করে দেয়াসহ ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনার যে সংস্কৃতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তারও প্রতিফলন ঘটেছে তৃতীয় দফায়। যদিও এবার ইসিকে আমরা কিছুটা ‘তৎপর’ হতে দেখেছি। গাজীপুরের এসপি এবং দুই ওসিকে বদলির নির্দেশ দিয়ে ইসি তার ইমেজ উদ্ধারে চেষ্টা করলেও, এরই মধ্যে আমরা ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’কে ধ্বংস করে ফেলেছি। তৃতীয় দফায়ও বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হতে যাচ্ছেন ২৫ জন চেয়ারম্যান, যারা সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। একই সঙ্গে সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ৭৯ এবং সাধারণ সদস্য পদে ১৭৪ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর নাম কি নির্বাচন? পাঠক নিশ্চই আপনারা স্মরণ করতে পারবেন, গেল ৩০ ডিসেম্বর যে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে ফেনী, পরশুরাম, দাগনভূঞা পৌরসভা নির্বাচনে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে কী হয়েছিল। সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনে ৪৮টি আসনের ৪৪ জন প্রার্থীই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধু একটি জেলার কথাই উল্লেখ করলাম। অন্য অনেক জেলায়ও একই ধরনের সংবাদ আমরা পেয়েছি। তবে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানের ‘নির্বাচন’কে অবৈধ মানতে রাজি নন সরকারি দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এ ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার’ নির্বাচনকে ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্নভাবে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়াকে হানিফ ব্যাখ্যা করেছেন, ‘সরকারের উন্নয়নের প্রতি আস্থা’ বলে। তার বক্তব্য, ‘কেউ যদি স্থানীয় উন্নয়নের স্বার্থে সরকারের প্রতি আস্থা ব্যক্ত করে প্রার্থী না হন, সেক্ষেত্রে আমাদের কী অপরাধ?’ (সমকাল, ২৯ ফেব্রুয়ারি)। এ প্রশ্ন আসতেই পারেÑ কী অপরাধ? কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়া হচ্ছেÑ এমন খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও নানা কথা আছে। আসলে নির্বাচন মানেই তো একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে ওই এলাকার জনগণের অর্থাৎ ভোটারদের আর সুযোগ থাকল না তাদের প্রার্থী পছন্দ করার। আমাদের সংবিধানের ৫৯(১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠাসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ এখানে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের’ কথা। এখন নির্বাচনের আগেই প্রথম দফায় ১১৪ জন কিংবা তৃতীয় দফায় ২৫ জনই যদি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তাহলে কি সংবিধান লঙ্ঘন হয় না? আরও একটা কথাÑ আওয়ামী লীগ যাদের মনোনয়ন দিয়েছে, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। পৌরসভা নির্বাচনেও আমরা এমনটি দেখেছিলাম। ৩৩ মেয়র প্রার্থীর (আওয়ামী লীগ) বিরুদ্ধে মামলা ছিল। সৎ প্রার্থী না দিলে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না। দল তাদের প্রার্থী না করে সৎ প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে পারত। এটা হলে ভালো হতো। আওয়ামী লীগ একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। সৎ প্রার্থী না হলে স্থানীয় পর্যায়ে সৎ রাজনীতি উপহার দেয়া যায় না। বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা থাকে বেশি। আওয়ামী লীগ এ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। উপরন্তু যে সাতটি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেখানে কী ধরনের ‘পরিস্থিতি’ বিরাজ করেছিল, তা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের জানার কথা। ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ বিজয়ী হওয়ার কাহিনী দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য যথেষ্ট নয়। বিজয়ী মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ‘ব্যবসায়ী প্রার্থীদের’ প্রবণতা বেশি ছিল। ৯০৪ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৬৫২ জন ব্যবসায়ী, অর্থাৎ শতকরা ৭২ দশমিক ১২ ভাগ ব্যবসায়ী ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেই ব্যবসায়ীদের আধিক্য বেশি ছিল। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর ১৬৫ জন (শতকরা ৭৪ দশমিক ৬৬ ভাগ), আর বিএনপির ১৬২ জন (শতকরা ৭৮ দশমিক ৬৪) ছিলেন ব্যবসায়ী। (সূত্র সৃজন, ঢাকা)। তাদের মাঝে অনেকেই বিজয়ী হয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যখন মেয়র হন কিংবা ইউপি চেয়ারম্যান হন, তখন তিনি ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে, নিরপেক্ষভাবে কি স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবেন? পৌরসভায় কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়। একজন ব্যবসায়ীর এক্ষেত্রে স্বার্থ থাকে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি এ ধরনের মেয়র পাওয়া সম্ভব, যিনি ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকবেন? বাস্তবতা বলে, এটা সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। আরও একটা কারণে ওই নির্বাচনের গুরুত্ব বেশি ছিল। দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে নির্বাচন করতে পারেনি। তবে জামায়াতের প্রার্থীরা মাঠে ছিলেন। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। পেয়েছেন মাত্র একটি আসন। বিএনপির হাইকমান্ড এটি জানে। লিখিতভাবে অথবা প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে বিএনপি দুইটি আসন দিয়েছিল জোটভুক্ত এলডিপি ও জাতীয় পার্টিকে (জাফর)। এর বাইরে ধারণা করছি, প্রায় ২৬টি আসনে বিএনপি জামায়াতকে ছাড় দিয়েছিল। বলা বাহুল্য, জামায়াত প্রার্থীরা নির্বাচনে ভালো করেননি। ইসিতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর্যায়ে রয়েছে। সরকার সম্ভবত আইনি প্রক্রিয়াতেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের কর্মকা- নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে জামায়াত সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। প্রার্থীরা স্থানীয়ভাবে পরিচিত। তাদের পরিচয় স্থানীয়ভাবে ভোটাররা জানেন। ওইসব আসনে বিএনপি প্রার্থী দেয়নি। ফলে ওই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, জামায়াতের প্রতি জনসমর্থন এতটুকুও নেই। এ জনসমর্থন নিয়ে জামায়াত নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে (অনেকটা তুরস্কের মডেলে), যদি জামায়াতকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই পৌর নির্বাচন প্রমাণ করেছিল, বিএনপি জামায়াতকে যেমনি ছাড়বে না, ঠিক তেমনি জামায়াতও বিএনপিকে ছাড়বে না। এ দুইটি রাজনৈতিক শক্তির মাঝে একটা ‘বিভক্তির’ উদ্যোগ নেয়া হলেও, তা কোনো ‘কাজ’ দেয়নি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা যোগাযোগ আছে। পৌর নির্বাচনের মতো ইউপি নির্বাচনেও এটা প্রতিফলিত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউপি নির্বাচনে জাময়াত সমর্থিত প্রার্থীদের বিএনপি সমর্থন করবে বলে আমার ধারণা।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। উপজেলা, সিটি করপোরেশন (তিনটি), পৌর নির্বাচনের পর এখন ইউপি নির্বাচনÑ প্রতিটি নির্বাচন শুদ্ধ না হলেও বিএনপির অংশগ্রহণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনী সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। কিন্তু তাতে নির্বাচন বন্ধ থাকেনি এবং কোনো অসাংবিধানিক শক্তিও ক্ষমতায় আসেনি। ওই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় সরকার বহির্বিশ্বে কিছুটা নিন্দা কুড়িয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু কোনো সরকারই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরও প্রধানমন্ত্রী জাপান ও চীন সফর করেছেন। এরপর উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো নির্বাচনই ভালো হয়নি। বরং নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি জন্ম হয়েছেÑ জালভোট প্রদান, ভোট কেন্দ্র দখল, বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধাদান। এই যে ‘সংস্কৃতি’, এটা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। আর সেজন্যই প্রশ্ন উঠেছে, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে সর্বসম্মতভাবে একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার। অতি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত কমিটির প্রধান জিন ল্যাম্বার্ট ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিমতটি দিয়েছিলেন। তার মতে সিদ্ধান্তটি নিতে হবে বাংলাদেশকেই। আর সে ব্যাপারে দ্রুতই আলোচনা শুরু করা দরকার। ল্যাম্বার্টের ওই বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কেননা সংবিধানে বলা আছে, কীভাবে পরবর্র্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে আলোচনা কিংবা ‘পদ্ধতি’ নিয়ে আলোচনার কী প্রয়োজন? কিন্তু বাস্তবতা বলে একটা কথা আছে। বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনের রাজনীতির ধারায় আনতে হলে আলোচনাটা জরুরি। একটা ‘পথ’ যদি বের করা না যায়, তাহলে বিএনপি ওই নির্বাচনে (সম্ভাব্য তারিখ ২০১৯, জানুয়ারি) অংশ নেবে কিনা, তা নিশ্চিত করে কেউ-ই এখন বলতে পারবে না। তবে বিএনপি নেতাদেরও বুঝতে হবে, নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার ঘোষণা গণতন্ত্রসম্মত নয়। বিএনপির জন্য সুযোগ এসেছে মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসার। কিন্তু কীভাবে? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দলীয় সরকারের (ওই সময় সরকার থাকে নির্বাচনকালীন সরকার। তাদের কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে না) অধীনে নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতি একটু ভিন্ন। বুদ্ধিজীবীরা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারতেন। আমি দুঃখজনকভাবে অনেক তথাকথিত সুশীলকে দেখছি টকশো’তে, তারা কিছুদিন আগেও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলতেন, পত্রিকায় কলাম লিখতেন। আজ দেখি, তারা টকশো’তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছেন! আমি অবাক হয়ে দেখি, যারা সাংবিধানিক পদে আছেন, শপথ নিয়েছেন, তারা টকশো’তে দলীয় রাজনৈতিক বক্তব্য রাখছেন। অতীতে কখনোই এমনটি হয়নি। অতীতেও রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ভিসিরা ছিলেন। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানরা ছিলেন। তারা সাধারণত ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ এড়িয়ে চলতেন। আজ পাল্টে গেছে সব। আর এভাবেই আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পাল্টে দিয়েছি। পাল্টে দিয়েছি নির্বাচনের সংস্কৃতি। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র হয়েছিলেন, তারা এখন দাবি করেন নিজেদের নির্বাচিত মেয়র হিসেবে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলছে ইউপি নির্বাচনে।
অতীতে যখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের বলেছিল, ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন’, ‘শতাধিক পৌরসভায় হামলা, সংঘাত, গুলি, ব্যালট ছিনতাই’, ‘বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা’ কিংবা যখন বহিরাগতদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকে জালভোট প্রদানের দৃশ্য প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল অথবা ভাঙা ব্যালট বাক্স জঙ্গলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার ছবি ছাপা হয়েছিল, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। এই যে সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতি সুস্থ গণতন্ত্র চার্চার জন্য সহায়ক নয়। এ সংস্কৃতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও দূরত্ব আরও বৃদ্ধি করে। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে হয়ে পড়ে একদলীয়! লঙ্ঘিত হয় মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সুস্থ চিন্তার চর্চা। ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে এ কথাগুলো আবারও বলা যায়। মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দিয়ে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা যায় বটে; কিন্তু দলীয় সরকারের ভাবমূর্তি তাতে উজ্জ্বল হয় না। এ মানসিকতায় যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। আজ তাই সময় এসেছে এসব নিয়ে ভাববার। এক্ষেত্রে শুধু নির্বাচন কমিশনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ‘স্টেকহোল্ডার’কে আজ এগিয়ে আসতে হবে।
Daily Alokito Bangladesh
24.04,16

আইএসের দাবিকে আমরা কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নেব?


