পশ্চিমবঙ্গের
বিধানসভার নির্বাচন সামনে রেখে আবারো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রশ্নটি
চলে এসেছে। ৪ তারিখ পশ্চিমবঙ্গের (একই সঙ্গে আসামেরও) বিধা সভার ২৯৪ আসনের
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ দুই রাজ্যে একাধিক জনসভায় বক্তৃতা করেছেন ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ও বিজেপি
সভাপতি অমিত শাহ। এরা তিনজনই একই সুরে অনেকটা 'বাংলাদেশবিরোধী' কথাবার্তা
বলেছেন। মোদি নিজে বলেছেন বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী আসছে এবং এদের
বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে! পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি
হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশবিরোধী একটা জনমত সৃষ্টি করার বিজেপির কৌশল
অনেক পুরনো। যদিও মমতা ব্যানার্জি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে তাই ওই নির্বাচনের গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় মমতা
ব্যানার্জি কথা দিয়েছিলেন তার ওপর আস্থা রাখতে। আমরা চাই তিস্তার
পানিবণ্টনের ব্যাপারে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করবেন। এটা আমাদের জীবন-মরণ
সমস্যা। মোদির সঙ্গে মমতা ব্যানার্জি ঢাকায় এলেও, মমতা তখন কোনো চুক্তিতে
রাজি হননি। কেননা এটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের একটি রাজনৈতিক ইস্যু। তিস্তার
পানিবণ্টনকে ইস্যু করে তিনি উত্তরবঙ্গে তার জনপ্রিয়তা বাড়াতে চেয়েছিলেন।
তখন যদি চুক্তি হতো এবং তাতে যদি বাংলাদেশের শতকরা ৫০ ভাগের ওপর
পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত হতো, তাতে তার ভোট কাটত। তিনি জনপ্রিয়তা হারাতেন। এখন
এই এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন শেষ হবে তাই ঝুঁকি তিনি নেননি
ভোটের স্বার্থে। একটি 'সমঝোতায়' তিনি তখন রাজি হতে পারেন। তবে তা
পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়। ঢাকায় এসে তিনি সেই পুরনো কথাই
বলেছিলেন। তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিস্তার পানিবণ্টনের
ব্যাপারে তিনি একবার একটি ফর্মুলা দিয়েছিলেন_ শতকরা ৭৫ ভাগ পানি
পশ্চিমবঙ্গের জন্য রেখে বাকি পানি বাংলাদেশকে দেয়া। এ ফর্মুলায় বাংলাদেশ
রাজি হয়নি তখন। কেননা এতে আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। তৃতীয়ত, মমতা
ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে আহ্বায়ক করে একটি
কমিশন গঠন করেছিলেন। তাদের দায়িত্ব ছিল তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে একটি
সুপারিশ করা। রুদ্র কমিশন তার সুপারিশে যা উল্লেখ করেছিলেন তার আংশিক
পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে তিনি অভিমত দিয়েছিলেন যে,
পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা মিটিয়েও বাংলাদেশে তিস্তার ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব।
তিনি এও মত দিয়েছিলেন যে, 'ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি' ব্যবহার করে তিস্তার
পানি মজুদ করা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণবকুমারও তার সঙ্গে
একমত হয়েছিলেন। কিন্তু যতদূর জানা যায় মমতা ব্যানার্জি রুদ্র কমিশনের
মতামতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিলেন না। যে কারণে রুদ্র কমিশনের রিপোর্টটি
তিনি প্রকাশ করেননি। আজ তিনি সেই রুদ্র কমিশনের ফর্মুলায় পানি ভাগাভাগিতে
রাজি হবেন, তা মনে হয় না। চতুর্থত, তাহলে তিনি কি নরেন্দ্র মোদির প্রস্তাবে
রাজি হয়ে এখন নির্বাচনের পর একটি চুক্তি করবেন? অতীতে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে
তার ঢাকায় আসা চূড়ান্ত হলেও শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেছিলেন। পরে এসেছিলেন
মোদির সঙ্গে। কিন্তু কোনো চুক্তিতে সম্মত হননি। নির্বাচনের পর তিনি কী
সিদ্ধান্ত নেন, তা দেখার বিষয়। এখানে অনেক সম্ভাবনা আছে। একটি প্যাকেজ
ডিলের আওতায় তিনি স্থলসীমান্ত চুক্তি সমর্থন করেছিলেন। রাজ্যসভায় তৃণমূল
সমর্থন না করলে বিলটি পাস হতো না। কেন্দ্র থেকে তার আর্থিক সাহায্য ও
সহযোগিতা দরকার। নরেন্দ্র মোদি ওই আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টিকে তার স্বার্থে
ব্যবহার করেছেন। মমতা ঢাকায় আসার ব্যাপারেও সেই মানসিকতা কাজ করেছিল।
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল কানেকটিভিটির প্রশ্নটি।