বাংলাদেশে বিদেশি হত্যাকা-, খ্রিস্টানধর্ম প্রচারক বা ফাদারদের হত্যা বা হত্যাচেষ্টার খবর যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়ে বলা হচ্ছিল এসব কর্মকা-ের সঙ্গে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের জঙ্গিরা জড়িত, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছিল এ সংগঠনের অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই। কিন্তু অতিসম্প্রতি আইএসের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত 'দাবিক'-এর সর্বশেষ সংখ্যায় (১৪তম) জনৈক শেখ আবু ইবরাহিম আল হানিফ নামে এক ইসলামী জঙ্গির সাক্ষাৎকার প্রচার করে বলা হয় তিনি বাংলাদেশের আইএসের প্রধান। ওই সাক্ষাৎকারে আবু ইবরাহিম আল হানিফ বাংলাদেশে আইএসের স্ট্রাটেজির কথাও উল্লেখ করেন। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি করতে চায় আইএস। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে 'হিন্দু ভারত' ও 'বৌদ্ধ বার্মা'য় জিহাদ পরিচালনা করবে জঙ্গি সংগঠনটি। এ সংবাদটি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবারো বলেছেন এ সংগঠনটির কোনো অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের সংবাদগুলোকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের খবর আমরা সংবাদপত্র থেকে পাঠ করছি। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই সর্বশেষ সাক্ষাৎকারটিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। নেয়া ঠিকও হবে না।

ইউরোপে কিংবা পশ্চিম আফ্রিকায় অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সেখানে সন্ত্রাসীরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা প্যারিস কিংবা ব্রাসেলসের সমাজজীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ যখন একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন, ওই স্টেডিয়ামের বাইরে তখন তিন আত্মঘাতী বোমারু নিজেদের বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা এটা অাঁচ করতে পারেননি। চিন্তা করা যায় সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে পাখির মতো নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে মানুষ হত্যা করেছিল! ওই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে তা ইসলামিক স্টেটের প্রপাগান্ডা ম্যাগাজিন 'দাবিকে' ফেব্রুয়ারির সপ্তম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন, পুরো ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে 'দাবিকে' অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তার পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাৎকার ছাপা হলেও তা প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউইয়র্কের 'টুইন টাওয়ার'-এর ক্ষেত্রে। টুইন টাওয়ার হামলার ১৫ বছর পর ব্রাসেলসে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত হলো। এর পরপরই আইএসের অপারেটিভরা ক্যালিফোর্নিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল।
২০০১ সালে অস্তিত্ব ছিল আল-কায়েদার। আজ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামিক স্টেট। টার্গেট একটাই_ মুসলিমবিরোধী একটা জনমত গড়ে তোলা। ২০০১ সালের পর দীর্ঘদিন মুসলিমবিরোধী একটা মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন মুসলমানরা, যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তারা সেখানে একটা আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। সে পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে মুসলমানরা যখন মার্কিন সমাজে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছেন, ঠিক তখনই ক্যালিফোর্নিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকা-ে আইএসের সম্পৃক্ততা 'আবিষ্কৃত' হয়েছিল।
আইএসের কর্মকা- এখন অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। আইএস এখন 'দূরবর্তী খিলাফত' প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আইএস মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তথাকথিত 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠার যে ম্যাপ প্রকাশ করেছে তাতে উপমহাদেশের দেশগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে যে হামলা চালানো হয়েছিল তা 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে করা হয়েছিল বলে আইএসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ইউরোপে তারা যে 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাকে তারা বলছে 'এমিরাত অব আন্দালুসিয়া'। ঠিক তেমনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে 'খোরাসান রাজ্য', যা ইসলামিক খিলাফতের অংশ। মধ্য এশিয়ার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল ছিল খোরাসান। মধ্যযুগে যেমনটা ছিল তেমনি করে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, ভারত ও চীনের একটা অংশকে খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। আফ্রিকাসহ বেশ কিছু দেশে কিছু জঙ্গি সংগঠন আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যেমন বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), আল শাবাব (সোমালিয়া), আনসার বায়াত আল মাকডিস (মিসর), পশ্চিম আফ্রিকায় মুভমেন্ট ফর ইউনিটি অ্যান্ড জিহাদ, তেহরিকে তালিবানের (পাকিস্তান) কথা। বলা ভালো, বোকো হারাম এখন শুধু উত্তর নাইজেরিয়ার বিশাল অংশই নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং পাশের মালি, ক্যামেরুন, নাইজারের প্রত্যন্ত অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণ করছে। সুতরাং আজ যখন আইএস বাংলাদেশে তার সংগঠনপ্রধানের নাম ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশে একটি ঘাঁটি গড়ার কথা ঘোষণা করে, একে হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে আইএস নেই। এর পেছনে হয়তো সত্যতা আছে। কিন্তু তারা সুযোগ খুঁজছে। আমাদের মধ্যকার বিভেদ, ফাঁদ, দরিদ্রতা, অসমতা ইত্যাদি একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে এ অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি তৈরি করার। আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এখনই। কিন্তু বাস্তবতা বলে বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে জঙ্গিরা যখন তৎপর হয়ে উঠেছে, তখন জঙ্গি দমন প্রশ্নে নূ্যনতম যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। ফলে বড় দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়েছে স্থানীয় জঙ্গিরা। আর তাদের কারো কারো সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সম্পর্ক থাকা বিচিত্র কিছু নয়।
আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য এখানেই যে, দেশে একটি পার্লামেন্ট থাকলেও জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত এ জঙ্গিবাদের বিষয়টি নিয়ে আমরা পার্লামেন্টে আলোচনা হতে দেখিনি। তথাকথিত একটি বিরোধী দল সংসদে রয়েছে বটে, কিন্তু তাদের কোনো কর্মকা- নেই। উপরন্তু সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে বিএনপিবিরোধী মনোভাব এখনো অব্যাহত রয়েছে। এমন কথাও বলা হয়েছে, দুই বিদেশি হত্যাকা-ের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত জড়িত। অবশ্যই আমরা চাইব এসব হত্যাকা-ের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হোক। কেননা জঙ্গিবাদের এ সমস্যাটা শুধু সরকার বা আওয়ামী লীগের একক কোনো সমস্যা নয়। বরং এ সমস্যাটা বিএনপিরও এবং সমগ্র জাতিরও। আমরা আইএসের নির্মম হত্যাকা-ের ভিডিও সংবাদ দেখেছি। কেনিয়ায় বোকো হারামের মেয়েশিশু অপহরণের কাহিনীও পত্রপত্রিকা থেকে পড়েছি। ওইসব পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমরা মেলাতে চাই না। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উৎখাতে তাই প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐকমত্য। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তটাও জরুরি, যাতে প্রকৃত 'সত্য' বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ আমরা সত্যি সত্যিই দেখতে চাই বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে কি নেই। কিংবা অতীতে সব হত্যাকা-ের সঙ্গে আইএসের তথাকথিত সম্পৃক্ততার অভিযোগটিও আমরা খতিয়ে দেখতে চাই। এ ক্ষেত্রে যদি 'বেস্নম গেম' হয়, যদি বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা দলকে টার্গেট করা হয়, তাতে প্রকৃত 'সত্য' বেরিয়ে আসবে না। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেক ভালো কাজ করছে। সম্প্রতি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে প্রশ্ন করলেও, অনেকেই এটা মানতে চাইবেন না। তাদের দক্ষতার অভাব নেই। নেই কমিটমেন্টেরও অভাব। র‌্যাব নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও এ বাহিনীর অনেক কৃতিত্ব রয়েছে। তাদের কৃতিত্বকে আমরা ছোট করতে পারি না। তবে সন্ত্রাসবাদ দমনে তাদের দক্ষতা, কৌশল, পরিকল্পনা বাড়ানো দরকার।
একটি শক্তিশালী 'কাউন্টার ইনটেলিজেন্স' ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। এ মুহূর্তে এ দেশে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি, যাতে জঙ্গি দমনে আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আমি আস্থাটা রাখতে চাই। তবে সেই সঙ্গে এও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এখন কোনো না কোনোভাবে এ জঙ্গিবাদে আক্রান্ত। তাই বৈশ্বিক একটা ঐকমত্য প্রয়োজন। একই সঙ্গে আরো একটা বিষয় আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। তা হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগিতা।
আফ্রিকায় 'বোবো হারাম' সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করার জন্য আফ্রিকান ঐক্য পরিষদ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নিজেরা তথ্য বিনিময় করবে এবং ঐকমত্যভাবে ওই সমস্যা মোকাবেলা করবে। জঙ্গি সমস্যাটি সার্কের ফোরামে আলোচনা হয়েছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বিবিআইএন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ কানেকটিভিটির আওতায় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপাল এখন থেকে একসঙ্গে কাজ করবে। এ সহযোগিতার আলোকে আমরা জঙ্গিবাদ অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। এ চারটি দেশ স্থানীয় জঙ্গিদের মুভমেন্ট মনিটর করতে পারে। তথ্য বিনিময় করতে পারে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বিশেষ করে জাতিসংঘের টেকনিক্যাল সহযোগিতারও প্রয়োজন রয়েছে। জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে অর্থায়নের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এদিকে নজরদারি বাড়ানো দরকার। জঙ্গি দমনে (মধ্যপ্রাচ্যে) গঠিত হয়েছে এষড়নধষ ঈড়ধষরঃরড়হ ঃড় পড়ঁহঃবৎ ওঝওখ. ৬২টি দেশ এতে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ এখনো তাতে যোগ দেয়নি। ভারত, পাকিস্তান ও চীনও এ অ্যালায়েন্সে যোগ দেয়নি। তবে বাংলাদেশ এষড়নধষ ঋঁহফ ভড়ৎ ঈড়সসঁহরঃু ঊহমধমবসবহঃ ধহফ জবংরষরবহপব-এর বোর্ড মেম্বার। এদের মূল কাজ হচ্ছে উগ্রবাদ দমন করা। 'অংশীদারিত্ব ও সংলাপ' চুক্তির পরবর্তী সভায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিষয়টি যে উঠবে, তা স্পষ্ট করেই বলা যায়। তাই আমাদের প্রস্তুতি থাকা দরকার। জঙ্গিবাদের উত্থানকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় জঙ্গিরা কারো মদদ পাচ্ছে। এরা কারা তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব গোয়েন্দাদের। এদের আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করা দরকার। সেই সঙ্গে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে আইএসের মুখপাত্র মাসিক পত্রিকা 'দাবিক'-এর বাংলা সংস্করণ অনলাইনে পাওয়া যায়। এখানে 'দাবিক'-এ প্রকাশিত সংবাদ, প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এর সঙ্গে বাংলাদেশি কেউ জড়িত কিনা, তা জানা জরুরি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের অনলাইন প্রকাশনার প্রচার বন্ধ করা যায় কিনা, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়াও জরুরি। আমরা বার বার বলে আসছি, বাংলাদেশে আইএসের সাংগঠনিক কাঠামো নেই। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমটি বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। এখানে জঙ্গি কার্যক্রম ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ঝুঁকি অন্তত আইএস নেবে না। দ্বিতীয়ত, আইএসের কর্মকা- পরিচালনার জন্য পাশের দেশগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সহযোগিতা তারা পাবে না। তৃতীয়ত, আইএস গেরিলা কায়দায় সন্ত্রাসী কর্মকা- পরচালনা করে না। এদের স্ট্রাটেজি ভিন্ন। এদের নিজস্ব সেনাবাহিনী পর্যন্ত আছে। বাংলাদেশে এটা সম্ভব নয়। চতুর্থত, বাংলাদেশে মূলত একটি সহনীয় ইসলাম রয়েছে। এ সহনীয় বা লিবারেল ইসলাম জঙ্গিবাদকে কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করবে না। তাই আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনের বিকাশের সম্ভাবনা এখানে ক্ষীণ। তার পরও একজন শেখ ইবরাহিম আল হানিফের সাক্ষাৎকারটি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। এটা একটি ভুয়া নাম। ওই সাক্ষাৎকারটি প্রপাগান্ডার একটি অংশ মাত্র।

বাংলাদেশে আল কায়দার উপস্থিতি ও বৈশ্বিক জঙ্গি তৎপরতা


 
  
বাংলাদেশে আল কায়দা কিংবা ইসলামিক স্টেট (আইএস)’র অস্তিত্ব নিয়ে বড় ধরণের বিতর্ক রয়েছে। আর এই বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে দুটো সংবাদ। প্রথম সংবাদটিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়ে ভারতে হামলা চালাতে চায় আইএস। আর দ্বিতীয় সংবাদটিতে আমাদের তথ্যমন্ত্রী ভারতের একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন আল কায়দা নেতা লাদেনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৮ হাজার জঙ্গি আছে দেশে।
সারা বিশ্বে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে। আইএস তাদের কর্মতৎপরতা সিরিয়া-ইরাকের বাইরে গিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স আর বেলজিয়ামে সম্প্রসারণ করেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে ইতালি ও জাপানি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ধর্মপ্রচারক লুৎ সরকারকেও হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় আইএস জড়িত এটা জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা সংস্থা SITE (Search for International Terrorist Entities)-এর পক্ষ থেকে বলা হলেও, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার অস্বীকার করা হচ্ছিল। কিন্তু আইএস এর মুখপাত্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ‘দাবিক’ ম্যাগাজিনে অতি সম্প্রতি তাদের ১৪তম সংখ্যায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি করতে চায় আইএস। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে ‘হিন্দু ভারত’ ও ‘বৌদ্ধ বার্মা’য় জিহাদ পরিচালনা করতে চায় আইএস।
বাংলাদেশ শাখার প্রধানের (শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ) সাক্ষাৎকারও ছাপা হয়েছে ওই সংখ্যায়। এই ঘটনা যখন বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তখন তথ্যমন্ত্রী ভারতীয় সংবাদপত্র দি হিন্দুতে দেয়া একটি বক্তব্য একইসাথে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে আল কায়দার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ৮ হাজার জঙ্গি আছে, এটা বহির্বিশ্বেও আলোড়ন তুলবে। জঙ্গি ওয়ার লিস্টের তালিকায় এখন বাংলাদেশকে দেখা হতে পারে। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ায়, ফিলিপাইনে ইসলামিক জঙ্গিরা তৎপর।
এদের কর্মকাণ্ড একাধিকবার আন্তর্জাতিক খবরের জন্ম দিয়েছে। ফিলিপাইনে আবু সায়াফ গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় জামিয়া ইসলামিয়ার হাতে বিদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এই দেশ দুটো সম্পর্কে বিশ্বে একটি বাজে ধারণার জন্ম দিয়েছে। এ অঞ্চলে আইএস’র নেটওয়ার্ক কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে, তা জানা না গেলেও আল কায়দার প্রভাব আছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে আল কায়দা একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের জঙ্গিরাও যে এতে করে উৎসাহিত হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীকে জড়িত করলেও অভিযুক্ত জঙ্গিদের ব্যক্তিজীবন তাদের জীবনধারা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কিংবা যায় ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা নেই। প্যারিস হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আবদেল হামিদ আবাউদ নিজে কোনো দিন কোরান পড়েননি। নামাজও পড়তেন না। তার চাচাতো বোন নারী বোমাবাজ হাসনা বুলাচেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ও জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন, এমনটাই জানা যায়। ফলে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই অনেকে মনে করেন।
যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে, এর শেষ কোথায়? প্যারিস ট্র্যাজেডিই কি শেষ? যেভাবে ব্রাসেলসে সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে তাতে করে কি এ ধরণের হামলা আগামীতেও রোধ করা সম্ভব হবে? এর জবাব সম্ভবত না বাচক। কেননা ইউরোপে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আইএস। একটি ‘শক্তি’ তাদের উৎসাহ যোগাচ্ছে। সম্ভবত ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে। সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এ ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কতগুলো উদ্দেশ্য পরিষ্কার।
এক. ৯/১১-এর পর যেভাবে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ মনোভাব সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল এখন প্যারিস ঘটনাবলির পর সারা ইউরোপে একটি ‘মুসলমান বিদ্বেষী’ সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে বিশ্বমনোভাব ছড়িয়ে যাবে। মুসলমানরা (যেসব শরণার্থীকে ইতোমধ্যে ইউরোপে আশ্রয় দেয়া হয়েছে) সব সময় থাকবেন এক ধরণের ‘নিরাপত্তা বলয়’-এর ভেতর। তাদের সব কর্মকাণ্ড মনিটর করা হবে। তারা ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছেন বটে কিন্তু তাদের এক ধরণের ‘বস্তিজীবন’ যাপনে বাধ্য করা হবে। তাদের জন্য তৈরি করা হবে ‘কংক্রিটের বস্তি’ এবং সেখানেই তাদের বসবাসে বাধ্য করা হবে। ইউরোপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হবে। জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ রাখত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী যুগে যেভাবে হোমল্যান্ড সৃষ্টি করে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হতো, অনেকটা সেভাবেই সিরীয় অভিবাসীদের এখন এক ধরণের ‘ঘেটো’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে।
দুই.
উগ্রপন্থী তথা কনজারভেটিভরা প্যারিস ঘটনায় ‘উপকৃত’ হবে। ফ্রান্সে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন আগামীতে। নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ করে তাদের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসা হবে এবং তাদের দিয়ে এক ধরণের ‘নোংরা রাজনীতি’ করানো হবে। অর্থাৎ ‘ইউরোপ হবে মুসলমান-মুক্ত’— এ ধরণের একটি স্লোগান ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে—এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। 
অন্যদিকে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সেখানে কট্টরপন্থীরা সক্রিয় হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য এর বড় প্রমাণ। তার মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব বাহ্যত আইএসকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘অবস্থান’ করতে সাহায্য করবে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৬৫ দেশের সমন্বয়ে একটি আইএস বিরোধী অ্যালায়েন্স করেছে। রাশিয়া এই জোটে নেই। কিন্তু রাশিয়া আলাদাভাবে আইএস বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। তবে অচিরেই আইএস বিরোধী অভিযানে ফাটল দেখা দেবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাঝে যদি ফাটল থাকে তাতে লাভ ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের। অধ্যাপক চস্পুডোভস্কি তার বহুল আলোচিত গ্রন্থ the Globalization of War : America’s Long war against Humanity-তে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ‘হাত’ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে আসছে তাতে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করে। এক. গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা, দুই. অর্থনৈতিক অবরোধ, তিন. সরকার পরিবর্তন। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্রাটেজি ব্যবহার করা হলেও তা সফল হয়নি। এই স্ট্র্যাটেজি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। যেসব দেশে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে দরিদ্রতা বেড়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে (ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া)। ‘মানবাধিকার রক্ষা ও পশ্চিমা গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে এ ধরণের অভিযান পরিচালনা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
ইউরোপে কিংবা পশ্চিম আফ্রিকাতে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সেখানে সন্ত্রাসীরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সন্ত্রাসীরা প্যারিস কিংবা ব্রাসেলসের সমাজ জীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ যখন একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন তখন ওই স্টেডিয়ামের বাইরে ৩ আত্মঘাতী বোমারু নিজেদেরকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল।