তিনি ভারতের এক অঞ্চলকে অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ_ এ তিনটি রাজ্য এ
প্রক্রিয়ায় জড়িত। মোদি এজন্যই চেয়েছিলেন ওই তিন রাজ্যের তিন মুখ্যমন্ত্রী
ঢাকায় যাবেন। তাই মমতা এসেছিলেন। তিস্তা এখানে প্রাধান্য ছিল না। অনেক
পরিকল্পনা মমতা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না যদি না কেন্দ্র আর্থিকভাবে তাকে
সাহায্য করে। তখন সামনে নির্বাচন ছিল। মমতা তাই ঝুঁকিটি নিতে চাননি।
পঞ্চমত, কেন্দ্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইর একটি চাপ ছিল মমতার ওপর। সারদা
কেলেঙ্কারি, তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ওপর সিবিআই তার নজরদারি
বাড়িয়েছে। ফলে এ 'চাপ'কে অনেকটা নিউট্রাল করতে তিনি মোদির সঙ্গে ঢাকায় আসতে
রাজি হয়েছিলেন, কোনো চুক্তি করতে নয়। ষষ্ঠত, মমতা ব্যানার্জি পুনরায়
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএতে যোগ দিতে পারেন। একসময় তিনি এ জোটে ছিলেন।
কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী ছিলেন। আবার বেরিয়েও এসেছেন। এখন যদি পশ্চিমবঙ্গে তার
বিজয় নিশ্চিত হয় ও সব কেলেঙ্কারি থেকে 'মুক্ত' হতে তিনি যদি আবারো এনডিএতে
ফিরে যান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সপ্তমত, যতদূর জানা যায় তিনি সাবেক
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসেননি একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে
মমতাকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন
চুক্তি করতে চাচ্ছিল, যা মমতার মনঃপূত হয়নি। ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারের
কিছুটা অধিকার স্বীকৃত। রাজ্য সরকারকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র এককভাবে কোনো
চুক্তি করতে পারে না। ঢাকা সফরের আগে মোদি তাকে কথা দিয়েছিলেন তিনি ঢাকায়
তিস্তার ব্যাপারে কোনো চুক্তি করবেন না এবং তিস্তার ব্যাপারে ঢাকার সঙ্গে
কোনো কথা হবে না। যদি কথা বলতেই হয়, এ ব্যাপারে মমতাই কথা বলবেন
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচনের পরপরই আমাদের উচিত হবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তিস্তার পানিবণ্টনের প্রশ্নটি উত্থাপন করা। আমাদের দাবি ভারত সরকারের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে নয়। আমরা শুধু স্মরণ করিয়ে দেব মমতা ব্যানার্জি আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। আস্থা রাখতে বলেছিলেন। সামনে শুষ্ক মৌসুম আসছে। সুতরাং তিস্তার পানিবণ্টনের প্রশ্নে এখনই আলোচনা শুরু করা জরুরি। সেই সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের যে ঘোষণা দিয়েছেন, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশ থেকে কোনো অভিবাসী ভারতে যায় না। যারা পশ্চিমবঙ্গে কিংবা আসামে বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তারা সবাই ভারতের নাগরিক। তুাদের সবার নাগরিকত্বের সনদপত্র আছে। রেশনকার্ড আছে। তারা সবাই ভারতের নাগরিক। তাদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা কোনো বন্ধুসুলভ আচরণ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পেঁৗছেছে। দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। ভারতকে আমরা ট্রানজিট দিয়েছি। ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি। নতুন একটি উপ আঞ্চলিক সহযোগিতার (বিবিআইএম) প্রস্তাব করা হয়েছে।
ধারণা করছি, আগামী এক দশকে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতি ও অর্থনীতি পরিপূর্ণভাবে বদলে যাবে। বাংলাদেশ এ থেকে উপকৃত হবে। কিন্তু সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের ঘোষণা করা, অবৈধ অভিবাসীদের কথা বলে বাংলাদেশকে কটাক্ষ করা ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলে না। আমরা ধারণা করছি এ সবই নির্বাচনী কথা। ভোট কাটতে রাজনীতিবিদরা এ ধরনের কথা বলে থাকেন। আমরা খুশি হতাম যদি মমতা ব্যানার্জি এসব বক্তব্যের প্রতিবাদ করতেন। তিনি তা করেননি। এখন মমতা যদি বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় থেকে যান, আমাদের প্রত্যাশা একটাই তিনি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন এবং একটি চুক্তিতে উপনীত হতে কেন্দ্রকে রাজি করাবেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা এটাই।Daily Jai Jai Din04.04.16
0 comments:
Post a Comment