গোয়েন্দারা এটা আঁচ করতে পারেনি। চিন্তা করা যায়, সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ‘পাখির মতো’ নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে! এই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে তা ইসলামিক স্টেটের প্রোপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন সমস্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে ‘দাবিক’-এ অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তার পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাৎকার ছাপা হলেও এর প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেননি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউইয়র্ক ও টুইন টাওয়ার-এর ক্ষেত্রেও। টুইন টাওয়ার-এর হামলার ১৫ বছর পর ব্রাসেলসে বড় ধরণের একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলো। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরপরই আইএস এর অপারেটিভরা ক্যালিফোর্নিয়াতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল।
২০০১ সালে অস্তিত্ব ছিল আল কায়দার। আজ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামিক স্টেট। টার্গেট একটাই—মুসলমান বিরোধী একটা জনমত গড়ে তোলা। ২০০১ সালের পর দীর্ঘদিন মুসলমান বিরোধী একটা মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন মুসলমানরা, যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তারা সেখানে একটা আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। সেই পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে মুসলমানরা যখন মার্কিন সমাজে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে, ঠিক তখনই ক্যালিফোর্নিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আইএসের সম্পৃক্ততা ‘আবিষ্কৃত’ হয়েছিল। 
আইএস এর কর্মকাণ্ড এখন অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। আইএস এখন ‘দূরবর্তী খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আইএস মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তথাকথিত ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার সংকল্প প্রকাশ করেছে তাতে উপমহাদেশের দেশগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে যে হামলা চালানো হয়েছিল, তা ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে করা হয়েছিল বলে আইএস এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ইউরোপে তারা যে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাকে তারা বলছে 'আমিরাত অব আন্দালুসিয়া।
ঠিক তেমনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে খোরাসান রায়, যা ইসলামিক খিলাফতের অংশ। মধ্য এশিয়ার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল ছিল খোরাসান। মধ্যযুগে যেমনটা ছিল তেমনি করে ইরানের উত্তর পূর্বাঞ্চল, প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, ভারত ও চীনের একটা অংশকে খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়—আফ্রিকাসহ বেশ কিছু দেশে কিছু জঙ্গি সংগঠন আইএস এর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যেমন বোকো হারাম (নাইজেরিয়া), আল সাবাব (সোমালিয়া), আনসার বায়াত আল মাকডিস (মিশর), পশ্চিম আফ্রিকায় ‘মুভমেন্ট ফর ইউনিটি এন্ড জিহাদ, তেহরিকে আলিবান (পাকিস্তান) এর কথা। বলা ভালো বোকো হারাম এখন শুধুমাত্র উত্তর নাইজেরিয়ায় বিশাল অংশই নিয়ন্ত্রণ করছে না।
বরং পার্শ্ববর্তী মালি, ক্যামেরুন, নাইজারের প্রত্যন্ত অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণ করছে। সুতরাং আজ যখন আইএস বাংলাদেশে তার সংগঠন প্রধানের নাম ঘোষণা করে, এটাকে হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বাংলাদেশে আইএস নেই। এর পেছনে হয়ত সত্যতা আছে। কিন্তু তারা সুযোগ খুঁজছে। আমাদের মধ্যকার বিভেদ, দরিদ্রতা, অসমতা ইত্যাদি একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে এই অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি তৈরি করার। আমাদের সতর্ক হবার সময় এখনই।
Poriborton
19.04.16

ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি গত ১৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখ প্রাচীন শহর ইস্তাম্বুলে ওআইসি বা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার দু’দিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। সম্মেলনে ওআইসি সদস্যভুক্ত ৫৭টি দেশের মধ্যে ৩০টি দেশের রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধানরা অংশ নেন। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ চূড়ান্ত করা হলেও শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর সফর স্থগিত রাখা হয়। এর পরিবর্তে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর স্থগিত করার ব্যাপারে কোনো সরকারি ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও একটি সংবাদপত্র আমাদের জানাচ্ছে নিরাপত্তাজনিত কারণেই প্রধানমন্ত্রীর ওআইসি সম্মেলনে যোগদান স্থগিত করা হয়। যদিও এটা ঠিক সম্প্রতি মুসলিম দেশগুলোতে সংঘাত, একটি মুসলিম দেশ কর্তৃক অপর মুসলিম দেশে আক্রমণ, সিরিয়া সংকট, আইএসের উত্থান এবং সৌদি আরবের ভূমিকা ইত্যাদি নানা প্রশ্নে ওআইসির কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে সংগতকারণেই অনেক মুসলিম দেশ ওআইসির এই শীর্ষ সম্মেলন তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এ ধরনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন সাফল্য অর্জন করা যায় না। কিন্তু তার পরেও সাইড লাইনে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা মতবিনিময় করেন। এক সময় মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে সাংবিধানিক বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সর্বশেষ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এই বাধ্যবাধকতাটুকু বাদ দেয়া হয়েছে। তার পরও মুসলিম বিশ্বে বিশেষ করে সৌদি আরবে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি সেখানে কাজ করেন। বাংলাদেশ সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোটে যোগ দিয়েছে, যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য একটি পরিবর্তন। ‘ট্রেডিশনাল ডিপ্লোম্যাসি’ বা সনাতন কূটনীতি এখন বদলে যাচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা, কানেকটিভিটি এখন প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এখন তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করছে আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিতে গড়ে উঠছে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ায়ও গড়ে উঠছে এমনি ধরনের একাধিক আঞ্চলিক তথা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। দুটি আঞ্চলিক তথা উপ-আঞ্চলিক সংস্থার নাম আমরা উল্লেখ করতে পারি বিসিআইএম এবং বিবিআইএন। এই দুটি সংস্থার ব্যাপারেই বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে এবং বাংলাদেশ মনে করে এই দুটি আঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ তার অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তার নিজের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারবে। দুটি আঞ্চলিক সহযোগিতার সঙ্গে ভারত এবং চীন জড়িত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য সেখানেই নিহিত, যেখানে বাংলাদেশ এই দুটি সংস্থার ব্যবহার করে তার জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নিতে পারবে। বিবিআইএন অর্থাৎ ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালকে নিয়ে যে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, তা পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে একদিকে সার্ক যেমনি দুর্বল হবে, ঠিক তেমনি বিসিআইএম জোটও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বলা ভালো মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ নীতিগতভাবে এই জোট গঠনে তার সম্মতি জানায়। বিসিআইএম মূলত একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। সম্প্রতি বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান প্রদেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমার) নামে যে অর্থনৈতিক জোটের জন্ম হয়েছে, তার উদ্যোক্তা চীন। ২০০৩ সালে চীন এ ধরনের একটি অর্থনৈতিক জোটের প্রস্তাব করে। চীনের উদ্দেশ্য ছিল চীনের ইউনান প্রদেশকে সামনে রেখে মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি জোট গঠন করা। চীনের ওই প্রস্তাবকে তখন চিহ্নিত করা হয়েছিল, ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘কুনমিং উদ্যোগ’ হিসেবে। কুনমিং হচ্ছে ইউনান প্রদেশের রাজধানী। কুনমিংয়ের সঙ্গে চট্টগ্রামের আকাশ দূরত্ব ব্যাংককের চাইতেও কম, মাত্র এক ঘণ্টা। আর কুনমিংয়ের আবহাওয়া আমাদের দেশের মতোই। কিন্তু দীর্ঘদিন ভারত চীনের এই প্রস্তাবের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর একটা উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলের সঙ্গে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর একটা যোগসূত্র স্থাপন করা। চীনের ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে ভারত তখন সন্দিহান ছিল। কেননা ভারত নিজে আসিয়ানের সদস্য হতে চায় এবং ইতোমধ্যে (২০০৭) আসিয়ানের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ এখন আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য। আসিয়ানের পূর্ব সদস্যপদ পেতে হলে প্রথমে আঞ্চলিক ফোরাম ও পরে ‘ডায়লগ পার্টনার’-এর (দ্বিতীয় ধাপ) সদস্য হতে হয়। ভারত ‘ডায়লগ পার্টনার’-এর সদস্য। বাংলাদেশ এই পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। ভারতের অনাগ্রহের কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর জট খোলেনি। পরবর্তীতে বিসিআইএমের ধারণার বিকাশ ঘটে এবং এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়। তবে বর্তমান মোদি জামানায় বিসিআইএম ধারণা আজো শক্তিশালী হবে কিনা, সে ব্যাপারে প্রশ্ন আছে। যদিও মোদি নিজে চীনের উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী। তিনি ২০০৬, ২০০৭ ও ২০১১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে চীন সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও চীনে গেছেন। একই সঙ্গে মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারেও মোদির আগ্রহ অনেক। ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে মিয়ানমারে। ভারত ইতোমধ্যে মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস আহরণে চুক্তি করেছে। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি সেখানে বিনিয়োগ করছে। ভারত প্রাপ্ত গ্যাস নিয়ে ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিযেতে চায় তাদের সাতবোন রাজ্যে। এ জন্য ভারত ‘কালাদান প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। কলকাতা থেকে মিজোরামে পণ্য পরিবহনের (মিয়ানমারের ওপর দিয়ে) লক্ষ্যই এই ‘কালাদান প্রজেক্টটি’ ভারত হাতে নিয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে অতি সম্প্রতি ‘কানেকটিভিটির আওতায় ভারতের একটি ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায়, এই ‘কালাদান প্রজেক্ট’-এর ভবিষ্যৎ তখন প্রশ্নের মুখে। ভারত এই রুটকে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেবে। তবে বিসিআইএমের ব্যাপারে ভারতের চাইতে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। বলা ভালো তিনটি রুটে ইউনানের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে। কিন্তু ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভারত ও চীন ধীরে ধীরে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। চীন প্রকাশ্যে তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি নিয়ে পৃথিবীর ৬০টি দেশকে একটি পতাকাতলে আনতে চায়। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এই স্ট্র্যাটেজির অন্যতম অংশ। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভারতের স্বার্থের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ কারণে ভারত তার পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ‘কটনরুট’কে আবার নতুন আঙ্গিকে পুনর্গঠন করছে। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। এই সময় ভারত মহাসাগরকে ‘চোল হ্রদ’ বলা হতো। ভারত আবারো ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফলে ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ফলে বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। এই জোটের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ এখন অনেক কমে যাবে। তার অগ্রাধিকার তালিকায় উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএম জোট গুরুত্ব পাবে বেশি। এক সময় বাংলাদেশের অসহযোগিতার কারণে ভারত ‘কালাদান প্রকল্প’ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকটিভিটি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করেছে। তাই ‘কালাদান প্রজেক্ট’ গুরুত্ব পাবে কম। এখন দেখার বিষয় ভারত আদৌ ‘কালাদান প্রজেক্ট’ পরিত্যাগ করে কিনা? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের বিপুল জ্বালানি চাহিদা ও পানি সমস্যার সমাধানে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে ভারতের মনোভাবের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ভারত যদি দ্বিপাক্ষিক দৃষ্টিকোণের আলোকে বিবিআইএন জোটকে তার স্বার্থে ব্যবহার করে, তাহলে এতে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের যে অগ্রাধিকার তা বাধাগ্রস্ত হবে। এতে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি বিকশিত হবে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি এক সময় যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা শোনা যায় না। এমনকি সরকারপ্রধান কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও এটা প্রমাণিত হয়নি যে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে। বলতে গেলে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলেই (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখিতার কথা বলে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশের গত ৪৪ বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্ব দিগন্তের দেশগুলো ছিল উপেক্ষিত। বিশেষ করে মিয়ানমার কিংবা থাইল্যান্ডের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার কোনো বড় উদ্যোগ অতীতে লক্ষ্য করা যায়নি। পূর্বমুখী নীতি বলতে সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব ও প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, জোরদার ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে বোঝায়। এটি ছিল অনেকটা উপেক্ষিত। যেমন বলা যেতে পারে সিঙ্গাপুরের কথা। ১৯৭৩ সালে সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশটি সফর করেছিলেন। এরপর ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর থেকে দেশ দুটির মাঝে উচ্চপর্যায়ে তেমন একটা সফর বিনিময় হয়নি। তবে বেগম জিয়া ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর সফর করেছিলেন। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটা গুরুত্ব আছে। সিঙ্গাপুর কর্তৃক প্রস্তাবিত আমেড-৮ এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সিঙ্গাপুরে প্রধানমন্ত্রী এশিয়া মিডিলইস্ট ডায়লগ-৮ (আমেড-৮) এর প্রস্তাব করেছিলেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মিসর, জর্দান, কুয়েত এবং বাহরাইনের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত এই ফোরামের লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় এবং পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য একে অপরকে সাহায্য করা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের তালিকায় আমেড-৮-এর গুরুত্ব অনেক। প্রসঙ্গক্রমেই বৈশ্বিক সন্ত্রাস দমনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে বাংলাদেশের যোগদানের প্রসঙ্গটিও আলোচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ মূলত এ জোটটিকে দেখছে ‘সন্ত্রাস দমনের’ একটি কেন্দ্র হিসেবে এবং দেখতে হবে আগামী দিনগুলোতে এই জোটটি কীভাবে বিকশিত হয়। বাংলাদেশ কোনো সামরিক কার্যক্রম অর্থাৎ কোনো যুদ্ধে অংশ নেবে না, সেটাই প্রত্যাশিত। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের যে ‘তালিকা’ সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কিছুটা ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ‘আর্থিক সম্পর্ক’ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া থেকে ৮ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় কিংবা রাশিয়া কর্তৃক একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি ‘নতুন দিক’, যাকে কিনা বলা হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়কার পররাষ্ট্রনীতিরই প্রতিফলন। একুশ শতকে অর্থনৈতিক কূটনীতি যেখানে সারা বিশ্বে অগ্রাধিকার পাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের সাফল্য খুব আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ এখনো তৈরি পোশাক রফতানির ওপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির আলোকে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এটি এখন নিয়ে যাওয়া হয়েছে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরে। এতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না। আমাদের পণ্যের রফতানি, একই সঙ্গে আমদানির পরিমাণও বেড়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আমদানি হয়। তাতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরটি নির্মিত হলে ২০ লাখ টিইউএস (কন্টেইনার টার্মিনাল) ধারণ করতে পারত। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ ক্ষমতা হতো ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন বছরে। এর প্রয়োজন ছিল। আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরটি থাকা উচিত ছিল। চীন প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এটি তৈরি করে দিতে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু ভারত নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়েছিলেন। ফলে এটি পায়রা বন্দরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চীন গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে বিশ্বে এক নম্বর। আমরা তাদের সক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারলাম না। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত ও চীনকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়। ভারত পার্শ্ববর্তী দেশ থাকায়, খুব স্বাভাবিক কারণেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্কেও বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ চীন সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই দুটি দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পার হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে মাত্র ৪০ বছর দিয়ে এ সম্পর্ককে বিচার করা যাবে না। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ভিত্তি রয়েছে এই দুটি দেশের মাঝে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত গত ২৯ জুন (২০১৫) স্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চায়। সে বছর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর পূর্তি হবে। বাংলাদেশের স্বপ্ন ২০৫০ সালে ধনী দেশে পরিণত হওয়া এসব স্বপ্ন পূরণে দুই দেশ এক সঙ্গে কাজ করতে পারে। গত ১২ এপ্রিল ঢাকা সফররত চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জোয়ানইউয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময়ও এমন আভাস পাওয়া গেছে। চলতি বছর চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে। জাতীয় স্বার্থের আলোকেই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে চীন ও ভারত যেমনি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি তার ভাষণে সন্ত্রাসবাদ, সহিংস উগ্রবাদ দমনে মুসলিম দেশগুলোর ওপর ঐক্যের গুরুত্ব দিয়েছেন। মুসলিম দেশগুলো বিশ্বে এক-চতুর্থাংশেরও বেশি স্থানে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। এটা বিবেচনায় নিয়ে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে মুসলিম বিশ্বে। এমনকি ওআইসির নেতৃত্বে একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠিত হলে বাংলাদেশ তাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি বটে, কিন্তু পররাষ্ট্রনীতিতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। Daily Manobkontho 18.04.16

মির্জা ফখরুলের স্বীকারোক্তি ও বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি



মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে দুইটি জাতীয় সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এসব সাক্ষাৎকারে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে করে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। মির্জা ফখরুল স্বীকার করেছেন, এর আগে যেসব আন্দোলন-সংগ্রাম তারা করেছেন, তাতে কিছু ভুলত্রুটি ছিল। আর সেসব ভুলত্রুটি সংশোধন করে নতুনভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের রূপরেখা তৈরি করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। (সকালের খবর, ১১ এপ্রিল)। যদিও সুস্পষ্টভাবে তিনি কোনো আন্দোলনের কথা বলেননি। তবে এটা তো সত্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর দেশে যে সহিংস রাজনীতি শুরু হয়েছিল, তাতে বিএনপিকে দায়ী করা হয়। বিএনপি ওই সময় লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেও  তাতে তারা সফল হয়নি। দেশে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটে। বিএনপি এসব অহিংস ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও, সরকার বারবার বিএনপিকেই দায়ী করে আসছে। আজ যখন প্রকাশ্যে মির্জা ফখরুল ‘ভুলত্রুটি’র কথা স্বীকার করেন, তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কেননা রাজনীতিবিদরা সাধারণত তাদের দলের ‘ভুলত্রুটি’র কথা স্বীকার করেন না। সরকারি দলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল অবশ্যই সাধুবাদ পেতে পারেন। মির্জা ফখরুল অপর একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একটি জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। (সমকাল, ১২ এপ্রিল), যা কিনা নতুন করে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে। দেশে বর্তমানে ইউপি নির্বাচন হচ্ছে। বিএনপি তাতে অংশ নিচ্ছে। বিএনপির নেতাদের ভাষায় তারা আওয়ামী লীগকে ‘খালি মাঠে গোল দিতে চায় না’। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিএনপির ব্যাপারে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নেগেটিভ প্রচারণা থাকলেও বিএনপি এখনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বিএনপি তার কাউন্সিল সম্পন্ন করেছে। গেল সপ্তাহে দল পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একাধিক যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদককে মনোনয়ন দিয়েছেন খালেদা জিয়া। কাউন্সিলে তার হাতেই এ ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। সব কাউন্সিলর এমনটিই চেয়েছেন। তবে দলের বাইরে বিভিন্ন মহল থেকে এমন প্রশ্ন উঠেছে, কেন কমিটি গঠনের দায়িত্ব এককভাবে খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দেয়া হলো? একটি ধ্রুপদী গণতান্ত্রিক সমাজে হয়তো এমনটি হয় না। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বড় দল আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও এমনটি আমরা দেখেছি। এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও একই ‘কাজ’ করেন। এককভাবে তিনি কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে কম বিতর্ক সৃষ্টি করেননি। ফলে এগুলো একটি ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়া। খালেদা জিয়া দল পুনর্গঠন করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে কাউন্সিলরদের ভোটে নেতা-নেত্রী নির্বাচিত হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ব্যক্তিই মুখ্য। ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রাজনীতি, দল বিকশিত হচ্ছে। সব দলের ক্ষেত্রেই এ কথাটা প্রযোজ্য।
বলতে দ্বিধা নেই, বিএনপি বড় একটি রাজনৈতিক দল। দলটির নেতাদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। সাম্প্রতিক দলটির নেতাকর্মীরা যেভাবে জেল-জুলুম মোকাবিলা করছেন, অন্য কোনো দলের নেতারা তা করেননি। পহেলা সেপ্টেম্বর বিএনপি ৩৭ বছরে পা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এ ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এ রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি, অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটে পড়েনি, যারা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-১৯৮২, ১৯৯১-’৯৬, ২০০১-২০০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল, ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন খালেদা জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করেই বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ৯০’র এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে খালেদা জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসাংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই খালেদা জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বয়স বেড়েছে। অসুস্থ তিনি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেয়া কিংবা পরবর্তী সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছে এদেশে, তা ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জ্বল করেনি। খালেদা জিয়াকে আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, ‘নিঃসঙ্গ একজন নাবিক’ হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না, কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামে ‘জাহাজ’টিকে তিনি পরিচালনা করবেন। এক সন্তানহারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে। নিঃসঙ্গ খালেদা জিয়া এখন একাই বিএনপি।
বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে। তবে অতীতে বিএনপির কয়েকজন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার ‘গুজব’ ছিল এ কারণেই। ‘খালেদা জিয়াকে দিয়ে হবে না’ কিংবা ‘জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবে’ এ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয়, তখন গুজবের নানা ডালপালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও কেউ কেউ জেলে আছেন এখনও। অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে। আর যারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ‘ব্যস্ত’ রাখতে চায় সরকার, যাতে করে তারা ‘আন্দোলনে’ নিজেদের জড়িত করতে না পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারেননি। খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত ধারা) বিচার, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কিংবা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ডান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে ‘শাস্তি’ দিয়ে তাকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে ‘অযোগ্য ঘোষণা’(?) করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন কিনা জানি না। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। খালেদা জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ নির্বাচনে অংশ নেবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে কেউ যদি বিএনপিকে সংগঠিত করে এটাও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্র্মুলা কার্যকরী করতে চান, আমার ধারণা, তা কোনো কার্যকর ‘ফল’ দেবে না। ‘আসল বিএনপি’ কিংবা নাজমুল হুদার অসংলগ্ন কথাবার্তায় মানুষ খুব আস্থাশীল, এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি আগামীতে অস্তিত্বের সম্মুখীন হতে পারে। বাহ্যত জাতীয় পার্টির মাঝে দুইটি ধারা বিদ্যমান। একটি ধারা, যারা সরকারের অংশ হিসেবেই থাকতে চায়। আর অন্য একটি ধারা, সত্যিকার অর্থেই ‘বিরোধী দলের’ ভূমিকা পালন করতে চায়। তাদের এ ‘দ্বৈত ভূমিকা’ জাতীয় পার্টিকে এরশাদের অবর্তমানে; এমনকি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে আরও একবার ভাঙনের মুখে ঠেলে দিতে পারে। বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টির একটা সম্ভাবনা ছিল বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার, কিন্তু তা হয়নি। ফলে জাতীয় পার্টি নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ব্যক্তি এরশাদের নিজস্ব একটা ‘ইমেজ’ আছে, তাও আবার তার নিজস্ব এলাকায়। তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। ফলে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। বিএনপির কাউন্সিলে হাজার হাজার ডেলিগেটের উপস্থিতি প্রমাণ করে রাজনীতিতে ‘বিএনপির অবস্থানটি’ জাতীয় পার্টি নিতে পারেনি। যদিও জাতীয় পার্টি এ মুহূর্তে সংসদে আছে।
এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্পই বিএনপি, ঘুরে-ফিরে এটা প্রমাণিত। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যে কোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য তথা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল। বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগের উপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সবাই বলেন। সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু প্রায় ২ বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব আছে সরকারে থাকা-না থাকা নিয়ে। ফলে সংসদকে আরও গ্রহণযোগ্য, আরও অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। বলা ভালো, বিএনপি সংসদে না থাকলেও,  বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূলধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থান ও আমার ধারণা অনেকটা সেরকম। সরকারের ভূমিকা তাই এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুইটি শক্তি। এ দুইটি দল দুইটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে, এ দুইটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জমানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে। এ দুই দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই পঞ্চম সংসদ (১৯৯১), সপ্তম সংসদ (১৯৯৬), অষ্টম সংসদ (২০০১) ও নবম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই ঘুরে-ফিরে বিএনপি আলোচনায় আছে এবং আমার বিবেচনায় আগামীতেও থাকবে।
কাউন্সিলে বিএনপি তার আগামী দিনের ‘রাজনীতি’ চূড়ান্ত করেছে। খালেদা জিয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ ‘রাজনীতি’ প্রকাশ পেয়েছে। কতগুলো বিষয়কে কেন্দ্র করে বিএনপির রাজনীতি এখন আবর্তিত হবে। প্রথমত, বিএনপি ‘ভিশন ২০৩০’ এর কথা বলেছে। অর্থাৎ বিএনপি কীভাবে ২০৩০ সালের বাংলাদেশকে দেখতে চায়, তার কিছু রূপকল্পের কথা বলেছে। যদিও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। একটি বড় দলের জন্য এ ধরনের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। দ্বিতীয়ত, বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি সংসদের কথা বলছে। বিএনপির জন্য এটা নতুন। তবে এক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে। এ ব্যাপারে আরও গবেষণা, আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। এক সময় জাসদ (রব) এর প্রবক্তা ছিল। সংবিধানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলা হয়নি। তৃতীয়ত, একটি অন্তর্বর্তীকালীন ও নিরপেক্ষ সরকারের কথা বিএনপি বলছে। যদিও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। সংবিধানে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেটা বিএনপি মানবে কিনা এটা একটা প্রশ্ন বটে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারপ্রধানের আওতায় বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে যাবে না। এখন এটাই বিএনপির শেষ কথা কিনা জানি না। তবে ‘সব দলের অংশগ্রহণের’ যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গ্রহণ করেছে, সেটা নিশ্চিত করতে হলে বিএনপির সঙ্গে একটি সহাবস্থানে যেতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সহাবস্থানের রূপটি কী? আমি ধারণা করছি, আগামীতে বিএনপির কাছ থেকে আমরা এ ব্যাপারে একটি ‘ফর্মুলা’ পাব, যাতে করে সংবিধানকে অক্ষুণ্ণ রেখেই বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশে করা যায়।
বিএনপি পুনর্গঠিত হয়েছে। এখনও স্থায়ী পরিষদ পুনর্গঠিত হয়নি। সেখানেও পরিবর্তন আসবে। তবে সেখানেও যোগ্যদের স্থান দেয়া উচিত। নতুন এক বিএনপি ধীরে ধীরে ‘জন্ম’ হচ্ছে। নেতৃত্বে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এমনটাই হওয়া উচিত। বিএনপি একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ গঠন করে স্থায়ী কমিটির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের সেখানে স্থান দিতে পারে। এতে করে তাদের প্রতি সম্মান দেখানোও হবে।
Daily Alokito Bangladesh
17.04.16

কর ফাঁকির আসল তথ্য ফাঁস করল জার্মান পত্রিকা


গত ৪ এপ্রিল সারা বিশ্বে ফাঁস হয়েছিল বিশ্বব্যাপী কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য। International Consortium Of Investigative Journalists (ICIJ) ফাঁস করে দিল হাজার হাজার ডকুমেন্ট, যাতে দেখা যায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের আত্মীয়স্বজনরা কর ফাঁকি ও অর্থপাচার করেছেন। এ জন্য হাজার হাজার ‘অফশোর আইল্যান্ড’ কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু আসল কথাটি ফাঁস করে দিয়েছে একটি জার্মান পত্রিকা ‘সুডডয়েচে সাইটুং’ গত ৪ মে। পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ অনেক দিন থেকেই কর ফাঁকির ব্যাপারে আইনি সহায়তাকারী সংস্থা মোসাক ফনসেকা ব্যবহার করে আসছিল এবং তারাই এই তথ্যটি ফাঁস করে দেয় ICIJ-এর মাধ্যমে। কর ফাঁকির ঘটনা যখন ফাঁস হয়, তখন থেকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল যেখানে চিন ও রাশিয়ার রাজনীতিবিদদের নাম এসেছে, সেখানে একাধিক মার্কিন রাজনীতিবিদ তথা ব্যবসায়ীর নাম নেই কেন? তাহলে কী তারা কর ফাঁকি দেন না? এখানে বলা ভালো, এই জার্মান পত্রিকাটিতেই কর ফাঁকির তথ্য ফাঁস করা হয়েছিল। পত্রিকাটি এখন জানিয়েছে, ‘জনৈক জন দো’ তাদের সঙ্গে তথ্য ফাঁস হওয়ার এক বছর আগে যোগাযোগ করে। পত্রিকাটি তখন ICIJ’র সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয় এবং পরে তা প্রকাশ করে। এখন পত্রিকাটিই জানাচ্ছে, ফাঁসের সঙ্গে সিআইএ জড়িত। মজার ব্যাপার, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা জানাচ্ছে ICIJ’র সঙ্গে জড়িত তথাকথিত সাংবাদিকদের অনেকেই একসময় সিআইএ’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফলে তথ্য ফাঁসের সঙ্গে সিআইএ’র সংশ্লিষ্টতা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে সিআইএ’র উদ্দেশ্য কী, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ বিশ্বাস করেন, তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা বলতে চাইছেন। একটি তথ্যে দেখা গেছে, কর ফাঁকির ঘটনার সঙ্গে এই মুহূর্তে মার্কিন রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিলারি কিনটনও (যিনি অন্যতম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী) জড়িয়ে গেছেন। পডেস্টা গ্রুপ (Padesta Group), যারা ওয়াশিংটনে লবিস্ট ফার্ম হিসেবে রেজিস্ট্রিকৃত এবং হিলারি কিনটনের হয়ে কাজ করছেন, এই প্রতিষ্ঠানটি কিনটনের কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তা মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণায় প্রভাব ফেলবে। তাহলে কী মার্কিন প্রশাসনের একটা পক্ষ চাচ্ছে না একজন নারী হোয়াইট হাউসে যান! এবং সেই সঙ্গে রিপাবলিকান প্রার্থীর জয়কে নিশ্চিত করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র! ইতিহাস হয়তো একদিন বিষয়টি উদঘাটন করবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কর ফাঁকির এই ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে। অনেক প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠেছে! কেন চিন ও রাশিয়ার নেতৃবৃন্দকে ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হলো? এটা কী ‘সরকার পরিবর্তনের’ ষড়যন্ত্রের একটা অংশ? যারা কর ফাঁকি দেন, যার কিছুটা হলেও বাস্তব ভিত্তি রয়েছে, তারা পানামাকে বেছে নিল কেন? আমি একটু খোঁজখবর নিয়েছি। তাতে দেখেছি পৃথিবীর ৮০টি দেশ ইতোমধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তিটিকে বলা হচ্ছে Multilateral Competent Authority Agreement। এটি ২০১৪ সালের অক্টোবরে বার্লিনে (জার্মানি) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিকে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ট্যাক্স সংক্রান্ত সব তথ্য বিনিময় করবে, যাতে করে যেসব প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, তাদের আইনের আওতায় আনা যায়। পানামা ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। এর অর্থ হচ্ছে, মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব তথ্য রয়েছে, তা তারা দিতে বাধ্য নন। এ কারণেই মোসাক ফনসেকার গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেশি।
কর ফাঁকি দেওয়া কিংবা অর্থপাচার করার কাহিনি আজকের নয়। আফ্রিকান সেনা শাসকরা অতীতে কোটি কোটি ডলার নিজ দেশ থেকে পাচার করেছেন (পাঠক নাইজেরিয়ান সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল সানি আবাচার সুইজারল্যান্ডে গোপনে রক্ষিত অর্থের কথা স্মরণ করুন)। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গাব্রিয়েল জুকম্যান Hidden Wealth of nation held offshore শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের মোট সম্পদের ৮ ভাগ (যার পরিমাণ ৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার) এখন এসব দীপপুঞ্জভিত্তিক হাজার হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো এসব অর্থ আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করে। অধ্যাপক জুকম্যান একটি আতঙ্কের খবর আমাদের জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, পারসীয় অঞ্চলের মোট সম্পদের ৫৭ ভাগ, রাশিয়ার ৫০ ভাগ, আফ্রিকার ৩০ ভাগ ও দক্ষিণ আমেরিকার ২২ ভাগ এসব ‘অফশোর আইল্যান্ডে’ বিভিন্ন কোম্পানির নামে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের জন্য চিন্তার অনেক খোরাক জোগাবে বৈকি।
পানামা পেপারস বিশ্বে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অভিযুক্ত আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগামুন্ড গুনলাগসন পদত্যাগ করেছেন। টিআইর চিলি শাখার প্রধান দেলাভেসু পদত্যাগ করেছেন এবং টিআইর ওই শাখা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের স্ত্রী তাহমিনা দুররানি শরিফ পরিবারের সব সম্পত্তি, যা পানামা পেপারসে উল্লেখ করা হয়েছে, তা পাকিস্তানের জনগণের নামে দান করার দাবি জানিয়েছেন (ট্রিবিউন, ৭ এপ্রিল)। মিসেস দুররানি মনে করেন এর মাধ্যমে শরিফ পরিবারের ‘পাপমোচন’ সম্ভব। নিঃসন্দেহে শরিফ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে দুররানির এই বক্তব্য নওয়াজ শরিফের অবস্থারকে দুর্বল করবে। ভারতে মোদি সরকার যেসব ভারতীয় ব্যক্তির নাম পানামা পেপারসে রয়েছে তা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। পানামা বলছে, তারা ট্যাক্সের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আরও উদ্যোগ নিচ্ছে। খোদ ওবামাও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। সব মিলিয়ে পানামা পেপারস বিশেষ একটি বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে। অর্থপাচার কিংবা ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা ফাঁস করার পেছনে আদৌ কোনো ‘উদ্দেশ্য’ আছে কিনা কিংবা কোনো ‘শক্তি’ এ থেকে ফায়দা উঠাতে চায় কিনা, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা বলাই যায়, চিনের রাষ্ট্রপ্রধান শি জেন পিংয়ের শ্যালকের অর্থপাচারের তথ্য যখন ফাঁস হয়, কিংবা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের কন্যা ও জামাইয়ের অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের তথ্য যখন ফাঁস হয় তখন এই তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সিনেটর তথা ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকির তথ্য যখন ফাঁস হয় না, তখন প্রশ্ন ওঠে বৈকি! বিশ্বের ১৪১৫৩ জন রাজনীতিবিদের অর্থপাচারের কাহিনি উঠে এসেছে পানামা পেপারসে। কিন্তু এতে কোনো বড় মার্কিন রাজনীতিবিদের নাম নেই। একমাত্র হিলারি কিনটনের নাম এসেছে, তাও পরোক্ষভাবে। তবে ক্যামেরন কিংবা আর্জেন্টিনার নাম যে এসেছে এবং যার দালিলিক প্রমাণ আছে, সেটা তারা স্বীকারও করেছেন। ক্যামেরন তার কর সংক্রান্ত ফাইল প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাতে প্রমাণ মেলে তিনি পানামার মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়েছেন। তবে একটি বড় ধরনের কর ফাঁকির ঘটনা এবং পরোক্ষভাবে সিরিয়ায় আসাদকে টিকিয়ে রাখার একটি অভিপ্রায়ের কথাও আমরা জানতে পারি পানামা পেপারসের ডকুমেন্টগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে। তাতে দেখা যায়, আসাদের দুই বৈমাত্রিয় ভাই রামি এবং হাফেন মসলউফ যখন সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, তখনো তারা পানামার মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে এবং সিসিলি দীপপুঞ্জ রেজিস্ট্রিকৃত তিনটি কোম্পানির মাধ্যমে তাদের ব্যবসা অব্যাহত রেখেছেন। তারা সিরিয়ার বিমানবাহিনীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জ্বালানির বিল পরিশোধ করেছেন। আসাদের বিমানবাহিনী সক্রিয় ছিল বিধায় বিদ্রোহী বাহিনীকে তিনি ‘দমন’ করতে পেরেছিলেন। যা কিনা পরোক্ষভাবে আসাদকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে। উল্লেখিত ওই তিনটি কোম্পানি হচ্ছে maxima middle east trading, Morgan additives manufacturing এবং pangatie international। এখানে আরও বলা যায়, আসাদের ওই দুই ভাইয়ের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, যা সিরিয়ার অর্থনীতির প্রায় ৬০ ভাগ। তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে জ্বালানি ও টেলিকম খাতে। সিরীয় সংকট শুরু হলে এরা তাদের সম্পদ সিসিলিতে সরিয়ে নেন এবং সেখান থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এখন প্রশ্ন এখানেই- অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা সত্ত্বেও কীভাবে আসাদ সরকার টিকে থাকে, কারা তাকে অর্থ ও জ্বালানি দিয়ে সাহায্য করেÑ এটা কি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ জানত না। নিশ্চয়ই জানত। তাহলে? সিআইএ চেয়েছে আসাদ সরকার টিকে থাকুক! তবে মোসাক ফনসেকার ডকুমেন্টে যাদের নাম আছে, তারা কর ফাঁকির ও অর্থপাচারে কিংবা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ায় কতটুকু জড়িত, সেটা নিয়ে তদন্ত হতে পারে। কিন্তু তথ্য গোপন নিশ্চিত করতে না পারার দায়-দায়িত্ব ফনসেকা এড়াতে পারে না। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক ভ্যালেনটিন কাতসোনভ (Valentin Katsonov) ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল লিখেছিলেন (operation offshore leak, ablal research) মোসাক ফনসেকার কাছে এ ধরনের তথ্য আছে। এমনকি এখন জানাও গেছে, জার্মান পত্রিকাটি এক বছর আগেই ওই তথ্যগুলো পেয়েছিল। তাহলে প্রশ্ন এসে যায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যখন বলা হয় যে ফনসেকার কাছে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নথি আছে, তাহলে সংস্থাটি এসব নথির নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক হলো না কেন? পৃথিবীর প্রায় ২০টি দেশে মোসাক ফনসেকার অফিস আছে। ফনসেকা এসব অফিসের মাধ্যমে অর্থপাচারে সহায়তা করেছে। অর্থাৎ এই অর্থ দিয়ে বিশ্বে যে অসমতা এবং গরিব দেশগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য, তা আমরা দূর করতে পারতাম। গরিব দেশের লোকগুলো তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে পারত। আফ্রিকায় এইডস, ইবোলা আর অতি সম্প্রতি লাতিন আমেরিকায় জিকা রোগের যে প্রাদুর্ভাব, তা আমরা নির্মূল করতে পারতাম। এসব সংক্রামক রোগের জন্য যে গবেষণা প্রয়োজন এবং তার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, তা আমরা রোধ করতে পারতাম। বিশ্বকে আরও রোগমুক্ত করতে পারতাম। গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করতে পারতাম। আফ্রিকার দেশগুলোর দরিদ্রতা দূর করতে পারতাম। একটি সমতাময় বিশ্ব আমরা পেতে পারতাম। ক্ষমতাসীনরা, ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীরা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ পাচার করে দিয়েছেন ওইসব ‘অফশোর দীপপুঞ্জে’ প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। তারা কর ফাঁকি দিয়েছেন। অর্থ পাচার করেছেন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তাদের আইনের আশ্রয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এসব অর্থ স্ব স্ব দেশে ব্যবহৃত হলে সেসব দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাটাই বদলে যেত। পানামা পেপারস ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিশ্চয়ই এখন আরও সতর্ক হবে। এ ব্যাপারে বিদ্যমান আইনে সংস্কার প্রয়োজন। ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার। এটি কতটুকু সহজ হবে, আদৌ সহজ হবে কিনা বলতে পারছি না। তবে একটা প্রশ্ন তো রেখেই গেল। অর্থপাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফের উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে বড়।
Daily Amader Somoy
17.04.16

বাংলাদেশে আইএস বিতর্ক

বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আইএসের মুখপত্র ‘দাবিগ’-এর ১৪তম সংখ্যায় জনৈক শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফের একটি সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছে, আইএস বাংলাদেশে ঘাঁটি করতে চায়, যাতে করে এখান থেকে ভারত ও মিয়ানমারে আক্রমণ পরিচালনা করা সম্ভব হয়। এই ইব্রাহিমকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে আইএসের বাংলাদেশ প্রধান হিসেবে। বিবিসি বাংলা ১৩ এপ্রিল এ সংবাদটি পরিবেশন করে, যা কোনো কোনো অনলাইন সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি আবারও বলেছেন, বাংলাদেশে আইএসের কোনো ঘাঁটি নেই। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আমাদের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি ভারতীয় পত্রিকা দি হিন্দুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশীকে ওসামা বিন লাদেন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা দেশে ফিরে এসেছে এবং তখন থেকে জনমনে হুমকির অনুভূতি প্রবল’ (দি হিন্দু, ১৫.০৪.১৬)। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই; সেখানে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশীয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের যোগাযোগ রয়েছে! তবে ‘দাবিগে’ যার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে, তিনি কে বা তার পরিচিতি কী, এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানা না গেলেও এভাবে ‘দাবিগ’ যখন সরাসরি কোনো ব্যক্তিকে আইএসের প্রধান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না।

এটা সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে আইএস তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ায় যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়, তাতে আইএস জড়িত বলে দাবি করেছে। আইএস তার ‘দূরবর্তী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল বলে তাদের মুখপত্র ‘দাবিগে’ উল্লেখ করা হয়েছিল। এজন্য সিরিয়া ও ইরাকে যেসব ইন্দোনেশীয় যুবক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের দিয়ে তারা ‘কাতিবা নুসানতারা’ নামে একটি ব্রিগেড গঠনও করেছিল। ওই ব্রিগেডই জাকার্তায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছিল। আইএস পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে নতুন একটি রাজ্যের ঘোষণা দিয়েছে। তারা এর নামকরণ করেছে খোরাসান। এ খোরাসান রাজ্যের একজন আমীরের নামও তারা প্রকাশ করেছে। তার নাম আমীর শায়খ হাফিজ সাইদ খান। ‘দাবিগে’র ১৩তম সংখ্যায় তার একটি সাক্ষাৎকারও প্রচার করা হয়েছে। ‘দাবিগে’ বলা হয়েছে, মধ্য এশিয়ার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল খোরাসান। মধ্যযুগে যেমনটা ছিল, তেমন করে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, ভারত ও চীনের একটা অংশকে খোরাসানের অন্তর্ভুক্ত করে এ অঞ্চল দখলে নিতে চায় আইএস।

আইএস আফ্রিকার দিকেও তাদের প্রভাব সম্প্রসারিত করেছে। সচেতন পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, গত ৭ মার্চ নাইজেরিয়ার সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বোকো হারাম আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। বোকো হারাম ইতিমধ্যে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উত্তর নাইজেরিয়া থেকে শুরু করে সীমান্তবর্তী নাইজার, শাদ, ক্যামেরুন ও মালিতে সম্প্রসারিত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলের দরিদ্রতা, অসমতা বোকো হারামের উত্থানের পেছনে দায়ী। অতি সম্প্রতি ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তা ইউরোপে তাদের তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই চালানো হয়। ইউরোপে যে ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠিত হবে, তাকে তারা বলছে ‘আমিরাত অব আন্দালুসিয়া’। লিবিয়ার উপকূলীয় শহর দারনাকে আইএসের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আইএসের টার্গেট মাগরেব অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া। তবে একটা প্রশ্ন আছে। তা হচ্ছে, আইএসের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক কী হবে? কারণ মধ্যপ্রাচ্যের তথা উপসাগরীয় অঞ্চলে আল কায়দার একটা বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং তারা সক্রিয়। বলা ভালো, আল কায়দার তাত্ত্বিক হচ্ছেন আবু মুসাব আল সুরি। সুরি আল কায়দার স্ট্র্যাটেজির কথা বলতে গিয়ে ‘Spider Web’-এর কথা বলেছেন। অর্থাৎ মাকড়সা যেমন এখানে সেখানে জাল তৈরি করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে এবং সেই জাল ভেঙে দিলে অন্যত্র গিয়ে ঠিক একইভাবে জাল তৈরি করে, আল কায়দার স্ট্র্যাটেজিও ঠিক তেমনি। ছোট ছোট গ্রুপে অঞ্চল ভিত্তিতে তারা সংগঠিত হয় এবং তাদের ওপর আক্রমণ হলে তারা অন্যত্র গিয়ে সংগঠিত হয়। Al-Qaeda in Arabian Peninsula, Al-Qaeda in Islamic Maghreb, Al-Qaeda in Iraq এভাবেই সংগঠিত। এর বাইরে তারা ভিন্ন নামেও অপারেট করে। যেমন আল নুসরা ফ্রন্ট (সিরিয়া), আল-গামা আল ইসলামিয়া। এ দুটি সংগঠনের সঙ্গে আদর্শগতভাবে আল কায়দার মিল আছে। এখানে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে তাদের অমিলের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আল কায়দার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের আদর্শগতভাবে অমিল রয়েছে। আল কায়দা যেখানে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামিক শাসন চায়, সেখানে ইসলামিক স্টেট চায় একটি ইসলামিক খেলাফত। অর্থাৎ একটি খেলাফত রাষ্ট্রের আওতায় সব মুসলিম রাষ্ট্র একত্রিত হবে। সেখানে একজন খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন। আল কায়দার সঙ্গে পার্থক্য এখানেই যে, আল কায়দা খেলাফতের পরিবর্তে ইসলামিক আমিরাতে বিশ্বাসী।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপমহাদেশে আল কায়দা কি আদৌ স্থান করে নিতে পেরেছে? ভারতে এর কোনো স্থান নেই। পাকিস্তানে তালেবানদের প্রভাব বেশি, আল কায়দা তার শাখা স্থাপন করতে পেরেছে, এমন খবর আমাদের জানা আছে। তবে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকতে পারে। আর বাংলাদেশে তাদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে যারা পরিচিত তাদের সঙ্গে আল কায়দার যোগাযোগ আছে, এমন কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণও আমাদের কাছে নেই। ফলে বাংলাদেশে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে এটা বলা যাবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশকে বারবার টার্গেট করা হয়েছে। অতি সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সংঘটিত হওয়া বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকে জড়িত করে SITE-এ যে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে, তাতে এই প্রচারণা বাড়ছে। এখন তথ্যমন্ত্রী নিজে স্বীকার করলেন, বাংলাদেশে আল কায়দার জঙ্গি রয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এসব জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে প্রথমে বলেছিলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। এটাই হচ্ছে আসল কথা। বাংলাদেশে ইসলামের নামে যারা উগ্রবাদ প্রচার করছে, তারা বিভ্রান্ত। আল কায়দা কিংবা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের মেলানো যাবে না। তবে এটা সত্য, কোনো কোনো মন্ত্রী, সরকারের সমর্থক বুদ্ধিজীবী যখন মিডিয়ায়, টিভির টকশোতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন, তখন তা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিভ্রান্তি তৈরি করে।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান। এখানে উগ্রপন্থী ইসলামিক দল আছে। ফলে বাংলাদেশ যে কোনো কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ একটি মডারেট ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দেশ। এখানে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। উগ্রবাদকে মানুষ পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের মাঝে এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই। তাই জঙ্গিবাদকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল। মনে রাখতে হবে, দলের সিনিয়র নেতারা, মন্ত্রীরা জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বললে তাতে সমর্থকরা প্রভাবিত হন। তাই তাদের সংযত কথাবার্তা বলা উচিত। জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমরা কেন, কোনো দেশই এ সমস্যার বাইরে নয়। এ সমস্যার সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো ব্লেমগেম কাম্য নয়। বরং সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে তৃতীয় পক্ষ এ থেকে ফায়দা তুলবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে তাই এ মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সমঝোতার। বেশ কিছুদিন আগে ঢাকায় দেয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্য আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছিলেন, ‘আইএসের উগ্রবাদ দমনে যৌথ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ।’ এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বার্নিকাট আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও তথাকথিত ‘সন্ত্রাস দমনে’ বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে গেল ফেব্র“য়ারিতে (২০১৬) একুশের বইমেলায় আমার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই সাময়িকভাবে নিজেদের জড়িত করেছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন তো হয়ইনি, বরং সন্ত্রাসের মাত্রা বেড়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জিইয়ে রেখে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। পাঠক আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে পারেন। আমার আতংকটা সেখানেই- আইএসের উগ্রবাদ দমনে বার্নিকাট যৌথ উদ্যোগের কথা বলে কোনো ইঙ্গিত করেছিলেন কি-না?

একাধিক কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একদিকে চীনের উত্থান, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া মৈত্রী যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। ভারত মহাসাগর ক্রমেই মার্কিন সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের কর্মকাণ্ড এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরে। অনেকেই মনে করতে পারেন, ২০১২ সালের ২ মার্চ মার্কিন সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশও এর আওতার মধ্যে রয়েছে) তৎকালীন কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এ নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশে কম বিতর্ক হয়নি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ বেশ ক’টি চুক্তিতে আবদ্ধ (যেমন, অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি ২০১৩, টিকফা চুক্তি ইত্যাদি), যেখানে সন্ত্রাস দমনে যৌথ কর্মসূচি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে SOFA (Status of Forces Agreement) চুক্তি ও আকসা (Acquisition and Cross Servicing Agreement) চুক্তি নামে দুটি চুক্তি করতে চাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সামরিক উপস্থিতি, জ্বালানি গ্রহণ, ‘পোর্স্ট অব কল’ সুবিধা দেয়া হবে। বাংলাদেশ এখন অব্দি এ ব্যাপারে সম্মতি না দিলেও চাপে আছে। ফলে SITE-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্ব আবিষ্কার এবং বার্নিকাটের যৌথ উদ্যোগের কথা বলার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি-না, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। এটা সত্য, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য যেখানে বেশি, সেখানেই ইসলামের নামে উগ্রবাদ জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, এমনকি দক্ষিণ থাইল্যান্ডের নারাথিওয়াত, পাট্টানি, ইয়ালা ইত্যাদি অঞ্চলে (যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করছে। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম কিংবা সোমালিয়ায় আল সাবাব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর খবর আমরা জানি। সেখানে ‘সন্ত্রাস দমনে’ মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এখানে পাঠকদের কিছু তথ্য দিতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকায় তাদের প্রথম সেনা কমান্ড AFRICOM (US-African Command) প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে আফ্রিকার ২৮টি দেশে ১৩০০ মার্কিন সৈন্য Counter Terrorism কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ২০০৫ সাল থেকেই বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে FINTLOCK বা US Training Exercise নামে মার্কিন সেনারা তৎপর। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ক্যামেরুনে ৩০০ সেনা পাঠিয়েছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার দৃষ্টি আফ্রিকাতে সম্প্রসারিত করছে। আফ্রিকার ইউরেনিয়াম ও তেল সম্পদের দিকে এখন তাদের দৃষ্টি। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি সম্প্রসারিত হচ্ছে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোর দিকেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের ৬টি যুদ্ধজাহাজ ২০২০ সালের মধ্যে ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। আর ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বৃহৎ শক্তির কাছে। একদিকে চীন তার সিল্ক রুটকে নতুন করে সাজাচ্ছে, যেখানে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এর একটি অংশ। ভারতও এগিয়ে এসেছে তার প্রাচীন কটন রুট নিয়ে। ভারত ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’ভুক্ত দেশগুলোকে তার নেতৃত্বের আওতায় আনছে। এ নিয়ে চীনের উদ্যোগ আছে। ফলে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়বে, আর তাকে কেন্দ্র করে বাড়বে মার্কিনি তৎপরতা!

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবারও বলেছেন, বাংলাদেশে আইএসের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। তবে আল কায়দা আছে, তথ্যমন্ত্রীর এ ধরনের স্বীকারোক্তি বিভ্রান্তি বাড়াবে। আইএস নেই এটা বিবেচনায় নিয়েই যা বলা যায় তা হচ্ছে, দাবিগ যখন শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামে তথাকথিত আইএস নেতার সাক্ষাৎকার প্রচার করে, তখন এটাকে হালকাভাবে দেখা উচিত নয়। এটা তো সত্য, এখানে কিছু জঙ্গি গোষ্ঠী রয়েছে, যারা চেষ্টা করছে আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে। এখানে অসমতা বাড়ছে। প্রত্যক্ষ অঞ্চলে জঙ্গিরা তাদের তৎপরতা বাড়াচ্ছে। সেখানে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা সীমিত। তাই ‘সম্ভাব্য আইএসে’র উত্থান ঠেকাতে (?) রাষ্ট্রের সব গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল সৃষ্টি করতে হবে। আইএস নিয়ে কোনো বিতর্ক হোক, এটা আমরা চাই না। Daily Jugantor 17.04.16